উনিশ শতকের শেষ দিকের গল্প। ১৮৭০ থেকে ১৮৯০ মধ্যেই সময়কাল। ব্রিটিশরা তখন সিলেট, আসামে চা বাগান তৈরি করা শুরু করেছে। জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান তৈরি করার জন্য তাদের শ্রমিক দরকার ছিলো। অমানুষিক কষ্টের এই কাজ করার জন্য স্থানীয় শ্রমিকরা সাড়া দেয়নি। তাই পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড়, ছোটো নাগপুরের জঙ্গলের বিভিন্ন অভাবী আদিবাসী গোষ্ঠীদের আনা হয়েছিল শ্রমিক হিসেবে। তাদের ছলনায় ভুলিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে যারা বাগানে নিয়ে আসতো তাদের বলা হতো আড়কাঠি। এই গল্পে একজন বাঙ্গালী যুবক কীভাবে ঘটনাচক্রে একজন আড়কাঠি হয়ে উঠলো এবং পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে কীভাবে সে একটা বীভৎস সত্য আবিষ্কার করলো তাই দেখানো হয়েছে, যেখানে অনেকগুলো হত্যা জড়িত।
যে কারণে "জল নেই, পাথর" ভালো লেগেছে, ঠিক সেই কারণে "আড়কাঠি " ভালো লাগলো না। কথাটা কি সাংঘর্ষিক? প্রথমোক্ত উপন্যাসে কৌতুক ও উদ্ভট ঘটনার আবহ থাকায় পুরো গল্প বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। কিন্তু "আড়কাঠি " সিরিয়াস উপন্যাস। বাস্তবের যে করুণ ও দুর্বিষহ ঘটনার প্রেক্ষিতে গল্পের পটভূমি রচিত হয়েছে তার প্রতি লেখক সুবিচার করতে পারেননি।যথারীতি ওবায়েদ হক এখানেও রোমাঞ্চ ও রহস্য রাখতে চেয়েছেন এবং শেষে একটা টুইস্টও দিয়েছেন। কথা হচ্ছে, একই সাথে তিনি চরিত্রদের বাস্তব অবস্থাও যথাযথভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। দুইটার মধ্যে বিরোধ নেই কিন্তু উপন্যাসের কঠোর বাস্তববাদী উপাদানের সাথে থ্রিলার অংশটা একেবারেই খাপ খায়নি।লেখকের বই লেখার ফর্মুলাতে (বিশেষত টুইস্টের ক্ষেত্রে) পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। এটা আরেকটা নেতিবাচক দিক। ইতিবাচক দিক বলতে, "আড়কাঠি " সুখপাঠ্য ও সিনেমা হিসেবে অধিকতর উপভোগ্য হবে।
শেষ করলোম। নিপীড়নের ইতিহাস বরাবরই লজ্জার। অথচ গল্পটা শুধু তা-ই নয়। মানুষের, বন, পিনু, দেবতা, ক্ষমতা -সব এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। আর কেমন লেগেছে? সারাদিন কুয়াশা ঢাকা দিনে যেমন লাগে। ভালো, কিন্তু বিষন্নতার ছোঁয়া মেশানো ভালো। "নরেন সেদিন উপলব্ধি করলো, ঈশ্বরকে মানুষ ভয় পায় না, নয়তো সর্বজ্ঞ ঈশ্বর সব দেখছি যেন অনাচার করতে পারত না, মানুষ আসলে ভয় পায় মানুষকেই। "
"ক্ষমতা থাকলে তা প্রদর্শন না করতে পারলে ক্ষমতাবানদের তা অসহ্য লাগে। " - কতো সত্য কথা! এ দুনিয়াতে বেঁচে থাকলে এ সত্যকে সামনে নিয়ে চলতে হয়। হাত-পা বাঁধা থাকে ওই ক্ষমতা আর টাকার কাছে। ক্ষমতা থাকলে মাথা নোয়াতে হয়না, ভয় পেতে হয় না, সবচেয়ে বড় বিষয়-মানুষকে মানুষ বলে গুণতে হয়না।
বইটা কতোগুলো দিক তুলে ধরে! এই আরণ্যকের মতোন শান্তির বর্ণনা দিচ্ছে তো, এই ক্ষমতার কালো অধ্যায় দেখাচ্ছে, এই মানুষের ভালোমানুষি দেখাচ্ছে তো, এই কদর্য রূপ দেখাচ্ছে।
“দীনেশ বিনা প্রয়োজনে কিছুক্ষণ পরপর তার কিশোরী বধুর স্মৃতিচিহ্ন রুমালখানা বের করে নাকে মুখে চেপে ধরে আবার রেখে দিচ্ছে। তার ছেলেমানুষি কারো কাছে ধরা পড়ে গেল নাকি সেটাও লক্ষ রাখছে। বউর প্রতি ভালোবাসা কোনোরকমে না প্রকাশ হয়ে যায়, এই নিয়ে সে সর্বদা তটস্থ, এই বাংলায় বউকে ভালোবাসার চেয়ে কাপুরুষতা আর নেই।“
ওবায়েদ হক বিয়ে শাদি করেছেন কী না জানা নেই। তবে কথা শতভাগ সত্য। জীবন থেকে নেয়া। যদিও বইয়ের কন্টেক্সট অনুযায়ী এই অংশটুকুর গুরুত্ব একেবারেই কম।
আড়কাঠি।
ভদ্রভাষায় যারা কুলি মজুর সংগ্রহ করে যারা, চা বাগানের জন্য শ্রমিক যোগাড় করার কাজ করে তাদের 'আড়কাঠি' বলে।
ইংরেজ সাহেবদের চায়ের বাগানে শ্রমিক লাগবে। একটা দুটো নয়, শত শত। এসব ছোটখাটো নোংরা কাজ সাহেবরা করেন না। নোংরা, অসভ্য ইন্ডিয়ানরা আছে এসব কাজ করার জন্যে। এদের আবার ফলনও অনেক বেশি। একটা মরলে দশটা জন্মায়। জবাবদিহি, জরিমানা বা শাস্তিরও কোনো ভয় নাই। একটু ভালো থাকার লোভ দেখালেই দলে দলে কাজ করতে ভীড়ে যায়। অন্ন, বস্ত্র, পরিবারের খুশির জন্যে এরা সব রকম পরিশ্রম করতে পারে। এসব অসভ্যদের কিনতে যাওয়াটাও ভদ্র সভ্য ইংরেজ সাহেবদের জন্য অসম্মানের ব্যাপার। তাই এসব ছোটখাটো হাত নোংরা কাজ করার জন্যে তাদের কিছু ব্লাডি ইন্ডিয়ান চাকর থাকে। টাকার লোভে এসব চাকর নিজের স্বদেশীদের দলে দলে কোরবানি দিতেও কার্পন্য করে না।
উপরোক্ত অংশটুকু পড়লে বোঝা যাচ্ছে এই 'আড়কাঠি' লোকগুলো মোটেই সুবিধার না। টাকাই এদের ঈশ্বর। যাদের কাছে টাকাই একমাত্র ঈশ্বর, তারা টাকা কামানোর জন্যে যে কোন অন্যায় করতে পারে। পারে শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে। কিন্তু কেমন হয় যদি না জেনে দু'জন ভালো মানুষ এই আড়কাঠিদের দলে ভীড়ে যায়?
