সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল ব্রিটেন ও এশিয়ার বৃহত্তম এবং সবথেকে ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয় ব্রিটেনের বাজারের জন্য এশিয়ার পণ্য কিনবার উদ্দেশ্য নিয়ে। এই কেনাবেচার পরিণাম পারস্য থেকে ইন্দোনেশিয়া, এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে প্রায় নাটকীয়ভাবে কোম্পানি ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। রাজনীতি ও বাণিজ্যের মধ্যে যে জটিল পরস্পরনির্ভরতা থেকে ভারতে ব্রিটিশ রাজের শুরু, তাই নিয়ে এই বই। সাম্প্রতিক গবেষণা ও ঐতিহাসিক তথ্যের সমন্বয় করে লেখক আরো দেখিয়েছেন যে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে কোম্পানির তাৎপর্য কোথায়, কীভাবে উনিশ শতকের বিশ্বায়ন ভারতে ব্যবসার কাঠামো বদলে দেয়, আর এই পরিবর্তনের প্রভাব কেন সুদূরপ্রসারী।
১৬০০ সালের শেষে কোনোএক দিন গঠিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও টাকাকড়ি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মোটাদাগে দু'ধরনের লেখাজোখা মেলে। এক পক্ষ কোম্পানির বিরুদ্ধে সরাসরি কলমি জং ঘোষণা করলেও, অপরপক্ষ কোম্পানি শাসনের গুণগানের নহর বইয়ে দেয়। আর তাতে পাঠক পায় ফক্কা।
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের পন্ডিত তীর্থঙ্কর রায়ের বইটা ভালোই আগাচ্ছিল। একেবারে কোম্পানির গোড়ার কথা বলতে বলতে আগাচ্ছিলেন। সাথে বোনাস হিসেবে ছিল প্রাসঙ্গিক দুর্লভ সব ছবি। ভাবতেই বসেছিলাম এই বুঝি নিরপেক্ষ একটি দৃষ্টিকোণ পেলাম। না,স্বপ্নভঙ্গ হল। সিরাজউদ্দৌলার অন্ধকূপ হত্যার প্রোপাগান্ডাকে যখন তিনি হাইলাইট করলেন, তখনই হকচকিয়ে গেলাম। এতো পন্ডিত লোক লেখক, অথচ জানেন না অন্ধকূপ হত্যার প্রোপাগান্ডাকে সেই কবেই সাক্ষ্যপ্রমাণে উড়িয়ে দিয়েছেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়!
আরো সামনে দেখি কোম্পানির রীতিমত কীর্তন শোনাতে বসেছেন লেখক!
প্রকাশ হতে না হতে তুমুল জনপ্রিয়/বিখ্যাত হয়ে যাওয়া বইয়ের তালিকায় আছে এটা। মানে এই তালিকা কেউ করছে এমন না, মানসিক তালিকা আরকি। ১৮০ পৃষ্ঠার বইপা বর্তমানে দুর্মূল্যই বলা যায়। বইটার প্রেজেন্টেশন এবং সেটার বিস্তৃতি দেখে মনে হইছিল বইটা না জানি কী। পড়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। কিন্তু পড়ার পর মনে হইলো বইটা আরো অনেক অনেক ভালো হইতে পারত। যা যা খারাপ তার পেছনে আনন্দ প্রকাশনীর সম্পাদনার কিছু ত্রুটি আছে। বইয়ে কিছু শব্দ যে বিষয়টা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হইছে তা পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ করতে পারে নাই।
এর বাইরে তীর্থঙ্কর রায় একদিকে অর্থনীতির কিছু জটিল বিষয় দেখাইতে চাইছেন কিন্তু সেটাও ইলাবোরেটলি করেন নাই। করলে বইটা অনেক ভালো হইত। 'বিটিশ' কোম্পানির ইতিহাস, ক্লাইভ, হেস্টিংস, কলকাতা, সিরাজ, সুতানুটি নিয়া সামান্য হলেও জানি আর সেই কারণে বলতেছি যে বইটা কিছু জিনিস ছুঁয়ে গেছে কিন্তু সেগুলো সেন্স মেইক করতে করতে করে নাই। কিছু বিষয় লেখক নতুন করে বা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চাইছেন কিন্তু সেটা বোঝানোর জন্য আরো বেশি বিস্তৃতি দরকার ছিল। আর এভাবেই যদি লেখার ছিল, এই মাপের বইয়ের রেফারেন্সিংটা স্ট্রং হওয়া দরকার ছিল। এই সংস্করণে সেটা দেখি নাই।