শ্রীপান্থের জন্ম ১৯৩২ সালে, ময়মনসিংহের গৌরীপুরে | লেখাপড়া ময়মনসিংহ এবং কলকাতায় | শ্রীপান্থ তরুণ বয়স থেকেই পেশায় সাংবাদিক | আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গে যুক্ত | সাংবাদিকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণামূলক রচনাদি লিখে যাচ্ছেন তিনি | তাঁর চর্চার বিষয় সামাজিক ইতিহাস | বিশেষত কলকাতার সমাজ ও সংকৃতি | তিনি সতীদাহ,দেবদাসী,ঠগী,হারেম-ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনিই কলকাতার পটভূমিতে লিখেছেন একাধিক রচনা | তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: আজব নগরী, শ্রীপান্থেরকলকতা, যখন ছাপাখানা এল, এলোকেশী মোহন্ত সম্বাদ, কেয়াবাৎ মেয়ে, মেটিয়াবুরুজের নবাব, দায় ইত্যাদি | বটতলা তাঁর সর্বশেষ বই | কলকাতার শিল্পী সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর বেশি কিছু প্রবন্ধ ইংরেজিতেও প্রকাশিত হয়েছে | বাংলা মুলুকে প্রথম ধাতব হরফে ছাপা বই হালেদের 'আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গোয়েজ'-এর দীর্ঘ ভূমিকা তার মধ্যে অন্যতম | পঞ্চাশের মন্বন্তরের দিনগুলোতে বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক কবিদের মধ্যে নব সৃষ্টির যে অভুতপূর্ব বিস্ফোরণ ঘটে তা নিয়ে লেখা তাঁর 'দায়'বইটির ইংরেজিতে অনুবাদ প্রকাশিত হতে চলেছে |
বইটি প্রথম দেখি পাঠক সমাবেশে। নাম দেখেই কৌতুহল হয়। কিন্তু লেখকের নাম অপরিচিত। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বেশ ভালো লাগল। বেশ আগ্রহোদ্দীপক, সুন্দর বর্ণনাভঙ্গি। কিন্তু নন-ফিকশনের প্রতি আগ্রহ কম থাকায় আর কোন খোঁজ খবর না করেই বইটি কিনতে মন সায় দিলো না। এরপর বাসায় এসে গুডরিডসে খোঁজাখুঁজি। চমৎকার সব রিভিউ বইয়ের। আফসোস হল ভালো একটি বই না নিয়ে চলে আসলাম।
এবার আসল কথায় আসি। 'ঠগী' সত্যিকারের ঠগীদের গল্প। তাদের খুন, লুঠ আর বিশ্বাসের গল্প। একটি অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কিভাবে হাজার হাজার মানুষ খুনি হয় আর কিভাবে তারা হাজার হাজার মানুষ খুন করে তার গল্প 'ঠগী'। নিপুণ তাদের হাতের কাজ। না থাকে কোন প্রমাণ না থাকে সাক্ষী। আর আছে এক 'ফিরিঙ্গী ঠগী'র কাহিনী। সাক্ষী, প্রমাণের এত অভাব থাকা সত্ত্বেও যার বুদ্ধি আর একনিষ্ঠতায় এই খুনি ঠগীদের বিনাশ হয়েছিল।
চমৎকার বর্ণনাভঙ্গি লেখকের। এমন গল্পের মত করে বলা ইতিহাস কার না ভালো লাগে। ইতিহাস নয় মনে হচ্ছিল থ্রিলার পড়ছিলাম।
"ঠগী" নিয়ে কৌতূহল আমার অনেকদিনের। শ্রীপান্থের এই বইটির খোঁজ পাই প্রায় বছর তিন আগে। কিনবো কিনবো করে আর কেনা পড়া কোনটাই হয়নি। অপেক্ষায় ছিলাম অনেকদিন। কিন্তু অপেক্ষা যে এতটা মধুর হবে ভাবতে পারিনি। এ যেন এক রূপকথার গল্প। অবিশ্বাস্য কাহিনী অথচ বাস্তব। আর এক যাদুকরের গল্প।
বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায় মূলত ১৩ থেকে ১৮ শতক জুড়ে ভারতবর্ষে ঠগীদের উৎপাত চলে। তখন ভারত ছিল যেন এক অবিশ্বাস্য দেশ। তার ঘর থেকে বের হলে মানুষ আর ঠিকানায় পৌছাতো না, তারা হারিয়ে যেত। পথিক হারিয়ে যেত, সিপাই হারিয়ে যেত, জমিদার হারিয়ে যেত, বণিক হারিয়ে যেত, নারী হারিয়ে যেত, শিশু হারিয়ে যেত। কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না তাদের। এই হারিয়ে যাওয়াই যেন ছিল প্রায় ৫ শ বছরের ভারতের প্রতিদিনের নিয়ম।
তখনও ডাকাত দল ছিল জলে-স্থলে। সামান্য কিছুর জন্য মানুষ মেরে ফেলতো তারা। ছিল ধুতুরিয়া, ঠ্যাঙ্গারে, তুসমাবাজ ঠগ, মেকফানসা, ছেলেধরা। কিন্তু সবচেয়ে বিভৎস আর ভয়ঙ্গকর ছিল "ঠগী"।
কারণে অকারণে তারা পথে নিরীহ পথিকদের খুন করত। শুধু খুন বললে ভুল হবে, খুন করে হাওয়ায় মিলিয়ে দিত। কেউ কোনদিন তার কোন চিহ্ন পেত না। ঠগীরা শুধু খুনীই নয়, ঠগী এক বিচিত্র বিশ্বাস।ঠগী যেন একটা ধর্ম। ওদের দেবী ভবানী বা কালী। হিন্দু মুসলমান উভয়েরই। ভবানীর নির্দেশেই তারা নাকি নিরীহ মানুষ খুন করত। শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ। তাদের ছিল সতন্ত্র ভাষা, ইশারা, সংকেত। ঢাল, তলোয়ার, বন্দুক বা ছুড়ি দিয়ে নয়। তারা খুন করতো হলুদ রঙের ছোট্ট একটা রুমাল দিয়ে। বন্ধু হয়ে নিরীহ পথিককে ভালোবেসে পাশে বসিয়ে এই রুমাল দিয়েই দিত ফাঁস। করে ফেলত গায়েব। কিন্তু প্রায় ৫ শ বছর ধরে চলা ঠগীদের এই নৃশংসতা তখনও দমাতে পারেনি কেউ।
আঠারো শতকের শুরুতেই সদ্য কুড়ি পেরুনো ইংরেজ যুবক উইলিয়াম হেনরী স্লীম্যান কলকাতায় পা রাখার আগে কেউ ভাবতেও হয়তো পারেনি ভারতবর্ষ কখনো ঠগীমুক্ত হবে। ভারতে আসার কিছুদিন পর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লাইব্রেরীতে ফরাসী পর্যটক এম থিভেনটের লেখা ভ্রমণকাহিনীতে প্রথম ঠগীদের কথা জানতে পারেন এই স্লীম্যান। তখন থেকেই শুরু হয় তার ঠগী খোঁজার সাধনা। এতটাই নিমগ্ন হয়ে পরেন যে তার নামই হয়ে যায় ঠগী স্লীম্যান। কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা আর নিরন্তর প্রচেষ্টায় বছরের পর বছর ধরে একেকটা ঠগী দলকে করায়ত্ত করেন স্লীম্যান। তাদের মুখে শোনেন ঠগীদের সবকিছু। সব লেখা হয়। সব খুনের ঘটনা, বিভৎসতা, পরিকল্পনা, বিশ্বাস সব। উদ্ধার করেন হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার পথিকের অস্থি। প্রায় ৩০ বছর ধরে দিনের পর দিন লেগে থেকে হিন্দুস্তানকে ঠগীমুক্ত করেন স্লীম্যান।
প্রায় ৪ শ বছর ধরে ঠগীদের নির্মমতার নানা ঘটনার পাশাপাশি স্লীম্যান নামের এক যাদুকরের গল্প বিস্ময় নিয়ে পড়েছি এই বইয়ে। স্লীম্যানের আত্মজীবনীতে আছে, ৩ শ বছরে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে ঠগীরা খুন করেছে। স্লীম্যান এই ঠগীদের দমন করতে না পারলে হয়তো সেই সংখ্যা কোটি কোটিতে পৌঁছাতো। ইংরেজরা ভারতবর্ষের জন্য ভালো যা কিছু করেছে তার মধ্যে সে সময়ের সিভিল সার্ভেন্ট স্লীম্যানের এই ঠগী দমন অত্যন্ত গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস।
স্লীম্যান ভারতবর্ষকে ভালোবেসেছিলেন। ভালোবেসেছিলেন এখানকার কৃষকদের। সাধারণ মানুষদের। বইটি শেষ হতে না হতেই ভারতীয় উপমহাদেশকে ভালোবাসা এই ইংরেজের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসবে নির্দ্বিধায়।
আর শ্রীপান্থ আমার বরাবরই পছন্দের লেখক। তবে ঠগী যেন তাকে আরো উপরে তুলে দিয়েছে। দুর্দান্ত ঝরঝরে ভাষায় ঠগীদের নিয়ে একেবারে আগাগোড়া সব যেন উঠে এসেছে দুই মলাটের মাঝে। ইতিহাসের বাস্তব ঘটনা লিখেছেন, অথচ মনে হবে দাদীর মুখে শুনছি রূপকথার গল্প।
কয়েক শতাব্দী আগে ভারতীয় উপমহাদেশের যা বাস্তবতা ছিল, আজ তা রূপকথার গল্পের মতই মনে হয়। অথচ এ-ও সত্যি ঘটনা। ঠগীদের মুখ থেকেই শোনা। আজকে কী ঠগী নেই? আছে। হয়তো অন্য নামে, অন্য সিস্টেমে। আজও সমাজে গুম হয়, খুন হয়, লুন্ঠণ হয়। আজ থেকে আরো এক শতাব্দী পর যখন নতুন প্রজন্ম আসবে, আর আজকের সমাজের এই কাহিনী যদি লেখা হয়, তাদের কাছেও হয়তো তা রূপকথার গল্পের মত শোনাবে। আজকের সমাজের বর্বরতার কাহিনী পড়ে তাদেরও হয়তো আমাদের মতই গা শিউড়ে উঠবে।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে এক হিসেবে দেখা গেলো প্রতি বছর গড়ে প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ (!) ঘর থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসতোনা। তাদের হদিস পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতোনা। কোথায় যেতো তারা? এর উত্তর 'ঠগী'!