গল্পটা নরেনের৷ যার মায়ের মারা যাওয়ার উপায় এবং উপলক্ষের অভাব ছিল না। কিন্তু মারা গেল কালোমুখো এক দানবের চাকার তলায়। যার বাবা ছিল মদ্যপ, মদের নেশায় নিজের পরিবার ধ্বংস করার পর একদিন মদের দোকান থেকে চারজনের ঘাড়ে করে ফিরে এলো। দিন যায় বছর যায়। ঘটনার পরিক্রমায় তার পরিচয় হয় দীনেশের সঙ্গে। সহজসরল ছেলে। ভীরু হলেও কাপুরুষ নয়। বুক ভরা ভালোবাসা তার। কাজের সন্ধানে দীনেশের মামাশ্বশুরের কাছে যাওয়ার পর তাদের আড়কাঠিদের সঙ্গে জুটিয়ে দেয়া হয়। যাদের সর্দার অঘোরবাবু। দায়িত্ব দেয়া হয় চা বাগানের জন্য শ্রমিক যোগাড় করে আনার। নরেন, দীনেশ, ভোলা, চারু, অঘোরবাবু চললেন মানুষ কিনতে। যদিও নরেন বা দীনেশের কোনো ধারণাই ছিল না চা বাগানের এসব শ্রমিকদের কপালে কী ঘটে।
সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে ওবায়েদ হকের লেখার মধ্যে যে মাদকতা আছে সেটা সম্ভবত খুব কম লেখকের থাকে। তবে এই বইটা একটানে না পড়ে একটু রয়েসয়ে আস্তে-ধীরে পড়তে সম্ভবত বেশি ভালো লাগবে। বইয়ের প্রথম লাইন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়ার ক্ষমতা সবার থাকে না। শুরু করেন যেই আকর্ষণের সঙ্গে, শেষটাও হয় ঠিক একই টানে। চমৎকার গল্প, ততোধিক সুন্দর তার ভাষার প্রয়োগ। প্রতিটা পৃষ্ঠায় এত সহজ মায়াময় ভাষায় একের পর এক ঘটনার বিবরণ দিয়ে যান, প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। তার লেখার অন্যতম শক্তিশালী উপাদান হিউমার। অত্যন্ত দুঃখের কোন ঘটনা বলছেন, কিন্তু এমনভাবে বলেন পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে যায় এখানে হাসবে নাকি কাঁদবে।
'আড়কাঠি' বইয়ের গল্প, চরিত্রায়ন, ভাষার প্রয়োগ সবই খাপে খাপ ময়নার বাপ। প্রায় দেড়শো বছর আগের ঘটনা, পরিবেশ, স্থান এত সুন্দর ভাবে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন মনেই হচ্ছিল না আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করছি। বইয়ের চরিত্রগুলোও নিজেদের স্থানে অসাধারণ। নরেন, দীনেশ, অঘোরবাবু, চারু, ভোলা বা অন্যান্য ছোট ছোট চরিত্রে যারাই বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে সবারই কোনো না কোনো গুরুত্ব রয়েছে। সবাই ঘটনার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। কোথাও মনে হয়নি লেখক অকারণে একটা শব্দ বাড়িয়ে লিখেছেন।
বই নিয়ে আলাপ আলোচনা করার সময় আমার শব্দ খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু ‘আড়কাঠি’ নিয়ে লিখতে গিয়ে কিছুতেই মনমতো আলোচনা করা যাচ্ছে না। আমার এই ধরনের গল্প ভালো লাগে জন্যেই সম্ভবত বইটা বেশ ভালো লেগেছে। তাই মনে হচ্ছে এটা লেখা দরকার, বইয়ের ওই লাইন সম্পর্কে ক'টা কথা বলা দরকার, ওই চরিত্র নিয়ে আরেকটু আলোচনা করা যাক। কিন্তু কলেবর আর বাড়াতে ইচ্ছে করছে না।
“আমার স্মৃতিকথায় তোমার স্থান হবে না সুরেন্দ্র, ইতিহাসে তোমার নাম উঠবে না। তুমি বড়োজোর একটা গল্প হয়ে থাকবে, যেটা শুনে কেউ বিশ্বাস করবে না।“
তবে ওবায়েদ হক ইতিহাসে থাকবেন। তিনি যদি নিজের লেখা ধরে রাখতে পারেন বা আরো উন্নতি করেন তিনি ইতিহাসে থেকে যাবেন৷ অন্তত আমার তাই মনে হয়।
গল্পের সময়কাল উনিশ শতকের শেষের দিক, ব্রিটিশরা তখন সিলেট, আসামের দিকে চা বাগান বিস্তারে ব��যস্ত। আর এসব কাজের জন্য শ্রমিক হিসেবে টার্গেট করা হতো অতি প্রত্যন্ত জঙ্গলে বাস করা আদিবাসীদের। আর আড়কাঠির কাজ হচ্ছে এইসব বলিকা বাখরা জোগাড় করা। আড়কাঠির মূল গল্প শুরু হয়েছে গল্পের নায়ক নরেনের নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র যাত্রার মধ্য দিয়ে। পথিমধ্যে সে যাত্রা ভঙ্গ হয়ে তার ভাগ্য জুড়ে যায় আরেক রোমাঞ্চকর যাত্রার সাথে- বনেজঙ্গলে, উদ্দেশ্য চা বাগানের জন্য আদিবাসীদের জোগাড় করা যার জন্য পাড়ি দিতে হবে দুর্গম পথ।
নরেনদের এই যাত্রাপথের অংশের বর্ণনা পড়তে ভালোই লাগে, এডভেঞ্চার কাজ করে। তবে আড়কাঠি আসলে যে ভিশন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সেটা পূর্ণ করতে পারেনি। উলটো সেই একই ফরম্যাট মোতাবেক টুইস্ট দিতে গিয়ে ওবায়েদ হক আড়কাঠির সাথে অন্যায্য আচরণই করেছেন। গল্প চা বাগানেই যেতে পারলো না, অথচ প্রচ্ছদ ইঙ্গিত দেয় সরাসরি চা-বাগানঘটিত কোনো গল্পের। থ্রিলার থ্রিলার ভাব আর টুইস্ট কি আসলেই বাধ্যতামূলক!? তাও আবার মানানসই না!
ফার্স্ট হাফ,মনে হলো বড় কোনো লেখকের সামাজিক কোনো উপন্যাস পড়ছি। গ্রামীন জীবন। মাতাল বাবা দুঃখী মা। একাকী একটা ছেলে চুপচাপ,শান্ত সবার চেয়ে অন্যরকম। সেকেন্ড হাফ, মনে হলো চাঁদের পাহাড় বা যকের ধন টাইপের অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস পড়ছি। পথের গল্প,যাত্রাপথের নানারকম রহস্য,রোমাঞ্চ। বিপদসংকুল পরিবেশ তৈরি করে পাঠকের মন মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া উত্তেজনা।
গল্পটা নরেনের। যার মাতাল বাবা দুঃখী মা মারা যাবার পর সে কেমন যেন হয়ে গেছিলো। দুরন্তপনা ছিলো না,জীবনের প্রতি ভয় বা মায়াও ছিলো না। তারপরও সময়ের সাথে একটা গাছও বেড়ে ওঠে,নরেন তো মানুষ। আর বেড়ে উঠতে উঠতে কারো সাতে পাঁচে না থাকা নরেন মানুষের সত্তর পঞ্চাশে থাকতে লাগলো। গ্রামে যেখানে যার যা প্রয়োজন নরেন না হলে চলেই না। এভাবেই একদিন একজনের প্রয়োজনে প্রথম গ্রামের বাইরে পা রেখে নরেন উপলব্ধি করলো, পৃথিবী মানেই তো শুধু তাদের গ্রাম নয়! তাদের গ্রামের বাইরে বিশাল একটা পৃথিবী রয়েছে তা তার অজানা ছিলো। নরেন আর ঘরে ফিরে গেলো না। পাকেচক্রে নিজেকে সে আবিষ্কার করলো আড়কাঠির দলে।
