'আমি রাধিকা। সনাতন ধর্মে রাধিকা শ্রীমতী রাধারই একটা নাম। মহালক্ষ্মী, মালিনী, মাধবী, রাই, বিনোদিনী এইসবও রাধার নাম। রাধার অনেক নাম। শুধু নাম নয়, ভক্তিও বেশি। কৃষ্ণের প্রতি রাধার ভক্তি এত বেশি ছিল যে খোদ সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই কৃষ্ণের আগে রাধা নাম উচ্চারণ করে। রাধা-কৃষ্ণ। চৈতন্যচরিতামৃতের আদিলীলায় বলা হয়েছে, রাধা-পূর্ণশক্তি, কৃষ্ণ-পূর্ণ শক্তিমান, দুই বস্তু ভেদ নাই শাস্ত্র-পরমাণ। শুধু এইটুকুন নয়, আরও আছে– মৃগমদ, তার গন্ধ-যৈছে অবিচ্ছেদ অগ্নিজ্বালাতে যৈছে নাহি কভু ভেদ রাধাকৃষ্ণ তৈছে সদা একই স্বরূপ লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ'
শুধু প্রথম গল্প ‘আদিম’-এর জন্যেই পাঁচ তারা দিয়ে দিতাম বইটাকে। এক যুগ আগে যখন গল্প লেখা শুরু করেছিলাম, তখন ঠিক এমন একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। এখনও পেরেছি কিনা নিশ্চিত নই। রহস্যময়, গভীর দার্শনিক কনসেপ্ট আর আধুনিক আরবান লেজেন্ডের উপস্থিতি, কিছুটা পরাবাস্তবতা আর অনেকখানি মহাজাগতিক অসহায়তা—সব মিলিয়ে ‘আদিম’ প্রচণ্ড শক্তিশালী গল্প।
দুর্ভাগ্যবশতঃ বইয়ের অন্য গল্পগুলো আর এই উচ্চতাকে ছুঁতে পারেনি। কোনোটাই একদম বাজে নয়, তবে খুব অসাধারণও নয়। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে গল্পগুলোর প্রেমিজ। সবগুলো আইডিয়া মোটামুটি পরিচিত (বা যথেষ্ট নতুন নয়)। লেখার ধরন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এবং সুখপাঠ্য। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে স্ত্রী স্বামীকে খুন করতে চায় বা লাশ থেকে ফুল জন্মায়, অথবা ভালোবাসার মানুষের পাত্তা না পেয়ে একজনের আত্মহত্যাকে শেষে টুইস্ট হিসেবে দেখানো—এসব প্লটকে অপরিচিত বা নতুন বললে দাবিটা ঠিক হবে না মনে হয়। কিছু ক্ষেত্রে বরং মনে হয়েছে শক্তিশালী লেখা দিয়ে অনিশ্চিত প্লটিং ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে (যেমন লিলিয়ানের গল্পটা। অবশ্য সেখানে আমার বোঝার গাফিলতি থাকতে পারে। মাত্র একবার পড়েছি, তাও অনেকগুলো গল্পের মাঝে)।
আরেকটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার ছিলো অনেক গল্পে ‘যুবতীর নগ্ন দেহ’-এর উপস্থিতি। আমি প্রুড না, কয়েকদিন আগে লাগালাগি নিয়ে একটা আস্ত উপন্যাস লিখলাম। আমার মনে হয় বাংলাদেশের বর্তমান জনরা লেখকদের গল্পে আরেকটু সেক্সের উপস্থিতি দরকার, এখনও আমাদের লেখায় সেবার ‘কিশোর উপন্যাস’ মার্কা একটা যৌনতাহীন ধাঁচ বেশি দেখা যায়। কিন্তু সেই তর্কের বিপক্ষে ভাবতে বাধ্য করলো সুবর্ণ-রাধিকা গল্প সংকলন। গল্পের প্রয়োজনীয়তার তোয়াক্কা না করে সবসময় মেয়েদের দেহের বর্ণনা না আনলেও বোধহয় চলতো। একটা উদাহরণ দিই—এক গল্পে একজন মেয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করে তার পাতলা গেঞ্জি ঘামে ভিজে দেহের সব ‘ভাঁজ, উঁচু-নিচু খাদ’ দেখা যাচ্ছে। পরে সে ভাবে—নিজের শরীর নিজে দেখাও পাপ? এখন কথা হইলো, কোন মাইয়ার ঠ্যাকা পড়সে মাঝরাতে খুনাখুনির স্বপ্ন দেইখা উইঠা পরক্ষণে নিজেরে চেক আউট করবে, যেখানে বাসার অন্য সবাই ঘুমায়ে আসে? There’s some real juvenile, male gaze-y shit here that reminded me of that ‘She breasted boobily down the stairs’ meme.
তবে এই দুটো ব্যাপার উপেক্ষা করলে বাকি গল্পগুলো যথেষ্ট উপভোগ্য। মারিয়ার ট্রেনের গল্পটা অনেক মজার লেগেছে, লা-পেরেগ্রিনাও উল্লেখযোগ্য রকমের ভালো। এই সংকলন আমি সহজেই যে কাউকে রেকমেন্ড করতে পারি, এবং গল্পের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের কারণে সবাই পছন্দের কিছু না কিছু নিশ্চয়ই পাবেন।
প্রথম গল্প "আদিম" বইয়ের সেরা গল্প; শুধু এই বইয়ের না, এই ধারার এতো হতবিহবল করে দেওয়া গল্প আমি খুব কমই পড়েছি। পরের গল্পগুলোয় একটাই সমস্যা - সেটা হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান, মনোবিকলন, অসুস্থতা ঘুরেফিরে বিষয় হিসেবে আসায় ক্লান্তি ভর করে একটা সময়। বিয়োগান্তক পরিণতির ক্ষেত্রেও একটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সাখাওয়াত হোসেন আত্মবিশ্বাসী গল্পকার। লেখনীর ক্ষেত্রে কোথাও তাকে নবীন বলে মনে হয়নি। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি বেশ দক্ষ। গল্প বাছাইয়ে আরেকটু সতর্ক হলে ভালো লাগবে। ভবিষ্যতে লেখকের কাছ থেকে অনেক চমৎকার গল্প পাওয়ার আশা রাখি। আর এই বইটা আরো অনেক ভালোবাসা ও পরিচিতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
কিছু গল্প মনের ভেতর অনেকটা গেথে যায়, দিন-সময় পার হয় তবুও সেখান থেকে বের হওয়া যায় না। সত্যিই লেখক অনেকটা সেই মানের কিছু গল্প লিখে ফেলেছিলেন প্রায়৷ তবে কিছু গল্প এভারেজ, কিছু বিলো এভারেজ। যেটা স্বাভাবিক একটা গল্প সংকলনের ক্ষেত্রে।
তবে লেখন শৈলী আসলেই দারুন। হয়তো সামনে অনেক ভালো কিছু লেখা পড়তে পারব লেখক থেকে।
❝ পরের জন্মে আমি একটা বই হব।❞ গ্রন্থন এর আবেশ থেকে কেউ বের হতে পেরেছেন?
জগাখিচুড়ি, দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। এই শব্দের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে তা জানি না। তবে ইন্টারনেটে এই শব্দের উৎপত্তি নিয়ে একটি গল্প পেলাম। জগন্নাথ নামে একজন বৈষ্ণব সাধক ছিলেন। স্থানীয়দের কাছে জগা নামেই অধিক পরিচিত তিনি। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি ব্যস্ত থাকতেন সাধনায়। দিনেরবেলায় শুধুমাত্র একবার বাইরে বেরিয়ে বিভিন্ন গৃহস্থ বাড়ি থেকে ভিক্ষা করে চাল, ডাল, শাক-সবজি সংগ্রহ করতেন। এরপর তা একত্রে সিদ্ধ করে নিজের ভোজন সেরে নিতেন। সিদ্ধ চাল, ডাল সহ বিভিন্ন সবজি মিশ্রিত এই খাবারই জগাখিচুড়ি নামে পরিচিতি পায়। . উৎপত্তি যেভাবেই হোক, বাংলা ভাষায় শব্দটি দ্বারা বিশৃঙ্খলা কিংবা একাধিক বিসদৃশ বিষয়বস্তুর একত্রে মিশ্রিত অবস্থাকে বোঝানো হয়। লেখক সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুবর্ণ-রাধিকা’ তেমনই একটা জগাখিচুড়ি। অতিপ্রাকৃত, লাভক্র্যাফটিয়ান হরর, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার সহ জীবনধর্মী জনরার একুশটা গল্পের একটি সংকলন। কিংবা লেখকের ভাষায় এক উদ্ভট হিজিবিজি জগৎ। . আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন যে ‘কোনো কিছু না থাকা’ বা ‘নাথিং’ এবং ‘শূন্য’ এর মধ্যেও পার্থক্য আছে? একটা বদ্ধ অন্ধকার ঘরে যে কিছু নেই, তা আপনি বলতে পারবেন না। কারণ ঘরে আর কিছু না থাকলেও আলোর অনুপস্থিতি অর্থাৎ ‘অন্ধকার’ আছে। কিন্তু শূন্য হচ্ছে না আলো, না অন্ধকার, না সসীম, না অসীম। এক মহাজাগতিক শূন্যতা। . নিশ্চয়ই ভাবছেন যে কী সব আবোলতাবোল বলছি। না, এটা আমি বলছি না। ‘আদিম’ গল্পে বলছে গল্পকথক রাফায়েত৷ ছোটবেলায় যাকে রাগ করে তার মা শাস্তিস্বরূপ কিছুক্ষণ আটকে রেখেছিল অন্ধকার বাথরুমে। তখন হঠাৎ করেই সে মুখোমুখি হয়েছিল এই অদ্ভুত, অপার্থিব শূন্যতার। যার প্রভাব তাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে আজীবন। সে আটকে গিয়েছে শূন্যতার ভেতর। . আবার, প্রায় সব পরিবারেই তো আপন ভাই-বোনেরা ছোট থাকতে পরস্পরকে উত্যক্ত করতে কিংবা হাসি-ঠাট্টা করে বলে যে সে আসলে এই পরিবারের কেউ না। তাকে জন্মের পর রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে। কখনো কি ভেবেছেন এই যে শৈশবে সামান্য একটা কথা কিংবা শাস্তি স্বরূপ অল্প কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকারে আটকে রাখার মতো ঘটনা কারো কারো জীবন অমূল বদলে দিতে পারে? কেননা শিশুমন যে বড্ড সংবেদনশীল। . এক বছর এগারো মাস তেরো দিন আগে এক যুবক প্রেমে পড়েছিল। প্রেমে পড়েছিল ভিনদেশী এক নারীর, যার সাথে দেখা হয়েছিল গীর্জায়। নাম, মারিয়া। তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল চব্বিশে এপ্রিল। কিন্তু বিয়ের ঠিক দুই দিন আগে উধাও হয়ে যায় মারিয়া। যুবক খুঁজতে বের হয়েছে তাকে। গত এক বছর তেরো দিনে বাংলাদেশের এমন কোনো ট্রেন নেই যাতে সে চড়েনি। আজও কর্ণপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী এক ট্রেনে উঠে বসেছে। অপেক্ষায় আছে একটু দুলুনির। আর একটা টানেলের, যার মুখে আবছা ধোঁয়া। গন্তব্য ইতালি। . খারাপ বাতাসের কথা নিশ্চয়ই ���ুনেছেন? রাত্তিরে জঙ্গলে মোষ খুঁজতে গিয়ে সতেরো পেরুনো রবিউলের গায়ে খারাপ বাতাস লেগেছিল। লাল মুখচ্ছবি, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, এলোমেলো চুলে ��াড়ি ফিরেছিল সে। ঝাড়ফুঁকের জন্য হুজুর এসে বলেছিল খারাপ বাতাসের নাম শেহজাদি। কিন্তু রবিউল জানতো, শেহজাদি না, নাম তার সাইকি। সাইকি কে, কোথায় থাকে কিছুই জানতো না সে। শুধু জানতো, রবিউলকে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছে সে, তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না কোনোদিন। পাঠক, গ্রীক পুরাণের রাজকন্যা সাইকিকে চেনেন তো? তার সাথে কি কোনো সংযোগ আছে এর? বইয়ে মোট ২১টা গল্প আছে৷ প্রতিটা গল্প আলাদা আলাদা ভাবে ব্রেকডাউন করতে গেলে বিশাল একটা লেখা হয়ে যাবে। তার উপর ছোটগল্পের পরিসর এমনিতেই ছোট, সামান্য কিছু বললেও আমার মনে হয় বেশি বলে ফেলেছি। তাই সেদিকে আর গেলাম না। ২১টা গল্পের মাঝে আদিম, শালুক, অংশন, বৃশ্চিক, অর্বুদ, ঘুম, হাওয়া, অন্বয়, লা পেরেগ্রিনা, বিভাস বিশেষ ভালো লেগেছে। নাম গল্প সুবর্ণ-রাধিকা মাতৃকালীন সিনড্রমের উপর লেখা। গল্পটা সুন্দর। তবে কিছুটা প্রেডিক্টেবলই লেগেছে আমার কাছে। . সাখাওয়াত হোসেন লৌকিকতা, অলৌকিকতা, পরাবাস্তবতার সংমিশ্রণে লেখা কিছু গল্পের মাধ্যমে পাঠকদের এনে দাঁড় করিয়েছেন কিছু প্রশ্নের সম্মুখে। কিছু গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন মানুষের মধ্যে থাকা একাধিক ব্যক্তিত্ব, মানুষের স্ববিরোধীতাকে। মুখোমুখি করেছেন বাস্তবতার। . অক্সালিস ট্রায়াঙ্গুলারিস; পাতাবাহার জাতীয় এক ধরণের উদ্ভিদ। পাতাগুলো কড়া বেগুনি রঙা। খুব অভিমানী এই গাছ। সামান্য অবহেলায়ও মরে যায়। অনেক সৌভাগ্যবান না হলে অক্সালিসের ফুল হয় না। এই গাছের আরো একটা বিশেষত্ব আছে। মরে যাওয়ার পরেও পর্যাপ্ত যত্ন পেলে পুনরায় গজিয়ে ওঠে। মানব সম্পর্কগুলোও তো এমনই? সামান্য অবহেলা সহ্য করতে পারে না, হয় তৈরী হয় দূরত্ব, নয় তো ভেঙে যায় বন্ধন। কিছু গল্পের মাধ্যমে সাখাওয়াত হোসেন বেশ নিবিড়ভাবে তুলে ধরেছেন সম্পর্কের এই টানাপোড়েনগুলো। . তবে আমার মনে হয় লেখক সবথেকে বেশি অবিচার করেছেন ‘লা পেরেগ্রিনা’ গল্পের সাথে। যেখানে দেখা যায় নেক্সাসের গহীন জঙ্গলে নরম্যান্ড নামের এক সুদর্শন যুবক নিজের কবর খুঁড়ছে। গলায় গোল পাথরওয়ালা একটা লকেট। হাতে একটা কালো ম্যাপেল পাতা। সাথে পাঁচশো বছর পুরোনো এক গল্প। যে অপেক্ষা করছে বিষাক্ত ম্যাপেল পাতার রস খেয়ে নিজেকে নিজেই মাটি চাপা দেওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য ১৫১৩ সালের পানামা উপসাগর। সান্টা মার্গারিটার অদূরে উত্তর-পূর্ব দিকে ছোট্ট এক দ্বীপ ক্যাসি। এই গল্পটা সংকলনের অন্যতম সেরা একটা গল্প। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান, বিখ্যাত ও অভিশপ্ত মুক্তা ‘লা পেরেগ্রিনা’ এর সাথে পানামা উপসাগরের সেই ক্যাসি দ্বীপ, ইংল্যান্ডের রাজপরিবার, ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনার মেলবন্ধন ঘটিয়ে যে শক্তিশালী ঐতিহাসিক যোগসূত্র সাখাওয়াত হোসেন স্থাপন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। লেখক অবিচার করেছেন কেননা এই গল্প আরো বিস্তৃত পরিসরের কোনো উপন্যাস হওয়ার দাবি রাখে। . গল্পগুলোর একটা বিষয় নিয়ে বলতেই হয়, আমার মনে হয়েছে কিছুক্ষেত্রে নারীদেহের অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা করেছেন লেখক। আমি এখন পর্যন্ত লেখকের একমাত্র উপন্যাস ‘মৃগয়া’ পড়েছি। সেখানে এর থেকে ঢের বেশি বিস্তারিত বর্ণনা ছিল যৌনতার। সেগুলো গল্পের প্রয়োজনেই এসেছে। কিন্তু এই বইয়ের কিছু গল্পের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে এই বর্ণনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিছুটা আরোপিত লেগেছে। . সাখাওয়াত হোসেনের গদ্যশৈলী শুধু শক্তিশালীই নয়, মোহনীয়ও। শুধুমাত্র এই গদ্যশৈলীর কারণেই সংকলনের কিছু গল্পের প্লট খুব সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য। ছিমছাম লিরিক্যাল বর্ণনা ভঙ্গি। ইটের উপর ইটের গাঁথুনি দেওয়ার মতো ছোট ছোট সরল বাক্য একের পর এক সাজিয়ে গল্প ফেঁদেছেন লেখক। পাঠক মনে তীব্র অভিঘাতের উদ্দেশ্যে অনুভূতিগুলোকে আরো জোরালো ভাবে উপস্থাপনের অভিপ্রায়ে কখনো কখনো বাক্য শেষ করেছেন মাত্র দুই-এক শব্দেও। মনুষ্য অনুভূতি নিয়ে কেমন করে খেলা যায়, কেমন করে ছড়ানো যায় শব্দজাল তা তিনি বেশ ভালোই জানেন। লেখকের লেখা পড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, গল্পে মিথলজিক্যাল ব্লেন্ডিং তিনি পছন্দ করেন। কাজটা করেনও মুন্সিয়ানার সাথেই। যার প্রমাণ পেয়েছি এখানেও। সাখাওয়াত হোসেন জানেন কোথায় থামতে হবে। পাঠককে একটু সুযোগ দিতে হবে ভাবার, আরো মোহগ্রস্ত হওয়ার। . বর্তমান সময়ের লেখকদের গল্প সংকলন আমার খুব একটা পড়া হয় না। শেষ কবে পড়েছি বলতেও পারবো না ঠিকভাবে। উপন্যাস পড়তেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি আমি। দীর্ঘদিন বসবাস করা যায় ভিন্ন কোনো সময়ে, ভিন্ন জগতে, ভিন্ন বাস্তবতায়। সেদিক থেকে ছোটগল্প বেশ আঁটসাঁট। শুরু হওয়া মাত্রই যেন শেষ। গল্পের বিস্তৃতি কম। তবে ‘সুবর্ণ-রাধিকা’ পড়ে তৃপ্তি পেয়েছি। কিছু গল্প পড়া শেষে কিছুক্ষণ যখন নিশ্চুপ হয়ে ভেবেছি যে কী পড়লাম এটা, যতটুকু সময় নিচ্ছিলাম সেই গল্পগুলোর রেশ কাটিয়ে ওঠার জন্য, তা ‘কম বিস্তৃতির’ এই অভিযোগ কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছে। . পাঠক, আপনারা যারা বইটা ভবিষ্যতে পড়বেন তাদের জন্য একটা পরামর্শ। গল্পগুলো টানা পড়বেন না। লেখকের লেখার প্রভাব খুবই কড়া। তাই সবচেয়ে ভালো হয় প্রতিদিন একটা করে গল্প পড়লে। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি গল্পগুলো আরো বেশি ভালো লাগবে। একটা গল্প অন্য আরেকটা গল্পের ছায়ায়ও প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়বে না। বাড়িয়ে দিবে উপভোগের মাত্রা। ২১টি গল্পের এই হিজিবিজি জগতে আপনাদের স্বাগতম। . বই : সুবর্ণ-রাধিকা লেখক : সাখাওয়াত হোসেন প্রচ্ছদ : পরাগ ওয়াহিদ প্রকাশনী : সতীর্থ প্রকাশনা পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২০৮ মুদ্রিত মূল্য : ৪০০ টাকা
একটা গল্প সংকলনের বই ভালো হয় কিভাবে?বেশিরভাগ গল্প ভালো হলে?বা ভিন্নধর্মী গল্প বেশি থাকলে?এই বইটার ২১ টা গল্পই ডিফারেন্ট লেভেলের।মানে প্রতিটি গল্প নিজ নিজ গুণে শ্রেয়। প্রতিটি গল্প শেষ করে আপনাকে ভাবাবে,চিন্তার খোরাক জমাবে,শেষে গিয়ে ধারনা জন্ম নিবে "এভাবে না হলেও পারত"। নিশ্চিতভাবেই " গ্রন্থন" গল্পটা এই বইয়ের সবচেয়ে সেরা গল্প।আহ গল্পটার শেষের ডায়লগ টা যা ছিল না।এখন ও মনের মধ্যে রয়ে গেছে।দ্বিতীয় সেরা গল্প অবশ্যই বিভাস গল্পটা। একটা মিথের উপর বেইজ করে পুরো গল্পটা সাজিয়েছে লেখক।দুর্দান্ত একটা এক্সিকিউশন ছিল পুরো গল্পটার।২১ টা গল্পের মধ্যে এই দুইটা ছিল সেরার সেরা। বইয়ের গল্প গুলো ধীরে ধীরে পড়বেন।একবারে টানা পড়বেন না কারণ লেখকের লেখার নেশায় জড়িয়ে যাবেন।সকালে ধরলে ৩ টা,বিকালে দুটো,রাতে ৩ টা এভাবে শেষ করবেন।
ছোটগল্পে জীবনের সামগ্রিক দিকটি উপন্যাসের মতো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত না হয়ে বরং এর আংশিক পরিবেশিত হয়। এজন্য ছোটগল্প যথাসম্ভব বাহুল্যবর্জিত, রসঘন ও নিবিড় হয়ে থাকে। সংগত কারণেই এতে পাত্রপাত্রী বা চরিত্রের সংখ্যা খুবই সীমিত হয়। ছোটগল্পের শুরু ও শেষ দৃশ্যপট সাধারণত খানিকটা নাটকীয় হয়। ছোটগল্পের এই গদবাঁধা মুখস্থ সংজ্ঞা আমরা সবাই জানি কম বেশি।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অবশ্যই কাহিনীর প্রেক্ষাপট, চরিত্রায়ন খুব সতর্কভাবে নির্ধারণ করা উচিত লেখকের যাতে গল্প পড়ার ক্ষেত্রে পাঠকের মনোযোগ ক্ষুণ্ন না হয়। এবং গল্পের সাথে নিজেকে সংযুক্ত ���রতে পারে পাঠক নিজেকে। আমি ছোটগল্প পড়তে পছন্দ করি কারণ আমার কাছে ছোটগল্পের আবেদন বেশ রোমাঞ্চকর লাগে। একটা বিষয়কে অল্প কথায় এমনভাবে লেখককে তুলে ধরতে হবে যেন গল্প শেষ হয়েও হলো না যেন শেষ।
সাখাওয়াত হোসেন, ওনার প্রথম উপন্যাস "মৃগয়া" আমি পড়িনি তবে পড়লাম ওনার প্রথম গল্পগ্ৰন্থ "সূবর্ণ রাধিকা"। এবং একুশটি গল্প নিয়ে সাজানো এই বইটাকে আপনি আসলে ঠিক নির্দিষ্ট একটা জনরায় ফেলতে প��রবেন না। এখানে রয়েছে বিভিন্ন জনরার মিশেলে তৈরি গল্প।
🍁আমি যদি প্রথম গল্প আদিম নিয়ে বলি এখানে এক কিশোরের ভয়াবহ ভয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যা বড়বেলা অবধি সে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সে শূন্যকে ভয় পায়। শূন্য কী জিনিস? শূন্য তো ফাঁকা। কিন্তু এই কিশোর শূন্যকে দেখতে পায়! এবং এই ভয়াবহ ভয়ের অনুভূতি বাকিদের বোঝাতে চায়। তারপর কী তবে?