সত্যি সত্যি এই নৃশংস, ধূর্ত, নিঁখুত খুনে গুপ্তঘাতক দল তিনশো বছরে অন্তত ১০লক্ষ মানুষকে উধাও করে দিয়েছে খালি হাতেই! বিশ্বাস করা যায়? এটা নিছক কোনো লোককথা নয়, সত্য ঘটনা। ঠগীদের সম্বন্ধে প্রথম জানি ছোটবেলায় পত্রিকায় একটা লেখা দেখে। কলকাতার লেখক শ্রীপান্থের ঠগী বইটার বদৌলতে নাড়ি নক্ষত্র দেখার সৌভাগ্য হয়ে গেলো।
ঠগীরা সেসময় আর দশজন যাত্রীর সাথে দল বেঁধে রওনা দিতো, তখন দূর দূরান্তে পায়ে হাঁটার রাস্তায় চলতো মানুষ। ৩০-৫০জন পথিকের একটা দলকে মাল পত্র গাড়িঘোড়া সমেত হাওয়া করে দিতো ঠগীরা। অস্ত্র? একটা রুমাল! একটা হাতলছাড়া কোদাল থাকতো কবর খোড়ার জন্য। অসহায় পথিকদের হত্যা করে তারা কবর দিয়ে দিতো মাটির নিচে। তাদের রীতিনীতি সুসংগঠিত যে কোন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মতোই সুনির্দিষ্ট। ঠগী-ধর্ম এক অদ্ভুত সমন্বয়বাদ। তারা সকলেই মা ভাবানীর সন্তান। তাদের তীর্থস্থান বাংলাদেশের কালীঘাটে। ঠগী শুধু খুনী নয়, ঠগী এক বিচিত্র বিশ্বাসও। ওদের চারদিক দেখেশুনে পথে নামতে হয়, চোখ-কান খোলা রেখে পথ চলতে হয়। 'রাতে বোলে তিতওয়ারা দিন কো বোলে শিয়ার, তুজ চৌলি ওয়া দেশরা, নৌহিন পুরী আচানুক ধা।'
টিকটিকির 'টিকটিক' করে ওঠা, মাথা থেকে পাগড়ী পড়ে যাওয��া, ডাইনের ডালে ঘুঘু বসে থাকা ইত্যাদি ইঙ্গিত দেখেশুনে তারা রওনা দিতো কিংবা দল টার্গেট করতো। যে কাউকে একা পেলেও যত মূল্যবান হোক হত্যা করতোনা। তাদের নিজস্ব মতবাদ তারা ধর্মের মতো মানতো। রামসী (Ramasee) নামে তাদের নিজস্ব ভাষাও ছিলো! সেই ভাষায় প্রতি সন্ধ্যায় শত শত খানে উচ্চারিত হতো মা ভবানীর আদেশে মৃত্যু-পরোয়ানা --তামাকু লাও!
এই ঠগীদের মূল উপ্রে ফেলেছিলেন যেই ব্যক্তি তাঁর নাম মেজর জেনারেল স্যার উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যান। ভারতবর্ষকে এক হাতে ঠগীমুক্ত করেছিলেন এই ভদ্রলোক। 'ঠগ বাছতে গাঁ উজার' কথাটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি! ১৮৪৮ সালে সম্পূর্ণভাবে ভারত ফিরিঙ্গী ঠগী মুক্ত হয়। কালক্রমে ধুতুরিয়া, বাজীকর, তুসমাবাজ, ম্যাকফানসা, ভাগিনা, ঠ্যাঙ্গারে এরকম আরও অনেক ধূর্ত ঘাতকদল গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু তারা কেউ ঠগী নয়। কেউ তাদের ধারেকাছেও যেতে পারবেনা। ইতিহাসের পাতায় তাদের মতো বর্বর আর কে হতে পারবে?
আমার চমৎকার লেগেছে বইখানা। শুরুর অংশ ঠগী কি, ঠগী কারা সেই ইতিহাস, তাদের পরিচয় মধ্যভাগে, শেষভাগে স্লীম্যানের তদন্ত বিভিন্ন ন্যারেটিভে বর্ণিত হয়েছে। আমি সামান্য একটু তারা কেটে রাখছি কারণ আমার মনে হয়েছে বইটা আরেকটু গোছানো হতে পারতো।
দুটো বাক্য। কিন্তু নিছক সাধারণ কোনো বাক্য নয়। এ এক অমোঘ মৃত্যুপরোয়াণা। যার উদ্দ্যেশ্যে এটা উচ্চারিত হয় কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে হারিয়ে যায় এই পৃথিবী থেকে। কারা এটা করে? কারা উচ্চারণ করে এই মৃত্যুবাক্য? নাম তাদের - ঠগী। ইতিহাসের দুর্ধর্ষতম,নিপুণতম এবং একইসাথে সবচেয়ে নিষ্টুরতম খুনী এই ঠগী। যারা গল্প উপন্যাসের চেয়েও শতগুণ বেশি নৃশংস।
এই ঠগীদের ব্যাপারে টুকটাক এখানেওখানে পড়লেও এই প্রথম জানলাম তাদের অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত..... সবকিছুই। বইয়ের নাম দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ হয়তো নিছকই ঠগীদের নিয়ে লেখা। আমিও এই ভুলই করেছিলাম। কিন্তু এই বইটিতে ঠগীদের সাথেসাথে খুঁজে পাবেন উনিশ শতকের ভারতকে। খোঁজ পাওয়া যায়,তৎকালীন ভারতের অন্যান্য সংঘবদ্ধ,বিচিত্র সব অপরাধের। আর.... খুঁজে পাবেন এক যাদুকরকে। নাম তার, 'উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান।' তাকে যাদুকর বলছি কেন? বা ঠগীদের নিয়ে লেখা বইয়ের সাথে তার কী সম্পর্ক? সাথে আরও একটা প্রশ্ন করে রাখি,তিনশ বছরে কিভাবে একটা দেশ থেকে হারিয়ে যেতে পারে প্রায় দশলক্ষ মানুষ? কিভাবে সম্ভব সেটা? সেসব প্রশ্নের উত্তর নাহয় আগ্রহী পাঠকদের জন্যে তোলা থাক।
ননফিকশন এই বইটি পড়তে গিয়ে একবারের জন্যেও মনে হয়নি,এটা কোনো ননফিকশন পড়ছি। ঠগীদের ব্যাপারে এতো নিঁখুত, এতো দুর্দান্ত বর্ণনা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এমনই সে বর্ণণা যে পড়তে পড়তে কোথাও শিউরে উঠতে হয়। কখনও বা জন্মাবে নিখাদ ঘৃণা। তাছাড়া দারুণ মেদহীন বর্ণণায় তরতর করে এগিয়ে গেছে বইটি। একবার পড়া শুরু করলে আটকে যেতে হয় পারিপার্শ্বিক কাহিনী আর লেখক 'শ্রীপান্থ'র অদ্ভুত সুন্দর লেখনীর জন্যে। সুতরাং সব মিলিয়ে রেটিং দিতে হলে ৫-এ ৫-ই দিবো আমি।
ঠগীদের নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়া হয়েছে কিছু বইয়ে। মুভিতেও দেখেছি এদের উপস্থিতি নিয়ে কাহিনী। এই জন্য আগ্রহ ছিল এই বইটার ব্যাপারে। উইশলিস্টে অনেক দিন ধরেই ছিল। এবার সুযোগ বুঝে পড়ে নিয়েছি বইখানা। খুব সুন্দর গোছানো একটা বই।
ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া ছোট এক দলের উদ্দেশ্য, কয়েক মাইল পার হয়ে যাবে এক জেলায়। সাথে কিছু মূল্যবান সম্পদ, দলে আছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। সন্ধ্যা নামায় যাত্রাপথে বিরতি, তাবু খাটিয়ে রাত্রিযাপনের পরিকল্পনা। পরের দিন ভোরবেলা, কিংবা তার পরের দিন বা তার পরের দিন আর খোঁজ নেই সেই ছোট্ট দলের, যেন পৃথিবীপৃষ্ঠে নেই তাদের অস্তিত্ব।
প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া নির্মম ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যেন এক নিয়মিত চিত্র ছিল ভারতবাসীর জন্য। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ ছিল ইতিহাসের সবচে নিষ্ঠুর ডাকাতদল,'ঠগী'। তারা শুধু মূল্যবান সম্পদ হরণ নয়, সম্পূর্ণ দলটার অস্তিত্বই মিলিয়ে দিতো রাতের অন্ধকারেই। ঠগীদের উৎপাতে বছরের পর বছর মানুষ উধাও হয়ে গিয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার পর আদৌ গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যেতে পেরেছে কজন তার হিসাব থেকে যেন না পৌঁছানো মানুষের হিসাব অনেক বেশি। সমগ্র ভারতবর্ষে যাদের এই তাণ্ডব, তারা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অন্য জগতের নিজস্ব রীতিনীতি আর ধর্মবিশ্বাসে আবদ্ধ।
ভারতবর্ষে ডাকাতদলের নাম ছিল ভিন্ন ভিন্ন। কেউ ধুতুরিয়া, কেউ ভাগিনা, আবার কেউবা ম্যাকফানসা বা ঠ্যাঙ্গাড়ে হত্যাকারী। তাদের ছিল ভিন্ন কৌশল, উদ্দেশ্য, ভাষা আর ভিন্ন অস্ত্র। তবে সবচে ভয়ংকর ছিল ঠগী। ঠগীদের দলের সবচে অবাক করা বিষয় ছিল এ দলে হিন্দু মুসলমান সবাই মানত এক দেবীকে,তার নাম ভবানী। মা ভবানীর আদেশেই ও দিকনির্দেশনায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতো তারা।
