২০০৯এর শেষটায়, বাংলা টাইপিং শিখছি যখন সবে, টুকটাক লেখাও, বাবাকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। পরের লেখাটা, কবে লিখব, সময় ঠিক না থাকলেও শিরোনাম ঠিক করা ছিল খুব পছন্দের একটা বইয়ের নামে। আমার পিতার মুখ।
চাণক্য সেনের এই সিরিজটা ইন্টারেস্টিং! প্রথমে লিখছে পিতা পুত্রকে, এরপর পুত্র পিতাকে। চার তারা পেয়েছে যেটা, সেখানার রিভিউ ঠুকে রাখাই দস্তুর, নাকি?
বাবাকে নিয়ে সাহিত্যে পত্রাঘাতের হুজুগ তুলনামূলক ভাবে কম। মানের দিক থেকে ম্যাক্সিমের মা কিংবা অসহনীয় প্রচারের দিক থেকে আমিষুলের মা যতোটা সহজে পাঠ্য, সে তুলনায় আব্বুকে মনে পড়ে কিংবা ভেরা পানোভার পিতা ও পুত্র ততোটা বাজারচলতি নয়।
এখনো মা দিবসের উচ্ছাস বহুগুণে ছাপিয়ে যায় ফাদারস ডের আনুষ্ঠানিক উদযাপনকে।
পুত্র পিতাকে, বাবা ও ছেলের মাঝে হাট করে খুলে লেখা একান্ত কথোপকথন। শ্বেতকেতু, উপনিষদ থেকে যার নাম রেখেছিলেন অধ্যাপক পিতা। যে বাবা সব সময় চেয়েছেন ছেলের জনক নয় কেবল; বন্ধু হতে, এমন বন্ধু যেখানে লুকোছাপার জায়গা নেই, চাপিয়ে দেওয়া মত বহনের ভার নেই, অশ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালবাসা নেই, সে বাবার কাছে লেখা। যেখানে দায়িত্ব মানে অবলিগেশন নয়, দায়িত্ব মানে সেন্স অফ রেসপনসিবিলিটি। বাল্য থেকে অসম বয়সী দুই প্রজন্মের বন্ধন কিংবা আপাত বিচ্ছিন্নতার গল্প এটি। হারিয়ে গিয়ে আবার শেকড়ে ফেরার কাহিনি, কখনো সোচ্চারে, কখনো নিরুচ্চারিত।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জঙ্গীবাদের মহামারি চলছে। এনএসইউ বা টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণেরা আল্লাহু আকবর বলে 'তাগুতি' আইনের বিলোপে চাপাতি দিয়ে অবলীলায় নামিয়ে দিচ্ছে ধড়, মরছে নিজেরাও, স্বেচ্ছায়। জিহাদ নাকি এটা। হাহ!
বাবারা, পরদিন নিউজে বিস্ময় নিয়ে দেখছেন পথভ্রান্ত আত্মজের মৃতদেহ। কখন গেলো আমার ছেলেটা এ পথে? কীভাবে? কখনো টের পাইনি তো!
