"একটা খুনের চিন্তা মাথায় নিয়ে আমি শহরের রাস্তায় হাঁটছি। ভাবছি, যে মৃত্যু কামনা করছে তাকে মারলে সেটা খুন হবে নাকি উপকার করা হবে? রাস্তায় কত মানুষজন দেখা যাচ্ছে, কেউ চলছে পায়ে, কেউ চাকায়। আমি মুখগুলো দেখছি, প্রায় প্রত্যেকটা মুখ আমার চেনা। যে লোকটা হনহন করে হেঁটে আসছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে জরুরি কাজে দেরি হয়ে যাচ্ছে তার, আসলে সে এভাবেই হাঁটে। দিনের অর্ধেক সময় কাটায় চায়ের দোকানে, কমদামি সিগারেট খায়। ছুটির দিনে যে মহিলাটা কোচিং থেকে বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফিরছে, তাকেও চিনি আমি, সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করে সে, সব সময় একটাই বোরকা পরে। তার স্বামীকে নতুন নতুন শার্ট গায়ে প্রায়ই কমবয়সী একটা মেয়ের সাথে রিকশায় দেখা যায়। মোটর সাইকেলে যে পেটমোটা লোকটা এইমাত্র হর্ন বাজাতে বাজাতে পার হয়ে গেল, তাকে একদিন মিছিলে দেখেছিলাম, সামনের লাইনে থাকার জন্য বাচ্চাদের মতো কনুই দিয়ে ঠেলাঠেলি করছে। ফোনের পর্দায় চোখ রেখে বোকা ডোডো পাখির মতো হাঁটতে থাকা ছেলেটা, সাইকেলে গলগণ্ডের মত কলসি বেঁধে ধীর লয়ে প্যাডেল ঘুরানো দুধওয়ালা, রিকশায় ফেরা বিধ্বস্ত পতিতা, এইসব মুখ দেখছি আর ভাবছি, এই মানুষগুলোকে কি আমি খুন করতে পারবো? যার মনে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, অনুশোচনা নেই, মায়া নেই তার দ্বারা ভয়ানক সব কাজ করা সম্ভব। যতই ভাবছি, ততই নিজেকে খুব বিপজ্জনক মনে হচ্ছে।"
কিছু বই থাকে যেগুলো নিয়ে এই সেই হ্যান ত্যান লিখে রিভিউ দিতে ইচ্ছা করে না। ওবায়েদ হকের বইগুলা আমার কাছে অনেকটা ওরকম মনে হয়। তার লেটেস্ট বই ‘জল নেই, পাথর’ এর ক্ষেত্রে একই এক্সপেরিয়েন্স। ডিরেক্ট সত্য স্বীকার করতে হলে বলবো, এই টাইপ বই নিয়ে লেখার জন্য যে টাইপ জ্ঞান, ভাষাজ্ঞান থাকা দরকার ঐটা আমার নাই। তাই আজাইরা প্যাঁচাল বন্ধ কইরা বইটা যেমন লাগছে সেইটা বলি।
ওবায়েদ হকের লিখনশৈলী নিয়ে আসলে বলার কিছু নেই। তবুও যারা তার নামটা প্রথম শুনতেছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলে ফেলা যায়, হুমায়ূন পরবর্তী সহজ সাবলীল ভাবে অল্প কথায় তার মত গল্প এক ওবায়েদ হক ছাড়া আমি কাউকে বলতে দেখি নাই। এইটা হইতে পারে আমার পড়ার লিমিটেশন। তবে এই কথায় ভুলেও আপনারা ভাববেন না ওবায়েদ হকের সাথে হুমায়ূন আহমেদের লেখার কোন মিল আছে। একদমই মিল নেই। দুজনের লিখনশৈলী পুরাই আলাদা। তবে গল্প বলার ক্ষেত্রে উনারা দুজইনই সহজ সাবলীলতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তেল আর জলের মতন, দুইটাই তরল কিন্তু একসাথে রাখলেও মিশবে না। ওবায়েদ হক বরাবরই তার চরিত্রের কিংবা গল্পকথকের মুখ দিয়ে সমাজের নানা বিষয়ে তার ফিলোসফি, অবজার্ভেশন প্রকাশ করেন। এই বইটাও ব্যতিক্রম না। আমাদের আশেপাশের ঘটনা যে প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে সেটাকে যে তিনি আলাদা ভাবে দেখেছেন এবং বিচার বিশ্লেষণ করেছেন সেটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। তার লেখার মাঝে যে ফিলোসফিক্যাল উদ্ধৃতি থাকে এই বইতেও আছে তা। তবে এইগুলা এইখানে লেইখা দিলে পাঠক হিসেবে আপনে তার লেখা পড়ার সময় জিনিসগুলা আবিষ্কার কইরা তৃপ্ত হবেন না। তাই স্রেফ একটা বইলা লিখনশৈলীর নিয়া আলাপ শেষ করি।
“বুড়োমানুষ মারা গেলে যে কান্না মঞ্চস্থ হয় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা, তাতে স্বস্তি থাকে। হাসপাতালের এই দৌড়াদৌড়ি, তোষামুদি, দুর্গন্ধময় জীবন থেকে মুক্তির স্বস্তি। মৃত্যুতে তারা যে স্বস্তি অনুভব করে, তা যাতে নিষ্ঠুর না দেখায় সেজন্য বিভিন্ন সান্ত্বনা দেয় নিজেদের-‘আল্লায় তারে কষ্ট থেইকা বাঁচাইছে’, ‘কেমন দিনটা পাইছে দেখছেন, একদিন পরে শুক্রবার, জুম্মার পর জানাজা পাইবো’, ‘মহরমের চান্দটা পাইছে মাশাল্লাহ’ ইত্যাদি। কর্মক্ষম কেউ বা কোন শিশু মারা গেলে পবিত্র দিন কিংবা মহররমের চাঁদের আর কোন মাহাত্ম্য তাদের মনে পড়ে না।”
প্লটের কথা বললে একটা হাস্যকর জিনিস মনে পড়ে। সেইটা হইলো, এই বইটার মার্কেটিং এর সময় দেখছিলাম এইটাকে ট্যাগ দেয়া হইছে থ্রিলার বইলা। আমি মোটামুটি শিওর ছিলাম মোটাদাগে থ্রিলার ওবায়েদ হক লিখবেন না। ১১২ পেজের লেখা অপুষ্ট থ্রিলার বই যেমন হবার কথা, আমার বিশ্বাস ছিলো ওবায়েদ হকের হাত দিয়ে সেই জিনিস বের হইবো না। পড়ার পরে দেখলাম আমার ধারণা সত্য। এই বইটাকে কোন অ্যাঙ্গেল থেকেই থ্রিলার বলা যায় না। এইটা একটা সমকালীন, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার বই। তাইলে এইটাকে কেন থ্রিলার বলা হইলো? এইটা কি বর্তমানে থ্রিলারে মজে থাকা তরুণ প্রজন্মকে এই বইয়ের দিকে টানার চেষ্টা? যদি তাই হয়ে থাকে জিনিসটা খুবই প্যাথেটিক, দুঃখজনক। এই বিষয়ে উপকথার পক্ষ থেকে বক্তব্য শোনার আগ্রহ প্রকাশ করে মূল প্লটে ফেরত যাই।
প্রায় প্রতিটা মানুষ দুঃখবিলাসী, একই সাথে প্রায় প্রতিটা মানুষ তার বেঁচে থাকার জার্নিতে অনবরত সুখের খোঁজ করে যায়। কিন্তু এই বইয়ের প্রোটাগোনিষ্ট মাহবুব সাহেব বলি বা পলাশ সাহেব বলি, তিনি খুঁজে চলেছেন দুঃখকে। দুঃখবিলাসী হয়ে দুঃখ খোঁজা না, কষ্ট বা ব্যাথাও না, একদম শাশ্বত দুঃখের অনুভূতি খুঁজতে ঘর ছাড়েন তিনি। তার এই যাত্রার কারণ কী? কারণ তিনি দুঃখবোধ করেন না। রাস্তায় চলার পথে ধুপ করে অ্যাক্সিডেন্টে কোন মানুষ মারা গেলে তাদের দেখে একদমই কোন অনুভূতি হয় না তার। অনুভূতি হয়নি যেদিন তার প্রিয় দুটি মানুষ অপঘাতে মারা গেলেন। আপাতদৃষ্টিতে এইটা তো ভালো জিনিস হবার কথা, তাই না? কিন্তু পলাশ সাহেবের বক্তব্য হইতেছে, এই দুঃখ না পাবার অনুভূতি তারে একটা আজব জীবন যাপন করাইতেছে। ফটোগ্রাফিক মেমরীওয়ালা পলাশ সাহেবের কাছে চোখে দেখা প্রতিটা ঘটনা ফিল্মের মত, ফ্রেমের পর ফ্রেম আসতেছে তো আসতেছে, কিন্তু সেইটাতে নাই কোন অনুভূতি। শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার পরেও বুক না ভরার অনুভূতি, বিস্বাদ খাবার গলাধকরণের মতো অনুভূতি তারে দিতেছে গলায় আটকানো একটা ঢোকের মত। অস্পৃশ্য জিনিসটা গেলার কোন রাস্তা নেই, আবার উগরানোর রাস্তাও নেই। তিনি এইটা থেকে মুক্তি চান, তার সে কারণেই শরণাপন্ন হয়েছেন মানসিক ডাক্তারের। আর এখান থেকেই গল্প শুরু। দুঃখের খোঁজে তার এই জার্নির সঙ্গী হয় কিছু চরিত্র, যেগুলো ভয়ানক রকমের অদ্ভুত।
লিখনশৈলী নিয়ে তো আগেই বললাম যে আপনার পছন্দ হবে। অল্প বিস্তর লেইখা প্লট হিসেবে যেইটারে লেখলাম সেইটাও আপনার পছন্দ হবার কথা। বাকি থাকে এক্সিকিউশন। এক্সিকিউশনেও কোন ঝামেলা লাগে নাই আমার কাছে। খুবই সুক্ষ্ম মাত্রার যে হিউমার ওবায়েদ হকের লেখায় পাওয়া যায় সেইটা এই বইতেও ছিলো। আর ঘটনাবলি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভীষণ আগ্রহে গ্রোগ্রাসে গিলেছি শুধু। শেষের দিকে একটা টুইস্ট আছে (আল্লায় জানে এইটার জন্য থ্রিলার ট্যাগ খাইছে নাকি) তবে সেইটা অনুমেয় না হইলেও ওবায়েদ হক যে সব সুতা মেলাবেন এইটা আমি আইডিয়া করছিলাম, তার বাকি বইয়ের মতই। শেষটা আমার কাছে তৃপ্তিদায়ক মনে হইছে।