এই দলকে দমানোর ইচ্ছা কিংবা ক্ষমতা যখন কেউ দেখায়নি তখন ইংরেজ যুবক উইলিয়াম হেনরী স্লীম্যানের আবির্ভাব। যার একার আগ্রহ ও একাগ্রতার জন্য শেষ হয়েছে দীর্ঘ পাঁচশ বছরের ঠগীদের তাণ্ডব। 'ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়' প্রবাদের প্রচলন হয়েছিল স্লীম্যানের এই ঠগ দমন অভিযানের কারণেই। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে গেছেন এখানেই।
প্রচুর তথ্যবহুল একটা বই, বিস্তারিত জবানবন্দীসহ ঘটনার বর্ণনা আছে তাই ধৈর্য নিয়ে পড়া উচিত। ঠগীদের জবানবন্দির বর্ণনাগুলো লেখক লিখেছেন এমনভাবে যেন আগ্রহ থাকে শেষ অবধি। এখন আমরা অনেকেই অনেক লোমহর্ষক সিরিয়াল কিলিংয়ের কাহিনি শুনি, ঠিক এই বইটি পড়ার পর মনে হয়েছে ঠগীরাও ঠিক তাদের কাতারেই পড়ে।
"সাহেব খান,তামাকু লাও" সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ল একসাথে ৭/৮ জন নিরীহ তীর্থ যাত্রী কিংবা পথিক। এই পড়ার সাথে সাথে হারিয়ে যেতো মানুষগুলো। কোথায় যেত সে কেউ জানে না। সবাই ভাবত বাঘের পেটে গিয়ে থাকবে বা অন্য কিছু! কিন্তু না! বাঘের চেয়ে ভয়ংকর ফাঁদ পেতে রাস্তায় রাস্তায় অপেক্ষা করত একদল ভয়ংকর মানুষ। যাদের হৃদয়ে কোন মায়া দয়া ছিল না। ইতিহাসের জঘন্যতম খুনি এরা।
খুনের কাজে কোন অস্ত্র তারা ব্যবহাত করত না। তাদের দেবীর নির্দেশ ছিল শিকারের রক্ত যেন না ঝড়ে। এরা খুন করত রুমাল দিয়ে। এই রুমালে দিয়ে এমন নিখুঁত ভাবে কাজ করত যে,সে যাত্রাতে বেঁচে ফেরার কোন সুযোগ থাকতো না।
এভাবেই এদের হাতে তিনশ বছরে চল্লিশ লক্ষ মানুষ খুন হয়েছে।
এই কুৎসিত খুনীদের নাম " ঠগী "।
অপরাধ করবে,কিন্তু তার ক্ষমা পেয়ে যাবে তা হবে না। ঠগীদের ও শেষ রক্ষা হয় নি। স্লীম্যান নামক এক ইংরেজ দমন করেছিল এই খুনিদের। তাই ইতিহাসের পাতা মনে রেখেছে এই মহান মা���ুষটিকে।
"সাহেব খান, তামাকু লাও" - এই কথাটা যে আসলে কি বুঝায়, সেটা বুঝতে পারার পর যতবারই পরে এই লাইনটা সামনে এসেছে, ততবারই আমার ঘাড়ের কাছের লোমগুলো সরসর করে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিবারই মনে হচ্ছিলো যে আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি কয়েকজন ঠগী মিলে একজন বা অল্প কয়েকজন অসহায় পথিকের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করছে নির্মম, বজ্র কঠিন কন্ঠে। শুধুমাত্র একটা বাক্য। একবারই শুধু 'ঝিরণী' দিয়ে ওঠা আপ্তবাক্য - "সাহেব খান, তামাকু লাও"। ব্যস। তাতেই শেষ। মুহূর্তেই পথিক গায়েব! পথিকের নাম নিশানা সহ গায়েব!
এই বইটা না পড়লে জীবনটা অপূর্ণ থেকে যেতো শিউর। এটা স্বীকার করতেই হবে আমাকে। না করে উপায় নাই। এত্ত সুন্দর করে লেখা নন ফিকশনও আগে পড়িনি কোনোদিন। মারাত্মক জিনিস!
পথ চলছে জনাকয়েক পথিক। গন্তব্য এখনো অনেক দূর। রাস্তা বিপদসঙ্কুল। যে কোন মূহুর্তে হতে পারে চোর ডাকাতের হামলা। আর বাঘ, সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের ভয় তো আছেই। তাই দুরদুরু বুকে পথ চলছে তারা। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা মিললো তাদের মতোই কয়েকজন পথচলা পথিকের সাথে। তাদের গন্তব্যও প্রথম পথিকদের কাছাকাছি। তারাও পথঘাটের চোর ডাকাত নিয়ে ভীত। আলাপ হল দুই দলের। ভালো ও লাগলো। তবে একসাথেই চলা হোক। এতে এক দলের বিপদে আরেকদল সাহায্য করতে পারবে। সম্মতি প্রকাশ করলো দুই দল। শুরু হল পথ চলা। গান বাজনা আর আনন্দ করতে করতে পথ চলছে ওরা। ইতোমধ্যে সবাই নিজ নিজ বাসায় আসার দাওয়াত ও দিয়ে দিয়েছে দুই দলের লোকজন। সানন্দে গ্রহণ করছে সেই দাওয়াত। সন্ধার পর বসে জমজমাট গল্পের আসর। সম্পূর্ণ আসর মাত করে রাখেন পথে দেখা হওয়া সেই দ্বিতীয় দলের দলপতি। নানা দেশ ঘুরেছে সে। অভিজ্ঞতা অনেক। তাই গল্পের স্টকও অনেক। সবাই তন্ময় হয়ে শুনে। প্রতিদিনের মত আজও আসর বসেছে। খাওয়া দাওয়ার পর যথারীতি গল্পের আসর বসেছে। হঠাৎ দলপতি তার দলের একজনকে আদেশ দিল "সাহেব খান, তামাকু লাও "। শ্রোতারা ভাবল নিশ্চয় তামাক খাবার শখ হয়েছে তার। তাই মুচকি হাসলো। আসুক তামাক। তারাও টানবে সাথে। কিছু বুঝে উঠার আগেই কে যেন একযোগে প্রথম দলের সবার গলায় রুমালের ফাসঁ পরিয়ে দিল। বাকিরা চেপে ধরল হাত পা। মিনিট দুইয়ের মধ্যেই বেরিয়ে গেল প্রাণবায়ু। তামাক আর খাওয়া হল না তাদের। হতভাগা পথিকরা জানতেও পারল না যে তামাক আনার কথা বলা হয়েছিল তা আসলে তাদের মৃত্যুর পরওয়ানা ছিল। পরের দিল সকাল বেলা দ্বিতিয় দল যথারীতি যাত্রা আরম্ভ করল। প্রথম দলের একজন লোকেরও কোন পাত্তা নেই। যেন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। আসলেও তাই। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেল কয়েকজন মানুষ। তাদের আর পাত্তা পাওয়া যাবে না। কেউ যানবে না কি হয়েছিল তাদের। শুধু কি এই অল্প কয়েকজন মানুষ হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে ? না! ঠিক একই কায়দায় এর আগেও হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ভারতের বুক থেকে। আজকের মানুষ গুলো তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। শুধুমাত্র দলনেতার একটি কথায় মরছে হাজারো হাজার মানুষ - "সাহেব খান, তামাকু লাও "। ব্যাস শুধু এই কথাটুকুই ছিল যথেষ্ট। কারা এরা? কেন একই কায়দায় মানুষ মারছে। তারা হচ্ছে তারা ঠগী। উপমহাদেশের ইতিহাসের এক দুর্ধর্ষ খুনে দল। তাদের দেবী মা কালী। তারা ডাকে ভবানী বলে যাদের উপস্থিত মানুষের অজানা ছিল প্রায় ৬০০ বছর। গড়ে প্রতিবছর যাদের হাতে মারা পড়তো ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ। লাশগুলো স্রেফ হাওয়া হয়ে যেত। কিভাবে মেরেছিল তারা এই হাজার হাজার মানুষ? উত্তর - স্রেফ একটি ৩০ ইঞ্চি রুমাল দিয়ে। জি হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন। ৩০ ইঞ্চি রুমালের আঠারো ইঞ্চিতে থাকতো একটি গিট । আর রুমালের দুই পাশে দুটো তামার কয়েন বাধা। উপযুক্ত হাতে পড়লে এই ছোট্ট রুমালই হয়ে উঠতো মারাত্মক মরনাস্ত্র। একটি তিরিশ ইঞ্চি রুমাল দিয়ে এক একজন ওস্তাদ ঠগী জীবনে হাজার বারোশ মানুষ মেরেছে। আর যাদের ভাগ্য খুবই খারাপ তারাও ৩০ জনের নিচে মারেনি। তারপর হঠাৎ করেই নৃশংস এই খুনিরা পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিল? কিন্তু কিভাবে? সেও আরেক ঠগীর বদৌলতে। নাম তার ফিরিঙ্গী ঠগী। উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যান। কিন্তু কিভাবে? কিভাবে মানুষের নাকের ডগা দিয়ে ডগা দিয়ে প্রায় ৬০০ বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে ঠগীরা। কেন তাদের অস্তিত্ব আগে কেউ জানতো না। কারা এরা? কি তাদের উদ্দেশ্য। শুধুই কি টাকা পয়সায় জন্য নাকি অন্য কোন কারণ আছে পিছনে? যানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে ঠগীদের একটি অসামান্য বই। যার প্রতি পৃষ্ঠা আপনাকে অবাক করবে। আপনি হবেন হতবাক। ঠগীদের কার্যক্রম আর জীবন যাপন আপনাকে শুধু বিস্ময়ই করাবে না বাকরুদ্ধ করে দিবে।
