খোঁজা থামিয়ে দিলেই পাবার আশা নিঃশেষ হয়ে যায়। নর্মদার সামনে বসে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য হয় রুদ্রদেব আর অসিত। সমুদ্র সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। এখানে গুরু শিষ্যের বিষয় খাটবে না, দুজনেই নবিশ। তবু অসিতকে এগিয়ে যেতেই হবে। অঙ্গদকে উদ্ধার না করে সে ফিরে যাবে না। রুদ্রদেবও শিষ্যকে ত্যাগ করতে পারে না। শিক্ষা শেষ হবার আগে কোন গুরুই শিষ্যকে ত্যাগ করে না।
ওদিকে রাহু অঙ্গদকে নিয়ে জাহাজে চেপে বসেছে। পশ্চিমে নিজের পরিচিত বন্দরের অভাব নেই। সেগুলোর একটাতে থিতু হয়ে বসেই অঙ্গদকে নিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিকল্পনা করে চলেছে সে। কিন্তু বিধির চিন্তা হয়তো অন্যরকম। রাহুর মতো লোকের তো আর পৃথিবীতে অভাব নেই। চলার পথে রাহু বুঝতে পারে, অঙ্গদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে লোকে। কেউ কেউ তো অঙ্গদকে পাবার জন্য তার প্রাণ নিতেও পেছপা হবে না।
রোমান সাম্রাজ্যের দখলে আছে পুরো গ্রীস আর ভূমধ্যসাগরের চারিদিকের অঞ্চল। রোমান সম্রাট ট্রাজানের শাসনে সাম্রাজ্যের কোথাও কোন সমস্যা মাথাচাড়া দিতে পারছে না। তবে পরাধীন গ্রীসের বাতাসে মাঝে মাঝে শোনা যায় স্বাধীনতার কানাকানি। আলেকজান্ডারের উত্তরসূরিরা নিজেদের এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। নিজেদের সিংহসম সাহস মাঝে মাঝে জেগে উঠতে চায়। বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা দেয় স্পার্টার আকাশে বাতাসে।
ইভানের স্বাধীনতা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। গ্রীসের অভিজাত সেনাদলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে অভিজাত সুবিধা নিয়ে জীবন কাটাতে পারলেই হলো। সেই লক্ষ্যেই স্পার্টার সেরা যোদ্ধা হবার পথে এগিয়ে চলেছে সে। কিন্তু হঠাৎ করে বদলে যায় তার জীবন। প্রেম জোয়ার বইয়ে দেয় তার জীবন নদীতে। আর, প্রেম কখনোই কাউকে অবিকৃত রাখে না। স্পার্টার দুর্গম পাহাড়ে জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে এক অমোঘ শক্তি। টিয়ার অব এপোলোর অপেক্ষায় কাল কেটে যাচ্ছে তার। সে কি জেগে উঠবে গ্রীসের স্বাধীনতার ভাগ্যবিধাতা হয়ে?
আপাত সম্পর্কহীন ঘটনাগুলো শেষে মিলে গেলো একই বিন্দুতে। মহাকালের পথে শুরু হলো এক রোমাঞ্চকর মহাযাত্রা।
৭৫২ পৃষ্ঠার মহাযাত্রার জন্য ৭৫২ শব্দের পাঠপ্রতিক্রিয়া। এটাকে এক ধরনের ট্রিবিউট বলা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে সিম্বলিক বিষয়টা আমার ভাল্লাগে। মহাকালে কিছুটা বিস্তারিত লিখেছিলাম, শব্দসংকটে এখানে মাধুরি মিশিয়ে এতকিছু লেখার সুযোগ হবে না, লিখতেও চাইনি। সুতরাং সংক্ষেপে:
° মহাকালে যেই রাজনীতি ও কূটনীতির জাল জটিলভাবে বিছিয়েছিলেন লেখক, সেটা নিয়ে এসেছেন মহাযাত্রায়ও, অন্যভাবে। মানুষে মানুষে কূটবুদ্ধির লড়াইয়ের থেকে এখানে লড়াইয়ে নামানোর চেষ্টা করেছেন দৈব শক্তিকে।
° অসিতের প্রাণাধিক প্রিয়, রঙিন বানর অঙ্গদকে নিয়ে জোচ্চোর রাহু রওনা দিয়েছে অজানা পথে। খোঁজা থামিয়ে দিলেই পাবার আশা নিঃশেষ হয়ে যায়, অসিত তাই অঙ্গদকে খুঁজবে পাতাল পর্যন্ত। নিজের প্রতিজ্ঞা বজায় রেখে তাকে সঙ্গ দেয় রুদ্রদেব৷ শিক্ষা শেষ হবার আগে গুরু কখনোই শিষ্যকে ত্যাগ করতে পারেন না। রাহুর পিছু পিছু অজানা পথে তাদের সঙ্গী হয় রহস্যমানব শেইরন।
° মহাকালের বুদ্ধির লড়াই, রাজনীতি আর কূটনীতি এখানে অনেকটাই অনুপস্থিত। ৬০৮ পৃষ্ঠার বিশালায়তন মহাকালে এই লড়াই আর বেদের বাণী একটা মুহুর্তের জন্যও বিরক্তি আনেনি।
মহাযাত্রায় এসব কিছুটা অনুপস্থিত, উপরন্ত দিবাকর দাস উপস্থাপন করেছেন গ্রেকো-রোমান যৌনজীবন। শুরুর দিকে এসব পড়ে খানিকটা বিরক্তি এসেছিল। যৌনতা মানবজীবনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, তা গ্রীসে হোক আর ভারতবর্ষে হোক, সোমবারে হোক আর মঙ্গলবারে হোক। মহাকালে ভারতবর্ষের রাজপুরুষদের যৌনজীবনের আলোকপাত অন্ধকারে ছিল। গ্রেকো-রোমান সমাজের যৌনতা দিয়েই শুরুর মহাযাত্রার প্রথম যাত্রা।
মহাকালের মতো মহাযাত্রাও একটা মাল্টি-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং উপন্যাস। রোমান সম্রাট ট্রাজানের গ্রীস শাসন নীতি, গ্রীসের অভিজাতদের রোমান শৃঙ্খল থেকে বের হবার বাসনা, গ্রীসের অভিজাত সেনাদলের দুই সদস্যের প্রেম উপাখ্যান; এসব একেকটা সাবপ্লটের মতো হাজির হচ্ছিলো একেকবার। পড়তে খারাপ লাগেনি, শুরুর বিরক্তি কাটিয়ে উঠতেও সময় লাগেনি।
আরেকটা বিস্তারিত প্লটে দেখা যায় রুদ্রদেব-অসিত জুটির সাগরযাত্রা। নিয়তি তাদেরকে হাজির করে সাগরের বুকে। যাত্রাপথে তাদের সাথে পরিচয় ঘটে রহস্যমানব শেইরনের। জাহাজের নাবিক-খালাসিদের চোখ এড়িয়ে চলতে থাকে অসিতের অস্ত্রশিক্ষা। সাগরের বুকেই একসময় দেখা পাওয়া যায় রুদ্রদেবের দিব্যাস্ত্রের।
একদিকে রুদ্রদেব খুজে পায় তার অমূল্য রত্ন, অপরদিকে স্বাধীনতার বাসনায় মত্ত গ্রীসের অভিজাত শ্রেণী খুজে বেড়ায় টিয়ার অব অ্যাপেলো, যেটা ছাড়া জাগিয়ে তোলা যাবে না যুদ্ধদেবতা অ্যারিসকে, যিনি না থাকলে গ্রীসের স্বাধীনতা অর্জিত হবে না বলে ভ্রমে আছেন মহা অভিজাত অ্যালেস্টর।
এদিকে রোমান সম্রাট ট্রাজানের গ্রীস শাসন নীতি চতুর। গ্রীসের নগর রাষ্ট্রগুলোকে তিনি ঘোষণা করেছেন ফ্রি টাউন। শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকেও যাতে তাদের পরাধীন মনে না হয়।
গ্রীসের মহাঅভিজাত অ্যালেস্টর এই ঠুনকো স্বাধীনতায় সন্তুষ্ট নন। গ্রীসের অন্যান্য অভিজাতদেরকে নিয়ে তাই একটা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন তিনি। তার জন্য দরকার দৈবশক্তি।
এই বিপ্লবের প্রস্তুতির মাঝেই দেখা যায় ক্রিপ্টএয়ারের দুই যোদ্ধার উপস্থিতি, ইভান ও অরিয়িন। ইভান-ইনোন জুটির প্রেমউপ্যাখান খুব একটা উপভোগ করতে পারিনি।
রুদ্রদেব গ্রীসের মাটিতে পা রাখতেই জেগে ওঠেন দেব অ্যারিস! এই রহস্য জানতে মহাযাত্রা পড়ার বিকল্প নেই।
সংক্ষিপ্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া:
এত বিশাল কলেবরের প্লট সাজানোয় মহাকালের মতোই মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন লেখক। অত্যন্ত ওয়েল বিল্ড মাল্টিলিয়ার একটা স্টোরিটেলিং। ৭৫২ পৃষ্ঠার জায়ান্ট পড়তে কিছু জায়গায় বিরক্তি আসলেও ওসব আমলে না নিলেও চলে।
চরিত্রায়নে ঘাটতি না থাকলেও সবগুলো চরিত্র আসলে ভালো লাগেনি৷ হয়তো পরিস্থিতি অনুযায়ী চরিত্রগুলো দাঁড়িয়ে যায়, হয়তো গ্রেকো-রোমান কৃষ্টি রিলেট করতে পারি না বলে চরিত্রগুলো মস্তিষ্কে প্রভাববিস্তার করতে পারেনি। রুদ্রদেব এবং অসিত আগের বইটার মতো এখানেও নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
মহাকালে মানুষের সাথে লড়াই বলে, দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান নেই এমন কারো উপরে দিব্য অস্ত্র প্রয়োগ করা যাবে না শর্ত থাকায় রুদ্রদেবের দৈবিক অস্ত্রাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়নি।
মহাযাত্রায় এই শর্ত না থাকায় মায়াযুদ্ধের অবতারণা করেছেন লেখক। প্রতাপশালী গ্রীক যুদ্ধদেবতা অ্যারিস বনাম ১৮ কলা, ৬৪ বিদ্যার মহারথী রুদ্রদেব। ক্ষণে ক্ষণে ঝলকে ওঠে তাদের মায়া অস্ত্র। অ্যারিসের প্রয়োগ করা দৈবিক অস্ত্রগুলোর জবাবে রুদ্রদেব নিক্ষেপ করে তার দিব্যাস্ত্র। সাদা চোখে গ্রীক দেবতা আর ভারতীয় মহারথীর অস্ত্রের পার্থক্য থাকলেও তাদের শক্তি, প্রভাব এবং ঠেকানোর কৌশলগত পার্থক্য একই। কারণ এসব অস্ত্র শক্তি সংগ্রহ করে প্রকৃতি থেকেই। পঞ্চভূত। গুরুর সমতুল্য না হলেও অসিতও কম যায় না। গ্রীসের রণক্ষেত্রে অসিতও প্রদর্শন করে তার নিপুন সমরবিদ্যা।
মহাকালের মতো বিস্তৃত না হলেও এই খন্ডেও লেখক রাজনৈতিক এবং দার্শনিক আলাপ সুনিপুনভাবে পরিবেশন করেছেন৷
অঙ্গদকে খুজতে যাওয়া সমুদ্রযাত্রার অংশটুকুতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মানুষ, খাবার, বস্ত্র তথা তাদের রঙিন সংস্কৃতির উপস্থিতি পাওয়া যায়।
তবে সমুদ্রযাত্রার অংশটুকু একটু বিস্তারিত হয়ে গেছে। কিছু জায়গায় মনে হচ্ছিলো যাত্রাপথ আরেকটু সংক্ষিপ্ত হলে দ্রুত আগাত বইটা।
বইটা মহাকালের তুলনায় স্লোবার্ন হলেও পড়ে শেষ করেছি তিনদিন। জুলাই বিপ্লব চলাকালীন ইন্টারনেট বন্ধ হবার সময়টার শেষ তিনদিন শুধু মহাযাত্রাই পড়েছি। প্রথম দু'দিনে চারশ পৃষ্ঠা, শেষদিনে বাকিটা। এবং মহাকালের স্বাদ অনেকটাই পেয়েছি দিবাকর দাসের গদ্যশৈলীতে।
মহাকালের মতো এখানেও যুদ্ধের কিছু অংশ রয়েছে। অ্যারিসের সাথে প্রথমযুদ্ধে রোমান সম্রাট ট্রাজান স্রেফ খড়কুটোর মতো উড়ে গেলেও তিনি যেভাবে চাতুর্যের সাথে অ্যারিসের সাথে সন্ধি করে নিজের সাম্রাজ্য এবং প্রাণের অখন্ডতা রক্ষা করেন--এটা ফিরিয়ে নিয়ে যায় মহাকালের রাজনীতিতে। যুদ্ধে দৈব প্রমীলা সেনাবাহিনী অ্যামাজনদের উপস্থিতি চমকপ্রদ। অসিত, ইথান, অরিয়নদের যুদ্ধকৌশল মুগ্ধ করবার মতো। মহাকালে দেখা গেছে ভারতীয় রণকৌশল, গ্রীসও যে খুব একটা পিছিয়ে নেই তার প্রমাণ দিয়েছে ইভান আর অরিয়ন।
প্রকাশিত হবার সময়ে মহাকাল ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বড় মৌলিক থ্রিলার। মহাযাত্রাও তাই। দিবাকর দাস ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকেই। মহা ট্রিলজির তৃতীয় খন্ড আটশ পৃষ্ঠার সর্ববৃহৎ মৌলিক থ্রিলার; এখনতক! মহাপ্রস্থান পড়া হয়নি এখনো, পড়বো। শুরুর কিছু পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়েছি বটে, তাতে করে বুঝলাম সুবিশাল কলেবরের এই উপাখ্যানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই সুরে মালা গেথেছেন দিবাকর দাস। এ এক কৃতিত্ব বটে!