🍁প্রসূন এই কোমল শব্দটি আদৌ কী কোমল? নাহলে লিলি কেনো তাঁর বাচ্চার মাথার কাছে ফুলের গোছা দেখে ভয় পায়? ফুল তাঁকে ভয় দিচ্ছে নাকি এই ফুল আদৌ এই পৃথিবীতে আছে কী না সে জানে না? এই পৃথিবীতে যারা বইপোকা বা বইপ্রেমী গ্রন্থনে ডুবে যাঁদের আনন্দ, তাঁরা আশেপাশের মানুষদের নিয়ে আদৌ কী ভাবে? মাঝে মাঝে কিন্তু ভাবা উচিত। একটা মেয়েকে বুঝতে হলে রাশি রাশি বই পড়লেই কী শুধু চলে? মেয়েটি অপেক্ষা করে পাশে বসে, মেয়েটি অবাক হয়ে দেখে এক গ্ৰন্থনে আবদ্ধ সত্তাকে। তারপর কী আর তাঁকে বোঝানো যাবে মনের কথা?
🍁বৃশ্চিকে হয়েছে শেষ সব যেন। ছোট্ট একটা পরিবারের সামান্য সামান্য কিছু সূক্ষ্ম বিষয় যে একটা বাচ্চার মনে কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে! একেকজনের ওপর প্রভাবটা একেক রকম।পুষ্পের ওপর প্রভাব পড়ে স্বপ্নে। সে স্বপ্ন থেকে জাগে না। এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নে যায়,যখন জাগে তখনও বুঝতে পারে না। ওদিকে সব অপার্থিব হয়ে ধরা দিচ্ছে এক স্বামীর মনে। কারণ তাঁর সন্দেহ তাঁর স্ত্রী লিলিয়ান তাঁকে খু ন করবে। সে নিজেকে প্রস্তুত করছে মানসিকভাবে। কিন্তু তাঁরা তো একজন আরেকজনকে অসম্ভব ভালোবাসে। তবে কেনো এসব?
🍁অন্তরকলনে অন্তরের ক্ষোভ প্রকাশ নাকি অন্তরের ভালোবাসার অনুভূতি? এখানে শোনা যাবে দুই পুরুষের অন্তরকলন দুই ভিন্ন ভিন্ন রুপে। গীর্জায় প্রার্থনারত এক যুবতীকে দেখে প্রেমে পড়ে গেলো এক যুবক। গভীর ঘনিষ্ঠ প্রেম। সেই প্রেম টিকেছিলো এগারো মাস। যুবতীর মধ্যে ছিলো কিছু রহস্য,একটা অতীত,হাতে পায়ে কালচে দাগ। আর ট্রেনপ্রীতি। তারপর কী হলো? একদিন সেই যুবতী হারিয়ে গেল হঠাৎ। কিন্তু কোথায়?
🍁শালুক ফুলের কথা নয় এখানে ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে জমাট বাঁধা কালো র ক্তের শালুক ফুল। এখানে সুতপা আছে, আছে প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধের গল্প। আবার দূর পারাবারে যাত্রারত বন্ধুকে নিয়ে আরেক বন্ধুর গল্পে দেখা মিলবে এক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। খুব সাদামাটা তবুও ভালো লাগবে যেন ওই আবেগগুলো।
🍁অংশনের দংশন কী এটা? গীর্জার কনফেশন রুমে একজন যুবক এসেছে কনফেশন করতে। অন্যদের সাথে তাঁর কনফেশনের ভিন্নতা আছে। সে এখনো পর্যন্ত কোনো পাপ করে নি। কিন্তু করবে। সে শোনাতে এসেছে আরেকজনের পাপের গল্প। তেমনি যেমন দুপুরবেলা খোরশেদ আলমের মনে হলো তিনি কুকুর হয়ে যাচ্ছেন। ওরকম কথার কথা নয় একদম আক্ষরিক অর্থেই। তিনি অনুভব করছেন তাঁর লেজ গজাচ্ছে,তাঁর ঘাম হচ্ছে না, জিহ্বা বের করে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে। স্ত্রী এতে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু আট বছরের কন্যা মজা পাচ্ছে। তিনি মোচকের মতো আরেকটা নতুন খোলসে আবৃত হচ্ছেন কিন্তু কীভাবে হলো এসব?
🍁মন্দিরের পাশে একটা পুকুর। পুকুরে অনেক টাকা খরচ করে ছাড়া হয়েছে মাছের পোনা। কিন্তু মাছ হচ্ছে না। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় কর্তা ঠিক করলেন মন্দিরে একটা বলি দিবেন। মধ্যরাতে চুরি করলেন একটা ছাগল। যেমন আবার ঘুমের গল্পে জড়িয়ে আছে ছোট্ট মিমি। হৃদয়স্পর্শী যেই গল্পের সবটা।
🍁রবিউলের একরাতে হাওয়া লাগলো। খারাপ বাতাস যাকে বলে। হাওয়ার নাম শেহজাদী। আরেকটা নাম আছে তাঁর সেটা হলো সাইকি। সাইকিকে রবিউলকে ভালোবাসে। ওদিকে নেক্সাসের এক জঙ্গলে নিজের কবর খুঁড়ছে এক যুবক। হাতে একটা ম্যাপল পাতা। রং কালো। তাঁর গল্প পাঁচশ বছরের পুরোনো।
🍁অক্সালিস ট্রায়াঙ্গুলারিস হলো পাতাবাহার জাতীয় একধরণের উদ্ভিদ। তিনটি করে পাতা থাকে। এই গাছ অল্প অবহেলায়ও সইতে পারে না। মরে যায়। বন্যা, বিন্তি, রিমি কী অক্সালিস গাছের সেই তিন পাতার মতো? অপরদিকে একজন চোর চুরি করতে ঢুকেছে এক বাসায়। বেডরুমের দরজায় দুইটা ফুটো। ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ভয় পেয়ে উল্টো পালানোর চেষ্টা করলো। পালাতে পারবে সে? কী আছে বেডরুমের ভেতরে?
🍁বিন্দু ব্যাথা পায় না কখনো। বিন্দু আদৌ কী ব্যথা পায় না নাকি বাবার মারগুলোকে নিজের শরীরে দাহ করে দিয়েছে ব্যথাহীন অভিনয়ে? ইভার মা ম রে গিয়ে সৎ মা হিসেবে এসেছে মায়ের বোন শায়না। ইভা শায়নাকে শাস্তি দিতে শুরু করে কারণ তাঁর ধারণা তাঁর মায়ের চলে যাওয়ার জন্য দায়ী শায়না। কিন্তু একটা লিফট, একটা পরিকল্পনা তারপর ঘটবে কিছু একটা।
🍁 জেনিফারের বয়স দশ বছর তখন তাঁর বাবা মা ঠিক করলেন আলাদা হবেন। মেয়েকে কেটে দুই ভাগ করে বাবা মা ভাগ করে নিলেন। কিন্তু জেনিফারের কী হবে? সে কী এভাবে নিজের শরীরকে আলাদা করে বাবা মায়ের শখ পূরণ করতে চেয়েছিল? সুবর্ণ রাধিকা দুই নাম কিন্তু ভালোবাসায় ভরপুর জীবন তাঁদের। কিন্তু একদিন রাধিকা হারায় নিজের বাচ্চাকে। এবং বাচ্চাটাকে বারান্দা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে সূবর্ণ! এটা কীভাবে সম্ভব! একজন বাবা নিজের সন্তানকে খুন করেছে?
যদি আমি ওভারঅল এই বইটাকে দেখতে যাই এখানে বিভিন্ন ধরনের গল্প আছে। এখানে যেমন হরর আছে, আছে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, ক্রাইম থ্রিলার, সাইন্স ফিকশনের সাথে হালকা হিস্টোরিক্যাল ছোঁয়া সহ লাভক্রাফটিয়ান হরর, জীবনধর্মী কিংবা ইমোশনাল গল্পের প্লট। এবং গল্পের মধ্যে এত এত ভেরিয়েশন যে আমার কাছে বেশ বৈচিত্র্যময় মনে হয়েছে।
তবে সবগুলো গল্প আমার কাছে ভালো লাগেনি আবার কিছু কিছু গল্পে লেখক দারুন। যেমন জননী গল্পটি আমার কেনো জানি খুব ভালো লাগলো আবার অন্তরকলনে টুইস্ট বুঝতে পারিনি। অংশন দারুন রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিলো। আবার বিভাস খুবই বোরিং লেগেছে এন্ডিং। এরকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিলো আমার ক্ষেত্রে।
লেখকের লেখনী বেশ ভালো। গল্প প্রেজেন্ট করার মতো সক্ষমতা আছে। আমার ভালো লেগেছে ওনার গল্পগুলোর গভীরতা। দুই একটা সাদামাটা হলেও বেশিরভাগই ছিল বেশ গভীর বার্তার। এখানে আপনাকে বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে।
প্রায় গল্পের মধ্যেই একটু আধটু ১৮+ বর্ণনা উনি রেখেছেন এটা বেশ অস্বস্তি দিয়েছে। কারণ আমার মনে হয়েছে কিছু কিছু গল্পে আসলে প্রয়োজন ছিলো না। না দিলেও গল্পটা জমজমাট থাকতো। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত একান্ত। আশা করছি এটা নিয়ে অন্যরা নিজেদের মতামত দিয়ে বিব্রত করবেন না আমাকে।
ছোটগল্প যদি একটু অন্য স্টাইলে, অন্য ধাঁচে উপভোগ করতে চান অবশ্যই তাহলে সূবর্ণ রাধিকা ট্রাই করা উচিত। সতীর্থ প্রকাশনার প্রোডাকশন ভালো ছিলো। বানান ভুল চোখে পড়লো না তেমনি প্রিন্ট বেশ ঝকঝকে। প্রচ্ছদটা মোটামুটি লেগেছে আমার।
🍁 বইয়ের নাম: "সূবর্ণ রাধিকা" 🍁 লেখক: সাখাওয়াত হোসেন 🍁 প্রকাশনী: সতীর্থ প্রকাশনা 🍁 ব্যক্তিগত রেটিং: ৪.৩/৫
আমার কাছে গল্প সংকলনের রিভিউ লেখা কঠিন মনে হয়। কেননা ছোট ছোট গল্পের যা-ই লিখি না কেন, মনে হয় স্পয়লার হয়ে যাবে। তাছাড়া ছোটগল্পের সংকলন আমাকে ঠিক টানে না। খুব বেছে বেছে কিছু বই পড়ার চেষ্টা করি। সম্প্রতি শেষ করলাম সাখাওয়াত হোসেনের “সুবর্ণ-রাধিকা” বইটি। খুব কম গল্প সংকলনের বই আছে যার পুরোটা মুগ্ধ করার মতো। “সুবর্ণ-রাধিকা” ঠিক তেমনি একটি বই।
বইটিতে মোট একুশটি ছোট গল্পের স্থান পেয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম এই একুশটি গল্পের সারসংক্ষেপ আলোচনা কর���। পরে মনে হলো, তাতে স্পয়লার হয়ে যাওয়ার সময় সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সবগুলো গল্পের কাহিনি আলোচনায় আনছি না। এই একুশটি গল্প একুশ রকমের ভালো লাগা ছড়িয়ে দিয়েছে। কোনো গল্পকে যে ভালো লাগেনি বলব, এমন কোনো অনুভূতি হয়নি। বরং দুর্দান্ত কিছু অনুভূতি দিয়ে গিয়েছে।
বিভিন্ন জনরার গল্পের সমাহার ছিল বইটিতে। কোনটা মনস্তত্ত্বের, কোনটা সামাজিক, আবার কোনোটা অতিপ্রাকৃত। কিছু থ্রিলার জাতীয় গল্পও স্থান পেয়েছে। সবগুলো গল্পতেই লেখক তার নিজস্ব স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। একজন লেখকের নিজস্বতা বলে একটা বিষয় থাকে, সাখাওয়াত হোসেনের প্রথম কোনো লেখা পড়ে সেই নিজস্বতা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।
গল্পগুলোর মধ্য থেকে জানা যায়, একটি পরিবারে একাধিক সন্তান থাকলে প্রত্যেককে সমান গুরুত্ব দিতে হয়। ছোটকালে পরিবারে অনেকে অনেকভাবে মজা করে। কিছু কথা সবসময় বলতে হয় না। সবার না হলেও কারো ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে সেই কথাটা গেঁথে যায়। আর তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। মজা করে বলা কথার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে নিতে চায়। মানসিক রোগের সূত্রপাত হয়ও এখান থেকে। আবার কোনো কোনো অপরাধ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেতে চায়। আর তাতে অদ্ভুত কিছু করে ফেলা হয়তো বাস্তব মনে হয়। সত্যিই কি বাস্তব!
আবার কোনো গল্পে আছে ভালোবাসার বীজ। যেমন করে আমরা ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসা পাই না। ভালোবাসার মানুষের হয়তো অন্য কোনকিছুতে ডুবে থাকতে ইচ্ছা করে। আমরাও ডুবে থাকতে চাই, হতে চাই সেই ডুবন্ত কোনো জাহাজ। ভালোবাসার মানুষ কখনো হারিয়ে যায়। হারিয়ে যেতে যেতে সেই হারানোর খোঁজ করতে গিয়ে সময় পেরিয়ে যায়। খোঁজ আর পাওয়া যায় না কিছুতেই। আবার কখনো সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তান বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে যখন শেষ নিঃশ্বাস, কালপ্রিটকে খুঁজে বেড়ায় বাবা, কিংবা না। কিন্তু যখন সত্য সামনে আসে, চমকে যেতে হয়। সত্য সবসময় নির্মম!
এভাবেই মানসিক অস্থিরতা ঘিরে ধরে। কখনো কোনো গল্পের চরিত্র মাথায় গেঁথে যায়, যার ফল হয় ভয়াবহ। কখনো ছোটবেলায় স্বপ্ন পূরণের বাঁধা অন্য এক সত্তায় পরিণত করে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণআনিসকে ভুল পথে পরিচালিত করে। বইটির কিছু অংশে লেখক গ্রীক পুরাণের বর্ণনা এনেছেন, কিন্তু মনস্তত্ত্বের আলোচনা করেছেন। ভয়ের বীজ বপন করেছেন। আবার কিছু গল্পের বিভৎসতা এতটাই ছিল যে, দুর্বল চিত্তের মানুষের হয়তো সহ্য হবে না।
আমরা সবসময় যা চোখে দেখি বা যা জানি, সবসময় সত্য নাও হতে পারে। কেননা আমাদের মনস্তত্ত্বকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা যায়। কাছের মানুষ ভুল হলেও তাকে বেশি বিশ্বাস করে সবাই। ফলে সত্য সামনে এসে কম। মিথ্যার আশ্রয়ে ভুলটাও হয় বেশি। কিন্তু সত্য যখন সামনে আসে তখন বিশ্বাসের ভিতও নড়ে যায়। এমন এক অদ্ভুত সুন্দর গল্প বইতে ছিল। যার শেষটা মায়াময়। আরেকটি গল্পের সেটা বেশ ভালো লেগেছে। যেখানে এক সন্তান বখে গিয়ে যখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, মা হারিয়ে যায়। বোনেরা অন্য কারো অস্তিত্ব হয়ে বেঁচে আছে, তখন বদলে যাওয়া নারী হিসেবে আবির্ভাব হওয়ার সময়টা! বেশ প্রিয় গল্প হয়ে থাকবে।
এমন অসংখ্য গল্প ভালো লাগার স্থান দখল করে নিয়েছে। কিছু গল্প ভয় ধরিয়েছে। কিছু বিভৎসতায় গা শিউরে উঠেছে। আবার এমন অনেক গল্প ছিল, যেগুলোর রহস্য শেষ পর্যন্ত বেঁধে রেখেছিল। চমকে যাওয়া কিছু উপকরণ হিসেবে ধরা দিয়েছে। সবগুলো নিয়ে কথা বললাম না। পাঠক নিজেরাই গল্পের মধ্যে প্রবেশ করুক, অনুভব করুক।
লেখকের লেখা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ছোটো ছোটো বাক্যে যেভাবে লিখেছেন, এই ধরনের লেখা আমার বেশ পছন্দ। কেননা এমন লেখনশৈলী খুব সহজে মননের সাথে যুক্ত করে দেয়। ফলে লেখার মায়ায় পড়ে আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। লেখকের লেখায় এক ধরনের বিষণ্ণতা আছে। যা ছুঁয়ে দিয়ে যায়। সাবলীল ভঙ্গিতে এভাবে আকৃষ্ট করার গুণ সব লেখকের থাকে না। প্রথমবার পড়ে বেশ মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে ছোট গল্পের ক্ষেত্রেই লেখক যেভাবে কারুকাজ করেছেন, শুরু থেকে শেষ— যেভাবে গল্প সাজিয়েছেন, একুশটা গল্পের কোনোটাতেই বলা যায় না তিনি তাড়াহুড়ো করেছেন। বা কোনো খামতি ছিল। সবগুলোই আমার কাছে যথাযথ মনে হয়েছে।
ছোটগল্পের ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ করা যায়, যে শুরুটা ভালো হলেও শেষটা হয় না। কিংবা শেষ করার পর মনে হয় আরও কিছু থাকলে ভালো হতো। কিন্তু “সুবর্ণ-রাধিকা” বইটির সবগুলো গল্পে এমন কিছু লক্ষ্য করিনি। বরং যেখানে যেভাবে শেষ করার প্রয়োজন ছিল, সেভাবেই শেষ হয়েছে। কিছু গল্পের সমাপ্তি বেশ তৃপ্তি দিয়েছে। হয়তো পরবর্তী ঘটনা জানতে মন চায়, তবুও সবকিছু যে সবসময় জানা হয় না। আবার কিছু গল্পে শেষে ভাবতে হয়। এখানে লেখকের ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যায়। পাঠক নিজের মতো করে ভেবে নিক। কিংবা অনুভব করুক গল্পের সমাপ্তি।
পরিশেষে, একক গল্প সংকলন, কিংবা ছোটগল্প যারা পছন্দ করেন এই বই সহজেই পড়তে পারেন। তবে ছোট্ট একটি ডিসক্লেইমার, দুর্বল চিত্তের মানুষ হলে কয়েকটি গল্প আপনার জন্য না। আবার কিছু সামাজিক গল্প এতটাই দারুণ, এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। দিন শেষে একটি বই উপভোগ করাটাই আসল। “সুবর্ণ-রাধিকা” তেমনই এক বই।
নিঃসন্দেহে সাখাওয়াত হোসেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলে থাকবে কোন একদিন । তার লেখনী একদিকে যেমন গভীর জীবনবোধে পরিপূর্ণ, অন্যদিকে তেমনই রহস্য, অতিপ্রাকৃত ও মানবমনের অন্ধকারতম কোণগুলোকে আবিষ্কারের এক দুর্লভ সাহসিকতা বহন করে। তিনি শুধু গল্প বলেন না বরং পাঠককে এক অনন্য অভিজ্ঞতায় ডুবিয়ে দেন, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার সীমানা মুছে যায়।
তার সৃজনশীল শক্তি চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয় প্রতিটি গল্পের কাঠামো, চরিত্র গঠন ও ভাষাশৈলীতে। লেখার মধ্যে আছে একধরনের নির্মেদ সৌন্দর্য, যেখানে অপ্রত্যাশিত মোড়, দার্শনিকতা এবং আবেগ একসঙ্গে মিশে এক ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করে।বিশেষ করে তার গল্পে যেভাবে অতিপ্রাকৃত বা হরর উপাদানগুলোর সঙ্গে মানবিক আবেগ ও মনস্তত্ত্ব মিশে যায় তা খুব কম লেখকের মধ্যেই দেখা যায়। তিনি ভয় দেখান, কিন্তু সেই ভয় কেবল বাইরের নয়, ভয় জন্ম নেয় পাঠকের ভেতরে, চিন্তায়, আত্মার গভীরে।তার গল্প পড়তে পড়তে পাঠক নিজেও নিজের অস্তিত্ব, পরিচয়, ভয়, স্বপ্ন সব কিছু নিয়ে ভাবতে বাধ্য হন। সেই ভাবনার গভীরতা কখনো নীরব অস্থিরতা তৈরি করে, কখনো বা চরম বিস্ময়।
সাখাওয়াত হোসেনের লেখনীতে রয়েছে পরিপক্বতা, নির্মোহ চিন্তাভাবনা এবং সমাজ, ইতিহাস ও মননের মিশ্রণ। তিনি সময়কে অতিক্রম করে পাঠকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলার মতো ক্ষমতা রাখেন।আমি মুগ্ধ, অনুপ্রাণিত ও ঋদ্ধ তার গল্প পড়ে। তার প্রতিটি লেখা যেন এক একটি দরজা, যা খুললে পাঠক প্রবেশ করেন অজানা, অথচ চিরচেনা এক বাস্তবতায়। বাংলা সাহিত্যে তিনি নিঃসন্দেহে এক অমূল্য সম্পদ।সুবর্ণ রাধিকা সাখাওয়াত হোসেনের এই গল্পগ্রন্থটি এক কথায় অসাধারণ। প্রতিটি গল্পই পাঠককে ভিন্ন এক আবেগ, রহস্য বা চিন্তার জগতে নিয়ে যায়। লেখকের গল্প বলার ভঙ্গি, ভাষার সৌন্দর্য এবং প্রতিটি গল্পের অন্তর্নিহিত বার্তা এই সংকলনকে অনন্য করে তুলেছে।এই গল্পগ্রন্থটির একেকটি গল্পে একেক রকমের আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ভয়, রহস্য, ভালোবাসা, স্বপ্ন, স্মৃতি আর সম্পর্কের টানাপোড়েন। সুবর্ণ রাধিকা গল্পের গাঁথুনি, ভাষার মুন্সিয়ানা ও অনুভবের গভীরতায় পাঠককে ধরে রাখতে জানেন।
গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো নিয়ে ছোট্ট করে রিভিউ
আদিম – গা ছমছমে এক গল্প, যেখানে বদ্ধ বাথরুমে আটকে পড়া এক শিশুর অভিজ্ঞতা অদ্ভুত এক টুইস্টের মাধ্যমে ভয়ের নতুন মাত্রা যোগ করে। গল্পে�� শেষাংশে পাঠককে কিছুক্ষণ থামতে হবে, শ্বাস নিতে হবে, তারপর আবার পড়তে হবে