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি! নাম শোনেনি এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। নাম শুনেই আন্দাজ করা যায় ব্যবসায় সংক্রান্ত কোনো প্রতিষ্ঠান। এমন একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পরিচয়টা কেন শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়? ভারতের বিশাল অর্থনীতির তুলনায় ইন্দো-ইয়োরোপীয় কতিপয় কোম্পানি, ধরতে গেলে এরা যৎসামান্য, কেনোই বা দীর্ঘদিন টিকে থাকলো এই ছোট ব্যবসায়িক সংগঠন? কিংবা ভারতে যখন কোম্পানি ক্রমবর্ধমান এবং ভারতের শাসন ব্যবস্থা তখন ক্ষয়িষ্ণু, এই সুযোগকে কিভাবেই বা কাজে লাগালো কোম্পানি? মোদ্দাকথা কোম্পানির মধ্যে কি এমন ছিল যে দীর্ঘদিনের পুরোনো ব্যবস্থা সমূলে ভেঙে পড়লো, এই সবগুলো প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরগুলো পাওয়া যেতে পারে এই বইয়ে। হ্যাপি রিডিং 💙
"স্মিথই প্রথম ইন্টেলেকচুয়াল নন যিনি কোম্পানির চার্টারের কারণে স্বাধীন ব্যাবসা কত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই প্রসঙ্গ আলোচনা করেন। তবে স্মিথই প্রথম এই আলোচনায় বাংলার অর্থনীতিতে কত ক্ষয় হয়েছে সেই বিষয় টেনে আনেন। কোম্পানি তাঁর দৃষ্টিতে একটি বিশেষ ধরনের একচেটিয়া ব্যাবসা। একচেটিয়া ব্যাবসা যথেষ্ট খারাপ, আরও অনেক বেশি খারাপ এমন একচেটিয়া ব্যাবসা যাদের হাতে রয়েছে সরকার চালানোর দায়িত্ব। স্মিথ দেখালেন যে এর ফলে ইংল্যান্ডের বাজারে ভারতীয় দ্রব্য অহেতুক বেশি দামে বিক্রি হয়। আর শাসনব্যবস্থার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় সাধারণের হিত- সাধনের জায়গায় ব্যক্তিবিশেষের লাভ- সাধন। শুধু তাই নয়, এ ধরনের দু’মুখো প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত বাজার নষ্ট করে ছাড়ে। ‘ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ্যচালনায় ব্যর্থ; রাজ্যচালনার মনোবৃত্তির কারণে ব্যবসায় ব্যর্থ।’ যুদ্ধ আর রাজনীতিক প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে গিয়ে কোম্পানি দেউলে হওয়ার পথে, আর ক্রমাগত সরকারি সহযোগিতা ও দানের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। স্মিথের এই মতামত অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।" -ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস
ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস এর সাথে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক সুতায় বাধা। তাই যখন লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স এর অধ্যাপকের লেখা পেলাম তখন পড়ার জন্য ঝাপিয়ে পডেছি। কিন্তু আমি হতাশ। লেখকের গবেষনা অসাধারন কিন্তু তিনি যখন বলেন ভারত Technology ও এ সংক্রান্ত পরিসেবার জন্য ইংল্যান্ডকে অর্থ দিয়েছে , উপনিবেশ হওয়ার জন্য না বা ইংরেজ উপনিবেশ হওয়ার জন্য সাধারন ভারতীয়দের কোন ক্ষতি হয়নি তখন মাথায় প্রথম প্রশ্ন আসে এর দালীলিক প্রমান কই? উনি বলেছেন অনেক গবেষনা কিন্তু একটি গবেষনাও উল্লেখ করেন নি। তাহলে এ প্রশ্ন আসে ইংরেজরা রেল লাইন, বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অন্য উপনিবেশে করেনি কেন? ভারতে করেছে কারণ return আসবে অনেক বেশী। ওনার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন উনি অন্ধকূপ হত্যার মত প্রমানিত যঘন্য মিথ্যাচারকে fact হিসেবে চালান।