ভারতীয় উপমহাদেশের গোপন কাল্ট ঠগীদের নিয়ে এক অসামান্য বই। অসাধারণ বললেও কম বলা হবে। বইতে খুব সহজ ভাষায় উঠে এসেছে তাদের জীবন যাপন, আচার ব্যাবহার, কার্যক্রম ইত্যাদি। কিভাবে তারা মানুষের নাকের ডগা দিয়ে তারা টিকিয়ে রেখেছিল তাদের গোপণ এই ধর্মকে। সেখানে হিন্দু মুসলমানদের কোন ভেদাভেদ ছিল না। তাদের সবারই একই পরিচয়, তারা ভবানীর সন্তান। যাদের ইতিহাস কাল্ট নিয়ে আগ্রহ আছে তাদের জন্য একটি অবশ্য পাঠ্য বই। কোনভাবেই মিস করা যাবেনা
যের জিনিস ভালো লাগে নাই -
কিছু কিছু জায়গায় সাল ভুল করেছে ! ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টি কটু দেখিয়েছি। একই অসাধারণ বইয়ের এই ক্ষুদ্র ভুল সময়ের হিসেবে যেমন গোলমাল লাগিয়ে দেয় তেমনি পড়াও কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে বটে।
ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য, আর অগুণতি রহস্যের একটি 'ঠগী'। একটা সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠী, যাদের পেশা ছিল পথিকদের হত্যা করে তাদের সর্বস্ব লুঠ করা। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু না। কিন্তু ঠগী, ব্যতিক্রম। তাদের বৈশিষ্ট্য তারা রেশমী রুমালের ফাঁসে মানুষ হত্যা করে। যাদের হত্যা করে, তাদের লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
ঠগী এক ভিন্ন ধর্ম। সেখানে তাদের দেবী ভবানী, কিংবা কালী। কিন্তু অদ্ভূত বিষয় হলো, ঠগী মুসলিমও হতে পারে। মুসলিম আচার পালন করে তারা, বিয়ে শাদি হয় ইসলামি রীতিতে। কিন্তু ভবানীকে দেবি মানে তারা। ঠগীদের ভাষা আলাদা। তারা মনে করে যেসব মানুষকে তারা হত্যা করছে তা করছে তারা দেবীর আদেশে।
মোগলদের শক্তি তখন শেষ, টিকে আছে শুধু নাম। নাদির শাহ্, আহমদ শাহ্ আবদালীদের লুন্ঠনে ভারত তখন ধুকছে। আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে কোম্পানীর শাসন। সেই সময়ে ঠগীদের হাতে বেমালুম নিখোঁজ হয়ে যেতো অনেক মানুষ। ফিরিঙ্গী যুবক স্লীম্যান সেই ঠগী দমনে নামেন। আঁটঘাট বেঁধে প্রচুর গবেষণা, আর বিস্তর পরিশ্রমে সমূলে উৎখাত করেন ঠগী। তাদের পরিবারের জন্য পূনর্বাসনের ব্যবস্থাও করেন। আর তাই তার নামে হয়ে যায় 'ঠগী স্লীম্যান'।
শ্রীপান্থর 'হারেম' পড়ে যতটা বিরক্ত ছিলাম, 'ঠগী' পড়ে ততটাই সন্তুষ্ট। লেখার কৌশল চমৎকার, প্রচুর তথ্য দেওয়া কিন্তু এগিয়েছে গল্পের মতো, হাঁপিয়ে পড়তে হয় না।
অদ্ভুত রকমের সুন্দর রোমহষর্ক বই। নন-ফিকশন ধাঁচের ইতিহাসের ভিত্তিক বই হলেও পাতায় পাতায় থ্রিলার। একেকটা ঘটনা গায়ের রোম খাড়া করে দেয়ার মতন।মনে হচ্ছে এখনো শুনতে পাচ্ছি "সাহেব খান,তামাকু লাও"
সুতরাং ‘জয় ভবানী’–পাতালের এই মন্ত্র নিয়ে শুরু হল ভারতময় হিন্দু- মুসলমানের এক বিস্ময়কর মিলিত সাধনা—খুন, খুন, খুন। রাজস্থানের মরুপ্রদেশে, পাঞ্জাবে সিন্ধুতীরে, উত্তরে গঙ্গা-যমুনার বিশাল অববাহিকা ঘিরে, দক্ষিণে নর্মদা- গোদাবরী উপত্যকা জুড়ে—সমগ্র ভারতের পথে পথে নিঃশব্দ পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার খুনী। বছরের পর বছর, শতকের পর শতক। তাদের কালো কালো শীর্ণ হাতগুলোতে পুরুষানুক্রমিক খুনের অভিজ্ঞতা, তাদের প্রশান্ত চোখের আড়ালে শত শত বছরের সাফল্যের ইতিকথা।"
'ঠগী' ভারতীয় উপমহাদেশের এক কালো অধ্যায়ের খলনায়কদের উপাধি। সাধারণ ভারতীয় মানুষ শীর্ণকায় দেহ, চোখগুলো আর দশটা মানুষের মতো। নিজেদের পরিবার আছে। নেই কোন বৈপরীত্য তখনকার আর দশজন ভারতীয় মানুষদের সাথে। কিন্তু উনবিংশ শতকের আগে সমগ্র ভারতীয় মহাদেশজুড়ে ত্রাশের সঞ্চার করেছিলো এই ঠগীরা। সমগ্র ভারতজুড়ে তাদের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চল থেকে বড় বড় শহরে। বর্ষা পর্যন্ত চাষবাসে ব্যস্ত থাকে এই মানুষগুলো। শীত আসতেই পথে নামে, হাতে উঠে আসে এক টুকরো রুমাল। সেটাই হয়ে উঠতো তাদের অস্ত্র। জমাদার সংকেত দিতেন 'ঝিরণী' দেওয়ার। "সাহেব খান, তামাকু লাও" আর তাতেই পথিক হয়ে যেতো অদৃশ্য। শতশত পথিক পৃথিবীর বুক থেকে যেতো হারিয়ে। 'রামসি' হলো তাদের নিজস্ব ভাষা। উনবিংশ শতকের আগের তিনশো বছরের প্রতিবছর গড়ে চল্লিশ হাজার মানুষ খুন করছিলো ঠগীরা। তাও সামন্য ফাঁসের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসে এমন সুসংগঠিত খুনির দল হয়তো খুব একটা পাওয়া যাবে না। এক ঠগীর জবানবন্দী অনুসারে সে তার সমস্ত জীবন জুড়ে ৯৮১ টি খুন করেছে সে নিজে।
এই আপাততঃ নিরীহ দেখতে মানুষগুলোর মধ্যে হিন্দু এবং মুসলমান সবাই থাকতো। কোন বিবাধ ছিলো না তাদের মাঝে। সবাই দেবী ভবানীর ভক্ত। তাদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান হলো কলকাতার কালীঘাট মন্দির। ঠগীরা পথিকদের খুন করে, হাতিয়ে নেয় নদগ অর্থ, সম্পদ, মূল্যবান জিনিস। এই ঠগীরাই আবার নিজেদের মাঝে লুণ্ঠন করা সামগ্রী ভাগের মধ্যে ছিলো সমান পন্থা অবলম্বনকারী। কেউ বেশি কেও কম নয়। সকলে সমান ভাগ, ছোট থেকে বড় সবাই। তাদের আচার আচরণ সংস্কার গুলোও তাক লাগানোর মতো।
তারা নিজেদের দেবী কালীর সন্তান বলে থাকে। দেবী রক্তবীজ নামক অসুরকে বধ করতে গিয়েছেন। যতবার বধ করেন ততবারই রক্তবীজের প্রতিটি রক্তের ফোঁটা থেকে সৃষ্টি হয় নতুন রক্তবীজ নামক অসুর। দেবী বধ করতে করতে যখন ক্লান্ত তখন দেহের স্বেদবিন্দুর দুইটি ফোঁটা মাটিতে এসে পড়লো। তা থেকে সৃষ্টি হলো দুইটি মনুষ্য। দেবী তার হাতের রুমালখানা দুই মনুষ্যকে দিয়ে বললেন, 'বৎস এই তোমাদের অস্ত্র, এই দিয়ে বিনাস করো' সেই মনুষ্য যুগল দেবীর দেওয়া রুমাল দিয়ে ফাঁস তৈরি করলেন। তা দিয়ে রক্তবীজকে দমন করলেন। সৃষ্টি হলো ঠগীর। তাই তারা নিজেদের দাবী করেন দেবী ভবানীর সন্তান।
ঠগী নিয়ে অনেকিছু আগে থেকে জানা থাকায় সব তথ্য চমকাতে পারেনি ঠিক তবে অনেক নতুন তথ্য চমকাতে বাধ্য করেছে। স্লীম্যানের ঠগী শিকার থেকে শুরু করে সবকিছু। ঠগীদের নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই বই দিয়ে পড়া শুরু করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডিটেকটিভ গল্পে আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, "আমাদের দেশের অপরাধীগুলা ভীরু এবং নির্বোধ, অপরাধগুলা নির্জীব এবং সরল, তাহার মধ্যে দুরূহতা দুর্গমতা কিছুই নাই। আমাদের দেশের খুনী নররক্তপাতের উৎকট উত্তেজনা কোনোমতেই নিজের মধ্যে সংবরণ করিতে পারে না। জালিয়াত যে জাল বিস্তার করে তাহাতে অনতিবিলম্বে নিজেই আপাদমস্তক জড়াইয়া পড়ে, অপরাধব্যূহ হইতে নির্গমনের কূটকৌশল সে কিছুই জানে না।" ঠগী বইটি পড়ার পর মনে হলো, কবিগুরু কি ঠগীদের ব্যাপারে জানতেন না?
ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়- এই কথাটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু কথাটি কোত্থেকে এসেছে জানি কি? ঠগী, একটি দুই ভাঁজ করা রুমাল এবং একটু আধুলি ছিল যাদের মানুষ মারার প্রধান অস্ত্র, কোনোরকম রক্তপাত ছাড়াই- তাদের সংখ্যা কোনো কোনো গ্রামে এমন পরিমাণ ছিল যে সেই গ্রামে কে ঠগী না, তা বাছতে গ্রামই উজাড় হয়ে যায়। যে ভারতবর্ষকে আমরা শান্ত-স্নিগ্ধ বলে কল্পনা করি, সেই স্বাভাবিক শান্তিময়তার স্রোতের মধ্যে একটি হালকা-চিকন প্রায় অদৃশ্য যে রক্তের ঢেউ ছিল, তার প্রধান হোতা এই ঠগীরা।
শ্রীপান্থের লেখা 'ঠগী' বইটি তথ্যবহুল, অনেককিছুই বিভিন্ন বই থেকে ধারদেনা করে সংগ্রহ করে লেখা হয়েছে- কিন্তু মাসুদ রানা পড়ে যে উত্তেজনা পাই, ঠিক কিংবা তার চেয়েও বেশি শিহরিত হয়েছি এই ঠগী বইটি পড়ে। কী নেই সেখানে? শ্রীপান্থের লেখা বইটি ঠগীদের সম্পর্কে আরও জানার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিলো।
ঠগী নিয়ে শ্রীপান্থ যা পড়ালেখা করেছেন কিংবা তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তাতে বইটির কলেবর আরও বড় হতে পারতো। বিশেষত ঠগীদের জীবনযাত্রার বিষয়গুলো সেখানে অনেকটাই অনুপস্থিত- যতোটা সরব উপস্থিত তাদের মানুষ খুন করার কাহিনী, স্লীম্যানের বীরত্ব কিংবা তাদের বধ করার ঘটনাগুলো। ঠগীরা 'ঝিরনী' দেয়ার কাজে আস্তে আস্তে পটু হতে থাকে, এই পটুত্ব কীভাবে ঘটে- তার বর্ণনা এসেছে বটে, কিন্তু পাঠকমন আরও কিছু জানার দাবি করে। কী কৌশলে রুমালটা ছুঁড়ে মারে, নিমিষেই কীভাবে পিঠের হাড় ভাঙা হয়- এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না থাকায় ঠগীদের মাঝেমধ্যে অলৌকিকই মনে হয়। তাছাড়া তারা যেভাবে দিনের পর দিন অধ্যবসায় নিয়ে ফলো করে একপর্যায়ে খুন করে- সে সম্পর্কে ভারতবর্ষের গ্রামবাসীরা কতোটুকু জানতো, তাদের মনোভাব কী ছিল ইত্যাদি বিষয় থাকলে বইটি পূর্ণাঙ্গ হতো।
অবশ্য কোনো বইই পূর্ণাঙ্গ চিত্র দিতে পারে না। পাঠকমন অদ্ভুত- একটার পর একটা চাইতেই থাকে। এই ঠগী বইটি যে ঠগীদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিলো- এখানেই তো বইটির সার্থকতা। তাই না?
It was so well-written and informative that it nearly seemed like a mystery or detective story, despite the fact that it was based on real events. Definitely recommended, and looking forward to reading more of the author's work.
অসম্ভব ইন্টারেস্টিং একটা টপিক নিয়ে লেখা বইটি পড়ে বেশ মজা পেলাম। নন-ফিকশন হলেও এত গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো মাঝে মাঝে। লেখক এমন অজানা একটি বিষয় নিয়ে এত সুন্দর একটি লেখা লিখেছেন, তার জন্য হ্যাটসঅফ ❤️
স্বপ্নেও ভাবিনি খুন-খারাবি নিয়ে লেখা কোন বই এত আগ্রহ আর রোমাঞ্চসহকারে পড়বো। তাও আবার এমন বিশেষ শ্রেণীর দস্যুদল যারা পথিকের গলায় রুমাল বা কাপড় জড়িয়ে হত্যা করত, তাদের নিজস্ব ধর্ম ছিল এমনকি নিজেদের মাঝে কথা বলার জন্য ভাষাও (রামসি) ছিল। ‘ঝিরনী�� শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো। ঠগীদের খুনের অস্ত্রটা ছিল বেশ অবাক করার মতো। অতি সাধারণ এক ফালি কাপড়ের টুকরো। কি সাংঘাতিক! উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যানের হিসাব অনুযায়ী ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগিরা ভারতবর্ষে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল।
উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যান যিনি ভারতবর্ষের সেই দুধর্ষ ঠগীদের নির্মূল করেছিলেন অথচ যার নাম কোনদিন স্কুল বা কলেজের ইতিহাস বইয়ে পাইনি। গর্ভনর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক তাকে ঠগীদের নির্মূলে আদেশ দিয়েছিলেন। তারপর সেই ইংরেজ কোন এক যাদুমন্ত্রবলে সত্যি সত্যি ঠগীদের ইতিহাসের পাতায় চিরতরে স্থানান্তর করে দেন।
সেই লড়াকু শ্লীম্যানের ঠগীদের ধরবার কৌশল ছিল আরো বেশি রোমাঞ্চকর। রীতিমত ম্যাপ এঁকে, কৌশল নির্ধারণ করে, তাদের ভাষা রপ্ত করে, নানা হিসাব আর ছক কেটে পরিকল্পনা তৈরি ক��তে হয়েছিল তাকে। যাকে দুধর্ষ ঠগীরাও বলতো ‘প্রেরিত পুরুষ’। তার নিশানা কখোনো ভুল হয়নি। দুর্ধর্ষ ঠগি-সর্দারদের অনেককে রাজসাক্ষী বানিয়েছিলেন তিনি আর তাদের পরিবারকে নতুন পেশা আর পরিচয়ে যুক্ত করেছিলেন। “ঠগ বাছতে গাঁ উজার” প্রবাদবাক্যটি উনার কারণেই উদ্ভব হয়েছিল সেটা জেনেও দারুন লাগলো।
ভারতবর্ষে ঠগীদের সত্যিকারের কাহিনী, তাদের কাজকর্ম আর ঠগী নির্মূলে শ্লীম্যানের কৌশল সম্পর্কে জানতে হলে এই বইয়ের কোন তুলনাই হয়না। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল দূরে কোথাও রাস্তায় চলা পথিক দেখে কোন ঠগী তার সহচরকে ঝিরনী তুলতে বলে আদেশ দিচ্ছে “সাহেব খান, তামাকু লাও।” এ এক দুস্বপ্ন!
প্রথমেই একটি দৃশ্য কল্পনা করুন। ধরুন আজ থেকে দেড়শো বছর আগে ভারতবর্ষের কোনো এক গ্রামে আপনার জন্ম। সাধারণ গৃহস্থ মানুষ আপনি। অভাব অনটনের দায়ে বা ভাগ্যের অন্বেষণে নিজের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেছেন। উদ্দেশ্য অন্য গ্রাম বা শহরে যেয়ে ব্যবসা করে দু পয়সা উপার্জন করে নিজের আর পরিবারের অভাব ঘুচানো। তো অজানা অচেনা পথে হাঁটতে হাঁটতে কিছু মানুষের সাথে আপনার দেখা হলো। উনারাও আপনারই মতো। আপনার গন্তব্য যেখানে, উনারাও সেদিকেই যাবেন। খুবই অমায়িক তাদের ব্যবহার। খুব অল্প সময়েই মিশে গেলেন আপনার সাথে। আপনার যত্নআত্তি করা শুরু করলো তারা। আপনিও তাদের আচার ব্যবহারে সন্দেহ করার মতো কিছু না পেয়ে বিশ্বাস করলেন তাদের। তার উপরে অচেনা জায়গা। মানুষগুলোর ব্যবহারও অবিশ্বাস করার মতো না। আবার দলে আছেও অনেক জন। আপনি এত মানুষ দেখে বুক ভরা বিশ্বাস নিয়ে তাদের দলে ভিড়ে গেলেন। চলতে চলতে সন্ধ্যা হলো। আপনারা সবাই একসাথে পথশ্রমে ক্লান্ত, কোনো এক জায়গায় ঘাঁটি গাড়লেন। রাত্রে বেশ ভালো খাওয়া দাওয়া হলো। খাওয়া শেষে সেই দলের দলনেতা সবাইকে নিয়ে আসরে বসলেন। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো- "সাহেব খান, তামাকু লাও" কথাটা কানে যেতে না যেতেই কেউ একজন চোখের পলকে আপনাকে পেছন থেকে শুইয়ে গলায় একটা ফাঁস পরিয়ে হেঁচকা টান দিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই আপনার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটলো এবং এই ঘটনা যে ঘটলো আপনার লাশটাও কেউ কখনো খুঁজে পেল না। আপনার পরিবারও আপনার আশায় বসে থেকে থেকে চোখের জল শুকিয়ে মরলো।
কি? অবিশ্বাস্য, রূপকথা মনে হচ্ছে? না একদমই রূপকথা নয়। কোনো গল্পকাহিনীও নয়। বরং আজ থেকে দেড়শো বছর বা তারও আগে ভারতবর্ষে এইটাই ছিল পথিমধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের বাস্তব নিয়তি। যেমন বর্ণনা উপরে পড়লেন, মোটামুটি সেরকম ভাবেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতো একেক জন হারিয়ে যাওয়া পথিক৷ তাদের আর খোঁজও পাওয়া যেত না কোনোদিন। আর নরহত্যার এই সুনিপুণ কান্ডটি যারা ঘটাতো, তারাই ইতিহাসে ঠগী, Thuggee বা Thugs নামে পরিচিত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঠগীরা আসলে কেন এমনটা করতো? এই নরহত্যার পেছনের মোটিভ কি? অনেকেই ঠগীদের ডাকাত বলে অভিহিত করে। কিন্তু ডাকাতদের যে কোন ধরণের অপরাধ সংঘটনের পেছনের মোটিভ বলা যায় অর্থ লাভ। মানে নিজেদের অভাব ঘুচানোর জন্য ওরা ডাকাতি করতো। কিন্তু ঠগীরা এমন নয়। হ্যাঁ হত্যার পর ভিক্টিমের সাথে যা টাকা পয়সা বা সোনাদানা থাকতো তা তারা নিজেরা নিজেদের মাঝে ভাগ করে নিতো। কিন্তু অর্থলাভ ঠগীদের মোটিভ নয় একদমই। শুধু একটা বিশ্বাসের উপর ভর করেই তারা নরহত্যা করতো। ঠগীদের অনেক এমন কেইস পাওয়া যায় যেখানে ভিক্টিম নিতান্তই ছাপোষা মানুষ, ঠগীদের কাছেই বরং সেই মানুষদের অপেক্ষা বেশি ধনসম্পদ ছিল। তাহলে কেন এই হত্যা?
