নায়িকা নয়, এ কাহিনির নায়ক অতি সাধারণ ঘরের এক অসাধারণ মেয়ে। নাম তার লুৎফা, সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের ঘরনি। ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় রাজা-নবাব জমিদারদের বীরত্বের কথা। রাজ্য-রাজনীতির কথা। অর্থনীতির কথাও। কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির মনের কথা, তাদের মান-অভিমান, প্রীতি-ভালোবাসার কথা, উপেক্ষিত হয় ইতিহাসের পাতায়। এ কাহিনি তেমনই এক সম্পর্কের, ঐতিহাসিক পটভূমিতে গড়ে উঠলেও এই কিসসা দুটি মানব-মানবীর| সম্পর্কের, যেখানে ইতিহাস প্রধান হয়ে ওঠে না।
শুধু সিরাজের দোষত্রুটিগুলো এমন অসহায়তার আবরণে মুড়ে, সমীচীন হিসেবে না দেখালে খুশি হতাম। সাহিত্য হলেও, এমন সাহিত্যের হাত ধরেই সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সন্মন্ধে জানতে পারে। ইতিহাসের সিরাজ বিতর্কিত হলেও, ভারতবর্ষের এক যুগান্তকারী চরিত্র। তার কাহিনীতে এমন শিক্ষণীয় অনেক বিষয় আছে, যা আজকের সিরাজ ও আজকের মীরজাফর, উভয়েরই জানা প্রয়োজন।
বই দেখলাম কারো বেশ ভাল লেগেছে কারো কারো যাচ্ছেতাই। আমি এত ভাল ভাল আর গবেষণানির্ভর ঐতিহাসিক ফিকশন পড়েছি যে এটা সেই মাপে একদম নবীশ লাগলো। কোন বইয়ের বা কিছুর তালিকাও পেলাম না বইয়ের শুরুতে বা শেষে যাতে ফিকশনের কোন তথ্যগুলো সত্য, কোনগুলো কল্পনার হোলিতে রঙিন বোঝা যেত খানিকটা। তাই যারা পড়ছে তাদের কাছে অনুরোধ ফিকশন এবং সত্যের মাঝের রেখাটা ধরবার চেষ্টা করলে ভাল হয়। নাহলে কিন্তু বিপদ!
ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসে লেখকের কাল্পনিক দিক থাকবে সেটা জানা কথা। তাই বলে নিজের কল্পনায় বাংলার নবাবদের মা বোন স্ত্রীদের প্রত্যেককেই এতটা বাজে চরিত্র দেখিয়ে উপস্থাপন করাও উচিত হয়নি। মনে হয়েছে সাহিত্যের নামে লেখক নিজের বিকৃত মানসিকতা আর বিকৃত রুচিরই প্রকাশ করেছে এই লেখার মাধ্যমে।
পলাশীর যু'দ্ধ বাংলার ইতিহাসেরই একটি অংশ। এ গল্প বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার। এ গল্প বিশ্বাসঘাতক ঘসেটি বেগম ও মির জাফরের। কিন্তু এ গল্পেরই আরো একটি দিক রয়েছে। ইতিহাসের বইয়ে বরাবরই যু'দ্ধের ঘটনাগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু এর আরেক পিঠে যে খানিকটা প্রেম, ভালোবাসা ও সহমর্মিতাও থেকে যায়, তা কারো চোখেই পড়ে না। ‘আমি সিরাজের বেগম’ বইটিতে ঠিক সেদিকটিই ফুটে উঠেছে। এখানে উত্তম পুরুষের ভূমিকায় রয়েছেন বাংলার স্বাধীন নবাবের দুঃসময়ের পরম আকাঙ্ক্ষিত স্ত্রী। যে কিনা একসময় প্রাসাদের জারিয়া বা দাসী ছিল। পরবর্তীতে সিরাজউদ্দৌলা ভালোবেসে তার নাম রাখেন লুৎফা।
অতীত মানেই এক খন্ড ইতিহাস। আজ এই বর্তমান সময় তৈরির পেছনে যত গল্প রয়েছে, সবই ইতিহাস হয়ে গিয়েছে সময়ের পরিক্রমায়। ইতিহাস কখনো আনন্দের, কখনো বা অজস্র কষ্টের। একসময় ইতিহাস বই পড়ে পলাশীর যু'দ্ধ সম্পর্কে বেশ ভালোই জানতে পেরেছিলাম। সে সময় ঘসেটি বেগম ও মির জাফরকে সামনে পেলে হয়তো তাদের টুঁটি চেপে ধরতেও দ্বিধা করতাম না। তবে ইতিহাসের সেই বই পড়ে পলাশীর যু'দ্ধ সম্পর্কে যেমন সম্যক ধারণা না পেলেও কিছুটা অবগত হয়েছি, এই বইটি পড়েও একই ইতিহাসের ভিন্ন আরেকটা দিক সম্পর্কে জানতে পারলাম। এতে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে খুব বেশি কষ্ট হয়নি অবশ্য।
