'হিটলার' একটি জীবনীগ্রন্থ জাতীয় রচনা। সৈয়দ মুজতবা আলী এখানে হিটলারের পূর্ণাঙ্গ জীবনের কথা বলেননি, তবে ওই নাৎসী নেতার জীবন ও কর্মের সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কতগুলো প্রবন্ধের মাধ্যমে অতিশয় জীবন্ত করে পরিবেশন করেছেন। হিটলার গ্রন্থটি পাঠকালে একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। লেখক যে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন, একজন একনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী গবেষকদের মত এক তথ্যের সঙ্গে অনেক তথ্যের তুলনা করে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছেন। হিটলারকে নিয়ে তাঁর এই প্রবন্ধগুলোর জন্য তিনি যেমন ওই নাৎসী নেতার রাজনৈতিক জীবন, তার সমরাভিযান, তার ইহুদীনিধনযজ্ঞ প্রভৃতির কথা বলেছেন তেমনি তার অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত জীবন ও তার প্রেম নিয়েও আকর্ষণীয় আলোচনা করেছেন। এজন্য মুজতবা আলীর পড়াশোনার গভীরতা ও ব্যাপকতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। তিনি উত্তম জার্মান ভাষা জানতেন, তাই সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি মূলপাঠের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। (ফ্ল্যাপ)
Syed Mujtaba Ali (Bengali: সৈয়দ মুজতবা আলী) was a Bengali author, academician, scholar and linguist.
Syed Mujtaba Ali was born in Karimganj district (in present-day Assam, India). In 1919, he was inspired by Rabindranath Tagore and started writing to the poet. In 1921, Mujtaba joined the Indian freedom struggle and left his school in Sylhet. He went to Visva-Bharati University in Santiniketan and graduated in 1926. He was among the first graduates of the university. Later, he moved to Kabul to work in the education department (1927–1929). From 1929 to 1932 he studied at the universities in Berlin, London, Paris and Bonn. He earned Ph.D. degree from University of Bonn with a dissertation on comparative religious studies in Khojas in 1932. In 1934-1935 he studied at the Al-Azhar University in Cairo. Subsequently, he taught at colleges in Baroda (1936–1944) and Bogra (1949). After a brief stint at Calcutta University (1950), Mujtaba Ali became Secretary of the Indian Council for Cultural Relations and editor of its Arabic journal Thaqafatul Hind. From 1952 to 1956 he worked for All India Radio at New Delhi, Cuttack and Patna. He then joined the faculty of Visva-Bharati University (1956–1964).
সৈয়দ মুজতবা আলী হিটলারকে নিয়ে লেখার কেন কাবিলিয়ৎ রাখেন, তার একটা ফিরিস্তি দিয়েছেন। যেমন: হিটলারের উত্থানের ঠিক আগে তিনি জার্মানিতে ছিলেন। হিটলারের চ্যান্সেলর হওয়ার পরপরই আবার গিয়েছিলেন। হিটলারের প্রভুত্ব যখন মধ্যগগনে তখনে জার্মান ভ্রমণ করেন এবং বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসপ্রায় জার্মানিকে দেখতে ডয়েচল্যান্ডে যান সৈয়দ মুজতবা আলী। একইসঙ্গে জার্মান ভাষায় বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তার আগ্রহ নিয়মিত। সবমিলিয়ে, হিটলার ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নিয়ে লেখার জন্য সৈয়দ মুজতবা আলী একজন কাবিল আদমি।