বাংলাদেশের চা বাগানে বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া হয় না,বা বলা যায় তারা থাকে না। এত কষ্ট করতে হয় যে তারা পালিয়ে যায়। তাই আড়কাঠির এই দলটি ভারতের আনাচ কানাচ থেকে ধরে আনে মানুষ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের আনার পথে বিপদসংকুল পরিবেশে পথেই মারা যায় অর্ধেক মানুষ,বাকি অর্ধেক যদিওবা পৌঁছাতে পারে কাজের চাপে তারাও অর্ধমৃত হয়েই যায়। তাই বলে আড়কাঠির এই দলটিকে নির্মম ভাববেন না। একই কষ্ট,একই যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হয় তাদেরও। জীবনের মায়া তাদেরও ত্যাগ করতে হয়। তাদেরও পরিবার আছে,ফেলে আসা জীবনের প্রতি তাদেরও টান আছে। তাদের কেউ মেয়ের হাতের ছাপ বুকের মধ্যপকেটের ছেঁড়া চিঠিখানার মধ্যে নিয়ে ঘুরছে,কেউ ঘুরছে বৌয়ের হাতের একটুকরো চুড়ি বা রুমাল নিয়ে।
ভেবেছিলাম চা বাগানের গল্প,তা নয়। গল্পটা চা বাগানে কাজ করবার জন্য মানুষ ধরে আনা আড়কাঠি দলের গল্প। চমৎকার প্লট, চমৎকার লেখনী। উপমা ব্যবহারেও ওবায়েদ হকের জুড়ি নেই। তার যে কয়টা বই এখনো অব্দি পড়েছি সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি উপমার ব্যবহারে। অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস হলেও উপলব্ধি করবার মতো অনেক চমৎকার সব বিষয় আছে। যকের ধন বা চাঁদের পাহাড়ের উদাহরণ দিলেও ওগুলোর সাথে আসলে কোনো মিল নেই। একদম আলাদা একটা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প এটা। চমৎকার। তারচেয়েও বড় কথা ওসব তো কত বড় বড় লেখকের উপন্যাস,এই লেখকের এই উপন্যাস ওসবের সাথে টক্কর দেবার মতো ভালো। এটাতেই আমি সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছি। অ্যাডভেঞ্চার+ সামাজিক উপন্যাস ভালোবাসলে বসে পড়ুন। অসাধারণ সময় কাটবে।
লেখক নয়, কবি বলেছেন-- "হে পাখি তোমাকে আমি হিংসা করি, আমি ইবাদত করে মরি, আর তুমি খোদার আরশের কাছে করো উড়াউড়ি।"
যে বছর প্রথম ট্রেন চালু হলো, উদ্ভোদন এর দিন ট্রেনের তলায় মরলো নরেন এর মা। সেই থেকে সবাই তাকে চিনতো, ট্রেনের তলায় মরলো যার মা-- এই পরিচয়ে। বাবা মরলো ট্রেন আসার অতি উৎসাহে। মা-বাবা নাই তাই ঘরও নাই, ঘরের প্রতি কোন টানও নাই। বোগলে বই নিয়ে বনে বনে ঘোরে, গাছের ডালে বসে বইয়ের অভাবে এক বই অনেক বার পড়ে। এক ভাবে দিন যায় না, তাই এভাবে আর নয়, নরেনের দিনও এমনি করে আর গেলো না। হঠাৎ একদিন বদ্ধ ঘরে আগুনের থেকে দীনেশকে বাঁচিয়ে তার চোখে ভগবান সেজে বসলো। দীনেশ দাদা বলে নরেন কে সঙ্গে করে নিলো।
সময়টা তখন ব্রিটিশ আমল। ব্রিটিশ রা ট্রেন লাইন চালু করার সাথে সাথে সিলেট ও আসামে চা বাগান তৈরির কাজে লেগে পড়লো। জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান তৈরির জন্য দরকার পড়লো শ্রমিকের। অমানুষিক কষ্টের এই কাজটা স্থানীয় শ্রমিকরা করতে রাজি ছিল না। তাই ছোট নাগপুর, ছত্রিশগড় ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গল থেকে উপজাতিদের ধরে আনা হলো প্রলোভন দেখিয়ে। যারা এই সব শ্রমিকদের প্রলোভন দেখিয়, ঠকিয়ে নিয়ে আসতো তাদেরকে আড়কাঠি বলা হতো। মূলত আড়কাঠি রা কিভাবে, কোথা দিয়ে এই সব শ্রমিকদের নিয়ে আসতো আর তাদের পরিনতি কতোটা ভয়াবহ হতো লেখক ওবায়েদ হক " আড়কাঠি" উপন্যাসে এটাই দেখিয়েছেন।
লেখক ওবায়েদ হকের সবগুলো বই পড়লাম। এই বইটার আগের বই গুলোতে যতোগুলো চরিত্র সবগুলো চরিত্রের পিছনের একটা করে নিজস্ব গল্প থাকে এবং সেই সব গল্প একসাথে মিশে তবেই দারুণ একটা উপন্যাস হয়ে উঠেছে। এবং সব গুলো ছিলো গল্প নির্ভর উপন্যাস। চরিত্র, গল্প এবং লেখনী সব মিলিয়ে অসাধারণ ছিলো। তবে "আড়কাঠি" উপন্যাস টা সে দিক দিয়ে একেবারেই আলাদা। লেখনী বরাবরের মতই চমৎকার তবে এটাতে কাহিনি বা গল্প একটাই, যে কারনে পড়তে গিয়ে প্রথমেই হোটচ খেতে হয়েছে। পরিচিত গন্ডির বাইরের এক ওবায়েদ হক এখানে ধরা পড়েছেন। এটা মূলত একটা সময়, স্থান আর সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে এক বর্ণনা নির্ভর উপন্যাস। অনেকেই লেখকের গতানুগতিক লেখা মাথায় নিয়ে পড়তে গিয়ে "আড়কাঠি" ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। আমারও প্রথমে এমনটা মনে হয়েছিল। তবে বইটা শেষ করে নতুন এক উপলব্ধি ও নতুন এক ওবায়েদ হকের দেখা পেলাম। আমার চমৎকার লেগেছে। রেশটা আগের মতই।
"কবি বলেছেন-- ভাগ্য তোমাকে শুধু দুঃখই দেয়নি, কত দুঃখ থেকে বাঁচিয়েছেও। তার প্রতি অপ্রসন্ন হয়ো না।"
চা বাগানের মালিকদের জন্য যারা শ্রমিক সংগ্রহ করে আনে তাদেরকে আড়কাঠি বলা হয়। লেখক ওবায়েদ হকের আড়কাঠি উপন্যাসে শ্রমিক সংগ্রহ করার এই দিকটাই উঠে এসেছে। তবে এর পাশাপাশি গল্পে রয়েছে আরো অনেক কিছুই। শুরুতে এটাকে সামাজিক বা সমকালীন ঘরানার উপন্যাস মনে হলেও, এক পর্যায়ে তা হয়ে যায় অ্যাডভেঞ্চার বা ভ্রমণ কাহিনীর মত। আবার শেষে পাওয়া যায় পুরোদস্তুর থ্রিলারের স্বাদ। তো এই ৩টা ধাপ নিয়েই বরং লিখি আমার অনুভূতি!