মহাকাল পড়বার পর সত্যিকার অর্থেই পাহাড়সম উচ্চাশা নিয়ে এটা পড়া শুরু। পুরোটা না পারলেও অনেকটা আশাপূরণ হয়েছে। আসলে এতো বড়ো কলেবরের গল্প সাজানো চাট্টিখানি কথা না। আগের খন্ডের বারিগজার কথা, সাতকর্নীর কথা, ভারতবর্ষের কথা এখানে পাওয়া যায় নি, এখানে চরিত্রগুলো ভাগ্যের টানে ধাবিত হয় নব্য প্রাচীন গ্রিসের পথে। অসিত আর রুদ্রদেব যায় অসিতের রঙিন বানরের খোঁজে। পথে নানা বিপদ। গ্রীক নগর রাষ্ট্র ���খন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। ভেতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, এরই মাঝে হতভাগা ইভান আর ইনোনের প্রেম, মাঝ দিকে যুদ্ধের দেবতা এরিসের আগমন (প্রথমে এই অংশটা গাঁজাখুরি লাগছে, তবে ঘটনা আগাতে আগাতে মিশে গেছে সে, চুল কাটার সময় নাপিত যেমন গ্র্যাজুয়ালি মিশিয়ে দেয়, ওরকম করে) , বারো অলিম্পিয়ান দের শ্রেষ্ঠত্ব দাবিতে তার যুদ্ধ ঘোষণা। (মহাভারতের পর এখানেই প্রথম মায়া যুদ্ধের বর্ণনা পড়লাম, সুন্দর গুছিয়ে লেখা) একদম শেষ অংশে গিয়ে রুদ্রদেব এর প্রকৃত পরিচয় রহস্য উন্মোচনটা ব্রিলিয়ান্ট ছিল।
মহাকাল যে বিন্দুতে মিলিত হয়েছে, ঠিক সেই বিন্দু থেকেই মহাযাত্রার সূচনা!
আর্যবতের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কেউ কেউ তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করেছে। কারও কাছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অধরাই থেকে গিয়েছে। রুদ্রদেব তার লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পেলেও অসিত পায়নি। যুদ্ধ বিগ্রহের সুযোগে তার বানর অঙ্গদকে নিয়ে রাহু সমুদ্রের পথে অনির্দিষ্ট যাত্রা শুরু করেছে। সে যাত্রা কোথায় নিয়ে যাবে কেউ জানে না। কিন্তু অসিতের যে অঙ্গদ চাই। সে লক্ষ্যেই তো বাসা থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু তীরে এসে তরী ডোবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অসিত কিছু বুঝে না, তার অঙ্গদকে চাই। ফলে গুরু রুদ্রদেবকে নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে অনিশ্চয়তার পথে ভেসে গেল দুইজন। আর্যবতের বাইরে না যাওয়া দুইজন জাহাজের মাস্তুলে নতুন করে প্রকৃতি চিনছে। তারা জানে না তারা কোথায় গিয়ে থামবে। এ অনন্তের পথে যাত্রা তাদেরকে নিয়ে যাবে মহাকালের অন্যপ্রান্তে। যে প্রান্তে নতুন ইতিহাস অপেক্ষা করছে দু’জনের জন্য।
যে কারণে রাহুর এ ছুটে যাওয়া সেই বিচিত্র বানর সকলের আগ্রহের কারণ। সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে কে-ইবা ছাড়তে চায়? রাহু যেমন ছাড়েনি, তেমনি যে বুঝবে অঙ্গদের সম্ভাবনা, সে-ও ছাড় দিবে না। তাই পথে অনেক বাঁধা। মৃত্যুর মতন পরিস্থিতি তৈরি হয়। ছলনার আশ্রয় নেয় কেউ কেউ। তবুও সকল বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে, কিছুটা ভাগ্যের সাহায্যে রাহু তাই পৃথিবীর অন্য প্রান্তের সন্ধান পায়। যেখানে অঙ্গদকে দিয়ে দিতে পারলে নতুন জীবনের সম্ভাবনা। কিংবা নিজের পাপের ফল অপেক্ষা করছে সেখানে।
পরাধীনতা যেকোনো দেশ বা জাতির জন্য অসম্মানের। যে গ্রীক বীরের জাত, আজ তাদের অন্যের গোলামি করতে হয়। রোমান সাম্রাজ্যের ছায়াতলে নিজেদের সত্তা বিলীন হয়ে যায়। তবুও পরাধীনতা মেনে নেওয়া যায় না। স্বাধীন হতে চাওয়া জাতি তাই বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের ফল হতে পারে সুফল, কিংবা কুফল। রাজনীতির ছলচাতুরিতে তাই কতটা সফলতা আসনে, সেটা সময়ই বলে দিবে।
ইভান ও ওরিয়ন ক্রিপ্টেয়ারের সদস্য। গ্রীকদের দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের এক দল। গোপনে ও কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে দলের সদস্যরা হয়ে উঠে গ্রীক সমাজের অভিজাত। সেরাদের সেরা দেওয়া হয় মহা অভিজাতের পদ। এমন এক দলের সদস্যদের মানসিকতা হতে হয় ইস্পাতের মতো কঠিন। কিন্তু ইভান যেন অন্য ধাতুতে গড়া। প্রেম মানুষের মনকে দুর্বল করে দেয়। ইনোনের প্রেমে মশগুল ইভান তাই মানবিকতার খাতিরে একটি ভুল করে ফেলে। যেখানে তার হওয়ার কথা ছিল মহা অভিজাত, সেখানে এখন তৃতীয় শ্রেণীর অভিজাত। ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে আরো ভুল দিয়ে। যার ফলশ্রুতিতে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া উপায় নেই। ধরা পড়লে গর্দান যাবে। একদিকে প্রেম, আরেকদিকে জীবন — দোটানায় থাকা ইভান কোন পথে যাবে?
প্রতিটি সমাজে নিচু শ্রেণীর জাত, দাসদের জাতের জীবনের কোনো মূল্য নেই। তারা সমাজে অপাংক্তেয়। প্রশিক্ষণের নামে নির্বিচারে তাদের নিধন চলে। মনিবের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে যেতে হয়। গ্রীক সমাজে তাদের হেলট বলে অভিহিত করা হয়। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে বিদ্রোহী রূপে আবির্ভূত হয়। কিন্তু অভিজাত যোদ্ধাদের সাথে সামান্য হেলটরূপী অনভিজ্ঞ দাসেরা কতটুকু কী করতে পারে? জঙ্গলের ছায়াতলে ডাকাতি করা আর বিদ্রোহী হয়ে আক্রমণ শানানো যে এক বিষয় না। সাহস আছে ওদের, কিন্তু এই সাহস ধরে রেখে লড়াই করার দুঃসাহস থাকব কি? সমাজ প্রতিটা মানুষের জন্য শ্রেণীবৈষম্য আপনাআপনি তৈরি করেছে। স্বাধীনতা চাওয়া, আরামে থাকতে চাওয়া দোষের কিছু না। কিন্তু নিজেদের শ্রেণীর বাইরে গিয়ে উচ্চস্থানে আসীন হতে গেলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়।
সে অনেককাল আগের কথা। এক পাপের ফল হিসেবে তাকে হয়ে যেতে হয়েছিল পাথরের মূর্তি। ‘টিয়ার অব অ্যাপোলো’ যখনই এই সম্রাজ্যে আবির্ভূত হবে, ঠিক তখনই তার শরীরে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হবে। সময় আগত। ‘টিয়ার অব অ্যাপোলো’ এই গ্রীক সম্রাজ্যে এসেছে। তাই জাগ্রত হয়ে উঠেছে গ্রীকদের যুদ্ধের দেবতা এরিস। যার লক্ষ্য আবারও অলিম্পাসে যাওয়া। যেখানে সে-ই হবে একচ্ছত্র অধিপতি। কিন্তু হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এই পৃথিবীর মানচিত্র যেমন বদলে গিয়েছে, মানুষের স্বভাবেও পরিবর্তন এসেছে। এখন আর কেউ দেবতায় ভক্তি করে না। আর ভক্তি ছাড়া অলিম্পাসে যাওয়া অসম্ভব। গ্রীকদের আগে স্বাধীন হতে হবে। আর সেই জন্য করতে হবে যুদ্ধ। স্পার্টানদের সাথে নিয়ে, নিজ বাহিনী আমাজনকে এক করে যুদ্ধ যাত্রা করল এরিস। এই যুদ্ধের ফল কিরূপ হবে? মুখোমুখি রুদ্রদেব ও এরিস। শক্তিমত্তায় গ্রীক দেবতা না-কি ভারতীয় পুরাণের দিব্যাস্ত্র? এমন এক লড়াই, যা কেউ দেখেনি আগে! বিজয়ের আগে তাই বিজয়ীর নাম লেখা অনর্থক…
◾পাঠ প্রতিক্রিয়া :
“মহাকাল ট্রিলজি”র প্রথম বই “মহাকাল” যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়েছে “মহাযাত্রা”। এই বইটি প্রথম বইটার তুলনায় ভিন্ন। কারণ প্রথম বই আর্যবত তথা ভারতবর্ষের ঘটনাপ্রবাহ থাকলেও “মহাযাত্রা” এবার অন্য পৃথিবী ঘুরিয়ে এনেছে। আর্যবত থেকে শুরু করে মিশর, আলেকজান্দ্রিয়া, রোমান সাম্রাজ্যে, গ্রীকদের বীরের নগরী স্পার্টা। কলেবরের এই বিস্তৃতি বেশ ভালো লেগেছে।
মহাকালের থেকে মহাযাত্রার পার্থক্য এর বিস্তৃতিতে। মহাকালের গল্পটা লেখা হয়েছিল আর্যবতকে উপজীব্য করে। সেই আর্যবতকে ছড়িয়ে যাওয়ার গল্পই যেন মহাযাত্রা। অসিত, রুদ্রদেব ও সর্বোপরি রাহু এই দুই পৃথিবীকে যুক্ত করেছিল। যেহেতু কাহিনি গ্রীক পর্যন্ত ছড়িয়েছে, সেহেতু এর ব্যাপকতা বিশাল। আরো স্পষ্ট করে বললে গ্রীক দেশের কেবল স্পার্টা সম্পর্কে লেখক আলোকপাত করেছেন।
স্পার্টার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ছলচাতুরি, কৌশল, বিধি নিষেধ এখানে আলোচ্য বিষয়। আর্যবত থেকে স্পার্টা পর্যন্ত পৌঁছুতে হলে জাহাজ ছাড়া বিকল্প নেই। সমুদ্রের উন্মত্ত হয়ে যাওয়া, বিপদসংকুল পথ, মাঝ সমুদ্রে ঝড়ের সাথে লড়াইয়ে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এখানে ফুটে ওঠেছে। এই পথে রোমানদের বিশাল সাম্রাজ্য যেন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাছে। যা ছড়িয়েছে মিশর পর্যন্ত। এখানে পিরামিডের কথা লেখক বলেছেন, আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল পাঠাগার উঠে এসেছে।
যেহেতু বইটি ফ্যান্টাসি জাতীয় উপন্যাস, সেহেতু এই বিশাল কলেবরের রাজ্য ও পৃথিবীর পাশাপাশি এখানে যুদ্ধ ছিল গুরুত্বপুর্ণ। সেই যুদ্ধের পাশাপাশি কিছু দৈব অস্ত্র ছিল মূল আকর্ষণ। যেহেতু এখানে দুই পুরাণের সংযোগ ঘটেছিল, কোন পুরাণ বেশি শক্তিশালী স্বভাবতই সেই বিষয়টি সামনে চলে আসে। দেবতাদের লড়াই যুগে যুগে চলে এসেছে। গ্রীকদের বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধে দেবতারা একে অপরের সাথে লড়েছিল। মহাভারতের যুদ্ধও যে পিছিয়ে নেই। যখন দুই প্রান্তের দুই পৌরনিক ঘটনা মুখোমুখি হয়, তখন যেন বাড়তি আকর্ষণ ঘিরে ধরে।
মানুষ স্বভাবতই স্বাধীন��েতা। স্বাধীনতাকামী মানুষ দুঃসাহসী হয়। যখন নিজ ভূখণ্ডে অন্য জাতি শাসন শুরু করে, যতই আরাম আয়েশ থাকুক না কেন বিদ্রোহী হওয়ার বাসনা কারো কারো মনে জেগে ওঠে। আর এই বিদ্রোহ কখনও ভালো ফল বয়ে আনে না। সফলতা নির্ভর করে পরিকল্পনার উপর। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিজ ও নিজের সমর্থকদের ক্ষতির কারণ। অভিজাতরা যেমন কারো পরাধীন থাকতে না চেয়ে বিদ্রোহ করে, দাসরাও অন্যের মুখাপেক্ষী না হওয়ার বাসনায় বিদ্র��হী হয়ে ওঠে। দুই দলের মধ্যেই মিল এক জায়গায় এসে মিলিত হয়, স্বাধীনতা!