প্রসূন– গল্পে এক অদ্ভুত ফুলের গন্ধ রসুনের মতো যা প্রতিরাতে শিশুর মাথার পাশে এসে পড়ে, ঘুমন্ত মা-বাবার অজান্তে। লেখক চমৎকার এক রহস্যময় ও ঘোরলাগা আবহ তৈরি করেছেন। শুরুটা যেন হুমায়ূন আহমেদের 'দেবী'র মতো মনে হলেও, শেষাংশে লেখক একেবারে নিজস্ব স্টাইলে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এখানেই তাঁর মৌলিকত্ব ও দক্ষতা ফু��ে উঠেছে। ভয়ের ভেতরেও মায়ার একটা স্তর জেগে থাকে গল্পটি পাঠককে সেটাই ভাবায়।
গ্রন্থন– গল্পটি এক অদ্ভুত সহচর্যের গল্প এক ছেলে আর এক নীরব মেয়ে নাম দিয়া। সারাদিন মেয়েটি ছেলেটার আশেপাশে বসে থাকে, কথা বলে না শুধু চেয়ে থাকে। গাছ বা পাথরের মতো নিষ্পন্দ তবু যেন একটা জীবন্ত উপস্থিতি। দিয়া চোখের ভাষায় এক নিঃশব্দ গল্প বলে, কিন্তু সেই ভাষাও যেন রহস্যে মোড়া। লেখক নিঃসঙ্গতা আর মানব-সম্পর্কের ভেতরকার শূন্যতাকে নিপুণভাবে এঁকেছেন। ❝পরের জন্মে আমি একটা বই হব ❞ এই এক লাইনে যেন গল্পের সবটুকু বেদনা গেঁথে রেখেছেন তিনি।
বৃশ্চিক– গল্পটি যেন শিশুমনের গভীরে প্রবেশ করার এক নিখুঁত চেষ্টা। পরিবারের ছোট ছোট বিষয়, ভাষা, মনোযোগ, উপেক্ষা কীভাবে একটা শিশুর মনে গভীর ছাপ ফেলে, তাই নিয়েই এই গল্প। পুষ্প স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যায়, সে ঘুমিয়ে থেকেও জেগে থাকে , জেগে থেকেও যেন ঘুমায়। মা রোকসানা টের পান, কিন্তু বাবা ততটা গ্রহণ করেন না সত্যটা। গল্পটি বাস্তব আর অবচেতনের মধ্যবর্তী এক বিষণ্ন জগতে পাঠককে নিয়ে যায়।
অপার্থিব– গল্পটি রহস্য আর মানসিক বিভ্রান্তির দোলাচলে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানুষের জার্নি। কথকের স্ত্রী লিলি যাকে তিনি ভালোবেসে লিলিয়ান বলেন, তার চারপাশে এক অদ্ভুত ছায়া ফেলেন। কথক বিশ্বাস করেন, লিলিয়ান তাকে খুন করবেন, এমনকি কীভাবে করবেন, তাও জানেন তিনি! তবে সবচেয়ে অদ্ভুত সত্য হলো লিলিয়ান একা নন, ছয়জন লিলিয়ানকে তিনি দেখেছেন!এই গল্প অপার্থিব নয় বরং পার্থিব বাস্তবতার মধ্যেই গাঁথা এক মানসিক রহস্য।অত্যধিক ভাবনা মানুষের জীবনে সুফল বয়ে আনে না কখনোই তারই বহিঃপ্রকাশ এই গল্প।
অন্তরকলন– প্রথমে সাধারণ এক অপহরণকাহিনি মনে হলেও আস্তে আস্তে উন্মোচিত হয় এক মানবিক অনুসন্ধানের স্তর।শফিকুল নামের এক বিকৃতমনস্ক ব্যক্তি কীভাবে মিনি নামের এক যুবতীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, তার বর্ণনা যথেষ্ট বিস্তারিত ও গ্রাফিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মিনি নিখোঁজ হওয়ার পর তার বন্ধু জোনায়েদ দিনের পর দিন তাকে খুঁজে বেড়ায় এই খোঁজ পাঁচ বছর গড়িয়ে যায়, কিন্তু সে কোনো কূলকিনারা পায় না। গল্পে সহিংসতা ও নির্যাতনের বর্ণনা এতটাই বাস্তব ও উদ্দীপ্ত যে সংবেদনশীল পাঠকদের জন্য এটি অস্বস্তিকর হতে পারে।
বিভাস– গল্পটি শুরু হয় মারিয়া নামের এক খ্রিস্টান নারীর প্রতি কথকের প্রেম দিয়ে। প্রথম দেখায় প্রেম, তারপর গীর্জার গোপন অপেক্ষা, ধীরে ধীরে দুই হৃদয়ের বন্ধন সবই যেন এক কবিতার মতো। তবে প্রেম যতই গভীর হয়, ততই উন্মোচিত হয় মারিয়ার জটিল অতীত আর চোখে লুকিয়ে থাকা বিষণ্নতা। একদিন হঠাৎ করেই মারিয়া হারিয়ে যায়, এক রহস্যঘেরা বিদায় যার উত্তর নেই, কেবল প্রশ্ন রেখে যায়। নীরব বিষাদের ভেতর মোড়ানো এক স্মৃতিকথা।
শালুক– গল্পের কেন্দ্রে আছে সুতপা এক সহজ-সরল গ্রামীণ মেয়ে, যে ভালবেসেছিল এক অচেনা পুরুষকে। ভাগ্যের পরিহাসে তার বিয়ে হয় অন্য একজনের সঙ্গে, কিন্তু গর্ভে ধারণ করে প্রেমিকের সন্তান। সন্তান জন্মের দেড় বছরের মাথায় সুতপা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বহু বছর পর, তার সেই কন্যাশিশু বড় হয়ে ওঠে আর ঘটতে থাকে কিছু অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড, যার সূত্র গিয়ে মেলে সুতপার অতৃপ্ত জীবনের দিকে।এই গল্প প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, আর অপ্রকাশিত রাগ ও যন্ত্রণার এক সূক্ষ্ম ও তীব্র বুনন। শেষে এক চিঠির মধ্য দিয়ে খোলে অতীতের মুখ, আর পাঠকের মনে রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী বেদনার ছায়া।
পারাবার– তওকীর, প্রীতি আর কথক তিনজন ছিল অবিচ্ছেদ্য বন্ধু। হঠাৎ ক্যাম্পাসে উল্টো করে পুঁতে রাখা তওকীরের লাশ পাওয়া যায়।প্রীতি কান্নায় ভেঙে পড়লেও, কথক থাকে একেবারে নিস্পৃহ। এই অনুভূতির ফারাকই তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে।আট বছর পর এক হঠাৎ দেখা পুরোনো ক্ষত আবার চাগাড় দেয়, আবার তারা ডুবে যায় স্মৃতির স্রোতে।এই গল্প বন্ধুত্ব, মৃত্যু ও অনুভূতির ভিন্ন প্রকাশ নিয়ে এক সংবেদনশীল অনুধ্যান। স্মৃতিমাখা বিষণ্ণতা আর নীরব মানসিক দ্বন্দ্বের নিখুঁত প্রকাশ ঘটেছে গল্পটিতে।
অংশন–গল্পটি শুরু হয় একুশ বছরের এক যুবকের গীর্জায় কনফেশন করতে আসার মধ্য দিয়ে।প্যান্ডোরা ও তার রহস্যময় বাক্সকে ঘিরে প্রতীকী ব্যাখ্যা গল্পের শুরুটা করে অনন্য।পাঠক ধীরে ধীরে আবিষ্কার করে, সেই বাক্সের মতোই যুবকের জীবনে জমে থাকা এক গোপন পাপের ভার।কাইমেরা নামের পৌরাণিক রূপকের ব্যবহারও গল্পে যুক্ত হয়েছে দারুণ এক ঘোর সৃষ্টি করতে।
মোচক– খোরশেদুল আলমের আচমকা কুকুরে রূপান্তরপ্রথমে মজার মনে হলেও ধীরে ধীরে তা এক গা ছমছমে বাস্তবতায় মোড় নেয়।স্ত্রী হাস্যরসেই বিষয়টি উড়িয়ে দেন, কিন্তু খোরশেদের অস্বাভাবিক আচরণ তাকে ভাবিয়ে তোলে।কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে বসে থাকা, হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা, আর ঘেউ ঘেউ করে ডাক সবকিছু যেন ধীরে ধীরে মানসিক রূপান্তরের দিকে ইঙ্গিত দেয়।গল্পের গভীরে লুকিয়ে থাকে এক অপূর্ণ সম্পর্ক, প্রতারণা, আর চাপা অনুশোচনার ইঙ্গিত।রূপকধর্মী এই গল্প বাস্তব আর বিকৃত কল্পনার মাঝামাঝি এক অদ্ভুত জায়গায় দাঁড় করায় পাঠককে।
মন্দির–ভগ্নদশা এক মন্দির আর তার পাশে রহস্যময় পুকুর যেখানে মাছ পোনা ছাড়া হলেও কোনো মাছ হয় না।অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে কর্তা ঠিকে বলির রাস্তা ধরেন। মধ্যরাতে চুরি করে আনা ছাগলকেই বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত।কিন্তু প্রথম কোপে মাথা না পড়ে গিয়ে ঘাড়ে ছুরি গাঁথা অবস্থায় ছাগলটি দৌড়ে যায় এ দৃশ্যেই শুরু হয় গা ছমছমে আতঙ্ক।মন্দিরের পরিবেশ, রাতের নিস্তব্ধতা আর সেই ছাগলের বিভীষিকাময় পালানোর দৃশ্য গল্পে এক অদ্ভুত অশরীরী আবহ তৈরি করে।হররপ্রেমীদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি টানটান উত্তেজনায় ভরা এক গল্প।
ঘুম– দুই ভাই-বোন, হাসিব ও মিমিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এই গল্পটি শুরু হয় এক উষ্ণ, সরল সম্পর্কের ছোঁয়ায় ভালোবাসা, খুনসুটি, আর নির্ভরতার ছায়ায়। মিমির আগমনের পর হাসিবের জীবন রঙ পায়, ছোট ছোট মুহূর্তগুলো হয়ে ওঠে অর্থবহ।তাদের মধ্যকার সম্পর্ক যেন পাঠকের মনে একটা নির্মল, ঘরোয়া অনুভূতি এনে দেয়।কিন্তু ঠিক তখনই গল্প এক ভিন্ন মোড় নেয় একটা ট্র্যাজিক পরিণতি পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়।এটি এমন একটি গল্প, যার শেষ শব্দগুলোও কিছু সময় পাঠকের মাথায় রয়ে যায়। স্মৃতিমেদুর আর আবেগঘন গল্পটি পড়ার পর ঘুম আসবে না, বরং থেকে যাবে দীর্ঘশ্বাস।
হাওয়া– রবিউলের শরীরে এক রাতে লাগে ‘হাওয়া’এক অদ্ভুত, অশরীরী অনুভব।হাওয়ার নাম শেহজাদী, যদিও সে নিজেকে সাইকি বলে পরিচয় দেয়।সাইকি রবিউলকে ভালোবাসে, এমনকি জানিয়েও দেয় সে কখনো রবিউলকে ছাড়বে না। বিশ বছর ধরে চেষ্টা করেন বোঝার এটা পাগলামি, না এক গভীর সত্য? পুরো গল্পে একটা হালকা আতঙ্ক, অলৌকিকতার ছায়া যা মনে করিয়ে দেয় মিসির আলীর অতল রহস্যকে।এটা শুধু গল্প না, একটা অসমাপ্ত প্রশ্ন যার উত্তর হয়তো কখনোই জানা যাবে না।
লা পেরেগ্রিনা– জঙ্গলের মাঝে মাটি খুঁড়তে থাকা এক রহস্যময় লোকের সাথে দেখা হয় গল্পকথকের।তার মুখে শোনা যায় ‘লা পেরেগ্রিনা’ নামক এক অভিশপ্ত মুক্তার ইতিহাস।যার হাতেই উঠেছে এই মুক্তা, তার জীবনেই নেমে এসেছে অনিবার্য দুর্ভাগ্য।মুক্তাটির পেছনে লুকিয়ে আছে শতাব্দী পেরোনো বিশ্বাসঘাতকতা, মৃত্যু ও প্রেমের গল্প।গল্পে টাইম ট্রাভেল ও ঐতিহাসিক ঘটনার ছোঁয়া যুক্ত হয়েছে নিখুঁতভাবে।রহস্য ও হৃদয়বিদারক আবেগের মিশেলে গল্পটি হয়ে উঠেছে দুর্দান্ত উপভোগ্য।
অন্বয়– অক্সালিস ট্রায়াঙ্গুলারিসের মতোই সম্পর্ক অবহেলায় মরে যায়, যত্নে ফ��রে আসে।বন্যা ও গল্পকথকের বন্ধুত্বও এমনই এক অবহেলায় ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়েছে।ভার্সিটি জীবনের সাধারণ গল্প মনে হলেও শেষে খুলে যায় আবেগের দরজা।ক্যাম্পাসজীবনের নিস্তরঙ্গ বন্ধুত্বের মাঝে গাঢ় ভালোবাসা হারিয়ে যায় নীরবে।বন্যার হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা ব্যথা ছিল অক্সালিস পাতার মতোই নরম, স্পর্শকাতর।শেষের পৃষ্ঠাগুলো পাঠককে এক অন্যরকম উপলব্ধির দিকে টেনে নিয়ে যায়।
নবমী– বিদ���শি চোর নাম ড্যান এক রাতে ঢুকে পড়ে এক অজানা বাসায়।দুটো ফুটো সেই জানালার মতো, যার একপাশে ছিল ড্যান, আর অন্যপাশে অজানা আতঙ্ক।ফুটো দিয়ে দেখা মুহূর্তেই বদলে দেয় সবকিছু, আর পালানোর পথও হয়ে যায় বন্ধ।ঘর, দরজা, আর সেই ফুটো এ যেন এক বিভীষিকার বন্দি কক্ষ।নবমীর রাত, যা শুরু হয়েছিল চুরির উদ্দেশ্যে, পরিণত হয় চিরন্তন শাস্তিতে।সহিংসতা, প্রাপ্তবয়স্ক আবহ আর মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে ভরা এক বিদেশি ঘরানার গা ছমছমে গল্প।
দাহ– ‘বাবা’ শব্দটা সাধারণত নিরাপত্তা, ভরসা, আর নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সবার জন্য তা নয়। “দাহ” গল্পে সেই অন্ধকার দিকটাই উঠে এসেছে যেখানে বাবার অস্তিত্ব মানেই নির্যাতন, যন্ত্রণা, আর নিঃসীম অসহায়ত্ব।বিন্দু নামের এক মেয়ের জন্ম থেকেই ছিল শারীরিক ত্রুটি, সে ব্যথা অনুভব করতে পারে না। এই ব্যতিক্রমই যেন হয়ে দাঁড়ায় তার পিতার জন্য আক্রোশের কারণ। ছোটবেলা থেকেই সে নির্যাতনের শিকার, আর এই নির্যাতন দিনদিন বেড়েই চলে। গল্পটি এখানেই থেমে থাকে না এক ছোট্ট বালকের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই সেই অমানবিকতা, জন্ম নিতে দেখি এক প্রশ্ন, এক বিচার, যেটা শেষ পর্যন্ত নির্যাতকের জীবনে এক শাস্তি হয়ে আসে।
জননী– ঘৃণা কখনো কারও মঙ্গল বয়ে আনে না। বরং তা সম্পর্কের মাঝে বিভেদ, ভুল বোঝাবুঝি আর অন্ধ প্রতিশোধের জন্ম দেয়। এই গল্পে ইভা তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের জায়গা নিতে আসা খালা শায়নাকে দেখে এক অদ্ভুত ঘৃণায় ভরে ওঠে। সেই ঘৃণার মাত্রা এতটাই তীব্র ছিলো যে শায়নার ভাগ্যে নেমে আসে অবহেলা, লাঞ্ছনা আর কষ্ট।কিন্তু ইভা জানতো না শায়নার অতীত। কীভাবে শায়না ও তার বাবা জড়িয়ে পড়েছিলো এক জটিল সম্পর্কের বাঁধনে! সবকিছু জেনেও শায়নার নীরব সহ্য, একরকম মায়ার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায় গল্পের শেষে।একজন মানুষকে না জেনে কেবল ঘৃণার বশে বিচার করলে কী ধরনের অনুশোচনার ভার বইতে হয় জীবনভর গল্পে তাই দেখানো হয়েছে । সম্পর্ক, অভিমান আর ক্ষমার দারুণ এক আখ্যান।
অর্বুদ– বাবা-মায়ের ঝগড়া, মান-অভিমান আর শেষমেশ বিচ্ছেদের বিষাক্ত ছায়া সবচেয়ে বেশি যাকে গ্রাস করে, সে হলো সন্তান। ‘অর্বুদ’ এমনই এক গল্প, যেখানে সেই আঘাতকে নিছক বর্ণনা নয়, বরং অনুভব করিয়ে দেন লেখক।গল্পের কাঠামো কিছুটা অদ্ভুত এবং বিমূর্ত, যা একদম ভিন্ন এক স্বাদ এনে দেয়। লেখকের ভাষা ও চিত্রকল্প বেশ শক্তিশালী। তবে কিছু দৃশ্যে ভায়োলেন্স রয়েছে, যা সংবেদনশীল পাঠকদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় শুধু সম্পর্ক ভাঙে না, ভেঙে যায় একজন শিশুর পুরো পৃথিবী। বাস্তবতা ও মানসিক জটিলতার এক সাহসী উপস্থাপনা।
সুবর্ণ রাধিকা– সনাতন ধর্মে যেমন কৃষ্ণ-রাধার প্রেম কোনো সাধারণ প্রেম নয়, তেমনি সুবর্ণ আর রাধিকার গল্পও প্রেমের এক অলৌকিক রূপ তুলে ধরে। প্রেমের যে রূপ মৃত্যুকেও অতিক্রম করে, সেটাই যেন এখানে প্রতিফলিত।তাদের প্রথম দেখা মর্গে, আবার দ্বিতীয় দেখাও মর্গে এই অদ্ভুত সেটআপ থেকেই গল্পটা একটা রহস্যময় মোড় নেয়। কিন্তু সেই রহস্যের গা ছমছমে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে আসে এক অবর্ণনীয় ভালোবাসার গল্প, যেখানে শেষটা হলেও শেষ নয় বরং পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া এক প্রগাঢ় অনুভব।
এক বসায় নয়, এক দিনে একটি গল্প।এই ছিল আমার পাঠের নিয়ম ,নিজের ভেতরে গল্পগুলোকে ধীরে ধীরে ধারণ করার চেষ্টা। প্রতিদিন একটা করে গল্প, যেন প্রতিদিন একটু করে ডুব দেওয়া হয় অনুভূতির সমুদ্রে। কখনও গা ছমছমে ভয়, কখনও বা নিঃশব্দে চোখ ভিজে যাওয়ার মতো বেদনা, আবার কখনও কিছু না বলা প্রেম এই সংকলনের প্রতিটি গল্প যেন নিজের মতো করে আমাকে ছুঁয়ে গেছে।এই বইটা ঠিক যেন একেকটি ছোট ছোট জানালার মতো প্রতিটা জানালা খুললেই একটা ভিন্ন জীবন, ভিন্ন বাস্তবতা, আর কিছুটা অনুভব এসে ধরা দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, যেন আমি এই গল্পগুলোর ভিতরে হাঁটছি, চরিত্রগুলোর পাশে বসে তাদের অনুভব করছি। সব গল্প একধরনের না হলেও, প্রতিটি গল্পের শেষে একটা ছাপ থেকে গেছে মনে কখনও ব্যথার, কখনও বিস্ময়ের, আবার কখনও দীর্ঘশ্বাসের। গল্পের রস এভাবেই একটু একটু করে প্রতিদিন আস্বাদন করেছি। হঠাৎ গিলে ফেলা নয়, ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে মনের ভেতরে রেখে দেওয়ার মতো এক পাঠ অভিজ্ঞতা ছিল এটি। সবশেষে, লেখক সাখাওয়াত হোসেন এর প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। তার কলমের জাদু আমাকে একাধিকবার থমকে দিয়েছে, ভাবতে বাধ্য করেছে, চোখে জল এনেছে। এমন সংবেদনশীল, গভীর ও ভিন্নধর্মী গল্প উপহার দেওয়ার জন্য তাকে অভিনন্দন। আশা করি, ভবিষ্যতেও তিনি আমাদের এমন অনেক গল্প উপহার দেবেন যেগুলো আমরা অনুভব করে পড়বো।
সাখাওয়াত হোসেনের গল্প পড়া হয় ফেসবুকে অনেকদিন থেকেই। এই ছেলেটা দুর্দান্ত ছোটগল্প লেখে। ইউনিক প্লট, সুন্দর প্রেজেন্টশন,মাস্টারক্লাস শব্দপ্রয়োগ। ফেসবুকে এসব পড়ে তৃপ্তি হয় না। মনে হয় এইসব গল্পের ফেসবুকে থাকার কথা না। এগুলা থাকবে বইয়ে। আমি তাই অনেকদিন ধরেই ওনার একটা ছোটগল্প সংকলনের অপেক্ষা করছিলাম। যেটা অবশেষে এলো।
এটা ওনার প্রথম গল্পগ্রন্থ হলেও এর আগেও ওনার একটা বই বের হয়েছে যেটা উপন্যাস। সেটা দাম ও জনরার জন্য নিইনি। ফ্যান্টাসি জনরা খুব একটা আমাকে টানে না বই হিসেবে। আর একটা নতুন লেখকের বই এই উইয়ার্ড জনরায় পাঁচশ টাকা দিয়ে কিনতেও কেমন খচখচ করে ভেতরটা। যদিও ওনার ওই বইটা খুবই পজেটিভ রেসপন্স পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে।
কিন্তু ওনার ছোটগল্প আমার পড়া। ছোটগল্পে ওনার হাত আমার জানা। আর ভালো ছোটগল্প আমি পড়তে পছন্দও করি। তাই এই বইটা কিনতে ভয় বা খচখচানি কিছুই কাজ করে নি। বরং শেষ করার পর মনে হচ্ছে বইটা আরেকটু বড় হলে ভালো হতো। আর কিছু গল্প থাকলে ভালো হতো। ফেসবুকে ওনার কিছু কিছু লেখা পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম।যেমন অপত্য,কুমুদ এগুলো আমার খুব পছন্দের দুইটা ছোটগল্প।তার সবগুলোও এই বইয়ে তিনি দেন নি। বাছাইটা করেছেন নিজের পছন্দে। এটাও আমার একটা আফসোস।
এই বইটির গল্প কোনো নির্দিষ্ট জনরার নয়। লেখকের ভাষায় বইটি হচ্ছে হিজিবিজি জনরার একটি সংকলন।
সংক্ষেপে সুবর্ণ রাধিকা গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো নিয়ে ছোট্ট করে রিভিউ:
✍️১.আদিম- গল্পকথক রাফায়াত সাহেব। একরাতে যার মা তাকে বাথরুমে আটকে দরজা বন্ধ করে দুষ্টুমির শাস্তি দিয়েছিলেন। সেই বাথরুমে বদ্ধ অবস্থায় তিনি দেখেছিলেন শূন্য। আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে,শূন্য আবার কিভাবে দেখে? রাফায়াত সাহেব সেটা খুব সুন্দরভাবেই বুঝিয়ে দিবেন আপনাকে। গল্পের মাঝামাঝিতে একটা বড় টুইস্ট আছে। আমার পরামর্শ,ঐ টুইস্টে একটু থামবেন। একটু জিরোতে দেবেন মাথাটাকে। একটু ঠান্ডা হয়ে আবার তার পর থেকে পড়া শুরু করবেন। (এই গল্পটা দুর্দান্ত লেগেছে। গল্পের পরতে পরতে কেমন একটা গা ছমছমে,না বুঝতে পারা,না বোঝাতে পারা ভয় লেখক তুলে এনেছেন। আদিম অপার্থিব সেই ভয়টার কারণেই গ��্পটা দারুন হয়েছে)