প্যারেন্টিং একটা কঠিন শব্দ। সে শব্দের ভার বইতে পারার যোগ্যতা আছে কিনা দুৰ্ভাগ্যবশত সেই পরীক্ষা কোন পিতাকেই দিতে হয় না। প্রাচীন ধারাপাতের পাতায় কোবিরা আমাদের শেখান-- 'সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি'। এই ভালোর সংজ্ঞা আগেই ঠিক করা, 'আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে'। সেই গুরুজন'ই শেখান হকারকে বলে এসো আব্বু বাসায় নেই, কালকে বিল নিয়েন। ফোনে শোনা হয় বস'কে বলছেন শরীরটা খুব খারাপ স্যার, আদতে প্ল্যান দুপুরে 'জল ও জঙ্গলের কাব্য'তে পারিবারিক বিহার।
আমরা এই দেখে বড় হই। আমরা শিখি ভাল মতো পড়ো, নইলে চান্স পাবে না কোথাও। এই ভালোর সংজ্ঞা খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারে কাটতি থাকা বিভাগগুলো। আলহামদুল্লিলাহ, মেয়েটাকে খুব ভাল বিয়ে দিয়েছি ভাইসাহেব- মানে ছেলের রোজগার ভালো, নিজের বাড়ি/ফ্ল্যাট ইত্যাদি। এই ভালো মানে টিকে থাকার রেসে চকচকে প্রাইসট্যাগ জোটানো সওয়ারি।
মা-খালা-ফুফুরা গল্প করতেন, তোদের নানা/দাদার দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস-ই ছিলো না আমাদের। বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে, বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়ে সে'সময় তারা শান্তি পেয়েছেন, সুখে থেকেছেন।
আমাদেরও এরকম বাবা অনেক। আমরা নিজেদের জন্য বাঁচি না, বাঁচি পরিবার আর সমাজের জন্যে। উত্তরাধিকারসুত্রে আমরা বহন করে চলি পিতা এবং মাতার না মেটা স্বপ্নের দায়। যে সুযোগ নিজে পাননি, সে সুখ, সে স্বচ্ছলতা, সে স্বাচ্ছন্দ্য সন্তানকে এনে দিতে বাবারা প্রাণপাত করেন। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে... তাঁদের বাবারাও ওভাবেই বেঁচে থাকতে শিখেছিলেন, শিখিয়েছিলেন।
সব বাবারাই চায় পুত্ররা তাদের জীবনের জয়ধ্বজা হোক। সে জীবন, সে স্বপ্নের ঠিকানা উভয়ত বিপরীতগামী হলেই সূচনা সংঘাতের।
না, বঙ্গদেশের সকল পিতা অবুঝ, পাষাণ, পিশাচ-- কদাচ এমন নয়। কিন্তু শুধু অভিভাবক না হয়ে সব বাবারা বন্ধু-ও হলে, অন্তত খানিকটা বন্ধুর মতো হলে, জীবনের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা অনেকখানি কমে যেতো মনে হয়।
ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে বসে ছিলাম। হঠাত চোখে পড়লো, পড়া শুরু করলাম। এরপর সেমিস্টার ফাইনাল থেকে শুরু করে সব লাটে উঠছে। হাজার চেষ্টা করেও পড়া থামাতে পারি না। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত সমাজ, সাম্রাজ্যবাদের অভিশাপ, ইডিপাস কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে ষাটের দশকের নিউইয়র্ক, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, নিগ্রোদের সংগ্রাম, শেকড়হীন একটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠা - সবকিছু এক বইতেই টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়েছে! মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গেছি, আগাগোড়া অসাধারণ ছিল পিতার কাছে লেখা পুত্রের এই পত্র।
বইটা ভালই, বেশ কিছু ফ্যাক্ট এন্ড অ্যানালাইসিস আছে যা চিন্তার খোরাক জোগায়। তবে "তরুণদের জেগে উঠতে হবে এগিয়ে যেতে হবে, প্রথা ভাঙতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি" রিডান্ডেন্টলি বলে এতো পৃষ্ঠা বাড়ানোর দরকার ছিল না।