কিন্তু এই সমাজে আমরা যতই শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে বুলি আওড়াই না কেন, শ্রেণী বিভাজন না থাকলে সামাজিক কাঠামো ধ্বসে পড়ে। যাদের যে কাজ, সেটা করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কৃষকরা দেশ চালাতে পারবে না। তাদের কাজ ওই খামারেই। নাহলে পুরো দেশ ও জাতির অন্নের যোগান যে সম্ভব নয়।
বিশাল কলেবরের এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা লিখনশৈলী, গদ্যশৈলী বা বর্ণনাশৈলী — যা বলি না কেন। এত দুর্দান্ত এক উপাখ্যান, লেখক চমকের পর চমক রেখেছেন। যেভাবে ঘটনাপ্রবাহ ঘটেছে, দুই পুরাণের সংযোগ হয়েছে, শেষ দিকে যেভাবে লড়াই হয়েছে— লেখকের কল্পনাশক্তির তারিফ করতেই হয়। কিন্তু সমস্ত চেষ্টার পরিসমাপ্তি হয়েছে বাচনভঙ্গি, গল্প বলার ধরন ও সংলাপে। এই জাতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে বর্ণনা ও সংলাপ খুব বেশি অর্থ বহন করে। কিন্তু এখানে লেখকের দুর্বলতা খুব বেশি লক্ষ্য করেছি।
ফলে এমন এক ঘটনা সম্বলিত বিশাল উপন্যাস পড়তে গিয়ে যেমন তৃপ্তি পাওয়া উচিত ছিল, পাওয়া হলো না। প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রেও বলেছিলাম, লেখকের মোটিভেশন দেওয়ার প্রবণতা, দার্শনিকতত্ত্ব এত বেশি ছিল যে বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। এখানেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অভিজাত হোক, দাস হোক, জ্ঞানী হোক, বা কিশোর— প্রত্যেকেই জ্ঞানী। আর সবাই মোটিভেশন দেওয়ায় ওস্তাদ। এই জিনিসটা ঠিক হজম হয়নি। সমাজে যার যেমন অবস্থান সেই হিসেবে বিষয়টার মীমাংসা করা যেত।
এছাড়া কিছু বিষয় ঘটনাপ্রবাহে লেখক এড়িয়ে গিয়েছিলেন। যেটা না করলে আরো ভালো হতো। যেমন শেষ সময়ে যখন লড়াই হয়, তখন পরিস্থিতি ভালোই সঙ্গীন। কিন্তু এমন অবস্থায় ইনোনের অনুভূতি লেখক এড়িয়ে গিয়েছেন। ইনোনকে পুরো অগ্রাহ্য করে গিয়েছেন যেখানে তার প্রেমিক বা স্বামী মরণপণ লড়াই করে গিয়েছে।
পুরো উপন্যাসজুড়ে ছোট ছোট এই বিষয়গুলোতে লেখক নজর দেননি। অথচ এই বিষয়গুলো যেকোনো বইয়ের শোভা বাড়ায়। যেখানে এত বিশাল কলেবরের এক বই, সেখানে তো আরও বেশি গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।
◾চরিত্র :
“মহাকাল” বইয়ের ক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করেছিলাম, সেখানে শক্তিশালী কোনো নারী চরিত্র ছিল না। ফলে কিছুটা পানশে হয়ে উঠেছিল যাত্রা। সেদিক থেকে “মহাযাত্রা”য় দুটি ভিন্ন নারী চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে। দুই বিপরীত মেরুর চরিত্র দুটি যেন বিপরীত চিত্র প্রদর্শন করে।
ইনোন যেখানে মার্জিত, প্রেমে পাগল এক অপ্সরী। নিক্স সেখানে ঔদ্ধত্য, যার চরিত্রে দোষ আছে। শারীরিক আমোদে যে বেশি ডুবে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু ইনোনের মতো এক সময় তারও প্রেম আসে, কিন্তু যে পাপ সে করে চলেছে তার প্রায়শ্চিত্ত যে করতেই হবে।
ইভান ও ওরিয়ন চরিত্র দুটিকে ভালো লেগেছে। আবেগী কিন্তু সময় এলেই আবার যুদ্ধক্ষেত্রে সেরা যোদ্ধা। তাদের প্রতিটি অনুভূতি, তাদের ভবিতব্যের পরিবর্তন হয়ে যাওয়া এখানে গুরুত্বপুর্ণ। ভাগ্যের চাকা এভাবেই বদলায়। কখনও ভালো, কখনও খারাপ। মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক নিজেকে হতে হয়। নাহলে ফল পাওয়া যায় না।
গ্রীক সমাজের দুই শ্রেণী বিভাজন এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। এক দিকে অভিজাত শ্রেণী, আরেক দিকে হেলট নামধারী দাসেরা। তাদের সমাজে কী অবস্থান তাও লেখক দেখিয়েছেন বেশ ভালোভাবেই। তাদের চাওয়া পাওয়ার পূর্ণ চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন। তবে যে রোমান সম্রাজ্য নিয়ে এখানে কথাবার্তা, সেই রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ট্রাজানকে আরেকটু জায়গা দেওয়া যেত মনে হয়। আমি অন্তত একটু বেশি প্রত্যাশা করেছিলাম। হয়তো পরবর্তী বইয়ে সেই বিষয়টা পাওয়া যাবে।
গ্রীক পুরাণ এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের দেবতা এরিস, অস্ত্রের কারিগর হেফাস্টাস, এরিসের যুদ্ধের সেনাবাহিনী আমাজন বা সাইক্লপ্স হয়ে উঠেছিল উপন্যাসের প্রাণ। তাদের কাজকর্ম, যুদ্ধের কৌশল, এরিসের ক্রোধ যেন বইয়ের শেষভাগ উত্তাল করে রেখেছিল। দেবতাদেরও লোভ থাকে। যেখানে দেবতার হওয়ার কথা সাধারণ মানুষের ভরসার স্থল, হওয়া উচিত দয়ালু; সেখানে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সব ধ্বংস করার বাসনা কি একজন দেবতার শোভা পায়?
আগেই বলেছি, মহাকালের চরিত্রগুলো মহাযাত্রায় অনুপস্থিত। কেবল রুদ্রদেব, অসিত আর রাহু এই দুই প্রান্তের সংযোগকারী। রাহুর পরিণতি হয়তো নিরেট বাস্তব। নিজের অপকর্মের শাস্তি এই পৃথিবীতেই পাওয়া যায়। অন্যদিকে রুদ্রদেবের যে পরিচয় সামনে এসেছে তা চমকে দেওয়ার মতো। অসিতও দিনে দিনে গুরুদেবের যোগ্য হয়ে উঠেছে।
◾বানান, সম্পাদনা ও অন্যান্য :
মহাকাল বইয়ে বানান বা ছাপার ভুলের পরিমাণ কম থাকলেও এই বইয়ে একটু বেশি পরিমাণে ছিল। বিশেষ করে শেষদিকে এসে বেশ লক্ষ্য করা গিয়েছে। এত বিশাল কলেবরের বইয়ে পুরোটা নির্ভুল করা সম্ভব না, তারপরও আরো কমিয়ে আনা যেত হয়তো।
চিরকুট প্রকাশনীর প্রোডাকশন কোয়ালিটি নিয়ে কথা হবে না। এত মোটা বই খুলে পড়তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। বাঁধাইও খুলে যায় না। তবে বইটা বেশ ভারী বলে ধরে পড়তে একটু অসুবিধা হয়। হাত ব্যথা হয়ে যায়।
◾পরিশেষে, মহাকালের শেষ বিন্দু থেকে যে মহাযাত্রার সূচনা হয়েছিল, এখন এখানেই মহাপ্রস্থানের গল্প। প্রস্থান মানেই যে চলে যাওয়া এমন কোনো বিষয় না, হয়তো নতুন কোনো গল্প প্রবেশ। কিংবা নতুন কোনো উপাখ্যানে নাম লেখানো। কে জানে, এরপর কী হয়?
মহাকাল পড়ার পরে যে উচ্চাশা ছিলো তা পূরণ হলো না। কূটনৈতিক যে মারপ্যাঁচ মহাকালে ছিলো, তা একেবারেই অনুপস্থিত মহাযাত্রায়। যুদ্ধের টানটান উত্তেজনা বইয়ের একেবারে শেষে ছাড়া আমি পাইনি, অথচ মহাকালে প্রতিটা যুদ্ধই চমকে দিয়েছিলো। কিন্তু লেখকের মুন্সিয়ানার প্রশংসা করতেই হয়।
'মহাকাল যেখানে কলমের শেষ আঁচড় টেনে সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলো, মহাযাত্রা'র শুরুটা ঠিক সেখান থেকেই হয়েছে'
খোঁজা থামিয়ে দিলেই জীবনের আরাধ্য জিনিসের পাবার আশা নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু রুদ্রদেব আর অসিত ভাবছে ভিন্ন কথা। সমুদ্র সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। এখানে গুরু-শিষ্যের কোনো জ্ঞানই খাটবে না, দুজনেই নবিশ। তবু অসিতকে এগিয়ে যেতেই হবে, অঙ্গদকে উদ্ধার না করে সে ফিরে যাবে না বলে যে শপথ নিয়েছিলো তার সমাপ্তি টানতেই হবে। রুদ্রদেবও শিষ্যকে ত্যাগ করতে চান না। শিক্ষা শেষ হবার আগে কোনো গুরুই শিষ্যকে ত্যাগ করে না।
ওদিকে রাহু রাজ্যে ঝামেলার গন্ধ পেতেই অঙ্গদকে নিয়ে চেপে বসেছে জাহাজে। পশ্চিমে নিজের পরিচিত বন্দরের অভা�� নেই তার, সেগুলোর একটাতে থিতু হয়ে বসেই অঙ্গদকে নিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিকল্পনা করে রেখেছে সে। কিন্তু বিধির চিন্তা হয়তো অন্যরকম, রাহুর মতো লোকের তো আর পৃথিবীতে অভাব নেই! চলার পথে রাহু বুঝতে পারে, অঙ্গদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে লোকে। কেউ কেউ তো অঙ্গদকে পাবার জন্য তার প্রাণ নিতেও পিছপা হবে না।
রোমান সাম্রাজ্যের দখলে আছে পুরো গ্রীস আর ভূমধ্যসাগরের চারিদিকের অঞ্চল। রোমান সম্রাট ট্রাজানের শাসনে সাম্রাজ্যের কোথাও কোনো সমস্যা মাথাচাড়া দিতে পারছে না। তবে পরাধীন গ্রীসের বাতাসে মাঝে মাঝে শোনা যায় স্বাধীনতার কানাকানি। আলেকজান্ডারের উত্তরসূরিরা নিজেদের এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। নিজেদের সিংহসম সাহস মাঝে মাঝে জেগে উঠতে চায়। বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা দেয় স্পার্টার আকাশে-বাতাসে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে স্পার্টারই কিছু আভিজাত।
ইভানের স্বাধীনতা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। গ্রীসের অভিজাত সেনাদলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে অভিজাত সুবিধা নিয়ে জীবন কাটাতে পারলেই হলো। সেই লক্ষ্যেই স্পার্টার সেরা যোদ্ধা হবার পথে এগিয়ে চলেছে সে। কিন্তু হঠাৎ করে বদলে যায় তার জীবন। প্রেম জোয়ার বইয়ে দেয় তার জীবন নদীতে। আর, প্রেমের হাত ধরে আসে নানান ঝামেলা, যা বদলে দেয় সকল লক্ষ্য, আশা, ভবিষ্যৎ।
স্পার্টার দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় কিছু লোক একত্রিত হয়েছে জেগে তোলার জন্য এক অমোঘ শক্তির, যা এনে দিতে পারে গ্রীসের স্বাধীনতা, হাজার বছর আগের রূপকথা আবারও ধরা দেবে বাস্তব হয়ে। টিয়ার অব এপোলোর অপেক্ষায় কাল কেটে যাচ্ছে যার, অপেক্ষা কী এখনো শেষ হয়নি!