সমকালীন অংশ
ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে যখন পা রাখে, আমাদের গল্পের পটভূমি সে সময়কার। নরেন নামের আপাত সুখী ছেলেটার জীবন চোখের সামনেই এলোমেলো হয়ে গেল রেললাইন বসানোর কারনে। দুঃখ তার জীবনকে এমনভাবে ছিড়েখুঁড়ে ফেলল যে তার ভিতরে মৃত্যু ভয়টাও আর রইলো না। ধর্মের কল নাকী বাতাসে নড়ে। আমাদের নরেনের জীবনটাও নড়ে গেল তেমনি এক ধর্মের কলে!! আর এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু।
যথারীতি একদম প্রথম বাক্য থেকেই লেখকের মধুমাখা লিখনশৈলীর দেখা পাওয়া যায় এখানেও। অদ্ভুত মায়া এই লোকের লেখায়। পড়তে গিয়ে এক ধরণের ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছি বলে ভ্রম হয়। এই ঘোরের কারনে মা-বাবার কাহিনী শেষ করে, কখন যে বনু জ্যাঠাকে নিয়ে গুনপুর গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়ে আসে নরেন তা টেরও পাওয়া যায় না। এরপর মুগ্ধতা শুধু বাড়তেই থাকে। ভয়ডরহীন, আবেগ বিবর্জিত নরেনের সাথে পরিচয় ঘটে সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত দীনেশের। তার সাথে অচেনা এক দেশে পৌছে যায় সে। হয়ে যায় এক আড়কাঠির সঙ্গী।
দীনেশ বিনা প্রয়োজনে কিছুক্ষণ পরপর তার কিশোরী বধুর স্মৃতিচিহ্ন রুমালখানা বের করে নাকে মুখে চেপে ধরে আবার রেখে দিচ্ছে। তার ছেলেমানুষি কারো কাছে ধরা পড়ে গেল নাকি সেটাও লক্ষ রাখছে। বউয়ের প্রতি ভালোবাসা কোনোরকমে না প্রকাশ হয়ে যায়, এই নিয়ে সে সর্বদা তটস্থ। এই বাংলায় বউকে ভালোবাসার চেয়ে কাপুরুষতা আর নেই।
বইয়ের এই অংশে কারেক্টারাইজেশন হয়েছে দূর্দান্ত রকমের ভালো। প্রতিটা চরিত্র যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম। লেখকের শব্দের জাদুতে নিজেই যেন পৌছে গিয়েছিলাম আঠারশ শতকের সেই সময়টায়। যথারীতি দারুণ সব উপমা আর উক্তির ব্যবহার গল্পকে করে তুলেছে আরো উপভোগ্য। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বর্ণনায়ন আর হিউমারের ব্যবহারও ছিল পরিমিত এবং সুন্দর।
নরেন সেদিন উপলব্ধি করলো, ঈশ্বরকে মানুষ ভয় পায় না, নয়তো সর্বজ্ঞ ঈশ্বর সব দেখছে জেনেও অনাচার করতে পারতো না। মানুষ আসলে ভয় পায় মানুষকেই।
ভ্রমণ আর অ্যাডভেঞ্চার
অবশেষে ভাগ্যের খোঁজে দীনেশ আর নরেন পৌছে গেল চাঁদপুরে। তাদেরকে সঙ্গী করে নিলেন অঘোরবাবু, যার কাজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুঁজে খুঁজে অনাহারে মৃতপ্রায় মানুষদেরকে শ্রমিক হিসাবে চা বাগানে নিয়ে যাওয়া। এই তিনজনের দলের সাথে যুক্ত হলো নতুন আরো দুই চরিত্র, ভোলা এবং চারু। শুরু হলো তাদের জঙ্গলের অভিযান আর আমাদের শুরু হলো অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় বিমোহিত হওয়া।
কলকাতায় যাত্রা বিরতিটা ঘটনাবহুল হলেও, শহরের বাইরের ঘটনা আরো চমকপ্রদ। কখনো সন্যাসী থেকে ডাকাত বনে যাওয়া কেউ, কখনো বাঘের আক্রমণের ভয়, তো হুট করেই অচেনা একাকী পথচারীর দেখা পাওয়া। এরপর আসে একের পর এক গ্রামে গিয়ে শ্রমিক খুঁজে নেয়া, সেসব গ্রামে তৈরী হওয়া নিত্য নতুন সমস্যা। কিংবা ফিরতি পথে রওনা দিয়ে একের পর এক রহস্যময় মৃত্যুর ঘটনা। এমন অনেক কিছুই একটানা চলতে থাকে গল্পজুড়ে। পাশাপাশি থাকে ভরা জোছনায় বিস্তৃত জঙ্গলের অপার সৌন্দর্যের বর্ণনা, জঙ্গল পার হবার কষ্টের কথা। সব মিলিয়ে দারুণ সময় কাটতে থাকে। আর তৈরী হতে থাকে একটা রহস্যময় পরিবেশ।
রহস্য কিংবা নাটকীয়তা
বইয়ের শেষ ধাপটা শুরু হয় দলের একজনের অন্তর্ধানের পর থেকে। নরেন তাকে খুঁজতে গিয়ে পরিচিত হয় গুলচির সাথে। সেখান থেকে জানতে পারে চরম এক সত্য। যে সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে এতগুলো মানুষকে চা বাগানের দিকে পাঠাচ্ছে তারা, সেটা এক নরক ছাড়া আর কিছুই নয়। নরেন দ্বিধায় পড়ে যায়, যে হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজবে নাকী যাদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনবে? এই অবস্থায় তাদের সাথে দৈববলে দেখা হয়ে যায় ফকিরের সাথে। ফকিরের করুণ কাহিনী যেকোনো আবেগপ্রবণ মানুষের ভিত নাড়িয়ে দিবে।
মসৃণ পাথরটার উপর ফকির এমনভাবে স্থির হয়ে বসে আছে যেন সে নিজেও পাথর হয়ে গেছে। বাতাসটা থমকে আছে, গাছের সবুজ ডালগুলো হেলদোল বন্ধ করে শান্ত হয়ে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে কোনো মমতাময়ী নারী কারো শোক দেখে সবুজ আঁচলে মুখ ঢেকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। একটু আগে আনন্দে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘগুলো থমকে গিয়ে মমতা নিয়ে ফকিরকে দেখছে। নরেন মাথা নিচু করে বসে রইলো, একটা সান্ত্বনার কথা উচ্চারণ করার ক্ষমতাও তার রইলো না। অনেকক্ষণ নীরবতায় কাটলো, তারপর নরেন বললো, আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার কারণে এসব দুঃখের কথা মনে করতে হলো আপনাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফকির বললো, তোমার কোনো অপরাধ নেই, তুমি আমাকে মনে করিয়ে দাওনি, আমি কোনোদিন ভুলতেই পারিনি এই দুঃখ।
তবে একইসাথে আমি বুঝে যাই বইয়ের বাকী অংশ কী ঘটতে যাচ্ছে। লেখক এই জায়গায় এসে বরাবরের মতই টুইস্ট এন্ড টার্নস আনতে চেয়েছেন গল্পে। বিশ্বাস করুন মন্দ লাগেনি পড়তে, তবে বিষয়টা অতিমাত্রায় নাটকীয় হয়ে গিয়েছে। আর লেখকের প্যাটার্নটাও বড্ড একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। উনার মত শক্তিশালী একজন লেখকের এই ধারা থেকে বের হয়ে আসার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
