Jump to ratings and reviews
Rate this book

মৃত্যুক্ষুধা

Rate this book
মৃত্যুক্ষুধা কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি উপন্যাস। এটি ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি সওগাত পত্রিকায় ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ‍ধারাবাহিক ভাবে মুদ্রিত হয়।

161 pages, Kindle Edition

First published August 1, 1930

59 people are currently reading
911 people want to read

About the author

Kazi Nazrul Islam

161 books273 followers
Kazi Nazrul Islam (Bengali: কাজী নজরুল ইসলাম) was a Bengali poet, musician and revolutionary who pioneered poetic works espousing intense spiritual rebellion against fascism and oppression. His poetry and nationalist activism earned him the popular title of Bidrohi Kobi (Rebel Poet). Accomplishing a large body of acclaimed works through his life, Nazrul is officially recognised as the national poet of Bangladesh and commemorated in India.

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
211 (47%)
4 stars
161 (36%)
3 stars
53 (11%)
2 stars
9 (2%)
1 star
12 (2%)
Displaying 1 - 30 of 51 reviews
Profile Image for Yeasin Reza.
508 reviews85 followers
November 9, 2022
কাজী নজরুল ইসলাম কবি হিসাবে বিশেষভাবে আখ্যায়িত তবে ঔপন্যাসিক হিসেবে যে তিনি অনেক শক্তিশালী ছিলেন তা "মৃত্যুক্ষুধা " পড়লেই বুঝা যায়।অভাব আর দারিদ্র কিভাবে একটি মানুষকে তার জন্মার্জিত ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কার থেকে দূরে ঢেলে দেয় এবং আত্মরক্ষায় যে কোনো ধরনের প্রবৃত্তিতে প্রলুব্ধ করে তার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি দৃশ্যায়িত হয়েছে নজরুলের এ উপন্যাসে, যা দেখে আমি সত্যই বিস্মিত হয়েছি। পেট, ক্ষুধা, তৃষ্ণা এই বিষয় গুলোর জন্যই মানুষ ক্রিয়াশীল। এসবের তাড়না আর জীবন রক্ষার নিমিত্তে একজন মানুষ সব করতে পারে তাতে তার বিন্দুমাত্র বাধে না। যা সত্য এবং স্বাভাবিক ঠিক তাই নজরুল তার লেখায় তুলে ধরেছেন। পক্ষান্তরে নিম্নশ্রেনীর স্বার্থ রক্ষার্থে যে সব নেতা কর্মীরা তাদের নিজের জীবন উৎস্বর্গ করেছে তাদেরই পোহাতে হয়েছে সর্বময় যন্ত্রণা। ফেরারি হয়ে তাদের বেড়াতে হয়েছে, প্রেম ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। এসব তৎকালীন বাস্তব সমাজ ব্যবস্থার ইঙ্গিত বহন করে চলেছে। মূলত আমার মতে এই উপন্যাসে কাজী নজরুলের নিজে ব্যাক্তি জীবনের দ্বৈতসত্ত্বা পাশাপাশি বিরাজমান আছে। একটা অভাব,দারিদ্র্য অন্যটি সংগ্রামী চেতনা। উপন্যাসটি পড়ে আমি বেশ বিস্মিত হয়েছি কখনো কখনো নিজের অজান্তে চোখের কোনে পানি চলে এসেছে।যদি মহাকালের সমস্ত বিস্মরণ ঘনীভূত হয়ে নজরুলকে স্মৃতিভ্রষ্ট অসহায় শিশু বানিয়ে না দিতো তাহলে বোধহয় বাংলা সাহিত্যে নজরুল উপন্যাসিক কিংবা গল্পকার হিসেবে ও অতি শক্তিশালী স্থান আদায় করে নিতে পারতেন। এই উপন্যাস অনেক বিচারেই পাঁচ তারকার হয়তো প্রাপ্য না,কিন্তু মানুষের প্রধান ত্রুটি এবং গুণ হচ্ছে সে আবেগকে প্রায়শই যুক্তির উপর স্থান দেয়। মানুৃষ হিসেবে আবেগময় চিহ্নিত হতে এখন আর লজ্জা বোধ করিনা।
Profile Image for Momin আহমেদ .
112 reviews49 followers
February 17, 2021
এই বই রেটিং করার ঊর্ধ্বে।
এই ৮০ পেজের বিশালতা বর্ণনা করবো তাও আমার পক্ষে সম্ভব না। একদম বিহ্বল হয়ে আছি।
Profile Image for Rubell.
188 reviews23 followers
April 20, 2022
He asked, "Are you Hindu or Muslim?"
Response came, "I am hungry sir!"

দুই লাইনের এই বিখ্যাত ছোটগল্প দিয়ে মৃত্যুক্ষুধার মূলভাবটা বর্ণনা করা যায়।

ক্ষুধাজর্জরিত কিছু মুসলিম যদি খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছ থেকে খাবার পাওয়ার আশায় ধর্মান্তরিত হয়; সেটা কি মুসলিমের চোখে বিরাট অধঃপতন হবে?

ক্ষুধার জ্বালা যে কী জ্বালা, তা যদি একটা দিনের জন্যও বুঝতিস, তাহলে পৃথিবীর কোন পাপীকেই ঘৃণা করতে পারতিসনে।

নজরুলের সাম্যবাদী নায়ক আনসার বলছেন এই কথা। যার পিছে ব্রিটিশ ভারতের পুলিশ লেগে থাকে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা। গুজব আছে সে নাকি বলশেভিক রাশিয়ার চর। আনসার সদাহাস্যজ্বল, সে তুখোড় বক্তা, প্রেমিক, রসিক, চা-খোর, কথার ধরণে বোঝা যায় তার মাঝে কবিত্ব আছে, তবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়- ক্ষুধার্থ মানুষদের জন্য সে জীবন উৎসর্গ করেছে।

আমাদের জানা তথ্যমতে নায়ককে অন্তত দুইজন রমণী ভালোবাসে- একজন গোপনে, একজন প্রকাশ্যে। তারা উভয়ই ডাকসাইটে সুন্দরী, কঠোর চারিত্রিক দৃড়তার অধিকারিণী, তবে হৃদয় তাদের কোমল,দয়ায় আর্দ্র! বিশেষ দ্রষ্টব্য হচ্ছে এই দুই রমণী নায়ক আনসারকে একজন আকর্ষণীয় পুরুষ ভেবে ভালোবাসে না, তাদের চোখে সে দেবতার মত!

কেমন ফিশি ফিশি লাগছে না? মনে হচ্ছে নজরুল নিজের চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নায়ককে তৈরি করেছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু কল্পিত হিরোইজম। আর একটা ফ্যান্টাসি, রমণীরা ভালোবাসুক তাকে মুগ্ধ বিস্ময়ে, তাকে মানুষ না ভেবে ভাবুক ফেরেশতা!

ফিকশনাল উপন্যাসই তো লিখেছেন, প্রবন্ধ তো নয়! মনে মনেই যদি পায়েস খাবো চামচ দিয়ে খেতে যাবো কেন? কোদাল দিয়ে গাপুসগুপুস খাবো। এমন ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন মনে হয়।

প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস। প্রথম ৯০ শতাংশ পাঁচে পাঁচ তারা ছিল আমার কাছে। ক্ষুধাজর্জরিত মানুষের সংগ্রাম, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, ধর্মবিশ্বাস নিয়ে উত্তেজনা, এসবের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ভালোবাসা, প্রেম, আর কিঞ্চিত রঙ্গরসিকতা- সবকিছু ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। ভাবছিলাম এই মাস্টারপিস আগে কেন পড়িনি! কিন্তু শেষ দশ শতাংশে উপন্যাসের প্লটটা ঝুলে গেল। ক্ষুধাপীড়িত সাধারণ মানুষের সংগ্রাম থেকে ফোকাস সরে গেল দেবতুল্য নায়কের ট্র্যাজিক প্রেমের দিকে।

খসে গেল একটা তারা।
৪/৫
Profile Image for Aishu Rehman.
1,093 reviews1,079 followers
October 24, 2020
খ্রীস্টান মিশনারি এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার কলহ-বিবাদ, ধর্মীয় মতভেদ, আর্থিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিত্যদিনের জীবন প্রবাহ সব মিলিয়ে নজরুলের মানবিক চৈতন্যের যে বিদগ্ধ রচনাশৈলী তারই সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি এ্ই মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস। একেবারে কাছ থেকে দেখা সাধারণ মানুষের জীবন-ঘনিষ্ঠতার যে যথার্থ অবয়ব নজরুলের সৃজন-দ্যোতনায় গতি পায় তারই বিশিষ্ট আয়োজন তার এই উপন্যাসটি। উপন্যাসের বিস্তৃত বলয়, ঘটনাবহুল বিষয়বস্তু, বিচিত্র চরিত্রের বিন্যাস সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় আবহ গ্রন্থের আবেদনকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা যেমন সমকালীন বিক্ষুব্ধ ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে একইভাবে ঔপন্যাসিককেও এক বিশিষ্ট মর্যাদায় দাঁড় করার।

সামাজিক বিভেদ, ধর্মীয় বিরোধ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অসঙ্গতি এবং শাসন-শোষণের সুতীব্র আঁচড় নজরুল কখনও মানতে পারেননি। তার পরিচ্ছন্ন অনুভব যেমন কবিতায়, সঙ্গীতে একইভাবে তাঁর কথাশিল্পেও। নির্বিত্ত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে কোন ধরনের রোষানলকে তিনি তোয়াক্কাই করেননি। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সৃষ্ট সব ধরনের অত্যাচার-অবিচার আর নিগ্রহের বিরুদ্ধে লড়াই করা অত সহজ ব্যাপার ছিল না। কারাবাস থেকে আরম্ভ করে বই বাজেয়াফত করা আরও হরেক রকম দ-ের বোঝা নজরুলকে বহন করতে হয়েছিল। কিন্তু অদম্য, দুর্দমনীয় বিদ্রোহীকে কোনভাবেই থামানো যায়নি। মৃত্যুক্ষুধা সেই বোধেরই রচনাশৈলী যা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিবাদ।

যেহেতু বইটি তিনি একটানা লেখেন নি। প্রায় দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও জীবনের নানামাত্রিক গতিময়তায় কয়েকটি সংখ্যায় তা অনুপস্থিতও থাকে , তাই এর শিল্প সৌকর্য কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে। উনিশ পরিচ্ছেদে আছে, মেজ-বৌ দুই সন্তান নিয়ে খ্রিস্টান হয়েছে। কিন্তু বাইশ পরিচ্ছেদে দেখা যায়, তার ছেয়েমেয়েরা মুসলমান রয়ে গেছে। একটানা না লেখার কারণে এ অসংগতি হতে পারে।

সর্বোপরি বইটি বেশ ভালো লেগেছে । বিশেষ করে অলংকরণ , উপমার প্রয়োগ ছিল দেখার মতো।
Profile Image for Sumaîya Afrôze Puspîta.
219 reviews288 followers
March 18, 2024
স্কুল-কলেজের পাঠ্যতালিকায় থাকা কয়েকটা কবিতা ছাড়া নজরুলের আর কিছুই কখনো পড়া হয়নি– এখন ভেবেও লজ্জা লাগছে।‌ কী শক্তিশালী লেখনী! তাঁর কবিতা পড়ে যেমন বি���্রোহে-প্রেমে‌ ডুবে যাই, উপন্যাসেও যেন তা-ই।

▪️ক্ষুধায় মৃত্যু– ক্ষুধার মতো আর কোনোকিছুই এত প্রকটভাবে মৃত্যুকে মহিমান্বিত করতে পারে না বুঝি… কারণ এই কষ্ট তিলে-তিলে, ধুঁকে ধুঁকে বয়ে যাওয়া কষ্ট। কথায় আছে, 'অভাবে স্বভাব নষ্ট।' সত্যিই তো, পেটে যখন ভাত থাকে না, তখন পিতৃ ধর্ম আঁকড়ে রাখা কী মারাত্মক কঠিন হয়ে পড়ে– আরো তা যদি হয় শিশুমুখের দিকে চেয়ে।

▪️এই উপন্যাসের বিদ্রোহী চরিত্র‌টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ– মনে হয় যেন নজরুল হয়তো খানিকটা নিজেই নিজেকে চিত্রিত করেছেন।

