কিছু-কিছু লেখা থাকে, সময়ের ধুলোময়লা যাদের স্পর্শ করে না। চিরকালের পাঠকের জন্য যা কিনা চিরনতুন উপহার।
‘খড়কুটো’ও নিঃসন্দেহে তেমনই এক উপন্যাস। ‘ছুটি’ নামে একদা চলচ্চিত্রে আলোড়ন তুলেছিল এই কাহিনী। এখনও বহু দর্শকের স্মৃতিতে হয়তো গুনগুনিয়ে ওঠে ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’র মতো গান, কিংবা জেগে ওঠে ভ্রমরের করুণ-রঙিন মুখচ্ছবি। আবার, ছাপার অক্ষরেও এ-উপন্যাসের আকর্ষণ যে একটুও কমেনি, তারই প্রতিফলন দ্রুত নিঃশেষ মুদ্রণে ও পাঠক-চাহিদার অন্যবিধ নিরিখে। বহু পাঠকই এ-লেখা পড়ে লেখকের কাছে জানতে চাইতেন, ‘ভ্রমর কে? বিমল কর তাকে দেখেছেন কিনা? কেন তার অমন অসুখ হল? অমল কে? লেখক নিজে কি ক্রিশ্চান?’ এমন অবধারিত কৌতূহল ‘খড়কুটো’র অসামান্যতারই অন্যতর পরিচয়। এবং এ-কথাও বলা দরকার যে, নিছক দুটি ছেলেমেয়ের ভালবাসার গল্প এ নয়। আরও বড় কিছু, বেশি কিছু।
Bimal Kar (Bengali: বিমল কর) was an eminent Bengali writer and novelist. He received 1975 Sahitya Akademi Award in Bengali, by Sahitya Akademi, India's National Academy of Letters, for his novel Asamay.
বিমল কর-এর জন্ম ৩ আশ্বিন ১৩২৮। ইংরেজি ১৯২১। শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। জব্বলপুর, হাজারিবাগ, গোমো, ধানবাদ, আসানসোল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কর্মজীবন: ১৯৪২ সালে এ. আর. পি-তে ও ১৯৪৩ সালে আসানসোলে মিউনিশান প্রোডাকশন ডিপোয়। ১৯৪৪-এ রেলওয়ের চাকরি নিয়ে কাশী। মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরাগ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক, পরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকা ও ‘সত্যযুগ’-এর সাব-এডিটর। এ-সবই ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে। ১৯৫৪-১৯৮২ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮২-১৯৮৪ ‘শিলাদিত্য’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক। বহু পুরস্কার। আনন্দ পুরস্কার ১৯৬৭ এবং ১৯৯২। অকাদেমি পুরস্কার ১৯৭৫। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ১৯৮১। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার ১৯৮২। ‘ছোটগল্প—নতুন রীতি’ আন্দোলনের প্রবক্তা।
ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। গলার কাছটায় একমুঠো কষ্ট দলা পাকিয়ে আছে যেন। প্রকৃত অর্থে বিয়োগান্তক না হয়েও, এতটা মন খারাপ রেখে যাওয়া যায়? এত অনাবিল, এতো সরল হয় ভালোবাসা? কৈশোরের এই প্রেম। যা আবেগময়, যা অভিমানী। যা স্নিগ্ধ ও ভীষণ নিষ্পাপ! যেন শীতকালের পড়ন্ত বিকেলের এক চিলতে রোদ্দুর। মিঠে ও মনমরা। সেই রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকা যায়। নিজ অজান্তেই গুনগুন করে উঠতে হয় কোনো ফিল্মের গান। কার উদ্দেশ্যে যেন বলে ওঠে মন...'বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।'
"ভ্রমরের মুখটি ছোট, কপাল সরু, গাল দুটি পাতার মতন, চিবুকে একেবারে প্রতিমার ছাঁদ। রঙ শ্যামলা। ঘন টানা টানা ভুরুর তলায় কালো কালো ডাগর দুটি চোখ। পাতলা নাক, পাতলা ঠোঁট। মানুষের মুখ দেখলে এত মায়া হয়—অমল জানত না। ভ্রমরের মুখ দেখে অমলের কেন যেন মনে হয়, এমন মুখ আর সে দেখে নি। ফুলের মত ভাল। সুন্দর, দুঃখী, শান্ত মুখ" লেখক এই গল্পের আসল চরিত্র "ভ্রমর" এর মুখচ্ছবি বর্ণনা করেছেন এভাবেই।। গল্পের অপর চরিত্র "অমল", যে কিনা ভ্রমরের প্রেমে পড়ে।। এই দুজনের প্রেমের গল্প নিয়েই উপন্যাস "খড়কুটো".... ছোটবেলায় মা হারানো ভ্রমর। তার বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন।। তার ২য় মা তাকে একদম ভালবাসে না, যত্ন করেন না। তেমনি ভ্রমরও এই মহিলা থেকে তেমন কিছু আশা রাখেন না। বেশ অনেকদিন ধরে অসুস্থ ভ্রমরকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায় অমল। অবহেলিত, অযত্নে বেড়ে উঠা ভ্রমর যেন অমল দ্বারা আবার ভালবাসার ছোঁয়া পাই...
