গোয়েন্দা অনেকেই, কিন্তু জাদুকর গোয়েন্দা একজনই— ম্যাজিসিয়ান কিকিরা। হুডিনির হাত আর শার্লক হোমস-এর মাথা, এ-দুইয়ের বিরল সংমিশ্রণে তৈরি যেন বিমল কর-এর এই অনন্য গোয়েন্দা চরিত্রটি। আসল নাম কিঙ্করকিশোর রায়। লোকে ছোট করে বলে, কিকিরা দি গ্রেট। একদা ছিলেন দুর্দান্ত ম্যাজিসিয়ান, এখন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। ফলে, কিকিরার গোয়েন্দাগিরির কাহিনির স্বাদই আলাদা। রহস্যের মধ্যে মিশে থাকে তন্ত্রমন্ত্রের নামে ভয়ংকর সব ব্যাপারস্যাপার কিংবা অলৌকিক বহু কাণ্ডকারখানা। ম্যাজিসিয়ান বলেই এইসব বুজরুকি আর ভেলকিবাজির কৌশল শেষ পর্যন্ত ধরেও ফেলেন কিকিরা। সঙ্গে তারাপদ আর চন্দন, কিকিরার দুই সুযোগ্য সহযোগী। এই ত্রিমূর্তিরই বুদ্ধিদীপ্ত এবং বৈচিত্র্যময় নানান কাহিনি নিয়ে এবার খণ্ডে-খণ্ডে বেরুচ্ছে ‘কিকিরা সমগ্র’।
এই প্রথম খণ্ডে রয়েছে পাঁচ-পাঁচটি উপন্যাস : ‘কাপালিকরা এখনও আছে’, ‘রাজবাড়ির ছোরা’, ‘ঘোড়া সাহেবের কুঠি’, ‘সেই অদৃশ্য লোকটি’ এবং ‘শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা’।
Bimal Kar (Bengali: বিমল কর) was an eminent Bengali writer and novelist. He received 1975 Sahitya Akademi Award in Bengali, by Sahitya Akademi, India's National Academy of Letters, for his novel Asamay.
বিমল কর-এর জন্ম ৩ আশ্বিন ১৩২৮। ইংরেজি ১৯২১। শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। জব্বলপুর, হাজারিবাগ, গোমো, ধানবাদ, আসানসোল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কর্মজীবন: ১৯৪২ সালে এ. আর. পি-তে ও ১৯৪৩ সালে আসানসোলে মিউনিশান প্রোডাকশন ডিপোয়। ১৯৪৪-এ রেলওয়ের চাকরি নিয়ে কাশী। মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরাগ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক, পরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকা ও ‘সত্যযুগ’-এর সাব-এডিটর। এ-সবই ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে। ১৯৫৪-১৯৮২ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮২-১৯৮৪ ‘শিলাদিত্য’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক। বহু পুরস্কার। আনন্দ পুরস্কার ১৯৬৭ এবং ১৯৯২। অকাদেমি পুরস্কার ১৯৭৫। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ১৯৮১। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার ১৯৮২। ‘ছোটগল্প—নতুন রীতি’ আন্দোলনের প্রবক্তা।
গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাসে বিমল করের চেয়ে আন্ডার-কনফিডেন্ট লেখক খুঁজে পাওয়া বিরল। আনন্দ গোষ্ঠীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে কিশোর কাহিনী লিখেছেন অনেকেই। দায়ে পড়ে, ফরমায়েশে, জন্মেছে কাকাবাবু থেকে অদ্ভুতুড়ে সবই। তবে নিজ সৃষ্ট চরিত্রের প্রতি এতটা সংশয় দর্শনীয়। কিকিরা সমগ্রের প্রতিটি খন্ডের শুরুতেই বেশ অপরাধীর মতো কাচুমাচু হয়ে পাঠকের সামনে দাঁড়িয়েছেন লেখক। 'কি আর করা যাবে' গোছের একটা মুচকি হাসি হেসে বলেছেন একটাই কথা।
"কিকিরা পেশাদার গোয়েন্দা নয়। কিকিরার কোনো গল্পকেই সেভাবে গোয়েন্দা-কাহিনী বলা যাবে না। কাজেই গোয়েন্দা-কাহিনী পড়ার কৌতূহল এই ধরনের গল্পে মেটার কথাও নয়৷ অপরাধমূলক কাহিনী বলতে যা বোঝায় কিকিরার গল্প মোটামুটি সেই জাতের।"
দেখতে গেলে, খুব একটা অত্যুক্তি করেননি লেখক। কাহিনীগুলো কালজয়ী সাহিত্য নয়। সার্থক ডিটেক্টিভ থ্রিলার আরও নয়। গোয়েন্দা গল্পের এনসাইক্লোপিডিয়ায় কিকিরা স্রেফ ফুটনোট হয়েই রয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। তবুও, অন্যতম প্রিয় লেখক বলে কথা। পড়ে দেখাটা কর্তব্য বলে মনে করি। অবশ্য, বয়স থাকতে কিকিরা পড়া হয়নি কোনোকালেই। যদ্দিনে আনন্দমেলা কিনতে শুরু করি, বিমল কর গত হয়েছেন বহুদিন। এই ম্যাজিশিয়ান গোয়েন্দাটি তাই কোনোদিনও র্যাডারেই আসেনি আমার। অতএব...
