লেখকের ভালো নাম তপু রহমান। তার মানে এই না যে উদাস খারাপ নাম। চরম উদাস আসল নামের চেয়েও বেশি ভালো, বেশি আসল নাম। এক দশক পূর্বে অন্যদিন, সাপ্তাহিক ২০০০ থেকে শুরু করে নানা পত্রপত্রিকায় লেখকের ছোট গল্প, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। গল্প লিখে সোনা পেয়েছেন (আট ভরি) একথা লেখক গর্ব করে বলে বেড়াতে পছন্দ করেন। যদিও বাল্যকালের সেইসব গল্পগুলিকে মাটিচাপা দিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন লেখা ছোত গল্প নিয়ে চ্যানেল আইতে মর্মান্তিক একখানা প্রেমের নাটকও তৈরি হয়েছে সেই কথা মনে করে লেখক লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চান।
লেখক হিসেবে মূল পরিচিতি সচলায়তন ব্লগে লেখালেখি করে। মাঝখানে টানা আট নয় বছর আলসেমির কারণে লেখক কোন কিছু না লিখে চরম উদাস হয়ে দিন কাটিয়েছেন। তারপর হঠাৎ একদিন সচলায়তনে রম্যরচনা 'জগাখিচুড়ি' দিয়ে চরম উদাস নামে নতুন করে লেখক পুনর্জন্মের শুরু। একে একে এরপরে 'জগাখিচুড়ি' ও 'এসো নিজে করি' সিরিজ হিসেবে লিখে রম্যের ফাঁকে ফাঁকে সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেছেন। লিখছেন স্যাটায়ারধর্মী নানা ছোটগল্প।
সচলায়তন ব্লগে প্রায় সময় 'চরম উদাস'-এর লেখা পড়ি। দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা ও বিদ্যমান অসঙ্গতিকে টার্গেট করে ব্যাঙ্গ রসাত্মক ভাষায় যে সিরিয়াস মেসেজ দেন তা একদম মহাকাব্যিক। কোনো দল বা সংস্থা বা কোনো মতবাদের বিপক্ষে কথা বলতে উনার কলমে বাধে না। কিছু কিছু লেখায় যদিও উনাকে উদ্ধত মনে হয় কিন্তু তারপরেও কোনো দল ও মতকে না পুছার এবং নিজের আইডিওলজিতে অটল থাকার জন্য উনাকে অন্য লেভেলের বলে মূল্যায়ন করি।
'লাইনে আসুন' বইটিতেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গল্পের সমাহার এই বইটি। ২/৩ পৃষ্ঠায় একটি গল্প সমাপ্ত। ২/৩ পৃষ্ঠাতেই সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা সমাজে বসবাস করা ছাগুপাগুলে রূপক অর্থে জুতাপেটা করা হয়। এই দিকটা বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু একটু সমস্যা আছে। গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল অনলাইন ব্লগ সচলায়তনে। যখন তিনি গল্পগুলো সেখানে প্রকাশ করেছিলেন তখনকার 'সাম্প্রতিক' ঘটনাকে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন। তাই সেই পটভূমির পাঠকের জন্য তা শতভাগ বোধগম্য ছিল। কিন্তু আজকে অনেকদিন পরে সেসব গল্পের প্রেক্ষিত অনেকের কাছেই অজানা। তাই কিছু কিছু গল্প দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। সেজন্য ভালো এই বইটি আমার কাছে নাম্বারিংয়ের দিক থেকে পিছিয়ে রইল।