নবাব আলিবর্দি খাঁর শাসনামলে লুৎফা শুধুই ছিলেন এক দাসী-বাঁদী। যে কিনা সবার হুকুম তালিম করতেই সদাপ্রস্তুত। সেসময় লুৎফা তার মা কিংবা বাবা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখতেন না। শয়নেস্বপনে একটি দুঃস্বপ্নই ছিল তার শেষ ভরসা। তবুও কিভাবে কিভাবে যেন তিনি বাংলার বেগমসায়েবার প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়ে গেলেন। সবার জন্য যেটা কঠোর শাস্তি, লুৎফার জন্য সেটা ক্ষমা। লুৎফা নিজেও বাংলার নবাব ও তার বেগমকে অসীম শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত তিনি নিজের ভবিতব্য সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। জানতেন না, একটি মাত্র সাক্ষাৎই তার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে চলেছে।
ঘসেটি বেগমের চরিত্র কখনই ধুঁয়া তুলসি পাতা ছিল না। উগ্র মেজাজী, চারিত্রিক খর্বতা, লোভী, বিশ্বাসঘাতক সবরকমের তকমাই তার সাথে যায়। এই সেই মহিলা, যে কিনা একজন সহজ, সরল, নির্বিবাদী লোককে বিয়ে করেও সিংহাসনের লোভে দিনের পর দিন অন্য লোকদের নিজের কাছে ঘেঁষতে দিয়েছেন। নিজেকে দ্রব্যসামগ্রীতে পরিণত করে ফেলেছিলেন যথারীতি। সিংহাসনের লোভে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। নবাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। যদিও পরবর্তীতে নবাবের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এতো বছরে যে বীজ তিনি রোপণ করে গিয়েছেন, তা থেকে গাছ হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে পলাশীর যু'দ্ধে রূপ নিয়েছে ইতোমধ্যেই। আর পরাজয় ঘটিয়েছে বাংলার শেষ নবাবের।
অপরিচিত কখনো শ'ত্রু হয় না। শ'ত্রু সবসময় নিজের খুব কাছের লোকেরাই হয়। সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয় তারা। আর চিরদিনের মতন পঙ্গু করে দিয়ে যায় অপর পাশের মানুষটিকে। নবাব তার শাসনামলে পদে পদে বিপদে পড়েছেন। অপদস্ত হয়েছেন অহরহ। একসময় গিয়ে হতাশায় নিমজ্জিতও হয়েছেন। যার কারণ ছিল তার পরিচিত পরিবেশ, পরিস্থিতির ভোলবদল। নিজের প্রিয় মানুষদেরকে প্রতিনিয়ত বদলে যেতে দেখে শক্ত-সামর্থ্য নবাবেরও হৃদয় ভেঙেছিল। গদি ছেড়ে দিয়ে একটু শান্তিতে বাঁচতে ইচ্ছে করেছিল। একসময় তো স্ত্রীকে বলেও ফেললেন, ‘যদি আমি কৃষক হতাম, তুমি হতে কৃষক পত্নী। আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হতো।’ কিন্তু তা আর হলো না। নবাব হওয়া যেইসেই কথা নয়। এখানে পরাজয় মানেই মৃ'ত্যু। আর বেঁচে থাকা মানে মৃ'ত্যুই শ্রেয়।
‘আমি সিরাজের বেগম’ বইটিতে নবাব আলিবর্দি খাঁর প্রতাপ, তার বেগমের কঠোরতা ও দৃঢ়তা, তাদের দুজনের মধ্যকার আন্তরিকতা, ঘসেটি বেগমের নিকৃষ্টতা ও কোমলতা, তার লোভ ও সেই লোভের আগুনের ধুপ করেই নিভে যাওয়া, ঘসেটি বেগম ও তার বোন আমেনা বিবির (সিরাজউদ্দৌলার মা) চরিত্রহীনতাসহ বহু বহু অজানা তথ্য জানা যায়। তবে যেটা না বললেই নয়। এখানে আমরা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার এক অন্য রূপ দেখতে পাবো। যেমনটা আমি আগে ভাবতাম। লুৎফাই নবাবের একমাত্র স্ত্রী। এটা যেমন সত্যি নয়, তেমনই শুদ্ধ নয় লুৎফার সিরাজের স্ত্রী হিসেবে পদার্পণ করার পদ্ধতি। যদিওবা এক্ষেত্রে সিরাজের ভূমিকাও কম নয়। লুৎফাকে যেমন সিরাজের অন্য বিবিরা মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছে, লুৎফারও তো তেমনই অন্য কাউকে মেনে নেওয়া উচিত, তাই না? আচ্ছা, নবাব হতে হলে কি একাধিক বেগম থাকাটা খুব জরুরি? তাহলে নবাব আলিবর্দি খাঁ কেন মৃ'ত্যুশয্যায়ও নিজের একমাত্র স্ত্রীকে স্বান্তনার বাণী শোনাতে শোনাতে মৃ'ত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন? জটিল প্রশ্ন!
