যে-বুদ্ধিজীবী জনগণের কাছে প্রিয়, তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। জনগণকে মুগ্ধ করা, জনগণের সমীহ আদায় করা, এগুলো বুদ্ধিজীবীর কাজ নয়। এগুলো যাদুকর, পীর-দরবেশ, ও পুঁথিজীবীর কাজ। এ দেশে দুই ধরনের লোককে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। এক- যিনি জনগণের মগজ খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। দুই- জনগণ যার মগজ খেয়ে সুখনিদ্রা যায়। কিন্তু যিনি মগজ সৃষ্টি করেন, নষ্ট মগজ মেরামত করেন, বা সমাজের ময়লায় ঢেলে দেন অবলীলায় সাবান, তাকে এ অঞ্চলে বুদ্ধিজীবী ডাকা হয় না। বুদ্ধিজীবী এখানে তিনি, যিনি জনগণ যা শুনতে চায় তা শোনাতে পারেন। জনগণ যা দেখতে চায়, তা দেখাতে পারেন। যা বললে জনগণের ঘুম ভেঙে যায়, যা উচ্চারণ করলে কেঁপে ওঠে স্থিতাবস্থা, তা মুখে আনা থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিজীবীতা। অর্থাৎ জনতা মনে করে - বুদ্ধিজীবী একপ্রকার ঘুমের বড়ি, যার কাজ সারাক্ষণ নির্বোধদের মাথায় পালক বুলিয়ে দেয়া।
' মূর্খকে জ্ঞান দেওয়া যায়। কিন্তু মূর্খ হয়েও যিনি জ্ঞানীর ভান ধরেন, তাকে জ্ঞান দেওয়া যায় না। ' - মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
ফেসবুক সেলিব্রিটিদের আমি সব সময় সন্দেহের চোখে দেখি। সৎ ও চিন্তাশীল প্রমাণের হওয়ার আগপর্যন্ত তাদেরকে আমি ঢালাওভাবে লোকরঞ্জনবাদী ও ধান্দাবাজ কিসিমের আদমি জ্ঞান করি। এক্ষেত্রে মহিউদ্দিন মোহাম্মদকে কোন কাতারে ফেলা যায় তা নিয়ে খানিকটা চিন্তাগ্রস্ত। তিনি লোকরঞ্জনবাদী নন ; হুমায়ুন আজাদের মতো প্রথানুগ চিন্তাকে তিনি নস্যাৎ করতে ভালোবাসেন। বিতর্কিত মন্তব্য করে থাকতে চান কিংবা থাকেন আলোচনায়। যা হয়তো এক ধরনের লোকরঞ্জনবাদ। তবুও মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলাদা। তাকে পছন্দ করা যায় ; অপছন্দ করার মতো কাজ তিনি কম করেন না। অথচ তাকে বাতিল করে দেওয়া কঠিন। এখানেই মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বাকিদের চাইতে যোজন যোজন আলাদা।
'মূর্তিভাঙা প্রকল্প' বইতে তিনি সত্যিকারের মূর্তি ভাঙতে উৎসাহ দেননি। বরং বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধকে বন্ধক দিয়ে ভক্তিবাদে নিমজ্জিত জাতিকে চিন্তাশীল হতে বলেছেন। ধর্মের সত্যের ওপরে প্রাধান্য দিয়েছেন বিজ্ঞানের সত্যকে। আর, নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিপরীত মতকে নির্দয়ভাবে আক্রমণ করেছেন। অথচ তিনি নিজেই নিরুৎসাহিত করেছেন ভিন্নমতকে উগ্রভাবে শায়েস্তা করতে। এ-ও এক ধরনের বিচ্যুতি বটে। যেমন: কুরবানি নিয়ে খামোখা বিতর্ক তৈরি করেছেন।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা পড়তে ভালো লাগে। তিনি গণ্ডির বাইরে ভাবতে উৎসাহ দেন। যদিও তার সকল যুক্তি আদরণীয় নয় ; তবুও 'মূর্তিভাঙা প্রকল্প' পড়ে দেখতে পারেন। হ্যাঁ, লেখক নিজে লিখেছেন পাঠ তিন ধরনের। যথা- এক. রিডিং অর্থাৎ লেখক যা বলতে চেয়েছেন তা ঠিকভাবে বুঝতে পারা, দুই. মিসরিডিং মানে ভুল অর্থ বের করা এবং তিন. ইল-রিডিং তথা স্ব-ইচ্ছায় বদ নিয়তে টেক্সটের একেবারেই অন্য অর্থ খুঁজে বের করা। বইটি 'রিড' করলে অনেক কিছুই ভাবনার খোরাক দেবে। তবে, ইল-রিডিং করলে লেখকের ওপর খাপ্পা হওয়া সুযোগ রয়েছে।