গল্পটার গতিবিধি সরলরৈখিক, মানে তেমন উঠা-নামা নাই। বেশ সহজ-সরলভাবে গল্পটি এগিয়ে যেতে থাকে। তবে শুধু লেখার জন্য পড়তে বেশ ভালো লাগে, কখনো ক্লান্তি আসে না। বিমল করের লেখা যেন শান দেওয়া, বেশ ধারালো।। বেশ বৈচিত্র্যময়তা লক্ষ্য করেছি উনার লেখাতে! আর উনি প্রকৃতির বর্ণনা বেশ সুন্দর দেন! পড়ে যেমন তৃপ্তি, তেমন বেশ সুন্দর লেখা।। আমার বিমল কর-এর পড়া প্রথম বই এটি হলেও মনে হয়েছে এই লেখকের আরো কিছু পড়া উচিত
শেষে ভালো লাগা লেখার একটা অংশ দিচ্ছি:--- "এখন সব চুপচাপ, সব শান্ত। বাগানে সবুজ ঘাসে কখনও দু-একটা ফড়িং, দু-চারটে চড়ুই নাচানাচি করছে। কোথাও বুঝি এ-বাড়ির কাক ও-বাড়ির কাকের সঙ্গে গল্প করছিল, তাদের কা-কা ডাক থেকে অমলের সেই রকম মনে হল। ভ্রমরের বেড়ালটাও ফলবাগানের কাছে খানিক ঘোরাঘুরি করে বারান্দায় গিয়ে গা-গটিয়ে ঘুমোতে শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাকাল অমল। অনেক যেন উচুতে উঠে গেছে আকাশ, খুব গভীর দেখাচ্ছে; রোদের তলা দিয়ে অনেক গভীরে যেন আকাশ দেখছে। বিন্দু-বিন্দু কালো ফোঁটা হয়ে চিল উড়ছে ওখানে। সাদা মতন একটুকরো মেঘ একপাশে দ্বীপের মতন পড়ে আছে, সেখানে চিল নেই, আকাশের নীল নেই"
"রাস্তা একেবারে ফাঁকা, সাদা সাদা কুয়াশা ঝুলছে রেশমের মতন, আকাশে ফটফট করছে চাঁদ। জ্যোৎস্না এবং কুয়াশায় পথ যেন কাশফলের মতন সাদা ও নরম হয়ে আছে। গাছ-গাছালির গায়ে চাঁদের কিরণ অবিরত সুধা চালছে। ঘোড়ার এবং গাড়ির ছায়া পড়েছে রাস্তায়, দীর্ঘ ছায়া, রাস্তা পেরিয়ে মাঠ দিয়ে ছায়াটা ছুটছে। ঘোড়ার গলায় ঘণ্টা বেজে চলেছে ঝমঝম করে, মাঝে মাঝে জীবটা ডেকে উঠছে"
এই সম্বোধনে অবাক হচ্ছো নিশ্চয়ই! কিন্তু কি করব, তুমি যে দৃঢ় মনে বিশ্বাস কর, কারো ‘প্রিয়তমা’ হয়ে ওঠার মধ্যে আসলে কোথাও পিতৃতন্ত্র নির্মিত একটি অলিখিত শৃঙ্খলে জড়িয়ে যেতে হয়! তাই বুঝি তুমি প্রিয়তম হতে রাজি, কিন্তু প্রিয়তমা হতে রাজি নও। তোমার কথাটি নেহাত মিথ্যেও নয়। সত্যি, আমরা পুরুষেরা নিত্য যেভাবে, যেমন করে আমাদের নারীকে চাই, তার মধ্যে আমাদের অধিকার ও পুরুষের অহঙ্কারের ভাগ নেহাত কম নয়। ফলে, তুমি সই, মোর প্রিয়তমা না হলেও, প্রিয়তমই সই!
তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে ভালবেসেছ জানি কিন্তু তবু প্রেম শব্দে তোমার বড় আপত্তি! পুরুষের প্রেমের প্রবল দৃশ্যমান উচ্ছাস কে তুমি চিরকালই অপছন্দ করে এসেছ। অস্বীকার করি না, সত্যি তো, প্রেমিকাকে রং-বেরঙে সাজিয়ে নিয়ে, সজোরে হাত পাকড়ে, হাটের মধ্যে জোড়ায় জোড়ায় গটগটিয়ে প্যারেড করে, নিরন্তর ফটো তুলে, সবাই কে সোচ্চারে জানান দিয়েও, কেন জানিনা মনে হয়, কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। সবার হয়ত এটা মনে হয় না, কারো কারো হয়। যেমন আমার মনে হয়। মনে হয়, প্রেম তো খুব হল, কিন্তু নিভৃতে ভালোবাসার অনুভব, আদান-প্রদান আর কই হল?
সম্প্রতি, ভালবাসার এই নিভৃতচারী দিকটি, জানো, যেন আরেকবার অনুভব করলাম বিমল করের ‘খড়কুটো’ উপন্যাসটি পড়ে। ছোটো এই উপন্যাসটি যেন আমার হৃদয়ের অস্ফুট শব্দাবলী কে মনের আলো-ছায়ার অন্দরমহল পেরিয়ে, বাহিরের সিংহদরজায় এনে খাড়া করে দিয়েছে। আমার ভাবনার প্রকাশ যা চিরকাল ঠোঁটের দরজা থেকেই বিদেয় নিয়েছে, আজ তাই তাকে দিয়েই তোমার এই পত্র সাজিয়েছি ।
কিন্তু দাড়াও, উপন্যাসটি সম্বন্ধে আরও কিছু বলার আগে এর ছট্টো কিছু অংশ তোমাকে শোনাই। শোনো...
[... রাত্রে চক থেকে ওরা ফিরছিল... চকবাজার ছাড়িয়ে আসতে শীতের কনকনে বাতাস ঝাপটা দিয়ে গেল। বেশ কুয়াশা চোখে পড়ল, ধোঁয়ার মত জমে আছে। ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, চোখ জ্বালা করে; কুয়াসায় সব কেমন ঠান্ডা লাগে, নাক মুখ শীতল হয়ে থাকে। অমল শখ করে পান কিনেছিল, নিজে খেয়েছে, ভ্রমরকেও খাইয়েছে। ... টাঙাটা একটা ছোটো পল্লী ছাড়িয়ে এবার ধু ধু ফাকায় পড়ল। চারপাশে উচু-নীচু মাঠ, দু চারটে গাছ দাঁড়িয়ে আছে, আর্দ্র জ্যোৎস্নায় চরাচর যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘোড়ার গলার ঘন্টিটি ঝুম ঝুম করে বেজে যাচ্ছে, কদমের শব্দ ও চাকার শব্দ মিলে-মিশে একটি অদ্ভুত ধ্বনি বিস্তার করেছে, কোচোয়ান তার গানটি গেয়ে যাচ্ছিল আপন মনে। ... ”আমাদের গাড়িওলা কি গান গাইছে ভ্রমর?”-অমল হঠাৎ জিজ্ঞেস করল। “দোহা।“ “শুনেছি কথাটা...। এক রকম গান না-?” .., [অমল] বলল, “তুমি একটা গান গাও।” “যাঃ!” ভ্রমর ভ্রুকুটি করল।...“তুমি গাও।” “আমি! বেশ আমি গাইছি। তুমিও গাইবে। একসঙ্গে গাইব আমরা।” ... প্রায় অর্ধেকটা গান অমল একা গেয়ে ফেলার পর ভ্রমর তার শেষ সঙ্কোচ এবং আড়ষ্টতাটুকু হারিয়ে ফেলে অমলের গলায় গলা মিলিয়ে গাইলঃ “এই তোমারি পরশরাগে চিত্ত হল রঞ্জিত, এই তোমারি মিলনসুধা রইল প্রানে সঞ্চিত...” কোচোয়ান গান আর গাইছিল না। ঘোড়ার কদম ফেলার তালে তালে তার গলার ঘন্টা ঝুম ঝুম করে বেজে যাচ্ছিল। জ্যোৎস্নার কণাগুলি মাঠ ও বৃক্ষচয় থেকে তাদের চক্ষু তুলে যেন ওই দুটি আনন্দিত তৃপ্ত যুবক-যুবতীকে দেখছিল।...]