‘নীল পাহার’, ‘জলেশ্বরী’, ‘কাঙাল সংঘ’ এর মতো এই বইটাও ভালো, তবে এই বইটা আমার কাছে একটু স্পেশাল কারণ এই বইটার প্রতিটা পাতায় ওয়াটারমার্কের মত মিশে আছে বিষণ্ণতার সুক্ষ্ম ছাপ। আমি জানিনা কেন, বইয়ের পাতায় যে কোন অনুভুতির চাইতে বিষণ্ণতা দেখতে আমার বেশি ভালো লাগে কেন। সো, সব মিলিয়ে আমার অনেক পছন্দের বইয়ের তালিকায় এই বইটাও থাকবে। আপনেও চাইলে পড়তে পারেন, খারাপ লাগার কথা না।
বাহ্যত বইটা হুমায়ূন এবং হিমু জ্বরে আক্রান্ত। হিমুর মতো পলাশেরও কিছু অলৌকিক ও মানুষকে বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা আছে। পার্থক্য হচ্ছে, হিমু অনেকটা নির্বাণপ্রাপ্ত (পরেরদিকের লেখায়), এদিকে পলাশ তার অনুভবশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বিয়োগান্ত ঘটনা দিয়ে শুরু হওয়া গল্পে অবশ্য প্রচুর মজার ও অদ্ভুত ঘটনা আছে।আপাত সম্পর্কহীন, পারম্পর্যবিহীন বিবিধ ঘটনা যেভাবে লেখক শেষে একসাথে মিলিয়ে দিলেন তাতে আমি মুগ্ধ।খুবই সহজ, বিষণ্ণ ও গভীর গল্পের জন্য "জল নেই, পাথর" এর কথা আমার মনে থাকবে।
ওবায়েদ হক এর বই মানেই এখন এমন একটা অনুভূতির কাজ করে যা হুমায়ূন আহমেদ এর বেলায় করতো। দুইজন কে কম্পেয়ার করছি না। দুজনের লেখার ভিতর মিলের বালাই ও নেই! কিন্তু দুজনেই একবারে আন্তর্সম্পর্ক তৈরী করে ফেলতে পারে নিমিষেই। লেখনী! এই দুইজনের গার্বেজ লেখা পড়লেও সুখাদ্য মনে হবে এই লেখনীর জন্য! নিজের হযবরল লেখা দেখে নিজের কাছেই মনে হচ্ছে বায়াসড হয়ে গেছি হয়তো!
দুপুরে খাওয়ার পর প্রত্যেকদিন ই���্ছেমতো যেকোন একটা বই হাতে নিয়ে আমি পড়তে শুরু করে দিই। তারপর কয়েকপাতা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ি। এটা একরকম অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে আমা���। আজকেও ঘুমানোর ইচ্ছে নিয়েই ওবায়েদ হকের ঝকঝকে নতুন এই বইটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তারপর কয়েক পাতা পড়ার পর খেয়াল করলাম আমি যেন নিজের মধ্যে একধরনের কাপুনি অনুভব করছি। হতে পারে নতুন কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনায়। কিন্তু আমার সমস্ত ঘুম উবে গিয়ে কোন এক জাদু মন্ত্রবলে সম্পূর্ণ বইটাকে শেষ করে থ মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর কল দিলাম আরেক বই পড়ুয়া বন্ধুকে। অতঃপর...... (তার কানটাকে ঝালাপালা করে দিছি)।
খুব বেশি মোহিত হয়ে গেলে সে বইয়ের সদ্য রিভিউ লিখতে পারি না আমি। আর রিভিউ লিখতে গেলেও তো কিছু কমতি চোখে পড়তে হয়। ওবায়েদ হককে স্রেফ জাদুকর মনে হয়েছে আমার কাছে। তার এই জাদুকরী লেখা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে আরো বহুতদিন।
এটা আমার প্রথম পড়া ওবায়েদ হক। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। হয়তো এরকম অসংখ্য জাদুকর আমার পাশেই আছে। তাদেরকে আবিষ্কার করতে পেরে আবার কোন একদিন নিজের মধ্যে কাপুনি অনুভব করব। মোহিত হয়ে থাকব অনেককাল।
সেই নীল পাহাড়ের সময় থেকেই ওবায়েদ হকের লেখা ভালো লাগে। জল নেই, পাথর বইটাও সেই ধারাবাহিকতায় ভালো লাগলো। ভেতরে মুরাকামিকে ট্রিবিউট দেয়ার বিষয়টাও উপভোগ করেছি। গল্প নতুনত্ব ছিল না। কিন্তু ভালো বই হতে হলেই গল্পে নতুনত্ব থাকতে হবে, সেটা আমার মনে হয় না। পরিবেশনটাই আসল। আর সেটা লেখক ভালোভাবেই করেছেন। আমার শুধু চোখে লেগেছে একটা ব্যাপার। কিছু জায়গায় পরপর তিন চারটা লাইন 'ছিল' বা 'হলো' দিয়ে শেষ হয়েছে। সাহিত্যে কবিতা বাদে এমন ছন্দ অন্তত আমার ভালো লাগে না। এটা হয়তো সম্পাদনার সময় লেখকের দৃষ্টিগোচর হয়নি, নতুবা এমনটা হবার কথা না।
৩.৫/৫ ওবায়েদ হকের উপন্যাসে একটা জার্নির ব্যাপার থাকে। "নীল পাহাড়" বইতে পার্বত্য অঞ্চল, "জলেশ্বরী" তে বানভাসি এলাকা এবং "আড়কাঠি" বইতে চা বাগানের লোক সংগ্রহের বর্ণনা পাওয়া যায়। এই বইতে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আবিষ্কার করি শহরের অলি-গলি ঘুরে বেড়ানো এক ভবঘুরে রূপে। তাই এবারের প্লট শহরকে নিয়েই৷
তার লিখার চোখে পড়ার মতোন আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নানান অসঙ্গতি তুলে আনা। ব্যাপারটা প্রশংসনীয় তবে ঘটনার সাথে এগুলোর আরেকটু যোগসূত্র ঘটানো গেলে চমৎকার হতো।
ওবায়েদ হকের বইগুলোর শেষের নাটকীয়তা ব্যাক্তিগতভাবে আমার পছন্দ নয়৷ মনে হয় যেন জোর করেই মেলাচ্ছেন সবকিছু। এই বইয়ের শেষও তাই যথারীতি ভালো লাগেনি। তবে সরল-তরল লিখার ফলে দ্রুতই শেষ করা যায় এই এক সুবিধে।
"জল নেই, পাথর" উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম মাহবুব ওরফে পলাশ। আর চারটা সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরের মতোই ছিল পলাশের জীবন- ভীতু, মাথা নুইয়ে বসের কথা শোনা, একই পথে অফিসে যাওয়া আর বাড়িতে ফেরা, মিইয়ে যাওয়া দাম্পত্য আর বছর চারেকের একটি ফুটফুটে কন্যা। বয়স অবশ্য চার নয়! আর দু'দিন বেশি বাঁচলে চারে পা দিতো পলাশের ছোট্ট মেয়েটি। কিন্তু তার আগেই রাস্তায় হুট করে ছিটকে আসা মোটরসাইকেল কেড়ে নেয় মা-মেয়ের প্রাণ আর তার সাথে কেড়ে নেয় পলাশের দুঃখবোধ। ভীতু পলাশের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসে এক নির্লিপ্ত, সাহসী, দুঃখবোধ হীন পলাশ। "জল নেই, পাথর" নামকরণ বোধহয় এ কারণেই। নিজের এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পলাশ শরণাপন্ন হয় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। সবকিছু শুনে ডাক্তার পলাশকে পরামর্শ দেন মানুষের দুঃখবোধ দেখতে। আর আমরা পাঠকরা পলাশের সাথে সাথে দুঃখের দুনিয়ায় বিচরণ করি- কখনও রাস্তায় কিংবা রেল স্টেশনে, কখনও সরকারি হাসপাতালে, কখনও বা সুইসাইড ব্রীজের আশেপাশে। এরমধ্যে আমরা দেখি পলাশকে পোটলা হাতে খালি পায়ে রাস্তার মানুষ হয়ে উঠতে..আর দেখা পাই মানুষের জটিল প্যাঁচালো মনস্তত্ত্বের! আর এইসব জিনিস চেয়ে দেখতে দেখতে ১১২ পৃষ্ঠা ফুরিয়ে আসে।যার ফলে ঘন ঘন বদলে যায় নাটকের দৃশ্যায়ন, নাটুকে মনে হয় কিছু ক্ষেত্রে! আর আমি ভাবতে থাকি লেখক হয়তো ১১২ পৃষ্ঠার বই বের করার ব্রত নিয়েছেন! ¬_¬
ওবায়েদ হক জলেশ্বরীআর জল নেই, পাথরকে এঁকেছেন একই ছাঁচে। হুট করে চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া তরলমতো কাজল আর প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে পথে ঝরে থাকা কোমল পলাশ! একজন পথে বেরিয়েছিল বাবার মৃত্যুতে, বাবার লিখে যাওয়া একটা লাইন তাকে করে তুলেছিল ব্যতিব্যস্ত, আটাশির বন্যা তাকে দেখিয়েছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবন; অন্যান্যদের সাথে দেখা হওয়ার পাশাপাশি ওর দেখা হয়েছিল তাপসী আর ফিজিক্সের শিক্ষক আসাদ উদ্দীনের সাথে। এদিকে পলাশ রাস্তায় বের হয়েছে স্ত্রী সন্তানের মৃত্যুতে; রাস্তায় রাস্তায় ভ্রমণ দেখিয়েছে অনেক কিছু! পাশাপাশি নয়ন কিংবা শশী আর ইংরেজি বলা বুড়ো ভদ্রলোক আমাদের শুনিয়েছেন অন্য রকম কাহিনী। পরিশেষে জল নেই, পাথরকে জলেশ্বরীর মিরর ইমেজ বলে মনে হলো যার শেড কালচে কিংবা ধূসর।