'আধুনিক গরু রচনাসমগ্র' নিঃসন্দেহে এই বইয়ের চাইতে ভালো। কেউ যদি মহিউদ্দিন মোহাম্মদের একটাই বই পড়তে চান তাহলে 'আধুনিক গরু রচনাসমগ্র' পড়ুন। লেখকের চিন্তার মূল নির্যাস বইটিতে রয়েছে। 'মূর্তিভাঙা প্রকল্প' মন্দ নয়। তবে, প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা পড়তে ভালো লাগে। খানিকটা স্যাটায়ার, খানিকটা সমাজের শ্যাটা ভেঙ্গে করা প্রশ্ন কিংবা কোনো একটা বিশ্লেষণ, আর বাঙালিকে জায়গামতো খোঁচা মারা; বেশ ভালোই লাগে পড়তে।
"পড়া তিন প্রকার। রিডিং, মিসরিডিং, ও ইল-রিডিং। রিডিং মানে স্বাভাবিক পাঠ। লেখক যা বলতে চেয়েছেন, তা অবিকল সেই অর্থে অনুধাবন করা। মিসরিডিং হলো ভুল পাঠ, যেখানে পাঠক অথবা লেখক, যেকোনো একজনের, অথবা উভয় জনের, ভাষা ও বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে ভুলভাবে কোনো লেখার পাঠোদ্ধার হয়। কিন্তু ইল-রিডিং হলো কূটপাঠ, যেখানে পাঠক ভালোভাবেই জানেন লেখক কী বলতে চেয়েছেন, তবুও নিজ স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে লেখাটির ভুল অর্থ সমাজে প্রচার করেন। মানুষকে ইল-রিডার বা কূটপাঠক হতে সাবধান হতে হবে।"
-মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ সঙ্গত কারণেই বর্তমানে বইপড়ায় আলোচিত-সমালোচিত-চর্চিত এক নাম। লেখকের গদ্যভাষা মসৃণ। নন-ফিকশন অনেকটা গল্প বলার ভঙ্গিমায় বলেন। তারপরও যেকোন লেখালেখি বিষয়টার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। চিন্তা, ভাব, দর্শন যখন মানবমস্তিষ্ক থেকে বাক্যবন্ধনীতে চলে আসে তখন যোগাযোগের সমস্যা তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় মিসকমিউনিক্যাশনের।
এ কারণেই পড়া আমার মতে চার প্রকার। লেখকের তিন প্রকার + ক্লোজ রিডিং। অনেক সময় ক্লোজ রিডিং এর পরও লেখক যা বুঝাতে চেয়েছেন পাঠক পর্যন্ত তা পৌছে না। চিন্তাকে ভাষায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে সমস্যাটি আজকের নয়। সমস্যাটির যথাসাধ্য সমাধাকল্পে তাই ক্লোজ রিডিং গুরুত্বপূর্ণ।
'মূর্তিভাঙা ( নাকি মূর্তিভাঙ্গা? ) প্রকল্প' চারটি অংশে লিখা। প্রথা-প্রবচন বিরোধী লেখক মহিউদ্দিন তাঁর রচিত গ্রন্থে যথারীতি মানুষের মধ্যকার যে প্রচলিত অকার্যকর এবং সেই মানুষজনের জন্যই সমস্যাজনক বিভিন্ন নিত্যনৈমিত্তিক আচার-আচরণ, রাজনীতি, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন নিয়ে যেরূপ বিশালাকার কনফার্মেশন বায়াস কিংবা নিজেকে অভ্রান্ত ভাবার অতি প্রাচীন প্রবণতার সমালোচনা করেছেন। কখনো দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন আবার কখনো পাঠককে পারস্যু করার প্রচেষ্টাও মহিউদ্দিনের লেখনিতে রয়েছে।
মানুষ যা দেখতে চায় তা-ই দেখে। যা শুনতে চায় তা-ই শুনে। কোন মানুষের সারাজীবনের চিন্তার যোগফলই সেই মানুষটি। বেশ কয়েক বছর আগে রল্ফ দোবেলির 'দ্য আর্ট অফ থিঙ্কিং ক্লিয়ারলি' পড়ার সময় জানতে পেরেছিলাম যে মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়াটি ত্রুটিপূর্ণ। বিভিন্ন শারিরীক সীমাবদ্ধতার কারণে জীবন ও জগতকে পারসিভ করতে মানুষ পুরোপুরি সক্ষম হয়ে উঠতে পারে না। এই বইয়েও এরকম আলাপ আছে।
'মূর্তিভাঙা প্রকল্প'এর আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে 'দর্শন কী?' অধ্যায়। ইয়াং জেনারেশনের অনেকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করি এটিকে। প্রাঞ্জল ভাষায় লেখক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করেছেন পুরো বই জুড়েই।