✍️২.প্রসূন- একটা ফুল। তার গন্ধ রসুনের গন্ধের মতো। ফুলগুলো রোজ কোথা থেকে জানি আসে,ছোট বাচ্চার মাথার কাছে পড়ে থাকে।মা বাবা ঘুমের মধ্যে যখন থাকেন তখন। (চমৎকার একটা আবহ লেখক তৈরি করেছেন। কেন জানি মনে হয়েছে এই গল্পের আবহ,লেখনীতে হুমায়ূন আহমেদের দেবী বেশ প্রভাব ফেলেছে। তবে লেখকের মুন্সীয়ানা হচ্ছে শেষের দিকে তিনি এমন একটা অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা ধরেছেন যেদিকে কখনো হুমায়ূন ধরতেন না। এইখানটাতে এসে তিনি স্বকীয়তা দেখিয়ে দিয়েছেন।)
✍️৩.গ্রন্থন- কেমন লাগবে যদি সারাটা দিন একটা মানুষ আপনার আশেপাশে সেঁটে থাকে? কথা বলে না,শুধু কথা শোনে? আপনি পড়ছেন,খাচ্ছেন,স্নান করছেন সে আপনার ঘরের চেয়ারে অথবা বিছানায় দন্ডায়মান মূর্তির মতো বসে। শুধু বসেই। আপনি একটা ছেলে সে একটা মেয়ে। মেয়েটার নাম দিয়া। শতাব্দীর অদ্ভুততম মেয়ে সে। একটা গাছ, একটা পাথর বা বলা যায় একটা পরিপূর্ণ মানুষও না সে। শুধুমাত্র চোখের ভাষা দিয়ে, শুধুমাত্র একটা মানুষকে এমন মূর্তির মতো বসিয়ে রেখে আস্ত একটা গল্প বলে ফেলতে পারবেন তার? যার এমনকি সেই চোখের ভাষা দেখেও জানা যায় না মনের কথা। (সুন্দর গল্প।সরলভাবে সুন্দর,জটিলভাবে না। সাধারণ। মন খারাপ করা।)
✍️৪.বৃশ্চিক-ছোট্ট একটা মজা,পরিবারের সামান্য সামান্য কিছু সূক্ষ্ম বিষয় যে একটা বাচ্চার মনে কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে! একেকজনের ওপর প্রভাবটা একেক রকম।পুষ্পের ওপর প্রভাব পড়ে স্বপ্নে। সে স্বপ্ন থেকে জাগে না। এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নে যায়,যখন জাগে তখনও বুঝতে পারে না। এদিকে তার মা রোকসানা,যিনি বুঝতে পারছেন তার মেয়ের কিছু একটা হয়েছে,বাবা তাও বুঝতে রাজি না। (এই পুরো গল্পসংকলনে এই গল্পটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। অসম্ভব ভালো। পারিবারিক এই বিষয়গুলো ফেস করেছি সেই কারণেই হয়তো। একটা দীর্ঘ সময় এই গল্পের কথা আমি ঘোরের মতো ভেবেই গিয়েছি,ভেবেই গিয়েছি।)
✍️৫.অপার্থিব -কথকের স্ত্রী লিলি। মানুষ বড় নাম আদর করে ছোট করে,কথক করেছেন বড়। নাম দিয়েছেন লিলিয়ান। তার ধারনা লিলিয়ান তাকে খু'ন করবে। কিভাবে করবে তাও তার জানা। লিলিয়ান একজন নয়। কথকের মতে,তিনি লিলিয়ান দেখেছেন অন্তত ছয়জনকে। (সুন্দর,নামের মতো অপার্থিব সুন্দর নয়। পার্থিব সৌন্দর্যে সুন্দর।)
✍️৬.অন্তরকলন- শরীফুল একজন যুবতীকে অপহরণ করেছে। কি জন্য করেছে কে জানে! কিন্তু করেছে। অপরদিকে জোনায়েদ হাতে একটা ছবি আর কাঁধে স্কুলব্যাগ নিয়ে শহরের ইঞ্চি ইঞ্চি খুঁজে বেড়াচ্ছে একটি তরুনীকে। (সাধারণ গল্পই মনে হয়েছে কিন্তু অসাধারণত্বের মোড়কে।)
✍️৭.বিভাস- গীর্জায় প্রার্থনারত এক যুবতীকে দেখে প্রেমে পড়ে গেলেন কথক। যার সেই প্রেম টিকেছিলো এগারো মাস। যুবতীর মধ্যে ছিলো কিছু রহস্য,একটা অতীত,হাতে পায়ে কালচে দাগ। আর ট্রেনপ্রীতি। ট্রেনে চড়তে অসম্ভব ভালোবাসতো সে। তারপর একসময় সে কোথাও একটা চলে গেলো,কোথায় কথক জানেন। কিন্তু সেখানে তিনি যেতে পারেন না। সেই গল্পই শোনাবেন। (প্রেমের গল্প,তবে তারসাথে আরো কিছু। বেশ সুন্দর।)
✍️৮.শালুক-সহজ সাধাসিধা এক ভদ্রলোক। যার কোনো দোষ নাই,যিনি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না। পুকুরের পানির মতো শান্ত একটা মানুষ হঠাৎই একদিন পড়ে রইলেন ম'রে। মরবার আগেরদিন সে একটাই কথা বলেছিলো স্ত্রীকে,"সুতপা ফিরে এসেছে!" স্ত্রী কবরস্থানে দাঁড়িয়ে,এক তরুণী এনেছে একটা চিঠি। এই চিঠি উত্তর দেবে সুতপা কে,কিভাবেই আর কেনই বা সে ফিরে এলো। (দুর্দান্ত একটা গল্প,এই গল্প থেকে একটা ওয়েব সিরিজ হলে দারুন হবে। অসাধারণ লেগেছে জাস্ট। বৃশ্চিকের পরে এইটা আমার কাছে সেকেন্ড বেস্ট।)
✍️৯.পারাবার- ঠিক যেভাবে গাছের চারা রোপন করা হয় ওভাবেই রোপন করা হয়েছে একটা আস্ত মানুষকে। তার নাম তওকির। তার দুই বন্ধু। একজন প্রীতি,যে তার মৃত্যুর খবরে অসম্ভব ভেঙে পড়েছে। আরেকজন কথক ইভু। যে একেবারেই ভেঙে পড়েনি। খবরটা শোনার পরেও চা খেয়েছে পাঁচ চুমুক। প্রীতি রাগ করেছে,প্রীতি ঘৃণা করেছে তাকে। মানুষ দুই প্রকার। একধরনের মানুষ প্রথম প্রথম কষ্ট পায় অসম্ভব রকম। ধীরে ধীরে সয়ে আসে। আরেক রকম মানুষ প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে কষ্ট পেতে শুরু করে। (আদতে ক্রাইম গল্প মনেও হলেও তা না। এটা বন্ধুত্বের গল্প,এটা মোটামুটি লেগেছে এই বইয়ের অন্য গল্পের তুলনায়।)
✍️১০.অংশন- গীর্জার কনফেশন রুমে একজন যুবক এসেছে কনফেশন করতে। অন্যদের সাথে তার কনফেশনের ভিন্নতা আছে। সে এখনো পর্যন্ত কোনো পাপ করে নি। কিন্তু করবে। সে শোনাতে এসেছে আরেকজনের পাপের গল্প। গল্পের দুই পাতা পড়েই মনে হলো টুইস্ট ধরে ফেলেছি। কিছুদূর এগিয়ে সেই টুইস্টের দেখা পেলামও। কিন্তু সেখানেই শেষ হলো না। সেই টুইস্টকে সাথে নিয়ে গল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তায় মোড় ঘুরলো। (ফ্যান্টাস্টিক। এই গল্পটা থেকে অজানা একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও জানলাম। থার্ড বেস্ট। দারুন লেগেছে।)
✍️১১.মোচক-এক দুপুরবেলা খোরশেদ আলমের মনে হলো তিনি কুকুর হয়ে যাচ্ছেন। ওরকম না। আক্ষরিক অর্থেই। তার লেজ গজাচ্ছে,তার ঘাম হচ্ছে না, জিহ্বা বের করে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে। স্ত্রী এতে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু আট বছরের কন্যা মজা পাচ্ছে। (মোটামুটি লেগেছে এটাও। মন্দ না। একবার পড়বার মতো। অন্যগুলোর মতো বারবার পড়ার ইচ্ছা হবে না এটা।)
✍️১২.মন্দির-ভগ্ন একটা মন্দির। তার পাশে একটা পুকুর। পুকুরে অনেক টাকা খরচ করে ছাড়া হয়েছে মাছের পোনা। কিন্তু মাছ হচ্ছে না। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় কর্তা ঠিক করলেন মন্দিরে একটা বলি দিবেন। মধ্যরাতে চুরি করলেন একটা ছাগল। একবারে সেটার মাথা শরীর থেকে আলাদা করা গেলো না। ঘাড়ে ছুরি গাঁথা অবস্থায় দৌড়ালো সেটি। (মধ্যরাতে এটা পড়তে গিয়ে অদ্ভুত গা ছমছমে একধরনের অনুভূতি হয়েছে। অনেকটা তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প পড়ে যেমন অনুভূতি হতো এমন। এই জাতীয় হরর আসলে আমাকে খুব টানে।)
✍️১৩.ঘুম-মিমি। ছোট্ট একটা বাচ্চা। যে জন্মাবার পর এক আকাশ সমান ভালোবাসা নেমে এসেছিলো তার ভাইয়ের জীবনে। স্বর্গের এই পরীর ছটফটে সৌন্দর্যে মুগ্ধ ভাই এক সেকেন্ড তাকে কাছছাড়া করে থাকতে পারতো না,না পারতো মিমিও। (খুব হৃদয়স্পর্শী একটা গল্প। মিমির জন্ম থেকে শুরু করে এত সুন্দর করে তার প্রতি ভালোবাসা জন্মাবার প্রতিটা মুহুর্ত খুব সুন্দরভাবে এঁকেছেন লেখক। এই একটা গল্প সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে আমাকে এই সংকলনে।)
✍️১৪.হাওয়া-রবিউলের একরাতে হাওয়া লাগলো। খারাপ বাতাস যাকে বলে। হাওয়ার নাম শেহজাদী। আরেকটা নাম আছে তার। সাইকি। সাইকে রবিউলকে ভালোবাসে। কথককে সে এটা জানায় যে সাইকি কখনোই তাকে ছেড়ে যাবে না। একটা রহস্য সমাধান করতে কথক সময় নেন একুশ বছর যে এই গল্পটা সত্যি নাকি মিথ্যা। (অনেকটা মিসির আলীর আনসলভড মিস্ট্রি টাইপের মনে হয়েছে। হালকা ভয়মিশ্রিত একটা অনুভূতি ছিলো।)
✍️১৫.লা পেরেগ্রিনা-নেক্সাসের এক জঙ্গলে নিজের কবর খুঁড়ছে এক যুবক। হাতে একটা ম্যাপল পাতা। রং কালো। তার গল্প পাঁচশ বছরের পুরোনো। লা প্রেরেগিনা নামক এক মুক্তা পেয়ে গেছিলো সে ঝিনুকের বুক চিরে। সাধারণ মুক্তার চেয়ে যা অনেকগুণ দামী। এত দামী যে তার ভার যেই গ্রহন করে,বহন করতে পারে না। তিনি শোনাবেন সেই লা প্রেরেগিনার গল্প। (হিস্টোরিক্যাল ফ্যান্টাসি জনরা খুব একটা পছন্দের না আমার। কিন্তু কাহিনীতে ঢোকার পর গল্পের বাদবাকিটা মুগ্ধ হয়েই পড়েছি।)
✍️১৬.অন্বয়-অক্সালিস ট্রায়াঙ্গুলারিস হলো পাতাবাহার জাতীয় একধরণের উদ্ভিদ। এর পাতাগুলি সুন্দর,হার্ট শে���প। এক ডাঁটে তিনটা করে পাতা থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় তিনটা প্রজাপতি। এই গাছ অল্প অবহেলায়ও সইতে পারে না। মরে যায়। আবার যত্ন নিলে জিইয়ে ওঠে। অনেকটা সম্পর্কের মতোই। বন্যার ভেতরটা এভাবেই একদিন মরে গিয়েছিলো ভালোবাসার অবহেলায়। (ভার্সিটি লাইফ,ক্যাম্পাসের বন্ধু এসব গল্প আমাকে টানে না আসলে। তাই শুরুটা পড়ে গল্পটা ভীষণ এভারেজ লাগছিলো। কিন্তু শেষের দিকটাতে এসে চোখ ফেরাতে পারিনি। ভীষণ ভালো লেগেছে। এমন বন্ধু মানুষের থাকে?)
✍️১৭.নবমী-ড্যান। নামটা বিদেশী হলেও আসলে প্রফেশনে তিনি একজন চোর। চুরি করতে ঢুকেছেন এক বাসায়। বেডরুমের দরজায় দুইটা ফুটো। ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ভয় পেয়ে উল্টো পালানোর চেষ্টা করলেন যেখান দিয়ে এসেছেন সেখানে। পালাতে পারলেন না। আটকা পড়ে গেলেন। আটকা পড়ে গেলো ফুটোর ওপাশের ব্যক্তিও। এক নবমীর রাতে চিরদিনের তরে। (ভায়োলেন্সে,এডাল্টে ভরপুর,ভয়ংকর এক গল্প। বিদেশী গল্পের বা সিনেমার মতোই। বেশ অন্যরকম লেগেছে।)
✍️১৮.দাহ- বিন্দু ব্যাথা পায় না। বাবা সময় পেলেই মারেন তাকে ইচ্ছামতো। ছোটখাটো কিছুতেও রেগে যান তার ওপর। অথবা সে ব্যাথা পায় না এতে আরো রেগে যান তিনি। দাগের পর দাগ কাটেন শরীরে তার। ছোট্ট একটা বালক দিনের পর দিন দেখছে সেই দৃশ্য। আর জানছে বিন্দুর প্রেমিক জিতু। একদিন আসবে এই বালক বাবাকে ফেলবে একটা প্রশ্নের মুখে,যার উত্তর না দেয়া পর্যন্ত বাবার মৃত্যু নেই। (হৃদয়স্পর্শী,ভীষণ সুন্দর একটা গল্প। চোখে জল আনার মতো। ভীষণ ভালো লেগেছে।)
✍️১৯.জননী- শায়নার একটা গোপন অসুখ আছে। ক্লস্টোফোবিয়া। সে বদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে না। তার দম আটকে আসে। শায়না ইভার সৎ মা। ইভা তাকে ঘৃনা করে। একদিন ইভা ঘৃনার চুড়ান্তে পর্যায়ে পৌঁছে তাকে আটকে ফেলে ছোট্ট একটা লিফটে। জানায় তার ঘৃনা। (কেন জানি না এটা টুইস্টটা প্রেডিক্ট করতে পেরেছি। তারপরও ভালো লেগেছে। মায়া মাখানো গল্প।)
✍️২০.অর্বুদ- জেনিফারের বয়স দশ বছর তখন তার বাবা মা ঠিক করলেন আলাদা হবেন। কিন্তু জেনিফার কার সাথে থাকবে? দুজনকেই সে সমান ভালোবাসে। বাবা মায়ের অবস্থাও তাই। সুতরাং তারা ঠিক করলেন, সন্তানকে করাত দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলে একভাগ বাবা একভাগ মায়ের কাছে থাকবে। বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া,তাদের আলাদা হওয়া এ সমস্ত কিছু সন্তানের ওপর কিভাবে প্রভাব পড়ে সেটা নিয়ে রুপকাকারে লেখা এই গল্পটা। (চমৎকার,জাস্ট অসাধারণ অল্প কথায় দুর্দান্ত একটা ইমাজিনেশন তৈরি করেছেন লেখক। মেসেজটা ধরতেও খুব বেশী মাথা খাটানো লাগবে না। প্রতিটা বাবা মায়ের পড়া উচিত এটা।)
✍️২১.সুবর্ণ রাধিকা- সনাতন ধর্মে বলা হয় কস্তুরি থেকে যেমন গন্ধ আলাদা করা যায় না,অগ্নি থেকে যেমন উত্তাপ আলাদা করা যায় না ঠিক তেমনই কৃষ্ণ থেকে রাধাকে আলাদা করা যায় না। ঠিক তেমনই সুবর্ণ আর রাধিকাকে আলাদা করা যায় না। সুবর্ণ আর রাধিকা একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাদের প্রথম দেখা হয় মর্গে। দ্বিতীয় দেখাও হয় মর্গে। (ভীষণ সুন্দর গল্প,চমৎকার সুন্দর। লাস্টে খুব দারুন একটা ইস্যু তুলে আনা হয়েছে। যদি প্রেডিক্ট করতেও পারেন তারপরও ভালো লাগবে।)
আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ছাড়াছাড়া ভাবে বই পড়ছিলাম। কয়েক পাতা পড়ি,নামিয়ে রেখে সিনেমা দেখি,ঘুমাই। অনেক অনেক দিন পর দীর্ঘ একটা সময় এই বই হাতে কাটিয়ে দিয়েছি মুগ্ধ পাঠকের মতো। সব গল্প যে সমান সুন্দর সেরকম না কিন্তু এককথায় বলতে গেলে আবহ,লেখনী সবমিলিয়ে বলতেই হবে এটা অসম্ভব শক্তিশালী একটা ছোটগল্প সংকলন। সবচেয়ে বড় কথা নেহায়েৎই কোনো ছোটগল্প না,প্রতিটা গল্পই কোনো না কোনো অর্থ বহন করছে,কোনো না কোনো সোশ্যাল,মেন্টাল ইস্যু তুলে আনছে।
বিন্দুমাত্র বানান ভুল নেই,বাক্যগঠন চমৎকার এমন লেখা একটানা পড়ে একটা আরাম আছে। সেই আরাম পেয়েছি প্রচুর। লেখকের বলার ঢং,বাক্যগঠন অনেক আলাদা। কিছু কিছু বাদে। কিছু কিছুতে প্রভাব আছে বিভিন্ন লেখকের। কিন্তু ইনি নিজের স্বকীয় জায়গাটা থেকেও ভীষণ সুন্দর এবং প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ঐসব প্রভাব কাটানোর। এই লেখক খামখেয়ালিপনা ছেড়ে মন দিয়ে লেগে থাকলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস টিকে যাবেন বাংলা সাহিত্যে। লেখার হাত এতটাই স্ট্রং তার। লেখকের প্রতি আমার শুভকামনা। এবং অনুরোধ এইসব চমৎকার গল্প ফেসবুকে দিয়েন না। বই আকারেই এমন গল্পগুলো সুন্দর।
সুবর্ণ-রাধিকা তরুণ লেখক সাখাওয়াত হোসেনের একটা গল্প সংকলন। ২১ টা গল্প জায়গা পেয়েছে এই বইতে। গল্প গুলোকে আসলে নির্দিষ্ট কোনো জনরাতে ফেলা যাবে না। অমীমাংসিত রহস্য, ভয়, অতিপ্রাকৃত, সাইকোলজিক্যাল আর আবেগ - অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । এক কথায় বলতে গেলে একটা হ য ব র ল জগৎ তৈরি হয়েছে এই বইতে।
⚠️ পাঠ - প্রতিক্রিয়া : ছোটবেলায় ওয়াশরুম ভয় পায়নি এমন মানুষ কমই আছে। এই ওয়াশরুম ভীতিকে আশ্রয় করে একটা ভৌতিক রহস্য গল্পে রূপ দিয়েছেন লেখক আদিম গল্পটাকে। সাধারণের মাঝেও যেন বিশেষ কিছু। সেই বিশেষ কিছুটা শৈশবের ট্রমা। এই ট্রমা খুঁজে পাওয়া যায় তার আরো গল্পে - বৃশ্চিক, দাহ, জননী আর অপার্থিব। খুব সাধারণ কিছু বিষয় , যে বিষয় গুলোকে আমরা তেমন পাত্তা দিই না কিন্তু অনেক সময় সেগুলো যে আমাদের মস্তিষ্কে গেড়ে বসে মানসিক একটা বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে তার উদাহরণ এই গল্প গুলো। লা পেরেগ্রিনা, বিভাস আর অংশন। এই গল্প তিনটায় লেখকের কল্পনাশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাস, অমীমাংসিত রহস্য আর মিথ কে বর্তমানের সাথে এমন চমৎকার ভাবে ব্লেন্ড করেছেন ! মোচক গল্পটা অদ্ভুত। হঠাৎ করে একজন ভদ্রলোকের কুকুর হয়ে যাওয়ার গল্প। গল্পের অন্তর্নিহিত বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে। আমার সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে অর্বুদ। সম্ভবত বইয়ের একমাত্র এই গল্পটাই মনে গেঁথে থাকবে দীর্ঘসময়। ছোট্ট জেনিফারের গল্প। বাবা - মার বিচ্ছেদ শিশুমনে যে চাপ সৃষ্টি করে সেই গল্প। অদ্ভুত সুন্দর আর দারুন উপস্থাপনা। অন্যান্য গল্পগুলো উপভোগ্য ছিলো কিন্তু মনে দাগ কেটে যাওয়ার মত লাগে নি। প্রতিটা গল্পই এমন ভাবে লেখা যে আমার মধ্যে একটা আগ্রহ কাজ করছিলো গল্পটা শেষ করার। কোন গল্পই পড়তে তেমন বিরক্ত লাগেনি। লেখার মধ্যে পাঠককে ধরে রাখার একটা অদৃশ্য টান ছিলো। এই সংকলনে সাইকোলজিক্যাল বিষয় গুলো বেশি প্রাধান্য পেয়েছে । এই সম্পর্কিত গল্প কমিয়ে আরো ভিন্ন কিছু গল্প যুক্ত করলে সংকলনটা আরো উপভোগ্য হতো আমার কাছে।
শেষ করে ফেললাম সুবর্ণ-রাধিকা। সাখাওয়াত হোসেনের প্রথম গল্পগ্রন্থ এটা। লভক্রাফটিয়ান হরর,অতিপ্রাকৃত,সাইকোলজিক্যাল,থ্রিলার আর জীবনধর্মী জনরার একুশটা গল্প নিয়ে এই বই।
বইটা আমার পারসোনালি অনেক ভালো লেগেছে। বিশেষ করে লেখকের লিখনশৈলীর প্রশংসা না করে পারা যায় না। খুবই সুন্দর তার লেখার ধাঁচ। বেশ সাবলীল লেগেছে আমার কাছে।
গল্পগুলা নিয়ে বলতে গেলে বলবো, প্রত্যেকটা গল্পই উদ্ভট তবে বেশ জীবন্ত। একুশটা গল্পের মধ্যে কিছু গল্প এভারেজ লেগেছে আবার কিছু গল্প খুবই ভালো লেগেছে আমার।
সবশেষে বলবো, ভিন্নধর্মী কিছু গা হিম করা গল্প নিয়ে সাজানো সুবর্ণ-রাধিকা পড়ুন। লেখক আমাকে নিরাশ করেননি। আশা করি আপনিও নিরাশ হবেন না।
পড়ে শেষ করলাম লেখক সাখাওয়াত হোসেনের বই সুবর্ণ-রাধিকা। বইটিতে ২১ টি ছোট গল্প রয়েছে বিভিন্ন জনরার। নিম্নে সবগুলো গল্পের ছোট করে বর্ণনা করা হলো:
আদিম: আদিমকাল থেকেই মানুষ "নাথিং" শব্দটিকে আদর্শ পরিমাপ হিসেবে ব্যবহার করেছে "শূন্যকে" নয়। এর বর্ণ্না লেখক খুব সুন্দর করে দিয়েছেন এই গল্পে। "আদিম" গল্পটি আসলে ফোবিয়া থেকে সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভোগা একজন মানুষের কথা বলা হয়েছে। কিভাবে সে ছোটবেলার ট্রমা থেকে "শূন্য" দেখেছিল কিন্তু কাউকে সেটা বোঝাতে পারে নি। যখনই বুঝানোর চেষ্টা করেছে তখনই কেউ আর তার প্রশ্নের উত্তর দেয় নি। গল্পটি বেশ মজার ছিল। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