লেখক প্রথম বই মহাকাল যেখানে শেষ করেছেন, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করেছেন মহাযাত্রার, তবে এবার মহাকালের মতো অতবেশি কূটনীতি, রাজনীতি নেই। একেবারেই নেই বললেও ভুল হবে, তবে যা আছে তা মহাকাল থেকে কমই বলা যায়। গল্পের বলতে অধিকাংশ জুড়েই আছে একদিকে অঙ্গদকে সাথে নিয়ে রাহুর ছুটে চলা, এই বন্দর থেকে সেই বন্দর হয়ে যার থিতু হয় একেবারে স্পার্টায়, এখানে উপভোগ করার মতো ঘটনা অল্পই আছে।
অন্যদিকে একই যাত্রাপথে চলতে থাকা রুদ্ধদেব আর অসিতের সাথে পরিচয় হয় বুড়ো শেইরনের, যাকে সাথে নিয়ে রাহুর পথেই যাত্রা করে দুইজন। সাথে চলতে থাকে অসিতের ট্রেনিং। রাহুর যাত্রাটা অতোটা চমকপ্রদ না হলেও সেই তুলনায় অসিত রুদ্রদেবের যাত্রা বেশ ঘটনাবহুল, যদিও এখানে রুদ্রদেব যতটা দৃশ্যপটে এসেছে অসিত ততটা আসেনি। অন্যদিকে স্পার্টার ইভান, ওরিয়ান চরিত্র দুটোও উপভোগ করার মতো। যেখানে স্পার্টার রাজনৈতিক পরিবেশও আনন্দ দিয়েছে।
তবে এবারকার এই মহাযাত্রা বইটার অন্তত ৪০০পৃষ্টারও বেশি পর্যন্ত কাহিনি বেশ ধীরগতিতে এগিয়েছে। সময় লেগেছে কাহিনি পরিণত হতে, সুতোর সকল প্রান্ত একই সূত্রে একত্রিত হতে। তবে বইয়ের শেষ দৃশ্য একেবারে চমৎকার, রোলার কোস্টারের মতো গতিশীল ভাবে একের পর এক চমক দিয়ে গেছেন লেখক। সাথে হিন্দু পুরাণ আর গ্রিক পুরানের মিশেলে পুরান থেকে তুলে আনা চরিত্রকে দিয়ে লেখক যে শেষ আঁচড় টেনেছেন, তা সত্যি মনোমুগ্ধকর। অতীতের পুরাণের সাথে বর্তমানের সমন্বয় করে লেখক দারুণ এক ঘটনার অবতারণা করেছিলেন বইয়ের শেষ দৃশ্যে, যা শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টান টান উত্তেজনা ধরে রেখেছিলো।
মহাকাল বইয়ে আমার অভিযোগ ছিলো রুদ্রদেবকে ঠিক যতটা শক্তিশালী চরিত্র হিসেবে এনেছে ঠিক ততটা উপস্থাপন হয়নি বলে, এবার সেই অভিযোগ করার সুযোগ নেই। রুদ্রদেবও এবার গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তবে শেষদিকে এসে অসিতের ভূমিকাটা একটা দীর্ঘসময় ধরে অনুপস্থিতিটা দৃষ্টিকটু লেগেছে। বিশেষ করে যুদ্ধের বর্ণনায় সবার কম বেশি বর্ণনা আসলেও সেখানে অসিতের বর্ণনা অনুপস্থিত ছিলো। তাছাড়া তাকে যেভাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে মহাকাল থেকে, তাতে তার ভূমিকাটা প্রথমদিকেও বজায় থাকলে ভালো লাগতো। তবে শেষ ট্রাম কার্ডটা দারুণ ছিলো।
একটা বিশাল অংশ জুড়ে অ্যাডভেঞ্চার, আর তার চেয়ে কম রাজনীতি আর মিথলজির সমন্বয়ে মহাকাল মহাযাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। মহাকাল শেষে যে অতৃপ্তি নিয়ে পাঠক গল্প শেষ করেছিলো, মহাযাত্রায় তেমন অনূভুতি আর পেতে হবে না। যদিও লেখক আরো এক খন্ড আনতে যাচ্ছেন, তবুও একটা মহাযাত্রার শেষে তৃপ্তি নিয়েই পাঠক গল্প শেষ করবেন। এছাড়াও মহাকালের পাতায় পাতায় যে ধর্মজ্ঞান, দর্শনের বুলি লেখক আউরে গিয়েছিলেন, তা আমার অতিরিক্ত মনে হওয়ায় বিরক্তিকর লেগেছিলো, এবার সেই সমস্যা হয়নি। লেখকের পূর্ণ মনোযোগ গল্পের মাঝেই ছিলো।
বইটির প্রোডাকশন, রাউন্ড বাইন্ডিং পাঠকদের জন্য ভালোই পাঠক সুলভ, অন্তত খুলে পড়তে অসুবিধা হবে না। বইটার বানান ও অন্যান্য সম্পাদনাও চমৎকার হয়েছে, অবশ্য এরপরও এক জায়গায় চরিত্রের নাম অদলবদল চোখে পড়েছিলো, এছাড়া আর কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি।
সবমিলিয়ে মহাযাত্রার সমাপ্তি করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি, যার রেশ রয়ে গেছে এখনো। থাকবে আরো কিছুদিন। গ্রিক আর হিন্দু পুরাণের মিশেলে এক সমুদ্রযাত্রা, যুদ্ধ আর রাজনীতির গল্প উপভোগ করতে চাইলে মহাযাত্রা চমৎকার চয়েস হবে।
৭৫২ পৃষ্ঠার একটা বিশাল কাহিনী পড়তে গেলেই ভয় করে। তাই না? সাইজ দেখেই তো ভয় পাবার কথা। কিন্তু বিশ্বাস করেন, যখন বইটা আমি ধরেছিলাম, একটা আত্মবিশ্বাস নিয়েই ধরেছিলাম যে বইটা ভালো লাগবে। কেনো? কারণ, আমি 'মহাকাল' পড়েছি। সেইটা ছিলো এই সিরিজের প্রথম বই। চমৎকার ছিলো। শুধু চমৎকার বললে অবশ্য ভুল হবে। তার চাইতেও যদি বাড়িয়ে বলা যায় তবেও ভুল হবে না। না, আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না। আমার কথা বিশ্বাস যদি না হয় তবে বলবো একবার 'মহাকাল' পড়ে দেখুন।
যাইহোক, রিভিউ লিখছি যখন 'মহাযাত্রা'-র তখন সেখানেই থাকা উচিত। 'মহাযাত্রা' দিবাকর দাসের লেখা একটি মিথোলজিক্যাল ও ঐতিহাসিক ফ্যান্টাসি জনরার উপন্যাস। এইটা তার 'মহাকাল ট্রিলজি'-র দ্বিতীয় বই।
প্রথম বই যারা পড়েছেন, তারা চাইলেও নিজেকে আর থামাতে পারবেন না। স্পেশালি, অসিতের জন্য। সাথে রয়েছে তার গুরুদেব রুদ্রদেব। দুই গুরু-শিষ্যকে শত বাঁধা বিপত্তির মাঝেও এগিয়ে যেতে হবে শুধুমাত্র অঙ্গদের জন্য। ওদিকে রাহুও এগিয়েই চলেছে অঙ্গদকে নিয়ে। অঙ্গদের কি আর দেখা হবে অসিতের সাথে?
যদি এইটুক পরিসরেই 'মহাযাত্রা' আবদ্ধ বলে ভাবেন, তবে ভুল ভাবছেন। ওদিকে, রোমান সাম্রাজ্য দখল করে রেখেছে পুরো গ্রীস আর ভূমধ্যসাগরের চারিদিকের অঞ্চল। পরাধীনতার গ্লানি কে-ই বা চায়? আলেকজান্ডারের উত্তরসূরিরা নিজেদের এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বিদ্রোহের লক্ষণ দেখা দেয় স্পার্টায়।
ইভানের স্বাধীনতা নিয়ে মাথাব্যাথা আছে বললে ভুল বলা হবে। গ্রীসের অভিজাত সেনাদলে প্রবেশ করাটাই তার মূল লক্ষ্য। কিন্তু হঠাৎ বদলে যায় তার জীবন। সর্বনাশা প্রেম এসে জুটে তার নসীবে।
অন্যদিকে, স্পার্টার দুর্গম পাহাড়ে জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে এক অমোঘ শক্তি। সে কি জেগে উঠবে? সে কি অপশক্তি নাকি দিব্যশক্তি?
এইসব ঘটনাগুলো এসে মিলিত হয় এক জায়গায়। কিভাবে? তা জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে এই অনবদ্য 'মহাযাত্রা'।
সত্যি বলতে একটা মূহুর্তও আমার কাছে বোরিং ফিল করতে দেয়নি বইটা। এতো বিশাল একটা প্লট এই গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কি লেভেলের কষ্টসাধ্য তা পড়ে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়। হ্যাটস অফ টু দিবাকর দাস!! একটা চমৎকার উপন্যাস পড়লাম। যাদের মিথোলজিক্যাল ও ঐতিহাসিক ফ্যান্টাসি জনরার বই পছন্দ করেন, তাদের বলবো কোনোদিকে দেখার দরকার নাই। এই সিরিজ আপনার জন্যেই। 'মহাপ্রস্থান' এখনও শুরু করিনি। তবে, আশা রাখছি সেইটাও চমৎকার হবে। এক অনন্য সিনেম্যাটিক টাইপ প্রশান্তি নিয়ে বই শেষ করেছি। সাথে রিভিউ লিখাটাও থামাচ্ছি। চলি!
হিস্টোরিক্যাল আর মিথোলজিক্যাল ফ্যান্টাসি "মহাকালের" ক্লিফ-হ্যাঙার খুব সহজেই মহাকালের পাঠককে নিয়ে যায় দিবাকর দাসের "মহাযাত্রা"র অভিমুখে। "মহাযাত্রা" বইয়ে ২৬৬ নাম্বার পৃষ্ঠার একটা কথা দিয়ে শুরু করি। সেখানে যোগীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে বলা হয়েছে, "বাসনা নেই, কিন্তু উপভোগ আছে"। আমি তো যোগী নই; একজন অর্বাচীন পাঠক মাত্র। তাই আমার বাসনা ও উপভোগ দুটোই আছে। উপভোগের ব্যাপারটায় হয়তো সকল পাঠকই একমত হবেন। মহাযাত্রা উপভোগ্য ছিল। এবং যারা পড়বেন সামনে তাদের জন্যেও উপভোগ্য হয়েই অপেক্ষা করবে।
"বাসনা" মানে প্রত্যাশা আর সেই প্রত্যাশার তাপে প্রাপ্তির পারদ কতটা উঁচুতে উঠলো - সেই আলোচনার চেষ্টা করবো এই লেখায়। মিথোলজিক্যাল ফ্যান্টাসি বা ফিকশন হলেও পাঠক হিসেবে আমি (অথবা আরও অনেকেই) প্রায়শই সেই গল্পটাকে রিয়েলিটির সাথে ম্যাচ করার একটা চেষ্টা করি। অথবা কোন মুভি বা চেনা দৃশ্যের সাথে সামঞ্জস্যতা পেলে সেটার বেসিসে একটা তুলনামূলক আলোচনারও চেষ্টা থাকে। হতে পারে এটা আমার এক ধরনের দুর্বলতা পাঠক হিসেবে। তবে আমার ধারনা যেকোন একটা বিষয়কে এলোন-ভাবে বিচারের করা থেকে বরং কম্পারিজন বেসিসে করলে সেটা থেকে আলাদা একটা রেফারেন্স ক্রিয়েট হয়।
মহাযাত্রার কাহিনি নিয়ে আগে কিছু বলে নেয়া যাক।
দুই.