লোকরঞ্জনবাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে মহিউদ্দিন মোহাম্মদকে লেখক হিসেবে আমার দরকারি মনে হয়। আবার একই সাথে তাঁর জনপ্রিয়তা দেখে একটু মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করে একজন অবজার্ভার এর দিক থেকে। প্রথাবিরোধীতা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেটির ফলাফল কোনদিকে যায় বলা মুশকিল। অনেক সময় প্রথা / প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা হয়ে ওঠে প্রথা / প্রতিষ্ঠানে।
তাই ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, ( যদিও আমার একথা বেশিরভাগ পাত্তাই দিবেন না ) লেখক নিজেকে রবীন্দ্রনাথে পর সবচেয়ে প্রতিভাবান মনে করেছেন কি না তা নয়, ( এক্ষেত্রেও মনে হয় অরণ্যে রোদন করলাম ) আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনা-সমালোচনা-কাউন্টার অ্যাটাক হোক উন্নততর ফিলসফির ও যুক্তির ভিত্তিতে।
অবশ্য লেখক "ধারণা করা হয়, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষায় সবচেয়ে প্রতিভাবান লেখক ও চিন্তাবিদ।" এই ফ্ল্যাপের গিমিকটা করে ভালোই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আজকাল খুব ভালো লেখকেরও এরকম কিছু ফেসবুক কিংবা বইয়ে না করলে পাঠকদের অ্যাটেনশন পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ দায় আমাদের লেখক-পাঠক-প্রকাশক সমাজ পুরোপুরি কি এড়িয়ে যেতে পারেন?
লেখালেখি তো উন্মোচনই। কেউ এই প্রচন্ড ভিড়ের জামানায় অ্যাটেনশন শিক করতে চাইলে কিংবা ভাইরাল হতে চাইলে সেটা তাঁর অধিকার। তবে মূল কাজটা তাকে ভালো করতে হবে।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বেশ ভালো লিখেছেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের সাথে কিছু বিষয়ে দ্বিমত ( যা খুবই স্বাভাবিক ) থাকার পরও তাঁর প্রতি শুভকামনা রইলো।
আমরা কেউই পৃথিবীর কোন বইয়ের সাথে পুরোপুরি একমত হই না, হতে পারি না। অনেকে হয়তো ভান করেন। জনপ্রিয় লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বক্তব্যে সেই ভানসর্বস্বতা কম আছে।
বই রিভিউ
নাম : মূর্তিভাঙা প্রকল্প লেখক : মহিউদ্দিন মোহা��্মদ প্রকাশক : জ্ঞানকোষ প্রকাশনী প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৪ প্রচ্ছদ : সব্যসাচী মিস্ত্রী জনরা : নন-ফিকশন, অ্যাফোরিজম, প্রতিষ্ঠান-প্রথার সমালোচনামূলক। রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
অনেকদিন আগেই বইটি পড়া শেষ করেছিলাম : যদিও অন্যান্য অনেক বইয়ের মতন পড়া শেষ করেই রিভিউ লিখা শুরু করে দেইনি। কিছুটা সময় জাবর কাটার জন্যে রেখে দিয়েছিলাম, ভেবে দেখলাম এখন পরিপাক প্রক্রিয়া শুরু করা যায়।
রিভিউটা Mohiuddin Mohammad এর কেবল এই বইটির জন্যই প্রযোজ্য এমন নয়,বরং এখন পর্যন্ত তার যে ৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে সবগুলোর জন্যেই প্রযোজ্য।
১৮৮৩ সালে প্রকাশিত নীৎসের "Thus Spoke Zarathustra” তে মানুষের তিন স্তরের গ্রোথের কথা বলা হয়। নীৎসের হিসেবে, ধাপে ধাপে শেষ স্তরে পৌঁছাতে পারলেই একজন মানুষের পক্ষে স্বাধীন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা সম্ভব। তিনি সেই মানুষের নাম দেন জার্মান ভাষায় উবারমেনশ, যার বাংলা অর্থ "শ্রেষ্ঠ মানব"।