এই বইটার ইতিহাস কতটা সত্য বা মিথ্যা, তা জানা নেই। তবে মোদ্দাকথা হলো, বইটা পড়ে ভালোলাগা কাজ করছে আমার । অনেকদিন পর মেদহীন একটা লেখা পড়লাম। সবার হয়তো বইটা ভালো লাগবে না। কেননা এখানে যু’দ্ধের পদ্ধতি দেখানো হয়নি, যু'দ্ধক্ষেত্র দেখানো হয়নি, দেখানো হয়নি শত্রুদের গোপন মিটিংয়ের অংশবিশেষও। কেবল দেখানো হয়েছে লুৎফার চোখে তার নবাব, নবাবের রাজত্ব, ক্ষনিকের বিচ্ছেদ, খানিকটা ষ'ড়য'ন্ত্র ও সবশেষে ইতিহাসের সমাপ্তি। আমার ধারণা, এই বইটা পড়তে হলে আগে পলাশীর যু'দ্ধ ও সিরাজউদ্দৌলার নবাব হওয়ার ইতিহাস কিছুটা হলেও জানা জরুরি। কারণ, এই গল্প কেবল লুৎফার নজর অবধিই সীমাবদ্ধ। পলাশীর য'দ্ধ, সেই যু'দ্ধের মাঠ, ঘসেটির হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ, শ'ত্রুদের একটু একটু করে বেড়ে ওঠা কিছুই দেখানো হইনি এখানে। কেবল যু'দ্ধ করা, বিজয়ী হওয়া বা জয়ী হওয়া এতোটুকুই উল্লেখ করে গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই আমি সাজেস্ট করবো পলাশীর যু'দ্ধ সম্পর্কে হালকা পাতলা ধারণা নিয়ে গল্পের আদলে এই বইটিকে উপভোগ করুন। তাহল�� হয়তো এর রস খুব ভালো করে আস্বাদন করতে পারবেন।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি, কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেব..... . ছোট বেলায় নবাব সিরাজ উদ দ্দৌলা ছবিতে এই ডায়লটা শুনতাম। ভাল ই লাগত। মাত্র ১৪ বছর বয়েসে পুরো বাংলার নবার হয়ে বসা তো যেন তেন কথা নয়। কিন্তু এই নবাব হওয়াটাই কাল হলো শেষ পর্যন্ত। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলেন। কিন্তু তিনি সত্যি কি পরাজিত হয়েছেন? . রাজ প্রাসাদ এক দারুণ জায়াগা। ইতিহাসবিদের মতে এই জায়গাতে কত রহস্য লুকিয়ে আছে তা আজও অজানা। ক্ষমতার লোভা, রাজনীতি ও কূটিলতায় ভরপূর ছিল তখন। সবার মাঝে ক্ষমতার লোভ ছিল। সবাই চাইতো নিজেকে মসনদে বসাতে। চক্রান্তের বেড়াজাল সব সময় ঘিরে ছিল। কারণ তখন কে আপন আর কে পর সেটা বুঝে ওঠাই দায় ছিল। . তবে রাজা, নবাবদের ছাড়াও প্রাসাদের অন্দর মহলেও ছিল অনেক কিছু যা ইতিহাসে রহস্য হয়েই রয়েছে। তেমন ই "আমি সিরাজের বেগম"। . তখনকার দিনে হেরেমে অনেক জারিয়া থাকত সেবা করার জন্য। তাদের জায়গা ছিল হেরেম। তারা বেগম হবার মত নয়। মুলত রাজা, নবাব ও বেগমদের সেবা করার জন্য জারিয়া রাখা হতো। তেমনি নবাব সিরাজের একজন জারিয়া ছিল " লুৎফুন্নেসা" যাকে নবাব লুৎফা বলেই ডাকতেন। . নবাব লুৎফা কে বিয়ে করেননি। কিন্তু তারা কাছে সব কিছু নিয়ে হাজির হতেন। তার সকল দুঃখ কষ্টের সময় লুৎফা কেই পাশে পেয়েছেন। এমনকি যখন পালিয়ে যাচ্ছেন তখনও লুৎফাই তার সাথে ছিলেন। অথচ বিয়ে না করেও লুৎফা পেয়েছেন তার স্ত্রীর