প্রসুন: একজন সাধাসিধে অমিশুক পুরুষ হাসান এবং অপরদিকে ধৈর্যশীল ও ভিতু স্বভাবের তার স্ত্রী লিলি ও তার ছোট দুধের শিশুকে তাদের ছোট পরিবার। হঠাৎ এক রাতে লিলির ঘুম ভেঙে যায় রসুনের গন্ধে। গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার বাচ্চার মাথার উপর ছয়টি নাম না জানা সাদা রঙের ফুল। প্রথম দিন বিষয়টি অগ্রাহ্য করলেও ধারাবাহিকভাবে এই ঘটনা ঘটে গেলে হাসান-লিলি দম্পতি উৎকন্ঠায় তাদের বাসা পরিবর্তন করে। কিন্তু তার পরও তাদের সমস্যা সমাধান হয় না। পরিশেষে তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। দুই মাসের পরিশ্রমের পর খোঁজ মিলে সেই অদ্ভুত গন্ধযুক্ত সাদা ফুলের, যার সঙ্গে মিশে আছে এক হৃদয়বিদারক গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
গ্রন্থন: কানন বিলাসে এড়ে উঠা দুজন বিপরীতধর্মী মানুষ হলো গল্পকথক আর দিয়া। গল্পকথকের স্বভাব হলো সে সারাদিন বই পড়ে কিন্তু দিয়া বই পড়তে জানে না, সে শুধু মুগ্ধতার সাথে বই পড়া শুনে যায় গল্পকথকের। কখনইও রাত কেটে যায় শুনতে শুনতে। এমনই একজন মানুষ দিয়া। সে কখনো কানন বিলাস ছেড়ে বাহিরের জগতে যেতে চায়নি। অন্যদিকে গল্পকথক চষে বেড়িয়েছে সর্বত্র। দিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে যায় এক বড় প্রকাশনী কর্ণধারের সাথে। কিন্তু তার সর্বদা ইচ্ছা ছিল সে কানন বিলাস ছেড়ে যাবে না। কারণটা খুবই স্পষ্ট ছিলো। তবে মানুষের সহজাত ধর্মই হচ্ছে সামনে সুখ রেখে সর্বদা দূরে খোঁজ করা। তেমনই গল্পকথকও নিজের কানন বিলাসে সুখ না খুঁজে, খুঁজেছে বাহিরে। তাই দিয়া অভিমান করে তার দিনলিপিতে লিখে গিয়েছিল, “পরের জন্মে আমি একটা বই হব”। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.০/৫।
বৃশ্চিক: বাবা-মা সব সন্তানকে সমান ভালোবাসেন কথাটা আসলে বেশ কন্ট্রাডিক্টরি। এই গল্পের মূল বিষয় এটি। পুষ্প বাবা-মায়ের মেঝো সন্তান। ছোটবেলায় তার বড় ভাই কৌশিক দুষ্টুমির ছলে তাকে বলেছিল তাকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে যেটা সচরাচর আমরা সবাই ছোট ভাইবোনের সাথে করে থাকি। এই বিষয়টি পুষ্পের মাথায় ঝেঁকে বসে। তার ছোট বোন পূর্ণার জন্মের পর যখন সে আদরের কেন্দ্রবিন্দু হয়, তখন পুষ্পের আরো অভিমান জমতে থাকে। যা একসময় বিশাল রূপ নেয়। পুষ্প সর্বদা হ্যালুসিনেশনে ভুগতে শুরু করে। সে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে। কখনো তার মা, কখনো তার ছোট বোনকে স্বপ্নে মেরে ফেলে। সে একসময় স্বপ্ন আর বাস্তবকে পৃথক করতে পারে না। সেই ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে। আসলে ছোট বিষয়গুলো যখন বড় আকারে রূপ নেয় তখন সেগুলোর প্রতিকার বেশ জটিল হয়ে যায়। পুষ্পের ক্ষেত্রেও একই পরিণাম হয়েছে। ব্যক্তিগত রেটিং ৪/৫।
অপার্থিব: মানুষ একটি চিন্তাশীল জীব। প্রতিনিয়ত সে কিছু না কিছু বিষয় নিয়ে তার মস্তিষ্কে চিন্তা চলমান রাখে। কিন্তু সবসময় সে চিন্তাগুলো মানুষের জীবনে সুফল বয়ে আনে না। তেমনি এই গল্পে গল্পকথক সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন। গল্পকথক ও তার স্ত্রী লিলিয়ানকে নিয়ে তাদের ছোট সংসার। তাদের বিয়ের সপ্তাহ খানেক পর থেকে গল্পকথক তার স্ত্রীকে বারবার নতুন করে আবিষ্কার করতে থাকে। লিলিয়ান তার প্রেমিককে নিয়ে অত্যধিক চিন্তার কারণে নিজেকে তচ্ছ মনে করতে থাকে। যা একসময় শেষ পরণতির সম্মুখীন হয়। অত্যধিক ভাবনা মানুষের জীবনে সুফল বয়ে আনে না কখনোই। তারই বহিঃপ্রকাশ এই গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
অন্তরকলন: গল্পের মূল প্রেক্ষাপট সাইকোপ্যাথ কিলিং। মিনি নামের এক যুবতীকের শফিকুল নামক সাইকোপ্যাথ কিভাবে হত্যা করে তার রগরগে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আর এদিকে মিনি হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ায় তার বন্ধু জোনায়েদ তাকে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে পাঁচ বছর অতিক্রম হয়ে যায় কিন্তু কোনো সুরাহা মিলে না। গল্পে বেশ ভালোভাবে টর্চারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যারা এসব বর্ণনা নিতে পারেন না তারা গল্পটি পরিহার করতে পারেন। ব্যক্তিগত রেটিং ৩/৫।
বিভাস: গল্পের শুরু মারিয়া নামে এক খ্রীষ্টাণ নারীর প্রতি গল্পকথকের প্রেমে পড়া নিয়ে। কিভাবে গল্পকথক মারিয়া প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যায়, কিভাবে তার জন্যে গীর্জায় অপেক্ষা করে, একসময় কিভাবে মারিয়া গল্পকথকের প্রেমে পড়ে যায় এই নিয়ে গল্পের মূল থিম। যদিও ধীরে ধীরে গল্পকথক আবিষ্কার করে মারিয়ার জীবনের দুঃখ ও অতীত নিয়ে। তবে একদিন মারিয়া যেভাবে গল্পকথকের জীবনে এসেছিল, সেভাবেই হারিয়ে যায়। কিভাবে হারিয়ে যায় সেই গল্পটি বেশ অদ্ভূত। গল্পে বেশ ভালো কিছু টুইস্ট আছে। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
শালুক: গল্পের প্রধান চরিত্র সুতপা। সুতপা গ্রামের সহজ-সরল এক যুবতী, যে প্রেমে পড়েছিল অজানা এক পুরুষের। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে যায় শহরের এক ব্যক্তির সাথে। সুতপা সন্তানসম্ভবা হয়। এরই মাঝে সে জানতে পারে তার আগত সন্তানটি তার স্বামীর নয়, বরং সে প্রেমিকের। তার কোলজুড়ে এক কন্যা সন্তান আসার দেড় বছরের মাথায় সে ইহত্যাগ করে। তারপর অনেক বছর কেটে যায়। সুতপার সে কন্যা বড় হতে থাকে। এরই মাঝে কিছু হত্যাকান্ড ঘটে যায়, যার সাথে সুতপার মৃত্যু ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। গল্পটির সাথে মিশে আছে ভালোবাসা, দুঃখ, প্রতারণা, ধোঁকা। ব্যক্তিগত রেটিং ৪.৫/৫।
পারাবার: প্রীতি, তওকীর ও গল্পকথক ছোটবেলার বন্ধু এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। হঠাৎ একদিন ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে তওকীরের লাশ পাওয়া যায় উল্টো করে মাটিতে পুঁতে রাখা। এতে প্রীতি খুব দুঃখ পেলেও অনুভূতিহীন গল্পকথক তেমন কোনো দুঃখের বহিঃপ্রকাশ করে না। এতে তাদের বন্ধুত্বের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। ঠিক আট বছর পর প্রীতি ও গল্পকথকের সাথে দেখা হয় এবং তারা হারিয়ে যায় পুরানো দিনের স্মৃতিতে। ব্যক্তিগত রেটিং ২/৫।
অংশন: গীর্জায় কনফেস করতে আসা একুশ বছরের এক কাহিনী নিয়ে এই গল্প। গল্পের শুরুতে প্যান্ডোরা ও প্যান্ডোরার বাক্স নিয়ে বেশ সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। কিভাবে প্যান্ডোরার বাক্স সেই যুবকের জীবনের সাথে জড়িত সেটাই গল্পের মূল উপজীব্য। কাইমেরা সম্পর্কেও বেশ সুন্দর বর্ণনা রয়েছে এতে। গল্পের শেষের দিকে এসে কেমন যেন একটি খাপছাড়া অনুভূতি তৈরি হয়েছিল আমার। তাই শেষের দিকে খুব ভালো উপভোগ করি নি। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
মোচকঃ গল্পটা বেশ অদ্ভুত। এক সকালে খোরশেদুল আলম বুঝতে পারেন সে ধীরে ধীরে কুকুরে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। তার স্ত্রীকে বিষয়টি জানালে সে বিষয়টি হাসির ছলে নিয়ে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার আচরণ পরিবর্তন হতে শুরু করে। সে কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে বসে থাকা, হামাগুড়ি দিয়ে চলা, ঘেউ ঘেউ করার মতো কাজগুলো করতে থাকে। কিন্তু এই হঠাৎ কুকুরে পরিণত হয়ে যাওয়ার পিছনে ছিল এক অস্ফুট সত্য ও প্রতারণার গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
মন্দির: গল্পের মূল প্রেক্ষাপট বলিপ্রথা। গল্পের শুরুতে মহাচৈতন্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বেশ ভিন্ন ধর্মের একদটি গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ৪/৫। ঘুম: গল্পটা মূলত দুই ভাই-বোনের খুনসুটি, ভালোবাসা নিয়ে। হাসিবের জীবনের তার মিমি আসার পর থেকে কিভাবে বদলে যায় জীবনের সবকিছু মূলত এ নিয়েই সুন্দর বর্ণনা। কিন্তু গল্পের শেষটা হৃদয়বিদারক। ব্যক্তিগত রেটিং ৫/৫।
হাওয়া: এক রাতে রবিউল খবর পায় তাদের দুটো মোষকে ডাকাতরা নিয়ে গিয়েছে। সেই মোষের সন্ধানে গভীর রাতে জঙ্গলে যায় আর সকালে ফিরে এসে অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। গ্রামে ছড়িয়ে যায়্ রবিউলের গায়ে খারাপ বাতাস লেগেছে। কিন্তু আর বন্ধু সাখা সকল নিষেধাজ্ঞা ত্যাগ করে যায়। তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কিন্তু সাখার এসব বিশ্বাস হয় না। আসলে রবিউওল খুব ভালো অভিনেতা ছিলো। দুই সপ্তাহ পর যখন সবকিছু শান্ত হয়ে যায় তখন সাখা রবিউলের সাথে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রবিউওলকে মাঠের মাঝে অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করে। দীর্ঘ একুশ বছর অনেক বই ও গবেষণার পর রবিউলের সেই আচরণের রহস্য খুঁজে পায় ব্যক্তিগত রেটিং ৪/৫।
লা পেরেগ্রিনা: শিকারে বের হয়ে জঙ্গলের মাঝে মাটি খুঁড়তে থাকা এক ব্যক্তির সাথে দেখা হঠাৎ দেখা হয় গল্পকথকের। আর সেখান থেকে গল্পকথক জানতে পারেন মহামূল্যবান মুক্তা লা-পেরেগ্রিণার কথা এবং সাথে এটাও জানতে পারে এর অভিশাপের কথা। যখনই লা-পেরেগ্রিণা যার হাতে গিয়েছে তখনই এর অভিশাপ নেমে এসেছে। গল্পটি বেশ উপভোগ্য ছিল। সাথে ছিল টাইম ট্রাভেল ও হৃদয়বিদারক কিছু গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ৪.৫/৫।
অন্বয়: “অক্সালিস” এক ধরনের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এর বিশেষত্ব হলো এর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। তেমনি মানুষের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যেও প্রয়োজন যত্ন। এই গল্পের মূল বিষয়বস্তু এটি। বেশ সুন্দর একটি গল্প।। ব্যক্তিগত রেটিং ৪/৫।
নবমী: মোকসেদ আলমের বাসায় চুরি করতে এসে ড্যান আবিষ্কার করে এক মৃতদেহ। মৃতদেহটি আর কারো নয় স্বয়ং মোকসেদ আলমের আর ড্যান ফেঁসে যায় এক গভীর ষড়যন্ত্রে। পুরো গল্পের সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে নৃসংশতা। তাই যারা এসব ভায়োলেন্স পছন্দ করেন না তারা পরিহার করতে পারেন এই গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ১/৫।
দাহ: ‘বাবা’ শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে আস্থার একটি স্থান। কিন্তু সবার জন্যে ‘বাবা’ আস্থা কিংবা স্বস্তির স্থান হয় না। তেমনি হয়েছে এই গল্পেও। বিন্দু ছোটবেলা থেকেই বাবার অসহনীয় নির্যাতনে বড় হয়েছে। বিন্দুর জন্ম হতেই শারীরিক সমস্যা ছিলো সে ব্যাথা অনুভব করতে পারে না। আর এ জন্যে তার উপর নির্যাতনের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে দিনের পর দিন। এই নির্যাতনের শেষ হয়েছিল একদিন। তবে এর জন্যে বিন্দুর বাবার ভুগতে হয়েছে সারাজীবন। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
জননী: ঘৃণা মানুষকে কখনই সুফল এনে দিতে পারে না। শুধু মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করে আর প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ করে দেয়। এই গল্পে ইভা তার মায়ের মৃত্যুর পর তার মায়ের স্থানে তারা খালা শায়নাকে দেখে নিজের মাঝে ঘৃণার জন্ম দেয়। আর সেই মাত্রা এতটাই প্রকট ছিলো যে বার বার শুধু শায়নাকে ভোগ করতে হয়েছে লাঞ্ছনা ও কষ্ট। কিন্তু ইভার জানা ছিলো না এর অতীত। কি হয়েছিলো আসলে শায়নার সাথে তারা বাবার! কিভাবে তারা জড়িয়ে পড়েছিল একটি সম্পর্কে! বেশ চমৎকার একটি গল্প। ব্যক্তিগত রেটিং ৫/৫।
অর্বুদ: বাবা-মায়ের ঝগড়া আর বিচ্ছেদ্র প্রভাব সন্তানের উপর কীরূপ প্রভাব ফেলে তাই এই গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গল্পটি বেশ অদ্ভুতভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন, যা বেশ ভালো লেগেছে। তবে কিছু ভায়োলেন্স রয়েছে এই গল্পে। ব্যক্তিগত রেটিং ৪/৫।
সুবর্ণ-রাধিকা: শারীরিক সমস্যা মানুষকে যতটা পীড়া দেয়, মানসিক যন্ত্রণা তার চেয়ে অনেক বেশি পীড়া দেয়। গল্পে সুবর্ণ নামের চরিত্রটি হঠাৎ নিজেকে একদিন মর্গে আবিষ্কার করে এবং সেখান থেকে তার পরিচয় হয় সুবর্ণের সাথে। কিভাবে সে মর্গে পৌছেছে তা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। এখান থেকে তাদের পরিচয় এবং একসময় তারা সাত পাঁকে বেঁধে নিজেদের একটি সম্পর্কে নিজেদের আবদ্ধ করে। তাদের ঘরে একটি সন্তানের আগমন ঘটে। কিন্তু সে বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কি হয়েছিল সেই নবাগত সন্তানের সাথে তা জানতে পড়তে হবে গল্পটি। ব্যক্তিগত রেটিং ৩.৫/৫।
কিছু কিছু গল্পে অযথা যৌনতা দিয়ে গল্পের সৌন্দর্্য নষ্ট করা হয়েছে আমি মনে করি। তবে কিছু গল্প খুবই সুন্দর করে বর্ণ্না করা হয়েছে। বইটি পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ রইলো যদি ছোটগল্প ভালো লেগে থাকে।
[২১টি গল্পের গুটিকয়েক হয়তো আলোচনায় বাদ যেতে পারে। দীর্ঘ আলোচনায় সেটা অনিচ্ছাকৃত। ১/২টা গল্পে হয়তো হালকা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মনে হতে পারে। সেটা আমার সিদ্ধান্তহীনতার কারন। একধরনের ডুয়ালিটিও বলা চলে।]
এক.
সাখাওয়াত হোসেনের "সুবর্ণ-রাধিকা" নিয়ে লিখতে বসে শুরুতে আমিও একটা ছোট গল্প বলে নেই। বলার প্রাসঙ্গিকতা পরে ম্যাচ করা যাবে।
বিখ্যাত ফরাসি মুকাভিনেতা মার্সল মার্সোর একটা দুর্দান্ত কাজ আছে। গল্পটা এমনঃ কোন একটা বিশেষ পরিচয়ের মধ্যে মানুষ আটকে যায়। ধরা যাক, একজন মানুষ একটার পর একটা মুখোশ লাগিয়ে মজা করছে। একটা মুখোশ লোকটার মুখে আটকে গেছে। সে মুখোশটা টানবে, কিন্তু খুলবে না।
বলা বাহুল্য, সত্যিকারের মুখোশ নেই সেখানে। লোকটা মানে একজন অভিনেতা মুখোশ পরার ভঙ্গি করছে, আর মুখটা বিশেষ কোন মুখোশের মতো হয়ে যাচ্ছে। খুব মাজাদার একটা মুখোশ পড়লেন অভিনেতা, কিন্তু সেটা আটকে গেছে; খুলছে না। মুখটা মাজাদার করে রাখা আছে, কিন্তু শারীরিক ভঙ্গি ভিন্ন। সমস্ত শক্তি দিয়ে পাগলের মতো সেই মুখোশ খোলার চেষ্টা।
আমাদের জীবনও কি অনেকটা তেমন না? একান্ত নিজের মুখোমুখি বসেও কি আটকে থাকা খুঁজতে পারি আমরা? বা খুলতে পারি সমবসময়?
দুই.
"সুবর্ণ-রাধিকা" ২১টি গল্প সংকলনের বই। তাই প্রতিটা গল্প ধরে ধরে বলার শক্তি, ধৈর্য এবং সাহস নেই। শুরুতেই তাই মূল আলাপে চলে যাব। আলাপ বড় হবে মনে হয়। ফরাসি মুকাভিনেতা মার্সল মার্সোর গল্পটা শুরুতে বলার কারন দুটো। বিভিন্ন জনরায় লেখা এই গল্পগুলো পাঠ শেষে কিছু কিছু গল্প হয়তো সেই লেগে থাকা মুখোশের মতোই হবে। পাঠক ভেদে সেই মুখোশ বদল হবে। এতো গেল পাঠকের দিক থেকে।
লেখকের দিক থেকেও এর প্রাসঙ্গিকতা আছে কিছুটা। বিভিন্ন জনরার মিশ্রনে লেখক যে গল্পগুলো লিখেছেন তার অবহে যেমন অলৌকিকতা আছে, সেই অলৌকিকতার ভাঁজে লৌকিক বিষয়গুলোর সন্নিবেশও চোখে পড়ার মতো। সমানের আলোচনায় সেটা কিছুটা রিভিল করার চেষ্টা থাকবে। যেটা বলছিলাম, রিয়ালিটি এর টাচ আছে, তবে সেই রিয়ালিটি-টুকু উপস্থাপনে লেখক ইমাজিনেশনের আশ্রয় নিয়েছেন। অথবা বলা যায় অলৌকিক অবহের আশ্রয় নিয়েছেন। ট্রান্সফর্মেশনের এই জায়গায় এসেই লেখক তার ম্যাজিক দেখিয়েছেন। এক ধরনের ডুয়ালিটি বলা চলে। লৌকিক এবং অলৌকিক এর মিশ্রনে যে ডিসটরশনগুলো একেঁ গেছেন - সেই ডিসটরশনগুলোও লৌকিক ও অলৌকিক এর ছায়ায় হয়ে উঠেছে অন্য রিয়ালিটি। "সবর্ণ-রাধিক" বইয়ের প্রথম গল্প "আদিম" এর যোগ্য উদাহরন। সব গল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। ত��ে "আদি��" গল্পটা নিয়ে আমি একদম শেষে আলোচনা করবো কিছু।
যেটা বলেছিলাম, এইখানে লেখকের একাধিক ট্রান্সফরমেশন নানা গল্পে দেখা যায়। অনেকটা মুখোশের মতোই। অনেকটা আইডোলজিক্যাল (ভাবাদার্শগত অর্থে) এক্সপেরিমেন্ট, ফিলোসফিক্যাল অভিব্যক্তি এবং অনেকক্ষেত্রেই পারসোনাল এজেন্ডা বা ফিলিংসগুলো এক্সপ্রেস করেই। এর মধ্যে কোনটা সেঁটে থাকা মুখোশ এবং কোনটা আলগা - সেটা নিরূপনের উপায় হয়তো পাঠক হিসাবে অব্যর্থ হবে না। সুতরাং সেই পথে না হাঁটাই শ্রেয়। তবে কিছু গল্পের ইথিক্যাল ইমপ্লিকেশন যে নেই তা না, আবার সব গল্পেই ইথিক্যাল ইমপ্লিকেশন থাকা অবশ্যম্ভাবী তাও না। ইথিক্যাল ইমপ্লিকেশন ব্যাপারটা যে গল্পে খুব সিগনিফিক্যান্ট ভ্যালু রাখবে বা থাকা লাগবেই এমন না।
তিন.