ঠগীরা বিশ্বাস করতো, তারা মা কালীর সন্তান। (মা কালীর কথা বলছি বলে আবার ভাববেন না ঠগীরা হিন্দু ছিল। না, বরং অনেক মুসলিমরাও ছিল ঠগীদের দলে। এবং তারাও দেবীকেই বিশ্বাস করতো।) অসুর রক্তবীজকে হত্যা করার সময় মা কালী দেখলেন রক্তবীজের প্রতিটা রক্তের ফোঁটা থেকে জন্ম নিচ্ছে আরো অসুর। সেই অসুরদের ধ্বংস করার জন্য আবির্ভাব হলো মা কালীর সন্তান ঠগীদের। মা কালী ঠগীদের হাতে তুলে দিলেন একটা হলুদ রঙের রুমাল। সেই রুমালে বিশেষ ভাবে গিঁট দিয়ে অসুরদের ফাঁস পরিয়ে মারতে লাগলো ঠগীরা। এক ফোঁটা রক্ত বের হলো না কোনো অসুরের শরীর থেকে। ফলে ধ্বংস হলো অসুরকূল। ঠগীদের উৎপত্তি সেখান থেকেই। যুদ্ধ শেষে মা কালী ঠগীদের আশির্বাদ করলেন যে তাদের রুমাল কখনো খালি থাকবে না। যখন যার মৃত্যু আসবে, তিনিই ঠগীদের কাছে সেই লোককে উপস্থিত করবেন এবং বিভিন্ন ইশারা পাঠাবেন। হয়তো দেখা গেলো কোনো বিশেষ জায়গায় কাক ডাকছে, অথবা কোনো একটা শেয়াল হয়তো রাস্তার বাঁ দিক হতে ডান দিকে গেলো, এমন অনেক ইশারা দেখে ওরা 'ঝিরণী' দিতো, "সাহেব খান তামাকু লেও" এবং দু এক মিনিটের মাঝেই সব শেষ।
অর্থাৎ শুধুমাত্র একটা বিশ্বাসের জোরে এই ঠগীরা হত্যা করে শয়ে শয়ে নিরীহ মানুষ। একেক জন ঠগীর প্রায় ৪০০-৫০০ মানুষ হত্যা করারও রেকর্ড আছে। ভাবলে গা শিউরে উঠে।
ঠগীদের কথা বললে যার কথাটা সবার প্রথমে আসে, তিনি উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যান। পুরো এই ঠগীবাহিনীর সকল কুকীর্তি উদ্ধার করেন তিনি মোটামুটি একা হাতে। বলা যায় ওয়ান ম্যান আর্মি। নিজের জীবনের পুরোটাই তিনি দিয়েছেন এই ঠগীদের ধরবার জন্য। উনার প্রচেষ্টায়ই ভারতবর্ষ থেকে এই নির্মম ঠগদের সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব হয়েছে। শয়ে শয়ে ঠগীদের ধরে তিনি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। বাকিদের সংশোধনাগারে পাঠিয়েছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের এক কালো অধ্যায়কে দূর করেছেন নিজ হাতে।
অনেক কথা বললাম। এবার 'ঠগী' বইটা নিয়ে একটু বলি। প্রায় তিনশ পেইজের বই আমি জাস্ট চারঘন্টায় শেষ করে দিয়েছি, এত টান টান উত্তেজনা ছিল বইটায়। লেখকের বর্ণনা খুবই সাবলীল আর মেদহীন। বইটা পড়ার সময় একবারও মনে হয়নি নন-ফিকশন কোনো বই পড়ছি। লেখকের কৃতিত্ব এখানেই। প্রতিটা ঘটনা পড়েছি আর শিউরে উঠেছি, বারবার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। কি নৃশংস ছিল ওরা, কি পৈশাচিক! বইটা পড়ার পরে আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিলাম বিষয়গুলো উপলব্ধি করার জন্য। পার্সোনাল রেটিং ৪/৫। সময় সুযোগ থাকলে পড়ে ফেলুন বইটি। উপমহাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয়ে যাবেন। জানবেন ঠগীদের ধরার বিভিন্ন অভিযানের কথা। গল্পকাহিনী মনে হবে। কিন্তু না, সবই বাস্তব।
এককথায় অনেক তথ্যবহুল ও সুখপাঠ্য বই। আমার পড়া লেখকের প্রথম বই, ভালো লেগেছে। বইতে যা যা আছে সবই সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা, কোনো কাল্পনিক চরিত্র বা গল্প নাই। অবশ্যই পড়ে দেখতে পারেন।
এই বইটিতে ঠগীদের নিয়ে কল্পিত কোনো গল্প নাই, সত্যি ঘটনার উল্লেখ আছে। সেদিনের ঘটনা যেদিন ভারত স্বাধীন হয়নি, মানুষ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতো, তখন লাখো লাখো ঠগী ঘুরে বেড়াতো পথে ঘাটে।খুন লুঠ এসবই ছিল তাদের পেশা, এবং বংশানুক্রমে তাইই চলত। এই বইতে পাবেন ঠগীদের খুনের পদ্ধতি,তাদের নিজস্ব ভাষা,ধর্মীয় আচারবিধি, রীতিনীতি,কুসংস্কার এবং স্লিম্যানের দ্বারা কিভাবে ঠগীরা ধরা পড়ে এসবের বিস্তৃত বিবরণ। এছাড়াও আছে ধুতুরিয়া, ম্যাকফানসা বা জলের ঠগীদের নিয়েও কিছু তথ্য।
🔺ঠগী সংক্রান্ত অন্য বই পড়তে চাইলে হিমাদ্রী কিশোরের ফিরিঙ্গি ঠগি, অথবা দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের পঙ্খিলালের গুহা পড়ে দেখতে পারেন।
'ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়।' প্রবাদটি কম বেশি আমরা সবাইই শুনেছি। তবে এই 'ঠগ' কিংবা 'ঠগী' কারা?কীভাবে তাদের উৎপত্তি? কিংবা কোন জাদুবলে সমস্ত ভারতবর্ষে তারা ত্রাস সৃষ্টি করেছিল?
পৃথিবীতে তখন আবির্ভূত হয়েছে মহাদানব রক্তবীজ। তার উৎপাতে পৃথিবীতে শান্তি নেই। দেবী কালী তার সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন কিন্তু একা তিনিও অসহায়।।কেননা, রক্তবীজের প্রতি বিন্দু রক্ত হতে আবার তৎক্ষনাৎ সৃষ্টি হচ্ছে মহাবলী সব রাক্ষস।ভবানীর (দেবী কালীর আরেক নাম)দেহের ঘাম থেকে সৃষ্টি হলো দুইজন মানুষ। ভবানী তাঁর হাতের রুমালটি তাদের দিয়ে বললেন এটাই তোমাদের অস্ত্র। সেই কাপড় দিয়ে দুটি ফাঁস তৈরি করলো তারা। তারপর যুদ্ধে নেমে রক্তবীজের শেষ বংশধরটিকেও হত্যা করলো। যুদ্ধ শেষ। এখন অস্ত্র ফিরিয়ে দিতে গেলে ভবানী তাদের অস্ত্র ফিরিয়ে না দিয়ে তাদের সেই অস্ত্রের দ্বারা ধর্মের বিপরীত শত্রুকুলের বিনাশ করতে নির্দেশ দেন। তাই তারা হত্যা করে সেই মৃতদেহ ভবানীকে ভোগ হিসাবে দেন।কিন্তু একদিন হত্যার পর পেছন ফিরে ভবানীকে দেখে ফেলায় সেই লাশের দায়িত্বও তাদের নিতে বলেন। এরপর হতেই তারা নরহত্যায় নিযুক্ত হয় এবং নিজেকে মা ভবানীর সন্তান বলে মেনে নেয়। ভারতবর্ষে তারা ছিল পারসিকদের বংশধর। হিন্দু-মুসলমান উভয় ঠগী সম্প্রদায়ই ভবানীকে নিজেদের দেবী মানতো।ফলস্বরূপ তারা নিজ নিজ ধর্মের বাইরেও ঠগী ধর্মের অনুসারী হয়ে যায়।
উপকরণ অতি সামান্য। একফালি হলুদ কাপড়। ঢাল নয়, তলোয়ার নয়, বোমা-পিস্তল, কামান-বন্দুক, কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নয়, একমাত্র হাতিয়ার সেই হলুদ রঙের রুমালটি। রুমাল নয়, ওরা বলত 'পেলহু' কিংবা 'সিক্কা'। খুলে রাখলে মনে হবে যেন কোন পাগড়ী খুলে রাখা হয়েছে অথবা কোমর বন্ধনী হিসেবে ব্যবহৃত কোনো কাপড়। দু'ভাঁজে ভাঁজ করার পর সেটি দৈর্ঘ্যে মাত্র ত্রিশ ইঞ্চি। আঠারো ইঞ্চি দূরে একটি গিঁট। গিঁটের প্রান্তে একটি রুপোর টাকা বাঁধাম নয়তো একটি তামার ডবল পয়সা। রুমালটা আসলে ফাঁস আর প্রান্তে বাঁধা টাকাটা ব্যবহৃত হয় ফাঁসটাকে আরো নির্ভুল করার জন্য।
ঠগী, ধুতুরিয়া,ঠ্যাঙ্গারে,ভাগিনা ইত্যাদি শ্রেণিবিভাগ থাকলেও একমাত্র ঠগীরাই নরহত্যাকে শিল্পকলায় পরিণত করেছিল। তারা দল বেঁধে যাত্রা করতো, পথে কোনো পথিকদলের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের হত্যার মাধ্যমে সকল সম্পদ লুট করতো।তবে এজন্য তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না। তারা বিশ্বাস করতো সবই তাদের দেবী ভবানীর অনুগ্রহে হচ্ছে।পুরো ভারতবর্ষেই তাদের আগ্রাসন ছিল। ঠগীর সন্তান ঠগী হতো এবং তারা সাধারণত ঠগীর মেয়েকেই বিয়ে করতো। ফলে এটা তাদের পারিবারিক পেশাতে পরিণত হয়েছিল। ভারতবর্ষ বড় একটা এলাকা হওয়াতে বিভিন্ন অঞ্চলের ঠগীদের মধ্যে হত্যার নিয়ম-কানুনের পার্থক্য ছিল।কিন্তু তারা ভবানী ঠাকুরের সন্তান এই নীতিতে একতাবদ্ধ ছিল।এমনকি ঠগীদের নিজস্ব ভাষা ছিল, যার নাম 'রামসী'। এই ভাষায় তারা একে অপরের সাথে কথা বলতো এবং একটি ঠগী দল আরেক ঠগী দলকে চিনতে পারতো।