মর্যাদা। . লুৎফা যে একজন জারিয়া ছিলেন তা নয়। অসম্ভব দূরদর্শী ছিলেন। নবাবের শাসন কার্যে এমনকি মহলেএ ভেতর ও বাইরের ষড়যন্ত্রের কথা সব কিছুই তার জানা থাকত। তবুও তিনি চক্রান্ত ভেদ করে বের হতে হতে সব শেষ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে পতন ঘটে নবাবের। এরপর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধারা পরেন। পরে তাকে হত্যা করা হয়। তাকে সমাধিস্ত করা হয় তার নানা আলিবর্দি খা এর পাশেই। . "আমি সিরাজের বেগম" বই শ্রীপারাবত এর ইতিহাস আশ্রিত একটি বই। এখানে সিরাজের বেগমের কথা উঠে এসেছে। তবে সিরাজের সাথে তার বিয়ে হয়নি। মৌখিক ভাবেই তাকে বেগম মানত সবাই৷ কিন্তু তার তীক্ষ্ম বুদ্ধি ও প্রখরতা সিরাজকে অবাক করত। এটা সত্য যে সে অন্যান্য বেগমদের মত নয়। তার স্বর্নালংকার, ক্ষমতা এসবের প্রতি লোভ ছিল না। সে শুধু সিরাজ কেই ভালবাসত। আর তার প্রমান তার মেয়ে। সিরাজ যখন ই কোন বিপদে পরতেন তখন লুৎফার কাছেই ছুটে আসতেন। হয়ত তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস দুটোই ছিল। . কিন্তু বেগম লুৎফাও সিরাজ কে বাচাতে পারেননি। ষড়যন্ত্রে বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে পারনি বাংলাকে। হয়ত ইতিহাস তাহলে অন্য রকম ভাবে লেখা হতো। . যদি ঘসেটি বেগম শুরু থেকে সিরাজ কে পছন্দ করতেন, যদি মীর জাফর, রাজ বল্লভ, জগৎশেঠ এর ক্ষমতার লোভ না করত। যদি সিরাজ ঠিক ভাবে যুদ্ধে জয়ী হতেন। তবে হয়ত আজ বাংলার ইতিহাস অনেক পাল্টে যেতো। . তবে ইতিহাসের পেছনের ইতিহাস হচ্ছে প্রাসাদের ভেতরের ইতিহাস। যে নারী তার সর্বোচ্চ দিয়ে বাংলার নবাব, বাংলা কে বাচাতে চেয়েছেন। যার ইচ্ছে ছিল নবাবের যেন কোন বিপদ না হয়। স্ত্রী না হয়েও তিনি সিরাজের বেগম। . অনেক দিন পর কোন বই মনের ভিতরে অনেক শক্ত ভাবে আঘাত করল৷ এত দিন কেন বইটি পড়িনি তাই আফসোস হচ্ছে। সত্য ইতিহাস অনেক বড় কষ্টের।
"সিরাজহীন হয়ে বেঁচে থাকার যে এত জ্বালা জানতাম না। সে যদি অত্যাচারী হতো, দুশ্চরিত্র হতো, তবু যেন ভালো ছিল। জানতাম সে বেঁচে রয়েছে। একদিন না একদিন অকস্মাৎ আমার কাছে আসবেই। কিন্তু এখন যে সে নেই। সে আর আসবে না।"
প্রবীর কুমার গোস্বামী বা শ্রীপারাবত ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসের পাঠকদের কাছে অতি পরিচিত এক নাম। তাঁর 'আমি সিরাজের বেগম' নামাঙ্কিত উপন্যাসটি আবর্তিত হয়েছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বেগম লুৎফাউন্নেসাকে ঘিরে। এই কাহিনিকে আমি নবাব ও বেগমের প্রেমের উপাখ্যান বলবো না, বরং লেখক তার উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে লুৎফার জবানিতে তুলে ধরেছেন তাঁরই জীবনকাহিনি। সামান্য ক্রীতদাসী থেকে নবাবের পছন্দের বেগম হয়ে ওঠা, ভবিষ্যৎ বাংলার নবাবের ভালোমন্দ বা তাঁর গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে লুৎফার মতামত, সিরাজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ওঠাপড়ার সুনিপুণ চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখনীতে।