পিতা-পুত্র সম্পর্ক আমাদের এই উপমহাদেশে ঠিক প্রানবন্ত ছিল না কখনোই, অনেকটা পলি বহন করে চলা নদীর ঘোলা জলের মতো, অনেক সম্পদশালী কিন্তু অসচ্ছ। সেদিক থেকে মা-পুত্র সম্পর্ক অনেক এগিয়ে। তবে আমাদের পিতাদের জেনারেশন বা আমাদের জেনারেশনের পিতারা অনেকটা লিবারেল। তারা শিখেছে বন্ধু হয়ে উঠতে। কিন্তু সেই আবহমান কালের চাপিয়ে দেবার অভ্যাসটা বুঝি জীনগত হয়ে পড়েছে, এতো সহজে যাবে না। আদিওপাস কমপ্লেক্স এর মতে পুত্ররা শিশু বয়সে তাদের পিতাকে প্রতিদন্ধী মনে করে।এ দন্ধ শুরু হয় মায়ের প্রতি ভালবাসা থেকে। মায়ের ভাগ কাউকে দিতে পুত্র চায় না, এমনকি পিতাকেও না। যেমনটা চানক্য সেনের উপন্যাস “পুত্র-পিতাকে” এর প্রোটাগনিস্ট চরিত্র কেতুর বেলায় ও আমরা দেখতে পাই। মায়ের ভাগ তার শিশু মন পিতাকে দিতে চায় না।
চানক্য সেনের “পুত্র-পিতাকে” উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে কেতুকে নিয়ে। যুগের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা অধ্যাপক পিতার পুত্র কেতু। কেতুর পিতা তার পিতা থেকে যা পায়নি দিতে চেয়েছে নিজের পুত্রকে। বন্ধুত্ব, স্বাধীনতা কেতু পেয়েছে তার পিতার কাছ থেকে ছোট্ট বেলা থেকে। সেই বন্ধুত্ব এতোই গভীর পড়তে পড়তে ঈর্ষা জন্মে যায় মনের কোন এক গহীন কোনে।
তারপরও পিতার সাথে জীবন যুদ্ধে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে কেতু। বোহেমিয়ান মেয়ে সুজান ফোর্ড কেতুর জীবনে এসে সব ওলট পালট করে দেয়। সুজান কে ঠিক মেনে নিতে পারেনা কেতুর পিতা। সুজানের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই কেতুর পিতা অপছন্দ করে বসে। অথচ পিতাই একদিন বলেছিল যে ধর্মের, যে বর্ণের মেয়েকেই কেতু বিয়ে করুক না কেন, তার আপত্ত�� থাকবে না। কিন্তু সুজানের বেয়াড়া জীবন তাকে বাধা দিতে বাধ্য করে। ফলে পিতা-পুত্র সম্পর্কে চিড় ধরে। সুজানের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ে কেতু।
এরপর বিশ্বের সাথে যেন তালগোল পাকিয়ে মিশে যায় কেতু। তৎকালীন অ্যামেরিকায় (অ্যামেরিকা তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ করছে) তখন কালোরা আন্দোলন করছে সমঅধিকারের দাবিতে। কেতু কাছ থেকে দেখেছে সেই আন্দোলন। আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন তখন যুব সমাজে প্রবল। সেখানটাও তার পদধূলি পাচ্ছে। সুজান অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীল মেয়ে, বিশ্বের যে প্রান্তে মানবিকতা সম্রাজ্যবাদীদের কাছে পদদলিত হচ্ছে সুজান তাদের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুজানের সাথে কি সুখী হতে পারবে কেতু? সেটা যদি বলেই দেই তবে আপনি বইটা কেন পড়বেন?
নিজের চব্বিশতম জন্মদিন উপলক্ষে পিতাকে চিঠি লিখেছে কেতু। অনেকটা কনফেসের মতো চিঠিটা। কিছু না চেপে রেখে লিখে গিয়েছে তার জীবন সম্পর্কে, জীবনবোধ সম্পর্কে। যেন একটা বিশাল ক্যানভাসে নিজের মনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে কেতু দারুন দক্ষতায়। এই চিঠিটাই উপন্যাস। পিতাকে ভালবাসা, পিতার থেকে দূরে সরে আসা, বিচ্ছিন্নতার ব্যাকুলতা, পুনরায় ফিরে আসার চেষ্টার দারুন একটা মহাকাব্য যেন এই উপন্যাস।
উপন্যাসের শুরুটা এতোবেশি মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছিল যে, আমার প্রত্যাশা উপন্যাসটাকে ঘিরে আকাশচুম্বী হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই মুগ্ধতা ঔপন্যাসিক ধরে রাখতে না পারলেও বইটি অনেক কিছু শিখিয়েছে।
"পিতার চেয়ে পুত্র বড় ,কেতু।পিতা পুরাতন, পুত্র নতুন।পিতা গতকালের ,পুত্র আগামীকালের। যতদিন আমরা বেঁচে আছি, তোমাদের দেখব। যদি দেখতে পাই ,তোমাদের জীবন মহত্তর, তোমাদের শ্রদ্ধা করবোই ।যদি দেখি তোমরা আমাদেরই মতো পচে বলে বাঁচছ,আর যাই পাও শ্রদ্ধা পাবে না।"