প্রথম স্তরের নাম ক্যামেল(উট)। একটা উট যেমন মনিবের প্রতি পুরোপুরি অনুগত, বিশ্বস্ত ও আশ্বস্ত থাকে - এই স্তরের মানুষেরাও সমাজের প্রতি তেমনি অনুগত থাকে। একটা উট যেমন তার মনিবের যেকোন কথায় প্রশ্ন তুলে না, তেমন এ স্তরের মানুষেরাও সমাজে প্রচলিত মতবাদকেই ধ্রুব সত্য ধরে নেয়। অনেকক্ষেত্রেই সমাজের প্রচলিত শিকলে তারা আঘাত পেলেও তারা তা নিয়ে ভাবে না - সমাজের গন্ডিতেই তারা আবদ্ধ থেকে যায়।
দ্বিতীয় স্তরের নাম লায়ন (সিংহ)। একটা সিংহ যেভাবে সমাজে বসে থেকেও সমাজের নিয়মের কোন বালাই করে না, সে গর্জন করে, লড়াই করে বনের রাজা হবার জন্যে : তেমনি এই স্তরের মানুষেরাও সমাজের প্রচলিত নিয়মে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখে না। সে প্রশ্ন করে, খুঁজে উত্তর, আঘাত করে সমাজের শিকলে। প্রচলিত পন্থাকে সে ভাঙ্গতে চায় নতুন ও আধুনিক পন্থাকে বরণ করে নিতে।
নীৎসের ভাষায় গ্রোথের একেবারের চূড়ার স্তরের নাম চাইল্ড(শিশু) - যে মানুষের সদ্যজন্ম হয়েছে, যাবতীয় সামাজিক সব বাধাকে পেছনে ফেলে যে এখন মুক্ত, সৃষ্টিশীল, আত্নশুদ্ধিতে রত; সব শিকলের উর্ধে গিয়ে জীবনকে যে অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করতে চায়। এখানে তিনি শিশুর বিশুদ্ধতার সাথে মানুষটিকে তুলনা করেন এবং এ মানুষের নাম দেন তিনি উবারমেনশ (শ্রেষ্ঠ মানব)। নীৎসে যদিও বলে গেছেন যে সবার পক্ষে এই স্তরে পৌছানো সম্ভব না। বইটি মূলত জরাথ্রুস্টের সাথে কাল্পনিক ভ্রমণ, যার পথ ধরে একজন মানুষের উবারমেনশ হওয়া সম্ভব।
উবারমেনশ হলো ভবিষ্যতের আদর্শ উচ্চতর মানুষ যিনি প্রচলিত খ্রিস্টান নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে তার নিজস্ব মূল্যবোধ তৈরি করতে এবং আরোপ করতে পারেন, মূলত নীটশে দ্বারা “Thus Spoke Zarathustra” (1883-5) বর্ণনা করা হয়েছে। [১]
রিভিউয়ের একেবারে কোর পয়েন্টে চলে এসেছি। এখন যা বলব, এর জন্যে গালিও খেতে পারি বা বাহবাও পেতে পারি। কিন্ত কথাগুলো আমার বলা প্রয়োজন।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এর বইগুলো নীৎসের উবারমেনশ গ্রোথের সাথে তুলনা করা যায়। যদি আপনি বইগুলোর ৩০% বা তার কম অংশ পছন্দ করেন এবং বাকি পুরোটা সময়ে ট্রিগার খান - আপনি তবে ক্যামেল। সমাজের অনেক প্রচলিত রীতিরই আপনি অন্ধভক্ত। আপনি প্রশ্ন করতে জানেন না, প্রশ্ন করতে চানও না।
৩০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় যদি আপনি পজেটিভলি নিতে পারেন ট্রিগার না খেয়ে, এবং ভাবতে পারেন - তবে আপনি লায়ন, এটা পজিটিভ দিক। এবং তার চাইতেও বেশি অংশ আপনি পড়ে যদি বুঝতে পারেন যে তা আপনারই মনের ভাষা, তবে আপনি উবারমেনশ।জীবনের পথে আপনি একজন ছাত্র, যার কোন পিছুটান নেই।আপনাকে শুভকামনা রইলো আগামী দিনের পথচলায়।
মাত্র তিন বছরের মধ্যে ৫ টা বই দিয়ে লেখক অনেক গভীরে শিঁকড় গেড়ে ফেলেছেন। এখন যদি আর কোন বইও না লিখেন,এই বই দিয়েই আগামী ২০ বছর তিনি আরামসে মার্কেট ধরে রাখতে পারবেন। এখন তিনি কি অনন্য, বা তিনি নিজেকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন, তা তার ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতির উপরে নির্ভর করতেসে। শুনলাম এবার তিনি উপন্যাস লিখবেন, পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের কালাপাহাড়ি গদ্য ভেঙে দিতে চায় আমাদের পাঠের আরামপ্রিয়তা। পড়তে পড়তে আমাদের অস্বস্তি লাগে কিন্তু না পড়ে থাকতে পারিনা, অন্তত আমার ক্ষেত্রে এমন হয়। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের সব চিন্তার সাথে হয়তো একাত্মবোধ করিনা, তবে এইরকম চিন্তাশীল গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই অনুভব করি। বুদ্ধির মুক্তি ও যুক্তিশীলতার চর্চার ক্ষেত্রে বর্তমানে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ উজ্জ্বল নাম।