হিটলারের জীবন ও রণকৌশলের তুলনামূলক অনালোকিত দিকগুলো নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে লিখেছেন সৈয়দ সাহেব। নাৎসিনেতার সত্যিকারের প্রথম প্রণয়ের কেচ্ছা পাঠককে নতুনত্বের খোরাক দেবে।
হিটলার নিয়ে আগ্রহী যে কোনো পাঠকের ভালো লাগবে সৈয়দ মুজতবা আলীর এই বই।
সৈয়দ মুজতবা আলী কাঁচা বাজারের জন্য তরি-তরকারির লিস্ট লিখলে সেটাও সুখপাঠ্য হবে- আমি নিশ্চিত৷ আর এটা তো হিটলারের মতো (অ)মানুষকে নিয়ে লেখা৷ আন্দাজ করে নিন কেমন হতে পারে৷
Mein Kampf আমি গত ১১ মাস ধরে পড়ার 'চেষ্টা' করছি । মুজতবা আলী'র লেখাতেই পড়েছিলাম বইটা এমনই খটোমটো জার্মানে লেখা এবং তার ইংরেজি অনুবাদটাও এতখানি প্যারাদায়ক আমি এযাবৎ একপলকের জন্য বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে সাথে সাথে চোখ নামিয়েও মনে রাখতে পারি না কোন লাইন টা পড়ছিলাম :3 -_- আর সেই বই একটানা পড়া আমার পক্ষে তো সম্ভব হয়ই নাই ( ইচ্ছা আছে এবছর শেষ হবে ~ )
মুজতবা আলীর উপর রাগ হয়ে এই বইটা একবার পড়িনি । তিনি হিটলার কে নিয়ে পর্যাপ্ত স্টাডি করে বইটা অনেক গুছিয়ে চমৎকার ভাবে লিখেছেন । আমার মতে বইটার প্রাধান্য হল চিরাচরিত হিটলারের বর্বরতা নিয়ে না মেতে লেখক হিটলারের জীবনে প্রেম , জীবনের শেষ ক'দিনে আত্মহত্যাকালীন সময় টা আর মার্কিন রুশ রাজনীতি নিয়ে হিটলারের ভবিষ্যৎবাণীর যে সঠিকতা সেগুলোকে দারুণভাবে সিগনিফাই করেছেন ।
এটা হিটলারের কোনো জীবনী গ্রন্থ নয়। হিটলারের জীবনের শেষ ১০ দিনে তার মনোজগতে কি টানাপোড়েন চলছিল তাই বই বন্ধি করেছিলেন লেখক। আত্ম-অহমিকা ও মানুষের উপর নিপীড়ন করে যে মিথ্যার প্রাসাদ গড়েছিলেন তা ভাঙার সংবাদ একে একে চারদিক থেকে আসতে থাকে , হিটলার হতাশ না হয়ে শেষ সব কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। শেষ দিকে হিটলার বুঝতে পারে আর কিছুই করার নেই, সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহননের। সে বিভিন্ন দায়িত্ব বন্টন করে এফা ব্রাউন সহ আত্মহত্যা করে। পালানো কিংবা লাশ কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অত বোকা সে নয়। শেষ দিকে তার সাথে গ্যোবেয়লসও একই সিদ্ধান্ত নেয়। সে নিজে গুরুকে অনুসরণ করলো ঠিক আছে কিন্তু তার নিষ্পাপ শিশুদেরও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মৃত্যুর পর রাশানরা তার লাশ (অবশিষ্টাংশ) জনসমক্ষে না এনে গোপনে লুকিয়ে রাখে এবং ঘৃণিত শাসককে ইতিহাসে হারানোর হাত থেকে রক্ষা করে।
আপনি জানেন কি আত্মহত্যার দুইদিন আগে বিয়ে করা ইভা ব্রাউন নয়, হিটলারের জীবনের একমাত্র ‘ গ্রেট লাভ' ছিল তার সৎবোনের মেয়ে গেলী? বা ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হিটলার আমিষ খেতেন না এবং আমিষভোজীদের শবাহারী বলে গালি দিতেন? বা জার্মানির আত্মসমর্পণের পর জাপানও আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায় কিন্তু আমেরিকা ‘ জনবহুল শহরের উপর অ্যাটম বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষা'র জন্য যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে? জানলে ভালো, আর না জানলে পড়তে হবে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘ হিটলার' বইটি যেখানে তিনি হিটলারের জীবনের নানা অজানা ও চমকপ্রদ অধ্যায়কে তুলে ধরেছেন।