দিবাকর দাসের "মহাযাত্রা" কাহিনিতে অসিত এবং রুদ্রদেব যে থাকবে সেটা সহজেই অনুমেয় ছিল। আর যেহেতু অসিত, রুদ্রদেব থাকবে সেহেতু কাহিনির এই অংশকে সাপোর্ট দিতে রাহুর উপস্থিতিও নিশ্চিত ছিল। দেখার বিষয় ছিল বাকি কে কে থাকে। নর্মদার সামনে দিয়ে কাহিনি কাকে-কাকে নিয়ে অগ্রসর হয়।
না সেভাবে আর কেউ নেই। এই কাহিনি ভারতবর্ষের গন্ডি ছাড়িয়ে এবার পরাধীন গ্রীসের ভূমিতে। গ্রীস তখন রোমান সম্রাজ্যের দখলে। ট্রাজানের বুদ্ধিদীপ্ত শাসনে কোন পরাধীন ভূখন্ডেই কোন সমস্যা মাথাচাড়া দিতে পারছে না। স্পার্টার আমজনতা আরাম-আয়েশে সব পরাধীনতা ভুলে থাকলেও সব সময়ের মতোই কিছু স্বাধীনতাকামী মানুষ থাকে। গোপনে গোপনে তাই বিদ্রোহ দেখা দেয়। শুরু হয় গুপ্ত আলোচনা এবং গুপ্ত হাম/লার প্ল্যান। যার প্রধান রূপকার এক সময়ের মহা অভিজাত এলেষ্টার।
ওদিকে গ্রীসের অভিজাত সেনাদলে যোগ্য সদস্য বাছাই করার লক্ষ্যে চলে গোপনে প্রশিক্ষণ। এখানে মহা অভিজাত হবার সবচেয়ে যোগ্যতর ইভান। স্পার্টার সেরা যোদ্ধা হবার লক্ষে আর এক-স্টেপ বাকি। এবং সেখানে যেয়েই শুরু হয় সকল ঝামেলার। বদলে যায় জীবন। একি সাথে আসে জীবনে প্রেম। অসম-প্রেম।
এদিকে রাহুকে অনুসরন করে অসিত আর রুদ্রদেব এসে পৌছায় গ্রীসে। পথে পরিচয় হয় আরও একজন রহস্যময় চরিত্র শেইরনের সাথে। স্পার্টার দুর্গম পাহাড়ে এক অমোঘ শক্তি জেগে ওঠার অপেক্ষায়। শুধুমাত্র "টিয়ার অব এপোলো" এর শক্তি তাকে আবারো প্রাণ দিতে পারবে। অসিত ও রুদ্রদেব গ্রীসে পা দেবার সাথে সাথে জেগে ওঠে সেই শক্তি। এখানেই আমরা পাই গ্রীক দেবতা এরিসকে। ১২জন দেবতাদের মধ্যে একজন। প্রাণ পেয়েই দখল নিয়ে নেয় গ্রীস। এবং যাত্রা শুরু করে রোমান সম্রাজ্যের দিকে। রোমান সম্রাট ট্রাজান এক অসম-যু/দ্ধের মুখোমুখি।
এতো সব বর্ণিল উপখ্যানের মাঝে সবচেয়ে বর্ণিল অঙ্গদ তখন গ্রীসের গভর্নর পায়াসের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় বন্দী। অসিত কি পারবে তাকে ফিরে পেতে? পায়াসের কন্যা নিক্স আর মহা অভিজাত এলেষ্টারের কন্যা ও ইভানের প্রেমিকা ইনোন গুরুত্বপূর্ন চরিত্র বলবো না, বরং উল্লেখযোগ্য চরিত্র। এই বিশাল মাহাযাত্রার কাহিনি কোন বিন্দুতে যেয়ে সমাপ্তি - সেই সবই উঠে এসেছে এই বিশাল ক্যানভাসের বইয়ে।
তিন.
হিস্টোরিক্যাল আর মিথোলজিক্যাল ফ্যান্টাসি হোক বা যে জনরার লেখা - দিন শেষে এটাও তো সাহিত্যের একটা পার্ট। শুরুতেই যেমন বলেছিলাম, গল্পটাকে রিয়েলিটির সাথে ম্যাচ করার একটা চেষ্টা করা - এই কনসাসনেস হয়তো অনেক পাঠকের মধ্যেই কাজ করে। তো, সেই বিচারে "মহাযাত্রা" কতটা এথনোগ্রাফিক্যাল ডকুমেন্ট হয়ে উঠলো তার একটা অনুসন্ধান থেকেই যায় মানসপটে। নৃতাত্ত্বিকতা বা এই এথনোগ্রাফিক্যাল ডকুমেন্ট হয়ে ওঠা মানে মানব আচরণকে অধ্যয়ণ করা (গল্পের চরিত্রগুলোকে) ।
"মহাযাত্র" যে সময়ের গল্প সেই সময়কে আমরা উপলব্ধি করি আমাদের দিব্যদৃষ্টি দিয়ে না বরং পূর্বের জানাশোনা এবং পাঠ দ্বারা। সেই যুগের রাজা-প্রজা বা মিথলজিক্যাল দেব-দেবীর যেসব গল্প আমরা জানি তার আলোকে। এর সাথে বর্তমান সময়ের মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞানের সমঞ্জস্যতা থাকবে না স্বাভাবিক। এথনোগ্রাফিক্যাল ডকুমেন্ট হয়ে ওঠার কাজটি করবে তাহলে কাহিনিতে লেখক নানা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে যেসব ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং দর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন তার আলোকে। মিথলজিক্যাল চরিত্রগুলো বাদ দিলে অসিত আমাদের খুব কাছাকছি। "রাহু" চরিত্রও আমাদের চেনা বা আমরা খুব সহজেই বর্তমানের প্রেক্ষাপটে রিলেট করতে পারি। এমন সুযোগসন্ধানী, লোভী ও অবিবেচক চরিত্র সব-যুগের পতাকাই বহন করে।
ফ্যান্টসি জনরার গল্প মানেই পাঠকের আনন্দ এবং একি সাথে একটা এসকেপ-রুট রিয়েলিটি হতে। তারপরও আমরা সেটাকে অবশ্যই একটু মিলিয়ে দেখি কোনটা আমাদের জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে বা সমন্বয় করা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই ফ্যান্টাসি গল্পের চরিত্রগুলো বা ব্যবহৃত ক্রিয়েচারগুলো আনফিজিবল হয়ে থাকে রিয়েল-ওয়ার্ল্ড থেকে। তবে মহাযাত্রার কাহিনিতে এইসব থাকলেও, এই কাহিনির বেশ কিছু চরিত্র, তাদের দর্শন বা আদর্শবোধ এবং একই সাথে অনাদর্শিক বোধও কাহিনিটাকে একটা এথনোগ্রাফিক্যাল ডকুমেন্ট হয়ে উঠতে সহায়তা করে। সাথে যেটা বললাম, কাহিনিকারের নিজস্ব দর্শন বা বিশ্বাস সংলাপের মধ্যে দিয়ে রোপণ করে দেয় কাহিনির মধ্যে - তার অনেকটাই হয়তো পাঠক নিজস্ব একটা বোধ হিসেবে অনায়াসে আলিঙ্গন করতে পারবে। চরিত্র বা গল্পের কাহিনি ঐতিহাসিক বা প্রাগৈতিহাসিক হোক, তার মধ্যকার দর্শন বা বিশ্বাসটুকু ততটা আনরিয়েল লাগে না। অথবা সেটাকে বাস্তবতার আলোকে ম্যাচ করিয়ে একটা ডিসকোর্সের সুযোগ রেখে যায়।
এই যায়গায় এসে মনে হলো - সেই সময়ের কাহিনির সাথে এই সময়ের একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরার চেয়েও "মহাযাত্রা" কে তুলনা করতে "মহাকাল" এর সাথেও একটা তুলনামূলক আলোচনা দাবি রাখে।
চার.
মহাকালের একটা দৃশ্য তুলে ধরতে মহযাত্রা বইয়ের ২৪০ নাম্বার পেজ থেকে ঘুরে আসি। যেখানে রুদ্রদেব অসিতকে প্রশিক্ষণ দেবার সমেয়ে হাতের পাঁচ আঙ্গুলে পাঁচটি উপাদানের নাম লিখে দিয়েছিল।
"বৃদ্ধাঙ্গুলে ছিল অগ্নি, তর্জনীতে বায়ু, মধ্যমায় ছিল আকাশ, অনামিকায় ভুমি আর কনিষ্ঠায় ছিল জল।"
একসাথে বললে এটাকে বলা হয়ে থাকে "পঞ্চভূত"। অন্যভাবে বললে - ক্ষিতি, অপ, তেজঃ, মরুৎ এবং ব্যোম - এই হচ্ছে পঞ্চভূত।
এই "পঞ্চভূত" ব্যাপারটা দুটো কাহিনির চরিত্রায়নেও রিলেট করা যায়��� যদি মোটা দাগে মহাকালের চরিত্রগুলো বিচার করা হয় তাহলে এমন ৫টা চরিত্র প্রধান উপজীব্য হিসেবে তুলে আনা যাবে। যেমন রুদ্রদেব-অসিত (রাহুকে এখানে সাপোটিং চরিত্র হিসেবে ধরা), রাজা নাহাপনা, মহারাজ সাতকর্ণী, মন্ত্রী গিরিধারী, এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ন চরিত্র আছে নামটা এখন মনে পড়ছে না আমার সহজে ভুলে যাবার প্রবণতা থেকে।
মহাযাত্রা থেকে যদি নেই অসিত-রুদ্রদেব (এখানেও রাহু এই জুটির উদ্দেশ্য পূরনের জন্যে সাপোটিং চরিত্র), এলেষ্টর, গভর্নর পায়াস (ট্রাজান গুরুত্বপূর্ন চরিত্র হলেও কম ব্যাপ্তির কারনে এখানে উল্লেখ্য না), এরিস, ইভান-নিকোলাস। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ন চরিত্র আছে কাহিনিতে। তবে মোটা দাগে এরাই প্রধান যাদের কাঁধে ভর করেই কাহিনি এগিয়ে গেছে। আগেই বলে রাখি, "মহাযাত্রা" উপভোগ্য একটি ফিকশন। পাঠক কাহিনির স্রোতে তরতর করেই এগিয়ে যাবে। তবে এই তুলনামূলক চিত্র মহাযাত্রার কিছুটা বিপক্ষে গেলেও সেটা বই পড়ার আনন্দকে ম্লান করবে না কোনভাবে। কারন কাহিনিকার দিবাকর দাস গল্প বলতে পটু। প্রতিটা অধ্যায়ের শেষে আক্ষরিকঅর্থেই পেজ-টার্নার ভাইব রাখতে সিদ্ধহস্ত। এই তুলনামূলক চিত্র হয়তো অনেকটা "ধান ভানতে শীবের গীতের" মতো মনে হতে পারে। যে আলোচনা যেখানে মহাযাত্রা নিয়ে সেখানে মহাকালের প্রসঙ্গ টানা কতটা শ্রেয়। হতে পারে। তবে মহাযাত্রার বীজ কিন্তু অঙ্কুরোদগম হয়েছেই ��হাকাল থেকে।
এখানে মহাযাত্রার কাহিনিটাকে আমি দুটো ভাগ করে নেই। প্রথম ৪৫০/৫০০ পেজ এবং ২য় অংশ তার পরবর্তী গল্প। মহাকাল আমাদের যে গল্প শুনিয়েছে বা যে আনন্দ দিয়েছে সেই মেজাজটা কতটা আপহোল্ড করে মহাযাত্রা সেটাই আসল। মহাকাল আমাদের যে নতুন এবং মোহনীয় গল্পে বুঁদ করে রেখেছিল, এবং সেই কারনেই পাঠক হিসেবে আমার কাছে মাহাযাত্রায় প্রত্যাশা আরো ছিল। কিন্তু কম্পারেটিভ বেসিসে যদি আমি দেখি - "মহাযাত্রার" কাহিনির ষ্ট্রকচারটা "মহাকাল" কাহিনিরই শ্যাডো।
আমি বলছি না এবসুলেট একটা ডিফারেন্স নিয়ে হাজির হবে মহাযাত্রা। যেহেতু সিক্যুয়েল। কিন্তু ওই যে ষ্ট্রাকচারটা - যেন আমি মহাকালের শ্যাডোতে মহাযাত্রা পড়ছি। উপরে যে ৫টি প্রধান চরিত্রের একটি চিত্র এঁকে নিলাম এর মধ্যে অসিত-রদ্রদেব এর জুটি মহাকালেও ছিল এবং মাহযাত্রায়। সেটা কাম্য এবং এর প্রগ্রেসটাও পাঠক দেখতে উন্মুখ ছিল। বাকি যে চরিত্রগুলো এবং কাহিনির যে বর্ননা তা কম্পারেটিভ অবস্থার বেসিসে আসলে অনকটা যেন পূর্বের চরিত্রগুলোকে নতুন চরিত্র দ্বারা রিপ্লেস করে একি স্ট্রাকচারে গল্প বলে যাওয়া। হ্যাঁ, এরিস আলাদা ছিল, তবে সেটা নিয়েও একটা কম্পারেটিভ অবস্থার অবতারনা হয় - সেটায় পরে আসি। পূর্বের চরিত্রগুলো থাকবে না, এবং নতুন কাহিনিতে নতুন চরিত্র থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সমস্যাটা আমার কাছে যেটা লেগেছে - ওই ষ্ট্রাকচারাল কারনে। একি ষ্ট্রাকচারে যেন ইঁদুর-বেড়াল খেলা।