এতদুর শুনে তুমি নিশ্চই মুখ টিপে হাসছ, ভাবছ এতো কৈশোরের রোমান্স, এতে নিতান্ত আবেগ ছাড়া আর কি আছে? আমি বলি আছে, বড্ড সরলতা আছে। বিমল করের সমস্ত লেখার একটি মুল উপাদানই হল সরলতা। ঘটনার ঘনঘটা নয়, বরং সাদা মাঠা, আপাত ভাবে বিবর্ণ জীবনের কোটর থেকে তুলে আনা কিছু উপাদান দিয়ে তিনি রচনা করেছেন তার উপন্যাস গুলিকে। তুমি জানো, ছোটোবেলায় ক্লাশ ফোর ফাইভে যখন দেশ পড়ায় হাতে খড়ি হয়, তখন প্রথমেই আগে সুনীল গাঙ্গুলীকে নিতাম পড়ে (এখন বুঝেছ তো আমি এত নর-নারী ব��ষয়ে এত জ্ঞানী হলেম কি করে!), পরে আরও কিছু কিছু পড়তাম কিন্তু বিমল কর সযত্নে এড়িয়ে যেতাম। সুনীল এর লেখা আমার কাছে মনে হত এক স্বচ্ছ পাহাড়ী ���র্ণার মত, উছল, চঞ্চল, বেগবান। তার স্রোত সবসময় এ মোড় ঘুরছে, ও মোড় ঘুরছে, রাশি রাশি উপল খন্ডকে ছুয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। সমস্তটায় এক দুর্দান্ত যৌবনের ছটফটানি! কিন্তু বিমল করের লেখা মনে হত এক স্থবির, মোহনার কাছে স্তমিত হয়ে আসা ভারাক্রান্ত মনের নদীর মত। ক্লান্ত, বিমর্ষ, গতিহীন। কিন্তু তখন খেয়াল করিনি, যা এখন বুঝেছি, যে সে নদীতেও স্রোত ছিল, তবে উছলতা ছিল না। সে নদীর বুকেও সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের কালে লালিমার ছোঁয়া লাগে, হালকা তিরতিরে স্রোত কিশোরীর বিনুনীর মত আলপনা বিছিয়ে যায় তার পথে পথে। সে স্থবির নয়, বৃদ্ধ নয়, সে আসলে ধ্যানস্থ। তার সৌন্দর্য তার স্থিরতায়, তার জ্ঞানে, সরলতায়, দেখার নিবিড়তায়।
এই যে অমল এসেছে তার এক পিতৃবন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন অবকাশ যাপন করতে, সে বাড়িতেই আছে ভ্রমর। কিন্তু এ ভ্রমর ডানার গুঞ্জরনে চারদিক মাতিয়ে তোলে না; সে মা-মরা মেয়ে, বাবা, সৎ মা ও সৎ বোনের সংসারে সে নিজেকে ছায়ার মতই লুকিয়ে রাখে। অমল, ভ্রমর কেউই অসাধারণ নয় তাদের চরিত্রে, নিতান্তই সাদামাঠা, নিতান্তই আটপৌরে, বড্ড রোজকেরে। তাই তাদের মধ্যে যখন একটা কি যেন সম্মন্ধ গড়ে ওঠে, তা কোনো অযাচিত ঢেউ তোলেনা চারপাশে। অথচ স্রোত একটা বয়, সবার অলখে, এক নুতন সুরালাপ শুরু হয় একে সাথে অপরের। তাদের এই প্রেমের সম্মন্ধটায় প্রলেপ বুলিয়ে যায় তীব্র শীতের উত্তুরে বাতাস। সমস্ত চরাচর যেমন কুয়াসায় ডুবে যায় প্রত্যহ, প্রত্যহ সে কুয়াসাকে ছিন্ন করে ওঠে নুতন দিনের সূর্যও। কিন্তু সে সূর্যালোকও বুঝি সমস্ত শীতার্ততা কে তাড়াতে পারেনা, কারন ভ্রমরের যে বড় অসুখ!
না! না, হে প্রিয়তম, শেষটা আমি মোটে বলব না, সে তুমি যখন পড়বে নিজেই জানবে। কিন্তু, আমি আবারও ওই ভালবাসার গুণগান করবোই, সে তুমি যতই মুখ টিপে হাস না কেন! প্রেমের মাতন তো এ নয়, এ নিতান্ত সহজ ভালবাসার সরলতা। এই যে একে অপরকে বুঝতে পারার এক আশ্চর্য অনুভূতি; কারো জন্যে মন কেমন করা; কারো জন্যে পথ চেয়ে থাকা নির্নিমেষে; এই প্রকৃতির বদলে বদলে যাওয়া; রোদের রং পালটান, হাওয়ার মোড় বদল; শিশিরের নম্রতার সাথে, ভোরের আবছায়া আলোর সাথে, সাঁঝের কুয়াসার সাথে সাথে একে অপরের কাছে নিবিড় হয়ে আসা; একটি নুতন মানুষের জন্যে আরেকটি মানুষের মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ওঠা; হৃদয়ের রন্ধ্র রন্ধ্রে এই যে কোমল, নরম, সমুদ্রের মত অগাধ আনন্দের স্রোত, তাকে আমি কিছুতেই তোমার মত করে অস্বীকার করতে পারিনে।
প্রেমের কল-কোলাহলে নয়, ভালবাসার এই আটপৌরে সহজতায়, রোজকার ঘরকন্নায়, বেচে থাকার এই নিরন্তর প্রবাহে আমি তোমাকেই চাই। বিমল করের এই ছোট্টো উপন্যাসের অমলের মতই, তার যাবতীয় ছেলেমানুষী নিয়ে আমি তোমার ভ্রকুটির হাতে নিজেকে সপে দিতে চাই। বুঝলে? অবশ্যই, সময় করে বইটি পড়ে নিও আর আমায় চিঠির জবাব দিও।
“দুপুরটা একেবারে লালচে-হলুদ গাঁদাফুলের মতন রঙ ধরে আছে, ঝিমঝিম করছে, ঠিক মনে হচ্ছে নিরিবিলিতে আকাশের কোলে গা গড়িয়ে নিচ্ছে। এখন সব চুপচাপ, সব শান্ত। বাগানে সবুজ ঘাসে কখনও দু-একটা ফড়িং, দু-চারটে চড়ুই নাচানাচি করছে। কোথাও বুঝি এ-বাড়ির কাক ও-বাড়ির কাকের সঙ্গে গল্প করছিল, তাদের কা-কা ডাক থেকে অমলের সেই রকম মনে হল।ভ্রমরের বেড়ালটাও ফুলবাগানের কাছে খানিক ঘোরাঘুরি করে বারান্দায় গিয়ে গা-গুটিয়ে ঘুমোতে শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাকাল অমল।অনেক যেন উ’চুতে উঠে গেছে আকাশ। খুব গভীর দেখাচ্ছে; রোদের তলা দিয়ে অনেক গভীরে যেন আকাশ দেখছে। বিন্দু-বিন্দু কালো ফোঁটা হয়ে চিল উড়ছে ওখানে।সাদা মতন একটুকরো মেঘ একপাশে দ্বীপের মতন পড়ে আছে, সেখানে চিল নেই, আকাশের নীল নেই।”
চুপচাপ, শান্ত ভ্রমর সবসময় রোগাক্রান্ত আর বিষাদগ্রস্থ থাকে। নিরিবিলি, নিরানন্দ রঙহীন জীবন তার।পিতা,সৎমা, সৎবোন কেউ তাকে তেমন ভালোবাসে না, সেও এদের কারো প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে না।তার এই বৈচিত্র্যহীন একঘেয়ে জীবনে হঠাৎ রঙের ছোয়া নিয়ে হাজির হয় অমল।অবকাশযাপনে সে আসে পিতৃবন্ধু আনন্দমোহনের বাড়িতে।এই অমল আবার কৈাতূহলী আর খুব ছটফটে ,ঠিক ভ্রমরের বিপরীত স্বভাবের।তবু দুজনাতে নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়।দুজনের একসঙ্গে জোনাকি বাজি দেখা,অমলকে আশেপাশের সুন্দর সব জায়গা ঘুরে দেখানো, দুজনের ছোট ছোট খুনসুটি, জ্যোস্না রাতে শীতের হিমেল হাওয়ায় টাঙ্গায় চড়ে ঘরে ফেরা, একে অপরের প্রতি যত্ন-উৎকণ্ঠা এসবের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব বদলে যায় ভালোবাসার সম্পর্কে।নিষ্পাপ বিষাদে ছেয়ে থাকা জীবনে ভ্রমর যেন প্রাণের আনন্দ ফিরে পায়।যেখানে কেউ কখনো ভ্রমরকে যত্ন করেনি, একটু ভালোবাসেনি, ভ্রমরের অসুখকে অবহেলা করেছে দিনের পর দিন, সেখানে অমলের ছোট ছোট যত্ন, ভ্রমরের কপাল ছুয়ে জ্বর দেখা, তার জন্য অমলের চিন্তা,তার নিখাদ ভালোবাসা ভ্রমরকে যেন নতুন করে বাঁচার আশা জাগিয়েছে।জীবনের শত কষ্ট ছাপিয়ে ভ্রমরের কাছে অমলের হাসিমুখটাই মুখ্য হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে।