কাহিনী, লেখার তারল্য আর উপমার ভার সবমিলিয়ে সাড়ে তিন ওরফে চারটি জ্বলজ্বল করা তারা।
২০ মার্চ, ২০২৪
আরেকটা কথা! মাঝে মনে হয়েছে হুমায়ূন উঁকি দিলেন। বিশেষ করে, ভয়াবহ ব্যাপারেও পলাশের নির্লিপ্ততা, নীরবতায়। এ ধরনের ক্যারেক্টারাইজেশন আসলে হুমায়ূন সাহেব তার উপন্যাসে, স্পেশালি হিমুর মাধ্যমে এতবার দেখিয়েছেন যে এই টাইপ কিছু দেখলে হুমায়ূন হুমায়ূন গন্ধ লাগে -_-
❝আমাদের ব্রেন খুব জটিল একটি অঙ্গ। শরীরকে রক্ষা করতে তার অনেক ডিফেন্স মেকানিজম আছে। যে ব্যথা আপনি সহ্য করতে পারবেন না, তেমন ব্যথা পেলে ব্রেন আপনাকে অবচেতন করে দিবে।❞
সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে রহস্যময় বিষয়বস্তুর তালিকা দিতে বলা হলে প্রথমে বলবো "জীবন" তারপর "মস্তিষ্ক"। প্রাণের সৃজন কীভাবে হয়? এই প্রশ্ন নিয়ে যতই ভাবি ততই আশ্চর্য হই! একটা দেহের মধ্যে আমরা (আত্মা) প্রত্যেকেই বন্দী! দেখছি চারিপাশের সবকিছু। তবে মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা বিশ্লেষণ যতই দেখি ততই গোলকধাঁধায় পড়ি! এক একজনের চিন্তা- ভাবনা, বুদ্ধি- বিবেক, আবেগ- অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া একেকরকম। আর এই ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। কার মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে বা করবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দুষ্কর।
ডাক্তার আজিজুর রহমানে��� চেম্বারের সামনের চেয়ারের সারিগুলোতে রোগীরা বসে আছে। চারিপাশের মানুষগুলো মাহবুব একপলক করে দেখছেন কিন্তু তিনি জানেন এদের আর কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না! সাইকিয়াট্রিস্ট আজিজুরের কাছে এইজন্যই আসা। একটা দূর্ঘটনা তার সমস্ত জীবনটা নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। হারিয়ে ফেলেছে অনুভব করার ক্ষমতা! কিন্তু হঠাৎই পেয়ে গেছেন ফটোগ্রাফিক মেমোরি! অনুভূতি আবারও ফিরে পেতে মাহবুব ওরফে পলাশ বাসা থেকে ব��ড়িয়ে পড়েন। এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তা ঘুরে চলেন দুঃখবোধ ফিরে পাওয়ার আশায়...!!!
স্ত্রী- কন্যাকে হারিয়ে যেখানে জীবন উজাড় করে কান্না করার কথা সেখানে জ্ঞান ফিরে নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন কেউ হিসেবে আবিষ্কার করেন মাহবুব, কাহিনির শুরুটা এইখানেই। যদিও কষ্ট পেতে আমরা কেউই পছন্দ করি না তবুও অনেকেই দুঃখবিলাসী তো বটেই। মাহবুবের কেসটাও এমন মনে করলে ভুল করবেন। অনুভূতি হারিয়ে নিজেকে বড় শূন্য মনে হতে থাকে! আর এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতেই মানুষের জীবন পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। ডাক্তারের মতে অন্যের দুঃখ দেখলে নিজের দুঃখ ফিরেও আসতে পারে। গল্পটা শুধু মাহবুবের না বরং সুজন, মফিজ, শশী, জনি ওয়াকারসহ গল্পটা আরও অনেকের। জীবন যে বিচিত্র রংবেরঙের তা প্রতিটি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খন্ড খন্ড জীবনের গল্পগুলো পাঠককে বিমোহিত করে রাখবে।
ছিমছাম সাবলীল লেখনশৈলীর মাধ্যমে যে কেন্দ্রীয় চরিত্রের রচনা লেখক করেছেন অর্থাৎ "মাহবুব", বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের বহুল আলোচিত চরিত্র "হিমু"- কে। হিমু নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে সিদ্ধহস্ত আর মাহবুব অনুভূতিহীন। কিন্তু দুজনেই নির্বিকার। ব্যক্তিগতভাবে এমন নির্বিকার চরিত্র আমার পছন্দ না। হিমুও যেমন আমাকে টানে না তেমনি মাহবুব চরিত্রও আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছি একটা ভুল তথ্যের জন্য। প্রচার পোস্টগুলোতে বইকে থ্রিলার জনরাভুক্ত করা হয়েছে। স্বভাবতই প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিলাম থ্রিলারের স্বাদ পাবো কিন্তু শেষ করে বুঝেছি এতোগুলো চরিত্রের মধ্যে একটা চরিত্র খুনি বলেই "থ্রিলার" ট্যাগ পেয়ে গেছে! সমাপ্তিতে কাকতালীয়ভাবে ঘটনাগুলো মিলে যাওয়া দেখে মনে হয়েছে পৃথিবী আসলেই গোল।
প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী তাই প্রথমেই প্রচ্ছদ দেখে ভালো লেগেছে। শুকনো মাটি ও পাথর ফেটে যেন মানব অবয়ব ফুটে উঠেছে। যদিও নামকরণের সার্থকতা বই শেষ না করে ধরতে পারিনি। বইয়ের ওভারঅল প্রোডাকশন ভালো হয়েছে। বানান ভুল তেমন চোখে পড়েনি।
দুর্ঘটনায় বউ-বাচ্চা হারিয়ে দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি উধাও হয়ে যাওয়া এক লোকের পথে নেমে সেই অনুভূতি খোঁজার অভিযান নিয়েই বইটা। লেখা নিয়ে বলার নেই কিছু, সরল গদ্য। গল্পের কাহিনীও একটু উইয়ার্ড ক্যাটাগরির। মুরাকামি বা জাপানিজ ফিকশন পড়ুয়াদের কাছে কমন বেশ। তাই সেরকম নতুনত্ব পাইনি। তবে গল্পটা সাজানো ভালো হয়েছে। প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে পাঠককে একটু ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক, এটা প্রশংসাযোগ্য।
আমার বই পড়া বেশ কমে গেছে। কোনো বই নিয়ে আলাপ-আলোচনা করাটা আরও বেশি কমে গেছে।
আজ দীর্ঘদিন পর কোনো বই এক বসাতে পড়েছি। আনুমানিক দুপুর ২.৩০ থেকে ৫.৪৫ অবধি একনাগাড়ে আমি ওবায়েদ হকের 'জল নেই পাথর' বইটি পড়ে শেষ করেছি।
যখন কোনো কিছু খুব বেশি ভালো লাগে তখন সম্ভবত গুছিয়ে কিছু বলা যায় না। এই মুহূর্তে আমার অবস্থাটাও ঠিক এমন। বইটি এত বেশি ভালো লেগেছে যে বইটির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে কেন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। তারপরও চেষ্টা করি। নিজের ভালোলাগাটুকু যদি প্রকাশ করতে পারি এই তো অনেক।
মনস্তাত্ত্বিক ধারার বইগুলো আমাকে প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করে। আমার কাছে একজন মানুষ মানে একটা বই। বইগুলোর মতোই তাদের একান্ত নিজস্ব গতিবিধি রয়েছে। এখন যেমন প্রচলিত একটি নিয়ম হয়ে গিয়েছে বা আমরা ধরে নিয়েছি মনস্তাত্ত্বিক বই মানেই ট্রাকের বাইরে কিছু হবে। যেমন একজন সিরিয়াল খুনির চিন্তাভাবনা, রেপিস্টের চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। কিন্তু আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের আশেপাশে কত বিচিত্র মানুষের বসবাস। তারা খুব সাধারণ মানুষ কিন্তু এই সাধারণ মানুষগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকে সুক্ষ্ম চিন্তাভাবনা।
পিওর মনস্তাত্ত্বিক ধারার এই বইটি পড়ে ঠিক এই কারণে আমার মনটা একদম ছুয়ে গিয়েছে।
একজন খুব সাধারণ মানুষের পুরো মানসিক জগৎই হয়তো লন্ডভন্ড হয়ে যায় কোনো বিশেষ কারণে। রুপান্তরিত হয় অন্য এক মানুষে অথবা লুকিয়ে থাকা চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কত কিছুই না হতে পারে। একজন ধর্ষিতা মেয়ের শারীরিক যন্ত্রণা কিন্তু একসময় কমে আসে কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা?
