টেনিসের বছর শুরু হয় সূর্যের সাথে সাথে পথচলায়। বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, পথ চলতে চলতে এশিয়া পার হয়ে এসে ফ্রেঞ্চ ওপেন, সেখান থেকে ইংল্যান্ডে গিয়ে উইম্বলডন এবং শেষ হয় ইউ,এস ওপেন দিয়ে। সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে টেনিস খেলাটাও হয়ে উঠেছে সূর্যের মতোই নিঃসঙ্গ। টেনিস চূড়ান্ত একাকীত্বের খেলা; সাড়ে চার, পাঁচ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় পাশে কেও থাকেনা, এমনকি কোচের সাথে কথা বলার-ও অনুমতি নেই। দৌড়বিদরা তার প্রতিযোগীকে পাশে পায়, বক্সাররা পায় রিং এর কোনায় তার এসিস্টেন্টকে বা স্পর্শ করতে পারে প্রতিপক্ষকে, কিন্তু টেনিসে লড়াই করতে হয় একা, নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো দাগ টানা কোর্টের এক পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই চলে আরেক দ্বীপে দাঁড়ানো প্রতিপক্ষের সাথে। আর এই নিঃসঙ্গ খেলাটাতে যে অল্পকজন শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় পৌঁছেছেন, সব ধরণের কোর্টে রাজমুকুট মাথায় পড়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আন্দ্রে আগাসী। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠির হিসেবে আগাসীর শ্রেষ্ঠত্ব আরও পরিপূর্ণতা পায় যখন জানা যায় আগাসীর অর্জনে আছে ক্যারিয়ার গোল্ডেন স্লাম (অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন, উইম্বলডন, ইউ এস ওপেন, অলিম্পিক গোল্ড) যেটা এমনকি রজার ফেদেরার, পিট সাম্প্রাসদের ও নেই।
টেনিসের এই নিষ্ঠুর একাকীত্বের কারণেই টেনিস প্লেয়াররা নিজেদের সাথে সবচেয়ে বেশি কথা বলে। দীর্ঘ সময় ধরে একা একা লড়াই করে যাবার সময় নিজেদের চাঙ্গা রাখতে, সে কি চায় সেটা নিজেকে বার বার মনে করিয়ে দিতেই নিজের সাথে কথা বলতে হয়, আর আগাসীর এই কথা বলাটা শুরু হতো ম্যাচের চার পাঁচ ঘণ্টা আগে থেকে। দীর্ঘ সময় ধরে শাওয়ার নেবার সময় বিড়বিড় করে, কখনো চিৎকার করে নিজের সাথেই নিজে কথা বলতো, বলতো সেটাই যেটা সে নিজের মাথার মধ্যে গেঁথে ফেলতে চায়।
ইরানে জন্ম গ্রহন কারী ইম���নুয়েল টেনিস খেলতে পারেনি কারণ ইরানে তখন কেউ টেনিস খেলত না; আর কেউ টেনিস খেলত না বলেই ইমানুয়েল হয়ে উঠেছিল বক্সার। দুইবার অলিম্পিকেও অংশ নিয়েছিলো, কিন্তু ইরানের বিপক্ষে সার্বজনীন পক্ষপাতিত্ব দেখে সিদ্ধান্ত নেয় ইরান ছাড়ার, পালিয়ে চলে আসে নিউ ইয়র্ক সিটিতে, নাম পালটে হয়ে যায় মাইক আগাসী। টেনিসের প্রতি আসক্তি আর অলিম্পিকর ব্যর্থতা দুই-ই দূর করার তীব্র সংকল্প বাস্তবায়ন করতে শুরু করে ছোট ছেলে আন্দ্রের উপর। ছেলের জন্মের পর পরই তাই ফিডারের বদলে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল টেনিস বল। ছেলেকে টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে বড় করতে তুলতে হলে বাড়িতে একটা টেনিস কোর্ট লাগবে, কিন্তু বিধ্বস্ত ইরানের দারিদ্র্যের নিম্নসীমা থেকে উঠে আসা পরিশ্রমী মধ্যবিত্ত বাবার শহরের মাঝে তেমন বাড়ি করার সামর্থ্য ছিল না বলেই বাড়ি করে মরুভূমির মাঝে এসে, যেই মরুভূমি ব্যবহৃত হতো জিনিসপত্র এবং ময়লা ফেলার কাজে; নষ্ট টায়ার, ব্যবহৃত কার্পেট, অপ্রিয় মানুষ এবং যে সকল জিনিস অপ্রয়োজনীয়।
সাত বছর বয়স থেকেই আন্দ্রে ঘৃণা করতে শুরু করে টেনিসকে, সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতো টেনিস এবং সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে টেনিসের সাথেই। প্রতিদিন বাবার কড়া শাসনে বোলিং মেশিন থেকে ছুটে আসা ২৫০০ বল তাকে নেটের অপর পাশে ফেরত পাঠাতে হতো, সেই নেটের উচ্চতাও ছিল স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে ছয় ইঞ্চি বেশি। সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী বাবার বিশ্বাস ছিল প্রতিদিন ২৫০০ বল মানে সপ্তাহে ১৭ হাজার ৫০০ বল, বছরে এক মিলিয়ন বলের কাছাকাছি; বাচ্চা কোন ছেলে যদি বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন বল খেলে পরিণত বয়সে তাকে হারানোর ক্ষমতা কারো থাকবে না। বাবার বিশ্বাস কিন্তু খুব একটা ভ্রান্ত ছিল না।