শেষটা অবশ্য কিছুটা ধাক্কা খাওয়ার মতো। আমার মনে হয়েছে, লেখক যা দিয়ে কাহিনি শুরু করেছিলেন তা বোধহয় ভুলেই গেছেন! তবে তাও আমি আশাহত হ‌ইনি। বয়সের দোষ বা এখনও রোমান্টিকতা ভালো লাগে বলেই বোধকরি সমাপ্তিটা হৃদয়ের তার ছুঁয়ে গেছে।
Profile Image for Zihad Saem.
123 reviews7 followers
February 2, 2025
যাকে বলে ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়া, ঠিক সেই রকম ভাবেই পড়েছিলাম উপন্যাসটা। আমি পড়ার সময় এতোখানি আশা করি নাই, যতখানি পড়ে উঠার পর ভালো লেগেছিলো।
Profile Image for Fowzul Fahad.
13 reviews26 followers
March 23, 2017
অসাধারণ! তৎকালিন পল্লীসমাজের একটা নিখুঁত চিত্র তুলে দিয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি।
প্রথম লাইন আমার বেশ ভাল লেগেছে।
"পুতুল খেলার কৃষ্ণনগর। যেন খেয়ালি শিশুর খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর।" অপার গভীরতায় ভরপুর! প্রতিটা পাতায় রয়েছে গভীরতার মিশ্রন। বেশ ভাল লেগেছে উপন্যাসটি।
Profile Image for Abu Rayhan Rathi.
108 reviews
September 19, 2020
অসাধারণ একটা বই পড়ছিলাম এতক্ষণ। কাজী নজরুল ইসলামের এই বইটাই আমার প্রথম পড়া।একদম মুগ্ধ হয়ে গেছি।

বইটার শুরু হয়েছে কৃষ্ণনগর গ্রামের মানুষদের নিত্যদিনের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে।এ গ্রামে একত্রে বসবাস করে মুসলিম, খ্রিস্টান ও কতিপয় হিন্দু।তাদের মধ্যে ঝগড়া হলো নিত্যদিনের সঙ্গী।তবে তাদের ঝগড়া বেশি দিন স্থায়ী হয় না।পরদিনই আবার তারা সবকিছু ভূলে যায়।তারা সবাই ধর্ম বিশ্বাসে ভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে একটা কমন বিষয় লক্ষ্য করা যায়।তাদের অধিকাংশই দরিদ্র,পরিশ্রমী ও কাজ না করলে দুবেলা খেতে পায় না।

বইটিতে সেকালের মানুষদের দুঃখ,দূর্দশা ও দারিদ্র্যের বিষয়টি লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন।আবার মানুষের দুঃখ-দূর্দশা লাঘবের জন্য আনসারের মতো মানুষদের ভূমিকা ও ত্যাগের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। খাবারের জন্য তাদের আহাজারি ও সেকালের কিছু ধর্মান্ধতার বিষয়ও উঠে এসেছে।এক কথায়, বইটি যেনো সেকালের মানুষদের জীবনধারার একটা বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
Profile Image for Shadin Pranto.
1,469 reviews560 followers
June 26, 2016
অত্যন্ত পল্লীঘনিষ্ঠ লেখা। গ্রামের নিম্নবর্গের মানুষের দুঃখ-বেদনা ই মূল উপজীব্য আর এক্ষেত্রে মনে হচ্ছিল বিভূতিভূষণ কে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন নজরুল। কেন তিনি এই ধরনের উপন্যাস আর বেশী লেখেন নাই সেটাই দুঃখের বিষয়। নির্দ্বিধায় ৫ তারকা।
Profile Image for Zinia Rahman.
57 reviews7 followers
October 29, 2021
"মৃত্যুক্ষুধার মতো সে চাউনি জ্বালাময়, বুভুক্ষু,লেলিহান। সে চোখে অশ্রু নেই, শুধু রক্ত।"
Profile Image for Himel Rahman.
Author 7 books46 followers
October 21, 2018
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "কবি" পড়তে গিয়ে পুরোটা সময় যেমন আচ্ছন্ন ছিলাম, প্রচণ্ড ভারী হয়ে ছিল বুক, ক্ষণে ক্ষণে ঝাপসা হয়ে আসছিল দৃষ্টি, কিংবা দুয়েকপাতা পেরুলেই সাদা পৃষ্ঠায় টপ করে গড়িয়ে পড়ত চোখের পানি–আজ ঠিক তেমনি করেই আরও একবার মনে হচ্ছে যেন, পার্থিব এ মায়া ছেড়ে বহুদূরে–অপার্থিব কোনো লোকে হারিয়ে গেছি।
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের "শাপমোচন" পড়ার সময়ও এরকম হয়েছিল। প্রতিমুহূর্তে বন্ধ হয়ে আসছিল নিঃশ্বাস। শেষের কয়েকপাতা পড়ার সময় কোনো ভাবেই স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না। চার-পাঁচ লাইন পড়েই সশব্দে চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে গিয়ে পায়চারি করতাম, বারবার মুছতাম ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো। তারপর আবার বসতাম, আবারও উঠে পড়তাম। একটা বই এতটা হতভম্ভ, মুগ্ধ-বিমুগ্ধ, বিক্ষুব্ধ, মোহাচ্ছন্ন করতে পারে আমার কল্পনাও ছিল না। বিদেশি ভাষার গল্প পড়ি, তাতেও মুগ্ধ হই। কিন্তু সেই মুগ্ধতার সাথে এই হৃদরক্তক্ষরণের মতো অনুভূতির কোনো তুলনা হয় না। কোনো তুলনা হয় না...
নজরুলের কয়েকটা কবিতা আর প্রবন্ধ ছাড়া কিছুই পড়া হয়নি। তাই একসাথে তিনটা উপন্যাস পেয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই কিনে নিয়েছিলাম। বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে এত বেশি ভালো লাগতো যে, পড়িনি, কারণ পড়লেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠতেই নজরুলের কথা মনে পড়লো।
মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসটি একদম শুরু থেকে শেষ শব্দ পর্যন্ত যে প্রচণ্ডরকম যন্ত্রণার কাঁটাতারে হৃদপিণ্ডটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল, তা শুধু নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। কী শব্দপ্রয়োগ! কী ভাষাগত দ্যোতনা! কী ঝংকার তার বাক্যে! কী নিদারুণ হাহাকার তার বাচনভঙ্গিতে! কী গভীর জীবনবোধ, যাতে কেবল তলিয়েই যেতে হয়!
এই মহান ব্যক্তিত্বকে রেটিং দেওয়া দুঃসাহসেরও বেশি কিছু। কিন্তু তবুও ৫ দিচ্ছি...কারণ সীমা যে এটুকুই।
Profile Image for Timothy Green.
63 reviews25 followers
April 6, 2017
"I do not have anymore time. My lamp too is dying."

The main theme of this book seems to be rebellion against injustices. Each of the central characters struggle with, but fight back against, the oppressive circumstance of their lives - whether that be due to poverty, gender or a general conservative society. Kazi Nazrul Islam portrays the very difficult lives of the poor of 1930s Bengal, whilst highlighting the beauty and love that can still be found. His prose and use of metaphor is wonderful. An enjoyable read.

"Who among those wretched people had time to remember? Only those who have fallen into a swirling whirlpool know that people who fall into the swift currents of a whirlpool forget the baby they lost a moment ago in the struggle to save themselves. The pangs of sorrow, want, grief, loss, humiliation, flow like a strong current against which the drowning masses desperately struggle to keep themselves afloat. Where do they have the leisure to remember their earlier sorrows? They remain busy in a life-and-death struggle, flailing their arms and legs desperately to keep alive."
Profile Image for রেজওয়ান আহমেদ.
12 reviews9 followers
July 23, 2021
'মৃত্যুক্ষুধা' - অভাবের চিরায়ত আখ্যান

আজকাল বইয়ের গ্রুপগুলোতে যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হই প্রায়ই - কোন উপন্যাস পড়ে কেঁদেছেন?

আমার ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের উত্তর নিঃসন্দেহে 'মৃত্যুক্ষুধা'। পরবর্তীতে বনফুলের লেখায় (গল্প - 'পাঠকের মৃত্যু') প্রভাবিত হয়ে আবার পড়ে দেখবার চেষ্টা করেছি এই নিয়ে দুবার। 'মৃত্যুক্ষুধা' আমার মোটামুটিভাবে আত্মস্থ হয়ে গেছে বলে হয়তো এখন আর কাঁদি না। না কাঁদলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই - করুণরস সৃষ্টিতে নজরুল মুনশিয়ানা দেখিয়ে ছেড়েছেন এ উপন্যাস দিয়ে। মোটাদাগে অভাব-অনটন-প্রেম আর পারিবারিক বন্ধনের মূর্ত উদাহরণ 'মৃত্যুক্ষুধা'।

অভাব আ��� ক্ষুধার স্বরূপ -

"বিধাতার দেওয়া ছেলেমেয়ে এরা বিধাতার হাতেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিত মনে পান্তাভাত খেয়ে মজুরিতে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে এসে বড় ছেলেটাকে বেশ করে দু-ঘা ঠেঙায়, মেজোটাকে সম্বন্ধের বাছবিচার না রেখে গালি দেয়, সেজোটাকে দেয় লজঞ্চুস, ছোটটাকে খায় চুমো, তারপর ভাত খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।"

চল্লিশের দশকের নিম্নবর্গের একেকদিনের বারোয়ারি জীবনের সবটা প্রতিফলিত হতে দেখি নজরুলের ডিটেইলিংয়ে।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি'তে জেলেপাড়ার সান্ধ্যকালীন পারিবারিক পরিবেশে অনেকটা এমনই কিছু দেখেছি।

চিরায়ত আর সমকালীনে সময় এবং অভিজ্ঞতার যে পার্থক্য, তার সার্থক রূপায়ণ সমকালীন সাহিত্যের লেখায় আমরা পাঠকরা প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশার প্রাপ্তি না ঘটলে মন ভাঙে আমাদের।

'চাঁপাডাঙার বৌ' পড়তে গিয়ে রাঢ়বঙ্গের স্ত্রীলোকের গালিভাষার যে পর��শীলিত রূপ দেখেছি, 'মৃত্যুক্ষুধা'য় গালিবিবরণে সে কথাগুলো বারবার মনে পড়েছে। গোখরোতে কামড়াবে, এই হবে, সেই হবে - টিকুরীর খুড়ীর কত্ত শাপ-শাপান্ত!

এদিকে 'মৃত্যুক্ষুধা'য় সাংসারিক কলহচিত্রে দেখা যায় শাশুড়ি পুত্রবধূকে অভিশাপ দিচ্ছে -

"... - ভাল হবে না লো, ভাল হবে না। এই আমি বলে রাখছি, বিয়ের রাতেই জাত-সাপে খাবে তোদের দুই জনকেই।"

নজরুলের লেখায় তারাশঙ্করের মতোই রাঢ়বঙ্গের সমাজজীবনের প্রভাব শাপশাপান্তে সাপের ব্যাপারটি। নজরুলের একটা গল্পের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে - 'পদ্মগোখরো'।

'মৃত্যুক্ষুধা' পাড়াগেঁয়ে কলহের রূপায়ণে বোধহয় এককাঠি সরেস। উপন্যাসের শুরুতেই ছুৎমার্গ প্রসঙ্গে ঝগড়ায় মেতে উঠতে দেখি প্যাকালেদের মা আর হিড়িম্বাকে। বলা হচ্ছে মুসলমান-খ্রিস্টান-হিন্দুদের একত্রবাস এখানে। যে যার ধর্মের ব্যাপারেই তবু কলহ-বিবাদ বেশি। আবার মানবতার বেলায় এরাই বহু-দেহ-এক-প্রাণ। দারিদ্র্য-অভাব-ক্ষুধায় এদের জীবন অতিষ্ঠ।

তাই পাঁচির বাচ্চা ভূমিষ্ঠ করানোর প্রয়োজনে হিড়িম্বার কাছেই গিয়ে ধরনা দেয় গজালে-প্যাকালের মা -

"না বোন সত্য বলছি, আল্লার কিরে! আমার পাঁচির কাল থেকে ব্যথা উঠেছে; ঝগড়া তোর গজালের মা-র সঙ্গেই হয়েছে, পাঁচির মা-র সঙ্গে ত হয় নি!"

