সরলাদেবী চৌধুরাণী এর নানাবিধ কার্যকলাপের সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এর প্রথম আলো উপন্যাসের মাধ্যমে। তখন তাঁর বহুমুখী প্রতিভা এবং কার্যকলাপ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। একই সাথে ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে একটা চিরকালীন আগ্রহ তো ছিলই। তাই এই আত্মজীবনীটির সন্ধান পাওয়ামাত্রই তক্ষশিলা থেকে সংগ্রহ করে নিলাম।
পূর্ণাঙ্গ জীবনী নয় এটি৷ শৈশব এবং যৌবনের অনেকখানি উঠে এসেছে বইটিতে, বিবাহোত্তর জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে তার অভাব পূরণ করা হয়েছে যোগেশচন্দ্র বাগল মহাশয় কর্তৃক সংকলিত 'বিবাহোত্তর জীবনকথা' এবং পরিশিষ্ট অংশতে। এছাড়াও বইটিতে রয়েছে অগ্রন্থিত পাঁচটি প্রবন্ধ, যা সরলা দেবী নানান সময় এবং নানান উপলক্ষ্যে রচনা করেছিলেন৷
সরলা দেবী ঠিক ঠাকুরবাড়িতে বড় হননি, কারণ তাঁর পিতা জানকীনাথ ঘোষাল ঘরজামাই ছিলেন না। তিনি আলাদা বাড়িতে থাকতেন, তবে ঠাকুরবাড়ির সাথে যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। সরলা দেবীর শৈশব স্মৃতিতে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত হবার হাহাকার বেশ প্রকট৷ দাসীর হাতে মানুষ হওয়ার সংস্কৃতি ছিল তখন, দাসীদের উপরই সমস্ত ভার। এছাড়াও গৃহশিক্ষক ছিলেন, যিনি কড়া ধাঁচের ছিলেন। গৃহশিক্ষক এবং দাসী উভয়ের হাতেই চড় চাপড় খাওয়ার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন সরলাদেবী। শৈশবের উচ্ছলতার ফাঁকে ফাঁকে অত অল্প বয়েসে নানান অবহেলা এবং উদাসীনতার পরিচয়, অভিভাবকদের তরফ থেকে, হৃদয়ে নাড়া দেয়। এমন অবস্থা হয়তো স্বাভাবিকই ছিল। তাই এত তেজোদীপ্তভাবে বেড়ে উঠেছিলেন সরলা, এধরনের অবিচার বা উদাসীনতা যে বাল্যমনে গভীর কোন দাগ ফেলেনি, এই সুখের কথা।
দিদি হিরন্ময়ী এর স্নেহধন্যা ছিলেন তিনি, অনেকটা মায়ের জায়গা পূরণ করেছিলেন এই দিদি। নানান গুণে গুনান্বিতা সরলা দেবীর বন্ধুভাগ্য ছিল ঈর্ষনীয়। অবলা বসু, লজ্জাবতী বসু প্রমুখ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরী। পড়াশোনাতে ভালো ছিলেন, পেয়েছেন শিক্ষকদের স্নেহ৷ পিয়ানো বাজাতেন খুব সুন্দর। রবি মামার সাথে সম্পর্কটা সবসময় সরলরৈখিক ছিল না৷ তাঁর প্রতাপাদিত্যকে জাতীয় বীর বলে মেনে নেয়াটা রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেননি। এছাড়াও রবিঠাকুর এর স্নেহের পাল্লা ইন্দিরা দেবীর দিকেই একটু বেশি হেলে ছিল।
সরলা দেবী আমাদের ইতিহাসে রাজনীতি সচেতন এবং কর্মঠ একজন নারী হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে রাখবেন৷ বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ এবং মহাত্মা গান্ধীর সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। চিঠি চালাচালিও হয়েছিল। তিনি মহাত্মা গান্ধীর চরকা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। সুচিন্তিত প্রবন্ধ এবং সাহিত্য রচনার দ্বারা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বঙ্কিমের।
প্রতাপাদিত্য উৎসবের পাশাপাশি সখি সমিতি, লক্ষীর ভাণ্ডার স্থাপন, লাঠি খেলার প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানান সমাজ সংস্কারমূলক কাজে জড়িত ছিলেন তিনি। সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা ও সাহায্যদাত্রী ছিলেন তিনি৷ ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে কর্মময় জীবন থেকে অবসর নিয়ে অধ্যাত্ম-সাধনায় নিমগ্ন হন। গ্রহণ করেন বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্ম্মা এর শিষ্যত্ব৷
সরলা দেবীর এই জীবনকাহিনী বেশ সাবলীল ভাষায় লেখা। নানান জানা অজানা কথা জানা যায় এই কর্মবীর নারীর জীবনকাহিনী থেকে৷ দৃঢ়তা এবং সাহসিকতা ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তেজস্বী এই নারীর লেখা প্রবন্ধগুলো তাঁর সুসংহত ভাবনার প্রকাশ। একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় তাঁর রচনা পাঠে জানা যায়।