ইতিহাস আশ্রিত বা ঐতিহাসিক কাহিনিতে স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে তৎকালীন সমাজের চিত্র, সাধারণের দৈনন্দিন। কিন্তু বেগমমহল বা হীরাঝিলে থাকা বেগমের পক্ষে বাইরের খবরাখবর পাবার সুযোগ খুবই অল্প। লেখকও সুনিপুণভাবে তাই গল্পের পরিসরে নবাবের যুদ্ধ কিংবা মহলের কুটিল সম্পর্কের বিন্যাসের কাহিনি লুৎফার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ঠিক ততটুকুই, যতটুকু একজন বেগমের পক্ষে তাঁর বাদীদের মারফত জানা সম্ভব। তাই ঐতিহাসিক তথ্যের মাত্রাতিরিক্ত ভার নেই এই কাহিনিতে, আছে নিতান্তই এক নারীর মনের কথা। যাঁর চিন্তার পরিসরে থাকেন শুধুমাত্র সিরাজ। জারিয়া থেকে বেগম হয়েও মসনদের লোভে নয়, লুৎফা থাকতে চান সামান্য গৃহিণী হয়ে, মানসিক শান্তিতে। তাঁরই কথায়- “বেগম হওয়ার সুখ মর্মে মর্মে অনুভব করছি। আর হতে চাই না বেগম। সিরাজকে নিয়ে যদি কোথাও পালাতে পারতাম, কোনো নির্জন গাঁয়ের কোলে, তাহলে বেঁচে যেতাম। কী হবে ঐশ্বর্যে, কী হবে নবাবিতে? সাধারণ মানুষের, সাধারণ সুখ-দুঃখই ভালো। তাতে খুনোখুনি নেই। নেই ব্যভিচারও।”
চরিত্র-চিত্রায়নের দিক থেকে 'আমি সিরাজের বেগম' এক অসাধারণ উপস্থাপনা। নবাব আলিবর্দী,ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম,মোহনলাল এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির অবতারণা করেছেন লেখক এই কাহিনিতে। শুধু তাই নয়, ঘসেটি বেগমের চরিত্রে তিনি এক অন্য মাত্রা যোগ করেছেন। এমনকি লুৎফার চোখ দিয়ে পাঠকের সামনে সিরাজকে উপস্থাপন করার সময় নবাবের চরিত্রের প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি লেখক। তবে বেগম তাঁর ভালোবাসার খাতিরে নবাবের এই দোষের পক্ষে সওয়ালও খুঁজে নিয়েছেন নিজে থেকেই- "নবাবের মন কখনোই একজন বেগমের ওপর থেমে থাকেনা। এখানেই সাধারণ মানুষের সাথে তার পার্থক্য। এজন্যই তিনি নবাব।"
'নায়িকা নয়, এ কাহিনির নায়ক অতি সাধারণ ঘরের এক সাধারণ মেয়ে'। যাঁর মনের কথা লেখক খুবই সহজভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, পরিণত-মনস্ক পাঠিকা হয়তো এই কাহিনীর নির্যাস আরো সুচারুভাবে অনুধাবন করতে পারবেন। অপূর্ব এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন রঞ্জন দত্ত। বইয়ের বাঁধাই এবং পাতার মানও ভালো। লেখকের অন্যান্য ঐতিহাসিক কাহিনিগুলিও এবার একে একে শেষ করার ইচ্ছে থাকবে।