প্যাকালের জীবনাচরণে আমরা দেখি আয়নার অভাব পূরণ করতে হয় জলে নিজের ছায়া দেখে। স্নানের জন্য তেলের শিশি হাতের তালুর ওপর উল্টে রাখলে পাঁচ মিনিটে পাঁচ ফোঁটা তেল হাতে পড়ে। দারিদ্র্যের স্বরূপ বিবরণে 'মৃত্যুক্ষুধা' অন্যান্য সমসাময়িক উপন্যাস থেকে কিছু আলাদাই। বলা ভালো সমৃদ্ধ। জড়োসড়ো, সংকুচিত, নোংরা বাসস্থানের বিবরণও এসেছে -

"যেটা উনুন-শাল, সেইটেই ঢেঁকিশাল, সেইটেই রান্নাঘর এবং সেইটেই রাত্রে জনসাতেকের শোবার ঘর। তারই একপাশে দরমা বেঁধে গোটা বিশেক মুরগি এবং ছাগলের ডাক-বাংলো তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।"

হরিশংকর জলদাসের সমকালীন উপন্যাস 'রামগোলাম' বলছে মেথরদের থাকার জন্য একটা আর রান্নার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ। এরকম দুটো ঘরজুড়ে প্রজন্মান্তরে জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে বাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ালেও অন্যত্র বড়ো ঘর বরাদ্দ পায় না এরা।

এর বাইরে 'হাজার বছর ধরে' এবং 'বোবা কাহিনী'র মতো চিরায়ত উপন্যাসে দারিদ্র্যের বিবরণ উল্লেখযোগ্য।

বোবা কাহিনীতে দেখি -

"... কেরোসিনের প্রদীপটি কতকটা ম্লান হইয়া আসিয়াছিল। আজাহের সলিতা একটু উস্‌কাইয়া দিল। তারপর ঘরের মধ্যে ছেঁড়া মাদুরটি বিছাইয়া তাহার উপর শততালি দেওয়া কাঁথাখানা অতি যত্নের সঙ্গে বিছাইল। রসুনের খোসায় তৈরী ময়লা তেল লাগান বালিশটি এক পাশে রাখিল। তারপর বউটিকে আস্তে কোলপাথালী করিয়া ধরিয়া আনিয়া সেই বিছানার একপাশে শোয়াইয়া দিল।"

এ স্বতঃস্ফূর্ত বিবরণে দারিদ্র্য যেমন করে ফুটে উঠেছে, সমসাময়িক 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসেও একইভাবে টুনির বাপের বাড়ির নিম্নমধ্যবিত্ত গেরস্তি জীবন তুলে ধরেছেন জহির রায়হান। সে বাড়িতে টুনির ঘরের বিবরণে চৌকির ওপরে বিছানো কাঁথা, তেল চিটচিটে বালিশ আর বেড়ার সঙ্গে ঝোলানো ভাঙা আয়নায় দারিদ্র্য প্রতিফলিত হচ্ছে।

'মৃত্যুক্ষুধা'র কাহিনি এগিয়ে চলে দুটো পরিবারের জীবনকে সমান্তরালে রেখে। প্যাকালের ওপর যে পরিবারটির ভার সেটি নিম্নবর্গীয় পরিবারের প্রতিভু। নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে দারিদ্র্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ। রাজমিস্ত্রির কাজ, খানসামাগিরি, বাবুর্চিগিরি করে এদের গেরস্তি চালানো কঠিনতর হয় দিনদিন। আমরা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশনি সংকেত' এবং হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' উপন্যাস দুটিতে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে যথাক্রমে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্বের কথা পাই। সেখানে খাবার এবং পরিধেয় বস্ত্রের অভাবের দুঃখজনক বিবরণ এসেছে। তবে অসম অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষের জীবনের পার্থক্য সূচিত হয়নি দুটোর কোনোটিতেই। 'মৃত্যুক্ষুধা' সেদিক দিয়ে আলাদা।

শুরুর দিকে নজরুল লিখেছেন -

মাথার ওপরে টেরির মত এদের মাঝে দু-চারজন "ভদ্দর-নুক"ও আছেন।

কৃষ্ণনগরের চাঁদ-সড়কের নিম্নশ্রেণীর জনগণের মাথার মণি হয়ে আছেন নাজির সাহেবের মতো লোক। তারা ধনিক শ্রেণীর প্রতিভু হলেও প্যাকালেদের দুঃখটা বোঝে। আলোচনার বিষয় সেটা নয় বরং বিবেচনায় নিতে হয় ক্ষুধাতৃষ্ণায় কে কতটুকু কাতর। খাবারের অভাবে গরিবঘরগুলোর সকলে উপোস করে মরলেও সে মৃত্যুর ছোঁয়া উচ্চবিত্তের ঘরে লাগে না। ফলে দুর্ভিক্ষের দুর্দিনে চা-জলখাবারের কখনোই অভাব হয় না লতিফাদের।

আবার কিছু বিপরীত চিত্রও কম নেই। দারোগার বাড়ির বেড়ালের উচ্ছিষ্ট দুধটুকু দিয়ে ক্ষীর করে খেয়ে দিন কাটাতে হয় ক্ষুধার্ত দরিদ্রসন্তানদের। ফলে বলা যেতে পারে দরিদ্রদের মূল্যায়ন এবং অবমূল্যায়ন দুই-ই পরিলক্ষিত হয় 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসে চিত্রিত সমাজে। ক্ষুধা-রোগ-জরায় মৃত্যুপথযাত্রী যারা, তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় হাজির বিনিময় প্রথায় বিশ্বাসী হাতুড়ে ডাক্তার। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের আগেপরে গ্রামাঞ্চলে হাতুড়ে ডাক্তার এন্তার দেখা মিলত। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বিপিনের সংসার', হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি', জসীম উদ্‌দীনের 'বউ টুবানীর ফুল', 'বোবা কাহিনী'র মতো উপন্যাসে এ বাস্তবতা এসেছে। অবশ্য এদের সকলে যে লোভী-স্বার্থপর ছিল, তা বলবার উপায় নেই।

সেজো-বৌয়ের মৃত্যুর বিবরণে প্রতীকায়িত পরিচর্যার আশ্রয়ে করুণরসাত্মক ভাব তৈরি করেছেন নজরুল। তিনি লিখেছেন -

"একটা আঁধার রাত যেন ডাইনীর মত শিস দিয়ে ফেরে। গাছপালা ঘরবাড়ি - সব যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে থাকে। তারাগুলোকে দেখে মনে হয় সহস্র হতভাগিনীর শিয়রে নিবু নিবু পিদিম।

এরি মাঝে মাটির ঘরের মাটির শেজে শুয়ে একটি মানুষ নিবতে থাকে রিক্ত-তৈল মৃৎ-প্রদীপের মত। তেল ওর ফুরিয়ে গেছে‍, এখন সল্‌তেতে আগুন ধরেছে। ওটুকুও ছাই হতে আর দেরি নেই।"

আবার সেজো বৌয়ের খোকার মৃত্যুপূর্ব পরিস্থিতিকেও যথাসম্ভব হৃদয়বিদারক উপমায় উপমিত করে লিখলেন -

"সেজো বৌ-র খোকাকেও আর বাঁচানো গেলো না।

মাতৃহারা নীড়-ত্যক্ত বিহগ-শিশু যেমন করে বিশুষ্ক চঞ্চু হাঁ করে ধুঁকতে থাকে, তেমনি করে ধুঁকে - মাতৃস্তন্যে চিরবঞ্চিত শিশু! ..."

এই যে বঞ্চনা, এ ত দুর্ভিক্ষজনিত ক্ষুধারই ফসল।

প্রেম -

'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসে মৃত্যু এবং ক্ষুধার জয়জয়কারে বোধকরি প্রেম অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। অবশ্য নজরুল ক্ষেত্রবিশেষে সেই ছাইচাপা আগুনকে একটু করে উস্কে দিতে ভোলেননি।

মেজ-বৌ আর ঘিয়াসুদ্দীনের রসায়নকে কুবের-কপিলার রসায়নের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

মঙ্গলকাব্যের বারমাসির ঢঙ এবং রাধার বিরহ সঙ্গীতের ব্যবহারে মেজ-বৌ'র একাকীত্ব স্পষ্ট হয়েছে উপন্যাসে। এক্ষেত্রে বড়-বৌ চরিত্রের যে বিচক্ষণতা, সচেতনতা আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের নিপুণতা, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসের চিত্রনাট্যে মালার সংলাপে এসেছে। কপিলারও জীবনে একাকীত্ব আছে, তা মালা বুঝতে পারে।

ছলনা আর বাণের ব্যবহারে কপিলার চেয়ে মেজ-বৌ কোনো অংশে কম নয়।

নজরুল লিখেছেন -

"আগুন আর সাপ নিয়ে খেলা করতেই যেন ওর সাধ। ঘিয়াসুদ্দীন ওকে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না বলেই এত ঘন ঘন আসে। মেজ-বৌও তা বোঝে, তাই তাকে ঘন ঘন আসায় অর্থাৎ আসতে বাধ্য করে।"

প্রেমের অস্তিত্ব আছে মেজ-বৌ আর আনসারের রসায়নে। বিশেষ করে মেজ-বৌ আনসারকে ভালো করেই চিনত আসতে-যেতে। দূর-থেকে-দেখা মুগ্ধতা তার দিক থেকে ছিল। সেই মুগ্ধতা অজান্তেই অব্যক্ত প্রেমে গড়ায়।

মেজ-বৌয়ের সাথে আনসার যখন দেখা করে গির্জায় তখনকার একপর্যায়ে লিখেছেন নজরুল -

"মেজ-বৌ হঠাৎ অশ্রু-সিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, "আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি - যদি কোনদিন ইচ্ছে হয়?" - বলেই সে তার অশ্রুসিক্ত আঁখি দুটি পূজারিণীর ফুলের মত আনসারের পানে তুলে ধরল।"

আবার সেই সাক্ষাতেরই একপর্যায়ে মেজ-বৌ বলে

"আমায় দিয়ে আপনার কোন কাজের সাহায্য যদি হয় জানাবেন, আমি সব করতে পারব আপনার জন্য!"

নজরুল এ ব্যাপারে লিখেছেন -

"কিন্তু ঐ 'আপনার জন্য' কথাটা বুঝি তার অগোচরেই বেরিয়ে এসেছে। ঐ কথাটা বলবার পরই তার চোখমুখ লজ্জায় রাঙা টকটকে হয়ে উঠল।"

এ প্রেমের যদিও কোনো পরিণতি নেই, আনসার ঠিকই এর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বোধের জায়গাটি আমাদের সামনে এভাবে আসে -

"তার দু-চোখের দুই তারা - প্রভাতীর তারা, সন্ধ্যাতারা - রুবি আর হেলেন, হেলেন আর রুবি। ...

