M. R. Akhtar Mukul (in Bengali: এম. আর. আখতার মুকুল) was a Benaglee author and journalist from Bangladesh; earned fame for Chorompotro, a radio programme from Shwadhin Bangla Betar Kendra.
এই বইটা পড়ার আগে আমার ধারণা ছিলো,মুক্তিযুদ্ধটার মাঝে কোন কোন্দল ছিলো না। সবাই কাঁধে কাধঁ মিলিয়ে দেশটা স্বাধীন করে ফেলেছে। কিন্তু না! কট্টর মুজীবপন্থী আওয়ামীলীগ, তাজউদ্দীন আহমেদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার, ভাসানী, দেশবিরোধী বাম/ডানপন্থী কত যে বিভক্তি ছিলো!!?? বইটা পড়ে তাজউদ্দীন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যাবে। তিনি যে কত বাঁধা ডিঙিয়ে দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুজিবনগর সরকার, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের ভূমিকাসহ আরো কত কিছু জানা যাবে এই বই পড়ে! সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বই।
বর্তমানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলছে নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনা আর তর্ক-বিতর্ক যা ঘরে- বাইরে গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সব জায়গাতেই লক্ষণীয় । আবার অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানেই একটি বিশেষ দলের দালালি। প্রকৃত ইতিহাসটা জানার অধিকারতা তো দেশের মানুষের থাকা উচিৎ। যে মুসলিম বাঙালি “হাত মে বিড়ি মু মে পান লড়কে লেংগে পাকিস্তান” স্লোগান দিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতার লড়াই করেছিল তাদেরকেই কিছুদিন পরে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” আর “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে ভাষা ও দেশ স্বাধীন করতে হয়েছিল।
আমি বিজয় দেখেছি মূলত লেখকের আত্মজীবনীমূলক বই, যিনি কাছ থেকে দেখেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ,নিজে ছিলেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পরিচালক, দেখতে পেরেছিলেন মুজিবনগর অনেকটা ভেতর থেকে।বইটি যদিও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের উপর কিন্তু লেখক তুলে ধরেছেন আওয়ামীলীগের উত্থান, যুক্তফ্রন্টের উথান ও পতন, ৬২ এর ছাত্র আন্দোলন , ৬৬ এর ছয় দফা, আগরতলা মামলা, অসহযোগ আন্দোলন, বামপন্থী বিভিন্ন দলের উত্থান ও যুদ্ধে ভুমিকা। মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি সম্পর্কে তথ্যবহুল অন্যতম সেরা বই ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ভিতরে যে এত দল-উপদল ছিল তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি । ভেবেছিলাম সবাই দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে একসাথে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু তা তো হয় নি অনেক মুক্তিযোদ্ধা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই এমনকি হত্যাও করেছিল। মুজিব ছিল জেলে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ আর বাঘের মত পাকিস্তানিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন টাইগার কাদের সিদ্দিকী। এই দুজন লোকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল । আরও কিছু নতুন প্রশ্ন মাথাচাড়া দিল মনের ভিতর
১. আমেরিকা পাকিস্তানকে সাহায্য করা সত্তেও কেন বাঙালি শরণার্থী শিবিরে সব থেকে বেশি সাহায্য দিয়েছিল ? তারা কি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল না অন্য কিছু ?? ২. শেখ মুজিব ক্ষমা করে দিতে পারেন এই জন্য না উনার নির্দেশেই সিরাজ শিকদারকে হত্যা করা হয়েছিল ? ৩. দেশ ও আওয়ামীলীগের জন্য এত কিছু করার পরও কেন তাজউদ্দীন আহমেদকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল ? ৪. শেখ মুজিব ও মাওলানা ভাসানি কি অঘোষিত সমঝোতার মাধ্যমে রাজনীতি করেছিলেন ?