টু বি অনেষ্ট - প্রথম ৫০০ পেজে (এরিসের জেগে ওঠার আগ পর্যন্ত) আমার কাছে মহাকালের শ্যাডোয়িংয়ের কারনে একরনের মনোটোনাস স্ট্রাকচার বা মনোটোনাস ফিল হয়। আলাদা যেটা স্থান এবং ভৌগলিক অবস্থা, মহাকালে যেটা ছিল স্থল মাহাযাত্রায় সেটা সাগর এবং অনেকটাই অরন্যের মঞ্চ। এটা সত্যি যে থমকে যেতে হয় না। কারন ক্লাইম্যাক্স বা উত্তেজনা রি-ক্রিয়েট করতে দিবাকর দাস দক্ষ। তবে প্রথম ৫০০ পেজের পরে এই মনোটোনাস ফিলটা অনেকটাই কেটে গেছে।
আরও একটু ভালোভাবে বুঝাতে গেলে আমি স্কুল লাইফের ক্লাশ-রুটিনটাকে একটা রেফারেন্স হিসেবে নিতে পারি। সেম-ওল্ড রুটিন। পার্থক্য শুধু রবিবারে প্রথম ক্লাশ বাংলা হলে পরের দিন হয়তো অংক। পরের দিন সমাজ। কিন্তু ফরমেটাটা একই গৎবাঁধা। গল্পটা নতুন, গল্প বলার ধরনটা বা কাহিনির প্রগ্রেসটা যেন মহাকালের তালেই।
মহাযাত্রার স্টোরিটেলিং দুর্দান্ত এবং উপভোগ্য বলেই নিয়েছি। সুতরাং এখনে "মনোটোনাস" ব্যাপারটাকে বোরিং বা একঘেঁয়ে ভাবার কোন কারন নেই। যদিও মনোটোনাস মানে বোরিং। এখানে এটা মাথায় রাখা জরুরী "রিপিটেশন" ব্যাপারটা মনোটোনাস হয়ে দাঁড়ায়। এই মহাকালের ষ্ট্রাকচার-টার শ্যাডো বা মাহাযাত্রায় তার রিপিটেশন হয়তো তার ইমপ্যাক্ট হারায় বা একটা নেগেটিভ ফোর্স হিসাবে কাজ করতে পারে। সহজভাবে বলা যেতে পারে "patterns standout". করতে পারে মানে, অনেকের বেলা করবে; অনেকের বেলা না। খুব প্রবলভাবে না হলেও আমার বেলা করেছে।
তবে এটাও বলে রাখা উচৎ বলে মনে করি যে, রিপিটেশন বা ইকো'স সবসময় যে নেগেটিভ ফোর্স হিসাবে কাজ করে তা না। অনক সময় একটা স্টোরিটেলিংকে সলিড একটা গঠন দিতে বা ছন্দবন্ধ (rhyming) ভাইব তৈরী করতেও সহায়ক। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা হয়তো একটা জ্যারিং টোন বা টায়াসাম রিডিং এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। বা সে সম্ভাবনা থেকেই যায়।
পাঁচ.
বইয়ের বাকি অংশ মানে এরিসের জাগরণের পর সেই কম্পারেটিভ বেসিসে দেখাটা আবার অন্যভাবে কাজ করে। এখানে আমি রেফারেন্স হিসেবে টানবো The Avengers মুভির Captain America আর Loki এর সেই বহুলদর্শিত দৃশ্য। যারই এভেঞ্জার মুভিগুলোর সাথে পরিচিত তারা খুব সহজেই রিলেট করতে পারবেন। এরিসের জেগে ওঠার পরে তাকে কুর্নিশ করতে বলা, তার ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ যেন খুব আইডেন্টিকাল। এখানে এটা বলার কারন এটা না যে কোনটাই কোনটার এডপশন। ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পাবে বা এভাবে দেখা যায় যে মুভিগুলোরও অনেক চরিত্র গ্রীক মিথলজির নানা চরিত্রের আশ্রয়ে আশ্রিত। সেক্ষেত্রে মিল থাকাই স্বাভাবিক। কথা এটা যে, এভেঞ্জার মুভি দর্শকদের কাছে এই চিত্রায়নগুলো খুব কমন। অথবা "Black Panther" মুভিতে "ওয়াকান্ডার" যে সুরক্ষা-দেয়াল তার সাথে এরিসের তৈরী করা দেয়ালের মিলও আইডেন্টিকাল।
আইডেন্টিকাল হলেও দিবাকর দাস যেভাকে সকল সুতো এক জায়গায় এনে বেঁধেছেন - সেটা উপলক্ষ করে মহাযাত্রা উপভোগ করতে কোনপ্রকার কষ্ট হবে না পাঠকের। বরং বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করবেন।
একি সাথে পাঠক স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা অনুমান সহজেই করে নিতে পারেন এবং একি সাথে উত্তেজনাও ফিল করতে পারেন দুই সুপার-পাওয়ারের সাক্ষাতের ক্ষণটুকু কল্পনা করে। পাঠক মাত্র্রেই এখানে একটা মানসিক প্রস্তুতি শুরু থেকে নিয়ে রাখে। কারন যেভাবে রুদ্রদেব, ইভান এবং এরিসকে আনা হয়েছে কাহিনিতে - সেখানে কোন দুটো চরিত্রের সংঘাত হবেই। এই কল্পনা মোটেও কম্পলিকেটেড না, বরং সহজেই অনুমেয়। ঠিক এই কল্পনায় কিন্তু আমাদের (যারা মুভি দেখে অভ্যস্ত) আমাদের সামনে এসে হাজির হয় "ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস"। পার্থক্য এই - মুভিতে দর্শক পছন্দ-ভেদে কেউ আগে থেকে "সুপারম্যান" এর পক্ষে। আর কেউ "ব্যাটম্যান" এর পক্ষে। মহাযাত্রায় (আমার ধারনা) সকল পাঠকই শুরু থেকে "রুদ্রদেবের" পক্ষে।
তারপরও মাহযাত্রায় যে গল্প ফাঁদা হয়েছে পাঠকের জন্যে তার অল্প কিছু অংশ অনুমেয় হলেও অথবা মুভির সাথে আইডেন্টিক্যাল হলেও পাঠক সেই ফাঁদে পা দিয়ে গল্প উপভোগ ঠিকই করবেন।
ছয়.
আরও একটি গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার মহাকালে যেটা ছিল - উক্ত কাহিনিতে কোন উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র নাই। বলতে গেলে সেভাবে কোন নারী চরিত্র নাই। দেখার বিষয় ছিল "মহাযাত্রায়" লেখক এই "সত্যজিত সিনড্রোম" কাটিয়ে উঠেছেন নাকি একি পথে হেঁটেছেন।
মহাযাত্রায় নারী চরিত্র আছে। বেশ ভালোভাবেই আছে। তবে আগের মতোই "উল্লেখযোগ্য" বা "একটি শক্তিশালী চরিত্রের মতো" নারী চরিত্র নেই এখানেই। এখানে "শক্তিশালী" মানে শারীরিক শক্তি মীন করে না বলা বাহুল্য। এই নারী চরিত্রের কথা উঠে আসায় ইনোন আর নিক্সের কথা মনে পড়লো। তাদেরকে যেভাবে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে বা গ্রীসের ওই ��ময়টার নারীদের এবং অভিজাতদের ও রাজাদের যে কামের প্রকাশ ঘটানো হয়েছে - সময়ের ভেদে সেটা মানিয়ে যায়। সেটা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। বরং আমাদের স্বল্প জানাশোনা দিয়ে আমরা হয়তো এইসব চরিত্রগুলোর কা/মার্ত খায়েশ এবং বিকৃত মনোবাসনার সাথে পূর্বেই পরিচিত। সারপ্রাইজিং কিছু না, বরং মানানসই।
মানানসই যেটা লাগেনি - গ্রীক বা রোমনা সম্রাজ্যে সেই সময়ে যেটা "কমন সিনড্রোম" হিসাবে আপহোল্ড করে, মহাকালের প্রাচীন ভারতবর্ষে কি সেটা ছিল না? নাকি লেখক কিছুটা পক্ষপাতিত্বের দোষে দায়ী এখানে? মহাযাত্রার এই ফরম্যাটের কারনেই প্রশ্নটা মনে আসে। খুব গুরুত্বপূর্ন কিছুই না হয়তো। গল্প উপভোগের অন্তরায়ও না। তবে একটা স্নবিশ ভাইব রেখে যায় কোথাও।
খুটিনাটি বিষয়গুলো এত বিশদভাবে বর্ননায় দিবাকর দাস মানে লেখক সিদ্ধহস্ত। যুদ্ধক্ষেত্র, সমরসজ্জা, সেনাদলের কার্যক্রম আমরা মহাকালে এতো নিঁখুত ভাবে পেয়েছি যে আমাদের ভিজ্যুয়ালাইজেশনে কোন প্রকার কষ্ট করা লাগে নাই। মাহাযাত্রায়ও একি প্রকার দক্ষতা লেখক দেখিয়েছেন। পাঠক সেই ভিজ্যুয়ালাইজেশনের প্লেজার বেশ ভালোভাবেই পাবেন। এই জায়গায় হয়তো প্রত্যেক পাঠকের নন-আর্গুমেন্টেটিভ পজিশনই হোল্ড করা লাগবে।
আর্গুমেন্টে যেখানে সেটা হচ্ছে, তিনি যেসব জায়গার কথা বলে গেছেন - হোক সেটা মহাকালের উপজীব্য ভারতবর্ষ অথবা মহাযাত্রায় রোমান ও গ্রীক সম্রাজ্য, সেই সব স্থানের যেসব বন্দর, সমুদ্র বা বনের কথা বলেছেন গল্পে সেগুলো কোনভাবেই ভিজ্যুয়ালাইজ করা যায় না। যে কাহিনিকার বিশদভাবে বর্নণায় একজন দক্ষ কারিগর হেফাষ্টাসের মতো, তিনি কেন এই ব্যাপারগুলো আরও একটু বিষদ বর্ননায় গেলেন না সেটা তিনি বলতে পারবেন হয়তো। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয় এইসব বন্দর বা সমুদ্রের আরো বিশদভাবে বর্ননা বরং মহাযাত্রাকে আরো সমৃদ্ধ করতো। তিনি এটায় সচেষ্ট হলে সফলও হতেন বলে আমার বিশ্বাস।
দিবাকর দাস তার কাহিনির সুতোগুলোর ব্যাপারে সবসময়েই সচেতন। কাহিনিতে লুপ-হোল থাকে না। কাহিনিতে প্রোটাগনিস্টের এস্টাবলিশমেন্ট বেশ দারুন ভাবেই হয়। একিভাবে তার বিপরীতে যোগ্য অ্যানার্কি ক্রিয়েটেও তিনি কোনপ্রকার ছাড় দেন না। যার ফলেই দন্ধটা হয়ে ওঠে আরো আকর্ষনীয়। তবে "মহাযাত্রায়" একটা ইস্যু পাঠক হিসেবে আমি ইগনোর করতে পারছি না।
রুদ্রদেবের সাথে প্রশিক্ষণকালে অসিত কখনোই সেভাবে ধনুকে "অগ্নি অ/স্ত্র" ধারন করতে পারে নি। কিন্তু শেষ ক্লাইমেক্সে অসিত প্রথমবারের মত সফলভাবে দুটো শক্তিকে ধারন করে। অগ্নি অ/স্ত্র আর বায়বাস্ত্র। সে কিভাবে পারল প্রশ্ন সেটা না। মানুষ বিপদে পড়লে বা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসম্ভবকেও সম্ভব করে তোলে। সুতরাং অসিতের হুট করে দুটো শক্তির ধারনের দৃশ্যটাকে একসেপ্ট করেই নেয়া যায়। বেক্ষাপ্পা যেখানে, দুটো অ/স্ত্রকে দুটো ভিন্ন দিকে কন্ট্রোলের যে ব্যাপার - এইরকম কোন ট্রেনিং অসিত পায়নি। যেটার সামান্য উল্লেখ নেই অসিতের প্রশিক্ষণকালেও। রুদ্রদেব-অসিতের প্রশিক্ষণকালে যদি এই বিষয়ে কিছু আলোচনা রেখে যেতেন লেখক তাহলে হয়তো এই ইস্যুটা ন্যারো লাগতো না। পুরো কাহিনি লেখক দিবাকর দাস যেভাবে এনসাইক্লোপিয়েডিক এসপেক্টে লিখেছেন তাতে এই ব্যাপারটায় হয়তো আরো একটু বিস্তিৃত বর্নান শেষের ক্লাইমেক্সে ভালো একটা ব্যাকআপ হিসেবে আপহোল্ড করতো বলেই আমার বিশ্বাস।
সাত.