ব্যক্তিগত রেটিং: ০৮/১০ (দারুন সব ছন্দময় বাক্য, শব্দের খেলা, উপমার ব্যবহার, পরিবেশ সৃষ্টি, হিউমার আর আবেগের চমৎকার মিশেল: ওবায়েদ হক মানেই এ সবকিছুর নিশ্চয়তা। শেষটা অতি নাটকীয়তার দোষে দুষ্ট না হলে নিঃসন্দেহে আরো বেশী রেটিং দিতে পারতাম)
এসময়কার সবচেয়ে পছন্দের লেখক উনি! এই বইটি পড়ার মাধ্যমে উনার সকল বই পড়া শেষ হলো। বইটি পড়তে গেলে কয়েকটি বই পড়ার ফিল পাওয়া যাবে। প্রথম দিকে মনে হচ্ছে সুন্দর সামাজিক উপন্যাস যেখানে নরেনের কৈশোর উঠে এসেছে। হারানো মা বাবার গল্প, বিমলা,বনোয়ারি সহ বন জংগলে নরেনের ছুটে চলা আরো কত কি! লেখকের লেখনী আর হিউমার বরাবর এর মতো সেরা।
পরে দীনেশের সাথে শুরু হয় ভ্রমণ কাহিনী। তারা আড়কাঠি, যারা গরিব-অসহায় উপজাতি দের ভুলিয়ে নিয়ে যায় চা বাগানের শ্রমিক হওয়ার প্রয়াসে। এখানের বনের এতো সুন্দর বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে বিভূতির আরণ্যক পড়ছি। এডভেঞ্চারাস ভ্রমণ কাহিনী বলা যায়।
শেষের টুইস্ট একটু সিনেম্যাটিক হয়েছে যার জন্য রেটিং ৪! কিন্তু পুরো বই পড়ার আনন্দ তে শেষ টুকু স্যাক্রিফাইস করা যায়, যেখানে লেখক হয়তো সামনে কাজ করবে।
আসলে আমি কেওক্রাডং, তাজিংডং এর দিকে আমার উপজাতি বন্ধুর বাসায় অনেক দিন থেকেছি সেই ২০১১ সালের দিকে। এজন্য এই পাহাড় কে ভিতর থেকে রিলেট করতে পেরেছি। সেই পাহাড়ে ৮-১০ ঘন্টা ট্রেকিং, সাথে খাওয়া শুধু পাহাড়ের মিস্টি তেতুল আর মুরি কি ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা, নস্টালজিক হয়ে গেলাম।
ওবায়েদ হকের যেকোনো বই পড়লে মন ভরে যায়। প্রচুর থ্রিলার পড়ে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই তখন ওবায়েদ হক পড়ি।
বইয়ের রিভিউ দেওয়ার আগে আমরা একটু পেছনের দিকে যাই। ব্রিটিশরা উপমহাদেশে শুধু জোর করে নীল চাষ ক��েই ক্ষান্ত থাকেনি, ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে তারা প্রলোভন, ভয় দেখিয়ে, অপহরণ করে, ভুল বুঝিয়ে, অনেক সময় সহিংসতার মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষকে চা বাগানে নিয়ে আসতো। কারণ, প্রথমে চা চাষের জন্য চীন থেকে কর্মী আনা হলেও উপমহাদেশের ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরে শ্রমিকদের মৃত্যু হতে শুরু করলে এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় চীনের কর্মীরা চলে যায়। এদিকে চা বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরো নতুন কর্মীর প্রয়োজন হয়। তখন শ্রমিকের জন্য ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকার দিকে নজর দিতে শুরু করে।
তাদের এনে প্রথমে এসব কেন্দ্রে জড়ো করা হতো। এরপর সেখান থেকে শ্রমিকদের চা বাগানগুলোয় পাঠিয়ে দেয়া হতো। যারা এগুলো করতো, তাদের বলা হতো আরকাত্তি বা আড়কাঠি। বাগান মালিকরা তাদের সম্পত্তি বলে মনে করতেন, মালিকরাই তাদের স্বাধীনতা নির্ধারণ করতেন, তাদের বিভিন্ন বাগানে আনা-নেয়া করা হতো। তাদের এমনকি বাগানের বাইরে যেতে দেয়া হতো না। তারা এখানে এসেছিলেন উন্নত জীবনের আশায়, কিন্তু এখানে এসে সারাজীবনের জন্য বন্দী হয়ে পড়েন। ব্রিটিশরা শুরুর দিকে এভাবে শ্রমিকদের নিয়ে এসেছিলেন। তারপর আর তাদের আনতে হয়নি। কারণ এই শ্রমিকদের সন্তানরাই পরবর্তীকালে বংশপরম্পরায় চা বাগানের কর্মী হিসাবে কাজ করতে থাকে। এমনকি পরবর্তী দুই শতকেও সেই পরিস্থিতির বদল হয়নি। . . . নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, বইয়ের কাহিনীও এই আড়কাঠিকেই ঘিরে।
গল্পের শুরুটা হয় নরেনকে দিয়ে। খুব অল্প বয়সেই এই নিজের মা-বাবাকে হারায় সে। এরপরই তার জীবনটা কেমন জানি হয়ে যায়। কোনোকিছুর ভয় নেই, যে যখন তাকে যেটা করতে বলছে, সে সেটাই করছে। যেহেতু সারাজীবন সে গ্রামেই থেকেছে, তাই নিজের গ্রামের বাইরের জগতটা তার কখনো দেখা হয়নি, সে দেখতেও চায়নি, দেখার সুযোগও মেলেনি।
তবে ঘটনার পরিক্রমায় অবশেষে তার সুযোগ মিলল গ্রামের বাইরে পা রাখার৷ সেই সূত্রেই তার পরিচয় হয় হাবাগোবা ধরনের এক ছেলে, দীনেশের সাথে। একটু বোকাসোকা হলেও বুকভরা সাহস তার৷ ঘটনাক্রমে দীনেশ আর নরেন, দুইজনেই ভিড়ে গেল আড়কাঠির দলে। তাদের কাজ হল আড়কাঠির সর্দার অঘোরবাবুর সাথে মিলে চা বাগানের জন্য শ্রমিক যোগাড় করে আনা৷ সে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েই হোক কিংবা ধরে-বেঁধে হোক, আনা লাগবেই। তবে এই শ্রমিকদের কী পরিণতি হয়, তা ছিল তাদের অজানা। কারণ সত্যিটা বললে তো শুরুতেই তারা বেঁকে বসতো!
যাত্রাপথে তাদের সাথে আরো কিছু মানুষ যুক্ত হয়৷ চলার পথে এই হয়তো কোন বন্য পশুর সম্মুখীন হচ্ছে, নাহলে ক্ষুধার্ত মানুষেরা তাদের সামনে চলে আসছে। কিন্তু আসল পশু যে তাদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল, তা কি তারা জানতো? . . . এত চমৎকার কাহিনী আর লেখার ধরন, অসাধারণ একটা সময় কেটেছে। একবারে এক বসায় শেষ করেছি। বিশেষ করে শেষের টুইস্টটা এত মারাত্মক ছিল! তবে মাঝখান দিয়ে কাহিনী একটু ঝুলে পড়েছিল মনে হচ্ছিল, কিন্তু তৃপ্তি নিয়ে পড়েছি। আড়কাঠি পড়তে পড়তে নরেনের সাথে সাথে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম শ্বাপদসংকুল ঐ জঙ্গলগুলোতে। গল্পের বুনন আর উপমা ভীষণ সুন্দর, খানিকটা বিভূতিভূষনের 'চাঁদের পাহাড়' এর ছাপ পাওয়া যায়। তবে আমি চা বাগান নিয়ে আরেকটু বেশি ফোকাস আশা করেছিলাম। বইটা শেষ করে মনে হল এর কলেবরটা আরেকটু বড় হলেও পারতো। সুখপাঠ্য বটে।