ভারতবর্ষে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে যায়,বাঘে খায়,গঙ্গাপ্রাপ্তি। এটা এমন এক দেশ যেখানে হারিয়ে যেতে নেই মানা। জনৈক এক ইংরেজ ঐতিহাসিক হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আগের তিনশো বছরে প্রতি বছর গড়ে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে। কোথায় গেল সেই লক্ষ লক্ষ জনতা? তাদের একটি বিরাট অংশ কি ঠগীদের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে? অন্যদিকে এনায়েত নামক এক ঠগীর জবানবন্দিতে জানা গেছে কোনো কোনো ঠগীর হাতে ৯৩১ টি মানুষ নিহত হয়েছে, কারো হাতে ৬০৪ টি কিংবা কারো হাতে ৫০৮ প্রাণ শেষ হয়েছে। সবচেয়ে মন্দভাগ্য যার তার হাতেও ২৪ টি মানুষ হত্যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এই হিসাব থেকে প্রতি বছর ৪০ হাজার মানুষ হারিয়ে যাওয়ার হিসাব সম্পর্কে আর সন্দেহ থাকার কথা না। কারণ পুরো ভারতবর্ষেই ছিল ঠগীদের ছড়াছড়ি।
ঊনিশ শতকে ভারতবর্ষে পা রাখেন বিলেতের এক তরুণ সৈনিক এবং পরবর্তীতে 'ঠগ বাছতে গা উজাড়' এর দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়া উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যান। ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থেকে তিনি ঠগীদের সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট সংগ্রহ করতে শুরু করেন। কিন্তু কোথাও তেমন কিছু ছিল না।কারণ ঠগীরা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঠগীরা যেমন ছিল দুর্ধর্ষ, তেমনি ছিল বিচক্ষণ। তাদের দেখলে মনে হতো কোনো একদল তীর্থযাত্রী যারা মাত্রই তীর্থ সেরে বাড়ি ফিরছেন। হেনরি স্লীম্যান সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে ঠগী দমন শুরু করেন। যা তাকে 'ফিরিঙ্গি ঠগ' কিংবা 'ঠগী স্লীম্যান' খ্যাতি এনে দেয়। ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার ১০ বছরে অর্থাৎ ১৮৪০ সালের মধ্যে তাঁর হাতে ধরা পড়েছে ৩৬৮৯ জন ঠগী। তাদের মধ্যে অনেকের ফাঁসী হয়, কারো হয় দীপান্তর,যাবজ্জীবন আবার অনেকে রাজসাক্ষী হয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন নিজ পেশার অন্যান্য ঠগীদের। একসময় ভারতবর্ষের শেষ ঠগীও রণে ভঙ্গ দেয় এবং স্লীম্যান তার নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার আগেই ১৮৫৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বইটা নিঃসন্দেহে অনেক তথ্যবহুল। ঠগীদের হত্যার কার্যকলাপ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক।তবে বইটাতে কয়েকটা জায়গায় সাল বিভ্রান্তি চোখে পড়েছে। যেমনঃ ১৮১৭ সালে স্লীম্যান ১৮৩৬ সালের রিপোর্ট পড়েছেন।৷ হয়তো এটা টাইপিং মিস্টেক ছিল। এড়িয়ে যাওয়া যায় আরকি। সর্বোপরি ভালো একটা বই। হ্যাপি রিডিং।
ভয়ংকর এক খুনি দল যারা গরীব হোক ধনী হোক রাস্তায় নামা পথিকদের লুটের পর খুন করে মাটি চাপা দিয়ে দিতো কোন এক পথের ধারে। এই খুনিদের ছিলো নিজেস্ব ভাষা, ধর্ম, আচার অনুষ্ঠান। ভারত বর্ষের এক ক্রান্তিকালে কিভাবে এই লুটেরাদের জন্ম হলো আর কিভাবেই তারা নির্মূল হলো শুধুমাত্র একজন ইংরেজ অফিসারের দৃঢ়তায়, খুব সুন্দর রুপে ফুটিয়ে তুলেছেন শ্রীপান্থ। বেশ লেগেছে আমার।
গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে একসময় চরে বেড়াত দুর্ধর্ষ এক খুনীর দল। দল হিসেবে যারা খুবই বড়ো, হত্যাকান্ডে নিদারুণ নিপুণ ও নির্দয়। তিনশ বছর ধরে ভারতবর্ষে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এই দলের হাতে, তাদের নাম ঠগী। এই ঠগীদের ইতিহাস, জীবনাচরণ এবং কীভাবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হলো সেই ইতিহাসই গল্পের মতো উঠে এসেছে এই বইয়ে।
# 🔍 How I Discovered It
অনেক ছোটোবেলায় কোনো এক বইয়ে ঠ্যাঙাড়েদের গল্প পড়েছিলাম। ঠগীদের সাথে তাদের কাজেকর্মে সামান্য মিল ছিল, তবে হুবহু নয়। ঐ গল্প সাবকনশাসে ছিল বোধহয়, ছোটোবেলায় বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম মনে পড়ে। কোনো একটা ফেসবুক গ্রুপে কেউ একজন এই বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে এই বিষয়ক আরো বইয়ের খোঁজ করছিলেন। তখনই মনে হলো পড়তে ভালো লাগবে।
# 🧠 Thoughts
ইতিহাস বরাবরই আমার প্রিয় বিষয়, সচরাচর পড়তে ভালোবাসি। আরো ভালো হয় যদি বোরিং বর্ণনা রেখে একটু গল্পের ছলে বলা হয় ইতিহাস। এই বইটিতে শ্রীপান্থ এই কাজটি করেছেন যত্নসহকারে। খুব বেশি দীর্ঘ কলেবরের বই নয়, তার উপর বর্ণন���শৈলী এত প্রাণবন্ত যে পড়তে কষ্ট হয় না একদমই।
ঠগীদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা জানা ছিল কিন্তু তা মোটেই এত বিস্তারিত ছিল না। “ঝিরণী” দেয়া, “তামাকু লেও” বলে ইঙ্গিত দেয়া- এই বিষয়গুলো জানা ছিল না। জানা ছিল না যে এদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ মুসলমান ছিল। এও জানা ছিল না যে ঠগী জীবন একটা ধর্মাচার বা জীবনাচার। যেকোনো ধর্মের লোকজন যেমন বাউল হতে পারে বাউল হবার নিয়মাবলি পালন করে, ঠগীর ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই।
আসল ধর্ম যাই হোক না কেন, ঠগী ধর্মে তারা পূজা করে ভবানী মাতার। ঘোরে হলুদ রঙের একটা রুমালের এক পাশে গিঁট দিয়ে একটা পয়সা বেঁধে। খুন করার পরপরই যেন বাতাসে মিলিয়ে যায় তারা। সব মিলিয়ে এই গল্প পড়ে বিশ্বাস হতে চায় না এই মাটিতেই একসময় এরকম কিছু হওয়া সম্ভব ছিল।
আরো কিছু লিখতে গেলে হয়ত দেখা যাবে বই থেকেই তথ্য তুলে দিচ্ছি। তাই বাদ দিলাম। আগ্রহী পাঠক বরং নিজে পড়ে নিলেই বেশি আনন্দ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
# 🥰 Who Would Like It?
আপনার যদি গল্পের ছলে ইতিহাসের সত্য ঘটনা পড়তে ভালো লেগে থাকে, রহস্যগল্পে আকর্ষণ থাকে তাহলে এই বইটি আপনার ভালো লাগার কথা।
এক অজানা ইতিহাসের সাক্ষী হলাম! অসম্ভব ইন্টারেস্টিং ছিলো বইটি। শ্রীপান্হের লেখার বরাবরই ভক্ত আমি। ঠগী সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি রবিন জামান খানের সপ্তরিপু বইটিতে। তারপর থেকেই ঠগীদের সম্পর্কে কৌতূহল জাগে,শ্রীপান্হের এই বইটি পড়ার ইচ্ছা অনেকদিন ধরেই ছিলো। অবশেষে তা পূরণ হলো। এক প্রাচীন নিষ্ঠুরতার ইতিহাস "ঠগী"। পড়ছিলাম আর শিউরে শিউরে উঠছিলাম! তথ্যে সমৃদ্ধ ঠগীদের সম্পর্কে সব জানতে চাইলে এরচেয়ে ভালো বই আর হতেই পারে না!