এই বইয়ের মূল চরিত্রগুলো ঠিক এরকমই। অতি সাধারণ মানুষ কিন্তু কোনো এক মানসিক আঘাতে তাদের পুরো জগৎটি যেন বদলে যায়। প্রকৃতি তখন তাদের নিয়ে খেলা শুরু করে। আঘাতের কারণে বিচিত্র হয়ে ওঠে তাদের আচার-আচরণ। কেউ হয়ে ওঠে অবসাদগ্রস্ত, প্রতিশোধপরায়ণ কেউবা হয়ে ওঠে অনূভুতি শূন্য।
গল্পের মূল চরিত্র অনূভুতিশূন্য একজন মানুষ। যার মধ্যে কোনো দুঃখবোধ নেয়। এই বইটি ভালো লাগার এটা আরও একটি মূল কারণ। প্রবল দুঃখবোধে কান্না করতে পারাটাও যেন সৌভাগ্য।
অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও দুঃস্বপ্নের মতো দিন পার করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। হয়তো প্রতিটি মানুষেরই আছে। ২০২০ সালে আমার তিন বছরের কন্যার সার্জারীর জন্য তাকে ওটিতে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন কিন্তু আমি একটুও কান্না করিনি। আমার ভেতরটা মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল। তারপরও ওটি থেকে আসার পর আমার কন্যার বাবার অদ্ভুত আচরণ আমি লক্ষ্য করেছিলাম। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম সে ব্যস্ত হয়ে দুপুরের খাবারের খোঁজ করছে। অন্যদের স্বান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু ওটিতে নেওয়ার আগের কয়টা দিন তার রাত-দিনের হিসেব ছিল না। গভীর শোকে সে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ওটিতে নেওয়ার পর তার মস্তিষ্ক এই শোক আর নিতে পারেনি। নার্ভাস ব্রেকডাউনের কারণে বিচিত্র সব আচরণ করছিল। এই বইয়ের কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে আমি যেন ২০২০ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে ফিরে গিয়েছিলাম।
"পলাশ সাহেব আমাদের ব্রেন খুব জটিল একটি অঙ্গ। শরীরকে রক্ষা করতে তারা অনেক ডিফেন্স মেকানিজম ব্যবহার করে। আপনার মেয়ের যে বয়স, সে বয়সে বাচ্চারা খুব আদুরে কথাবার্তা বলে। এই বয়সে বাবাদের সাথে তাদের বন্ডিং খুব ভালো হয়। বাবার মাধ্যমেই সে বাহিরের জাদুকরী জগৎটার পরিচয় পাওয়া শুরু করে। বাবা তাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে, এমন একটা বিশ্বাস তার মধ্যে জন্মায়। বিশ্বাসটা অমূলক না, বাবারা আসলেই তা করে। আপনি তাকে রক্ষা করতে পারেননি, এই কষ্টটা আপনার মস্তিষ্ক নিতে পারেনি।' (আলহামদুলিল্লাহ আমাদের কন্যা সম্পুর্ণ সুস্থ আছে। ভালো আছে আর দশটা শিশুর মতোই।)
ওবায়েদ হক এমন একজন লেখক যার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে পাঠকের আবেগকে নাড়া দিতে পারার। লেখনী সম্বন্ধে নতুন করে বলার কিছু নেই যারা তার লেখা পড়েছেন তারা জানেন একদম ঝরঝরে তার লেখনী। প্রচন্ড শক্তিশালী কনসেপ্ট এবং কনসেপ্ট এর সাথে মিল রেখে লেখার শৃঙ্খলা অতি চমৎকার। অল্প কিছু চরিত্র কিন্তু সবগুলো চরিত্র শক্তিশালী। একদম যেন আমাদের পরিচিত মানুষগুলোর অপরিচিত মনস্তত্ব। বিশেষভাবে বলত��� হয় চরিত্রগুলোকে অযাচিতভাবে উদ্ভট বানানো হয়নি।
আমার ফ্রেন্ডলিস্টে অসংখ্য বইপড়ুয়া আছেন। আমি জানি সবার রুচি একরকম নয়। এরকম কোনো আইনও নেই যে আমার যা ভালো লাগবে তা আপনার ভালো লাগবে, আবার আপনার যা ভালো লাগবে তা আমার ভালো লাগতেই হবে। তারপরও পাঠক মহলকে এই বইটির ব্যাপারে হাইলি রেকমেন্ড করবো।
পাঠ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিজের জীবনের কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সংযোজন করার জন্য ক্ষমাপ���রার্থী।
আমরা মানুষেরা প্রতিনিয়ত সুখ খুঁজি। দুঃখকে ভুলে থাকতে চাই। সুখের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে চাই মনের কোণে কোণে জমে থাকা দুঃখকে। হারিয়ে যাক, যেন আর ফিরে না আসে। কিন্তু এভাবে কি সম্ভব হয়? আমাদের জীবন যে সাম্যাবস্থা পছন্দ করে। আজ দুঃখ, তো কাল সুখ। এভাবেই চলতে হয়। একটা হারিয়ে অন্যকে থিতু করলে হয়তো জীবনের গতিপথটাই হারিয়ে যায়।
কোনো একদিন দেখলেন, আপনি জীবনের সব দুঃখবোধ হারিয়ে ফেলেছেন। কোনো দুঃখ আপনাকে ছুঁয়ে যায় না। তাহলে কেমন লাগবে? খুব খুশি লাগবে? দুঃখ বলে যে জীবনে কিছু নেই। কিন্তু সুখ ছাড়া যেমন থাকা যায় না, তেমনই দুঃখ ছাড়াও মানুষ অসহায়। জীবনে ঘটে যাওয়া এক ট্র্যাজেডি যেখানে কাঁদায় না, সেখানে জীবনের মূল্যও হারিয়ে যায়।
পলাশ কিংবা মাহবুব, যে নামেই ডাকা হোক না কেন; আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্রের সাথে এমনই এক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আমার জন্মদিনের দিন দুয়েক পরের ঘটনা। কথায় আছে, ‘একটি দুর্ঘটনা, সারাজীবনের কান্না’। নিজের একমাত্র সন্তান ও স্ত্রীকে হারিয়ে পলাশ সাহেব যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছেন। দুর্ঘটনায় সারাজীবনের যে কান্নার কথা বলা হয়, তা যেন তাকে ছুঁয়ে যেতে পারছে না। চার বছরের মেয়ে মা রা গিয়েছে, তবুও যেন কষ্ট অনুভব করতে পারছে না।
কেন এমন হচ্ছে? জানে না পলাশ। তবে মানসিকভাবে কিছু যে একটা হচ্ছে, তা ঠিকই বুঝতে পারে সে। নিজেকে আর আগের মানুষ মনে হয় না। যেন অন্য এক সত্তায় পরিণত হয়েছে। যে মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। চোখের ভাষাতে সত্য, মিথ্যা বুঝতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, কাউকে একবার দেখলে বা কিছু পড়লে জীবনেও ভুলে না। স্মরণশক্তির এমন দৃশ্যায়ন আশীর্বাদ, না অভিশাপ?
ডাক্তারের পরামর্শে দুঃখ খুঁজতে শুরু করেছে সে। ডাক্তার বলেছে, দুঃখের কোনো এক ঘটনা তার মনে আবারও দুঃখবোধ এনে দিতে পারে। সে তাই ছুটছে দুঃখ খুঁজতে। নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে থিতু হয়েছে রাস্তায়। হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকে। যেন মানুষের মৃত্যুর খবর, তাদের কান্নার আহাজারি তাকে কিছুটা দুঃখ এনে দিতে পারে। এই নগরীর পথে-ঘাটে, অলিতে গলিতে ছড়িয়ে থাকে কত দুঃখ, না পাওয়ার বেদনা। সেগুলো যেন তাকে ছুঁতে পারে না। তারপরও দুঃখ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা বিরাম নেই।
এভাবেই একদিন পরিচয় হলো এক বৃদ্ধ মানুষের সাথে। যে নিজেকে পরিচয় দেয় জনি ওয়াকার নামে, বাড়ি আমেরিকার ফ্লোরিডায়। এমন একজন মানুষ ফুটপাতে কী করে? জানায় তার অদ্ভুত স্বপ্নের কথা। মানসিক বিকৃতি? না অন্য কিছু। সবকিছুর মধ্যে কোনো না কোনো যোগসাজস আছে। কী সেই সংযোগ?