চরিত্র হিসেবে কিকিরা মন্দ নয়। পুরো নাম, কিঙ্কর কিশোর রায়। অদ্ভুত দর্শন মানুষ। রিটায়ার্ড জাদুকর। ঢ্যাঙাপড়া রোগাটে চেহারা, অবিন্যস্ত চুল, পরনে সর্বদা ঝোলা আলখাল্লা। সাথে একেনবাবুর ন্যায় শন্তিপুরী বিনয় ও 'স্যার' সম্বোধন। এরই মাঝে ঝলক দেয় তীক্ষ্ম বুদ্ধির আভাস। বলাই বাহুল্য, লেখক নায়ক-রূপে বেশ ইউনিক একটি চরিত্রের অবতারণা করেছিলেন সেই সময়। তবে বইয়ের ব্লার্ব অনুযায়ী, কিকিরাকে একেবারে হুডিনি ও শার্লকের মোক্ষম কম্বিনেশন বলে দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।
সে যাই হোক। বইতে সংকলিত হয়েছে, পাঁচটি উপন্যাস। সিরিজের প্রথম অভিযান, 'কাপালিকরা এখনও আছে' লেখা হয়েছিল আনন্দমেলায় ধারাবাহিক হিসেবে। শব্দসংখ্যার যাবতীয় শৃঙ্খলের অভাবে বেশ সময় নিয়ে গপ্পো ফেদেছিলেন লেখক। এই গল্পেই তারাপদ ও চন্দনের সাথে কিকিরার প্রথম পরিচয়। রহস্য ও অলৌকিকের আবেশে, গল্পটি শুরু হয় বেশ, তবে বিশ্রী ক্লাইম্যাক্সের দরুণ প্রাথমিক থ্রিলের রেষটুকু বজায় থাকে না শেষমেশ।
দুঃখের বিষয়, ব্যাপারটা, প্রায় সব গল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রায় প্রতিটি কাহিনীই শুরু হয় চমৎকার। ভালো লাগে, কিকিরা-তারাপদ-চন্দন ত্রয়ীর সহজাত কেমিস্ট্রি ও অফুরন্ত বাৎসল্য-ভাব। বলিষ্ঠ লিখিয়ে, বিমল কর। ওনার কলমে, প্রতিটি পটভূমির স্থান-মাহাত্ম ঠিকরে ওঠে যেন। বর্ণনা শক্তির বাইরেও স্রেফ সাবলীল সংলাপ দিয়ে রহস্য জমিয়ে তোলেন তিনি।
বাঁধ সাধে, রেজোলিউশনে। এখানেই বারংবার লাইনচ্যুত হয় ট্রেন। কোনো সিস্টেম্যাটিক পন্থায়, ধীরেসুস্থে রহস্য উদঘাটনের পথে হাঁটেন না লেখক। মিশরীয় মমির ব্যান্ডেজ খোলার মতো ধাপে-ধাপে প্রহেলিকার জট না খুলে, অতীব তাড়াহুড়োয় গুটিয়ে নেন সুতো। আচমকাই, ফুরিয়ে যায় একেকটি প্রতিশ্রুতিশীল কাহিনী। পাঠক মন ভরেও ভরে ওঠে না তাই। দৃষ্টান্ত হিসেবে, 'রাজবাড়ির ছোড়া' নামক দ্বিতীয় উপন্যাসটি বিশেষ দ্রষ্টব্য। উপরোক্ত সমস্ত অভিযোগ, বেশ চড়া দাগে ফুটে ওঠে এই লেখাটিতে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে, আমার সবচেয়ে অপছন্দের গল্প এটি। সামান্য বিরক্তিকরও বটে।
তবে, আর চারটি গল্পে, অন্ধ-বিশ্বাস ও বুজরুকির বিরুদ্ধে কিকিরার সক্রিয় প্রতিরোধ বেশ উপভোগ্য। কোথাও ভন্ড কাপালিক তো কোথাও প্রেতসিদ্ধ তান্ত্রিক। পুনর্জীবিত মৃত মানুষ থেকে শূন্যে বিলীয়মান মৃতদেহ! আপাত অর্থে কিছু অসম্ভব ঘটনার পেছনে লজিকের স্থিতধী বিশ্লেষণে বাজিমাত করেন কিকিরা। কতকটা, 'ভবানন্দের লীলাসাঙ্গ' গোছের আস্ফালন যেন। ধূলিসাৎ হয় ভেলকিবাজি। খারাপ লাগে না পড়তে।