"সুবর্ণ-রাধিকা" এর সবচেয়ে ঝামেলার বিষয় (আমার মতে) এর ২১টি গল্পের সমাহার। এক মলাটে গল্প-সংখ্যা বেশ বেশিই হয়ে গেছে। অথাব আমি হয়তো লেখার প্রেক্ষিতে সেই বিবেচনাবোধ দিয়ে দেখছি। পাঠক হয়তো চাইবে আরও বেশি। ব্যাপারটা অনেকটা ব্যুফে লাউঞ্জের মতো। অজস্র মুখেরোচক খাবার প্রথমে দেখতে ভালো লাগলেও, পরবর্তীতে চোখের একটা ক্লান্তি আসে। সব খাবার সমানভাবে উপভোগও করা যায় না "ওভারডোজ" এর কারনে। এর মানে এই না যে, খাবারগুলো মাজাদার না। বরং অনেক মাজাদার খাবারও অন্য খাবারের অধিক্যের কারনে কিছুটা পানসে লাগে। সেটা খাবারের দোষ না, বরং অন্য খাবারের উপস্থিতির কারন।
"অর্বুদ" গল্পটা আমি একদম স্কিপ করেছি। ২১টা গল্পের শুধুমাত্র এই গল্পটা আমি স্কিপ করেছি এর বিষয়বস্তুর কারনে। একান্ত ব্যক্তিগত ফিলিংস এটা। গল্পের দোষ না। এই টাইপ থিম আমার মানসিক অসস্থায় বাড়তি চাপ ফেলে। ছোট বাচ্চা রিলেটেড এমন কিছু আমি তাই এড়িয়ে যাই।
উপরে যেটা বলছিলাম সেই সূত্র ধরে "শালুক", "নবমী", "মন্দির" এবং "প্রসূন" গল্পগুলো এই ধারায় পড়ে। অন্য গল্পগুলোর ছায়ায় উক্ত গল্পগুলো অনেকটাই তার নিজস্ব আলো হারিয়েছে। সেটা লেখকের লেখরা দোষে না, বরং আমি বলবো "অধিক ফলের ভারে নুয়ে পড়া গাছের মতো" যার কিছু ফল মাটিতে স্পর্শ লেগে স্পট পড়ে যায়। এইখানে বলে রাখা যায়, লেখক তার সবগুলো গল্পে খুব চিন্তা-ভাবনা করে প্লট সাজিয়েছেন এবং এক্সপেরিমেন্টও করেছিন। শুধুমাত্র "প্রসূন" গল্পে সেই ঘাটতি রয়ে গেছে। এই ঘাটতিটুকু তাড়াহুড়াজনিত ফল নাকি অন্য কিছু তার অনুমান করা কঠিন। নাকি "slippery slope" বলবো?
চার.
ছোটগল্প মানেই আঁটসাঁট, ঘনবন্ধ আবহ। উপন্যাসের মতো এতে সেই জায়গাটা নেই যেখানে লেখক হয়তো মূখ্য কাহিনির পাশাপাশি কোন গৌন কাহিনির সমরৈখিক বর্ননায় তার বক্তব্য উজ্জ্বল করবে। চরিত্র তো যেকোন গল্পের প্রাণ। সেটা ছোটগল্প হোক, বড়গল্প অথবা উপন্যাস। ছোটগল্পে আকার সীমিত বলেই চরিত্রের স্তরবিন্যাস খুব একটা জরুরী না। চরিত্র ডেভোলপমেন্ট ব্যতীত হুট করে কোন পূর্ন চরিত্রের আবির্ভাব বরং প্রত্যাশিত। বরং ইনসিডেন্ট বা ঘটনা মূখ্য ভূমিকায় দাঁড়ায়। টাইট-প্লটিং এবং ইমাজিনেশন হয়ে ওঠে সবচেয়ে সফল অস্ত্র। চূড়ান্ত পরিনতি বা ক্লাইমেক্সের দিকেই ধাবিত হয় সেই গল্প। প্রস্তুতি থাকে সূচনায়।
সূচনার এই প্রস্তুতি লেখককে এমনভাবে করা লাগে যাতে পাঠক শুরুতেই হুকড হয়ে যায়। বলা চলে সূচনার আকর্ষনীয়তার পাঠককে পুরো গল্পে ধরে রাখে। লেখক সাখাওয়াত হোসেন তার "সুবর্ণ-রাধিকা"'র প্রতিটি গল্পেই এই সূত্র খুব ভালোভাবেই বহাল রেখেছেন। প্রতিটা গল্পের সূচনার আকর্ষনীয়তা কোন গল্পেই ক্লাইমেক্সের প্রতি অনীহা তৈরী করেনি, বরং পাঠক একদম শুরুতেই হুকড হয়ে যাবে।
অনেকটা "নামহীন কথকের" আদলে তিনি যেভাবে গল্পগুলো বলেছেন, তা লৌকিক ও অলৌকিকের আবহ মিশ্র করেও যেন কথকের অভিজ্ঞতার গল্প শুনছি - যার আকর্ষনের মূলে আছে অবিশ্বাস্য এবং অস্বাভাবিক নামক দুটো সহায়ক। এবং তার গল্পবলার (উপস্থাপনের) ভঙ্গিমায় যেন পাঠক সেই মুহূর্তটুকু "দিব্যদর্শন" (অথবা গল্পদর্শন) করছেন বলে মনে হবে। অলমোষ্ট অধিকাংশ গল্পেই লেখক এই "নামহীন কথক" ব্যাপারটা চাইলেই পুরোটাই নামহীন রেখে বলতে পারতেন। সেই জায়গাও ছিল। তবে মেক্মিমাম গল্পে তিনি শুধু ১ বারই সেই "নামহীন কথকের" নাম রিভিল করেছেন। শুধুমাত্র ২টি গল্প "দাহ" এবং "লা পেরেগ্রিনা" তে আমরা "নামহীন কথক" কে নামহীন অবস্থায়ই পাই। নামগুলো রিভিল না হলে হয়তো কথকের ভূমিকায় সম্পূর্নরূপে "লেখক" কে প্রতিস্থাপন করার সুযোগ ছিল। “হাওয়া” গল্পে যদিও সেই নমহীন কথকের নাম "সখা" উল্লেখ করে তিনি "সাখাওয়াতের" সংক্ষিপ্তরূপ দিয়েছিন কিনা কে জানে। গুরুত্বপূর্ন কিছু না। তবে এই "নামহীন কথকের" টোনে গল্প বলতে বলতে ১/২ বার সেটা রিভিল করা বোধহয় লেখকের ষ্ট্যাইল ধরে নেয়াই যায় প্রতিটা গল্পে সেই ছাপ থাকায়।
পাঁচ.
লেখকের গল্প বলার ভঙ্গি বা ষ্ট্যাইল নিয়ে কথা হচ্ছিল। লেখকের গল্প বলার ভঙ্গিমা মোহনীয়, সেটা পূর্বেও সব পাঠকই স্বীকার করে নিয়েছেন। নতুন করে বলার কিছু নেই। ছোট-ছোট বাক্যে পড়ার কম্ফোর্ট পাঠকের জন্যে বাড়িত সুবিধা এড করেছে। এই অংশে আমি "ঘুম" গল্পের হতে কিছু অংশ তুলে ধরিঃ (আরও অনেক গল্পেই এই ব্যাপারটা আছে)-
"আমি যখন মিমিকে প্রথমবার কোলে নিলাম, তখন সকাল। কেবিনের ছোট একটা জানালা দিয়ে সকালের প্রথম রোদ এসে জমে রইলো কোলের উপর আমার, ওখানে মিমি। মিমির তুলতুলে মুখের উপর রোদ। মনে হলো, আমি একটুকরো রোদ কোলে নিলাম মাত্র। মাথা নামিয়ে টুপ করে ঠোঁটে চুমু খেলাম। দুধের গন্ধ। আদুরে। তুলতুলে। কোমল। নিটোল।"
শেষ ৪/৫ টা শব্দ খেয়াল করলে দেখা যাবে, লেখক অনেক গল্পেই এমন ১ শব্দ দিকে বাক্য শেষ করেছেন। ব্যাপারটা মূলত "বিশেষণ" গুলোকে লেখক এভাবে লিখে ব্যাপারটাকে আরও তীক্ষ্ণ বা বোল্ড করে দেখানোর অভিপ্রায়। এই প্র্যাকটিসটাও লেখকের অনেক গল্পেই আমরা পাই। ব্যাপারটা শুধুমাত্র "ভালো বা মন্দের" সরল ছকে দেখার বিষয় না। লেখক তার মতো করেই লিখবেন। আমাদেরও এভাবে পড়তে বেশ সহজ এবং সাবলীলই লেগেছে। কিন্তু ব্যাপারটা অধিকাংশ লেখায় দেখে মনে যে প্রশ্ন জাগে, এটাকে কি লেখকের সিগনেচার স্ট্যাইল বলবো নাকি মুদ্রাদোষ।? "মুদ্রাদোষ" এখানে অবশ্যই নেগেটিভ সেন্সে না। বরং আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রশ্নটা জাগলো, যে "কোন লেখকের মুদ্রাদোষ কি তার সিগনেচার স্ট্যাইলে দাঁড়ায়? অথবা তার কোন সিগনেচার স্ট্যাইলই "মুদ্রাদোষ হয়ে দেখা দেয়?" নাকি অধিকাংশ গল্পে এরূপ ব্যবহার প্রত্যক্ষের কারনেই মনে হতে পারে লেখক অজান্তেই হয়তো নিজের ছায়া অনুসরণ করে গেছেন?
ছয়.
কিছু গল্পে লেখক যেমন শুধু হেঁটেছেন হৃদয়ারণ্যের ছায়ায়, তেমিন কিছু গল্পে লেখক দেখিয়েছেন বুদ্ধির চোরাগলিতে হাঁটার কৌশল। আবার কিছু গল্প যেন একই সাথে বুদ্ধির চোরাগলিতে হাঁটার পাশাপাশি হৃদয়ারণ্যের ছায়ায় হাঁটার সহাবস্থানও। "নবমী" গল্পে আমরা সেই বুদ্ধির চোরাগলিতে বিচরনের অনুভূতি পাই। তেমনি "অংশন", "পারাপার", "অন্বয়" এবং "অন্তরকলন" গল্পে পাই হৃদয়ারণ্যের ছায়ায় বেড়ে ওঠা দুর্দান্ত গল্প।
"আদিম" গল্প দুটোরই মিশ্রন। "সুবর্ন-রাধিকা"র প্রথম গল্প আদিম। শুরুতেই পড়ে মনে হচ্ছিল এই গল্পটাই আমার সবচেয়ে সেরা পাঠ হবে। যদিও পরবর্তীতে "অন্তরকলন" এবং "পারাপার" গল্পদুটো সেই জায়গা নেয়। তারপরেও "আদিম" সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত এবং দারুন একটা গল্প নিঃসন্দেহের এর মাল্টি-সারফেসের কারনে।
মেলানকলিক বিউটি বলেই কি "অন্তরকলন" অসম্ভব প্রিয় হয়ে ওঠে? অথবা "পারাপার" নামক গল্পটি? যেখানে শুরুতেই "আদিম" আমার কাছে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং আইডোলজিক্যাল (ভাবাদার্শগত অর্থে) এক্সপেরিমেন্ট/ প্রকাশ এর কারনে মোহনীয় হয়ে ছিল, সেখানে সেটা ছাপিয়েও উক্ত গল্পদুটো আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। "পারাপার" যদিও অনেকের কাছে "দুর্বল" গল্প হিসেবে বিবেচিত (কিছু রিভিউ দেখে এবং তাদের চয়েসের প্রতি সম্মান রেখেই আমি দ্বি-মত পোষন করি), তথাপি আমার কাছে লেখকের অসম্ভব ভালোদুটো গল্প ওই দুটো।
বিশেষ করে "অন্তরকলন" গল্পটার কথা না বললেই না। "সুবর্ণ-রাধিকার" সবগুলো ভালো গল্পে মধ্যে "অন্তরকলন" এর "আমি এই মুহূর্তে বসবাস করি স্যার" এর যে অনুভূতি সেটা পুরো গল্পগ্রন্থের মোষ্ট এস্থেটিক এবং বইয়ের ভরকেন্দ্র হিসেবেই দাঁড়িয়ে যায়। বা সৃজন হয় বলা চলে। নিজেরে জানার জন্যে মানুষের যে আকাঙ্খা এবং সেই জানতে চাওয়ার প্রসেসের দাঁড়প্রান্তে "নিজেকে বুঝে ফেলার পূর্বের ধাপে" আটকে যাবার এই চিরন্তর বিষটারই যেন অপার্থিব রূপ। ক্ষীন-রশ্মির মতো কিন্তু প্রবল আশাটুকুই যেন "মেলালকলি বিউটি" হয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকে গল্পে।
"পারাপার" ও খুব সাধারন সাদামাটা একটা গল্প। অনায়াসে এড়িয়ে যাওয়া যেত বা পড়ে সেভাবে মনে নাও রাখা যেত। কিন্তু এর শেষটা, "ঐ শহর আমার কিছু দুঃখ পোষে। আমি আমার ভেতর আস্ত এই শহর পুষি" - আমাদের (অন্তত আমাকে) এই গল্পটাকে ভুলতে দেয় না। মেঘলা দিনে থমথমে আকাশ আর যে কোন সময় বৃষ্টি নামার ভয় এবং আকাঙ্খার যে মিশ্র অনুভূতি সেই "আকাশটাকে" মধ্যবিত্ত আকাশ করে তোলে - ঠিক তেমনি হয়োত "পারাপার" গল্পটা আমাদের মধ্যবিত্ত গল্পের আদলে রয়ে যায় বা যাবে ভিতরে। শুধুমাত্র শেষ আঁচড়টুকু একটা সাধারন গল্পকে অসাধারন করে তুলেছেন লেখক।
সাত.
“মোচক" গল্পটিও রূপকার্থে "কুকুরের" ব্যবহার অনন্য। "শালুক" গল্প মোটামুটি লেগেছে। সেই একই কথাই বলবো, অনেক গল্পের কারনেই হয়তো “মোটামুটির আলো” নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। "গ্রন্থন" গল্পে অন্য গল্পগুলোর মতেই লৌকিক এবং অলৌকিক আবহের মিশ্রন - সাথে প্যারেন্টিং বা সচেতনতা মূলক গল্পও ধরা যায়। "সুবর্ণ-রাধিকা" ভালো গল্প, তবে ছোটগল্প বলে এক্সপ্লেইনেশেনের জায়গা কম। আরও বিস্তারিত যদি হতো এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারগুলো - তাহলে সেটার উজ্জ্বলতা আরও বাড়ত।
অন্তর্জালে লেখকের সাথে এড থাকার দরুন কিছু সিদ্ধান্ত (হতেও পারে ভুল) দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সোজা। যেমন লেখকের "হুমায়ূন আহমেদ" অবসেশন আছে। বেশ কিছু রহস্য বা থ্রিলার পড়লে যেমন একটা ফিল হয় (আপতত উদারহন স্বরূপ "শেষ মৃত পাখি" মনে পড়ছে) যে, "থ্রিল আছে, স্পাই নেই" - ঠিক তেমনি বেশ কিছূ গল্পেই ফিল হয়েছে, "রহস্য আছে, মিসির আলী নেই"। "জননী" গল্প এবং আরও এমন কিছু গল্প আছে।
"বিভাস" টাইম-ট্রাভেল রিলেটেড বা সাই-ফাই গল্প। তবে কিছুটা ওভার-ইউজড থিম। তাই সেভাবে ভালো লাগেনি। "manifest" টিভি সিরিজও অনেকটা সেম টোনের। হয়তো এই কারনেই সেভাবে আমার কাছে এ্যপিলিং কিছু লাগেনি।
"গ্রন্থন" দারুন একটা গল্প। তবে এই গল্পের কংকালে আছে ইমতিয়াজ মাহমুদের "বই" কবিতা। "খোদা আমাকে মানুষ বানালো/ আমি বই হতে চেয়েছিলাম" এর মূল অর্থে মিশে আছে গ্রন্থনে। এই কবিতাটি দ্বারা গল্পটি অনুপ্রাণিত কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। কাকতালীয় বলেও কথা আছে। তবে যেহেতু ইমতিয়াজ মাহমুদ আমার আগে পড়া - তাই সেই পড়া সুবাদে "গ্রন্থন" আমার কাছে নতুন কোন আঙ্গিক নিয়ে হাজির হয়নি।
"প্রসূন" গল্পে রসুনের ঘ্রাণ ছাপিয়েও কিছু দুর্বল যুক্তি উঠে এসেছে। লেখকের ২১টি গল্পের মধ্যে এই ১টি গল্পে আমার মনে হয়েছে কিছুটা তাড়াহুড়া ছিল হয়তো। পূর্বেই কিছু কথা বলেছি এই ব্যাপারে। লেখক তার অন্যসব গল্পের ব্যাপারে যেমন সাবধানী, সচেতন এবং বুদ্ধিদীপ্ত ছিল, সেখানে হয়তো "প্রসূনের" রসুনের ঘ্রানে লেখক নিজেও কিছুটা আবিষ্ট ছিল। যেমন, ছোট একটি বাচ্চার ঘুম পাতলা এবং ফুলের ঘ্রাণ নিতে টেনে টেনে নাকের শ্বাস নেবার শব্দে সেই বাচ্চার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেটা মানানসই। তবে তার পূর্বে চায়ের কাপ হাত থেকে পড়ে ভেঙে একাকার হওয়ার শব্দেও সেই বাচ্চার ঘুম না ভাঙাটাও আবার অযৌক্তিক। খুব সমান্য বিষয়, তবে বললাম এই কারনেই যে, লেখক তার সবগুলো গল্পেই সূক্ষ্ণ ডিটেইলিং এর প্রতি লক্ষ্যও রেখেছেন, সুবিচারও করেছেন। তাই এই অংশটুকু চোখে পড়েছে আলাদা ভাবে।
লেখকের লেখার হাত দারুন কোন সন্দেহ নেই। গল্পের প্লট নির্বাচনও লেখকের ইমাজিনেশন সক্ষমতার সফল বহিঃপ্রকাশ। ইমাজিনেশনের পাশাপাশি রিয়েলিটির রিফ্লেকশনটুকুও চোখে পড়ার মত। হতে পারে সেটা অভিজ্ঞতার ফল অথবা চারপাশের সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার দৃষ্টির দান। এখানে "অথবা" টুকু রাখা লেখকের বয়সের কারনে। সব অভিজ্ঞতা যে ব্যক্তিগত হবে সেটার কোন কারন নেই। তবে যেভাবেই আসুক না কেন সেটা – প্রসংশনীয় এবং মোক্ষম। রিয়েলিটির রিফ্লেকশনটুকুই গল্পগুলোকে অলৌকিক অবহে আবদ্ধ রেখেও একদম "আউট-অফ-ওয়াল্ড" না করে বরং পাঠকের লজিক্যাল ফেনোমেনার মধ্যে রেখে দেয় কিছুটা। অবশ্যই কল্পনা-বিলাসী তবে বড়সড় উদাসীনতার মধ্যে পড়ে না।
আট.
"সুবর্ণ-রাধিকা" ২১টি গল্পের যে সংকলন - তাতে নান জঁরার মিশ্রন। অনেকটা মুড়ি মাখনোর মতো। আমাদের শৈশবের সেই মুড়ি মাখানোর স্বাদ বা স্মৃতি সবার মনেই খুব উজ্জ্বল। শুধু স্বাদ না - আমার মতে মোহনীয় খাদ্যটার সিম্পল প্রিপারেশনটাও অনেকাংশে দায়ী মনে দাগ কাটতে। "সুবর্ণ-রাধিকা" থেকে যদি প্লট নির্বাচনের ক্যারিশমা, অলৌকিকতা বা অন্য বিশেষণ বাদ দিয়ে শুধু সিম্পল-প্রিপারেশনটুকু রাখি - সেই অর্থেও লেখক সাখাওয়াত হোসনে উৎরে যাবেন দারুন ভাবেই। "অন্বয়" গল্পটি তার উদাহরন।
"অন্বয়" গল্পটির নাম "অক্সিলিস" হলেও ক্ষতি ছিল না। অনায়াসে মানিয়ে যেত। গল্পে ব্যবহৃত চিঠি নয় - বরং "অক্সিলিস" এবং সেই গাছে “ফুল ফুঁটিয়ে আনা” বোনদের জন্যে, এবং একি সাথে "ইভুর" জন্যে "ফুল না ফুঁটিয়ে" টবে গাছ আনার তারতম্যটুকু গল্পটাকে নিয়ে গেছে ক্যাচি প্লেসে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা অথবা ইমোশোনাল ড্রাইভ - লেখক এই ব্যাপারে সম-ভাবেই সিদ্ধহস্ত। তাই শুধু সামাজিক জঁরাতেও লেখক খুব দুর্দান্ত কাজ রাখবেন বা সমনে উপহার দেবেন - এই আশা মোটেও দুরাশা নয় - শুধু অপেক্ষার পালা। "পারাপার" বা "অংশন" গল্পগুলোও এই উদাহরনের আওতায় অনায়াসে খাপা খায়।
লেখকের সূক্ষ্ণ ডিটেইলিং অথবা মানুষের মন বা মনস্তাত্বিক বিষয়গুলো ফুঁটিয়ে তোলা লেখকের সাবলীল কলমের চিহ্ন। তবে এন্ড নোটে এটুকু বলে যাই, লেখকের গল্পের অধিকাংশ পুরুষগুলো যেন খুব বেশি পারফেক্ট? "নবমী" গল্পের "ড্যান" অথবা "দাহ" গল্পের "পিতার” চরিত্রে যা একটু নেগেটিভিটি পাই। এর বাইরে অধিকাংশ পুরুষ চরিত্র যেন অসীম ধৈর্যশীল এবং পারফেক্ট হয়ে উঠে আসে। উদারও। আলাপের কারনে উল্লেখ করা - গল্পের টোনে এর কোন আলাদা প্রভাব নেই। লেখকের বাস্তবিক দেখার সাথে লেখার একটা আঙ্গিকের অনুপস্থিতি বলা যায়। নাকি মেয়ে-পাঠক বলে আমি এখানে "ফেমিনিস্ট" আচরন প্রকাশ করে ফেললাম? আদতে সেরকম কিছু না।
নয়.