পরিচয় ঘটে নিজেকে শেষ করে দিতে চাওয়া একটি মেয়ের সাথে। আত্মহননের পথ থেকে ফিরে এসে জানায় নিজের দুঃখের কথা। একাকীত্ব যেন মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়। এই নিঃসঙ্গতা, নিজেকে হারিয়ে ফেলার গল্প এখানে বলে যায় শশী নামের মেয়েটি। চেনা নেই, জানা নেই এমন একটি মেয়ের সাথে যেন এই বন্ধন অদৃশ্য। এখানেও এক অদৃশ্য সংযোগে আবদ্ধ এ গল্প। এই গল্পের শেষটা জানার অপেক্ষা।
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :
ওবায়েদ হকের লেখার মধ্যে এক ধরনের মাধুর্যতা আছে। যে মাধুর্যতায় কোন সময় যে ডুবে যাওয়া হয়, কেউ জানে না। “জল নেই পাথর” বইটার জনরা আসলে কোনটি? বইটি প্রচার-প্রচারণায় থ্রিলার বলা হলেও আমার বইটিকে থ্রিলার মনে হয়নি। মোটাদাগে সাইকোলজিকাল উপন্যাস বলা যেতে পারে, যেখানে মানুষের মনস্তত্ত্বের এক অন্যরকম দিক উন্মোচিত হয়েছে।
এই গল্পের মূল চরিত্র পলাশ কিংবা মাহবুব। তার-ই জবানে বইটির গতির প্রকৃতি নির্ধারিত। তার দৃষ্টি দিয়ে এই সমাজকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন লেখক। আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনে দুঃখ আছে, হাহাকার আছে। কিন্তু এই হাহাকার কতটা সত্য আর কতটা মেকি, আমরা কি জানি? হয়তো মানুষের দুঃখবোধ আমাদের তাড়িত করে। কিন্তু সেই মেকি বা মিথ্যের হাহাকারে জীবন জড়িয়ে যায়।
আমরা প্রত্যেকেই এক ধরনের মুখোশ পরে থাকি। সেই মুখোশ সময়ে অসময়ে খসে যায়। এই কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করে নেওয়া স্বামীকে ফেলে স্ত্রী চলে যায়। মুখোশের আড়ালে থাকা দুঃখ কিংবা কান্না হয়তো মন ভোলানো। কেউ কেউ সত্যিই দুঃখে তাড়িত হয়। অন্যের দুঃখ নিজের করে নেয়। আবার অনেকেই থাকে, নিজের শান্তির জন্য খুঁজে নেই অরাজকতা। অন্যের ক্ষতিতে যার শান্তি। ছোটো ক্ষতি করতে করতে কখন যে কারো বিরাট ক্ষতি করে ফেলে, নিজেই অনুধাবন করতে পারে না।
আগেই বলেছি, “জল নেই পাথর” মনস্তাত্বিক উপন্যাস। বেশ কিছু চরিত্রের গভীরতা দিয়ে লেখক এই মনস্তত্ত্ব ভালোমতো ফুটিয়ে তুলেছেন। যা হয়তো গভীরভাবে ভাবতে শেখায়। আমরা কি সত্যিই এমন? মানুষের মনের মধ্যে ভালো ও খারাপের বাস। যেই পাল্লাটা ভারী হয়, সে অনুসারে মানুষ নিজের কর্ম সাধন করে। মনস্তত্ত্বের এই দিক বেশ ভালো লেগেছে।
ওবায়েদ হকের লেখনশৈলী নিয়ে অভিযোগ করার জায়গা নেই। দুর্দান্ত, অনবদ্য। মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। বর্ণনাশৈলী মনে ধরে ভীষণ। টুকরো টুকরো সাদামাটা বিষয়ের বর্ণনাও কেমন যেন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই বইটির বেশ কিছু জায়গায় এমন ছিল। যেন সত্যতা সামনে এসে ধরা দেয়। লেখক শুরু থেকেই গল্পের সাথে জড়িয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সাবলীল ও গতিশীল বর্ণনায় শেষ চমকটাও ছিল অপ্রত্যাশিত। এভাবে হবে হয়তো ভাবতে পারিনি। বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এক বিন্দুতে মিলিয়ে আনার যে মুন্সিয়ানা লেখক দেখিয়েছেন, তারিফ করতেই হয়। অনেক কিছুই লেখক না বলেই বলেছেন। সেগুলো অনুভব করে নিতে হয়। তাহলেই তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব।
বইটিতে যা উপাদান যেমনভাবে দরকার ছিল, তেমনই ছিল। মেদহীন পরিমিত বর্ণনা, শব্দচয়নের মুন্সিয়ানা, চরিত্রদের যতটুকু সময় দেওয়া— কোনো কিছুতেই বাহুল্য লক্ষ্য করিনি। লেখকের এই কাজ ভালো লেগেছে। যদিও শশীকে আরেকটু সময় দেওয়া যেত। তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগত। আমার ভয় ছিল, শেষটা না আবার তাড়াহুড়ো হয়। তবে যেভাবে লেখক সমাপ্তি টেনেছেন, এক ধরনের তৃপ্তি নিয়ে শেষ করেছি।
শুরুর দিকে দুয়েকটা ছাপার ভুল ছাড়া সম্পাদনা দারুণ। প্রচ্ছদ শুরুতে পছন্দ হয়নি। তবে বইটি পড়ার পর মনে হচ্ছে, এরচেয়ে পারফেক্ট প্রচ্ছদ আর হয় না।
▪️পরিশেষে, আমরা হয়তো আমাদের সুখ ভিন্ন দুঃখ চাই না। কিন্তু অপ্রতুল দুঃখও যেন বিষাদের কারণ হতে পারে। যে সময় কাঁদা দরকার, জীবনের কষ্টকে ভাসিয়ে দেওয়া দরকার; সে কষ্টকে যদি বের না করেই দেওয়া যায়! তবে অনুভূতিহীন দুঃখগুলো আরো বেশি জাঁকিয়ে বসে। তখন বিষাদের পরিমাণও বাড়তে বাড়তে সীমা ছাড়ায়।
হুট করেই একদিন আপনি আবিষ্কার করলেন আপনার আর কোন দুঃখবোধ হয়না। কারোর জন্যই না, কোনকিছুর ��ন্যই না। নিজের জন্য ও না।
আপনার মস্তিষ্কের দুঃখ তৈরীর জায়গাটা হঠাৎ করেই শূন্য হয়ে গিয়েছে। তাই একের পর এক সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে মানুষের নাম, তাদের গন্ধ, তাদের হাসি, কান্না, অথবা গায়ের তিল। আপনি চাইলেও মাথা থেকে সেসব বের করতে পারছেন না।
আপনি দুঃখ খুজতে লাগলেন। দুঃখবোধ না হওয়াটা যে জীবনে অস্থিরতা এনে দিচ্ছে, তার থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য দুঃখ কোথায় পাওয়া যায়? কেউ বললো সরকারি হাসপাতালে একবার গিয়ে দেখেন, সেখানে মানুষের অনেক কষ্ট, আপনি দুঃখ খুজে পাবেন। আপনি গেলেন, দুঃখবোধ হলোনা আপনার, এবারও।
আপনি ঘর ছাড়লেন, রাস্তার মানুষ হলেন। রাস্তায় মানুষের দুঃখ দেখলেন, দুঃখবোধ করতে চাইলেন। হলোনা। দুঃখ খুজতে খুজতে আর কতোদূর যাওয়া যায়? রাতের সুইসাইড ব্রিজ, রেলস্টেশন নাকি আবার ফিরতে হবে মৃত্যুপথযাত্রী ব্যথায় কুকড়ে যাওয়া মুখের কারো কাছে।
ওবায়েদ হক পড়ার অভিজ্ঞতা আমার বরাবর ই ভালো। তার লেখার ধরণ আমার বেশ পছন্দ। চমৎকার চমৎকার সব উপমা ব্যবহার করেন তিনি। গল্পে ও এক অদ্ভুত শক্তি তৈরী করেন। চরিত্রকে গুরত্ব দেন। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তার বিপরীত ঘটেনি। তাই পছন্দের তালিকায় যোগ হলো, আরেকটি বই।
কালকে রাতে ভয়ানক মন খারাপ ছিল, এর মাঝে এই বইটা হাতে নিয়ে এক বসায় পড়ে শেষ করি। বইটা পড়ে আরো বিষণ্ণ হয়ে যাই, বিমোহিত হয়ে যাই। নিজেরে অনেক বড় পড়ুয়া মনে করি না, কিন্তু আমি হরেক রকমের বই পড়ার চেষ্টা করি। “জল নেই, পাথর” রিভিউ লেখার জন্য যে ধরণের পড়ুয়া নলেজ থাকা দরকার ঐটা আসলে আমার মতো wannabe বই পড়ুয়ার নাই।
ওবায়েদ হকের সব কয়টা বইই কিনে রাখছি, এইটা আমার পড়া তার দ্বিতীয় বই। ওবায়েদ হক পড়তে গেলে আপনার বার বার মনে হবে আপনি হুমায়ুন আহমেদ পড়তেছেন। কিন্তু তাই বলে যে উনারে wanna be হুমায়ুন আহমেদ বলবেন, সেটা কিন্তু হবে না। হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা ছিল তা হলো তার গল্প বলার স্টাইলটা অনেক সাবলীল ছিল। ওবায়েদ হকের গল্প বলার প্যাটার্নটাও খুবই সাবলীল; এবং এই সাবলীলতার সাথে উনি খুব সুন্দর ভাবে যেটা করেন সেটা হইলো আমাদের চারপাশে সবসময় ঘটতে থাকা ঘটনাগুলার তার নিজের পারসেপশন। এই বইয়ে অল্প কিছু চরিত্র কিন্তু সবগুলো চরিত্র শক্তিশালী, একটা চরিত্রও অকারণে আনা হয় নাই। গল্পের শুরু থেকে বুনতে থাকা এক একটা সুতা তিনি তার মতো শেষে লেখনশৈলী দিয়ে সুন্দর করে জোড়া লাগান। তার পারসেপশনগুলাতে খুব সুন্দর হিউমার থাকে। তার লিখা চরিত্রগুলার মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ পড়তে পড়তে আপনার একটা আলাদা মাদকতা কাজ করবে। গল্পের প্রয়োজনেই হোক কিংবা লেখকের লিখার স্টাইলের জন্যেই হোক, গল্পে নাটকীয়তা থাকাটা অনেকে আবশ্যক মনে করে। আবার অনেকে “বাস্তবজীবনে এরকম হয় না” বলে গল্পকে “অতি নাটকীয়” বলে ট্যাগ দিয়ে খালাস করে দেয়। আমার পারসেপশনটা ভিন্ন, আমি ফিকশন রাইটারদের সব ধরণের এক্সপেরিমেন্ট হজম করতে রাজি আছি যদি সে আমারে তার লিখা দিয়ে ধরে রাখতে পারে। ওবায়েদ হক আমার জন্য এইখানে ছক্কা মারছেন।