চারটির মাঝে, 'শুদ্ধানন্দ প্রেতসিদ্ধ ও কিকিরা' ও 'ঘোড়া সাহেবের কুঠি' উপন্যাসদুটি দিব্যি লাগলো। আরেকটু ছোট বয়সে পড়লে আরও বেশি চমকে উঠতাম, এটা মানি। তবে, গল্পগুলির কোনো রিপিট ভ্যালু নেই। আজ থেকে বছর খানেক বাদে, কোনো মন খারাপের সকালে কি বিষণ্ন বিকেলে এই গল্পগুলোর কাছে আমি সদিচ্ছায় ফিরে আসবো না, এই যা। তা স্বত্বেও সিরিজটা আমি ভবিষ্যতে পড়ে যাবো। কিকিরার খাতিরে না হলেও, স্রেফ বিমল করের জন্যেই নাহয় পড়বো সবটা। সার্থক রহস্য কাহিনীর থ্রিল না পেলেই বা, প্রিয় লেখকের খাতিরে, এটুকু সহ্য করাই যায়! কি বলেন?
ব্যোমকেশ বক্সী আর ফেলু মিত্তিরের মতো কালজয়ী গোয়েন্দা, এবং আরো ভালো ভালো বাংলা রহস্য গল্প পড়বার পর কিকিরা টা জমলো না বলবো না, একেবারে মাঠে মারা গেলো| কিভাবে পুরোটা পড়লাম জানি না! আতঙ্কের বিষয়, একসাথে প্রথম ২ টি খন্ড কিনেছি, তাই দ্বিতীয় খন্ডটিকেও কিছু সময় দিয়ে মানরক্ষা করতে হবে|
বই - কিকিরা সমগ্র খণ্ড ১ লেখক - বিমল কর প্রকাশক - আনন্দ মূল্য - ₹৩৫০/-
কিকিরার গল্পগুলি সমগ্র আকারে কোনোদিন পড়া হয়ে ওঠেনি। তারওপর আছে আনন্দের না ছাপা থাকা বই/ বাজারে না পাওয়া যাওয়া বই - এসব ঝামেলা। শেষ অব্দি Amarendra Pal ভাইয়ের কাছে পাই বইটি এবং শুরু থেকেই শুরু করি পড়তে।
✍️এই প্রথম খন্ডে পাঁচটি উপন্যাস ঠাঁই পেয়েছে। শুরু থেকে পড়লেই ভালো কারণ কিকিরার অন্যতম দুটি চরিত্র তারাপদ আর চন্দনের সাথে কিকিরা দ্য ওয়ান্ডার এর কিভাবে দেখা হলো, আলাপ হলো সেগুলো স্পষ্ট হবে।
✍️ লেখনী নিয়ে বলতে গেলে কোনো প্রয়োজন নেই আশা করি। আমরা কম বেশি সকলেই এনার লেখার ভক্ত। সহজ ভাষায় কি দারুন লেখেন। বিরাট কিছু জটিল রহস্য না, কিন্তু অদ্ভুত এক আকর্ষণ পাতার পর পাতা উল্টাতে বাধ্য করে।
✍️কমবেশি সব রহস্যগুলির জট পারাবারিক অশান্তি। কিন্তু রহস্যের উন্মোচন বেশ নাটকীয় এবং রোমাঞ্চকর। কোনরকম অস্ত্রছাড়া শুধুমাত্র বুদ্ধির বলে মানুষ কতটা জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে -কিকিরা মহাশয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
✍️বেশিরভাগ গল্পে আসানসোল, যশিডি, কালীপাহাড়ী - মানে আমার বাড়ির দিকের সব জায়গাগুলোর উল্লেখ পড়ার উৎসাহ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
✍️ আলাদা আলাদা করে বলবনা, সবগুলি ভালো লেগেছে আমার। খুব বেশি করে বললে, ঘোড়া সাহেবের কুঠি, সেই অদৃশ্য লোকটি বেশি ভালো লেগেছে।
লেখার হাত ভালো হলেও চরিত্রায়ন কখনও কখনও খুবই নাটকীয়। নায়ক কিকিরাকে শেষ অবধি পাঠকের কাছে সম্পূর্নভাবে মেলে ধরতে না পারাটা লেখকেরই ব্যর্থতা বলে আমার মনে হয়। তবে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এধরনের লেখা আরো অনেক দরকার ।