এক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে গল্পের শেষে পুনশ্চ বা নোট হিসেবে ২/১ লাইনের একটি প্যারা যোগ করে দিতে পারতো। কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে সে গল্প লেখা হয়েছে তা থাকতো ঐ প্যারায়। লেখকের আরেকটি বই 'এসো নিজে করি' পড়ছি। তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো লাগছে এটি। আমার ধারণা নাম্বারের দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে এটি।
কয়েকটা গল্পের বিশেষণে 'অসাধারণ' শব্দটি ব্যবহার না করে উপায় নেই। আর কয়েকটা লেখা ঠিক গল্প হয় নি, ব্লগ হিসেবেই ওগুলো ভালো চলে। সব মিলিয়ে ভালো ছিল। মাঝে মাঝে এমন কিছু তামাশা ছিল যে সেগুলো মনে পড়লে সময়ে অসময়ে যেকোনো সময়ে খুব হাসবো।
আপনি যদি already লাইনে থাকেন, তবে গল্পগুলো পড়ে দারুণ লাগবে। আর লাইনে না থাকলে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে বলা মুশকিল। হয়তো খুব রেগে গিয়ে বই দেয়ালে ছুড়ে মারবেন। তবে স্যাটায়ারের স্বাদ নেয়ার মতো সামর্থ্য থাকলে ঠিকই আনন্দ পাবেন। আর এ বই ভালো লাগলে তো বার বার পড়বেন, এটা নিশ্চিত। কারণ গল্পগুলো লাইট রিডিং এর জন্য পার্ফেক্ট, পড়ে যেমন মজা পাওয়া যায় তেমনই খুব সহজে ভুলে ফেলাও যায়। তাই বেলাইনেও যদি থাকেন সমস্যা নেই। গল্পগুলো বারবার পড়তে পড়তে ঠিকই একসময় লাইনে চলে আসবেন।
"ওর সেই লেখাটা নিয়েই কথা বলছিল সবাই। আমার কাছে ওর কথাগুলাে বেশ পছন্দ হয়েছিল। অন্ধ আবেগ কারও কোন কাজে আসে না। ৪২ বছরের শুকিয়ে যাওয়া ঘা জোর করে আবার খােচানাের মানে নেই। অন্য সবাই একই রকম কথা বলছিল। দুই-একজন কিছু কিছু জায়গায় একমত হল না। তবে সবাই বেশ যুক্তি দিয়ে আলােচনাই করছিল। এর মধ্যে রায়হান এসে বাজে কথা বলা শুরু করল। সালেহ ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল। বলে, দেখ রায়হান আমি তােমার আবেগ বুঝি। কিন্তু ডিভাইড অ্যান্ড রুল হচ্ছে শত বছরের পুরনাে ব্রিটিশ রেসিপি। এই ফর্মুলা আর কতদিন? ৪২ বছরের আগের ঘটনা যতটা রেলেভেন্ট তার চেয়ে অনেক বেশি রেলেভেন্ট কিভাবে সামনে আগানাে যায়।
এক-দুই কথার পরেই রায়হান টেম্পার লুজ করে বসলাে। চিৎকার করে বলে,