আপাতদৃষ্টিতে উপন্যাসটা সাধারণ একটা প্রেমের গল্প।কিন্তু এর সাথে জুড়ে দেওয়া শীতকালের মন কেমন করা বর্ণনা আর লেখকের সহজ সাবলীল লেখা বইটাকে আরো চমকপ্রদ করে তুলেছে।এমন নয় যে উপন্যাসটা খুব আহামরি টাইপ সুন্দর।তবু কোথাও যেন একটু মিষ্টি হাওয়ার আমেজ আছে এতে। পড়তে গিয়ে শীতের হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া এসে লাগবে বই ছাপিয়ে, যেন বা ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুর নয়, চোখের সামনে শিশিরভেজা ঘাস আর এতে পা ছড়িয়ে বসে বইয়ে ডুবে থাকা আমি।
যারা বিমল করের লেখা আগে পড়েননি,এই বইটা রিকমেন্ড করবো।বইটা পড়ে লেখকের অন্য বইগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
অমল কিছুদিনের জন্য তার বাবার বন্ধু আনন্দমোহন বাবুর বাড়ি বেড়াতে আসে। সেখানে এসে তার পরিচয় হয় আনন্দমোহন বাবুর মেয়ে ভ্রমরের সাথে।
"ভ্রমরের মুখটি ছোট, কপাল সরু, গাল দুটি পাতার মতন, চিবুক একেবারে প্রতিমার ছাঁদ। রঙ শ্যামলা। ঘন টানা টানা ভুরুর তলায় কালো কালো ডাগর দুটি চোখ। পাতলা নাক, পাতলা ঠোঁট। মানুষের মুখ দেখলে এত মায়া হয়—অমল জানত না। ভ্রমরের মুখ দেখে অমলের কেন যেন মনে হয়, এমন মুখ আর সে দেখে নি। ফুলের মত ভাল। সুন্দর, দুঃখী, শান্ত মুখ।"
ছোটোবেলায় ভ্রমর তার মাকে হারানোর পর তার বাবা আবার বিয়ে করে। কিন্তু সেই মা, তার মেয়ে কৃষ্ণা কেউই ভ্রমরকে সেই অর্থে কখনও ভালোবাসেনি। ভ্রমর প্রায়শই অসুস্থ থাকে বলে তার সৎ মা তাকে অপছন্দই করে। এছাড়া তার বাবাও তার প্রতি কর্তব্য পালন করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করেনি। ফলে সে বাবার ওপরেও ছিল অপ্রসন্ন। তাই চাইতেও সে কখনও তাদের ভালোবাসতে পারেনি।
কিন্তু অমল আসার পর থেকে সব পালটে যেতে থাকে। একদিকে ভ্রমর যেখানে চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের, অন্যদিকে অমল তেমন চঞ্চল স্বভাবের, সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু স্বভাবে বিপরীত হওয়ার পরও দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায় গাঢ়। ভ্রমর অমলকে দিওয়ালির দিন রাজবাড়ির মাঠে বাজ��� পোড়ানো দেখাতে নিয়ে যায়, একসাথে নানা জায়গায় ঘোরায়। অমল উপলব্ধি করে ভ্রমরের কাছে থাকতে তার ভালো লাগে। "ভ্রমরের কাছাকাছি, ভ্রমরের পাশাপাশি থাকতেই অমলের ভাল লাগে।" ভ্রমরেরও অমলকে আপন মনে হতে থাকে। আর এখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। ভ্রমরের মনে হয় অমল তার জন্য অনেক ভালোবাসা নিয়ে এসেছে। ছোটো থেকে তার জীবনে যে যত্ন, ভালোবাসার অভাব ছিল অমল এসে তা পূরণ করে, অমলের ভালোবাসা তাকে বাঁচতে শেখায়। তার মনে হয়, "ভালবাসা পেলে অসুখ থাকে না"
অমলের এতো যত্ন, ভালোবাসার পরেও ভ্রমরের জীবন কিন্তু স্বাভাবিক ছন্দে চলে না। কেন স্বাভাবিক ছন্দে চলে না, কী হয় এরপর তা পাঠকরা পড়ে দেখুক। আমি এর বেশি আর বিষয়বস্তু লিখছি না।
গতকাল সারাদিন ধরে এক মধুর প্রেমের কাহিনীর সাক্ষাৎ হলাম। যেখানে নেই কোনো লোক দেখানো প্রেম, নেই কোনো সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নেই কোনো শারীরিক চাহিদা। আছে কেবল একে অপরের প্রতি অগাধ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যা শীতের দুপুরের মিষ্টি রোদের মতো স্নিগ্ধ। অমলের ঘন ঘন সিগারেট খাওয়ায় ভ্রমরের অভিমান, ভ্রমরের জ্বর আছে কিনা দেখার জন্য অমলের তার কপাল ছুঁয়ে দেখা, ভ্রমরের দুঃখ-কষ্টে তার কষ্ট পাওয়া, তার জন্য চিন্তা, তাদের প্রতি মুহূর্তের খুনসুটি, এসবের মধ্যে দিয়েই একে অপরের প্রতি অমোঘ টান, নিষ্পাপ- অগভীর ভালোবাসা ফুটে ওঠে। সত্যিই ভালোবাসা তো এমনই হয়। লেখক যেভাবে এই নিষ্পাপ, সুমধুর প্রেম কাহিনী রচনা করেছেন তার জন্য সত্যিই তাঁকে প্রণাম জানাই। এক সহজ সাধারণ লেখাকে তিনি এক আলাদাই মাত্রা দিয়েছেন। মন ছুঁয়ে গেছে একদম।
জানি অনেকেরই পড়া এই বই। কিন্তু যারা এখনও পড়েননি, তাদের বলবো দ্রুত পড়ে দেখুন। আশা করি খুব ভালো লাগবে। পাঠে থাকুন।
"আমিও তোমায় দেখতে পাব না।...তবু, তুমি আমার কথা ভাববে সব সময়, আমি তোমার কথা ভাবব।" "আমিও সারাক্ষণ তোমায় ভাবব, ভ্রমর; সকালে দুপুরে রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও।"
একদম ছোটোবেলায় যখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিলেন লেখক। ভালোবাসা যে এত সহজ, সরল, সুন্দর হয়; সেটা ভুলেই গেছিলাম! গল্পটা শেষ হয়েও হয়নি, একটা ভারাক্রান্ত শেষের আভাস দিয়ে গেছেন লেখক। অমল আর ভ্রমর অনেক বড়ো হোক আর অনেক খুশি হোক।।
ভ্রমর আর অমল, আর তাদের একটি সাধারণ গল্প। কিন্তু সেই সাধারণ গল্পই যেন কখন অসাধারণ হয়ে উঠেছে, আর সেখানেই বিমল করের লেখার সার্থকতা!!!