আরে, মূর্তিভাঙ্গা প্রকল্প? নাহ, এই মূর্তিটি কোন দেবতা বা দেবীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নয়। এটা অনেকটা মানুষের মানসিকতার/অপধারণার দেয়ালের মতো যা লেখক ভাঙতে চান। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের সম্প্রতি দুটি বই পড়েছি - একটি আধুনিক গরু রচনাসমগ্র এবং অন্যটি টয়োটা করোলা । যেগুলো পড়ার দরুন এই বই কিনতে চাওয়া। লেখক আগেই সর্তকবাণী দিয়ে শুরু করেছিলো যে এই বইয়ে মিসরিডিং হওয়ার চান্স বেশি, (মিসরিডিং- ভুল পাঠ। যেখানে পাঠক অথবা লেখক, যেকোনো একজনের, অথবা উভয় জনের, ভাষা ও বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো লেখার পাঠোদ্ধার হয়।) বইটি চারটি গল্পের সমন্বয়ে রচিত। -> কর্ণফুলির গান -> লোকের জঙ্গল -> দর্শন কি? -> পশু নয়, ফলমূল কর্ণফুলীর গান ৬২ টি ছোট ছোট মতবিরোধি লেখা নিয়ে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে লোকের জঙ্গল যেখানে লেখক দেখিয়েছেন মিডিওকার রা কেন শত্রু। অজ্ঞতা এবং বুদ্ধিহীন বিদ্যা যে একই মুদ্রার দুটি দিক সেটি নিয়ে ভালোই আলোচনা করেছেন। দর্শন কি? তে লেখক লিখেছেন দর্শন কেন প্রয়োজন, কেন তা বিলুপ্তির পথে। সবচেয়ে বোল্ড লেখা বলতে গেলে পশু নয়, ফলমূলে। যেহেতু ধ্যান ধারণা কম এ বিষয়ে তাই কিছু বলার নেই এদিক আমার। এত ছোট বই আসলে একবার পড়েই দেখুন। পড়ুন এবং ভাবুন।
পরিশেষে, মহিউদ্দিন মোহাম্মদের রচনাগুলি আমাদের পূর্ব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার এবং আমাদের দিগন্তকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের শক্তির প্রমাণ হিসাবে কাজ করে। অপ্রচলিত বিষয়গুলির অন্বেষণের মাধ্যমে, তিনি আমাদের নিজেদের বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য চাপ দিয়েছেন এবং মানব মনের জটিলতাগুলিকে আলিঙ্গন করতে আমাদের উৎসাহিত করেছেন। যদিও আমরা তার উপস্থাপিত সমস্ত কিছুর সাথে একমত নাও হতে পারি, এই বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তৃতার মাধ্যমেই আমরা আমাদের চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে বিকশিত হতে এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি। যাইহোক, এই বিষয়টিতে জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে এই বই সম্পূর্ণ সত্য বা ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার জন্য নয়। তিনি তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং মতামত উপস্থাপন করছেন, এবং এটি সম্পূর্ণভাবে সম্ভব যে পাঠকরা তার যুক্তিগুলির সাথে নিজেদের দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তবুও, এটি দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য এবং ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে জড়িত থাকার ইচ্ছা যা বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে সমৃদ্ধ করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।