সে মানুষের জন্য সর্বত্যাগী হবে, সকল দুঃখ মাথা পেতে সহ্য করবে, তারা দুঃখী, তারা পীড়িত বলে নয়, তারা সুন্দর বলে। এ-বেদনাবোধ শুধু ভাবের নয়, আইডিয়ার নয়, এ-বোধ প্রেমের, ভালোবাসার।"

আবার, আনসার আর রুবির মধ্যে একটা বিয়োগান্তক প্রেম। প্রকৃতপক্ষে এ প্রেমটিকেই আখ্যানের প্রধানতম উপাখ্যান ধরা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, প্রেম ছাপিয়ে আনসার চরিত্রে বিদ্রোহই বেশি প্রকটিত। সে কমিউনিস্ট। তার এই আদর্শকে ঠিক মানতে পারে না রুবি। রাজপথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত রুবির চরিত্রে। এ প্রসঙ্গে জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসের ডলি চরিত্রের উল্লেখ করা যায়। অবশ্য ডলির চরিত্রে ওঠানামা থাকলেও রুবি সরল প্রেমিকা চরিত্র। 'মৃত্যুক্ষুধা' রুবির বিয়ে, বৈধব্যের উল্লেখ করলেও রুবির মধ্যে পতিপ্রেম রাখেনি। বরং শেষদিকে যক্ষ্মা আক্রান্ত আনসারের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে তার সাথেই করুণ পরিণতি গ্রহণ করে। যক্ষ্মাজনিত করুণ পরিণতি জসীম উদ্‌দীন দেখিয়েছেন তাঁর 'বোবা কাহিনী' এবং 'বউ টুবানীর ফুল' উপন্যাসে।

যে কথাটি বলা হয়নি, সেটি হচ্ছে আনসার প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহী নজরুলেরই ছায়া। কৃষ্ণনগরের নিম্নবর্গের মানুষের পক্ষে শ্রেণিসংগ্রামের সূচনা ঘটায় সে। কারারুদ্ধ হবার পর তার কী পরিণতি হয়, সে ত মাত্রই বললাম।

জসীম উদ্‌দীনের স্মৃতিকথা থেকে নজরুলের চা-প্রীতির কথা জানা যায়। এ ব্যাপারটি আনসারের মধ্যেও উঠেলে এসেছে। সে প্রসঙ্গ ধরেই রুবির স্পষ্ট সাহসের পরিচয় পাওয়া যায় একটি সংলাপে -

"তার (চায়ের কাপকে বেশি ভালোবাসার) কারণ জানিস, বুঁচি? চায়ের কাপটা যত সহজে মুখের কাছে তুলে ধরা যায়, আমায় যদি অমনি করে হাতে পেয়ে মুখের কাছে তুলে ধরে পান করতে পেত তোর দাদু, তাহলে আমিও ঐ চায়ের চেয়ে বেশি প্রিয় হয়ে উঠতুম!"

মোটাদাগে স্বামীহারা নারীদের সংগ্রামের গল্প হলেও সপতি চরিত্র হিসেবে লতিফা আর নাজির সাহেবের সম্পর্ক বেশ স্বচ্ছ বন্ধুত্বপূর্ণ।

পরিণতি ঘটেছে এমন প্রেম প্যাকালে আর কুর্শির মধ্যে চিত্রায়িত। চল্লিশ দশকের স্বাভাবিক সামাজিক বাধাবিপত্তির আঁচে পুড়তে থাকা প্রেমিকজুটির মধ্যে মান-অভিমান-ভয় অথবা ধর্মত্যাগের সৎসাহস পর্যন্ত দেখিয়েছেন নজরুল। এ বিষয়টি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সপ্তপদী' উপন্যাসে কৃষ্ণস্বামী চরিত্রে দেখি।

আনসার চরিত্রে বিদ্রোহী নজরুলের ছাপ যেখানে, সেখানে প্যাকালের চরিত্রে ছাপ প্রেমিক নজরুলের, জীবন-সংগ্রামী কিশোর নজরুলের, যে পেটে গানের দলে কাজ করে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করে সংসার চালায়। কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে লিখেছেন 'দুরন্ত দুখু'।

প্যাকালের চরিত্রে ব্রিটিশ-প্রভাবিত আধুনিকতা দেখা যায়। তার ফ্যাশন-সচেতনতা, সিগারেট ফোঁকা, চা খাওয়ার অভ্যাস - ব্রিটিশ থেকেই তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় 'চাঁপাডাঙার বৌ' উপন্যাসে ঘোঁতন ঘোষের মধ্যে অনুরূপ অনুপ্রবিষ্ট আধুনিকতা দেখিয়েছেন।

বিশেষ চরিত্রায়ণে মুনশিয়ানা -

গজালে, সোভান, বারিক, প্যাঁকালে, পাঁচিদের মা বাঙলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ দাদিচরিত্র। 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসের আঞ্চলিকতায় দেখছি নাতিরা তুই-তোকারি করছি দাদিকে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটিতে দোষ ধরবার অবকাশ নেই।

আমাদের দেশের পশ্চিমাঞ্চলে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, কুমারখালী, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলা এবং প্রান্ত-উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে 'তুই' সম্বোধনে ত্রুটির অবকাশ নেই, বরং এ-ই স্বাভাবিক।

বৃদ্ধা তাঁর নাতিদের মধ্যে মৃত ছেলের অস্তিত্ব খুঁজে পান।

'মৃত্যুক্ষুধা'য় এসেছে -

"দেখ বড়-বৌ, সোভান ঠিক এমনটি দেখতে ছিল, ছেলেবেলায় ঠিক এমনি করে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদত! ঠিক তেমনি আওয়াজ।"

আবার আমরা দেখি পাঁচির ছেলেকে পেয়ে নিজেদের ক্ষুধার যন্ত্রণা পর্যন্ত ভুলে যান তিনি। নাতিগুলোও কমবেশি দাদির ন্যাওটা।

সমসাময়িক হুমায়ুন কবিরের উপন্যাস 'নদী ও নারী'তে পড়েছি দাদিচরিত্র। নজরুলের স্নেহধন্য শিশুকবি জসীম উদ্‌দীন লিখেছেন 'বউ টুবানীর ফুল'। সয়লার দাদি সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

ভাই-বোনের মধ্যকার রসায়ন -

আনসার এবং লতিফা চরিত্রের রসায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসের আখ্যানভাগ বিচারে। পরিণত বয়সের ভাইবোন চরিত্রের রসায়নে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বিপিনের সংসার' তুল্য হতে পারে। বিপিন আর বীণা, আনসার-লতিফার মতো এতোটা স্বচ্ছ সম্পর্কে বাঁধা ছিল - বলার সুযোগ নেই।

শিশু মনস্তত্ত্ব -

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে শিশু মনস্তত্ত্ব যথেষ্ট পরিমাণে এসেছে।গালিভাষা আয়ত্তকরণের ব্যাপারটি যেমন - ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে গালিভাষা শিখলে পাড়ার দোষ দেয় বড়োরা। এ প্রবণতা লতিফার মাধ্যমে প্রকাশিত।

এর বাইরে মেজ-বৌয়ের ধর্মত্যাগের ব্যাপারে তার এতিম সন্তানের মন্তব্য -

"তাহলে আমি আব্বার কাছে যাব। আচ্ছা দাদি, আব্বার কাছে যেতে হলে কদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়! তুই ত বিছানায় শুয়ে অসুখ করেছিস, তারপর সেখানে যাচ্ছিস! আমারও এইবার অসুখ করবে, তারপর আব্বার কাছে চলে যাব! মা ভালবাসে না, খেরেস্তান হয়ে গিয়েছে! হারাম খায়! থুঃ! ওর কাছে আর যাচ্ছি না, হুঁ হুঁ!"

মেজ-বৌ চরিত্রের দর্শন -

মেজ-বৌ চরিত্রে মাতৃত্ব বলি, বৈধব্য বলি, সৎসাহস বলি আর যা কিছুই বলি - সবটাই এ চরিত্রের বাঁক এবং বিকাশের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। নজরুল আনসার চরিত্রের আড়ালে মেজ-বৌয়ের মধ্যে নিজের প্রেমিকাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। মনে পড়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসে কুবের জগা মাঝির বৌয়ের মধ্যে কপিলাকে খুঁজছিল। মেজ-বৌ অবশ্য উজ্জ্বলতায় ভরপুর চরিত্র সে তুলনায়।

পুঁজিবাদী চিন্তায় নয়, বরং গ্রাম্য নোংরামির শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এ বিষয়টি তার সংলাপেই উঠে এসেছে -

জি না! আপনারা একটু একটু করে আমায় খ্রিস্টান করেছেন!

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁপাডাঙার বৌ' উপন্যাসে বড় বৌ চরিত্রের বিরুদ্ধে গ্রাম্য নোংরামির যে উদাহরণ রেখেছেন তা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হলেও মেজ-বৌ, চাঁপাডাঙার বৌয়ের তুলনায় বেশ শক্ত নির্মাণের ফসল।

প্রসঙ্গত এতদাঞ্চলে মিশনারিদের দৌরাত্ম্য সে সময় খুব ভালোরকমেই ছিল। বিশেষত তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী ধারণা বিস্তারের একটা উল্লেখযোগ্য ফল হিসেবে পর্তুগিজ, স্কটিশসহ আরো নানা ধরণের খ্রিস্ট মতবাদ এদিকে প্রচারিত হতো। এদের উপনিবেশবাদী তৎপরতাকে চাইলে 'পদ্মানদীর মাঝি'র হোসেন মিয়ার রাষ্ট্রচিন্তক মানসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

মেজ-বৌ এদেরই প্রতিনিধি মিস জোন্সের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত হয়ে বরিশালে যায়। সেখানে তৎকালীন জমিদারি প্রথায় মনোরঞ্জক নারীরূপে জীবিকা নিলে তার কিছু আর্থিক সংগতি হয়। এটা মূলত পুঁজিবাদী চিন্তার উপাদান উপন্যাসে। এই জায়গাটিতে তারাশঙ্করের 'সপ্তপদী' উপন্যাসের রিনা চরিত্রের সাথে মিল পাওয়া যায় মেজ-বৌয়ের।

বরিশাল অংশে নজরুল মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়েছেন বরিশালের প্রকৃতির -

"বরিশাল। বাংলার ভিনিস।

আঁকাবাঁকা লাল রা���্তা। শহরটিকে জড়িয়ে ধরে আছে ভুজ-বন্ধের মত করে।

রাস্তায় দুধারে ঝাউগাছের সারি। তারই পাশে নদী। টলমল টলমল করছে - বোম্বাই শাড়ি-পরা ভরা-যৌবন বধূর পথ-চলার মত। যত না চলে, অঙ্গ দোলে তার চেয়ে অনেক বেশি।

নদীর ওপারে ধানের ক্ষেত! তারও ওপারে নারিকেল-সুপারি কুঞ্জঘেরা সবুজ গ্রাম, শান্ত নিশ্চুপ। সবুজ শাড়ি-পরা বাসর-ঘরের ভয়-পাওয়া ছোট্ট কনে-বৌটির মত।

এক আকাশ হতে আর-আকাশে কার অনুনয় সঞ্চরণ করে ফিরছে, "বৌ কথা কও। বৌ কথা কও।"

সকলে যদিও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আরণ্যকে'র কথা বলতে চাইবেন, আমার মনে পড়ে পল্লীকবির 'বোবা কাহিনী' এবং 'বউ টুবানীর ফুল' উপন্যাসের গ্রাম্য প্রকৃতির বিবরণ। বউ কথা কও পাখিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে এ দুটো উপন্যাসেই।

এরকম পরিবেশে মেজ-বৌ যথেষ্ট নিষ্ঠুর মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কোলের সন্তান ফেলে রেখে গিয়েছেন। আবার কোলের সন্তানের টানেই সব ছেড়েছুড়ে স্নেহময়ী মা হয়ে কৃষ্ণনগর ফিরেছেন। এসে খোকাকে জীবিত দেখতে না পেয়ে ঘটনাক্রমে খ্রিস্টধর্ম ছেড়ে আবার মুসলমানও হয়েছেন। আমরা তার সার্বজনীন মাতৃসত্তার পরিচয় পাই শেষের দিকে।

খোকার টাইফয়েডে মৃত্যু হয়। হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' উপন্যাসে এক খোকা ছিল। তারও টাইফয়েডে মৃত্যু হয়। টাইফয়েড 'বোবা কাহিনী'র বড়ুর মৃত্যু ঘটায়।

সংগ্রামী-সাহসী-দৃঢ়চেতা মহিয়সী নারী এবং দুখিনী মা মেজ-বৌকে ঘিরে অসাধু ধর্মজীবী মোল্লাদের তৎপরতা ছিল, ছিল মোড়লের স্বার্থবাদী মনোবৃত্তির আভাস, সর্বোপরি গ্রামীণ জনগণের ধর্মান্ধতার কৃষ্ণগহ্বর।

🅒 রেজওয়ান আহমেদ,
শিক্ষার্থী-গবেষক,
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন),
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
This entire review has been hidden because of spoilers.
Profile Image for Raihan Ferdous  Bappy.
226 reviews13 followers
June 12, 2024
"খোদা তোকে সুখে রাখুন, কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা যে কি জ্বালা, তা যদি একটা দিনের জন্যেও বুঝতিস, তাহলে পৃথিবীর কোনো পাপীকেই ঘৃণা করতে পারতিসনে!"