একটি মেয়ে যে মাকে হারিয়েছে সেই কোন ছোটবেলায়, মার স্মৃতি তার কাছে খুবই আবছা, একটা ভীষণ দুঃখ, মা খুব দুঃখে ছিলেন, বাবার যেন সব সময়ই মনে হয়েছে যে তিনি মাকে বিয়ে করে খুব ভুল করেছেন। আর ভ্রমর সেও তো কম দুঃখী ছিলনা ! বাবা তাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে হিমানীমা কে বিয়ে করেছিলেন আর তার সাথে আপন করে নিয়েছিলেন হিমানীমার্ মেয়ে কৃষ্ণাকেও। ভ্রমর কোনোদিনও বাবা বা হিমানিমায়ের বিচার করেননি। কারণ মা বাবার বিচার করা যায়না । হিমানিমার কাছে ভালোবাসা সে কোনোদিনও পাইনি।
এই সময় অমলই ছিল একজন যে তাকে ভালোবাসা কি তা জানতে শিখিয়েছিলো। অমলই ছিল একজন যে ভ্রমরকে বেঁচে থাকার আশা জাগিয়েছিল। আর তাই তাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল ভ্রমর। এভাবেই খড়কুটো দিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়ে ছিল ভ্রমর।
কিন্তু তার অসুখ আর অসুস্থতাই অমলকে এক অনিশ্চয়ত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ভ্রমরের আশ্বাস ছিল সে ফিরবেই অমলের কাছে।
বইটিতে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে। অমল আর ভ্রমরের ভালোবাসার রোমাঞ্চ। এক ভীষণ দুঃখ আছে। সব সময়ই যেন মনে হচ্ছিলো ভ্রমরের যেন কিছু না হয়। ভ্রমর যেন ভালো থাকে। বইটির মাঝখান থাকতে থাকতেই শেষ পাতাটা পড়েছিলাম। শুধু এইটুকু জানতে যে ভ্রমর ভালো আছে...
📝 ‘খড়কুটো’ একটি প্রেমের গল্প । ভ্রমর আর অমলের গল্প । দুজন মানব-মানবী যেমন স্বাভাবিক নিয়মেই পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে, এই গল্পটিও ঠিক সেইরকমই । খুব সাধারণ প্রেমের গল্পে যা কিছু থাকা প্রয়োজন সেই সবকিছুই আছে এই গল্পে । কিন্তু, গল্পটি তো বিমল করের লেখা... তাই পড়তে পড়তেই অনুভব করতে পারবেন কখন যেন এই সাধারণ গল্পটিই অসাধারণ হয়ে উঠেছে ।
▪️গল্পের শুরুটা খুবই সাধারণ । কিন্তু তা সত্বেও... লেখনীর গুণেই হোক বা অন্য কিছুর টানে, গল্পটি অদ্ভুত ভাবে আকর্ষণ করে রাখে আমাকে । তারপর পড়তে পড়তেই মন যেন অজান্তেই প্রশ্ন করে - “ভালোবাসার গল্প এতটা সুন্দর হয় ?”