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এক যুবক 'কেতু' তার বাবাকে চিঠি লিখেছে। সেখানে সে তার শৈশবের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে বলে।কেতুর বাবা অন্যান্য বাবাদের থেকে আলাদা, তিনি মুক্তচিন্তার ও আধুনিক। তিনি তার সন্তানকে স্বাধীনভাবে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিয়েছেন।যেসব বিষয়কে সমাজে ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়,সেইসব ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা কেমন হওয়া প্রয়োজন তার চর্চা ছোটবেলায় তিনি কেতুকে দিয়েছেন। বাবা-মায়ের কাছে উচ্চশিক্ষার জন্য কেতু একসময় দেশের বাইরে যায়। সেখানকার অন্যান্য যুবক-যুবতীদের সাথে মিশে তার চিন্তা জগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বাবা-মায়ের প্রতি সেখানকার সন্তানদের মনোভাব বা দায়িত্ব-কর্তব্য ভারতের সন্তানদের সাথে তুলনা করে সে প্রচলিত প্রথা ভেঙে পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে। ধীরে ধীরে সরে আসে বাবা মায়ের কাছ থেকে,মিশে যায় পথভ্রষ্ট অনেক বিদেশী যুবক-যুবতীদের সাথে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান অনেক তরুণদের মনোভাব বুঝতে তাদের সাথে থাকা শুরু করে। এখানে পরিচয় হয় সুজান ফোর্ড নামের এক নারীর সঙ্গে। বাবা-মায়ের নিষেধ অগ্রাহ্য করে বেশি বয়সী সুজানের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কেতু।এক সময় গোলক ধাঁধায় আবর্তিত পথহারা কেতুকে পথ দেখায় জুন। জুন কে নিয়ে সে ফিরে আসে বাবাদের সমাজে।
এই বইতে এমন অনেক বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা অনেক পাঠকের যুক্তি-তর্কের সাথে মিলবে না।তবে পাঠকের মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে বইটি পড়লে। বারবার মনে হয় বইটি লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা।
My father actually gave me this book... and I was never quite the reader but soon I was fascinated how this literary piece in its own simple and fluent story-line explains the common dynamic of Bengali father-son relations throughout the generations
This book has a personal significance and I love Ketu, his family and of course a special shout out for Susan Ford
প্রথমে ঠিকঠাক শুরু করার মতো টান অনুভব করিনি সত্যি, তবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম পাতার পরে পাতা উল্টে পাল্টে পরের পাতায়। একটা সময় ডুবে গেলাম ঠিক যখনি পুত্রকণ্ঠে বলছিল, এই ভারতবর্ষের পিতা হিসেবে তাঁর পিতার দায়িত্ব পালনে ত্রুটিহীনতার কথা। এক নিরব বাষ্প অশ্রু চোখের কোনে চলে আসলো। আমার নিজের ছবিটাই যেন ক্ষণিকের জন্যে মানসপটে অঙ্কিত হয়ে রইল। ধারালো লেখনিই শুধু নয়, এই লেখনী মর্মে গিয়ে নাড়া দেয়। করে মলিন দৃশ্যপটের অবতারানা। কোথা হতে যেন নতুন জীবনের সঞ্জীবনী এনে দিলো। বাঁচতে চাইলে আবার বাঁচা যায়। সব মলিনতা ছিড়ে ফেলে দিয়ে এক সমুদ্র পাড়ি দেয়া যায়। চাণক্য সেন , দেখিয়েছেন নতুন দেখার চোখে, সাজিয়েছেন নতুন দৃশ্যপটে। সামগ্রিক বিবেচনায় বইটি পড়ার ঝোঁক আর বাড়িয়ে দেয়। শুভ হোক চাণক্য পঠন।
পিতা পুত্রের মতানৈক্য দেখানো হয়েছে, পুত্র কীভাবে পুরাতনের বেড়াজাল উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় আধুনিকতার দিকে, বিয়ে করে পশ্চিমের মেয়ে বয়সে বড় বরের থেকে। ভাল উপন্যাস