শেষ করলাম কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বিখ্যাত উপন্যাস "মৃত্যুক্ষুধা"। এই উপন্যাসের মাধ্যমে সমাজের নিম্নশ্রেণীর অভাবী মানুষদের দু:খ, যন্ত্রণা, বেদনার ছবি লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তার অসীম লেখনী দিয়ে। মূলত, অভাব আর দারিদ্র‍্যতা দিয়ে ঘেরা বলেই তিনি এই উপন্যাসের নামকরণ করেছেন " মৃত্যুক্ষুধা"।

এই বইটা নিয়ে আমার অনেক জল্পনা কল্পনা ছিলো। অনেক দিন থেকে উইশলিস্টে ছিলো। হাতে পেয়েছি অবশ্য অনেক পরে। পাবার পরপরই পড়া শুরু করি। যেভাবে শুরু হয়েছিলো, আমার মনে হয়েছিলো অনেক অন্যরকম একটা প্লট হবে। কারণ, কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীশক্তি যে কতোটা শক্তিশালী সেটা অন্তত বলে দিতে হবে না। আমার যোগ্যতায় নাই সে ব্যাপারে কিছু বলবার। কিন্তু কেনো জানি না আমার কাছে মনে হলো, শেষে এসে উপন্যাসটার প্লটটা যেনো একদম মিইয়ে গেলো, একদম হারিয়ে গেলো। সেজন্যে ঠিক মেনে নিতে পারলাম না হয়তো।

সবমিলিয়ে, আমার কাছে এভারেজ লেগেছে। এই কথাটা বলতে অবশ্য নিজেরও খারাপ লাগছে। কারণ, এই উপন্যাসটা অনেকের পছন্দের একটা উপন্যাস। আমারো পছন্দ হলে ভেতর থেকে নিজেও খুশি হতাম। আনফরচুনেটলি, সেটা হয়নি। অনেকের কাছে শেষটাই পছন্দ হয়েছে। আমার কাছে কেনো জানি শেষটা ভালো লাগলো না। হয়তো বেশি আশা করায় আশাহত হয়েছি। এইতো!

হ্যাঁ, একটা জিনিস বেশ উপভোগ করেছি। সেটা হচ্ছে, এই উপন্যাসে উপমার প্রয়োগ। কাজী নজরুল ইসলাম উপমার প্রয়োগগুলা করেছেন একেবারে দেখার মতো। এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তাছাড়া, বাকিটা একটু খাপছাড়া ধরনের বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে।
Profile Image for Mehedi  Hasan Mahfuz.
171 reviews27 followers
March 15, 2023
এই বইয়ের রিভিউ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না, কি বলতে কি বলে ফেলি প্রচন্ড ভয় হয়। নজরুল ঔপন্যাসিক হিসাবেও যে এতটা শক্তিশালি ছিলেন অ্যাদ্দিন তা না জানায় নিজের প্রতি ধিক্কার আসতেছে!!
Profile Image for Preetam Chatterjee.
6,736 reviews355 followers
May 25, 2025
মৃত্যুক্ষুধা : বেঁচে থাকার চেয়ে মরার তৃষ্ণা বেশি যাদের, তাদের কাহিনি

গ্রন্থ সমালোচনা ও পাঠপ্রতিক্রিয়া

“যে মৃত্যুকে ভালোবাসে, সে জীবনের আসল অর্থ বোঝে।”

কাজী সাহেবের “মৃত্যুক্ষুধা” কোনও রোম্যান্টিক প্রণয়োপন্যাস নয়। এটি একরাশ জ্বালাময় চিন্তা, একফোঁটা সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন, আর মুষ্টিমেয় বিদ্রোহের ছায়া দিয়ে লেখা এক অন্তর্জ্বালার কাহিনি।

নজরুল যেখানে "বাঁধন-হারা"য় প্রেম ও নারী-স্বাধীনতা নিয়ে বলেছিলেন, "মৃত্যুক্ষুধা"য় তিনি বলে ওঠেন—"আমি মরব, কিন্তু মরে উঠব আবার অন্যের প্রাণে।"

এই উপন্যাসের মূল শক্তি তার চরিত্রগুলোর ভেতরের দহন।

বিশ্বজোড়া তুমুল পরিবর্তনের সময় এটি লেখা—রুশ বিপ্লব সদ্য ঘটে গেছে, বলশেভিকরা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। নজরুল সেই
বিপ্লবকে দেখে মুগ্ধ—কারণ সেখানে ধর্ম নয়, বর্ণ নয়, শুধু মানুষ গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বিশ্বাস করেন—যুগ বদলাতে হলে শুধু প্রেম নয়, চাই বিজ্ঞান, চাই সমাজতত্ত্ব, চাই ন্যায়ের জন্য মৃত্যু তেও হাসিমুখ।

আনসার চরিত্রটি নজরুলের অন্তর্জগতের এক প্রতিচ্ছবি। সে শুধু বিপ্লবী নয়, সে চিন্তক। সে প্রেমিক, কিন্তু প্রেমে মোহাবিষ্ট নয়। সে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানে না, কিন্তু মানুষকে ভালোবাসে ধর্মের থেকেও বেশি।

আনসারের চেতনায় মিশে আছে—

মার্ক্সীয় যুক্তিবাদ

বিজ্ঞানমনস্ক মানবতা

আত্মত্যাগের চরম আকাঙ্ক্ষা

আর একটা স্থায়ী প্রশ্ন: এই সমাজ কি বদলাতে পারবে শুধু কথার জোরে? না কি চাই মৃত্যুর খিদে?

আনসারের একটি উদ্ধৃতি কল্পনা করুন: “আমি মরতে চাই, কারণ বাঁচতে চাই সেই পৃথিবীতে, যেখানে কেউ অনাহারে কাঁদে না।”

এই ভাবনাটাই যেন গোটা উপন্যাসের স্পাইন।

পাকালে চরিত্রটি যেন গ্রামের অন্ধকারে বাস করা সেই সকল মানুষের প্রতিনিধি, যারা নিজে কিছু না বুঝেও বিপ্লবের ঢেউয়ে জড়িয়ে পড়ে।
সে আনসারের ছায়া হয়ে থাকে, প্রশ্ন তোলে, বোঝে না—তবু পাশে থাকে।
এই "বোঝার চেষ্টা"টাই বাঙালির চিরন্তন রাজনীতি-সংশয় আর মানুষের পেছনে ছুটে চলার প্রতীক।

"মৃত্যুক্ষুধা"-র গদ্য সাহিত্যিকের নয়, বিপ্লবীর গদ্য। তাতে কাব্য কম, যুক্তির তীব্রতা বেশি।

প্রচলিত কাহিনির কাঠামোকে না মেনে নজরুল লিখেছেন একরকম বক্তব্য-নির্ভর গদ্য। ২৮টি ছোট ছোট অংশে সাজানো এই উপন্যাস যেন প্রতিটি অধ্যায়ে একটি করে চিন্তার বিস্ফোরণ ঘটায়।

কিছু কিছু অংশ একেবারে দার্শনিক প্রবন্ধের মতো। কখনো মনে হবে—এই তো, নজরুল হয়তো নীৎশে বা টলস্টয়ের সাথে সন্ধ্যায় বসে তর্ক করছেন। আর মাঝে মাঝে হঠাৎ উঠে আসছে আবেগের এমন বিস্ফোরণ, যা শুধু নজরুলই পারেন—

"মৃত্যু মানেই পরাজয় নয়, কখনো কখনো সেটা শ্রেষ্ঠ মুক্তি।"

এই উপন্যাসকে তুমি তুলনা করতে পারেন শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র সঙ্গে।

কিন্তু নজরুল আলাদা কারণ তিনি নৈতিক জোরে লেখেন, রাজনৈতিক পতাকায় নয়। তিনি চরিত্রদের বাঁচাতে চান না, তাদের দিয়ে সমাজ বদলাতে চান।

শেষে নিজেকে জিজ্ঞাসা করবেন, কেন এই উপন্যাস আজও প্রাসঙ্গিক?

আজকের সমাজে, যেখানে আমরা তথাকথিত "আধুনিকতা" আর "সিস্টেম"-এর গ্যাঁড়াকলে হাঁসফাঁস করছি, সেখানে "মৃত্যুক্ষুধা" যেন এক ধাক্কা।
নজরুল বলতে চান—"এই ক্ষুধা শুধু ভাতের নয়, বেঁচে থাকার সম্মানের। আর সেটা না পেলে মৃত্যুও মধুর।"

"মৃত্যুক্ষুধা" পড়লে বোঝা যায়, নজরুলের কলম শুধু প্রেমে নয়, আগুনেও পুড়তে জানে।
Profile Image for Niva.
5 reviews
February 24, 2018
পুরো বই জুড়ে উপমাগুলো সবচেয়ে বেশি ভাল লাগছে, শেষের দিকে এসে একটু খাপছাড়া মনে হইছে যদিও। শেষটা বাদে অনেক ভাল লাগছে।
Profile Image for Saumen.
256 reviews
December 26, 2022
নজরুলের কলম অকা���ে থেমে গিয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে বাংলার। আসলেই তিনি অমিত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।

এই এক বইতে দুখের রূপ কখনো কাব্যিক গদ্যে, আবার কখনো নিজের একান্ত অন্তরজ্বালা দিয়ে যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অনবদ্য৷ তিনি সাম্যবাদী, ক্ষুধার জ্বলায় খ্রিষ্টান হওয়া মেজ বৌকে তিনি ছুড়েঁ ফেলেননি, আবার শেষে তার মাতৃমূর্তির আগমনকেও সমালোচনায় বেধেঁননি।

এতটুকু একটা বইয়ে নরনারীর প্রেম, নারীর মাতৃমূর্তি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য কতকিছু! বিশাল পরিধি এই বইয়ের, অথচ বইটা মাত্র ১৬১ পেজের। অসীম প্রতিভাধর হলেই অমন দেবদুর্লভ প্রকাশক্ষমতা থাকে!

পড়া শেষে একটা কথাই মুখ দিয়ে বের হয়েছে, কি মারাত্মক লেখনীরে ভাই!
Profile Image for Sohan.
274 reviews74 followers
July 15, 2021
~৩.৫/৫~
Profile Image for Md Sohanoor  Rahman Sohag.
24 reviews15 followers
May 7, 2023
মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসটি কাজী নজরুল ইসলামের বাস্তবধর্মী এবং অভিজ্ঞতা প্রসূত একটি নির্মম উপাখ্যান। বিশ শতকের প্রথম দিকে যখন ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষ কলকাতার কৃষ্ণনগরের এক করুণ চিত্র, ঠিক সেই সময়ের একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে রচিত উপন্যাস।

হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে, বয়স্ক মা, তার তিন বিধবা পুত্রবধূ, কয়েকজন নাতি এবং একমাত্র জীবিত সন্তান প্যাকালে
নিয়েই বৃদ্ধার জগত সংসার। প্যাকালেই এই পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব বহন করে কিন্তু যদিও ওটা খুবই অপ্রতুল। ক্ষুধা,দারিদ্র ও আর্থিক টানাপোড়ন তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। আর্থিক টানাপোড়া থেকে মুক্তির জন্য একটা সময় এসে পরিবারের মেজ বউ মুসলিম থেকে খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত হয়ে যায় এবং প্যাকালে যে কিনা পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বে, সেও একটা সময়,আর্থিক সচ্ছলতার মোহে এবং খ্রিস্টান মেয়ে কুরশির প্রেমের বাস্তব রূপ দিতে খ্রিস্টান হয়ে যায়। বৃদ্ধা মা মেজ বউ এবং পুত্র সন্তানকে হারিয়ে যেন এক ধরনের পাগলপ্রায় অবস্থা।



অন্যদিকে একজন দেশ প্রেমিক আনসার সাহেব, যে কিনা ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য গ্রাম থেকে গ্রাম, শহর থেকে শহরে জনসচেতনতা এবং জনগণকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসন তাকে রাঙ্গুনি নির্বাসনে পাঠান।

তাছাড়া উপন্যাসটিতে খ্রিস্টান মিশনারীদের আর্থিক সচ্ছলতার নামে ধর্মান্তরিত করার ঘৃণিত ইতিহাস তাকেও খুবই সুনিপনভাবে উপস্থাপন করেছেন।

আচ্ছা পরবর্তীতে কি মেজ বউ এবং পেকালে স্বধর্ম এবং সপরিবারে কি ফিরে আসবে?
বিপ্লবী আনসার সাহেব এবং তার প্রেমিকা রুবি এর সাথে কি রেঙ্গুনে দেখা হবে?