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, সবগুলো গল্প নিয়ে ডিটেইলস আলাপের উপায় নেই। তাতে লেখা বইয়ের চেয়েও বড় হবে। ইতোমধ্যে অনেক বড়ই হয়েছে। তাই "আদিম" গল্পটা নিয়ে অল্প কিছু বলে শেষ করব। "অন্তরকাল" বা "পারাপার" অনেক প্রিয় হলেও "আদিম" নিয়ে আলাদা করে আলোচনার কারন এই গল্পের মাল্টি-সারফেস এবং লেখকের বুদ্ধিদীপ্ত লেখার জন্যে।
আদিম গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি নামহীন কথক (রাফায়েত) কে তার মা অন্ধকার একটও ওয়াশরুমে পানিশমেন্ট স্বরূপ আটেকে দেয়। ঘটনার শুরু সেখানেই। অন্ধকার ওয়াশরুমে অন্ধকারে রাফায়েত দেখে কুচকুচে কালো রঙের সাপ উঠে আসছে। গল্পের এই পর্যায়ে এসে পাঠক হ��়তো তার "লজিক্য���ল ফেনোমেনা" কাজে লাগিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিতে পারেন যে, অন্ধকার রুমে কালো কুচকুচে সাপের অনুভব হওয়া হয়তো সম্ভব। কিন্তু লেখক এখানে ব্যবহার করেছেন "নীচের দিকে তাকিয়ে দেখা"।
গল্পের আবহের কারনে এই অংশে সেই লজিক্যাল ফেনোমেনা অনেকাংশেই বাতিল হবে। কারন ওয়াশরুমের দরজার বাহিরের পাশ এবাং ভিতরের পাশ - এর মধ্যে লেখক তৈরী করেছেন একধরনের সাইক্যাডেলিক ঘোর। একি সাথে লেখক অনায়াসে সৃজন করে নিয়েছেন দুটো দৃশ্য - আলো এবং অন্ধকার। দরজার ওপাশে তাই লজিক্যাল ফেনোমেনা অন্তঃসারশূন্য বলেই গণ্য হবে।
এর পাশাপাশি লেখকের "নাথিং" এবং "শূন্য" ও সেই ঘোরের অংশ। পাঠক কোন পক্ষে যাবে সেটাও পাঠকালীন পাঠকের চয়েস। এবং একি সাথেও এই "চয়েস" টাও আদতে কি "পাঠকের চয়েস" হিসেবে থাকে নাকি লেখক কৃর্তক নিয়ন্ত্রিত? লেখকের "আদিম" গল্পের বুদ্ধিদীপ্ত অংশের ঝলক এখানে। পুনরায় গল্পের কথক (অথবা লেখক) আপনাকে ঠিকই দাঁড় করিয়ে দেবে সেই দরজার সামনে। দরজার রং রুপালি। এর মধ্যে হয়তো আপনি ঘুরে এসেছেন অন্য কোথাও।
এই আলো-অন্ধকার, দেয়ালের রঙ, প্রক্তনের গল্প, নাথিং এবং শূন্যের মারপ্যাচ পেরিয়ে পাঠক হয়তো কোন এক মুহূর্তে বুঝতে পারবনে লেখক পুরোটা সময় ধরেই একটা জিনিস শুধু নিজের হাতে রেখেছেন। সেটা হচ্ছে "সুইচবোর্ড"। সেই সুইচবোর্ড লেখক তার ট্রিকি-ওয়েতে কখনো অন করেছেন, কখনো অফ। পাঠক সেই তালে কখনো আলোতে, কখনো অন্ধকারে।
ঊনপঞ্চাশজনকেও ছাড়েননি? পাঠক আপনি যে "পঞ্চাশতম" সেই পাঞ্চলাইনটা কি টের পাচ্ছেন? রাফায়েতের মায়ের মতো টের পেয়েছেন? যার মাথা নেই। শূন্য আর নাথিং এর বৃত্তে সকল আলো-অন্ধকার, প্রক্তন, রুপালি দরোজা, ওয়াশরুম সামনে রেখে লেখক (অথবা গল্পের কথক) যে পুরোটা সময় ধরে সুইবোর্ড অন-আর-অফ করে শিকার করলেন আপনাকে - হয়তো এটাই "আদিম" গল্পের সবচেয়ে দারুন পার্ট। যেই গল্পের ছদ্মনাম "শিকার" হলেও মানানসই হতো।
কে সেই শিকার?
পাঠক? নিঃসন্দেহে।
আদিমের মাল্টি-সারফেস গল্পটাকে অনায়াসে খুব দুর্দান্ত একটা উপন্যাসের রূপে লেখক খুব সহজেই দিতে পারতেন পাঠককে।
দশ.
২১ টি গল্প। ২১ টি মুখোশ। নিঃসন্দেহে আমার মুখে "অন্তরকলন", "পারাপার", "অংশন" অথবা "আদিম" মুখোশগুলো লেগে আছে। পাঠকভেদে তার তারতম্য হবে বৈকি। কিন্তু প্রতিটি গল্পের রেশ পাঠককে আলাদা স্বাদ দেবে, তৃপ্তি দেবে বলা বাহুল্য। সাখাওয়াত হোসেনের লেখার হাত দারুন। প্লট নির্বাচন সুচিন্তিত এবং তার উপস্থপান সহজ-সরল কিন্তু আকর্ষনীয়। পাঠকের সাইক্যাডেলিক ঘোর হয়ে ওঠার জন্যে যথেষ্ঠ।
অন্তত এইটুকু বলাই যায়, লেখকের পরবর্তী লেখা পাবার জন্যে সুবর্ন-রাধিকার পাঠকরা অধীর আগ্রহেই অপেক্ষা করবে লেখন নতুন কোন চমক নিয়ে হাজির হয়। বয়সের দিক থেকে খুবই নবীন লেখক। সময় মানুষকে আরও পরিশীলিত করে। তাই সামনে আমরা যে খুব শক্তিশালী একজন গল্পকার পাব এই আশার দূরাশা নয়, অলৌকিকও নয়। বরং বাস্তবিক হয়েই ধরা দেবে বিশ্বাস। শুধুমাত্র প্রগল্ভতা জেঁকে না বসলেই হয়। তাহলেই প্রতিভাত হবে এই শক্তিশালী লেখার হাত। সতীর্থ প্রকাশনী কে ধন্যবাদ এমন দুর্দান্ত একটি গল্প সংকলন উপহার দেবার জন্যে।
কারো লেখা প্রথম গল্পগ্রন্থ পড়তে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পাঠকরা আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘায়িত করে রাখবে না। গল্পগুলো ভালো হলেই লেখক সফল। আমিও রাখিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লেখক আমায় বাধ্য করেছে প্রথম গল্প থেকেই।
• প্রথম গল্প আদিম। শূন্যের সাথে পরিচয় ঘটাতে গিয়ে লেখক আমায়ও আটকে দিলেন শূন্যতায়। বাড়িয়ে দিলেন আগ্রহ। দ্বিতীয় গল্প প্রসূন বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। কিছুটা অনুমেয় লাগলেও উপস্থাপন ছিলো চমৎকার। তারপর একে একে একুশটা গল্পই পড়ে শেষ করলাম। পাঠ আনন্দে কোথাও ভাটা পড়েনি। এর সবচেয়ে বড় কারন লেখনশৈলী। লেখকের লেখার অভিজ্ঞতা ভালো। গল্পগুলো তার প্রমাণ রাখে।
• পাঠকের আগ্রহের মাত্রা আরো বেড়ে যায়, যখন লেখক জ্ঞানভাণ্ডার থেকে পাঠকের কাছে জানা-অজানা সব কথা গল্পের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পারেন। এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। বিভাস, অংশন, ঘুম, হাওয়া, লা পেরিগ্রিনা এ গল্পগুলো প্রমাণ, লেখক পুরান, অমীমাংসিত বাস্তব রহস্য, সাইকোলজিক্যাল বিষয় নিয়ে জ্ঞান রাখেন।
'গ্রন্থন' সাধারণ গল্প হয়েও মন ছুঁয়েছে শেষ বাক্যে, জাগিয়েছে আক্ষেপ। 'বিভাস' জাগিয়েছে কৌতূহল। 'শালুক' গল্পটা পড়ে শুরুতে যার জন্যে দুঃখ হলো, আশ্চর্যজনকভাবে তাকেই ঘৃনা করেছি সমাপ্তিতে। 'সূতপা ফিরে এসেছে।' সূতপাদের ফিরে আসা দরকার, এভাবেই। 'লা পেরিগ্রিনা' নামক গল্পটা আমার জন্য ছিলো কনফিউজিং। প্রশ্ন জেগেছিলো, কোন আমলের কোন রাজশাসন, এতোকিছু জেনে আমি কি করবো! উত্তর না জানিয়েও লেখক এর উত্তর দিতে পেরেছেন, বিচ্ছিন্ন ঘটনা সব মিলিয়ে দিয়ে। 'অন্বয়' গল্পটা আমার কেনো এতো পছন্দ হলো? সবচেয়ে সহজভাবে এক গুচ্ছ জীবনের কঠিন দিকটা তুলে দেয়া বলেই কি? আমি জানি না। ইভুকে বলা আন্টির শেষ কথা কী, তাও জানি না। অনুমান করতে পারি। লেখকও হয়তো তাই চেয়েছেন, পাঠক যেন অনুমান করে নেয়। 'জননী' গল্পটাও এমনই। ক্ষোভ, ঘৃনা, মাতৃত্ব এর কোনোটারই সীমাবদ্ধ সঙ্গা নেই। লেখকও গল্পে সীমাবদ্ধতা রাখেননি এসবের। সবচেয়ে বেশি পছন্দের গল্প জিজ্ঞেস করলে আমি জননী ও অন্বয়কেই শীর্ষে রাখবো। তবে নাম গল্প 'সুবর্ণ-রাধিকা' ছিল ভিন্ন কিছু। গ্রন্থের সমাপ্তি টানার জন্য যথাযথ গল্প।
• অপছন্দ করার মতো কোনো গল্প নেই বইটিতে। তাও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে বলবো 'পারাবার' ও 'নবমী' বাকিদের তুলনায় দুর্বল। পারাবারের ত্রুটি লেগেছে প্লটের। এ গল্পে আরো বিস্তর কিছু থাকলে 'ইমোশন কানেক্ট' করা যেতো আরো ভালোমতো। নবনীর ত্রুটি লেগেছে লেখনীতে। বাকি গল্পের তুলনায় এতে লেখা কিঞ্চিৎ দূর্বল মনে হয়েছে। গল্পটা থ্রিলার উপন্যাসের একাংশ তুলে দেয়ার মতো লেগেছে। কামনা জর্জরিত বর্ণনাও এর দূর্বলতা ঢাকতে যথেষ্ট ছিলো না। • পৃষ্ঠা ৮৮ তে, গল্প 'পারাবারে' ভার্সিটি ক্যাম্পাসকে কলেজ ক্যাম্পাস বলা হয়েছে। ভুল বলতে চোখে পড়েছে এইটুকুই।
• বাড়তি কথা (হাল্কা স্পয়লার যুক্ত): ইতোমধ্যে রিভিউর নামে অনেক বেশি বলে ফেলেছি। বলার কারণ আছে। বইটা নিয়ে অনেককিছুই বিশ্লেষণ করার আছে। যেমন: গল্পের নামকরণ। সবগুলো গল্পেরই ভেবে চিন্তে নাম দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, • 'প্রসূন' গল্পটার মূল কাহিনী এক দম্পতিকে নিয়ে যাদের নবশিশুর মাথার কাছে প্রতিরাতে সুঘন্ধি ফুল পড়ে থাকতে দেখা যায়। 'প্রসূন' শব্দের অর্থ ফুল। কাকতালীয় নাকি লেখকের ইচ্ছাকৃত জানি না, তবে বাংলা অভিধানে প্রসূনের পূর্ব শব্দ 'প্রসূতি' অর্থাৎ জন্মদাত্রী এবং পরের শব্দ 'প্রসৃত' যার অর্থ নির্গত, বা ভূমিষ্ঠও বলা যায়।। প্রসূন গল্পে লিলি একজন জন্মদাত্রী/ প্রসূতি। • আবার 'দাহ' গল্পটার নামকরণও লেখকের বুদ্ধির পরিচয় দেয়। গল্পে মূল প্রশ্ন ছিল, 'বিন্দুকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে?' কেউ জানে না। লেখক শেষ পর্যন্ত গল্পের কোথাও বললেন না। কিন্তু গল্পের নামেই তো বলে দেয়া হয়েছে, দাহ। বিন্দুকে কবর দেয়া হয়নি, দাহ করা হয়েছে। • একইভাবে, 'অংশন' নামের কারণ, অংশন অর্থ বিভাজন। মাতৃগর্ভে কোষের বিভাজন সম্পর্কি��� বিষয় গল্পের প্লটের সাথে জড়িয়ে আছে। 'হাওয়া' গল্পের নামকরণ হয়েছে, রবিউলের গায়ে খারাপ বাতাশ/হাওয়া লাগা থেকে। আর 'অন্বয়' নামকরণ এসেছে সম্ভবত গল্পে সম্পর্কের অদ্ভুত এক দৃষ্টান্ত থাকার কারণে। অন্বয় শব্দের অর্থ হয় সম্পর্ক। 'অর্বুদ' অর্থ রোগ, এর সাথে গল্পের জেনিফার কীভাবে সম্পর্কিত সেটা পাঠক পড়লেই জানতে পারবেন। এছাড়া কিছু নাম নিয়ে আমার কনফিউশন আছে, তাই সেগুলোর বিশ্লেষণ উল্লেখ করতে চাই না। লেখকের কাছে জানতে চাই, বৃশ্চিক, অন্তরকলন, বিভাস, শালুক, মোচক এ নামগুলোর পিছনে কী কারণ আছে?
এই বই বিশ্লেষণ সংবলিত আরও কথা বলা যেতো। থাক, ইতোমধ্যে লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেছে। পাঠ প্রতিক্রিয়া অংশে গল্পগুলোর প্লট নিয়ে সংক্ষেপেও বলতে পারিনি। বইটার ব্যাক কভারে সুন্দর করে লিখা আছে। অথবা রকমারিতে বইটার Summary সেকশন দেখতে পারেন, সেখানে প্রতিটি গল্পের আলাদা আলাদা করে প্লট বলে দেয়া আছে।
• ব্যক্তিগত রেটিং: ৪.৭/৫
গল্প প্রেমীদের জন্য একটা বড় ট্রিট 'সুবর্ণ-রাধিকা'। পরিণত বয়সের জন্য সীমাবদ্ধ না হলে ফুল মার্ক দিয়ে দিতাম।
ছোটগল্প আর উপন্যাস আমার কাছে এথলেটিক্সের দুটো ইভেন্টের মত মনে হয়। ছোটগল্প হচ্ছে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। শুরু হতে না হতেই শেষ। শেষ হবার পরে আবার মনটা আকুলি-বিকুলি করে আরেকটুর জন্য। পিপাসা আর মেটে না । রবীন্দ্রনাথ যেটাকে বলেছেন ,
অন্তরে অতৃপ্তি রবে , সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইলো না শেষ।
উপন্যাসকে সেক্ষেত্রে ম্যারাথন রেসের সাথে তুলনা করা যায়। গুটি গুটি কালো শব্দের পসরা সাজিয়ে লেখক পাঠককে নিয়ে যান তার মনের অন্দরে। সেখানে তার মস্তিষ্কপ্রসুত কাল্পনিক দুনিয়ার সাথে পাঠক পরিচিত হয়। কল্পনার সে দুনিয়ার চরিত্রদের সাথে তাদের দেখা হয়। তাদের দুঃখে পাঠকের কান্না পায়, বেদনায় তাদের হৃদয়ও ব্যথিত হয় । গল্পের সমাপ্তিতে নায়ক-নায়িকার মিল হলে পাঠকের মুখে ফুটে উঠে হাসি। আর স্যাড এন্ডিং দিলে মনে মনে লেখকের পিন্ডি চটকাতে দ্বিধাবোধ করেন না । বিশাল সাইজের একেকটি উপন্যাস যেন বিরাট এক আয়োজন। লেখকের জন্যও আবার পাঠকের জন্যও।
ছোটগল্প হচ্ছে সেখানে মার মার কাট কাট টাইপ। লেখক যা বলতে চান তা লিখতে তখন ২০ পৃষ্ঠা খরচ করার লাক্সারি থাকে না । বরং ২০ লাইনে সেটিকে বলতে হয়। একজন লেখকের জায়গা থেকে ছোটগল্প লেখা তাই সাহিত্যচর্চার বেশ দুরূহতম কাজ।
আর এই ছোটগল্পের রিভিউ লিখাটা আমার কাছে তার থেকেও কঠিন মনে হয়। আবার রিভিউ যদি কোনো ছোটগল্পের সংকলন নিয়ে হয় তাহলে তো কথাই নেই।
সুবর্ণ-রাধিকা সাখাওয়াত হোসেনের একটি ছোটগল্প সংকলন। এতে সর্বমোট ২১টি গল্প আছে। স্পয়লার দেয়ার ভয়ে গল্পগুলো নিয়ে বিস্তারিত কোনো আলোচনা করা যাচ্ছে না । আমি এমনকি গল্পগুলো নিয়ে অন্যদের একটু ধারণা দিতেও রাজি নই। কারণ বলতে গিয়ে একটু বেশি বলে ফেললেই মজা মাটি। আর গল্পগুলো নিয়ে কোনো ধরণের পূর্ব ধারণা না নিয়ে বইটি শুরু করাটাই সবচেয়ে ভালো। (তবে আমি শুধুমাত্র নবনী নামের গল্পটি নিয়ে পাঠকদের একটু সতর্ক করে দিতে চাই। গল্পটা আসলে দুর্বল হৃদয়ের মানুষের জন্য না । এই গল্পটার শুরুতে ওয়ার্নিং দেয়া উচিত ছিল। ) এই পোস্টটা মূলত আমার অনুভূতি শেয়ার করতেই লেখা।
সাখাওয়াত হোসেন যে ভালো ছোটগল্প লেখেন তা আগে থেকেই জানতাম ফেসবুকের কল্যাণে। আমার আগ্রহ ছিল তিনি উপন্যাস কেমন লেখেন তা দেখার। মৃগয়া পড়ে সে আগ্রহ মিটেছে। লেখক আমার কাছ থেকে লেটার মার্ক্স পেয়েছেন( কিছু মার্ক্স কাটা অতিরিক্ত দামের জন্য) ।
এই ছোটগল্প সংকলনের একটা গল্পও আগে পড়া না থাকা সত্ত্বেও আমি জানতাম কি হতে যাচ্ছে। পাঠকের মনকে নিয়ে তিনি কি খেলা খেলবেন পূর্বে তার বেশ কয়েকটি ছোটগল্প পড়া থাকায় জানা ছিল আমার। ছোট ছোট বাক্যে তিনি এমন কিছু গল্পের পসরা সাজাবেন যেগুলো পাঠকের মনে এক অদ্ভুত ঘোর সৃষ্টি করবে। আমি তাই বইটি শুরু করার আগে মনে মনে প্রস্তুতই ছিলাম। এত সাবধানতা সত্ত্বেও লেখক আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন তার কল্পনার রাজ্যে। লাভক্রাফটিয়ান হরর,অতিপ্রাকৃত,সাইকোলজিক্যাল,হরর,থ্রিলার কিংবা জীবনধর্মী জনরার ২১টি গল্পের এই হিজিবিজি রাজ্যে আমি হারিয়ে গেলাম। মুগ্ধ হলাম। হতাশ হলাম কেন এত দ্রুত শেষ হয়ে গেলো।
তবে প্রতিটা গল্পই যে সমানভাবে ভালো লেগেছে তা বললে মিথ্যা বলা হবে। কিছু গল্প বেশ দুর্বল মনে হয়েছে, আবার কিছু গল্প অসম্ভব ভালো লেগেছে। কিছু গল্প পড়ে মনে হয়েছে বাহ! কি দুর্দান্ত। আবার কিছু গল্পের শেষে মনে হয়েছে ধুর! এটা কিছু হইলো!
লেখকের সিগনেচার স্টাইল ছোট ছোট বাক্য সংবলিত লেখনী আমার কাছে খুব প্রিয়। এতে একটানা অনেক পড়া যায়, অল্প কথায় অনেক কিছু বুঝে ফেলা যায়। তবে এ ব্যাপারটাই আবার অনেকের কাছে বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। প্রথম প্রথম এরকম লেখনী নতুনত্ব লাগলেও একটানা অনেকগুলো গল্প পড়তে গেলে একঘেয়েমি পেয়ে বসতে পারে। আমার সাজেশন তাই একটা-দুটা করে গল্প পড়া।
ওয়াইন যেমন পানির মত ঢক ঢক করে না গিলে জিভে নিয়ে চেখে দেখতে হয় । উনার গল্পগুলোও তেমন। এগুলো মাথায় নিয়ে খেলা করার জিনিস।
সব মিলিয়ে এবারও লেখক আমার কাছ থেকে লেটার মার্ক্স ই পাবেন।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে সতীর্থ প্রকাশনী থেকে। এই বইটির আগে আমি আরেকটি প্রকাশনীর একটি বই পড়েছিলাম যা ছিল বানান ভুলে ভরা। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার পড়ার সময়। এই বইটিতে বানান ভুল একেবারেই চোখে পড়েনি । সতীর্থ প্রকাশনীকে তাই ধন্যবাদ এত চমৎকার কাজ দেখাবার জন্য। তবে বইটির প্রচ্ছদ আমার বেশি জুতের লাগেনি। হলুদের বদলে সাদা রং ব্যবহার করলে আরো ফুটে উঠত মনে হয়।
ভয় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। উচ্চ শব্দ এবং উচ্চতার ভয় নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহন করে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনায় মানুষের নতুন নতুন ভয়ের সৃষ্টি হয়। কেউ হয়তো অন্ধকারকে ভয় পায় আবার কেউ কোনো প্রাণীকে। তবে কেমন হয় যদি একজন মানুষ শূন্যতাকে ভয় পায়? রাফায়েতকে ছোটবেলায় তার মা রাগের বশে অন্ধকার ওয়াশরুমে আটকে রেখেছিল। সেই সময়ে রাফায়েত অনুভব করে অসীম শূন্যতাকে। সে এই ভয়কে ঠিক ভাষায় বর্ননা করতে পারে না। কারণ কোনো বস্তুর উপস্থিতি বর্ননা করা সহজ হলেও একেবারেই শূন্যতা শুধু অনুভব করা যায়। ছোটবেলায় পাওয়া শূন্যতার ভয় তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়।
গল্পকথক ও দিয়া ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছে। তাদের খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো সবই একসাথে। দিয়া ছিল মনোযোগী শ্রোতা। দিয়া কথকের পেছনেই সবসময় ঘুরঘুর করতো। মনের মধ্যে ছিল ভালো লাগা। কিন্তু কথক কখনো সেটা বুঝতে চায় নি বা বুঝতে পারে নি। সারাক্ষণ বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকতো। হতে চেয়েছিল কচ্ছপ কারণ কচ্ছপ দীর্ঘদিন বাঁচে। তাই সেও বেশি বই পড়ার সময় পাবে। দিয়াকেও জিজ্ঞাসা করেছিল সে কী হতে চায়? উত্তর দেয় নি দিয়া। লিখে রেখেছিল ডায়েরির পাতায়। তাতেই বা কী লাভ!
পরিবারের মধ্যে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের মস্তিষ্ক কোনো একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে শত কথাতেও তা পরিবর্তন করে না। পুষ্প'রা তিন ভাই বোন। চাকরিজীবী বাবা ও মা রোকসানা বেগমকে নিয়ে সংসার ভালোই চলছে। কিন্তু পুষ্পর কাছে মনে হয় সে পরিবারে অবহেলিত। কিন্তু সে কি আসলেই অবহেলিত? নাকি এসব স্বপ্নে দেখছে? অথবা স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন? বাস্তব অবাস্তব গুলিয়ে যায় পুষ্প'র কাছে।
মাঝেমধ্যেই অনলাইন জগতে অতীত বা ভবিষ্যত ভ্রমণের বিভিন্ন খবর পাওয়া যায়। অতীতের কোনো ব্যক্তির ছবিতে আধুনিক ব্যাপার স্যাপার মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। আবার পুরো বিমান কিংবা ট্রেনই হারিয়ে গিয়েছে যেগুলোর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। এই যানবাহন ফিরে আসার খবর মানুষকে চাঙ্গা করে তোলে। কেমন হয় যদি অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো মানুষের সাথে প্রেম হয়ে যায়? তাদের সেই প্রেমের পরিণতিই বা কীরকম হয়?