অনেক রয়েসয়ে সময় নিয়ে বইটা শেষ করলাম। এম আর আখতার মুকুলের এই বইটার নাম শোনেননি, এমন কেউ অন্তত নেই। না পড়লেও অন্তত "আমি বিজয় দেখেছি" এই বইটার নাম অনেকের জানা। বইটা পড়া শেষ করে অনেক অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। ১৯৭১ এর যুদ্ধে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের জানার অন্তরালে। মুজিবনগর সরকারের অবদান, ওয়্যার স্ট্রাটেজি, যুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের ভূমিকা, বালু হক্কাক লেনের জয়বাংলা অফিস। পাকিস্তানিদের প্রোপাগান্ডা, আন্তর্জাতিক মহল এই দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, পক্ষে কেমন অবস্থান নিয়েছিল, আর আছে চরমপত্র। এম আর আখতার মুকুল কেমন করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চরমপত্রের স্ক্রিপ্ট লিখে গিয়েছিলেন, তা যেন চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি। এই দেশের তো বটেই, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কাছেই এই চরমপত্রের বদৌলতে তিনি পেয়েছেন অকুণ্ঠ প্রশংসা। পাকিস্তানিরা যখন একের পর এক প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করেছে, তখন চরমপত্র যেন একাই বীর সেনানি হয় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলো এর বিরুদ্ধে। সেক্টর কমান্ডারদের সাহসী যুদ্ধের বর্ণনা যেমন আছে, আর আছে পাকিস্তানিরা কীভাবে একের পর যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ হয়ে জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিলো আমাদের। ইন্দিরা গান্ধী, জেনারেল মানেক শ-এর নামও এসেছে ঘটনার প্রয়োজনে অনেকবার। সবশেষে একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী কেন জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো? কেন সেদিন এম এ জি গণি ওসমানীকে দৃশ্যপটে দেখা যায়নি? লেখক নিজেও এই প্রশ্নটা বইতে কাহিনীর আবর্তে নানাবার করেছেন। যাকগে, বইটা অবশেষে শেষ করতে পারলাম। মুক্তিযুদ্ধের অনেক অনেক ঘটনা যেন চোখের সামনে দিয়ে ঘটে যাচ্ছিল। লেখকের সাথে আমিও যেন বিজয় দেখেছি...
"মুক্তিযুদ্ধ" শব্দটা আমার ইদানিং বেজায় অপছন্দের হয়ে উঠেছে। কেবল সামরিক শক্তিমত্তার ভিত্তিতেই যদি একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ তৈয়ার করা যেত, তবে রাষ্ট্রনেতাদের দরকার ছিলনা, সমরনেতারাই দিব্যি দেশ চালিয়ে নিত শখানেক বছর আগেকার মত। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের যে পরতে হয় হাজারটে মুখোশ! সে একই সাথে সমরনায়ক, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ, কৃষিবিদ ও আরও কত কী! তবে এ সবকটার মধ্যমণি বলে কিছু থাকলে, নিঃসন্দেহে সেটা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্তি। রাজনৈতিক সত্তাবিহীন রাষ্ট্র যত সমরশক্তিমানই হোকনা কেন, তা প্রাণহীন নিথর মহাবীর আলেক্সান্ডারের শবের চেয়ে খুব আলাদা কিছু নয়। "মুক্তিযুদ্ধ" না বলে "স্বাধীনতা সংগ্রাম" বলাটাই বোধয় শ্রেয়, কারণ এ যুগে যুগে, দেশে দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক কিংবা সামরিকভাবে হয়নি। স্বাধীনতাকামী জনগণের স্বাধীন হবার জন্যে বহুমাত্রিক যে সাধনা, সেটাই স্বাধীনতা সংগ্রাম, যার একটা ছোট অংশ হল মুক্তিযুদ্ধ।
আমাদের বাংলাদেশের জন্মলগ্নে আমরা সামরিক যুদ্ধ করেছি ঠিকই, তবে যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক পটভূমি অনেকটাই ধোঁয়াশার পুরু চাদরে মোড়া। মুজিবনগর সরকার কবে কোথায় কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল, এর বাইরে নবজাতক রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক কলকব্জা নিয়ে তথ্যের প্রচার হয় কমই। মুজিব-মোশতাক গণ্ডগোল দানা বাঁধল কী করে, যুদ্ধে ভাসানীর আর কমিউনিস্টদের আসল ভূমিকা কী ছিল, আওয়ামী লীগের এককভাবে যুদ্ধকালীন সরকার গঠন নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল আপত্তি করেনি কিনা এসব বেশ কিছু জিনিস নিয়ে মনে খচখচানি হত মাঝেমধ্যে। এ বইটায় এসব বেশ কিছু উত্তর পেলাম। যুদ্ধকালীন বেসামরিক লোকজনের দিনলিপি কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রের সম্যক চিত্র তুলে ধরা বই আছে ঢের, আর যুদ্ধপূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতির চিত্রও কমবেশি সর্বত্র আছে। কিন্ত যুদ্ধকালীন কিংবা যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশি অভ্যন��তরীণ রাজনীতির চিত্র এর আগে খুব বিশদ বিবরণে পাইনি কোথাও।
বারবার পড়বার মত বই কি? হ্যাঁ, হয়ত। এ জনরার লেখা আরও পড়লে বলতে পারব ঠিক এই বইটার বিষয়বস্তু কতটা স্বতন্ত্র। তবে অন্যদের রেকমেন্ড করব পড়ে দেখতে।