📝 সদ্য অসুখ থেকে ওঠা অমল এসেছে তার এক পিতৃবন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন হাওয়াবদল করতে, সে বাড়িতেই আছে ভ্রমর । সে মা-মরা মেয়ে, বাবা, সৎ মা ও সৎ বােনের সংসারে সে নিজেকে সবসময় ছায়ার মতোই লুকিয়ে রাখে । অমল একটু কৌতুহলী, একটু ছটফটে । ভ্রমরের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গী সত্ত্বেও দুজনের ভেতরে সুন্দর নির্মল এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । ভ্রমরকে এর আগে কেউ এত প্রশ্ন করেনি, কেউ কপালে হাত দিয়ে ভ্রমরের জ্বর এসেছে কিনা কখনো দেখতে চায়নি । অপরদিকে, নিজের বাড়ি থেকে দূরে ভ্রমরদের বাড়িতে থাকতে থাকতে অমলও একাকীত্বের সম্মুখীন হয়, এবং ভ্রমরের বন্ধুত্ব ও তার সঙ্গে গল্প করা, একসঙ্গে ঘুরতে বেরােনাের মধ্যে সুন্দর, নির্মল একটা আনন্দ খুঁজে পায় সে । এইভাবে একদিন নিজেদের অজান্তেই একটু কাছে চলে আসে দুটি মন । অমল, ভ্রমর - এরা খুবই সাধারণ চরিত্র, যেন আমাদের ভীষণ পরিচিত, নিতান্তই আটপৌরে । তাই তাদের মধ্যে যখন একটা কি যেন সম্মন্ধ গড়ে ওঠে, তা কোনাে অযাচিত ঢেউ তােলেনা চারপাশে । অথচ সবার অলক্ষ্যে একটা স্রোত বইতে থাকে, এক অচেনা অনুভূতির উপলব্ধি হয় একে অপরের প্রতি । তাদের এই প্রেমের সাথে মিশে থাকে অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা, ঠিক যেন শীতের সকালের মিঠে রোদের মতো ।
📝 ভ্রমরের শরীর খুব একটা ভালাে নেই । মাঝে মধ্যে জ্বর আসে । গল্পের প্রথম থেকেই এটা পাঠকের মনের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে । তবুও অমলের সান্নিধ্যে ভ্রমর যেন অনেকটা সুস্থ, অনেকটা খুশী হয়ে ওঠে । মা-হারা মেয়ে, যে কিনা তার সৎ-মায়ের কাছে কোনোদিনও ভালোবাসা পায়নি, অথচ সে কখনো তার বাবা এবং সৎ-মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধাশীল হতে শেখেনি । সেই সময় অমলই ছিল একমাত্র যে তার সত্যিকারের ‘কাছের মানুষ’ । অমলই তাকে ‘ভালােবাসা কি’ তা জানতে শিখিয়েছিলাে । অমলই ছিল একজন যে ভ্রমরকে বেঁচে থাকার আশা জাগিয়েছিল । আর ঠিক যেভাবে একজন ডুবন্ত মানুষ একটা ‘খড়কুটো’ আশ্রয় করেও বেঁচে থাকতে চায়... ভ্রমরও ঠিক সেইভাবেই অমল নামের ‘খড়কুটো’ অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল ।
▪️আসলে ভ্রমর চরিত্রটি লেখক এত সরলতা আর মমত্ববোধ দিয়ে তৈরী করেছেন যে... প্রত্যেক পাঠকই ভ্রমরের কষ্ট অনুভব করতে, তার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে বাধ্য হবে । আমার নিজের পড়তে পড়তে সবসময়ই মনে হচ্ছিলা ভ্রমরের যেন কিছু না হয়, ভ্রমর য��ন ভালাে থাকে ।
📝 এই গল্পের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হল গল্পটির ‘সরলতা’ । বিমল করের সমস্ত লেখার মূল উপাদানই হল সরলতা । ঘটনার ঘনঘটা নয়, বরং সাদামাটা, আপাতদৃষ্টিতে বিবর্ণ জীবনের কোটর থেকে তুলে আনা কিছু উপাদান দিয়ে তিনি রচনা করেছেন তার উপন্যাস গুলিকে ।
📜 এই যে একে অপরকে বুঝতে পারার এক আশ্চর্য অনুভূতি, কারাে জন্যে মন কেমন করা, কারাে জন্যে পথ চেয়ে থাকা, একটি নুতন মানুষের জন্যে আরেকটি মানুষের মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ওঠা... এ নিতান্তই সহজ-সরল ভালবাসার চিহ্ন । যদি আপনি কখনো কোনো একজনের প্রতি আপনার বুকের মধ্যে এইরকম অনুভূতি বহন করে থাকেন, তাহলে অমল আর ভ্রমরের এই ভালােবাসা আপনাকে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য ।
"সব ভালো জিনিসই দূরের, অনেক দূরের৷ ভগবান দূরে থাকেন৷ ভালোবাসাও বোধহয় ভগবানের মত দূরে থাকেন৷"
সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে হাওয়া বদলের তাগিদে অমল এসে উঠেছে পিতৃবন্ধু আনন্দমোহনের বাড়িতে। সেখানে তার দেখা হয় আনন্দমোহনের ঔরসজাত কন্যা ভ্রমরের সঙ্গে। "ভ্রমরের মুখটি ছোট, কপাল সরু, গাল দুটি পাতার মতন, চিবুক একেবারে প্রতিমার ছাঁদ। রঙ শ্যামলা। ঘন টানা টানা ভুরুর তলায় কালো কালো ডাগর দুটি চোখ। পাতলা নাক, পাতলা ঠোঁট। মানুষের মুখ দেখলে এত মায়া হয়—অমল জানত না। ভ্রমরের মুখ দেখে অমলের কেন যেন মনে হয়, এমন মুখ আর সে দেখে নি। ফুলের মত ভাল। সুন্দর, দুঃখী, শান্ত মুখ।"
ভ্রমর বড় দুঃখী। সে শৈশবেই তার মাকে হারিয়েছে। তার বাবাও তাকে বোঝেনা। মায়ের মৃত্যুর পর ভ্রমরকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে হিমানী মা কে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছে বাবা। নিয়ে এসেছেন হিমানী মার মেয়ে কৃষ্ণাকেও। ভ্রমর জানে, মাকেও খুশি রাখতে পারেনি তার বাবা। মাকে বিয়ে করার পরই বাবার মনে হয়েছিল তিনি ভুল করে ফেলেছেন। অন্যদিকে , উপন্যাসের শুরু থেকেই আমরা দেখতে পাই, ভ্রমর বারে বারে জ্বরে ভোগে। পাঠককে বড় চিন্তায় ফেলে ভ্রমরের এই অসুখ। নিজের বাবা ভ্রমরের যত্ন নেয় না, এমনকি তার সৎ মাও তার অসুখে বিরক্ত হয়। ভ্রমরেরও তাঁর কাছ থেকে কোন প্রত্যাশা নেই। সে তাকে নিজের বলে মনে করে না। নিজের সৎ বোনের সঙ্গেও ভাব নেই ভ্রমরের। সে বড্ডো একা। মেয়েটির এই একাকী জীবনে বসন্তের বাতাস বয়ে আনে অমল; বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। ঘুচিয়ে দেয় তার একাকীত্ব। অমল ভাবে, "ভালোবাসা পেলে অসুখ থাকে না।"