জীবনীগ্রন্থ যে রকম হয় এই বইটা ঠিক তেমন কোনো বই না। বইটা মূলত লেখকের বিভিন্ন সময়ে লেখা হিটলার ও তার সাথে সম্পর্কিত কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের সংকলন। ফলে হিটলারের সমগ্র জীবন এখানে উঠে আসে নি বরং খন্ডিত চিত্র এসেছে। মূলত তার প্রেম এবং জীবনের শেষ দিকে রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ঘিরে রাখা বার্লিনের বাঙ্কারের জীবন প্রাধান্য পেয়েছে এখানে।
বইটার সবচেয়ে চমৎকার দিক হলো এখানে লেখক হিটলারের বেশ কিছু সহযোগী যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক বইয়ের আলোকে প্রবন্ধগুলো লিখেছেন। ফলে হিটলারের অন্দরমহলে ঢুকে হিটলারকে দেখার মতো একটা অনুভূতি হয়েছে বইটা পড়ার সময়। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে মারা মানুষটাও যে একসময়ে প্রেমিকার মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন সেসব জেনে অবাক-ই হতে হয়। প্রত্যেক নিষ্ঠুর মানুষই ভালো প্রেমিক – সেটাই আরেকবার প্রমাণিত হয় হিটলারের জীবন থেকে। সংগ্রামী আডেনবাওয়ারকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধটা মুগ্ধ করেছে ; বিশ্বযুদ্ধের পর একা হাতে বিধ্বস্ত জার্মানিকে গড়ে তোলার কারিগরের জীবনটা আকর্ষণীয়।
প্রটুর ফুটনোট ব্যবহার করেছেন লেখক ( যেগুলো অনেকসময় পড়ার গতি বাধাগ্রস্তও করেছে) ফলে ইতিহাস একটু কম জানলেও বইটার রসাস্বাদনে কোনো সমস্যা হয় নি। ভাষা নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে বইটা পড়ার সময়। দেশে বিদেশে, জলে ডাঙ্গায় বা শবনমে যে হিউমারে পরিপূর্ণ ভাষা পেয়েছিলাম এখানে সেটা পাই নি। একটা কারণ তো অবশ্যই এটা যে বাকিগুলো উপন্যাস হলেও এটা প্রবন্ধ। অবশ্য তবুও লেখক নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মজা করতে ছাড়েন নি।
জীবনের শেষ দশদিন শীর্ষক প্রবন্ধটা সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বেশ কিছুদিন আগে দেখা Downfall ( 2004) মুভিটা দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলাম, এই প্রবন্ধটা পড়েও হয়েছি। সবমিলিয়ে, চমৎকার একটা বই।
প্রথমেই বলে নেই, হিটলারের জীবনী নিয়ে এত সরস ও উপভোগ্য রচনা স্রেফ মুজতবা আলীর পক্ষেই লেখা সম্ভব। বইটা সাইজে বেশি বড় না, কিন্তু মুজতবা আলীর মত দক্ষ সাহিত্যিকের একটা এনসাইক্লোপিডিয়া লেখার দরকার পড়ে না। ছোট পরিসরেই তার হয়ে যায়। এরই মধ্যে তিনি হিটলার নামক এই ম্যাগালোম্যানিয়াকের ছবি খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেন। রেফারেন্স হিসেবে আরো কিছু বইয়ের উল্লেখ করে দিয়েছেন তিনি, আগ্রহীরা ওগুলোও উল্টেপাল্টে দেখতে পারেন।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি হিটলারের শেষ দিনগুলোর কথা পড়তে। হিটলার যেন কলে আটকা পড়া ইঁদুর, ছটফট করছেন! বই পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়ছিল “ডাওনফল” ছবির কথা। ওটাও হিটলারের শেষ দিনগুলো নিয়ে বানানো। “ডাওনফল”-এর সাথে এই বইটার একটা মিল আছে। দুইটাই মাস্টারপিস!