এই বইটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে আর অনুশোচনা করাবে আমরা অনেক সম্মানী মানুষদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। এই বইয়ের যে বিষয়টি খারাপ লেগেছে সেটা হলো লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের মধ্যে যে সমস্যাটা হয়েছিল সেটা জেনেও প্রকাশ করেননি। অথচ এই সমস্যার ফলেই দেশে তখন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। যেমন বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে ভীড় করেছিল পাচাটার দল। তাজউদ্দীন আহমেদ যেখানে একজন ভালো পরামর্শদাতাও ছিলেন।
আমি বিজয় দেখেছি' বইটি সম্পর্কে মোটা দাগে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে-
এক. বইটি মুক্তিযুদ্ধের ভিতর বাহিরকে নানাভাবে-নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
দুই. যুদ্ধের দিনগুলোতে মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যদের জীবনযাপন, লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট কতটা তীব্র, ভয়ঙ্কর ও অমানবিক ছিল তার রোমহর্ষক ও বেদনাবিধুর বাস্তবতাকে বিশ্বস্ত দলিলরূপে হাজির করেছে।
তিন. কিছু মিথ বা ট্যাবু যেমন ভেঙে দিয়েছে বা খণ্ডনের সুযোগ করে দিয়েছে ঠিক তেমনি কিছু মিথকে অমীমাংসিত অবস্থায়ই রেখে দিয়েছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যারা ওপারে (ভারতে) আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে পরিচালনা করেছেন, তারাও যে কি পরিমাণ কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপন করেছেন তা লেখকের ব্যক্তিক উদাহরণের পাশাপাশি নানাজনের সুবাদে পাঠক সম্মুখে হাজির হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা আমরা সবাই জানি। আবার এটাও জানি যে, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব ছিল, কিন্তু কেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। লেখকও এ বিষয়টার প্রতিও ইঙ্গিতপূর্বক কৌতূহল জারি রেখেছেন।
'আমি বিজয় দেখেছি' আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য একটি বই। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এরকম একটি বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদ মাত্রাছাড়া, অসহনীয় রকমের। কিছু অসঙ্গতিও অস্বস্তিকর। বইটির এ কারণে সুসম্পাদনা জরুরি।
'আমি বিজয় দেখেছি' বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ ঐতিহাসিক অনেক দলিল ও তথ্যাদি হাজির রয়েছে। এই কারণে এ ধরনের একটি বইয়ের ভুল তথ্য কিংবা মুদ্রণপ্রমাদ পাঠকদের জন্য যেমন বেদনা ও কষ্টের তেমনি ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুসমূহতে বিভ্রান্তির শঙ্কাও রয়ে যায়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের জন্য বইটির আশু সম্পাদনা ও পরিমার্জিত সংস্করণ জরুরি। উত্তর প্রজন্ম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে আগ্রহী। তাদের কাছে বিভ্রান্তিকর তথ্য যদি যায় তবে সেটা হবে অমোচনীয় লজ্জা ও বেদনার।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন স্মরিত হবেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি স্মরিত হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়সমূহ। যার ধারাবাহিকতায় হাজির হবে 'আমি বিজয় দেখেছি'র মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থরাজি। মুক্তিযুদ্ধকে জানতে-বুঝতে এবং গভীর অভিনিবেশে উপলব্ধি করতে এম আর আখতার মুকুলের আলোচ্য বই অমৃত সঞ্চারী জ্ঞানভাণ্ডার বিশেষ। একারণে এধরণের বইয়ের বহুল পঠন-পাঠন ও প্রচার-প্রচারণা অবশ্যম্ভাবী।
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায় হলেও, সেসব নিয়ে লেখালেখি প্রতুল নয়। আবার যতটুকু আছে তাও মানসম্পন্ন নয়। সেখানে যতোটা গল্প আছে নিজেকে এবং নিজেদেরকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা আছে ততোটুকু নেই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন প্রয়াস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সামরিক যুদ্ধ না জনযুদ্ধ, তা নিয়েও রয়েছে বিভাজিত অবস্থান। স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের বাইরে নেই মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বয়ান। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পেরিয়ে এসেও এরূপ অবস্থান আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতায় নির্দেশিত হয়। আমি বিজয় দেখেছি'র মতো আলোচিত ও পাঠকপ্রিয় বইয়েও বৌদ্ধিক বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করা হয়নি। এই বইয়ে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার প্রয়াস রয়েছে। আদতে হওয়া উচিৎ ছিল উল্টোটা।