বইয়ের এই লাইনটা একদম মাথায় গেঁথে গেছে ❝ঈশ্বরকে মানুষ ভয় পায় না, নয়তো সর্বজ্ঞ ঈশ্বর সব দেখছে জেনেও অনাচার করতে পারতো না, মানুষ আসলে ভয় পায় মানুষকেই।❞
বাংলা সাহিত্য পাড়ায় ওবায়েদ হক এখন পরিচিত নাম। "নীল পাহাড়" দিয়ে আভির্ভূত হওয়া এই লেখক মনে হয় ইতোমধ্যে নিজের ছাপ পাঠককে চেনাতে সক্ষম হয়েছেন। ওবায়েদের হকের সবচেয়ে বড় সিগনেচার তার wit আর উপমার ব্যাপকতা। এই দুই জিনিস দিয়ে সহজেই শনাক্ত করা যায় লেখককে। আড়কাঠিতে তার প্রকট উপস্থিতি লক্ষ করা যায়,সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায়নি আশাকরি।এদিক দিয়ে আড়কাঠিতে লেখক তার নামের প্রতি সুবিচার করেছেন বলা যায়। তবে মূল কাহিনীতে মনে হয় নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। "আড়কাঠি" নামের সাথে জড়িয়ে আছে চা-শ্রমিকদের নিদারুন ইতিহাস। প্রত্যাশা ছিল সেই চা-শ্রমিকদের উপজীব্য করে গড়ে উঠবে তথাকথিত এই নিম্নশ্রেণীর উপর অত্যাচারের ইতিহাস, তাদের সংস্কৃতি আর অবস্থা।কিন্তু "আড়কাঠি" তে সেই অনুপস্থিতি যারপরনাই হতাশ করেছে। শুধুমাত্র আড়কাঠি সর্দারদের মাধ্যমে ভুলিয়ে-ভালিয়ে চা-শ্রমিক সংগ্রহ করার ইতিহাসের মাধ্যমে মনে হয় না রক্তচোষা ব্রিটিশদের এবং চা-শ্রমিকদের পরিপূর্ণ অবস্থাটা উঠে এসেছে। এমনটা আশা করছি না যে "আড়কাঠি" হয়ে উঠুক 'তারাশঙ্করের' "হাঁসুলি বাঁকের উপকথা ", কিন্তু লেখক চাইলেই হয়তো শক্তপোক্ত কোনো ছাপ রাখতে পারতেন। এক কথায় কাহিনীর আরো পরিস্ফুটনের দরকার ছিল বোধহয়। হ্যাপি রিডিং 💙 একচুয়াল রেটিং - ২.৫/৫
গ্রামের দিকে একটা কথা প্রচলিত আছে, ছাগলকে একটু লম্বা দড়ি দিয়ে কোনো খুঁটির সাথে বেধে রাখলে ওই খুঁটির চারপাশেই ঘুরতে থাকে। ওবায়েদ হকের লেখাও একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনো নতুনত্ব নেই। লেখক নির্দিষ্ট একটা ছক এঁকেছেন এবং সেখান থেকে বের হওয়ার কোনো চেষ্টা নেই তার মাঝে। তার গতানুগতিক লেখার প্যাটার্ন যে খুব আহামরি কিছু তাও না।
লেখক ওবায়েদ হকের আর কোনো বই পড়ার ইচ্ছা নেই আপাতত, ভবিষ্যতে নোবেল প্রাইজ পেলে তখন আবার ভেবে দেখা যাবে।
বিভূতিভূষণ আমার অসম্ভব পছন্দের লেখক, ফলে সঙ্গত কারণেই ‘আড়কাঠি’ পড়তে আমার ভালো লেগেছে। বাক্যটা অসংলগ্ন মনে হতে পারে, তাই আরও স্পষ্ট করে বলি, ‘আড়কাঠি’র পাতায় পাতায় অহরহ ছায়া ফেলে গেছে বিভূতির ভূত, পড়তে পড়তে আমার অন্তত এমনই মনে হয়েছে। এই মনে হওয়া হয়তো ভালো। কেননা, উপন্যাসের শুরু যেখানে সেখানে এইসব ছায়াবাজি নিয়ামকের মতোই কাজ করার কথা। প্রসঙ্গ হচ্ছে, কতটুকু সফল হলো এই যাত্রা, সেটা নিয়ে।
ঔপন্যাসিক শুরুতেই প্রোটাগনিস্টের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই নায়ককে আমরা জানি, তাঁর দুঃখগাঁথা আমাদের পরিচিত ফলে চমকে না ওঠে, তাঁর যাত্রার দিকে আমরা রাখতে চাই সজাগ দৃষ্টি। আমরা তাঁর হাত ধরে যাই শহরে, পরিচিত হই আরও বিশেষ কিছু চরিত্রের সাথে, এই চরিত্রগুলোর মধ্যেও আছে কিছু কারিজম্যাটিক পাওয়ার.. ঔপন্যাসিক লিখছেনও খুব বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে ফলে গল্পের রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে আমাদের ভালোই লাগে। ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট, ডিটেলিং কিংবা ন্যারিটিভে ওবায়েদ হক’কে বেশ ম্যাচিউর্ড মনে হয়েছে। ঔপন্যাসিক গল্পটা আয়োজন করে বলতে জানেন, পাঠককে আটকে রাখার মন্ত্র তিনি রপ্ত করেছেন বেশ।
১০০ পাতা পর্যন্ত তাই আগ্রহমিশ্রিত আনন্দ নিয়েই পাতা উল্টাই আমরা। কিন্তু তারপরই যেন ঘটে ছন্দপতন। প্রথম ১০০ পাতা যখন একটা বড় ক্যানভাসে গল্প বলার ইঙ্গিত দেয়, তখন উপন্যাস শেষ হয়ে যায় ১৫২ পাতায়। হঠাৎ যেন বেড়ে যায় লেখকের ব্যস্ততা, যেন ক���ন এক অশরীরী মেঘ তাড়া করছে তাঁকে। যেন লেখকের আর বলবার কিছু নেই। অহেতুক, সস্তা থ্রিলারের ফিল দিতে গিয়েই এই বিপত্তি হলো কিনা কে জানে! এই তাড়াহুড়োর জন্য শেষের দিকের চরিত্রগুলো দাঁড়ায়নি বলেই মনে হয়েছে। ড্রামা ও মেলোড্রামা এত বেশি, শুরুর ১০০ পাতায় খুঁজে পাওয়া গুপ্তধন, মূল্যহীন হয়ে যেতে খুব বেশি সময় নেয় না। সিনেম্যাটিক ফিনিশিংটা এতো প্রেডিকটেবল, বইয়ের শেষে কিছুটা বিরক্তিও এসে দখল করে নেয় আমাদের মন। . পার্সোনাল রেটিংঃ ২.৫ / ৫
"আলো খুঁজে লাভ নেই, তুমি দৃষ্টি খোঁজো। আলো তো সবখানেই আছে, নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠের মনের গভীরেও তুমি আলো পাবে, যদি সেই দৃষ্টি থাকে।"
"নরেন সেদিন উপলব্ধি করলো, ঈশ্বরকে মানুষ ভয় পায় না, নয়তো সর্বজ্ঞ ঈশ্বর সব দেখছি যেন অনাচার করতে পারত না, মানুষ আসলে ভয় পায় মানুষকেই। "
"ক্ষমতা থাকলে তা প্রদর্শন না করতে পারলে ক্ষমতাবানদের তা অসহ্য লাগে। " - কতো সত্য কথা! এ দুনিয়াতে বেঁচে থাকলে এ সত্যকে সামনে নিয়ে চলতে হয়। হাত-পা বাঁধা থাকে ওই ক্ষমতা আর টাকার কাছে। ক্ষমতা থাকলে মাথা নোয়াতে হয়না, ভয় পেতে হয় না, সবচেয়ে বড় বিষয়-মানুষকে মানুষ বলে গুণতে হয়না।
ওবায়েদ হকের এই পর্যন্ত গল্পসংকলন বাদে বাকীসব বই পড়া হয়েছে। আড়কাঠি আমার কাছে একটু অন্যরকম লেগেছে যদিও প্লট ইংরেজ আমলের ছিলো তবুও কোথাও একটা কিন্তু আমাকে বেশ ভালোরকমের খোঁচাচ্ছে! আমি কিন্তুটাকে হাতড়ে বেড়াচ্ছি কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না!!