এই বইটা হিটলারের জীবনী বললে ভুল হবে। সাধারণত হিটলারকে নিয়ে আলোচনার বেলায় তার নৃশংসতাই আলোচনা হয়। কিন্তু এখানে তার প্রেম, লিঙে ও গ্যোবেলস পরিবারের সাথে ওনার বন্ধুত্ব নিয়ে খুব সুন্দর আলোচনা হয়েছে।
২০২১ সালটা ছিল এক অদ্ভুত সময়—বিশ্বজুড়ে অতিমারির ক্লান্তি, বিভ্রান্তি, আর মানুষের চরম হতাশার পরেও বেঁচে থাকার সেই অসামান্য প্রবণতা। সেই সময়েই হাতে এলো সৈয়দ মুজতবা আলীর 'হিটলার'—এক পাতলা অথচ ক্ষুরধার প্রবন্ধসঙ্কলন, যা যেন ইতিহাসের রক্তাক্ত ছায়ায় দাঁড়িয়ে পাঠককে হাসিয়ে চিন্তায় ফেলতে জানে।
এটি কোনো কেতাবি জীবনী নয়—এই বই ইতিহাসের মুখে ব্যঙ্গের কালি, আর রাজনীতির গালে চপেটাঘাত। আলীর লেখনীতে হিটলার যেন কেবল এক ভয়ংকর নেতা নয়, এক সাংস্কৃতিক সঙ্কট, এক চূড়ান্ত আত্মপ্রবঞ্চনার প্রতীক। হিটলারের জাতীয়তাবাদ, নাৎসি মতাদর্শ, যুদ্ধের বীজ—সবই উঠে এসেছে ব্যঙ্গের চাদরে মোড়ানো তীব্র বিশ্লেষণে।
এই বইয়ের আসল শক্তি মুজতবা আলীর স্বভাবসিদ্ধ রসবোধ। তিনি হিটলারকে কেবল একজন ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবেই দেখেননি, বরং সেইসব জনতাকেও প্রশ্ন করেছেন—যারা তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেছিল। তাঁর লেখনীতে হিটলার ভয়ংকর, কিন্তু পাঠকের চোখে ব্যঙ্গাত্মক করুণ রসের চরিত্রে পরিণত হন।
২০২১ সালে, যখন গোটা পৃথিবী আবার নতুন করে ‘নেতৃত্ব’-এর অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন এই বই পড়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা। হিটলারের গল্প শোনার চেয়ে, মুজতবা আলীর চোখ দিয়ে তা দেখা অনেক বেশি তীক্ষ্ণ, শিক্ষণীয় এবং আশঙ্কাজনকভাবে প্রাসঙ্গিক।
সংক্ষেপে, এই বই শুধু ইতিহাসের পাতা নয়, আমাদের সময়েরও এক সতর্কবার্তা—অন্ধ বিশ্বাস আর জাতীয়তাবাদের মোহ আজও ফিরতে পারে অন্য মুখোশে। আর সৈয়দ মুজতবা আলী? তিনি সেই সতর্ক বাঙালি, যিনি ব্যঙ্গের আগুনে ইতিহাসকে আলোকিত করতে জানেন।
হিটলার। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসা একটি নাম। এই লোকটাকে নিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছে ছিল। নানান কারণে হয়ে উঠেনি। জানার ইচ্ছে ছিল ঠিক কি চিন্তা ধারার মানুষ হলে এক বাক্যে কয়েক মিলিয়ন ইহুদীকে মেরে সাফ করে দিতে পারে। "মাইন ক্যাম্ফ" বইটা কয়েকবার হাতে নিয়েও দুয়েক পেইজ পড়ার পরে আর আগাতে পারিনি। যাই হোক, অবশেষে হিটলার সম্বন্ধে পড়া হলো এই বই থেকে।
বইটা আসলে হিটলারের কোনো জীবনী গ্রন্থ নয়। অন্তত আমার কাছে মনে হয়নি। বরং হিটলারের জীবনের কিছু প্রধান ভাগের উল্লেখ আছে বইয়ে। উল্লেখ আছে হিটলারের জীবনের প্রেম সম্পর্কে, তার জীবনের কিছু কিছু বাঁক সম্পর্কে এবং সবশেষে রয়েছে হিটলারের জীবনের শেষ দশদিনের বিশদ বর্ণনা। বইটি মূলত লেখকের বিভিন্ন সময়ে লেখা হিটলারসম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলোর একটি সংকলন বলা যায়। প্রথম দিকে যদিও বিভিন্ন ফুটনোটের জ্বালায় আমার পড়তে বেশ কষ্টই হয়েছে। তবে সময়ের সাথে সাথে ফুটনোটের আধিক্য কমেছে। প্রথম দিকের প্রবন্ধগুলোতে ভাষাটাও কিছুটা খটমট ঠেকেছে৷ যদিও শেষের দিকে লেখক সব পুষিয়ে দিয়েছেন। বইটায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা তৎকালীন রাজনীতিরও বিশদ বর্ননা নেই। তাই যারা তৎকালীন রাজনীতি বা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট পড়ার আশা নিয়ে পড়তে বসবেন, তাদের আশাভঙ্গ হবে। তবে "হিটলারের শেষ দশদিবস" প্রবন্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা টাইমলাইন পাওয়া যায়। এই শেষ প্রবন্ধটির জন্যই আমার কাছে বইটা ফাইভ স্টার পাওয়ার উপযোগী।