৭১ এর ঘটনাকেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এম আর আখতার মুকুলের "আমি বিজয় দেখেছি" গ্রন্থটি। এটি মূলত একটি আত্নজীবনীর মতো তবে এর আবর্তে আবর্তে ছিলো মূলত ১৯৭১ এর ঘটনাগুলোই। তবে ১৯৭১ এর ঘটনাগুলোর পরিস্কারভাবে তুলে ধরার জন্য তিনি গোড়ার কারণগুলোও লিখেছেন। ফলে বইয়ের ব্যপ্তি শুধুমাত্র ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আটকে থাকেনি। বরং থেকে থেকে ৫২ এর আন্দোলন, ৬২ এর আন্দোলন, ৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ৬ দফা দাবী, ৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রসংগ, ৬৯ এর গনঅভ্যুথান, ৭০ এর নির্বাচনের দিকে ফিরে গিয়েছেন। ১৯৭১ কে বুঝতে হলে যেসকল বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা বাঞ্ছনীয় তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে এই বইয়ে। ৭১ এর ঘটনার একটি মিনি এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যেতে পারে।
এম আর আখতার মুকুল দীর্ঘদিন ইত্তেফাক পত্রিকাতে সাংবাদিকতা করেছেন। তাই বইয়ের লেখনীও দারুন। এছাড়া ছাত্র জীবনে তিনি রাজনীতিতেও জড়িত ছিলেন। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ৭১ এর সবচেয়ে জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান "চরমপত্র" এর লেখক ও পাঠক। চরমপত্রের কিছু কিছু লাইন তখন মানুষের মুখে মুখে ছিলো।
ইয়াহিয়া...ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া এলায় কি বুঝতাসেন
বইয়ের ঘটনার শুরু লেখকের ভারতে আশ্রয়ের জন্যে গমনের কথা দিয়ে। পথের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনার সাথে সাথে ছোট ছোট করে বিভিন্না বিষয়ের কথা তিনি তুলে ধরেন। পরবর্তীতে কি পরিস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালু হয়, পরিচালনা করা হয় এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়। মুজিবনগর সরকারের প্রেস ও তথ্য বিভাগের পরিচালক তিনি ছিলেন বিধায় তার চেয়ে বিস্তারিত বর্ণনা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে কিনা আমি জানি না। পরবর্তিতে যুদ্ধের ময়দানের খবরাখবর, পাকিস্তানি আর অন্যান্য বিদেশী মিডিয়ার খবর, মুজিবনগর সরকারের আভ্যন্তরীন রাজনীতি, অল্প-বিস্তর ভারত সরকারের কূটনীতির কথা তিনি উল্লখে করেন।
বইয়ের বিভিন্ন অংশে তিনি তিনি বারবার জোর দিয়েছেন তিনি একাত্তরের সবগুলো ঘটনার বর্ণনায় নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন। ৭১ এর পরবর্তী ঘটনাবলির কুশিলবদের ব্যাপারে তেমন কোন ব্যক্তিগত মন্তব্য তিনি করেন নি। জুন থেকে পরিচালিত সেক্টর ভিত্তিক যুদ্ধের সাথে সাথে তিনি মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনীর পরিচয়, মুজিবনগর সরকারের সাথে সম্পর্কে ইত্যাদি তুলে ধরেন। বইয়ের শেষ অংশে তিনি যখন সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন তখন বাঙ্গালী সাহসী সেনা নায়ক খালেদ মোশাররফ, এ টি এম হায়দার, এম কে বাশার, আবু তাদের তাদের কথা বার বার বলেন। এছাড়া মিত্রবাহিনীর সামরিক অফিসারদের নাম উল্লেখ থাকলে তাদের ভূমিকা নিয়া খুব বেশী আলোচনা হয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি একটি ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছেন কেন আরো বেশী মুক্তিযুদ্ধের উপর গল্প উপন্যাস এতো কম। ৬৬,৬৮,৬৯ এর যেখানে ছিলো বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের আন্দোলন, যুদ্ধের সময় তিনি মনে করেন বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা দূরে সরে যান। ফলে সম্মকভাবে যুদ্ধ না দেখে যুদ্ধ নিয়ে আসলে বই লিখা সম্ভব না। তার এই মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ন। শুধুমাত্র বইয়ের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা প্রবাহ। তার মাঝে অন্যতম একটি দলিল হিসেবে টিকে থাক আমি বিজয় দেখেছি
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমার পড়া অন্যতম বইগুলোর একটি । কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এল, কিভাবে তখন যুদ্ধ পরিচালনা হত, সবকিছু বাস্তবের মত চোখের সামনে ভেসে উঠে । এম, আর, আখতার মুকুল স্যার এর লেখনি প্রশংসা না করে পারছি না । সত্যিই, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্যে সেরা পাঁচের মধ্যে আমি এই বইটা কে রাখবো ।
এককথায় অসাধারণ .... স্বাধীন বাংলা বেতার সৃষ্টি ... জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধের পর শেষ জবানবন্দি, শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকার, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় প্রতি অংশের খন্ডচিত্র , দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়কালের নিখুত বর্ননা। আফসোস এটাই, আরও আগে কেন পড়ি নাই