বক্সার বাবার দর্শন ছিল প্রতিপক্ষের সেরা জায়গায় আঘাত করা, ছেলেকেও গড়ে তুলেছিল সেই একই দর্শনে, কেউ যদি ভালো ফোরহ্যান্ডে খেলে তবে তাকে বেশি বেশি ফোরহ্যান্ড-ই খেলতে দাও আর সেগুলোকে এমন ভাবে ফেরত পাঠাও যেন সে তার নিজের ফোরহ্যান্ডকেই ঘৃণা করতে শুরু করে। আগাসী হয়ে উঠেছিল টেনিসের রেকেট হাতে একজন বক্সার। সব টেনিস প্লেয়াররা যেখানে গুরুত্ব দেয় দুর্দান্ত সার্ভ করার দিকে, আগাসী সেখানে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল সকল ধরনের সার্ভকে দুর্দান্ত ভাবে ফিরিয়ে দেয়ায়।
টেনিসের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে একাডেমী ছাড়ার জন্য চুলে বিচ্ছিরি রঙ করা, দৃষ্টিকটু রকম বড় নখ রাখা, নেইলপলিশ ব্যবহার করা, শরীরে পিয়ারসিং করা, নিয়ম ভাঙ্গা, মারামারি, ক্লাসে ফাঁকি দেয়া, মদ খেয়ে মাতলামি করা, নিষিদ্ধ গাঁজা সেবন, এমনকি মেয়েদের ডর্মিটরিতে লুকিয়ে থাকার মত কাজও আগাসী করেছে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের ব্যর্থতায় কয়েকবারই সরে দাঁড়িয়েছে টেনিস থেকে। আবার ফিরেও এসেছে। দুর্দান্ত ভাবে। নিষ্ঠুর হয়ে।
টেনিসের ধ্রুপদী লড়াইগুলোর একটা ছিল পিট সাম্প্রাস আর আন্দ্রে আগাসীর লড়াই, কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে একজন উঠলে অপেক্ষা করতো আরেকজনের ফাইনালে উঠার জন্য। তবে আগাসীর ‘ওপেন’ শুধুমাত্র টেনিস নিয়ে নয়, আগাসীর জীবনযাপন আর জীবনদর্শন নিয়ে। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ, বাইরের পৃথিবীকে দেখার তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বারবার পরাজিত হওয়া, অপবাদ-নিন্দা, ড্রাগস নেয়ার অনুশোচনা, অপরাধ আর ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠার তীব্র ইচ্ছা পাতার পর পাতায় আগাসী রেখে গেছেন। শেষ করার পরে এই বই যতটা না টেনিস সম্পর্কিত, তার চেয়ে অনেক বেশি অনুভূতি সম্পর্কিত।
বইয়ের ভালো না লাগার কোন দিক নিয়ে বলতে গেলে বলতে হবে দীর্ঘ বইতে অনেক বেশি ডিটেইলসের বর্ণনা মাঝেমাঝেই ভাবায়, এতোটা নিখুঁত কি আসলেই ছিল? সাত বছর বয়সে খেলায় কার সাথে কত স্কোর লাইন ছিল কিংবা কোন একটা নির্দিষ্ট ম্যাচের আগে কত মিনিট ধরে গোসলে ছিল বা কত মিনিট স্ট্রেচারে শুয়ে ছিল সে বর্ণনা পড়ে চিন্তা আসে, আগাসী ছাড়া আর কে ঘড়ি ধরে গোসল করে?
এই ছোট খাট জিনিসগুলো মন থেকে বাদ দিতে পারলেই নিশ্চিত থাকেন, আগাসীর সাথে বইয়ের পাতায় চমৎকার কিছু সময় কাটাতে যাচ্ছেন। বই পড়া শুরু করলেই আমি নিশ্চিত বলতে পারি যে বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টার শেষ করেই ইউটিউবে সার্চ করে আগাসী আর বাগদাতীসের ইউ,এস ওপেনের ম্যাচের হাইলাইটস দেখতে শুরু করবেন, এবং প্রতি দুই/তিন চ্যাপ্টার পড়ার পর পর ইউটিউবে এসে কিছু হাইলাইটস দেখাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে।
টেনিস বুঝতে হবে না, আগাসীকে পছন্দ না করলেও হবে, বায়োগ্রাফী যদি ভালো না লাগে তবুও সমস্যা নাই, ফিকশন হিসেবে চিন্তা করে পড়লেও ‘ওপেন’ একটি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো ফিকশন। লেখনীর কথা বললে দীর্ঘদিন এই বই ছিল নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার, ২০১০ সালে জয় করে নেয় ব্রিটিশ স্পোর্টস বুকস এওয়ার্ড।
স্পোর্টস বায়োগ্রাফী হিসেবে নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত আমার পড়া সেরা বই ‘ওপেন’। চাইলে বই থেকে শ’খানেক কোটেশন তুলে দেয়া যেতো, মাত্র একটা দিলাম -
“It's no accident, I think, that tennis uses the language of life. Advantage, service, fault, break, love, the basic elements of tennis are those of everyday existence, because every match is a life in miniature. Even the structure of tennis, the way the pieces fit inside one another like Russian nesting dolls, mimics the structure of our days. Points become games become sets become tournaments, and it's all so tightly connected that any point can become the turning point. It reminds me of the way seconds become minutes become hours, and any hour can be our finest. Or darkest. It's your choice.”