ধন্যবাদ ❤️‍🩹
Profile Image for Bibi Rasheda Afrin Rumi.
16 reviews21 followers
September 8, 2023
শুরুটা যেভাবে শুরু হয়েছি, যতটা আগ্রহ ধরে রেখেছিলো, যে প্লট সাজিয়েছেন লেখক শেষটা তেমন শেষ হয়নি। যে প্লট নিয়ে লেখক শুরু করেছিলেন শেষে যেন প্লটটাই হারিয়ে গেলো। শেষটার জন্যই এক তারকা কম দিতে হলো।
নাহলে এক ভিন্নধর্মী উপন্যাস হিসেবে মৃত্যুক্ষুধা অসাধারণ। লেখকের লেখনি তো অবশ্যই। কবি হিসেবে নজরুল আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। আফসোস উনি মাত্র ৩টি উপন্যাস লিখেছেন।
Profile Image for Maliha Tabassum Arna.
186 reviews49 followers
December 5, 2020
এই প্রথমবার বই পড়ে কাঁদার অভিজ্ঞতা হলো । এভাবেও কেউ ট্রাজেডি উপন্যাস লিখতে পারে ,তা ও জানতাম না । শুধু অসাধারন বললেও অনেক কম হয়ে যায় ।
Profile Image for Chayan Biswas.
35 reviews13 followers
June 25, 2020
এদের অভাব অসীম, অপরীমেয়। দুঃখ-দারিদ্র, রোগ-শোক, ক্ষুধা ও দূরভীক্ষ তাদের গ্রাস করে রাখে সর্বক্ষণ। এদের একদিকে মৃত্যু আর অন্যদিকে ক্ষুধা।

বইঃ মৃত্যুক্ষুদা
লেখকঃ কাজী নজরুল ইসলাম।
ধরনঃ জীবনধর্মী উপন্যাস

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে আমৃত্যু সকল অন্যায় ও শোষনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। আবার একই সাথে কোমল দরদী মন নিয়ে ব্যথিত ও বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকেছেন তিনি। তার লেখা ৩ টি উপন্যাসের ভিতর বিখ্যাত হলো মুত্যুক্ষুধা উপন্যাস।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, চল্লিশের দশকের ভঙ্গুর ও বিপর্যস্ত সময়কে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস মৃত্যুক্ষুদা (১৯৩০)। কৃষ্ণ নগরের চাঁদসড়কের দরিদ্র হিন্দু -মুসলিম-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দারিদ্র দুঃখে ভরা জীবন নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে।

উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে এভাবে- পুতুল-খেলার কৃষ্ণনগর। যেন কোন খেয়ালি-শিশুর খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর। খোকার চলে যাওয়ার পথের পানে জননীর মত চেয়ে আছে, খোকার খেলার পুতুল সামনে নিয়ে। এরি একটেরে চাঁদসড়ক। একটা গোপন ব্যথার মত করে গাছ-পালার আড়াল টেনে রাখা।’ কত চমৎকার না?

কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়ক। মুসলমান, কনভার্টেড ক্যথলিক খ্রিস্টান এবং দুয়েক হিন্দু ঘরের বাসস্থান। ক্ষুধা, দুঃখ-দুর্দশা এদের নিত্যদিনের সঙ্গী। মাঝে মাঝে ঝগড়া করলেও পরে তা নাই হয়ে যায় ক্ষুধা-যন্ত্রণার সমীকরণে। গঁজালের মায়ের তিন ছেলে যৌবনে বয়সে মারা যায়। মৃত ছেলেদের বিধবা স্ত্রী আর তাদের প্রায় এক ডজন ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার। ছোটো ছেলে প্যাঁকালে বয়স ১৮-১৯ রাজমিস্ত্রী ও যাত্রাদলে নায়ক সেজে সবার ভরন পোষনের চেষ্টা করে।

প্যাঁকালের মা তার মেজোবউ এর সাথে প্যাঁকেলের বিয়ে দিতে চাইলে সে সব ছেড়ে বাইরে চলে যায় এমনকি তার ভালবাসার মানুষ খ্রিস্টান কূর্শিকেও না জানিয়ে। প্যাঁকালে চলে যাবার পর তাদের অভাবের সংসারে আরও অভাব ভর করে।

মেজোবৌ দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মনটিও সুন্দর সন্তানদের দুমুঠো খাদ্যর জন্য আর প্রিতিবেশীদের মিথ্যে অপবাদে মেজ-বৌ খ্রিস্টান হয়ে যান। তারপর পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ছোট্ট দুটি শিশুকে রেখেই একদিন চলে যান বরিশালে।

এদিকে কৃষ্ণনগরে নতুন বসাবাস শুরু করেন নাজির আর লতিফা বেগম। এখানে উত্থান হয় আনসার আর রুবী নামের দুজন চরিত্রের। আনসার বিপ্লবীনেতা। সে মেহনতী মানুষের জন্য সংগ্রাম করে। কস্টে থাকা মানুষের মনে বেঁচে আশার বীজ উপ্ত করতে করতে আনসারে শরীর সৃষ্টি হয় মরণব্যাধীর। এদিকে রুবির বাবা মা রুবির অপন্দের ছেলের সাথে বিবাহ দেয়। কিছুদিনের মধ্যে রুবি বিধবা হয়। ভাগ্যের নিপড়নে সে জর্জরিত। একদিন রুবিই অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়ে চলে যায় আনসারের কাছে।

আনসার আর রুবীর পরিণতি কি হয়েছিল? তাদের প্রেম কি তাদের বাঁচাতে পেরেছিল? মেজ-বৌ কি ফিরে এসেছিল তার সন্তানদে কাছে, তার ধর্মের কাছে? প্যাঁকাল আর কুর্শীর অবস্থাই বা কি হলো?

ক্ষুধার তাড়ণায় কেমন করে মানুষ ধর্মান্তরিত হতেও দ্বিধা করেনা, কেমন করে মানুষ নিজের সন্তানের মৃত্যু কামনা করে, কোন পরিস্থিতে মৃত্যুই তাদের কাছে ক্ষুধা হয়ে ওঠে, -উপন্যাসটি না পড়লে তা কখনোই জানা যাবেনা।

পাঠ-প্রক্রিয়াঃ উপন্যাসটি এতো সুন্দর বর্ননা দিয়ে শুরু হয়েছে - "পুতুল-খেলার কৃষ্ণনগর। যেন কোন খেয়ালি-শিশুর খেলাশেষের ভাঙা খেলাঘর"। এ বাক্য পড়লে পরবর্তী পেজে যাবার আগ্রহ জাগবেই সকল পাঠকের।

উপন্যাসটিতে প্রধানত দুঃখ, ক্ষুধা, দুর্দশা এসব ফোটে উঠেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধত্তোর এসব দুঃখ-যন্ত্রণা মানুষকে কিভাবে গ্রাস করেছিলো তা উপন্যাসটি পড়লে চোখের সামনে ভেসে উঠে। তৎকালিন পল্লীসমাজের একটা নিখুঁত চিত্র তুলে দিয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসটি একদম শুরু থেকে শেষ শব্দ পর্যন্ত যে প্রচণ্ডরকম যন্ত্রণার কাঁটাতারে হৃদপিণ্ডটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল, তা শুধু নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। কী শব্দপ্রয়োগ! কী ভাষাগত দ্যোতনা! কী ঝংকার তার বাক্যে! কী নিদারুণ হাহাকার তার বাচনভঙ্গিতে! কী গভীর জীবনবোধ, যাতে কেবল তলিয়েই যেতে হয়! এই উপন্যাসখানা পড়ছিলাম আর কিছু চিন্তার বাষ্প উদগীরণ করে ভাবছিলাম-- কাজী নজরুল ইসলাম যদি আরো কিছু উপন্যাস লিখে যেতে পারতেন--তাহলে হয়তো অনায়াসেই মহান কবি হওয়ার পাশাপাশি মহান ঔপন্যাসিকও হয়ে যেতেন।

চরিত্রগুলি এতো চমৎকার ও পরিপূর্ণরুপে ফুটিয়ে তুলতে খুব কম উপন্যাসেই নজর গোচর হয়েছে।

সমস্ত উপন্যাসের যোগসূত্র মেজোবউ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই প্রবণতা চূড়ান্তে উঠেছিল। নজরুল ইসলাম ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে মুসলমান নারী মেজ-বৌয়ের খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী জটিলতা, বেদনা ও কারুণ্য রূপায়িত করে সত্যি তাকে অমর করে গেছেন। বলতেই হয় ‘মেজ-বৌ’ নজরুলের এক অনবদ্য সৃষ্টি।

নজরুলের উপন্যাসে নজরুলই নায়ক। উপন্যাসের শুরুতে টেরিকাটা চুল আর থিয়েটারে গান গাওয়া প্যাঁকালের চরিত্র প্রতিনিধিত্ব করে লেটো গান দলের সেই নজরুলকে, আর শেষদিকে মানে পনেরো পরিচ্ছদে আনসারের আবির্ভাব। আনসার চরিত্রে নজরুলের আত্মপ্রতিফলন ঘটেছে। নজরুলের মতোই আনসার সাম্যবাদী—সমাজের নিচুতলার মানুষ—মেথর, মুচি, ঝাড়ুদার ইত্যাদি শ্রেণিকে সে সাম্যবাদের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছে। শাসন-শোষণহীন যে সমাজের স্বপ্ন আনসার দেখে তা কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না—কেবল মাত্র কথা এবং বক্তৃতায় সমাজে পরিবর্তন আসে না।

উপন্যাসের মূল উপকরণ দারিদ্র ও ক্ষুধা হলেও এতে রয়েছে রোমান্টিকতার ছোঁয়া অার্থ-সামাজিক ও প্রছন্ন রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মের নামে ব্যবসা বা ধর্মের অপব্যবহারের দিকটিও ফুঁটে উঠেছে সুন্দরভাবে।

উপন্যাসটি আপনাকে যেনো জীবনের শুরু থেকে সকলকিছু নতুন করে ভাববার অবকাশ দিবে এবং হিসেবের পাল্লার দড়ি ছিঁড়ে সকল বিষয়বস্তুগুলিকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুকে স্পর্শ করার উদ্যম শক্তি দান করবে।

হ্যাপি রিডিং ♥♥♥
পৃথিবী হোক বইময় ♥♥♥
Profile Image for Khobaib Hamdan.
19 reviews2 followers
May 6, 2022
মৃত্যুক্ষুধা: নিম্নবিত্ত সমাজের চিত্রকল্প

“বিধাতার দেওয়া ছেলেমেয়ে এরা বিধাতার হাতেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিত মনে পান্তাভাত খেয়ে মজুরিতে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে এসে বড় ছেলেটাকে বেশ করে দু-ঘা ঠেঙায়, মেজোটাকে সম্বন্ধের বাছবিচার না রেখে গালি দেয়, সেজোটাকে দেয় লজঞ্চুস, ছোটটাকে খায় চুমো, তারপর ভাত খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।”

