অনেক খাটুনি দিয়ে লিখেছেন লেখক। বলা যায় অনেক বছর ব্যয় করেছেন একটি বই লিখতে। সিরাজ-উদ-দৌলা বংশ পরম্পরায় শেষ মেষ কতদূর পৌছেছে তা ভাল ভাবেই ট্রেস করতে পেরেছেন। উঠে এসেছ প্রধান সেনাপতি মোহনলালের পরিণতি। কোন চর্বিত চর্বন নেই লেখায় ।
ইতিহাসের অনেক কথাই আমাদের অজানা থেকে যাবে, এমনই এক অজানা ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে এনেছেন অমলেন্দু দে। সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধের পরেই নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু তার পুত্রকে গোপনে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছিলেন তার বিশ্বস্ত অনুচর ও আত্মীয় মোহনলাল। সিরাজের স্ত্রী আলেয়া ছিলেন মোহনলালের বোন। সিরাজের পুত্র পরবর্তীতে এক হিন্দু জমিদারের দত্তকপুত্ররূপে যুগলকিশোর রায়চৌধুরী নামে বড় হন ময়মনসিংহে। শেষ বয়েসটা কাটে তার সিলেটের কাজলশাহে, পরবর্তীতে তার বংশধরেরা চলে যান সুনামগঞ্জে, এরপর কয়েকবার পদবী পরিবর্তন করে বর্তমানে ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের নানা জায়গায়। সেই পারিবারিক ইতিহাস, যা দীর্ঘদিন গোপন ছিল, সেটাই এতদিন পরে সবার কাছে প্রকাশিত হল। এই কাহিনী যেন একটি বাস্তব জীবনের থ্রিলার। একই সাথে আলোকপাত করা হয়েছে মোহনলাল কি পলাশীর যুদ্ধের পরও দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন কিনা? আর ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ভবানী পাঠক ও মোহনলাল আদতে একই ব্যক্তি কি না। বইটি পড়ার আগে যুক্তি প্রমাণ নিয়ে আমি বেশ সন্দিহান ছিলাম, বইটি পড়ে মনে হল এই কাহিনী সত্য হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
সিলেটের যুগলকিশোর রায় সিরাজের পোলা এই কাহিনী শুইনা বড়ো হইছি। মনে হইত হয়ত কাহিনী। ওইটা যে ঐতিহাসিক সেই বিষয়ে অতটা ভরসা আছিল না। এই বইটা পরিষ্কারভাবে সেইটা দেখায়া দিলো। বইটার সবচে বিস্ময়কর হইল উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠক যে সিরাজের সেনাপতি মোহনলাল হইতে পারেন সেই বিষয়ে একটা ইঙ্গিত
লেখক পরিচিতিঃ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. অমলেন্দু দে-র জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২ জানুয়ারি। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাস ড. দে-র বিস্তৃত গবেষণার ক্ষেত্র। নানান বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন নতুনভাবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় ইতিহাসের গুরুনানক অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পরও অশীতিপর এই মানুষটি নানা গবেষণাকর্মে ব্যাপৃত।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। ইংরেজ শাসনের ভিত্তি পাকা হয়ে যাওয়ার পরে সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের পরবর্তী অবস্থা কী হলো, সিরাজের বংশধরেরা কে কোথায় আছেন এবং কী অবস্থা তাদের ছিল সেই বিষয়েই অক্লান্ত অনুসন্ধিৎসার মাধ্যমে গ্রন্থটি রচনা করেছেন ড. অমলেন্দু দে।
মোহনলালের বোন হীরা, যে কিনা ধর্মান্তরিত হয়ে পরিচিত হয় আলেয়া নামে, সে ছিলো সিরাজের এক স্ত্রী। আর তার গর্ভেই জন্ম নেয় সিরাজের এক পুত্র। যুদ্ধে সিরাজ নিহত হওয়ার পর মোহনলাল তার এই ভাগ্নেকে নিয়ে ময়মনসিংহের এক জমিদারের কাছে দত্তক দেন। এই পুত্রের নাম যুগলকিশোর রায়চৌধুরী, যার জমিদারি ছড়িয়ে ছিলো ময়মনসিংহ- সিলেট প্রভৃতি জায়গায়।
সিলেটের কাজলশাহ এলাকাতে যুগলটিলা, যেটি এখন ইস্কনের একটা বড় মন্দির, এই স্থাপনাটি আসলে করেছিলেন সিরাজের এই পুত্র যুগলকিশোরের এক ছেলে জমিদার কৃষ্ণনাথ চৌধুরী। আর কৃষ্ণনাথের ছেলে শৌরিন্দ্র কিশোর, যিনি পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হন প্রসন্ন কুমার দে, তিনি আবার সুনামগঞ্জের বিখ্যাত জুবিলী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা৷
ইতিহাস সম্পর্কে খুব জ্ঞান না থাকায় এই তথ্যগুলো জেনে আমি আশ্চর্য হয়েছি। কারণ, আমি নিজেই সুনামগঞ্জ এর নাগরিক, আবার সিলেটের কাজলশাহেই আমার মেডিক্যাল কলেজটি অবস্থিত।
শুধু এই নয়, প্রায় প্রতিটি সন্ততি কে কী করতেন, কে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে ছিলেন, এসব বিষয় খুব আগ্রহোদ্দীপকভাবে আলোচনা করেছেন লেখক। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং কিছু সূত্রও দিয়েছেন যে বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস 'দেবী চৌধুরানী' এর চরিত্র ভবানী পাঠক, আসলে নাকি মোহনলাল! ইতিহাসের এই চরিত্রটির পরবর্তী পরিণতি সম্পর্কে আসলে তেমন কিছুই জানা যায় না।
অনেক গবেষণা, অনুসন্ধান, তদন্তের মাধ্যমে লেখক সিরাজের পুত্র এবং বংশধরদের খোঁজার প্রয়াস রেখেছেন এবং বের করে এনেছেন আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। টীকা হিসেবে সংযুক্ত গ্রন্থগুলিও উপকারী। যাদের ইতিহাসে আগ্রহ আছে, তারা বইটি পড়ে নিতে পারেন। কোনভাবেই থ্রিলারের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়!