"luring the reader" বোধহয় একজন লেখকের সবচেয়ে মোক্ষম অ/স্ত্র বা আরাধ্য টেকন্যিক। দিবাকর দাস এই অ/স্ত্র চালনায় রুদ্রদেবের মতোই দক্ষ। রুদ্রদেবের কপালে যদিও "টিয়ার অব এপোলো" এর শক্তির সমান একটা রত্ন ছিল। দিবাকর দাসের কপালে সেই রত্ন পাঠকের ভালোবাসা। তবে সেটা এমনি এমনি তো আর আসে না। পাঠককে তার গল্পে আকৃষ্ট করার সহজাত প্রবণতার কারনেই।
পাঠকরে চিন্তার আর আকাঙ্খার ট্রানজিশনকে খুব ভালোভাবেই তিনি কন্ট্রোল করেন। যেমন, রাহু যখন অঙ্গদকে নিয়ে মঞ্চে ওঠে প্রদর্শনের জন্যে এবং খাঁচাটা ঢাকা থাকে কাপড়ে। এবং ঠিক ওই জায়গায় শেষ হয় অধ্যায়টি। এবং তার পরের কিছু অধ্যায় গল্পের অন্য অংশ নিয়ে। মানে রাহু এবং অঙ্গদের এই ক্লিফ-হ্যাঙারটুকু আরো কিছু অধ্যায় পরে আবার আসবে। পাঠক কিন্ত ঠায় তখনো বসে গ্যালারিতে। বা বলা যায় লেখক পাঠকদের বসিয়ে রাখেন সেই গ্যালারিতে। পাঠক গল্পের বাকি অংশ পড়তেছে ঠিকই - কিন্তু তার অবচেতন মন চেয়ে আছে মঞ্চে। তাকিয়ে আছে সেই কাপড়ে ঢাকা বাক্সের দিকে। এমন আরো অনেক উদাহরণই আছে। পাঠকে প্রলুব্ধ করে নিজের আয়ত্বে নেবার সহজাত গুণ লেখকের, এবং সেটার সহজাত ব্যবহার মাহাযাত্রায়ও বেশ ভালোভাবেই আছে।
দিবাকর দাসের গল্প বলার ভঙ্গিমা বা মহাকাল-মহাযাত্রার কাহিনি পাঠকের সাইক্যাডেলিক ঘোর হয়ে ওঠে সে কারনেই। গল্পে টানটান উত্তেজনা, কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার বিন্যাস, বৈচিত্র্যময় এবং চমকপ্রদ নাটকীয়তা "মাহযাত্রার" প্রাণ এবং লেখক দিবাকর দাসের সহজাত বৈশিষ্ঠ্য।
আট.
মুদ্রণপ্রমাদকে নিয়ে আলোচনা অন্তঃসারশূন্য। শুধু উল্লেখ করা এজন্যে যে, যদি চোখে পড়ে বইয়ের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের, তাহলে পরবর্তী মুদ্রনে তার সেটা কারেকশন করে নিতে পারবেন।
মহাযাত্রার প্রতি আমার সবচেয়ে বড় অভিযোগ এর বিভিন্ন অধ্যায়ের বিন্যাসের উপর। যে কোন বইয়ে অধ্যায়গুলো কোন সবাটাইটেল, ১..২.৩ নাম্বারিং বা কোন মাকিং (চিত্র) দ্বারা ভাগ করা থাকে। যাতে পাঠক বুঝতে পারেন নতুন একটা অধ্যায়ের সূচনা। এই বইয়ে সেই ধরনের কোন মাকিংই নাই। আমি কলকাতার ভার্সনও চেক করে দেখেছি - সেম। একটা অধ্যায় যখন কোন পেজের মাঝামাঝি শেষ হয়, তখন হয়তো ইজিলি বুঝা যায় যে পরবর্তী অধ্যায় নতুন একটা অধ্যায়ের শুরু। কিন্তু আগের অধ্যায়টা যদি একদম পেজেরে এন্ডে এসে শেষ হয় এবং পরের পৃষ্ঠায় যেয়ে দেখি নতুন অধ্যায় শুরু, তখন হোঁচট খাওয়া লাগে। মহাযাত্রায় এই সমস্যা অনেকবারই ফেস করেছি। পাঠকের এই কম্ফোর্টের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ ছিল লেখক ও প্রকাশকের।
"মহাকাল" বই থেকেই বহুবার যে "রাধা" বানান নিয়ে হৈ-চৈ এবং লেখক নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন ভুলটা এবং মহাকাল থেকে সেই ভুল সংশোধনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন। সেক্ষেত্রে কিভাবে "মহাযাত্রায়" সেই ভুল থেকে যায় অহরহ সেটা একটা বিশাল "প্রশ্নবোধক" হিসাবে থেকে যাবে। ৬৪১ নাম্বার পেজ থেকে "রাধা" বানানের সঠিক প্রয়োগ করা হয়েছে। এর আগে সব জায়গায় আবারো ভুল বানানের প্রয়োগ রীতিমত দৃষ্টিকটু।
৬৫৫ নাম্বর পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভুলটা ধরা পড়ে। এরিসের দলে "রুদ্রদেব" থাকার কোন প্রশ্নই উঠে না। এখানে ভুলে এরিসের জায়গায় রুদ্রদেব লিখে হুট করে সাময়িকভাবে পাঠককে বিভ্রান্ত করে ফেলার অবকাশ আছে।
চিরকুটের বইয়ে ভুলের মার্জিন বেশ কম। এই বইয়েও কম, তবে তাদের অন্য বই থেকে এটায় একটু বেশি। আমি অল্প কিছু নোট রেখে দিচ্ছি যদি কাজে লাগে -
পৃষ্ঠা নং ১৫ - "মেরে" হবে। "মেলে" লেখা। পৃষ্ঠা নং ২৩১ - "মাজিদ বলে মাজিদের কাছে মানচিত্র" - এখানে প্রথম "মাজিদ" রাহু বা শরিফ হবে। পৃষ্ঠা নং ৩৬১ - "আলো কাপড়" - হবে "কালো কাপড়" পৃষ্ঠা নং ৪০৬-৪০৭ - "তল্লাসী" বানাটা একি পেজে ২ ভাবে লেখা আছে কয়েকবার। হবে "তল্লাসী"। পৃষ্ঠা নং ৪১৯ - "বিবাহ বাসর" লেখা। হবে "বিবাহ আসর"। পৃষ্ঠা নং ৬৮৬ - "অপরের দিকে" লেখা। হবে "উপরের দিকে"।
এবং আরো বেশ কিছু ভুল আছে। নোট নিতে মনে ছিল না।
নয়.
যে কোন বইয়ের আলোচনা সহৃদয়তা প্রকাশের মাধ্যমেই হওয়া দরকার। সেটা বইয়ের বিপক্ষে গেলেও। আমি প্রথমেই বলে নিয়েছি এবং আবারো বলি, বাসনা নেই, কিন্তু উপভো�� আছে - এটা যোগীর স্বভাব। পাঠকের দুটোই থাকে। উপভোগের প্রশ্নে মহাযাত্রা অবশ্যই দুর্দান্ত। বাসনা বা সেই প্রত্যাশার ক্ষেত্রে হয়তো পাঠকভেদে বিভেদ কিছুটা আসবে।
আলোচনাতো আর পাঠকের সিদ্ধান্ত না, বরং পাঠকালে পাঠকের মানে আমার বিস্ময়সূচক প্রশ্ন বা ভাবনাগুলোরই প্রতিফলন। আলোচনা মানেই কিছু প্রশ্নের উদয় এবং মাহাযাত্রার এই আলোচন সেইসব কিছু প্রশ্ন এবং বিস্ময়সূচক ভাবনাগুলোরই প্রতিফলন। সেসব বাদ দিয়ে দিবাকর দাসের "মহাযাত্রা" দারুন উপভোগ্য বই। চিরকুটের প্রোডাকশনও বরাবরের মতো দুর্দান্ত। তবে এতটাই দুর্দান্ত এবার যে রাউন্ড বাইন্ডিংয়ে বই মেলে পড়তে বেশ কষ্টই হয়েছে। লাভের লাভ এই যে কিছুটা ব্যায়াম হয়েছে। বই মেলে ধরার কষ্টে যে বাড়তি ক্যালরি ক্ষয় হয়েছে তাহার জন্যেও ধন্যবাদ। মেলায় যেয়ে হাকিম চ্ত্বরের ৪০ টাকার খিুচুড়ি আর মেলা শেষে ভাজাপোড়া নিশ্চিন্তে খাওয়া যাবে। সজল চৌধুরীর করা প্রচ্ছদও দারুন। তবে মহাকালের সিক্যুয়েল বলেই হয়তো আইডেন্টিক্যাল।
মহাকাল গতবার পড়েছি। মহাকালের পটভূমিকা ছিল ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত জুড়ে। প্রধান দুই শক্তি আর তাদের সহযোগী শক্তি। সে তুলনায় মহাযাত্রার অভিযান অনেক বিস্তৃত। কিন্তু সরলরৈখিক। মহাকালে অনেক জটিলতা ছিল, কুটিলতা ছিল। কিন্তু মহাযাত্রা একটা সরলরৈখিক পথে চলেছে। এখানে রুদ্রদেবের চরিত্র অনেকটাই উন্মোচিত। শেষে একদম উন্মোচিত। আর একটা ব্যাপার না বলে থাকা গেল না, যেটা হলো গল্প বলতে গিয়ে বইয়ের আয়তনের সঙ্গে লেখক কোন আপস করেন নি। এত বড় আকারের বই পড়তে গিয়ে পাঠকের কোন অসুবিধে হয় নি, বরঞ্চ সুবিধাই হয়েছে। ছোট ছোট চরিত্রগুলোও একটা রূপ পেয়েছে। কিন্তু কলেবরে বেড়ে যাওয়ার ফলে মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেটার কারনে বিক্রিও একটু কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু লেখক এ ব্যাপারে কোন আপস করেন নি। এখানেই একটা বইয়ের সার্থকতা।
মহাকালের দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে রুদ্রদেব ও তার শিষ্য অসিত পাড়ি দিচ্ছে আরেক দীর্ঘযাত্রায়। প্রিয় অঙ্গদকে না পাওয়া পর্যন্ত অসিতের রেহাই নেই। সেই লক্ষ্যে ভারত থেকে সমুদ্রপাড়ি দিয়ে তারা পৌছায় গ্ৰীসে। একই সময়ে গ্ৰীসের অন্দরমহলে চলছিলো বিদ্রোহ, রোমান সাম্রাজ্য থেকে নিজেদের স্বাধীন করার জন্য বিদ্রোহ। শক্তি ও বল দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যকে না ডিঙাতে পারলেও মনোবল তীব্র থেকে তীব্রতর হতে চলেছে এক শ্রেণির মানুষের। সেই লক্ষ্যেই চলছে তারা, দেবতার অর্চনাও বাদ যাইনি।
একই রাজ্যে ইভান ও তার বন্ধু ওরিয়েন খুব শীঘ্রই সেরা অভিজাত হতে চলেছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার মাধ্যমে। তবে কথায় আছে মন যখন প্রণয়ের গতিতে চলতে থাকে তখন মূল লক্ষ্য থেকে মনোযোগ সরতে সময় লাগে না। প্রেম , ভালোবাসা , নারী জাতের স্পর্শ পেয়ে ইভানের ভাগ্যের চাকা অন্যদিকে ঘুরতে সময় নেয় না। সেই চাকায় বন্ধু ওরিয়নও স্বাচ্ছন্দ্যে পিষে যায়।
সবকিছুর ডামাডোলে গ্ৰীসের পরাধীন রাজ্য স্পার্টাতে জেগে ওঠে যুদ্ধ দেবতা এরিস। ক্রোধ, লোভ, প্রতিহিংসা এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে যায় এই দেবতাকে যা থেকে সম্পূর্ণ রাজ্য এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার ভিতর নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। রুদ্রদেব ও অসিতের গ্ৰীস যাত্রা, বিদ্রোহের ডাক, ইভানের জীবনের নতুন ধাপ, দেবতার আবির্ভাব সবই ভিন্ন ঘটনা হলেও দীর্ঘযাত্রার শেষে একত্রে মিলিত হয়েছে।
মহাকাল ও মহাযাত্রা দু'টো বইয়ের মধ্যে লেখকের সবচেয়ে ভালো দিক লেগেছে যে অতিরিক্ত চরিত্র দিয়ে জগাখিচুড়ি করার চেষ্টা করা হয়নি। লেখনী, প্লট সবই ঠিকঠাক তবে প্রথম বই মহাকালের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি। যদি চরিত্রগুলো নিয়ে বলি, তবে রুদ্রদেব পছন্দের চরিত্র হয়ে থাকবে আমার কাছে।
"মহাকাল" তার পূর্ণতা পেলো "মহাযাত্রা"তে এসে! ২টা মিথোলজিকে অসাধারণ ভাবে একসাথে ফুটিয়ে তোলার জন্য দিবাকর দাদার অনেকটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই পথ যেন এখানেই শেষ না হয়, এটাই কামনা। ♥
📜🌟এ এক অনন্ত মহাযাত্রা পড়ে শেষ করলাম। অসাধারণ, অপূর্ব এই শব্দ গুলোও কম পড়ে যাবে বইটির জন্য। মহাকাল পড়ে এক বাক্যে বলেছিলাম ‘অসাধারণ'। মহাযাত্রা পড়ে এক বাক্যে ‹আমি আবারও ‘মুগ্ধ'›!