—আমার মাকে কেউ রেপ করলে সেইটা ৪২ না ৪২ হাজার বছর পরেও আমার কাছে রেলেভেন্ট, তুই তাের রেপ হওয়া মায়ের মাথায় হাত বুলায়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলিস, আম্মা ভুলে যান এসব। আমি বলব না। আমার মত লক্ষ-কোটি মানুষ এখনাে আছে এই দেশে। শালা বেঈমানের বাচ্চা, শালা মাদারচোদ। তাের মায়েরে গিয়া তুই বল, আম্মা ভুলে যান। আমি বলব না। মরে গেলেও না।"
লেখক সম্ভবত অধিকাংশ লেখা 'সচলায়তন' ব্লগে লিখেছিলেন। নিদারুণ পোংটা তথাপি 'ছেঞ্চেতিব' সব লেখা, পড়ে যদি এটাকড ফিল করার কারণ না পান তবে ঘর কাঁপায়ে হাসতে পারবেন। বিবিধ কন্টেক্সট-কে স্যাটায়ারের বেশে ভীষণ আছোলা আক্রমণ করেছেন লেখক। অল্প কিছু গল্পের ক্ষেত্রে কনটেক্সট বুঝতে পারিনি, তাই ভালো লাগেনি।
এমন কনটেক্সচুয়াল হিউমার পড়তে পাওয়া বিরল। পড়েন।
[ অনেক ক্ষেত্রে লেখক আর আপনি সেইম 'লাইনে' না থাকতে পারেন। বই ছুঁড়ে-টুরে মাইরেন না দেইখেন। ]
একটানে পড়লাম ; কী লিখা!!! রসবোধ চরম। অনেক দিন পরে একটা বই পড়লাম ; সেই রকম কিছু ডায়লগ নিয়ে; স্বলেহন,লছাগু-গছাগু, বানরের গল্প , কনে দেখা অন্ধকার অসাধারণ আরো ভালো লাগসে , এক ভাইজান যেইভাবে , স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখে গেছেন কয়েক লেয়ারে ......।।আবার ফিরে এসেও স্বপ্নের মধ্যেই আছেন
****মা বিষয়ক গল্প গুলো একবার ডুবাইসে একবার ভাসাইসে; এরপর একদম ধুইয়া দিসে
ভীষণ উইটি সম্পন্ন লেখক চরম উদাসের প্রথম প্রকাশিত বই। এতে মোট ২২টা গল্প/লেখা রয়েছে। অযথা স্হূলতা এড়িয়ে লেখক যদি তাঁর কীবোর্ড/কলম সচল রাখেন তবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একজন শক্তিমান (রম্য) লেখক পাবে এতে কোন সন্দেহ নাই।
বইটা পড়েছি অনেক সময় নি���়ে, ধীরেধীরে। একেকটা গল্প পড়ে সেটা প্রসেস হতে সময় লেগেছে অনেক। হাসতে হাসতে মন খারাপের বিষয়টার সাথে লেখক বেশ কৌশলে পরিচয় করিয়ে দিলেন���
অসাধারন রসবোধ এবং ঝরঝরে লেখা। কিন্তু ৯০ শতাংশ গল্প সেই একই বিষয়বস্তুর উপর এবং একই মর্মার্থের। অন্যান্য বিষয়বস্তু নিয়ে আরো লেখা বেশি থাকলে একতারা বেশি দেওয়া যেত।
রকমারির উইশ লিস্টে অনেকদিন ধরেই 'লাইনে আসুন' আর 'এসো নিজে করি' বই দুইটা উঁকিঝুঁকি মারছিলো। মংগাপীড়িত বিকাশ একাউন্ট নিয়া বারবার ঐ পেজটা রিফ্রেশ করা ছাড়া উপায় ছিল না। আব্বা যেদিন কিছু ট্যাকা দেয়, মুখ দিয়া আব্বার দীর্ঘহায়াত কামনা করছিলাম আর হাত দিয়া দৌড়ের উপরে বইদুটা অর্ডার দি। দুদিন পরে সুন্দরমত বই দুটা হাতে পাই। আহ কি যে সুখ!!