নরেন সেদিন উপলব্ধি করল-"ঈশ্বরকে মানুষ ভয় পায় না,নয়তো সর্বজ্ঞ ঈশ্বর সব দেখছি জেনেও অনাচার করতে পারত না,মানুষ আসলে ভয় পায় মানুষকেই।"
শেষ করলাম লেখক ওবায়েদ হকের"আড়কাঠি"।গল্পটির মূল চরিত্রে নরেন থাকলেও বইটি আরও মানুষের গল্প বলে।গল্প বলে উনিশ শতকের শেষের দিকের চা বাগানের শ্রমিকদের নির্মম জীবনের।কিছুক্ষণ পর আবার অন্যরকমভাবে তুলে ধরেন আরণ্যকের কাহিনি।সেই গল্পে শান্তি পেতে শুরু করলেই আবার উঠে আসে ক্ষমতার এক কদর্য কাহিনি,খেতে না পারা,ক্ষুধার্ত কিছু মানুষের কাহিনি।যেখানে গল্পের স্রষ্টা কিন্তু পিনুর গল্প বলতেও ভুলেন না। লেখক এবারের গল্পেও তার পুরোনো মাদকতা রেখেছেন।লেখকের লেখার সেই পুরোনো অনুভূতি রয়েছে বইয়ে।তবে এবার লেখকের গল্পে নতুন মাদকতা আশা করেছিলাম।।
পড়ে মনে হলো কোন এক সময় এটা নিয়ে একটা সিনেমা হতে পারে এই ভেবে লেখা। বই পড়ে পুরোপুরি হতাশ তা বলবো না। কারণ ওবায়েদ হকের লেখা গড়গড়িয়ে পড়া যায়৷ আর কিছু লাইন থাকে যা মনে গেঁথে যায়। তবে শেষটা এতো মেলোড্রামাটিক যে একাই একটা তারা খসিয়ে দিল। ওহ! আর বইয়ের প্রচ্ছদটা খুবই মিসলিডিং।
ওবায়েদ হকের লেখা দ্বিতীয় বই পড়লাম। আগেরবারের মতই পড়তে ভীষণ ভালে লেগেছে। তবে শেষে গিয়ে থ্রিলারের মত টুইস্টটা ভাল লাগেনি। ফকির মশাই-এর আবির্ভাবের পর কাহিনী পুরো বদলে গেল। নরেন চরিত্রটির সাথে আরও গভীর কাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল আমার।
ওবায়েদ হক আড়কাঠি নামক বিচিত্র একটা পেশার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে এই বইটিতে। সমাজের বঞ্চিত শোষিত অংশের কথা লেখকের ভাষায় দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। সেই সাথে নরেনের মত অনাথ লোকের মনুষ্যত্ব, যেটা আমাদের মাঝে কমই দেখা যায় আজকাল।
প্রচ্ছদটা কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ লাগেনি। প্রচ্ছদ দেখে ধরেই নিয়েছিলাম চা বাগান কেন্দ্রিক কাহিনী হবে৷ কিন্তু চা বাগান পর্যন্ত যায়নি গল্প। প্রচ্ছদ ভিন্ন হলে ভাল হত।
ভালোই লেগেছে।শেষের দিকের টুইস্ট টুকুও খারাপ ছিলো না,তবে শেষ টুকু ঠিক পরিপক্ক মনে হয় নি।নরেনের চরিত্র টি যে গভীরতা নিয়ে শুরু হয়েছিল শেষে এসে সেই রেশ ধরে রাখতে পারে নি। নরেন চরিত্র টার আর একটু বিস্তৃতি আশা করেছিলাম। গল্পের শেষে এসে আসলে গল্পটা কার সেটাই নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয় মনে,কারণ শুরু থেকে গল্পের যাত্রা ছিলো একরকম শেষে এসে মোড় গেলো ঘুরে,তাই ধরেই নিলাম গল্পটা সবার। গল্পের দিক থেকে তিন তারকা কিন্তু একটি বাড়তি তারকা দিলাম লেখকের লেখনী, অসাধারণ উপমা এবং শব্দ চয়নের জন্য।
বিষাদমাখা উপাখ্যান আড়কাঠি। মৃত্যুর বসন্ত বইছে তখন। মানুষজন পেটের দায়ে কোথায় যেতে চলেছে নিজেরাও জানেনা। পূর্বে কখনো নিজের গ্রামের বাইরে পা না রাখা নরেন ঘটনাক্রমে সেসবের সাক্ষী হচ্ছে। সাক্ষী হলাম আমিও পড়তে পড়তে।
'আড়কাঠি' কী? 'আড়কাঠি' হলো একপ্রকার দালাল গোছের মানুষ, যারা নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের দিকভ্রম করে অন্যত্র নিয়ে আসে। ব্রিটিশ রাজত্বে যখন চা বাগানগুলোতে প্রচুর শ্রমিকের দরকার ছিল, তখন এই আড়কাঠিরাই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়খণ্ডের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষদের নানান রকম প্রলোভন দেখিয়ে চা বাগানে নিয়ে আসতো। এই গল্পে সেই কাহিনীই ফুটে উঠেছে।
ছোটোবেলায় বাপ-মা হারানো অনাথ নরেন, যার নেই কোনো পিছুটান। তবে কৌতূহল এতো বেশি যে, সে কোনো ভয়কেই পরোয়া করে না, মৃ*ত্যুর ভয়ও তার কাছে তুচ্ছ। "জীবন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল, সতীনের ছেলের মতো অবহেলা করে সে প্রাণটাকে। যে কাজে মৃ*ত্যু সম্ভাবনা আছে নরেনকে কোনোমতেই সে কাজে আটকানো যায় না।" আর সেই কৌতূহল বশতই, যে কখনও গ্রামের বাইরে যাইনি, সে একদিন চলা শুরু করে এক অজানা পথের উদ্দেশ্যে। দীনেশের কথায় সে যোগ দেয় আড়কাঠি সর্দার অঘোরবাবুর সঙ্গে। উদ্দেশ্য পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের বুঝিয়ে চা বাগানে নিয়ে আসা। এই উদ্দেশ্য স্বরূপ তারা গিয়ে পৌঁছায় পুরুলিয়ার গভীর জঙ্গলে।
কথায় আছে, 'দূরের ঘাস ঘন দেখায়।' ঠিক সেরকমই নরেনের বিশ্বাস ছিল, এই সকল আদিবাসী মানুষেরা চা বাগানে গিয়ে শান্তিতে দুবেলা পেট ভরে খেতে পারবে। গ্রামে থেকে যেভাবে তারা প্রতিনিয়ত মৃ*ত্যুর কবলে পড়ছে, সেখানে গিয়ে তারা অন্তত সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে। কিন্তু একদিন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া দীনেশের খোঁজ করতে গিয়ে গভীর জঙ্গলে তার দেখা হয় গুলচির সাথে। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে থেকে, তার বিশ্বাসের পর্দা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। গুলচির কোন অভিজ্ঞতা নরেনের বিশ্বাসের ভীতটাকে টলিয়ে দেয়? আর দীনেশ, তারই বা কী হয়?
জঙ্গলে ক্ষুধার্ত মানুষ পশু হয়ে যায়, দেবতারা হয়ে যায় হিংস্র। কথায় কথায় অভিশাপ নেমে আসে। তাহলে দেবতার অভিশাপেই কি প্রতি রাতে মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে? দীনেশের নিখোঁজের পেছনেও কি এই অভিশাপই দায়ী? নাকি রয়েছে অন্য কোনো কারণ? সত্যের সম্মুখীন কি নরেন হতে পারবে? নাকি সেও হয়ে পড়বে দিকভ্রষ্ট?