📜মহাকাল সম্পর্কে একটু না বললেই নয়📜 🪔রাজায় রাজায় যুদ্ধ, তাদের রাজনীতি, তাদের রাজ্য জয় এসব তো রয়েছেই। আর আমার যেটা ভীষণ ভালো লেগেছিলো সেটা হলো গল্পের বিশেষ চরিত্র গ্রামের ছেলে ‘অসিত’ আর তার বানর ‘অঙ্গদ’। অসিত তার বানর অঙ্গদকে নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলো, সেই সময় রাহুর চোখ পড়ে অঙ্গদ-এর উপর। রাহুর চোখ পড়া মাত্রই অসিতের থেকে অঙ্গদকে ছিনিয়ে নেয়। অসিত তার প্রিয় অঙ্গদের খোঁজে অজানা পথে যাত্রা শুরু করে ....তারপর শুরু হয় অসিতের অন্য জীবন যাপন। পথে দেখা যায় রুদ্রদেবর সাথে। তার পর থেকেই অসিতের জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন।
📜🌟রুদ্রদেব সম্পর্কে মহাকালে যতোটুকু জানা গিয়েছিলো..... 🪔একটা মানুষ যে কিনা তিন হাজার বছর অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছে। তিন হাজার বছর পর মহাদেবর আশীর্বাদে সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। স্বয়ং মহাদেব তার নামকরণ করে “রুদ্রদেব”! উপন্যাসে রুদ্রদেবের চরিত্র ভীষন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একজন দক্ষ তিরন্দাজ এবং একজন গুরু। উপন্যাসের শেষের দিকে এসে তিনি একজন যোগ্য সেনাপতি।
🪔মহাকাল শেষ করার পর লেখকের প্রতি একটু অভিমান হয়েছিল। কারণ এতো বড় একটা উপন্যাস পড়ার পর যখন বুঝতে পারি যে (এটা উপন্যাসের অর্ধেক অংশ, বাকি অংশ আসবে অন্য বই তে)! যাই হোক মহাকাল প্রকাশিত হওয়ার ৭ মাসের মধ্যেই সম্ভবত দ্বিতীয় পর্ব চলে আসে। আর আমাকে বেশ আপেক্ষাও করতে হয়নি। মহাযাত্রা হাতে পাওয়ার পর লেখকের প্রতি অভিমান মুছে গেছে। আর পড়ার পর তো আমি মুগ্ধ। 😊❤️
📜🌟মহাযাত্রা নিয়ে আলোচনা🌟📜
🪔খোঁজা থামিয়ে দিলেই পাবার আশা নিঃশেষ হয়ে যায়! তাই রুদ্রদেব আর অসিত অঙ্গদকে উদ্ধার করার জন্য বেড়িয়ে পরে......... অন্য দিকে রাহু অঙ্গদকে নিয়ে পশ্চিমের বন্দরে পাড়ি দিয়েছে.....নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিকল্পনায়। রাহুর মতো লোকের তো আর পৃথিবীতে অভাব নেই। অঙ্গদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে লোকে। রাহু বুঝতে পারে অঙ্গদকে এই ভাবে নিজের কাছে আর রাখা সম্ভব নয়.......
🏷️📜‘অঙ্গদকে উদ্ধার না করে সে ফিরে যাবে না’। অসিতের মনের তীব্র জেদ, অসিতকে এগিয়ে নিয়ে চলে অঙ্গদের কাছে.....রুদ্রদেবও শিষ্যকে ত্যাগ করতে পারে না। শিক্ষা শেষ হবার আগে কোন গুরুই শিষ্যকে ত্যাগ করে না। তাই যাত্রা পথেই চলতে থাকে অসিতের শিক্ষা..... অসিত কি শেষ পর্যন্ত অঙ্গদকে উদ্ধার করতে পারবে ? শেষ পর্যন্ত ��ি হয় সেটা জানতে হলে অবশ্যই উপন্যাসটি পড়তে হবে। এই উপন্যাস প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
🏷️📜উপন্যাসের মধ্যে অনেক কিছু আছে, সে সব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই এতোটুকুই থাক। রুদ্রদেব আসলেই কে তা প্রকাশ্যে এলো একদম শেষ মুহূর্তে। রুদ্রদেবর শিক্ষা প্রদান করার এতো সুন্দর কৌশল, যে কেউ পড়েই মুগ্ধ হতে বাধ্য হবে। লম্বা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এই উপন্যাস পড়ে শেষ করার পর একটা আলাদাই অনুভূতি তৈরি হয়েছে, ভীষণ ভালো লেগেছে।
💐লেখককে অনেক ধন্যবাদ। আপনার লেখার দীর্ঘায়ু কামনা করি। ভালো থাকবেন........
📌হতাশা পাশে ঠেলে দিয়ে নতুন লক্ষ্য স্থির করাই সফলতার শর্ত!
📌বিদ্যা হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। আসলে কোনোকিছুই পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। বিশেষ করে জ্ঞান। কেবল লুকিয়ে থাকে। যে সন্ধান করতে পারে সে একসময় সেটা খুঁজে পায়!
📌'কোনো তালাই যেমন চাবি ছাড়া তৈরি করা হয়নি, তেমনি কোন সমস্যাই সমাধান ছাড়া জীবনে আসে না!
📌দুর্ভাগ্য বন্যার জলের মতো। যখন আসে হুড়হুড় করে কেবল ঢুকতেই থাকে। তারপর মানুষ কেবল অপেক্ষাই করতে পারে। কখন জল ঢোকা বন্ধ হবে আর কখন সেই জল নেমে গিয়ে দুই দণ্ড শান্তি দেবে তাকে। এছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। প্রকৃতির খেয়ালের কাছে মানুষ যেমন অসহায় তেমনি ভাগ্যের কাছেও!
📌মানুষের জীবনে বিপদ তো আসবেই। সে যা চায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হবে না। কিন্তু এসব মেনে নিয়ে যে হাসি মুখে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পারে সেই তো আসল সিদ্ধপুরুষ। সেই তো আসল মানুষ!
🥳🗒️2024 Book Review ~ 25 আবারো দেখা হবে পরের রিভিউতে। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন আর অনেক অনেক বই পড়ুন। ধন্যবাদ 🙂🙏
বহুদিন পর একটা মৌলিক সিরিজ পড়লাম যার ওয়ার্ল্ড লেভেল মুভি হবার সামর্থ্য আছে। হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা,দেয়াল,শঙ্খনীল কারাগার যেমন তাকে বাংলা সাহিত্যে আজীবন বাচিয়ে রাখবে, হয়তোবা তেমন লেজেন্ডারী লেভেলের কাজই করে দেখালেন লেখক।বাকীটা সময়ই বলে দেবে। অসাধারণ একটা সিরিজের সমাপ্তি ঘটলো, চিরায়ত উপন্যাসের রূপ ধরে ধীরে ধীরে ফ্যান্টাসী, মিথলজি,থ্রিলার,এডভেঞ্চার কি নেই এই বইয়ে। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই মিথলজীর এতো সুন্দর মিশেল পুরো অসম্ভব রকম সুন্দর ছিলো। লেখকের পরবর্তী বইয়ের জন্য শুভকামনা এবং অনুরোধ রইলো এই সিরিজের অবসান এখানেই করার জন্য।
মহাযাত্রা আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে অন্যতম বড় একটা বই। লেখক মহাকালের পর মহাযাত্রার যাত্রা চমৎকার ভাবেই সম্পন্ন করেছেন.... দারুন কাজ হয়েছে...তবে মহাযাত্রার যাত্রায় দিবাকর দাদা কামের ফাঁদে পরেছেন পাঠকদেরকেও ভালভাবেই ফেলেছেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। রোমান, গ্রীক, ভারতীয় পৌরাণিক সাথে প্রেম,যুদ্ধ,ইতিহাস,ধর্ম,সাগর সব মিলিয়ে পাঠকদের মহাযাত্রার যাত্রা নি:সন্দেহে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে 🖤
জনরা: ঐতিহাসিক থ্রিলার মহাকাল পড়ার পর প্রত্যাশা একটু বেশিই ছিল। মহাকাল ৫ দিয়েছিলাম এটায় একটু কমে গেল। দিন তারিখের হিসাব কেমন যেন এলোমেলো লাগলো। আগের বইটা থেকে এটা পরিচিত ছকে এগিয়েছে মনে হয়েছে (কম চমকিয়েছি)। তারপরও সব মিলিয়ে উপভোগ্য ভ্রমণ ছিল৷ তবে বাচ্চাদের জন্য এ ভ্রমণ নিষিদ্ধ। বাকিদের মহাযাত্রায় স্বাগতম।
মহাকাল পড়ে যতটা ভালো লেগেছিল, মহাযাত্রায় এসে সেই হিসেবে হতাশ হয়েছি বলা চলে। প্রথম দিকের কাহিনী গঠন আর শেষের দিকে ending এর মধ্যে অনেক পার্থক্য মনে হয়েছে। পুরো উপন্যাস শেষ করার পর মনে হচ্ছিল লেখক খুব তাড়াহুড়ো করে গল্প শেষ করেছেন। কিছু কিছু যায়গায় একেবারেই যুক্তিহীন মনে হয়েছে। অসিতের তিন বছর এরই মধ্যে শেষ হবার কথা, কিন্তু বোঝানো হচ্ছে যে আরো কিছুটা সময় বাকি, এটাও অযৌক্তিক। অ্যালেস্টরের বাড়িতে গিয়ে নিকোলাস এর ঘোরের মধ্যেও পায়াসের বাড়ির নকশা দেখে অ্যালেস্টরের পরিকল্পনা বুঝে যাওয়ার বিষয়টা অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং হাস্যকর হয়েছে। প্রথম থেকে শেইরনের গাম্ভীর্য ও চারিত্রিক গঠনের সাথে শেষে এসে তার অবদানের সাথে কেনো যেনো মিলেনি। সব শেষে ইভান আর ইনোনের ইন্ডিংটা একেবারেই সাদামাটা হয়েছে, প্রথম থেকে পড়তে পড়তে আশা করেছিলাম নিশ্চয়ই শেষে ইভান গভর্নর হবে। ডোরার মৃত্যুটাও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার খুব একটা ভালো লাগে নি। পুরো উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল রুদ্রদেবের আসল পরিচয়। সেটা জানতে হলে মহাযাত্রা পড়তেই হবে।
This entire review has been hidden because of spoilers.