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হঠাৎ করে কেউ আপনাকে মেরে চলে গেল। আপনার পরিবার ত জানে আপনি কারো সাতে পাঁচে থাকেন না। অথচ আপনার লুকিয়ে রাখা জীবনের ইতিহাসটা আপনার সাথেই কবরে চলে যায়। যখন কেউ সেই সত্যকে খুঁজে বের করে আনে তখনই নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় অন্যদের।
ছাগল বলি দিতে গিয়ে মানুষ বলি হওয়ার জোগাড়! ভূতের ভয়টা যেন মানুষের স্বভাবজাত। আবার বাতাস লাগার গল্প বা বাস্তবতাকে হার মানিয়ে রবিউল হয়ে উঠে নতুন কেউ? তবু তার বন্ধু যেন সেই রহস্যকে সমাধান করতে চায়।
লা পেরেগ্রিনার নাম শুনেছেন? অদ্ভুত লাগবে লা পেরেগ্রিনার গল্পটি শুনলে। একজন মানুষ ম্যাপল পাতার রস খেয়ে সময় পরিভ্রমণ করে কারণ ভালোবাসা। ভালোবাসার গল্পে কতকিছুই না হয়! নাম গল্পে সুবর্ণ ও রাধিকার দেখা হয়েছিল মর্গে। সেই থেকে পরিচয় ও পরিণয়। সন্তানও হলো কিন্তু সেই সন্তান একদিন বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেল। সুবর্ণই নাকি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলেছে! একজন বাবা কীভাবে পারেন তার সন্তানকে এভাবে হত্যা করতে? নাকি এর পেছনে রয়েছে গূঢ় কোনো রহস্য!
একটি উপন্যাস পড়লে একই গল্পের ধারাবাহিকতার স্বাদ যেমন পাওয়া যায়, অন্যদিকে একটি গল্পগ্রন্থ পড়লে ভিন্ন গল্পে ভিন্ন স্বাদ। কোনো গল্প যদি হয় রোমান্টিক তো কোনোটি বিয়োগান্তক আবার অন্যটি হয় ভৌতিক। তরুণ লেখক সাখাওয়াত হোসেনের সুবর্ণ-রাধিকা মোট একুশটি গল্পের সংকলন। গল্পগুলোকে সাধারণ কোনো জনরায় ফেলা যায় না; কোনোটা লাভক্রাফটিয়ান হরর, কোনোটা অতিপ্রাকৃত, কোনোটা সাইকোলজিক্যাল বা থ্রিলার অথবা জীবনধর্মী।
লেখক নিজেকে পরীক্ষা করেছেন গল্পগুলো দিয়ে। বিভিন্ন জনরায় লিখে ভিন্নমাত্রার অবয়ব সৃষ্টি করেছেন। কিছু কিছু গল্পের প্লট নির্বাচন অনন্য ছিল। অন্তত মনে রাখার মতো কিছু গল্প লেখক আমাদের উপহার দিয়েছেন। তবে দেখা গেছে কয়েকটি গল্পের প্রবাহ একইরকম ছিল। আমি বলবো বইটির এক তৃতীয়াংশ গল্প অনেক ভালো। তাহলে বাকি গল্পগুলো? সেই গল্পগুলো সেরাদের ছায়ায় মিশে গিয়েছে। হ্যাপি রিডিং।
❝মনু মাষ্টারের ঘরের দুয়ারে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। বাতাসে দরজার কবাট বারি খাচ্ছে আলতা রাঙ্গানো পাদুটোয়। আঁচল লুটোপুটি খাচ্ছে মাটিতে। দরজার ফ্রেমে বেকে গেছে পাজর, ব্লাউজে মেখে গেছে ছোপ ছোপ লালচে-ধূসর রঙ, রক্তের। উঠোনে জমে গেছে উৎসুক জনতা, কারো চোখ বুকে কিংবা কারো চোখ পেটে, মিহির চেয়ে আছে চোখে কিংবা চোখে চোখ রেখে বহুদূরে।❞
পরের অংশটুকু না লিখবার জন্য মেরে বসতে পারেন হয়ত আমাকে! আগেই বলে রাখছি আমাকে মারবেন না, শুধু শুধু হাতে ব্যাথা পাবেন কিংবা মারার জন্য আমাকেই বা পাচ্ছেন কই!
উদ্ধৃতাংশটুকু লিখে ফেললাম শুধু মাত্র আপনাকে আটকে ফেলতে, নবীশের অনাড়ি চেষ্টামাত্র।
বইমেলায় প্রথম বই কেনা কিংবা পড়া যাই বলেন না কেন দুটোই সাখাওয়াত হোসেন এর লেখা সুবর্ণ রাধিকা বইটা দিয়ে শুরু।
ভদ্রলোক তার পাঠককে বঁড়শিতে চমৎকারভাবে গেথে ফেলতে জানেন, শুরু করলে আপনি শেষ পর্যন্ত যেতে বাধ্য। সুবর্ণ রাধিকা একটা গল্পগ্রন্থ, মনোজাগতিক বিষয়াদি নিয়ে ছেলেখেলা করবার কিছু গল্প, তা সে পাঠকেরই হোক কিংবা তার সৃষ্ট চরিত্রের।
শুরুর গল্পটা ❝আদিম❞, মানবমনের সর্বপ্রাচীন অনুভূতি ভয়/ভীতি নিয়ে ছেলেখেলা করবার গল্প। বর্ননার ধরন অদ্ভুত, লেখক বারবার গল্প থেকে বের হয়ে গেছেন। এই ধরুন গলা শুকিয়ে গেছে গল্প বলতে বলতে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুরু করেছেন। আপনি অবশ্য আটকে থাকবেন গল্পেই, আপনার পানি খাবার জো নেই মোটেও।
আরো দু তিনটে গল্প পেরিয়ে আপনি পড়বেন ❝অন্তরকলন❞। অভিধানে এরকম কোন শব্দ আছে বলে আমি জানি না যদিও, খুঁজেও দেখিনি। গল্পটা একটা যুবতীর, মিনি। একরাত্তিরে নিখোঁজ, ম্যানিয়াকের খপ্পরে ভয়াবহ একটা রাত, এবং নিশ্চুপ। আসলে গল্পটা জোনায়েদের, যে ঐ এক রাতেই আটকে আছে। অলিতে-গলিতে খুঁজে ফিরছে একটা মুখ ❝মিনি❞। মানুষ আসলে কিসে আটকায়? এই গল্পটা পড়ে মনে হবে মানুষের আসলে আটকাবার মতো কোন কারন লাগে না। একটা মুহূর্ত, একটা মুখ কিংবা একটা শব্দ প্রয়োজনের চেয়ে যথেষ্ট।
বইয়ের সেরা গল্পটা পাবেন ১২৭ পৃষ্ঠায়, ❝সেরা❞ অবশ্য আমার চোখে। হাওয়া, না সুমনের সিনেমা নয়, অবশ্য সিনেমার থেকে কোন অংশেই কম কিছু নয়। রবিউলের নিজ জগতে সেরা অভিনেতা কিংবা তার রিয়েলিজম বেছে নেবার গল্প। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই স্পয়লার হয়ে যাবে, সুতরাং মুখে গোজ আটলাম।
বইয়ের সবথেকে দুর্বল গল্পটাই ❝সুবর্ণ রাধিকা❞। কন্সেপ্ট এক্সিকিউশন পড়ে মাত্রই একটা ঝাকি খেলেও পরমুহূর্তেই মনে হবে এরকম হবার ছিলো না, অন্যকিছু হতে পারতো। এটা ঠিক ঠিক হলো না। টুকটাক লেখালিখির অভিজ্ঞতা থেকে যতটা জানি নিজের সবথেকে দুর্বল লেখাটাই কিভাবে যেন প্রিয় হয়ে যায়, লেখকের ও তাই হয়ে গেছে কি না কে জানে!
কয়েকটা গল্পের ক্রম পাল্টিয়ে দিলে বেশ ভালো হতো, মেইন কনসেপ্ট এর মিল/আংশিক মিলে যাওয়াটা চোখে লেগেছে। মাঝে অন্য গল্প ঢুকিয়ে দিলে মনোটোনাসভাবটা কমে যেতো।
সতীর্থ তার সিগনেচার হলুদ থেকে বের হয়ে অন্যান্য কালারে কভার করছে দেখে ভাল্লাগলো তবে এই কাভারটা আরো ভালো কিছু হতে পারতো। এটা একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। যদিও কন্টেন্ট ভালো হলে কভার সাদাকালো হলেও কিছু যায় আসে না। বানান ভুল চোখ পড়ে নি কিংবা বলা যায় গল্পে বুদ হয়ে সব ভুলে গেছিলাম।
কোনো গল্প সংকলন একটানা পড়ে যাওয়ার ফলাফল সচরাচর সুখকর হয় না। ভালো লাগার পরিবর্তে সেখানে বিরক্ত ভর করে। তার ওপর গল্পের শক্তিশালী লিখনশৈলী ছাড়া যখন দেখবেন প্লট বা কনসেপ্ট একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে লুপের মতো; অবশ্যই কিছু গল্প ব্যতীত—তখন অনুভূতি ভোঁতা হয়ে পড়ে। লেখক সাখাওয়াত হোসেন যে-কোনো ঘটনাকে কাহিনিতে রূপান্তর করে সেটা ক্লিফহ্যাঙ্গারে রাখতে ভালো পারেন। শুধু পারেন না, একেবারে জমিয়ে পারেন। তাঁর লেখায় সাহিত্যগুণের পাশাপাশি প্রাঞ্জল ভাষাশৈলী ঘোর সৃষ্টি করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। কিন্তু লেখক বোধ হয় নিজেও জানেন না, তিনি তার নিজের তৈরি করা জালে পাঠক ফাঁদ পাততে গিয়ে নিজেই ফেঁদে বসে থাকেন। কীভাবে?
আলোচনা শুরু করি—গল্প সাজানো নিয়ে। ‘আদিম’ গল্পটা এ সংকলনের নিঃসন্দেহে সেরা একটি গল্প। শুধু গল্প বিষয়টা এখানে হাইলাইট করা ভুল হবে। মানব মনের আদিম অনুভূতি নিয়ে এ গল্পের সূচনা। ‘ভয়’ বিষয়টাকে এক-এক মানুষ উপলব্ধি করে এক-একভাবে। লেখক এখানে হুমায়ূন আহমেদের মতোই ‘শূন্য’ কনসেপ্ট নিয়ে যে অসচারচর গল্প লিখেছেন—তা দুর্দান্ত। কিন্তু এর পরপরই ‘প্রসূন’ সেই মহাজাগতিক অনুভূতিকে কিছুটা ফিকে করে দেয় যখন লেখক পরাবাস্তব ঘটনা অথবা মানব মস্তিষ্কের রহস্যময় দিক নিয়ে আরও একটি গল্প ফাঁদেন। তৃতীয় গল্প ‘গ্রন্থন’ এখানে সঠিক প্লেসমেন্ট হতে পারত। গ্রন্থন গল্পের একটি লাইন বেশ আলোচিত—‘পরের জন্মে আমি একটা বই হবো।’ গ্রন্থন সেইসব পাঠিকা উদ্দেশ্য করে লেখা, যারা তাদের ব্যক্তিজীবনে বিশেষ কোনো মানুষ থেকে কেবল অবহেলায় পদদলিত হয়ে এসেছে বা আসছে। তারা ভীষণভাবে গল্পটির সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারবে।
সেই একই ধাঁচের অথবা কাছাকাছি গল্প ‘বৃশ্চিক-অপার্থিব-অন্তরকলন’ পরপর না রেখে এর মাঝামাঝিতে রাখা যেত ‘মোচক’ নামক গল্পটা। এ গল্পের বিশেষত্ব কিছুটা হলে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিবে কাফকার কালজয়ী সৃষ্টি ‘মেটামরফোসিস’-কে। আমি কোনো গল্প নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখছি না। ছোটো গল্প অনুধাবন করার বিষয়। এখানে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ—বিস্তারিত নয়। বিস্তারিত ভাবনা বা মতবাদ পাঠকভেদে আলাদা হয়ে থাকে। আমার যে গল্প ভালো লাগবে সেটা আপনাকে ভালো লাগা না-ও দিতে পারে।
‘আদিম’ গল্পের পর ‘মোচক’ গল্পটা আমার পছন্দের। ‘স্বভাব’ থিমটা এখানে কমন। মানুষের স্বভাব অদ্ভুতুড়ে ক্ষেত্রবিশেষে হয় বিক্ষিপ্ত। যা আমাদের বিস্মিত করে। কখন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মানব মন ও মননে তা পূর্ব নির্ধারিত হয়ে কখনও থাকে না। যাহোক, সূচিপত্র অনুযায়ী এর মাঝামাঝি একটা গল্প দারুণ রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে মনে। নাম—‘বিভাস’। একটি ট্রেন জার্নির গল্প। তবে নিছক গল্প ভেবে থাকলে ভুল করবেন। সময়ের এক গভীর আর রহস্যময় মারপ্যাঁচ এখানে লুকায়িত। এ গল্পটা উক্ত সংকলনের আমার বিশেষ পছন্দ।
লেখক আরেকটা অকাম ঘটিয়েছেন ‘শালুক-পারাবার-অংশন’ তিনটি গল্প পরপর দিয়ে। এর পরপর ‘মোচক-মন্দির-ঘুম-হাওয়া-লা পেরেগ্রিনা-অন্বয়’ গল্পগুলো রেখে আরেকটি ঝামেলা পাকিয়েছেন। প্রথম মোচক থেকে অন্বয়—এ গল্পগুলো ভালো। থিমের ভিন্নতা আছে, লেখক ভাবনার কারিশমার আরও কিছু উদাহরণ গল্পগুলোর পরতে পরতে জমে আছে। কিন্তু এ গল্পগুলো যদি শালুক থেকে অংশন-এর ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত—তবে বিরক্ত সৃষ্টি হতো না। এখানে একাধারে ভালো ও তুলনামূলক ভালো গল্পগুলো একই সারি বা সূচিতে পরপর রাখাটা উচিত কার্য হয়নি। এ ব্যাপারে আরেকটু ভাবনা-চিন্তা করা যেত।
নতুন কোনো পাঠক যদি ‘সুবর্ণ-রাধিকা’ সংকলনটি কিনবেন বলে মনস্থির করেন—তবে তারা ‘মোচক থেকে অন্বয়’ অর্থাৎ ১১০ পৃষ্টা থেকে ১৫৯ পৃষ্টা কখনোই টানা পড়বেন না। এতে গল্পের রস আস্বাদন করার চেয়ে উলটো ক্লান্তি ভর করবে। অন্যান্য গল্পের পরপর গল্পগুলো পড়লে ভালো। আর প্রতিদিন ২-৩টির বেশি গল্প একই সংকলন থেকে না পড়ার পরামর্শ দিব। একটানা পড়লে পাঠক মস্তিষ্কে গল্প-লেখা-লেখক নিয়ে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল কনফ্লিক্ট তৈরি হয়। তুলনামূলক কম ভালো একটা গল্প শেষ করে যখন সত্যিকার অর্থে একটা ভালো থিম, শক্তিশালী প্লটের গল্প পড়তে যাবেন—ঝামেলা সেখানে তৈরি হয়। এজন্য প্রায় মাসখানেক পরে এ বইটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখতে হচ্ছে।
যাহোক, অনেক জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা লিখলাম। মোচক নিয়ে ইতোমধ্যে বলেছি, ‘মন্দির’ গল্পটির থিম খুবই কমন। তবে এর শেষটার প্রশংসা করতেই হয়। রয়েছে অতিপ্রাকৃতের ছাপ। ‘ঘুম’ একটি কোমল মনের বেদনাদায়ক গল্প। এর সমাপ্তি হয়তো আপনার মন খারাপের কারণ হবে। যদি সত্যিকার আবেগ আপনার অন্তরে নিহিত থেকে থাকে তবেই। ‘হাওয়া’ গল্পেও পরাবাস্তবতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষাপটটা লেখক বেশ যত্ন নিয়ে তৈরি করেছেন। উক্ত সংকলনের আমার আরও একটি পছন্দনীয় গল্প এটি। ‘লা পেরেগ্রিনা’ গল্পটি কখনোই এত ছোটো আকার ডিজার্ভ করে না। সত্যি বলতে এটি নিয়ে লেখক পুরোপুরি একটি উপন্যাস লিখতে পারেন। এর হিস্টোরিক্যাল কানেকশন বেশ স্ট্রং। ‘অন্বয়’ গল্পটি লেখক এমনভাবে লিখেছেন যে, গাদা গাদা উপন্যাস লিখে বেস্টসেলার হওয়া অনেক বংদেশিয় লেখকের কমন পাঁচটা উপন্যাসকে হার মানাতে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। ‘অর্বুদ’ গল্পটা এ সংকলনের অন্যতম মেটাফরিক অ্যাখান। ভাবনার অনেক সুতো এ গল্পের ভাজে ভাজে লুকানো। পাঠকদের কেবল সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
একটি সংকলনের একুশটি গল্প নিয়ে বিশ্লেষণাত্বক প্রতিক্রিয়া দেওয়া সম্ভব নয়। সময়সাপেক্ষ কাজ। তার ওপর সব গল্প নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। বাছাই করা সেরা কিছু কাজ নিয়ে কথা বলতেই বরং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তা-ই করলাম এতক্ষণ। ‘সুবর্ণ-রাধিকা’ গল্পটি সংকলনের শেষ গল্প, গল্পটি মনস্তাত্ত্বিক। এটিকে সম্ভবত আমি ভালো-খারাপের একটি মাঝামাঝি অবস্থায় রাখব। এমনতর গল্প এর পূর্বে বেশ পড়া হয়েছে তাই হয়তো। তবে সংকলনের নামের ক্ষেত্রে ‘সুবর্ণ-রাধিকা’ পারফেক্ট চয়েস। এখানে লেখক লিঙ্গের ভেদাভেদ করেননি। অবশ্য করার মতো তেমন কোনো গল্পের নাম মনোযোগ কাড়তে ব্যর্থ হতো এক ‘লা পেরেগ্রিনা’ ছাড়া। তাই নামকরণে লেখক হয়তো পাঠকের চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
লেখকের ‘মৃগয়া’ পড়েছি এর পূর্বে। সুন্দর, মায়াময় দুনিয়া গড়েছেন সেখানে। সংকলনেও এর কিছুটা প্রভাব রয়েছে। লেখকের লেখা শীতের সকালের নরম রোদের মতো। ওটা অল্প অল্প করে উপভোগ করা ভালো। যদি এর অভ্যাস একবার পেয়ে বসে তবে গ্রীষ্মের ছাতি ফাটা রোদ আপনাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে বেশি সময় নিবে না। সম্ভবত এ বছর লেখকের আর কোনো লেখা পড়ব না। সামনে এলেও, এড়িয়ে চলব। আগামী বছর আবারও পড়ব। একটানা এসব লেখা মস্তিষ্কে ভিন্ন প্রভাব ফেলে। এমন প্রভাবনীয় ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। তা-ই সাখাওয়াত হোসেন অন্যান্য লেখকদের থেকে কিছুটা আলাদা।
মানব মনের লুকানো অনুভূতিকে জড়ো করে কোনো লেখক যখন একটি লেখা লিখেন, সেটা পাঠক মনকে যারপরনাই উজ্জীবিত করে। ‘সুবর্ণ-রাধিকা’র গল্পগুলো তেমনই। ২১টি গল্প যদি ২১ দিনে পড়তে পারেন, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। অথবা সময় নিয়ে আরও কয়েক মাস পড়া চালিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া লেখককে আমি সেটাই বলতে চাইব, যেটা আমি হুমায়ূন আহমেদ-এর ক্ষেত্রে সবসময় বলি।
‘লেখক, আপনার সাহিত্যকে দেওয়ার এখনও বহু কিছু রয়েছে। তবে আপনি নিজেকে এক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। আপনার ছোটো গল্প বাদ দিয়ে, উপন্যাসিকা বা উপন্যাস লেখা উচিত। ফ্যান্টাসি লিখছেন ভালো, তবে সেখানে মিথলজিক্যাল ব্লেন্ডিং ব্যতীত হিস্টোরিক্যাল প্রেক্ষাপট যুক্ত যদি করতে পারেন তবে আরও ভালো। তবে আপনার ‘হাওয়া’ গল্পটা পড়ে মনে হলো, আপনার খুব সময় নিয়ে একটা জাদুবাস্তবতার গল্প লেখা উচিত। অবশ্যই সেখানে মানব মনের লুকানো মনস্তত্ত্ব থাকবে সর্বাধিক। পরাবাস্তবতাও যে একেবারে থাকবে না তা নয়। এটা আপনি বেশ ভালো লিখতে পারেন। আর দর্শন—ওটা তো পিপে ভরতি মদের মতো টলটল করবে। আমার বিশ্বাস, সেই কাজটা আপনার লেখা শত শত কিংবা অন্যান্য কাজ থেকে শ্রেষ্ট ��য়ে থাকবে। আপনার ভেতর সেই ক্ষমতা আছে, দয়া করে সেটা নষ্ট করবেন না। আর হ্যাঁ, আপনার লেখায় হুমায়ূনী ভাব প্রকট। যদি সম্ভব হয়, এদিকটা ভাঙার চেষ্টা করবেন। একটু আক্তারুজ্জামান, একটু শহীদুল জহির, একটু মানিক কিংবা একটু ওয়ালীউল্লাহ যদি আপনার লেখায় ধার করতে পারেন, তবে এখানে অনবদ্যতার এক আসর জমে যাবে। বাংলা সাহিত্যের এক নতুন ধারা রচিত হবে। ধন্যবাদ।’
আমার ভায়োলেন্স একদমই সহ্য হয় না। তাই খুন খারাবির কাহিনি আমি পড়ি না। কোনো অ্যাকশন মুভি দেখি না। তাও কিছু কিছু বই মাঝে মধ্যে পড়া হয়। কদিন আগে অন্বয় আকিবের "দ্যা মোস্ট ডেনজারাস গেইম" পড়লাম, সিরিয়াল কিলারদের জীবনী। আর আজ সুবর্ণ রাধিকা পড়ে শেষ করলাম। এর একেকটা গল্পের একেকজন চরিত্রের ক্রিমিনাল মাইন্ডের তুলনায় বাস্তবের কিলারগুলো দুগ্ধপোষ্য শিশু। জীবনে তিন লেখা পড়ে আমার সারাদিন বমি বমি লাগছে (রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি,ছেলেমানুষী আর সুবর্ণ রাধিকার প্রতিটা গল্প)
লেখকের কল্পনাশক্তির তারিফ করতে হয়। সবমিলিয়ে ভয়ংকর সুন্দর একটা বই।
২১ টা গল্পের এই বইটা ছিলো অসাধারণ। অনেক সময় নিয়ে বইটা পড়েছি, প্রতিদিন একটার বেশি গল্প পড়িনি। খুব ভালো লেগেছে বইটা। এই বইয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পটা হলো, "গ্রন্থন"। গল্পটার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। লেখকের 'মৃগয়া' বইটাও খুব দ্রুত সংগ্রহ করে পড়ে ফেলবো। লেখকের জন্য শুভকামনা। 💖