“বুড়োমানুষ মারা গেলে যে কান্না মঞ্চস্থ হয় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতা, তাতে স্বস্তি থাকে। হাসপাতালের এই দৌড়াদৌড়ি, তোষামুদি, দুর্গন্ধময় জীবন থেকে মুক্তির স্বস্তি। মৃত্যুতে তারা যে স্বস্তি অনুভব করে, তা যাতে নিষ্ঠুর না দেখায় সেজন্য বিভিন্ন সান্ত্বনা দেয় নিজেদের-‘আল্লায় তারে কষ্ট থেইকা বাঁচাইছে’, ‘কেমন দিনটা পাইছে দেখছেন, একদিন পরে শুক্রবার, জুম্মার পর জানাজা পাইবো’, ‘মহরমের চান্দটা পাইছে মাশাল্লাহ’ ইত্যাদি। কর্মক্ষম কেউ বা কোন শিশু মারা গেলে পবিত্র দিন কিংবা মহররমের চাঁদের আর কোন মাহাত্ম্য তাদের মনে পড়ে না।”
মনস্তাত্ত্বিক বই বলতে সবাই ধরে নেয় আলাদা কিছু একটা হবে। হয়তো কোন রেপিস্ট কিংবা কোন সিরিয়াল কিলারের এঙ্গেল থেকে এই মন তাত্ত্বিক গল্পগুলা শুরু হয়। কিন্তু এই বইটা একদমই আমাদের আশেপাশে থাকা খুবই সাদামাটা মানুষগুলার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। বেশ কয়েকটা পছন্দের লাইন আছে। - ‘সারমাসে তিনি যত সালাম পেতেন, তত টাকা মাস শেষে ঘরে আনতে পারতেন না।অঢেল সম্মান আর অভাবের প্রাচুর্য নিয়েই আমরা বড় হয়েছি ’ - ‘সরকারি হাসপাতালের প্রতিটা ওয়ার্ডে যে গন্ধটা আলাদা করে পাওয়া যায় তা হচ্ছে দারিদ্র্যের গন্ধ। অসুখ, ওষুধ, পুঁজ, রক্ত, ঘাম, কান্না, অভাব আর অসহায়ত্ব একসাথে মিশে তৈরি হয় এই গন্ধ।’
বইটা ভয়ংকর সুন্দর। মনে দাগ কেটে ফেলছে দেখে এতো বড় রিভিউ লিখা। আমার মেয়ের বয়সী কুটুর ডাকা “বাবা, বাবা” ভুলতে পারবো না; শশীকে ভুলতে পারবো না; মাহবুব ওরফে দুঃখবোধকে হারায় ফেলা পলাশকে তো ভোলার কোন প্রশ্নই আসে না। খুবই সাবলীল, মারাত্মক রকমের বিষণ্ণ এবং অদ্ভুদ রকমের গভীর মনস্তাত্ত্বিক গল্পের জন্য দুর্দান্ত, অনবদ্য, ম্যাজিকাল ওবায়েদ হকের ১১২ পাতার "জল নেই, পাথর" এর কথা আমি আসলে ভুলতে পারবো না। সবার রুচি এক না, আমার যেটা ভালো লাগবে সেটা আপানর কাছে ভালো নাই লাগতে পারে। কিন্তু এই বইটা হাইলি রিকমেন্ডেড।
বই: জল নেই পাথর লেখক:ওবায়েদ হক উপকথা প্রকাশনী মুদ্রিত মুল্য -২৬৭ বইয়ের শুরুটা আমার বেশ ভালো লেগেছে। কথাটা এমন ছিল যে- "পৃথিবীর সবচেয়ে বিষন্ন জায়গায় বসে আছি আমি।ঠান্ডা, ছিদ্রযুক্ত, নীল ধাতব চেয়ারে উদ্বিগ্ন বিমর্ষ কতগুলো মানুষ বসে আছে। "
এমন একটি জায়গা কোথায় হতে পারে?কথাটি যে বলল তার নাম পলাশ। সে বসে আছে ডাক্তার আজিজুর রহমানের চেম্বারে । আজিজুর রহমান একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ। পলাশের তার কাছে আসার হেতু কি??
আসুন পলাশ সম্পর্কে জানি। একটি সুস্থ স্বাভাবিক মধ্যবিত্তভাবে জীবন যাপন করা ব্যক্তি পলাশ। হঠাৎই রোড এক্সিডেন্টে স্ত্রী এবং কন্যাকে হারায় সে। এরপরই বদলে যায় তার জীবন। তার জীবন এখন আর অন্য পাঁচটা লোকের মত নয়। সে এখন অনুভূতিশূন্য। তার কোন দুঃখবোধ নেই। নেই কোন অনুভূতি। যার দুঃখ নেই তা তো সুখী হওয়ার কথা। কিন্তু পলাশ এই অনুভূতিহীন দুঃখহীন জীবন চায় না। দুঃখ এবং সুখ একে অপরের পরিপূরক। দুঃখ অনুভব করতে পারলে তবেই না সুখ কি তা বুঝতে পারবে। তাই পলাশ তার সমস্যা নিয়ে হাজির হয় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আজিজুর রহমানের কথায় সবকিছু ছেড়ে পলাশ বের হয় দুঃখের সন্ধানে।দুঃখী মানুষদের খোঁজে। এখানে তার সাথে দেখা হয় অনেক চরিত্রের। চরিত্রগুলো ছিল আলাদা আলাদা ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। চরিত্র গুলোর মাঝে থেকে লেখক সমাজ ব্যবস্থার নানান দিক বা সমাজের বিভিন্ন অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন। অনেকটা ফিলোসফিক্যাল ভাবে। গল্পটা মূলত দুঃখে পাথর হয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির জীবনের গল্প। দুঃখের খোঁজে তার এগিয়ে চলার গল্প।
বইটা যখন আমি কিনতে যাই দেখতে পাই বইটি একটি থ্রিলার বই। কিন্তু বইটিকে আমার কোন দিক থেকেই থ্রিলার জনার বলে মনে হয়নি। এটিকে পুরোপুরি সামাজিক উপন্যাস ও বলা যায় না। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক বই। কাহিনীর প্লটটা বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। প্লটটা আমার কাছে নতুন, এমন প্লটের বই আগে আমার কখনো পড়া হয়নি। এমন প্লটের কোন বই সম্পর্কে জানলে আমাকে জানাবেন অবশ্যই। লেখকের লেখনশৈলী গল্পের মধ্যে আটকে থাকতে বাধ্য করেছে। বইটি অত্যন্ত ছোট একটি বই। মাত্র ১১২ পৃষ্ঠার।আগ্রহ ধরে রেখে পড়তে পারলে এক বসায় শেষ ��রা যাবে।কাহিনী যে খুব বেশি টানছে এমন কিছু না তাও আমি আমার আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছিলাম হয়ত সেটা লেখকের লেখনশৈলী এর জন্যই। কেন জানিনা আমি বইয়ের মাঝপথে বইয়ের এন্ডিং টা সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলাম।তাই এন্ডিং টা খুব বেশি আমাকে অবাক করেনি। ব্যক্তিগত রেটিং ৬.৫/১০
বইয়ের বাইন্ডিং এর কথা বলি। আমার কাছে বাইন্ডিং অতটা ভালো লাগেনি। আমার বইটা ধরে পড়তে একটু সমস্যাই হচ্ছিল। ৯৮ পেজে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি আমার বইয়ের বাইন্ডিং খুলে গিয়েছে। it hurts me a lot... কিন্তু প্রচ্ছাদের বিষয় কোন কথা হবে না। ১০০/১০০
আমার দ্বৈত সত্তার যে সত্তাকে আমি জীবনের ডার্ক সাইট বলি। মনে হলো, সে সত্তার অনেকগুলো স্বপ্ন আর গল্প মিলিয়ে 'জল নেই, পাথর'। শুধু মলাট বদ্ধ বই যদি বলি তাহলে ভুল হবে।
এখন পর্যন্ত ওবায়েদ হকের যতগুলো বই পড়েছি, সেগুলোর মধ্যে এটা সবার নিচে থাকবে। ভালো লাগে নি বলছি না, তবে এই বইয়ে ওবায়েদ হকের লেখার যে একটা অন্যরকম ধরণ থাকে, সেটা মিসিং ছিল। মনে হল হুমায়ূন আহমেদ পড়ছি! এই জিনিসটা একদমই ভালো লাগে নি। লেখক হয়তো তাঁর রেগুলার জনরা থেকে বের হয়ে কিছু লিখতে চেয়েছিলেন। একটু টুইস্ট এনেছেন, কিছুটা রহস্য যোগ করেছেন। রেগুলার জনরা বলতে বুঝিয়েছি মানুষের জীবনের সাধারণ, স্বাভাবিক ঘটনাকে চমৎকারভাবে নিজের লেখনীর জাদুতে লেখকের সামনে উপস্থাপন করার বিষয়টাকে। কিন্তু এই বইয়ে সবই কেমন অস্বাভাবিক! গল্পের চরিত্রগুলোর এলোমেলো জীবনের এমন গল্প বহুবার পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে! তাহলে শুধু শুধু ওবায়েদ হক পড়ার দরকার কি?