📎“ঘুমন্ত ক্ষুধাতুর অজগরের জাগরণ দেখেছিস?” ক্ষুধিত অজগর যদি জেগে উঠে? সে আবার মৃত্যুক্ষুধা! মৃত্যুপুরে বসে প্রহর গুনে, মৃত্যুকে বরণ করতে অপেক্ষা করে! জন্ম নিয়েছে তাই মরতে হবে সবাই জানে, তবে সেই জন্মের উদ্দেশ্য যদি শুধু মৃত্যুই হয়। জন্মকে তারা মৃত্যুর রূপে দেখেছে ক্ষুধার যন্ত্রণায়। কী বিভৎস ক্ষুধা! ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে তীব্র সাগ্রহে। কেমন রূপ দুঃখের? আক্ষেপের? বেদনার? যারা দুমুঠো অন্নের জন্য অন্যের দুয়ারে সংশয়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তাদের অন্তরের কী রূপ?
একপাশে দেশের বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল অন্যপাশে দালানকোঠায় বড় বড় সাহেবদের বসবাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মা নদীর মাঝিতে যেটাকে বলে “ভদ্রপল্লী”। মাঝখানে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধযুক্ত একটা ছোট খাল যার পাশে একটা ছোট বস্তি। করোনাকালের কঠোর লকডাউনে তখন সবকিছুই প্রায় বন্ধ! আসছিলাম আন্দরকিল্লা থেকে রিকশায়। যখন
‘অভদ্রপল্লী’ বস্তির সামনে দিয়ে রিকশা যাচ্ছিল বস্তির একলোক রিকশার চাকা ধরে হাউমাউ করে কাঁদে, চোখগুলো জমাট রক্তের মতো টকটকে লাল হয়ে আছে! বলে, “বাবা, খাওন দেয় নইতো এখন মরুম, বাবা খাইতে দেয় নইলে মরুম!” এও কী “ঘুমন্ত ক্ষুধাতুর অজগরের জাগরণ”? নজরুলকে বলি, যদি এই হয় জাগরণ, তবে দেখেছি। সেদিন বইবন্ধুর এক সহযোদ্ধাকে নিয়ে জিইসি থেকে হেঁটে আসছিলাম ২নং গেট। আসার পথে দেখতে পাই ফ্লাইওভারের পাশের ছোট পথে আড়াআড়ি হয়ে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ! বন্ধুর মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, “দেশত্ পল'র সংখ্যা বউত্ বাড়ি গেইয়্যি, এগুন লইয়েরে আর কী গরা যায়। অঁঝ সোজা অইয়েরে ফ্লাইওভার'র নিচদ্দ্যি শুইত পারিবি এডে শু।” ওরে এমন বলতে দেখে বৃদ্ধ কেঁপে ওঠে সরতে চেষ্টা করে। চেহারায় ভেসে উঠে প্রচন্ড ক্ষোভ ও আক্ষেপ! পরে কাছে গিয়ে জিগ্যেস করি, বাবা কি হয়েছে আপনার? বলে “যা মিয়া যা।” “পল নয় রে পাল নয়, কুত্তারবাচ্চা উন যে খাইতো ন দেয়। ভুগোর জ্বালায় এডে পরি তন পরে” সেই কুত্তারবাচ্চা কারা কী জানি! তবে বৃদ্ধের চেহারায় যে ক্ষোভ তা বুঝি সমস্ত ভদ্রলোকেদের বিরুদ্ধে! ঘুমন্ত ক্ষুধাতুর এই অজগরেরও কী জাগরণ ঘটবে?

দারিদ্র্যতা, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, ধর্ম এরপরে বিপ্লব আবার প্রেম মৃত্যুক্ষুধা'র গল্পে দেখা দিবে নিম্নবিত্ত জনজীবনের সকল রূপ।

📎“জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এদের পুরুষেরা জনমজুর খাটে অর্থাৎ রাজমিস্ত্রী, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ওই রকমের কিছু একটা করে। আর মেয়েরা ধান ভানে, ঘর-গেরস্থালির কাজকর্ম করে, বাঁধে, কাঁদে এবং নানা দুঃখ-ধান্ধা করে পুরুষের দুঃখ লাঘব করার চেষ্টা করে। বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনের দুঃখকে বড় করে দেখার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়ত মস্ত বড় একটা অঘটন ঘটত। এরা যেন মৃত্যুর মাল গুদাম। অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে সাপ্লাই। আমদানি হতে যতক্ষণ, রফতানি হতেও ততক্ষণ।”
এরূপটি উপন্যাসের পটভূমি কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়ক বাস্তি এলাকার। সেখানে খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মিলেমিশে বসবাস। দারিদ্র্যতার উপর ক্ষুধার জোয়ার যেখানে ধর্মীয় বিভেদে সেখানে ভাঁটা পড়ে; ভাঁটা হলেও তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রীস্টানদের যে ধর্মগত ভেদাভেদ তা কোন এক সময় মিলে মিশে একাত্ম হয়ে যেতেও বেশি দেরি লাগে না। আসলে সূক্ষ্ম বিরোধগুলো নিম্নবিত্ত মানুষদের অত ভাবায়ও না।

“কান্না তো নয়, বেঁচে থাকার প্রতিবাদ।” প্যাঁকেলে, তার মা, বিধবা তিন বড়, মেজ, সেজ বৌ সহ ডজনখানেক ছেলেপুলে নিয়ে তাদের বসবাস। পুরো পরিবারের ভার প্যাঁকেলে একজনের উপর। খেয়ে না খেয়ে তাদের জীবনযাপন। লেখক দেখান এক চরিত্র যতটা ব্যক্তিক ততটা সামাজিক। কেউ কেউ সামাজিক কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসতে পারলেও তা অতিক্রম করতে পারে না অনেকে। সমাজ ব্যবস্থা মানুষের চরিত্রের গতি নির্ণয় করে দেয়, তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় সর্বোপরি এক অবধারিত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। কেউ কেউ প্রচলনের স্রোতের উপর গা ভাসিয়ে ভেসে যেতে থাকে প্রচলিত মতের মহাসমুদ্রের দিকে। কেউ স্রোতের উল্টো পথে দৌঁড়ালে তারাই নিয়মের ব্যত্যয়! গজালের মায়ের প্রাত্যহিক জীবনে তার বয়স, অভিজ্ঞতা ও মনোকামনা সবকিছু সঁপে দিতে হয় সামাজিক ব্যবস্থার পাদদেশে। ব্যতিক্রমী রূপ ও চিন্তা নিয়ে আত্মপ্রকাশ দেখা যায় অকাল বিধবা মেজ বৌয়ের। তার ধারা সম্ভব হয় নি সমাজব্যবস্থার সাথে আপোষ করে নিজের সবকিছু "না"তে মিলিয়ে দেয়া। সেজ বৌয়ের অসুখকালীন সময়ে তার চিকিৎসার জন্য যে ডাক্তার ও নার্স মিস্ জোন্স এসেছিলেন, সেজবৌ'র মৃত্যুর পর সেই মিশনারীর হাতে ক্ষুধার্ত মেজ বৌ হয়ে যায় খ্রিস্টান। ক্ষুধার যন্ত্রণা মিঠাই ধর্মের বিনিময়ে। একদিকে দেখা যায় মেজ বৌয়ের সিদ্ধান্ত সামাজিক অপসাংস্কৃতিক আয়োজনের গাড়ে লাগিয়ে দেয় শক্ত চপেটাঘাত অপরদিকে ধর্মান্তরকরণের মত্ত খেলা। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ঘর থেকে বের হওয়া অকাল বিধবা মেজ বউ ধর্মীয় বাতাবরণের এক পরিবর্তিত অধ্যায়ের শিকার। মুসলিম হতে ডাইরেক্ট খ্রিস্টানে রূপান্তরে দেখা যায় তৎকালীন সময়ে মিশনারীদের বাহ্যিক রূপের নিচে আঁকা কুৎসিত জাল। অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে ব্যবহার করে তৎকালীন হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করার মত্ত যে খেলায় মেতে ছিল খ্রিস্টান মিশনারি তা লেখকের লেখায় উঠে এসেছে।

রূপের হাঁড়ি মেজ বৌকে বিয়ে করতে বললেও প্যাকেলে অস্বীকৃতি জানায়। “যেখানে ক্ষুধা নিত্যসঙ্গী ও মৃত্যু তার প্রতিকার” সেখানেও প্রেম আসে। টেরি কাঁটা, সিগারেট খাওয়া, চা পান খেয়ে একটু বিলেতি ভাব নেওয়া প্যাকেলে ভালোবাসে কুর্শিকে। লেখক বলে, “মেয়েটি যেন একখানা চার পয়সা দামের চৌকো পাউরুটি।” খ্রিস্টান প্রেমিকা কুর্শিকে বিয়ে করে সেও একসময় খ্রিস্টান হয়ে যায়। সমাজচ্যুত হওয়ার আশংকায় পালিয়ে যায় অন্যত্র। মানুষের ব্যক্তিক ভালবাসা, উচ্ছ্বাস, আবেগ আর প্রীতির এক নির্মল বাঁধনে বাধা প্যাঁকালে এবং কুর্শি।
অন্যদিকে উঠতি যুবকদের সুখসন্ধানী স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে মিশনারীর লোকেরা অপকৌশলে মাততে থাকে, তাদের দুজন ও মেজ বৌকে পাঠিয়ে দেয়া হয় বরিশাল। এদিকে তা দেখে প্যাকেলের মায়ের মরি মরি অবস্থা হয়ে যায়। সে অবস্থায় সুযোগ বুঝে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মোল্লারা লুটেপুটে দারিদ্র্যতাকে মৃত্যুর দোয়ারে নিয়ে যায়।


উপন্যাসে এবার উপস্থিত হয় বিপ্লবী আনসার। বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্ভুদ্ধ বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মী সে। গোপন আস্তানায় চলে বৈপ্লবিক দলের কার্যকলাপ। ব্রিটিশ শাসকের অন্তরালে কাজ করতে গিয়ে ঘানি পোহাতে হয় ঝক্কি ঝামেলার। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় একেক জায়গায়। দিশেহারা হয়ে অনিশ্চিত কয়েকদিনের জীবন গাড়ে অনিশ্চিত স্থানে। বিদ্রোহী কবি তাঁর স্বভাবসুলভ বৈপ্লবিক চেতনায় আনসার চরিত্রটিতে উপস্থাপন করেন। বৈপ্লবিক দলের আনসার আর্থিক সচ্ছলতা থাকার পরও অর্থাবিলাসে না মেতে এসেছে ক্ষুধিত মানুষের পাশে। তাদের সাথে থেকে তাদের দুঃখ দূর করায় যেন তার একমাত্র দায়িত্ব। রুবির সাথে তার প্রেম থাকলেও রুবির পিতা তাকে বিয়ে দেয় আইসিএস পরীক্ষার্থী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। রুবির বিয়ে তার সাথে হলে স্বামী হিসেবে ভালোবাসেনি তাকে। না পাওয়া যন্ত্রণায় রুবির জীবনে তিক্ততা নেমে আসে, স্বামীর মৃত্যু হলেও সে সত্য প্রকাশে নির্লিপ্ত। রুবি আনসারকে বলে,—
“দেখ আনু ভাই, যাকে কোনদিন স্বীকার করি নি কোন-কিছু দিয়ে, সেই হতভাগ্যেরই মৃত্যু স্মৃতি আমায় বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জিন্দেগী ভরে — নিজেকে এই অপমান করার দায় থেকে কী করে মুক্তি পায় বলতে পার?”

মোয়াজ্জেমের মৃত্যুর পর বিধবা রুবির জীবনে নেমে আসে সমাজের কুসংস্কারগত সকল বিধিনিষেধ। আনসারকে পুলিশ হাজতে পাঠানোর পর রুবি আসে আনু'র বোন লতিফার ঘরে। অতঃপর পত্রপাঠ শেষে (ফের মুসলিম হয়ে যাওয়া) মেজ বৌয়ের উৎসাহে সমাজের কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে রুবি যায় আনসারের কাছে। উপন্যাসের পাতায় পাতায় মিশানো ক্ষুধা ও মৃত্যু শেষটাও তেমন। মৃত্যুর আগে মিলিত হয় প্রেম। ক্ষুধিত অজগরের সর্বগ্রাসী আকর্ষণে সমর্পণ করে নিজেকে। দু'জনে প্রেমের সাথে ভাগ করে রোগ এবং মৃত্যু পরিশেষে, প্রেম ও ক্ষুধার তাড়নায় দু'জনের মৃত্যুর অপেক্ষা।

📎
আনসারের সাম্যবাদী দর্শন, অর্থনৈতিক টানাপোড়া লাঘবে মেজ বউয়ের ধর্মান্তর, মিশনারীর অপকৌশল, প্যাকেলে, কুর্শি ও মেজ বৌয়ের বরিশাল গমন, নজির সাহেব ও লতিফার স্নেহ ও ভালোবাসার দৃশ্য, নিজ সন্তানের মঙ্গলের জন্য ধর্মের বলি, প্যাকেলের মা'র নীরব আত্মচিৎকার, দারিদ্র্যতার চাপ, কুসংস্কার, নারী জীবনের দুবির্ষহ অন্ধকার, যুদ্ধপরবর্তী দুর্বল সমাজের চিত্র, ধর্মনেতার অধার্মিক কাজকর্ম এবং ক্ষুধার তাড়না ও পরিণামে মৃত্যু "মৃত্যুক্ষুধা" এক বাস্তবিক সমাজের চিত্রকল্প।

▫বই— মৃত্যুক্ষুধা
▪লেখক— কাজী নজরুল ইসলাম
▫ধরন— উপন্যাস
▪পৃষ্ঠা সংখ্যা— ১১৫-১২০
▫আনুমানিক মূল্য— ৳১২০-১৫০


খোবাইব হামদান
মিয়াখাননগর, চট্টগ্রাম
Profile Image for FaRzana YeSmin.
7 reviews6 followers
December 29, 2022
"বিধাতার দেওয়া ছেলেমেয়ে এরা বিধাতার হাতেই সঁপে দিয়ে নিশ্চিত মনে পান্তাভাত খেয়ে মজুরিতে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে এসে বড় ছেলেটাকে বেশ করে দু-ঘা ঠেঙায়, মেজোটাকে সম্বন্ধের বাছবিচার না রেখে গালি দেয়, সেজোটাকে দেয় লজঞ্চুস, ছোটটাকে খায় চুমো, তারপর ভাত খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।”

বাংলা সাহিত্যিক, বিশেষ করে, বাঙালি মুসলিম লেখকদের অকালে চলে যাওয়ার আফসোস ছিলো আহমদ ছফার লেখা পড়ে। সেই সাথে আরেক নাম যুক্ত হলো, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। হয়তো তার লেখাগুলো পাঠ্যবইয়ের বাইরে পূর্বে পড়া হয়নি বলেই এতো দেরি!
পক্ষাঘাতগ্রস্ত না হয়ে উনি যদি আরো কিছুদিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতেন! মাত্র ৩টি উপন্যাসের জায়গায় আমরা আরো কত অমূল্য লেখনী পেতাম তার কাছ থেকে!