পাঠক মহলে বর্তমানে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ অন্যতম আলোচিত/সমালোচিত একজন লেখক। উনার এই বইটি ৪ ভাগে বিভক্ত- ১. কর্ণফুলির গান ২. লোকের জঙ্গল ৩. দর্শন কি? ৪. পশু নয়, ফলমূল 'কর্ণফুলির গান' অনেকগুলো ছোট ছোট প্রবন্ধের সমষ্টি। যেখানে তিনি নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ছোট্ট হলেও সেই সকল প্রবন্ধ যেই কোনো চিন্তাশীল মানুষকে ধ্বাক্কা দিতে সক্ষম, মোটামুটি প্রচলিত সিস্টেম এবং ধ্যান ধারণাকে নিয়ে উনি নানা ধরণের মন্তব্য করেছেন। এই ভাগটি বারবার পড়ার মতো, আমার মনে হয়না এই ভাগটা ১-২ বার পড়লে সকলের মগজে সঠিকভাবে সবকিছু বোধগম্য হবে। 'লোকের জঙ্গল' বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে, মিডিওকোর লোকদের নিয়ে আলোচনা। এই সকল আলোচনা নিয়ে তেমন জানাশোনা ছিলোনা দেখে বেশ ভালোই লেগেছে। 'দর্শন কি?' মোটামুটি লেগেছে। 'পশু নয়, ফলমূল' বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখার মতো লেখা। আমার মতো সল্পজ্ঞানী এটা নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক কিছু বলার মানে নিজের অজ্ঞানতা ঢাকার জন্য জ্ঞানী সাজার ভান করা।
ভালো লাগে নাই বইটা। কিছু কিছু জাইগাতে ইসলামোফোবিয়া মনে হয়েছে। মনে হয়েছে উনি উনার মূল লেখা থেকে বের হয়ে ইসলামের পিছে লেগে ওয়াজ করতেছে। হিজাব, বোরখা, কোরবানি এইগুলা উনার সেক্টর না। উনি সেক্টরের বাইরে বের হয়ে গেছেন কেনো বইটাতে সেটা বুঝতে পারলাম না।
বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় থাকায় বইটা পড়বো কি পড়বো না নিয়ে বেশ দোলাচলে থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাঠক সত্তার কাছে হার মেনে নিলাম। সম্পূর্ণ বইয়ে চিন্তা করার মত যথেষ্ট রসদ বিদ্যমান। বইটা একজন পাঠক কে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। বইটা শেষ করার পরে বইয়ে থাকা বেশ কিছু বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানার আগ্রহ হয়েছে। আমার কাছে এটা এই বইয়ের একটা স্বার্থক দিক। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে লেখকের দর্শনের গভীরত্ব প্রশংসনীয়। লেখক পাঠক দের মিস রিডিং এবং ইল রিডিং নিয়ে সতর্ক করলেও পুরো বইয়ের বেশ কিছু জায়গা পড়ে আমার ধারণা হয়েছে লেখক নিজেই কিছু বিষয়ে মিস রিডিং অথবা ইল রিডিং এর স্বীকার।
তীব্র ভাষায় লেখক নিজের মত প্রকাশ করে অন্যান্য মতকে উড়িয়ে দিতে চান৷ এটা তার লেখার একটা কৌশল। একটু আত্মম্ভরিতা না থাকলে নি:সন্দেহে আরো সুপাঠ্য হত! আর লেখকের লালনকে কেন এতব অপছন্দ সেটাও বুঝতে পারলাম না। লালনের গানের দর্শনকে তো এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। যাই হোক, মুক্তচিন্তায় অনভ্যস্ত পাঠকদের কাছে বইটা আঘাত মনে হবে। ভাবনা-চিন্তার প্রচুর খোরাক পাবেন তারা। ৩.৫/৫
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইয়ের মধ্যে এটা আমার পড়া দ্বিতীয় বই। কেন জানি না, আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র এর মত অতটা ভালো লাগেনি। কেন লাগেনি জানি না। হয়তো আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র পড়ে আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, বইটা তবুও যথেষ্ট ভালো। ইন্টারেস্টিং ও মস্তিস্কে খোঁচা দেয়ার মতই বই।