খুবই সাদামাটা কিছু চরিত্র, গল্প টাও চেনাজানা, আমাদের চারপাশে যা ঘটে নিত্যদিন। চরিত্র বা কাহিনিতে আলাদা কোন বৈচিত্র্য নাই কারণ আহামরি কোন ঘটনা এখানে নাই যেটার জন্য উদ্বিগ্ন বা উৎকণ্ঠা থাকবে, মোটেই তেমনটা নয়। চেনাজানা চরিত্র ও ঘটনা নিয়ে লেখক ওবায়েদ হকের এই বই " জল নেই পাথর"।
কিন্তু চমকটা অন্য খানে, লেখকের লেখনীতে। পলাশ সাহেব ব্যাংকে চাকরি করে। ঘরে তার স্ত্রী কন্যা। প্রচন্ড ব্যস্ততায় তাদের সময় দিতে পারে খুবই কম। এমনই এক পলাশের কাহিনি। তবে এটা কোন কাহিনি নির্ভর লেখা নয়। কাহিনি টা গৌণ। মূখ্য এখানে মানুষের মনস্তত্ত্ব আর লেখকের লেখন শৈলী। উপমা আর শব্দের ব্যবহারে খুবই তুচ্ছ একটা ঘটনা বা বিষয়কে যেনো নাড়া দিয়ে যায়। যা একটা শব্দে বোঝানো যায়। লেখক সেখানে দুই লাইন শব্দের অপচয় করে জিনিটাকে মনে গেঁথে রাখার মত মাধুর্য্যে নিয়ে গেছেন।
লেখকের সব লেখাই ভালো লাগে। এ বইটাও সমান ভালো লাগা ছুঁয়ে গেলো।
বইটার প্রচ্ছদ করেছেন অনন্যা চক্রবর্তী। এর আগে উনার কোন প্রচ্ছদ দেখি নাই, প্রচ্ছদ টা অসম্ভব ভালো লেগেছে। বইটার মতই।
জল নেই পাথরের রিভিউ এ পর্যন্ত যা দেখেছি বা বই সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে মূল গল্পটা মোটামুটি হারিয়েই গেছে বলতে হবে। এমনকি ওবায়েদ হক একটা সাক্ষাৎকারে নিজেই বললেন,"একটা মানুষ দুঃখ পায় না।তাকে একজন পরামর্শ দিলো, তুমি একটা খু'ন করো।" তো মোটামুটি প্রমোশন দেখে এরকমই একটা ধারণা ছিলো যে এটা একটা থ্রিলার আর গল্পটা একজন খু'নীর। কিন্তু বই পড়তে গিয়ে সেই ধারনা পাল্টে গেলো পুরোপুরি। আমার কাছে মনে হয়েছে গল্পটা মনস্তাত্ত্বিক,গল্পটা একটা বাটারফ্লাই এফেক্টের,গল্পটা কিছুটা সামাজিকও।
গল্পের মূল চরিত্র পলাশ সাহেব। একদিন হঠাৎ অফিসে কাজ করতে করতে তার কাছে ফোন আসে তার স্ত্রী আর মেয়ে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। পলাশ সাহেবের সমস্যাটা শুরু হয় তখন থেকে যখন তিনি মেয়ের ডেডবডির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই মূহূর্ত থেকে তার অনুভূতির উর্বর জমিতে পাথর গজালো। তিনি দুঃখ পেতে ভুলে গেলেন। ঘর ভরা মেয়ের ছবি দেখেন,প্রতিদিন পত্রিকায় পড়েন তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পুরোনো খবরটি। কিন্তু কোনো দুঃখ পান না। দুঃখের খোঁজ করতে তিনি নানাখানে গেলেন। হাসপাতালে গেলেন,রাস্তায় নামলেন। কিন্তু তিনি দুঃখ পেতে ভুলেই গেছেন।
মানুষ রাস্তায় বাস করতে শুরু করলে যা হয়, অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়। পলাশ সাহেবেরও তা হলো। কিন্তু গল্প তখন শুরু হলো যখন এক বৃদ্ধ ভালুক ফুটপাতে পলাশ সাহেবের জায়গা দখল করে ঘুমাতে শুরু করলো।
মনস্তাত্ত্বিক দিকটা এই বইয়ের অনেক স্ট্রং। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবিও এত সুন্দর করে পাঠকের মনশ্চক্ষে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যাতে মুগ্ধ হতে হবে। এন্ডিংও চমৎকার। তবে আমার ভয় এন্ডিং কিছু পাঠককে এত বেশী আচ্ছন্ন করে ফেলবে যে তারা পুরো বইয়ের দর্শন কিছুই মনে রাখবে না,মনে রাখবে খালি এন্ডিং। দেখার চোখ দিয়ে দেখলে এই পুরো উপন্যাসে অনেক কিছুই দেখার আছে। যেমন দেখার আছে দুঃখের স্বরুপ। আমাদের চারপাশে অনেক দুঃখ। কিন্তু তারমধ্যে খুব কম দুঃখই আসল দুঃখ। আবার কথক পলাশের ফটোগ্রাফিক মেমোরি থাকার কারণে সে কিছুই ভোলে না,একজন রাস্তার মানুষ হিসেবে তার এই মেমোরির চমৎকার ব্যবহার দেখিয়েছেন লেখক। রাস্তায় আজ যাকে দেখা যাচ্ছে মারপিটে আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করছে,একসপ্তাহ আগেই পলাশ তাকে দেখেছে ছেলেকে স্কুলে দিতে গিয়ে কপালে চুমু খেতে। এই বিষয়গুলোও ভীষণ সুন্দর। এন্ডিংয়ে টুইস্ট আছে। এই টুইস্টের জন্য গল্পকে আমি পাঁচে চার দিলাম। কারণ এই টুইস্ট পুরো গল্পকে অন্যায়ভাবে ছাপিয়ে গেছে।
বাক্যের পদে পদে মাত্রাতিরিক্ত অলঙ্কারের সাথে মৃত হুমায়ূন আহমেদের, নতুন করে জিবন পাওয়া হিমু। প্লাস পয়েন্ট হিসাবে আছে চারপাশে ঘটে চলা অনিয়মে চোখের পাতা টেনে ধরে, সহজ অথচ কটাক্ষের সাথে, চোখকে দেখতে বাধ্য করা। আর শেষে তো একটা মুগ্ধতা থাকছেই, কিন্তু পোয়েটিক জাস্টিস জিনিসটা থাকলে আরও ভালো লাগতো।
“একটা খুনের চিন্তা মাথায় নিয়ে আমি শহরের রাস্তায় হাঁটছি। ভাবছি, যে মৃত্যু কামনা করছে তাকে মারলে সেটা খুন হবে নাকি উপকার করা হবে?”
ত্রি-চরণে স্মরি : জল নেই, পাথর
দুদিনের এই জাগতিক আয়োজনে ‘কাছের মানুষ’ টিকে থাকার মূল অবলম্বন। হাতেগোনা সেই কয়েকজন হারিয়ে গেলে কিংবা দূরে ম্লান হয়ে গেলে বাকি সব তুচ্ছ হয়ে আসে। তুচ্ছতার আবহ মনে আনে ‘ডোন্ট কেয়ার ভাব’, কাউকে পরোয়া না-করে নিজেকে স্বাধীন (না কি উচ্ছন্ন) করে কখনও, না কি তা কখনও ‘হাহাকার’ হয়ে ফিরে আসতে পারে, কিংবা দুঃখের পারদ ওপরে চড়াতে প্রত্যাবর্তন করে!