একটা সময় ছিল যখন শুধু বাংলায় না গোটা ভারতবর্ষে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন এবং জীবনযাত্রায় একটি পরিবার আলাদা করে পথ দেখাতো। সেটা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। এই পরিবারের মহর্ষি দেবেন্দ্রেনাথের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী আর কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পিছনের অন্যতম কর্মী জানকীনাথ ঘোষালের দ্বিতীয় কন্যা ছিলেন সরলা দেবী। সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা বোধহয় রবি ঠাকুরের বছর বারোর ছোট ছিলেন। ঠাকুর বাড়ির সে সময়ের রীতি ছিল বাড়ির জামাইরা সাধারণত ঘরজামাই হিসেবে থাকতেন ঠাকুর বাড়িতেই পরিবারসহ। কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জানকীনাথ ঘোষাল সে রীতি না মানলেও পড়াশোনার জন্য তার বিলেতে যাবার সময়টায় অর্থাৎ সরলা দেবীর বাল্যকালের একটা বড় সময় কেটেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেই। সেই বাড়ির আদব কায়দা রবি ঠাকুর বা অবন ঠাকুরের আত্মস্মৃতিতে পড়েছি। সরলা দেবীর আত্মজীবনীতেও উঠে এসেছে সেই পরিচারক/ পরিচারিকার কাছে বড় হওয়া, কঠোর নিয়মানুবর্তিতার দিকগুলো। পরবর্তীতে অবশ্য সরলারা চলে যান আলাদা বাসায় কিন্তু যোগসূত্র তো ছিলই বরাবর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম জন্মদিন পালন তারই কৃতিত্ব, নিজে গান ভালো গাইতেন, সুর সংগ্রহের ঝোঁক ও ছিল খুব। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ঘোরার সুবাদে নানা জায়গা থেকে পছন্দের সুরগুলো তিনি তুলে এনেছিলেন রবি মামার জন্য। ভারতের অন্যতম জাতীয় সংগীত বন্দে মাতরমের প্রথম দুটো স্তবকের সুর করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কিন্ত বাকি অংশের সুর যে সরলা দেবীর করা এই তথ্য কিংবা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলা যে গান আমি কোথায় পাবো তারে থেকে সংগ্রহ করা সেই সুরও কিন্তু সরলা দেবীই পৌছে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে সরলা দেবীই। দেশীয় এবং পাশ্চাত্য সংগীতে যেমন ছিল তার দক্ষতা তেমনি সাহিত্য রচনা, পত্রিকা সম্পাদনায়ও। স্বাদেশিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই। দেশের মেয়েদের গ্রামীণ কুটির শিল্প নিয়ে গড়া প্রতিষ্ঠান লক্ষীর ভান্ডার ই হোক কিংবা দূর্গাপূজায় বীরাষ্টমী পালন এসবের কৃতিত্বও তারই। সবসময়ই চেয়েছিলেন বাঙালি তার দূর্বল অপবাদ ঘোচাক, বাংলার ছেলেদের শরীর চর্চা ও খেলাধূলায় তার উৎসাহ এবং সহযোগীতাও ছিল ভীষণ রকমের। বলতে গেলে এ ব্যাপারেও অগ্রণী মানুষটিও তিনিই। সেই কত বছর আগে একা একটি মেয়ে চাকরি করতে চলে গিয়েছিলেন মহীশুর রাজ্যে। সেখানের মানুষকে দেখেছেন, শিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ বা দেবেন্দ্রনাথ তো বটেই সরাসরি যোগাযোগ এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বঙ্কিম চন্দ্র এবং স্বামী বিবেকানন্দের সাথে। পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীর সাথেও। বিয়ে হয়েছিল অবশ্য সেই দূর পাঞ্জাবে। সেখানেও পত্রিকা সম্পাদনা এবং রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন। ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হয়েও পৌত্তলিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন জীবনের মধ্যভাগে এসেই। সেই পথেই ছিলেন শেষ পর্যন্ত। অবশ্য তফাত হয়তো করেন নি, কিন্তু পথ হিসেবে নিয়েছিলেন সেটাই। এই আত্মজীবনীতে জীবনের মধ্যাংশের পরের কথা লিখেন নি তিনি, লিখে যেতে পারেন নি। তবু যতটুকু আছে তাও ভীষণ বৈচিত্রপূর্ণ, ঘটনাবহুল। কিছুটা আত্মপ্রশংসা বা নিজের কৃতিত্বগুলো তুলে ধরার ব্যাপারও হয়তো আছে তবু তিনি লিখে না গেলে সেগুলো তো বিস্মৃতির আড়ালেই থেকে যেত। অন্য এক সময়ের ভীষণ আধুনিক এবং সাহসী নারীর জীবনের কথা এই আত্মজীবনটি। অনেক অজানা ঘটনা, তথ্য যেমন জানার সুযোগ হয়েছে তেমনি অদেখা সময়কে নতুন করে নতুনভাবে জানার সুযোগও করে দিয়েছে এই বইটি।