মহাসুখে জর্জরিত আমি বন্ধু স্বাধীনের বারবার বাঁধার পরেও এক বসায় দুটা বই শেষ করে ফেলি। এরপর মনে হতে থাকে আহ কি যে হারিয়ে ফেললাম, আমার ৩২৬ টাকা বুঝি শেষ। যাই হোক দিনশেষে পয়সা উশুল করার মত বই। অনেক হল বিহাইন্ড দ্যা গল্প, এবার আসি সিরিয়াস কথায়।
লেখকের নাম চরম উদাস। বাংলা ব্লগে যাদের আনাগোনা, তাদের কাছে খুব পরিচিত একটা নাম। আমার কাছে পরিচিত সুড়সুড়ি দেওয়ার গুরু হিসেবে। এই ভদ্র লোক এমন একটা পাবলিক, যে আপনাকে কাতুকুতু দিয়া নাচাবে, আপনি হাঁপিয়ে উঠবেন, সে আরো বাড়িয়ে দিবে এর মাত্রা। লাইনে আসুন এমন একটা বই।
সাহিত্যের সোজা লাইন থেকে বেরিয়ে লেখক সবাইকে আহব্বান করেছেন লাইনে আসতে। ছোট্ট ছোট্ট গল্পে এই টইটুম্বুর এই বই পাঠককে হাসাতে হাসাতে জানান দিবে সমাজের নানা জরুরী ইস্যুর। পুরো লেখা জুড়ে লেখক তার সারকাজম লেভেলকে নিয়ে অন্য এক উচ্চতায়। রোজা রেখে পড়তে গিয়ে আমার অবস্থা কাহিল, ইফতারে দু গ্লাস বেশি পানি খেতে হয়েছিল।
"কোমল সাহিত্য মেশিন" নামক একটা গল্পে লেখক পরিচিত করান এমন একটা মেশিনের যেটার কাজ সব কঠিন লেখাকে সহজ করে ছাপিয়ে দেয়। যেসব লেখা অনুভূতিতে আঘাত করে, ঐ মেশিন সেগুলোকে ঠিক করে দেয়। তো একবার হুমায়ুন আহমদের লেখার পরিবর্তে আজাদের লেখা ইনপুট দিয়া দিলে মেশিন বিরাট শব্দ করে শুধু ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।
তখন মেশিনম্যান মফিদুল বলেন, "স্যার... আমি হুমায়ুন স্যারের লেখাটা ইনপুট দিতে বলছি, গাড়লটা আহমেদের লেখা না দিয়ে আজাদের লেখা ইনপুটে দিছে। আমাদের মেশিন এইরকম হার্ডকোর লেখার জন্য এখনো রেডি না। আর মেশিনের কি দোষ, ওই লেখা পড়লে মানুষের পেছন দিয়াই ধুমা বাইর হয় আর মেশিন তো কোন ছার"
আরেকটা গল্পে সাংবাদিকদের জ্বালায় অতিষ্ট নেতা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে। মরি মরি করেও মরছে না। এইদিকে প্যাকেজ রেডি। সবাই ভাবছে এই বুঝি গেল, কিন্তু না নেতা আর মরে না। তখন এক সাংবাদিক জিজ্ঞাস করে, "স্যার এবারো বেঁচে গেলেন?" তখন নেতা বলেন, "হরে সব সঙবাদিক মরার আগে মরবা না মনে হয়।"
তিক্ত কথা হলেও কাউকে আঘাত কর বলা যাবেনা, সুশীলিও ভাষা ছাড়া লেখা যাবে না। লেখক এসব সিস্টেম থেকে বের হয়ে অসাধারণ একটা সংকলন তৈরি করেছেন। তবে গায়ের চামড়া হালকা হলে, এই বই থেকে দূরে থাকুন।
ব্লগে চরম উদাসের টুকটাক লেখা পড়তাম। বই বেরুচ্ছে শোনার পর থেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি কখন বইটা হাতে পাবো। অবশেষে এক বড় আপুর বদৌলতে বইটা পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই।
এককথায় চরম উপভোগ্য একটা বই, এক নিঃশ্বাসে শেষ করে উঠার মত। লেখকের রসবোধ চরম, মানুষ হাসাতে পারেন। হাসাতে হাসাতে হাসানোর মাঝখানে আবার মনও খারাপ করিয়ে দিতে পারেন। নতুন এঙ্গেলে ভাবার সুযোগ করে দিতে পারেন, আবার অনেক অসঙ্গতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিতে পারেন।
বইটি সম্পর্কে শুধু এটাই বলব, বইটি কিনে পড়লে টাকা এবং সময় কোনটাই লস হবে না।
চরম উদাসের লেখনীর সাথে পরিচয় সচলায়তন এ। স্যাটায়ার আর বাট কমেডির মধ্য দিয়ে নিদারুণ খোচা দিয়ে জান তিনি আমাদের নাগরিক মননের সভ্যতার পোষাকে। আমার কথা আগের মতই জাহাপনা তুসি গ্রেট হো, ওনা