নিজের ভিতরের অনুভূতি শূন্যতাকে দূর করার সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে একটি খুন করতে চায় পলাশ। তেমন একজন মানুষও পেয়ে গিয়েছে সে। যে স্বেচ্ছায় তার হাতেই মরতে চায়। কিন্তু পলাশের মাঝে অনুভূতির অভাব কী কারনে তৈরী হলো? কেনোই বা ওই মানুষটা মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে? আমাদের নিয়তি গড়ে দিচ্ছে কে আড়াল থেকে? এমন সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে পড়তে হবে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লেখক ওবায়েদ হকের জল নেই, পাথর বইটি।
মানুষ মাত্রই নাকী দুঃখবিলাসী। সে সকল সুখের মাঝেও নাকী দুঃখকে খুঁজে নিতে জানে। যুগে যুগে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার এই কথাটা বলেছেন। আমি নিজেও কথাটার সাথে একমত। তবে আমাদের এই গল্পের মূখ্য চরিত্রের সমস্যাটা ভিন্ন। বেচারা কোনভাবেই দুঃখ অনুভব করতে পারে না। দুঃখকে খোঁজার নিমিত্তে শুরু হয় তার যাত্রা আর বইটার সাথে পাঠকের যাত্রাও শুরু এখান থেকেই।
লেখকের প্রতি মুগ্ধতা
ওবায়েদ হকের বই মানে প্রথমেই একগাদা স্তুতিবাক্য লিখতে হবে উনার গদ্যশৈলী, শব্দচয়ন, বাক্য গঠন আর উপমার ব্যবহার নিয়ে। উনার বইয়ে একটা গল্প থাকে, তবে সে গল্পটা পাঠকের মনকে আন্দোলিত করে এই দারুণ লিখনশৈলীর দরুণ। অল্প কথায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দেবার অদ্ভুত এক ক্ষমতা রয়েছে ভদ্রলোকের। এই ক্ষমতাটা আমাদের দেশের খুব কম লেখকের রয়েছে। এই বইটাতেও যথারীতি দারুণ কিছু বাক্য আর উপমা ব্যবহার করেছেন তিনি। যা পড়ার পর কিছুক্ষণ থেমে যেতে হয়; এত সুন্দর করেও কেউ লিখতে পারে! বইয়ের বেশ কিছু জায়গায় চরিত্রের মুখে ইংরেজিতে সংলাপ বসিয়েছেন লেখক। নরমালি আমার এটা পছন্দের না, কিন্তু এখানে চরিত্রগুলোকে এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে, তাদের মুখে তা একদম মানিয়ে গিয়েছে।
বিষন্নতার গল্প
এবার আসি গল্পে। এই গল্পটার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে বিষন্নতা। পাঠক তা অনুভব করলেও, গল্পের মূল চরিত্র সেটা অনুভব করতে পারে না। সে মানসিক রোগের ডাক্তার থেকে শুরু করে, হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগ কিংবা রাস্তার মানুষদের মাঝেও দুঃখ খুঁজে নিতে চেয়েছে। কিন্তু পায়নি কোথাও। অনুভূতিহীন এই মানুষটার কিছু কর্মকান্ড পড়ে অবশ্য হিমুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। তবে হিমু থেকে পলাশ (কিংবা মাহাবুব) বেশ অনেকটাই ভিন্ন। হিমুর মত স্থুল রসিকতা সে করে না। তবে ফটোগ্রাফিক মেমোরি এবং দারুণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার দরুণ তার আশেপাশের চরিত্রদের চমকে দেয় ভয়ানকভাবে। সে নিস্পৃহ, তবে সেটা নিজ ইচ্ছায় নয়। নিজের মাঝে অনুভূতিকে ফিরে পেতে চায় বারবার। যে ঘটনার কারনে তার ভিতরে এই নিস্পৃহতা জন্ম নিয়েছে তা যথেষ্টই করুণ। তবে তার নিজের রোবটিক অনুভূতির কারনে পাঠকের মাঝে সে ঘটনা খুব একটা আবেগের জন্ম দিতে পারে না। নিজেকে পলাশের জায়গায় দাঁড় করালেই একমাত্র সেই ধাক্কা কিছুটা অনুভব করা সম্ভব।
পলাশকে ঘিরে বইয়ে অল্প কিছু চরিত্র এসেছে। যার মাঝে নয়ন কিংবা শশী ছাড়া বাকীদের তেমন কোন ইমপ্যাক্ট নেই গল্পে। এই শশী এবং সেই অদ্ভুতুরে বুড়ো চরিত্রকে দিয়েই একটা বাটারফ্লাই ইফেক্ট ধরণের গল্প সাজিয়েছেন লেখক। আপাতদৃষ্টিতে বইয়ের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘটনাগুলো যেভাবে শেষে এসে এক জায়গায় জুড়ে দিয়েছেন, তা আসলে একটা টুইস্ট আকারে এসেছে বলা যায়। ব্যাপারটা সুন্দর এবং ভালো লেগেছে। এছাড়াও শশীর ব্যাকস্টোরিও ভালো ছিল। মোটাদাগে এটা মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার বই। যার সবটা জুড়েই রয়েছে দুঃখের নীল ছোঁয়া।
অদ্ভুত সমাপ্তি
লেখকের নীল পাহাড় পড়ে মুগ্ধতার আবেশে যেভাবে বিভোর হয়েছিলাম, এই বইটা সেভাবে ততটা বিমোহিত করতে পারেনি আমাকে। তবে নিঃসন্দেহে বইটা অবশ্যই চমৎকার একটা বই। শেষে লেখক একদম ওপেন একটা এন্ডিং দিয়ে রেখেছেন। সেই এন্ডিংটা আমি আমার মত করে সাজিয়ে নিলেও, খুব জানতে ইচ্ছে করে লেখকের মনে কী ছিল?
ব্যক্তিগত রেটিং: ০৮/১০ ( ওবায়েদ হক এমন একজন লেখক যার প্রতিটা বই পড়েই ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হওয়া সম্ভব। সে ভালো লাগার পরিমান কম বেশ হতে পারে; কিন্তু ভালো যে লাগবেই এটা মোটামুটি নিশ্চিত )
প্রোডাকশন: উপকথার প্রোডাকশন যথেষ্ট ভালো হয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। এছাড়াও পিচ্চি এই বইটার আনুষঙ্গিক অন্যান্য দিকেও প্রোডাকশন সুন্দর। বানান ভুল কিংবা বাক্যে অসঙ্গতি চোখে পড়েনি তেমন একটা। তবে বইয়ের দামটা এমন মাঝামাঝি করে কেন রাখা হলো সেটা খুব জানতে ইচ্ছে করছে অবশ্য।
গল্পের প্রটাগনিস্ট পলাশের সবকিছু ভালো লেগেছে। যেন ঢাকা শহরের অলি-গলি থেকে তুলে আনা সব ঘটনা আর চরিত্র। তবে শশীর মায়ের ব্যাপারটা অতিনাটকীয়।
রাস্তার বুড়ো পাগল মুরাকামির 'কাফকা অন দ্য শোর' উপন্যাসের চরিত্র জনি ওয়াকার হয়ে বাঁচতে চায়; যাকে কিছু উন্নাসিক বইপোকার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যারা কিনা নিজের ফ্যান্টাসি চরিতার্থ করার জন্য অন্যের ক্ষতিসাধন করতে দ্বিধা করেনা।
সবমিলিয়ে ভালো ছিল তবে কিছু অতিনাটকীয় ব্যাপারের জন্য ইচ্ছের তারা দিতে পারলাম না।
পলাশ নামক ব্যাংকে কর্মরত এক ব্যক্তি হঠাৎ করেই একদিন অফিসে থাকতে খবর পায় তার স্ত্রী আর সন্তান সড়ক দুর্ঘটনায় পটল তুলেছে। একজন মধ্যবিত্ত দশটা থেকে পাঁচটা অফিস করা লোকের কাছে তার গোটা সংসার একদিনের নোটিশে তছনছ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা হজম করতে যতটা কষ্ট হওয়ার কথা আশ্চর্যজনক ভাবে ততটা কষ্ট না হওয়ায় পলাশ বিপন্ন বোধ করে। সে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হলে ভদ্রলোক তাকে পরামর্শ দেয় হাসপাতালে ঘুরাঘুরি করার জন্যে। রোগ,অসহায়ত্ব, দারিদ্র্য, শোক খুব কাছ থেকে দেখলে যদি তার দুঃখবোধ টা আবার ফিরে আসে।পলাশ হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বেড়ায় দুঃখ খোঁজার জন্যে... কিন্তু এত স্বাভাবিক এবং নিত্যনৈমিত্তিক একটা মানবিক আবেগ কি এত সহজে তাকে ধরা দিবে?
গল্পের কথা বলবার আগে একটু প্রচ্ছদশিল্পীর প্রশংসা করে নিই। যিনি এই বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন তার কাজ চমৎকার। বারবার মুগ্ধ হয়ে আমি বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম যতোক্ষণ হাতে ছিলো।
গল্পটা একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ব্যক্তিকে নিয়ে, যার ছোট্ট ছিমছাম একটা সংসার থাকে। যিনি স্ত্রী এবং কন্যা নিয়ে শহরের বুকে বসবাস করেন আর পাচটা মানুষের মতোন। এমন মানুষ রোজ আমাদের পাশ দিয়ে অফিসে লেট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে উর্ধশ্বাসে ছুটে যায় বাস ধরতে, বাড়ি ফেরে সন্তানের জন্য খেলনা কিংবা চকলেট কিনে। নিজের জীবন এবং পরিবার ছাড়া কারও সাতে পাচে না থাকা সাদামাটা চাকুরিজীবী, যার জীবনে চাকরির প্রমোশন, সন্তানের পড়াশোনা ভবিষ্যৎ ছাড়া তেমন কিছুই গুরুত্ব বহন করে না।
পলাশ নামক এমন আপাতদৃষ্টিতে বৈশিষ্ট্যহীন লোকটি হঠাৎ টের পায় তারমধ্যে কোনো দুঃখবোধ কাজ করছে না। দুঃখবোধ থাক, তার ভেতরে কোনো অনুভূতিই ঠিক সাড়া জাগাতে পারছে না। জঞ্জালের এই ব্যস্ত শহরে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে থাকা এক অনুভূতিশুন্য মানুষের গল্প 'জল নেই, পাথর'।
লেখকের আগের দু'টো বই পড়া হয়েছিলো এবং বলাবাহুল্য যে বেশ ভালোও লেগেছিলো যার মূল কারণ তার লেখনশৈলী। তবে এই বইখানা পড়ে মনে হলো লেখকের এই বইটি আগের লেখাগুলোকে অনেকটা ছাপিয়ে গেছে। লেখনীর পাশাপাশি গল্পও বেশ অন্যরকম। অনেকদিন বাদে ভিন্ন স্বাদের কিছু পড়া হলো। যা আশা করিনি, তা দিয়েই বইয়ের ইতি টেনেছেন তিনি।এবং আলাদা করে বলতে নেই, বইয়ের লেখনী চমৎকার যার ভক্ত আমি বরাবর।