মৃত্যুক্ষুধা- নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবন সংগ্রাম।
হায়! কি ছিলোনা এতে? অসাম্প্রদায়িকতা, আবার ধর্মকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর মানুষের শোষণ, সাথে না খেতে পেয়ে জন্মকেই অভিশাপরূপে গ্রহণ করা মানুষগুলোর আকুতিভরা জীবনযুদ্ধ!

একটু খেতে পাবার আশায় মানুষগুলো মুসলমান থেকে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। ওষুধের অভাবে অকালেই ঝরে যাচ্ছে প্রাণ, আর সে যদি হয় উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি, তবে তো এ যেন " গোদের উপর বিষফোঁড়া"। বাচ্চাগুলোও যেন জন্মেছে ক্ষুধার তাড়নায় আবার সেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়বে বলে।

সংগ্রামী, বিপ্লবী নায়ক আনসারের এমন সমাপ্তি যেন পাঠককে আরেকদফা মৃত্যুক্ষুধার কষাঘাতে জর্জরিত করার কৌশল।

এই বইখানা পড়ে মনে হয়েছে, দম বন্ধ হয়ে থাকা মানুষ হঠাৎ করেই যেন একটু দম নেওয়ার সুযোগ পেল।কিন্তু, সেই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে না করতেই আবার দম বন্ধ হবার জোগাড়!

মৃত্যুক্ষুধা
কাজী নজরুল ইসলাম
Profile Image for Sajid.
457 reviews110 followers
April 5, 2020
প্রশংসা করার ভাষা যেনো মনোজগতে ধাক্কা দি���়ে অনন্ত জগতের শূন্যতার তলে ডুবে গেছে।প্রশংসা বাণী ছাড়া আমার আর ছিলই কি যা এই উপন্যাসের মহান লেখককে দিতে পারতাম! বাংলা সাহিত্যে নির্দ্বিধায় এটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে একটি এবং সর্বদাই আমার মনের তলে এটি আপন বাসস্হান নিয়ে বসবাস করবে। কি চমৎকার লেখার স্টাইল! কি চমৎকার উপমা! কি চমৎকার অনুভূতির প্রকাশ! এই উপন্যাসখানা পড়ছিলাম আর কিছু চিন্তার বাষ্প উদগীরণ করে ভাবছিলাম-- কাজী নজরুল ইসলাম যদি আরো কিছু উপন্যাস লিখে যেতে পারতেন--তাহলে হয়তো অনায়াসেই মহান কবি হওয়ার পাশাপাশি মহান ঔপন্যাসিকও হয়ে যেতেন। চরিত্রগুলি এতো চমৎকার ও পরিপূর্ণরুপে ফুটিয়ে তুলতে খুব কম উপন্যাসেই নজর গোচর হয়েছে।মানুষের দুঃখ,বেদণাকে যেনো তিনি এক অজানা জগতের আড়াল থেকে আমাদের দৃষ্টিগোচরে সাহায্য করেছেন। জীবনের প্রতিমূহুর্তে দুঃখের,অভাবের অসংযত ধাক্কায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত সমাজের উপর যে প্রভাব ফেলে তা যেনো ধর্ম ও ইশ্বরকেও বাঁকা চোখে দেখা থেকে পিছু হটে় না,বরং ধর্মান্ধ মানুষগুলো স্বল্প মূল্যের আফিম খাওয়ার মতো করে যে ঘন কুয়াশার মতো ঘোরের সৃষ্টি করে যেখানে না পৌঁছে অভাবগ্রস্হ মানুষের ব্যর্থ আর্তনাদ,আর না পৌঁছে চোখের জলে সিক্ত কঙ্কালের অজস্র কাঁপুনি। উপন্যাসটি আমাকে যেনো জীবনের শুরু থেকে সকলকিছু নতুন করে ভাববার অবকাশ দিলো এবং হিসেবের পাল্লার দড়ি ছিঁড়ে সকল বিষয়বস্তুগুলিকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুকে স্পর্শ করার উদ্যম শক্তি দান করলো।
Profile Image for Tanmay.
14 reviews
June 1, 2025
স্কুল,কলেজের বদৌলতে কবি, প্রাবন্ধিক নজরুলের সাথে পরিচিতি হলেও ঔপন্যাসিক নজরুলের সাথে আমাদের পরিচিতি কম। তবে কথাসাহিত্যিক হিসেবেও নজরুল কতখানি শক্তিশালী ছিলেন তার কিঞ্চিৎ নমুনা পাওয়া যায় এ উপন্যাসের মাধ্যমে।
কৃষ্ণনগরে অবস্থানকালে নজরুল "মৃত্যুক্ষুধা" উপন্যাসটি রচনা করেন। তাই এই উপন্যাসে নজরুলের যাপিত জীবনের কিছু ঘটনার অনেকখানি ছায়াপাত ঘটেছে। কবি এ সময় কঠিন দারিদ্র্য-দুঃখে নিপতিত হয়েছিলেন।
বইটি কলেবরে ছোট হলেও এর বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি কোনো অংশেই কম নয়। উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ক্ষুধা, শুধু আহারের ক্ষুধা নয়, বরং সম্মান, আশ্রয় ও ভালোবাসার ক্ষুধা। এই ক্ষুধায় পরে মানুষের শুধু শারীরিক মৃত্যুই নয়, আত্মিক মৃত্যুও ঘটে। এই ক্ষুধা সমাজের তলানিতে পড়ে থাকা একদল মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করে, যাদের জীবনে প্রতিদিনের সংগ্রাম শুধুই বেঁচে থাকার জন্য।
উপন্যাসটি মূলত তিন ধর্মীয় সম্প্রদায় খ্রিস্টান, মুসলিম ও হিন্দু এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিভাজন ও সহানুভূতির জটিল বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে রচিত। ধর্ম এখানে সংঘাতের কারণ, আবার একইসাথে সহমর্মিতার সেতুও বটে। নজরুল এই দ্বন্দ্বকে সাহসিকতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। আরো দেখিয়েছেন ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম। এই উপন্যাসটির রিভিউ দেয়া আমার মত আনাড়ির পক্ষে সম্ভব নয়, বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রতন "মৃত্যুক্ষুধা"।
Profile Image for Anjum Haz.
285 reviews69 followers
March 3, 2019
দেশী-বিদেশী উপন্যাস পড়লাম এতো, অথচ ঘরের কবির লিখা উপন্যাসই পড়া হয়নি এতো দিন! নজরুলের কবিতার শক্তির সাথে পরিচয় কৈশোর থেকে। আজকে জানলাম, কি শক্তি-দীপ্ত উপন্যাসই না লিখেছেন নজরুল! "মৃত্যক্ষুধা" যে উপন্যাসের নাম, তার ভাষাটাও তেমনি ক্ষুরধার। ক্ষুধা যে মৃত্যুর জন্যও হয় আর তার যে তীব্রতা - নজরুলের লেখনীতে তা ধরা পড়েছে।
অসহায় দরিদ্র মানুষের সংগ্রাম, ক্ষুধার মর্মস্পর্শী হাহাকার, ধর্ম তাকে আরো আটকিয়ে রাখতে চায়। ক্ষুধার কাছে, বাস্তবতার কাছে ধর্ম তখন তুচ্ছ, হাটে বেঁচে দেওয়া শেষ সম্বল।
নজরুলের তীক্ষ্ণ ভাষা তাকে ব্যাঙ্গ করেছে -
"- আচ্ছা বলুন তো, আপনার হঠাৎ খ্রিস্টান হবার কারণ কি? ...
- আমি তো হঠাৎ খ্রিস্টান হই নি। ...
- তার মানে আপনি একটু একটু করে খ্রিস্টান হয়েছেন, তাই বলতে চান বুঝি? ...
- জি না। আপনারা একটু একটু করে আমায় খ্রিস্টান করেছেন।"
পুরো উপন্যাসেই নজরুল বাস্তবতার কঠিন রূপকে তীক্ষ্ণ ভাষায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের ইতিটাও দাগ কাটার মতো, স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।
"মৃত্যক্ষুধা" প্রিয় একটি উপন্যাস হয়ে থাকবে।
Profile Image for Abu Hanif.
45 reviews1 follower
January 26, 2024
কৃষ্ণনগর এর মৃত্যশোক আর ক্ষুধায় জর্জরিত মানুষগুলোর মধ্যে কতক মুসলিম আর কতক খ্রিস্টান। চানাচুরের বাদামের ন্যায় ছিটেফোঁটা কয়েকঘর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ও আছে সেখানে। স্বামীহীনা, পিতৃহীন ক্ষুধার্ত মানুষগুলো স্বার্থ সন্ধিৎসু ও ধর্মব্যবসায়ীদের মাঝে পড়ে তারা আসলে কোনটাকে গুরুত্ব দেবে? ধর্ম নাকি খাদ্য! যাদের পেটে ক্ষুধা নেই, তারা কি সুখী? চরম দুঃখের এই ক্ষুদ্র জীবনে সুখ মনেকরে সর্বস্ব ত্যাগ করে যেটাকে মানুষ বেছে নেয়, তাতে আদৌ কতখানি সুখ পাওয়া যায়, এসব জিনিস খুবই দারুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে "মৃত্যুক্ষুধায়"। নজরুল ইসলাম এর এই লেখায় শব্দ, বাক্য ও উপমা এত সুন্দর করে তিনি সাজিয়েছেন যে, আমি অতিমাত্রায় মুগ্ধ হয়েছি!!
Profile Image for Nymul Yeachin.
1 review2 followers
May 27, 2022
ঔপন্যাসিক হিসাবে কাজী নজরুলকে আমার একটু অন্য রকম লেগেছে।
উনি ঠিক উপন্যাস লিখার জন্য লিখেননি। সমাজের মানুষের বেদনা গুলো তুলে ধরার জন্যই উপন্যাস লিখেছেন। উনার বই গুলোর নাম দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
মৃত্যুক্ষধা উপন্যাসে সার্থক ভাবে অভাবী সংসারের দূঃখ, যন্ত্রণা, বেদনার ছবি তুলে এনেছেন।সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জীবন কাছ থেকে দেখেছেনতিনি। উপন্যাসে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
তবে গল্পের শেষের দিকের ঘঠনা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি এগিয়েছে। প্রথম দিকে দারিদ্র্য জীবনসংগ্রাম মূল্য বিষয়বস্তু মনে হচ্ছিল, শেষের দিকে প্রেম আর বিরহ এনাতে কেমন জানি খাপছাড়া লেগেছে।
This entire review has been hidden because of spoilers.
Displaying 1 - 30 of 51 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.