হিটলার কে, কী আমরা জানি। তার মতো মানুষকে নিয়ে এমন একটা অনুভূতিসম্পন্ন বই লেখা, বলা যেতে পারে, কোনো লেখকের ক্ষমতার একটা তুরীয় নিদর্শন। হিটলারের আঁধারে আলো ফেলে এগোনোর পথ পাওয়া যায় না। পথ লাশে রক্তক্লেদে ভরা। আলো পথিককে আরো বিপদে ঠেলে দিতে পারে। কারণ, আসতে পারে এমন মানসিক বিপর্যয়, যার সঙ্গে আগে কখনো পরিচয় ঘটেনি। হিটলারের এই নিকষ কালোয় পথ দেখায় কেবল কথার কালো কৌতুক। হয়ত এটা "বিষে বিষ ক্ষয়" সূত্র। একজন সৈয়দ মুজতবা আলী বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ। তিনি আগলে না রাখলে, হাত ধরে এগিয়ে না নিলে পথ হারাতাম। তখন বার্লিনের রাস্তায় আমারও শবদেহ থেকে অজানা সবুজ পতঙ্গ বেরিয়ে এসে বাতাস ঘন করে তুলত।
বাংলা ভাষায় হিটলারের মত একজনকে এত সুন্দর করে লেখা হয়েছে তা আমার জানা ছিলনা। সৈয়দ মুজতবা আলীর মত একজন লেখক হিটলারকে নিয়ে লিখবেন তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত। সবাই যখন বিষাক্ত গ্যাস চেম্বার আর ব্লীটস্ক্রীগ নিয়ে লিখেই এই লোকটাকে পশুরুপী মানুষ হিসেবে দেখাতে ব্যাস্ত তখন লেখক হিটলারের প্রেমিক দিকটিও যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা দেখিয়েছেন। বইটা ছোট পরিসরে হলেও অনেক তথ্যবহুল।
সৈয়দ মুজতবা আলী'র লিখা 'হিটলার' বইটি আদতে কোনো জীবনীগ্রন্থ নয়, বরং হিটলারের মতো এক ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বের শেষ সময়ের অন্তর্জগৎ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর একটি অসাধারণ সাহিত্যকর্ম।
শেষদিকটায় হিটলার ভুল-তথ্যের ঘোরাটোপে বন্দি হয়ে পড়েন। নিজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কর্মকীতারা পর্যন্ত নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। বিশেষ করে হিটলারের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও সহযোগী হাইনরিখ হিমলার, গোয়েবলস, হ্যারমান গোরিংদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য গোপনে তার অবর্তমানে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন।
হিটলার কখনই চাননি তার মৃতদেহ রুশ বাহিনীর হাতে পড়ে। এজন্য তিনি নির্দেশ দেন, আত্মাহত্যার পর তার মৃতদেহ যাতে পুড়িয়ে ফেলা হয়। পেট্রোল দিয়ে মানবদেহ পোড়ানা সহজ নয়, তারপও বাঙ্কারের গার্ডরা চেষ্টা করেছেন হিটলার এবং তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী এভা ব্রাউন এর মৃতদেহ পোড়াতে। বোমার আঘাতে বাগানে সৃষ্টি হওয়া একটি গর্তে চাপা দেয়া হয় তাদের দেহাবশেষ।