রাজবাড়ির মাঠে জোনাকিবাজি দেখতে যাওয়া, চকবাজারে বাজার করতে যাওয়া, টাঙায় করে বাড়ি ফেরা আর গল্প, আড্ডা, নানান খুনসুঁটির মধ্যে দিয়ে তাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কের গণ্ডি পেরিয়ে কড়া নাড়ে অন্য এক গহীন অনুভূতির দরজায়। সে কি ভালবাসা না স্নেহ না অন্য কিছু? এসব কিছু ওরা বোঝে না। শুধু অমল এটুকু বোঝে, "ভ্রমরের কাছাকাছি, ভ্রমরের পাশাপাশি থাকতেই অমলের ভাল লাগে।"
নর-নারীর এক চিরন্তন সম্পর্কের গল্প বলে এই উপন্যাস। নিতান্তই সাদামাটা এর কাহিনী, সেই অর্থে কোনো ওঠা পড়া নেই। কিন্তু লেখক যে বিমল কর! তাঁর লেখার গুণেই এই সরল আখ্যান হয়ে উঠেছে এক মনমুগ্ধকর লেখা। এছাড়াও উপন্যাসে উঠে এসেছে প্রকৃতির অসামান্য বর্ণনা। যেমন এক জায়গায় লেখক লিখেছেন, "এখন সব চুপচাপ, সব শান্ত। বাগানে সবুজ ঘাসে কখনও দু-একটা ফড়িং, দু-চারটে চড়ুই নাচানাচি করছে। কোথাও বুঝি এ-বাড়ির কাক ও-বাড়ির কাকের সঙ্গে গল্প করছিল, তাদের কা-কা ডাক থেকে অমলের সেই রকম মনে হল। ভ্রমরের বেড়ালটাও ফলবাগানের কাছে খানিক ঘোরাঘুরি করে বারান্দায় গিয়ে গা-গটিয়ে ঘুমোতে শুরু করেছে। আকাশের দিকে তাকাল অমল। অনেক যেন উঁচুতে উঠে গেছে আকাশ, খুব গভীর দেখাচ্ছে; রোদের তলা দিয়ে অনেক গভীরে যেন আকাশ দেখছে। বিন্দু-বিন্দু কালো ফোঁটা হয়ে চিল উড়ছে ওখানে। সাদা মতন একটুকরো মেঘ একপাশে দ্বীপের মতন পড়ে আছে, সেখানে চিল নেই, আকাশের নীল নেই।"
বিমল করের লেখা এই প্রথম পড়লাম। এই উপন্যাস সুন্দর। ফাল্গুনের বিকেলে পশ্চিমের আকাশটায় যেমন লালচে- হলুদ গাঁদাফুলের মত রং ধরে থাকে, তেমনই নির্মল আর স্নিগ্ধ এই উপন্যাস।
"সব ভালো জিনিসই দূরের, অনেক দূরের৷ ভগবান দূরে থাকেন৷ ভালোবাসাও বোধহয় ভগবানের মত দূরে থাকেন৷"
গল্প সংক্ষেপ📝- অমল কিছুদির হাওয়া-বদলের জন্য তার বাবার বন্ধু আনন্দমোহনের বাড়ি এসে ওঠে কিছুদিনের জন্য৷ সেখানেই আনন্দমোহনের বড় মেয়ে ভ্রমরের সঙ্গে তার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন গড়ে ওঠে৷ না, ঠিক প্রেম হয়তো নয়৷ নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক, যেটা আস্তে আস্তে নিখাদ ভালোবাসায় পরিণত হয়৷ অন্যদিকে ভ্রমরের সৎ মা হিমানী ও বোন কৃষ্ণা কে সে কোনোদিন নিজের করে মেনে নিতে পারেনি ৷ তাই ভ্রমরের জীবনে ভালোবাসার অভাব ছিল, যা অমল এসে পূরণ করে৷ তবে ভ্রমরের জীবন কোনোদিনই সরল ছিল না৷ একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত ভ্রমর সত্যিই কি পারবে আবার অমলের কাছে ফিরে আসতে?
পাঠ-অনুভূতি📝- এই উপন্যাসে সেই অর্থে কোনো নির্দিষ্ট গল্প নেই, ঘটনা নেই৷ আছে অসাধারণ লেখনী, চরিত্রগঠন, মন ছুঁয়ে যাওয়া কিছু বর্ণনা আর অমল আর ভ্রমরের মধ্যে ঘটে চলা অসাধারণ কিছু সংলাপ৷ ব্যাস এইটুকুই বইটা ভালোলাগার জন্য যথেষ্ট ৷ ◾এখানে কোথাও লোক দেখানো ভালোবাসা নেই৷ ঘটা করে কোথাও বলা নেই "আমি তোমাকে ভালোবাসি৷" কিন্তু অমল আর ভ্রমরের মধ্যে যে সম্পর্কটা আছে সেটা একদম নিখাদ, ইনোসেন্ট, নিষ্পাপ৷ সেখানে কোনো উদ্দেশ্য নেই কোনো চাওয়া পাওয়া নেই, কোনো প্রত্যাশা নেই৷ আছে শুধু দুজন দুজনের প্রতি একটা সুন্দর অনুভূতি, একদম খাঁটি৷ ◾এই উপন্যাসের পাঠকরা প্রতিমুহূর্তে শুধু ওদের দুজনের ভালো চাইবে৷ ওরা যেন ভালো থাকে, ভ্রমরের মধ্যে এমন একটা ইনোসেন্স আছে যেটার জোড়েই সে পাঠকদের মনে জায়গা করে নেয়৷ শেষের দিকটা পড়তে পড়তে শুধু এটাই মনে হয়েছে, ভ্রমর যেন ভালো হয়ে যায়৷ সে যেন আবার অমলের কাছে ফিরে আসতে পারে৷
-- "আমি তোমায় দেখতে পাবো না৷..তবু, তুমি আমার কথা ভাববে সব সময়, আমিও তোমার কথা ভাববো৷" -- "আমিও সবসময় তোমার কথা ভাববো, ভ্রমর; সকালে, দুপুরে, রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও৷"
বেশ অনেকদিন সময় নিয়ে অল্প অল্প করে পড়া হলো বিমল করের এই ছোট্ট পাখির পালকের মত স্নিগ্ধসুন্দর উপন্যাসটি। গোটা উপন্যাস জুড়েই এত এত উপমা ব্যবহার করেছেন, আর এত গভীর ডিটেইলস প্রত্যেকটা বিষয়ের, যার কারণে গল্পের চেয়ে এর ভাষাচিত্রই মুখ্য হয়ে উঠছিল প্রায়শ। গতানুগতিক প্রেমের উপন্যাস কেমন হুটহাট তড়িঘড়ি করে অনেককিছু শুরু হয়ে যায় আবার শেষও হয়ে যায়। দৃশ্যের পর দৃশ্য পাল্টাতে থাকে। কিন্তু 'খড়কুটো' এই যাত্রায় বোধহয় এক ভিন্ন পরিকল্পনা। একটু খচখচে যা লেগেছে, ক্রিয়াপদ; পরপর অনেকগুলো বাক্যে ক্রিয়াপদটা শেষে চলে যাচ্ছিল। ফলে বিরক্তি ধরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারপরও বারবার বিভিন্ন বর্ণনার ভিতর ওইটুকু বোধ হারিয়ে গেছে শেষে। অনেক ভারী ভারী সাহিত্য পড়ে ক্লান্ত কোনো পাঠক এই হালকা ধাঁচের কাহিনিটা শুরু করতেই পারেন। মন্দ কী!
ভ্রমর আর অমলের বেদনাবিধুর, নিষ্পাপ, অতল, গভীর এক ভালবাসার কাহিনি। অসুখে ক্লিষ্ট ভ্রমরের মা নেই, বাবা বিয়ে করেছে হিমানীমাকে আর আছে কৃষ্ণা। ভগবান যিশুর ভক্ত ভ্রমর চায় সবাইকে ভালবাসতে, পেরে ওঠে না। তাকেও সম্পূর্ণত ভালবাসার যেন কেউ কোথাও নেই। এমত সময়ে অমল আর ভ্রমরের হৃদ্যতা গাঢ় হয়ে ওঠে। ভ্রমর নাগপুরে যায় অসুখ সারাতে। আর অপেক্ষার খড়কুটো জমা হয় অমল আর ভ্রমরের ওষ্ঠপুটে।
Those who want to fall in love with the idea of love, the book fits perfect for them.A tranquil love story without anything that will lead you to the peak of exitation. Probably this thing makes this one a must read classic Bengali novel.