ওবায়েদ হক, এই নামটাই যথেষ্ট, বই কেনার জন্য। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে প্রিয় লেখক হওয়ার দরুন, ওঁর কোনো লেখাই আমার খারাপ লাগে না। না হয় হলামই কেবল একজনের লেখার প্রতি একটু biased, ক্ষতি কী তাতে? সেই প্রথম 'তেইল্যা চোরা' পড়ে, ওঁর লেখার প্রতি টান জন্মেছিল, তারপর 'জলেশ্বরী' তো পুরো ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। তারপর একে একে 'নীলপাহাড়', 'একটি শাড়ি ও কামরাঙা বো*মা', 'কাঙালসংঘ', প্রত্যেকটা লেখাই এককথায় অসাধারণ। না, এই লেখার থেকে দূরে থাকা যায় না।
ওঁর বাকি বইগুলোর মতো, এই বইয়ের লেখাও আমার দুর্দান্ত লাগলো। সহজ সাবলীল, ঝরঝরে লেখা। এতো সুন্দর মেদহীন টানটান, গদ্যরূপ লেখা, যা নেশাগ্রস্ত করে তোলে। ওঁর লেখায় যেভাবে সবসময়ই বাস্তবিক চিত্র ফুটে ওঠে, তা সত্যিই ভাবায়। বই শেষ হওয়ার পরও এই রেশ কাটে না।
বইয়ের একটি পছন্দের অংশ~ "আলো খুঁজে লাভ নেই, তুমি দৃষ্টি খোঁজো। আলো তো সবখানেই আছে, নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠের মনের গভীরেও তুমি আলো পাবে, যদি সেই দৃষ্টি থাকে।"
"আমার স্মৃতিকথায় তোমার স্থান হবে না সুরেন্দ্র, ইতিহাসে তোমার নাম উঠবে না। তুমি বড়জোর একটা গল্প হয়ে থাকবে, যেটা শুনে কেউ বিশ্বাস করবে না।"
ঠিক বিশ্বাস না করার মতোই গল্প। আজ থেকে দেড় দুইশ বছর আগের ইতিহাসের কালো অধ্যায় গুলো আসলে বিশ্বাস হতে চাইবে না। আমরা শুধু চাকচিক্য দেখি, ফলাফল দেখি। অথচ এর পেছনে কত বিসর্জন, ত্যাগ, তিতিক্ষা, কষ্ট তা দেখি না। দেখতে চাই না আরকি। এই ভারতীয় উপমহাদেশে চা বাগান গড়ে উঠার পিছনের কাহিনী যে এতটা হৃদয়বিদারক সেটা আগে আমি উপলব্ধি করি নাই। "আড়কাঠি" আমাদেরকে শোনাবে নরেনের গল্প। ছেলেবেলায় মা বাবাকে হারিয়ে একাকী এক মানুষ যার কোন ভয় ডর নেই। যাকে মৃত্যুও ছুঁয়ে দিতে চায় না। যে তার গ্রামের সবার কাজে লাগে। সে একদিন তার গ্রাম ছেড়ে বেড়িয়ে পরে এক বুড়ো দাদুর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে। তখনও সে জানতো না এই গ্রামে তার আর ফেরা হবে না। এই গল্পটা দীনেশেরও। আদতে ভীতু কিন্তু কাপুরুষ সে নয়। ভাগ্য অন্বেষণে সে বাড়িতে রেখে এসেছে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে। পথিমধ্যে তার দেখা হয় নরেনের সাথে। সরলমনের দীনেশ তাকে দাদা ডেকে সাথে করে নিয়ে যায় চাঁদপুর। এক আত্নীয়ের সুপারিশে জুটে যায় আড়কাঠি হিসাবে। এই গল্পটা অঘোর বাবু নামের আরেক আড়কাঠির। কেন সে এই পথ বেছে নিয়েছে সে এক রহস্য। সাথে আছে ভোলা আর চারু। যাদের নাম আছে পুলিশের খাতায় ডাকাতির অভিযোগে। এরম ৩ ভয়াবহ লোকের সাথে কিভাবে করে নরেন আর দীনেশের মতো দুই ভালো মনের মানুষ জুটে গেলো সেটা জানতে হলে পড়তে হবে এই চমৎকার উপন্যাসটা।
আড়কাঠি হচ্ছে তারা যারা সেই দূর দেশ থেকে চা বাগানের জন্য লেবার/কুলি নিয়ে আসে ভুলিয়ে ভালিয়ে। ঝাড়খণ্ড, ছোট নাগপুরের মতো জায়গা থেকে সাঁওতাল, মগ, ওরাওঁদের নিয়ে এসে বিক্রি করে দেয় সাহেবদের কাছে।
ক্ষুধার কাছে সব বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। সভ্য সমাজের আইন জঙ্গলে চলে না দেখেই এখানের সহজ সরল মানুষ শিকার হয়ে যায় সহজেই।
ওবায়েদ হকের লেখা শেষ করে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকা লাগে। মন খারাপও বলা যায় না। আমার বিষণ্ণ লাগে ভারী। তবে হ্যাঁ প্রকৃতির যে সুন্দর বর্ণনা করেন মনে হয় চোখের সামনে দেখতে পারছি।
২০২৫ রিভিউ বিষয়: বই রিভিউ: ৭৩ বই: আড়কাঠি লেখক: ওবায়েদ হক প্রকাশনী: বায়ান্ন প্রচ্ছদ: আবুল ফাতাহ জঁরা:
কিছু গল্পের, কিছু জীবনের শুরু থেকে শেষ! উত্থান -পতন কিংবা সমানভাবে চলা জীবন।
নরেণ, গ্রামের বেশ হেসে খেলে দিন যায় বা স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে ছিল। কিন্তু লোভ আর ক্রোধ, মানুষের ষড়রিপুর করাল থাবায় সে না খেয়েও দিননিপাত করে একদিন। সব কাজের কাজী নরেন যেদিন বানোয়ারি খুড়োর শেষ ইচ্ছা পূরণে রাস্তায় নামে, সেদিন জানত না, তার আর পেছনে ফেরা হবে না। গল্প-স্থান-কাল সেই সময়ে যখন বাংলায় পু ঝিক ঝিক শব্দে রেলগাড়ি মাত্র আসতে শুরু করেছে।
পথে যেতে যেতে, সে হয়ে যায় আড়কাঠি। অঘোরবাবু, দীনেশ, চারু আর ভোলা কে নিয়ে সে খুঁজে ফেরে পণ্য। এই পণ্য নিয়ে তাকে আসতে হবে চায়ের বাগানে। এই পণ্য সওদাগরের ঝোলার কিছু না, না খেতে পেয়ে মরতে বসা মানুষ এরা।
এটা দাস প্রথা সময়ের গল্প না কিন্তু, তবুও।
পথ চলতে নরেণের সাথে হরেক রকম মানুষের দেখা হয়, হারানোতে অভ্যস্ত সে, নতুন করে হারাবার কিছুই থাকেনা আর। নরেণের জীবন তবুও কেটে যায়, কাটাতে হয়।
আড়কাঠি বইটা যত আশা নিয়ে শুরু করেছি ততই হতাশ। আড়কাঠির জীবন খালি মৃ***ত্যু।র গন্ধ শুকে মানুষ খুঁজে আনা? আর এই যে বন পাহাড়ের অতিরিক্ত যে বর্ণনা এটা খুব দরকার ছিল কি?
লেখায় মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ছাপ স্পষ্ট। তার মতই বর্ণনা শৈলী, দর্শন। এটা পজেটিভ দিক হিসেবেই নিলাম।
অনেক মানুষের প্রিয় বই, কিন্তু মত ভিন্ন হতেই পারে। আমার মনে হয়েছে, নামের সাথে একেবারে ই মিল নেই। দার্শনিক বই ও সুন্দর লাগে, কিন্তু গাছে ফুলের বাহার, একবারের বদলে দশ বার দিলে অন্তত আমার কাছে যুতসই লাগল না।
দীনেশকে আরো স্পেস দেবার দরকার ছিল, বিমলা বা গুলচি থেকে পরের অংশটা মোটামুটি ভালো ছিল। চরিত্র হিসেবে সবাইকেই বেশ লেগেছে।মূল চরিত্র নরেণকে যথাযথ জায়গা দেয়া হয়েছে। শুরু থেকেই নরেণকে, তার গল্প কে এগিয়ে নিয়েছেন লেখক বেশ ভালো করেই। অনেক ছোট বড় চরিত্র ও আছে, মনে দাগ কেটে যাবার মতই। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক বর্ণনা দিতে গিয়ে কোথাও কিছু যেন নাই।
সমান্তরালে চলা আড়কাঠির গল্প কোথায় যেন হারিয়ে গেল পথে চলতে।
এত্ত সুন্দর একটা গল্প এত্ত মনে দাগ কাটানোর মতো। অনেকদিন পর ওবায়েদ হক এর বই পড়লাম। জলেশ্বরী আর একটি শাড়ি কামরাঙ্গা বোমা পড়ার পর থেকে তার রীতিমতো ভক্ত আমি। একে একে বাকি বই গুলোও পড়েছিলাম। এখন এই প্রায় দেড় বছর বাদে তার আরেকখানা বই পড়লুম। লেখকের লেখার নিপুনতা বাড়লো বৈকি। নরেন এর জন্য আমার মায়া হয়, এখানে সব চরিত্রের জন্যেও। বনজঙ্গল, সূর্য, আকাশ- প্রকৃতিকে কী সুন্দর ভাবে যে নিজের লেখায় উপস্থাপন করেছেন যে মনে হয়না সামান্য গাছ ই ত একে নিয়ে লেখার কী আছে? আছে আছে।
শুরুতে চা বাগান ও শ্রমিকদের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের সন্নিবেশিত উপন্যাস ভেবে পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ছিটেফোঁটাও পেলাম না। যদিও প্লট নির্বাচন যথার্থ মনে হয়েছে। ওবায়েক হকের লেখার ভঙ্গি আমার খুব পছন্দ৷ নিরাশ হওয়ার সুযোগ থাকে না। ক্ষুধার দাপটে মানুষের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলতে দারুন পটুত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। শেষদিকের চমকটা প্রত্যাশিতই ছিলো।