এক খুনে ডাকাতদলের নাম "ঠগী"।এরা রুমালে ফাঁস বেঁধে হত্যা করতো নিরীহ মানুষদের,অতি সাধারণ রুমাল আর একটা কয়েন দিয়েই তারা তাদের কাজ সারে।তাদের সন্দেহ করবে কার সাধ্যি। সবসময় বিরাট দলে থাকে। ব্রিটিশ শাসনাধীন তখনকার ভারতবর্ষে ঠগী ছাড়াও ধুতুরিয়া,ম্যাকফানসা, ভাগিনাদেরও অস্তিত্ব ছিলো! ঠগীরা তাদের নিজেদের তৈরি একধরণের ভাষায় কথা বলতো।সে বুলির নাম -রামসী! এমন নিষ্ঠুরও যে কোনো খুনীর দল হতে পারে ,তা এই প্রথম পড়লাম। প্রথমে শিকারের সাথে ভালো ব্যবহার করে,তাকে বন্ধু বানিয়ে নিয়ে তারপর খুন! অবিশ্বাস্য, ওদের খারাপও লাগতো না কারণ ওরা ভাবতো এ শিকার মা ভবানীর দান। হাজার হাজার মানুষ হাওয়া হয়ে যেতো ঠগীদের খপ্পরে পড়ে।
স্যার উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ আপনাতেই ভিজে ওঠে।একজন সাহেব,যিনি ভারতবর্ষকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিলেন। ভারতবর্ষ থেকে ঠগীদের নির্মূল করেছেন সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে। শ্রীপান্হের "ঠগী" একটি ঐতিহাসিক বই। রোমাঞ্চে ভরপুর, গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠবেই,এক নিঃশ্বাসে শেষ করার বই রুদ্ধশ্বাস একটি বই। খটমটে ইতিহাস নয় বরং হালকা চালে গল্পে গল্পে ইতিহাসের সাক্ষী "ঠগী"।
" ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তার আগের তিন শ' বছরে প্রতি বছর গড়ে অন্তত চল্লিশ হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে এদেশের কোল থেকে। হ্যাঁ,বছরের পর বছর - তিন শ' বছর। প্রতি বছর গড়ে তাদের সংখ্যা ছিল - চল্লিশ হাজার। " - এক ইংরেজ ঐতিহাসিক হিসেব করে জানিয়েছিলেন এটা। এই হারিয়ে যাওয়ার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ খুনে ডাকাতদল ঠগীদের অস্তিত্ব। ঠগীরা দলবদ্ধ হয়ে পথিক সেজে অন্য পথিককে হত্যা করে সব কিছু লুটে নেয়। সব ডাকাতদলই করে সেটা। কিন্তু ঠগীদের সমস্ত কিছু আলাদা। তাদের পুরো জীবনযাত্রা নিয়মমাফিক। নিয়মের বাইরে তারা কিছু করে না। এক ফোটাও রক্তপাত না করে সবচেয়ে ভয়ংকর খুনী ঠগীরা। যাকে হত্যা করবে বলে ঠিক করে তার প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা দেখায় না। কিন্তু এদের পারিবারিক জীবন পুরো উল্টো। মায়া-মমতা, ত্যাগ স্বীকার সব কিছুই আছে সেখানে। কয়েকশত বছর যাদের নাগাল কেউ পায়নি তাদেরকে দমন করতে বদ্ধপরিকর হন উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যান। প্রথমদিকে সহকর্মীদের বিদ্রুপের স্বীকার হন। পরবর্তীতে তারাই বাধ্য হন স্লীম্যানের প্রশংসা করতে। আমি বইটা কিনেছিলাম ঠগী নিয়ে কোন গল্প লেখা আছে ভেবে। আসলে বইটা ঐতিহাসিক তথ্যবহুল একটা বই। কিন্তু একবারের জন্যও মনে হবে না এটা কোন সত্য তথ্য ভরা ননফিকশন বই। এত সুন্দর উপস্থাপন আর ঘটনা গুলা এত থ্রিলিং যে, মনে হয় এটা সত্য হওয়া সম্ভব না, গল্পই। এটা একটা মাস্টারপিস।
I read about this community first when Aamir Khan's Thugs of Hindustan was released. There was so many writings on this online. Though I didn't watch the movie yet, but the particulars of this book attracted me. The writer is well-known for his historical researches and presenting them in befitting manner in his books. This one was no exception. It gives a different experience to know about this lost(?) Community. And the exposure here is really great. I liked the book and would recommend anyone having interest on history.
কথায় আছে না মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কিছু করা? সেটাই হলো বইটা পড়তে গিয়ে। পুরো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম। ঠগীদের ইতিহাস, সংস্কৃতি সব যেন ফ্যান্টাসি গল্পের মত। আর সবশেষে উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যান! স্যালুট জানাই এই মানুষটাকে। এমন মানুষ পৃথিবীতে থাকে বলেই পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে ওঠে।
ভাগিনা নয়, ম্যাকফানসা নয়, ঠ্যাঙ্গারে নয়, ধুতুরিয়াও নয়, ওরা হচ্ছে ঠগী। ঢাল তলোয়ার লাগে না ওদের, সামান্য উপকরণ একফালি হলুদ কাপড়, একটি রুমাল মাত্র। মাত্র সাতটি গোত্র থেকে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল এই ঠগীর দল, সে কবে কে জানে? ওদের দাবী ইলোরার গুহায় ঠগীর কাহিনী আঁকা আছে, মানে তারা সপ্তম শতকের আগেও ছিল। আবার কারো মতে মুসলিম শাসকদের সাথে সাথে উপমহাদেশে ওরা এসেছিল পারস্য থেকে।কবে কোথায় তাদের উৎপত্তি সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না তবে উনিশ শতকের আগের তিনশ বছরে ওরা খুন করেছিল প্রায় দশ লক্ষ মানুষ এমনই ধারণা করেছিলেন স্লীম্যান। স্লীম্যান আবার কে? উইলিয়াম হেনরী স্লিম্যান, ভারতবর্ষ থেকে ঠগীদের উৎখাত যার হাত ধরে হয়েছিল যার নাম লোকেমুখে হয়ে উঠেছিল ঠগী স্লিম্যান, তার কথাই বলছি। ঠগী বলে একটা সম্প্রদায় ছিল অতীতে, এখনও হয়তো থাকতেও পারে আর থাকলেই বা কি আমাদের তো ক্ষতি করছে না ঠগী সম্পর্কে কোম্পানী মানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসকদের এই ছিল মনোভাব। তবু স্লীম্যান হাল ছাড়েন নি। সামান্য সৈনিক থেকে কর্মজীবন শুরু করে চলে গিয়েছিলেন সিভিল সার্ভিসে, মৃত্যুর সময় পেয়েছিলেন স্যার খেতাব যদিও জেনে যেতে পারেন নি। তার জীবনের অনেক কীর্তির মধ্যে সেরা কীর্তি এই ঠগী দমন। অদ্ভুত দল এই ঠগী, এদের মধ্যে আছে হিন্দু মুসলমান দুই ই। উত্তর, দক্ষিণ, মধ্য, পশ্চিম, পূর্ব গোটা ভারতেই ছিল এদের উপস্থিতি। তবে জলের দেশ বাংলায় এদেরই জাতভাই পাঙ্গু বা ভাগিনারা ছিল, যারা ���ানুষ মেরে সব কেড়ে নিত জল পথে, নৌকায় বসে।
কি করতো ঠগীরা? নিরীহ পথিক সেজে দলে দলে ভাগ হয়ে বেড়িয়ে পড়তো দিকে দিকে। নিরীহ পথিকদলের সাথে বন্ধুভাবে মিশে যেত তারা, তারপর কোন নির্জন নির্দিষ্ট স্থানে সুযোগ বুঝে তাদের নিজস্ব ভাষায় সংকেত দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো শিকারের উপর ওদের ভাষায় যাকে বলতো ঝিরণী।গলায় ফাঁস দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে নিরীহ মানুষগুলোকে পাঠিয়ে দিত পরপারে। তাদের প্রাণহীন দেহগুলোর স্থান হতো কবরে। সেই কবরের উপর বসেই ওরা সেরে নিতো গুড়ের ভোজ। ওদের একটা নিজস্ব একটা আলাদা ভাষাই ছিল-রামসী। হিন্দু মুসলমান যাই হোক এদের উপাস্য দেবী ভবানী যিনি কালীরই আরেক রূপ। কলকাতার কালীঘাট বা বিন্ধ্য পর্বতের ভবানীর মন্দির ছিল এদের তীর্থ। নিজেদেরকে এরা ভাবতো বাঘের মতো, বাঘ যেমন প্রাণী হত্যা করে খাদ্য সংগ্রহের জন্য তেমনি মানুষ শিকার করে অর্থ সংগ্রহের জন্যই ঠগীরা জন্মেছে, এতে তাদের কোন পাপ হয় না। এদেরই কাহিনী, কি করে হেনরী স্লিম্যান এদের মূলোৎপাটন করলেন তার মনোমুগ্ধকর কাহিনী ঠগী। ঠগী একটি সত্যি কাহিনী। শ্রীপান্থের বর্ণনা, ভাষা দুর্দান্ত, যেন মোহাবিষ্ট করে রাখে। অজানা ইতিহাসকে গল্পের মতো করে জানার সুযোগ করে দিয়েছে এই বই। স্লীম্যান হয়তো এখন বিস্মৃত তবু মধ্য প্রদেশে এখনো একটি গ্রাম রয়ে গেছে স্লীমেনাবাদ, প্রতিদিন সন্ধ্যায় গ্রামের মন্দিরে স্লীম্যানকে স্মরণ করে মঙ্গলদীপ জ্বালানো হয়। স্লিম্যান তাই হারান নি, হারিয়ে গেছে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ঠগীরাই।
ভারতবর্ষে এমন ঘটনা ঘটেছিলো! বইটি পড়ে ঠগীদের নিয়ে আরো জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো৷ বইটি খুবই লোমহর্ষক অনুভূতির জন্ম দেয় এবং এর ঘটনার ধারাবাহিকতা খুবই লোভনীয়। ইংরেজদের ঠগী নিধনে যে ভূমিকা রেখেছিলো তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
আমার প্রথম প্রথম বইয়ের টোন টা ধরতে খুব ঝামেলা হচ্ছিলো। মানে প্রতি চ্যাপ্টারে মনে হচ্ছে পারশেপ্সহন বা ন্যারেটর বদলাচ্ছে কিন্তু বুঝতে পারছিলামনা। যাই হোক, বেশ ভাল কিন্তু ঠগিদের নিজেদের ভাষার বিবরণ তা শুরুতে থাকলে ভাল হতো।