হিটলারের প্রতি আমার ঘৃণা দৃঢ়, প্রশ্নহীন—তাঁর আদর্শ, কর্মকাণ্ড, ও নিসংশতার প্রতিটি ছাপ আমি ঘৃণার চোখে দেখি। তবু সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় যখন দেখি এক শক্তিশালী একনায়ক ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছেন এক পরাজিত, একা, বিভ্রান্ত মানুষের রূপে—তখন মনে একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করে। এমনকি এক নিষ্ঠুর স্বৈরাচারীর জন্যেও। হয়তো এটাই সাহিত্যের সুন্দর শক্তি—ঘৃণার গভীরেও একটুখানি সহানুভূতির কান্না জমে থাকে।
মুজতবা আলীর অতি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ন্যারেটিভে শুরুর দিকে মন বসাতে কষ্ট হচ্ছিলো বেশ। উপটীকা, পাদটীকা, কপালটীকার ছড়াছড়িতে বারবার খেই হারিয়ে ফেললেও শেষের দিকে একদম ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো টেনে নিয়ে গেছে বইটা। পড়েই বোঝা যাচ্ছিলো সংকলনধর্মী লেখা, বইয়ের ফরমুলায় নয়। তাই জন্য পুনরাবৃত্তি আসছিলো বেশ। তাসত্ত্বেও মুজতবা আলীর বিমূর্ত চোখে হিটলারের বিশ্লেষণ বেশ ভালো লেগেছে।
অনেকে হিটলারের ব্যক্তিসত্তাকেও পাশবিক করে তোলার চেষ্টা করলেও যদ্দুর বুঝলাম, ব্যক্তি হিটলার অনেক নিয়মনিষ্ঠ এবং মানবিক৷ শিল্পের একনিষ্ঠ ভক্ত, সঙ্গীতপ্রেমী সেই একই হিটলারের হাত ধরে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অপরাধের পেছনে অভিপ্রায় কী তবে? দিস্তার পর দিস্তা এ-সম্পর্কে লেখা যায়। তবে সাদামাটা বিচারে হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদকেই দায়ী করা যেতে পারে। একইরকমের উগ্র জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর আনাচে কানাচে এখন ভালোই দ্রষ্টব্য। সামষ্টিক নৃশংসতা মুহূর্তের কোনো ঘটনা নয়। একটু একটু করে ধাপে ধাপে মানুষ ইতিহাসের নজিরবিহীন নৃশংসতা ঘটাতে সক্ষম, সে বারে বারেই।
এক বসায় শেষ করা ২০২১ এর প্রথম বইটা থেকে কী পেলাম?
যেই বিশ্বাস আর আইডিওলজি নিয়ে ১৯৩৩-১৯৪৫, এই বারোটি বছরে দুনিয়ার বুকে এক অমোচনীয় ইতিহাস রচনা করে গেলেন এডলফ হিটলার নামের মানুষটি, তার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে। কেন বিশাল এই যুদ্ধে বাঁধালেন, কেন ফরাসিদের হারানোর সাথেই একটু এগিয়ে গিয়ে ব্রিটিশদের ধরলেন না, রুশদের দিকেই হাত বাড়ানোর এত কী ঠেকা ছিল- সেসবের উত্তর রয়েছে হিটলারের নিজের বয়ানে। শত বছর আগে নেপোলিয়ন পারলেও হিটলার কেন মস্কো এসে হার মানলেন? নাতিদীর্ঘ পরিসরে সবের উত্তর আছে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাঙ্কারে বসে রুশ কামানের গোলার আওয়াজ শুনে হিটলারের মনের ভাবান্তর হয়েছিল কী? শেষ অধ্যায়গুলোকে Der Untergang ছবির ভাষাচিত্র বলেই মনে হবে। কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা, পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে অনুচরদের ভাবলেশহীন আচরণ ও পলায়ন সবই হয়ত আমাদের জানা। তবুও সৈয়দ মুজতবা আলীর সুবিখ্যাত কলমের জোরে সব যেন নতুনের মত প্রাণ পেয়েছে। পড়ে ফেলুন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা সুতরাং খুবই সহজপাঠ। হিটলারের পুরো বায়ো গ্রাফি না শুধু মারা যাবার আগের তার ফুয়েরার বাঙ্কারের শেষ কয়টা দিনের কাহিনী। খুবই ছোট বই , একবসায় পড়ে ফেলা যায়। এখন ডকুমেন্টারি দেখে এর চেয়ে বেশি জিনিস জানা সম্ভব কিন্তু মুজতবা আলীর সময়ের সাথে তুলনা করলে এই বই লেখার জন্য তার বেশ ভালো পড়াশোনা করতে হয়েছে । বাংলা ভাষায় সুন্দর সুন্দর শব্দচয়ন লক্ষণীয়।