প্যানপেনে প্রেমের গল্পে ভীষণ বিতৃষ্ণা অনুভব করি। কারণটা বিষয়বস্তুর জন্য নয়। উপস্থাপনার জন্য। সেইজন্যই হয়তো বিমল করের খড়কুটো-র প্রথম কয়েক পাতা যখন পড়ি, মনে একটু শঙ্কা জেগেছিল। এটাও কি ”তুমি আমার, আমি তোমার”, “আমরা অমরসঙ্গী”-তেই পরিণতি পাবে? এটা কি মাঝপথেই আমাকে ছেড়ে দিতে হবে? কিন্তু কি যেন একটা বিষণ্বতা অপেক্ষা করছে মনে হচ্ছে শেষের জন্য? তাই তো প্রথম কয়েক পাতা একটু বোরিং লাগলেও সেই লুকিয়ে থাকা কি যেন এক সৌন্দর্যের আকর্ষণে পড়তে থাকি। এবং তারপরেই এক সুন্দর উপলব্ধি, এক নির্মল সৌন্দর্যের ঠান্ডা শীতল হাওয়া যেন এসে মুখে আছড়ে পড়ে।
প্রেম এতটা সুন্দরও হয়?
ভ্রমর বাল্যকালে মাতৃহারা। বাবা এবং বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর থেকে কোনোদিনই আন্তরিকতা না পাওয়ায় কেমন যেন মলিন, ম্লান ভ্রমর নামের মেয়েটির মন। তাদের বাড়িতে অমলের আবির্ভাব ঘটে। অমল একটু কৌতূহলী, একটু ছটফটে। ভ্রমরের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গী সত্ত্বেও দুজনের ভেতরে সুন্দর নির্মল এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভ্রমরকে এর আগে কেউ এত প্রশ্ন করেনি, কেউ কপালে হাত দিয়ে ভ্রমরের জ্বর এসেছে দেখে খেয়াল রাখতে চায়নি। নিজেকে ধার্মিক দিক থেকে আলাদা করে রাখতে চাইলেও নিজের মনের ঈশ্বর ও অমল - এই দুটি সত্ত্বার সঙ্গে ভ্রমরের খুব ভালোবাসা হয়ে যায়। ভ্রমর বিশ্বাস করে ঈশ্বর নিষ্ঠুর নন, তিনি ভ্রমর ও সকলের জন্যে মঙ্গল চান। নিজের বাড়ি থেকে দূরে ভ্রমরদের বাড়িতে থাকতে থাকতে অমলও একাকীত্বের সম্মুখীন হয়, এবং ভ্রমরের বন্ধুত্ব ও তার সঙ্গে গল্প করা, একসঙ্গে ঘুরতে বেরোনোর মধ্যে সুন্দর, নির্মল একটা আনন্দ খুঁজে পায়। এইভাবে একদিন নিজেদের অজান্তেই একটু কাছে চলে আসে দুটি মন। আর তারপর থেকেই দুজনে একে অপরকে মন থেকে খুব ভালোবাসতে শুরু করে। যদিও দুজনেই বাইরে থেকে একে অপরকে সোজাসুজি সেই ভালোলাগা নিয়ে বলতে লজ্জাবোধ করে, তবুও দুজনেই যেন নিজেদের একাকীত্বে ভরা জীবনে খুব সুন্দর এক “সারাজীবনের বন্ধু” খুঁজে পেয়ে আনন্দে বাক্যহারা হয়ে যায়। নির্মল ও সুন্দর ভালোলাগার আলোতে যেন ভ্রমর ও অমল, দুজনেই ঊজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিছুদিনের জন্য।
ভ্রমরের শরীর খুব একটা ভালো নেই। মাঝে মধ্যে জ্বর আসে। গল্পের প্রথম থেকেই এটা পাঠকের মনের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। অমলের সান্নিধ্যে ভ্রমর যেন অনেকটা সুস্থ, অনেকটা খুশী হয়ে ওঠে। কিন্তু তবু ভ্রমরকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কেমন যেন একটা চিন্তা। অমল এবং ভ্রমরের সুন্দর অপরিণত অথচ নির্মল প্রেম যখন আমার হৃদয়কে কেমন একটা মোহ দিয়ে আবিষ্ট করে ফেলেছে বইটার পাতায়, তখনই একই সঙ্গে আমার মনে ভ্রমরের শরীর খারাপ নিয়ে একটা সূক্ষ্ম দুশ্চিন্তাও যেন পাল তুলতে গিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এবং শেষের দিকে সেই কালো মেঘের সম্ভাব্য তান্ডব নিয়েই গল্পের উপসংহার। শেষে অমল বা ভ্রমরের ভালোবাসার পরিণতি নয়, তাদের একে অপরকে নিয়ে অন্তরে যে কতটা ভালোবাসা, কতটা কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে, সেটাই লেখা হয়েছে। শেষে কি হল সেটার থেকেও বড় কথা, দুটি তরুণ হৃদয় নিজেদের বাহ্যিক পৃথিবী থেকে পাওয়া একাকীত্বের মধ্যে কতটা আবেগপূর্ণভাবে একে অপরকে মন থেকে পেয়ে খুশী, অথচ বাস্তবতার আবির্ভাবে দুঃখিত, সেটাই এই উপন্যাসের উপসংহার।
সারা বই জুড়ে শীতকালের পরিবেশের অপূর্ব অথচ মনকেমন করা বর্ণণা। পড়তে পড়তে যেন এই প্রখর গ্রীষ্মেও ভ্রমর আর অমলের নরম রোদ্দুর পায়ে লাগা গল্পটুকু বুকে জায়গা করে নিল। প্রেম এত সুন্দর হয়তো বাস্তবে হয়না। বাস্তবে হয়তো অমল হয় না, ভ্রমরও হয় না। কিন্তু বুকের মধ্যে কোনো একজনকে নিয়ে যদি কখনও একটুও আনন্দ পেয়ে থাকেন নিজের ম্লান বাস্তবতায় ভরা পৃথিবীতে, তাহলে অমল আর ভ্রমরের এই ভালোবাসা পাঠককে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য।
প্রেমের বই বস্তাপচা হয় না। বিমল করের “খড়কুটো” তার নামকরণের দিক থেকে সার্থক। কখনো কখনো একটা মানুষের ভালোবাসাই যেন খড়কুটোর মত সম্বল হয় উপচে পড়া কান্না সামলিয়ে নতুন সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখার। সেটাই ভালোবাসা। আর এই বই সেই অর্থে সুন্দর একটি ভালোবাসার বই। অমল নই, তবু লিখতে চাই, ভালো থেকো ভ্রমর।