গল্পে আছে প্রধান পাঁচ টি চরিত্র – মোহিনী, অবিন, আয়না, সুহাস ও জ্যেঠামশাই । গোটা বইটি অদ্ভুত ভাবে সাজানো, এক একটি অধ্যায় এক এক জনের প্রেক্ষাপট ও দৃষ্টিভঙ্গি তে রচনা করা। প্রধান যে দুটি চরিত্র অর্থাৎ অবিন ও মোহিনী তাদের মানসিক ওঠাপড়া, সম্পর্কের জটিলতা সম্পূর্ণ গল্পটিকে ঘিরে রেখেছে। বই পড়তে পড়তে আমি বহুবার অবিন চরিত্রটির সাথে হুমায়ুন আহমেদের রচিত চরিত্র ‘হিমু’ বা ‘হিমালয়’ চরিত্রটির মিল পেয়েছি। আর হয়তো এই বিষয়টিই আমার ভালোলাগার অন্যতম একটি জায়গা। একটি অন্য ধরণের গল্প, বা উপস্থাপনা পড়ার ইচ্ছে থাকলে, এটি পড়তেই পারেন।
Bimal Kar (Bengali: বিমল কর) was an eminent Bengali writer and novelist. He received 1975 Sahitya Akademi Award in Bengali, by Sahitya Akademi, India's National Academy of Letters, for his novel Asamay.
বিমল কর-এর জন্ম ৩ আশ্বিন ১৩২৮। ইংরেজি ১৯২১। শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। জব্বলপুর, হাজারিবাগ, গোমো, ধানবাদ, আসানসোল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কর্মজীবন: ১৯৪২ সালে এ. আর. পি-তে ও ১৯৪৩ সালে আসানসোলে মিউনিশান প্রোডাকশন ডিপোয়। ১৯৪৪-এ রেলওয়ের চাকরি নিয়ে কাশী। মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরাগ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক, পরে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকা ও ‘সত্যযুগ’-এর সাব-এডিটর। এ-সবই ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে। ১৯৫৪-১৯৮২ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮২-১৯৮৪ ‘শিলাদিত্য’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক। বহু পুরস্কার। আনন্দ পুরস্কার ১৯৬৭ এবং ১৯৯২। অকাদেমি পুরস্কার ১৯৭৫। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ১৯৮১। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নরসিংহদাস পুরস্কার ১৯৮২। ‘ছোটগল্প—নতুন রীতি’ আন্দোলনের প্রবক্তা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশ কয়েকটা বিষয়ের উপর নির্ভর করে পড়ার জন্য বই নির্বাচন করি। কখনও স্রেফ লেখকের নাম, কখনও স্রেফ প্লট, কখনও বইয়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পজিটিভ রিভিউ আবার কখনও পুরস্কারপ্রাপ্তি। হুম, পুরস্কারপ্রাপ্ত বই আমার লিস্টে অটো চয়েজ হিসেবেই যুক্ত হয়। বিমল করের এই বইটাও আমি ডাউনলোড করি লেখকের এই বইটার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পাওয়ার জন্যই। লেখক এই বইটার জন্য ১৯৭৫ সালে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। ‘ দেখি তো কি আছে এতে যাতে বিচারকগণ উনাকে পুরস্কার দিলেন' ভেবেই শুরু করি বইটা, লেখকের লেখনী সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা সত্ত্বেও।
বাড়তি দু-চার কথা বলার আগে বইটার প্লটটা সম্পর্কে কিছু বলে নিই। প্লটটা আহামরি কিছু নয়। বলতে গেলে এক পরিবারের কয়েকজন মানুষের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে বইটাতে। জ্যাঠামশাইকে নিয়ে এক বাড়িতে থাকে মোহিনী, সঙ্গী ছোট বোন আয়না এবং কলকাতায় চাকুরি করা ভাই সুহাস। পারিবারিক বন্ধু শচিপতিকে নিয়ে একসময় ঘর বাঁধার স্বপ্ন ছিল মোহিনীর কিন্তু সেটা তো হলই না, বাবা-জ্যাঠার পছন্দ করা পাত্রের সংসারও মাস ছয়েকের বেশি করতে পারল না সে। এদিকে সুহাস একসময় একই গ্রামের বুলাকে পছন্দ করলেও কিছুটা দিদির জন্য ত্যাগস্বরূপ আর কিছুটা নিজের জন্য বুলাকে ভুলে যায় সে। বর্তমানে কলকাতায় পাশের ফ্ল্যাটের খ্রিস্টান ডাক্তার ইন্দুর সাথে কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে সে। আর আয়না গ্রামে তার একমাত্র সঙ্গী বন্ধু তপুকে শুধু বন্ধু হিসেবেই এতদিন দেখলেও যতই বাড়িতে তার বিয়ের কথা উঠছে ততই তপুকে ভিন্নরূপে আবিষ্কার করছে সে। আর এদের সবার সাথে আছে সুহাসের বন্ধু অবিন যে অল্পদিনেই মোহিনীর প্রায় সন্ন্যাসিনীর জীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সুহাসকে বাস্তবের দুনিয়ায় নেমে আসতে উদ্বুদ্ধ করছে, আয়নাকে নিজের সম্পর্কে সিরিয়াস হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে আর শচিপতিকে ভয়ংকর এক রোগের বিরুদ্ধে লড়তে উজ্জীবিত করছে।
যেসব বই পড়লে মনে হয় ‘ আরেহ! এসব তো আমার সাথেও ঘটেছে বা চরিত্রগুলোকে তো আমি চিনি', এই বইটা সেই ক্যাটাগরির। সহজ-সরল একটা প্লট আর সহজ ভাষায় লেখা বইটা বিভিন্ন ধরনের আবেগকে নিয়ে যেন খেলা করেছে। হাসি, কান্না, রাগ, বিরক্তি, আক্ষেপ, প্রেম, বন্ধুত্ব প্রতিটা বিষয়েরই স্বাদ দিয়েছে বইটা। আর সবচেয়ে ভালো যে দিক সেটা হলো মানব মনের অলিগলিতে পরিভ্রমণ করেছেন লেখক। প্রধান ছয়টি চরিত্রের কাছে গল্প বলার দ্বায়িত্ব দিয়ে লেখক একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন পাঠকের কাছে। তাছাড়া জীবনের কিছু মৌলিক প্রশ্ন যেমন সম্পর্ক, দ্বায়িত্ব, মতামত, স্বাধীনতা, মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে প্রতিটা চরিত্রকে দিয়ে কথা বলিয়েছেন। ফলে আমরা দেখতে পাই লিঙ্গভেদে, অবস্থাভেদে, পারিবারিক শিক্ষা বা মূল্যবোধভেদে কিভাবে একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে হাজির হয় ব্যক্তির কাছে। কেউ যেখানে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে জীবনের দিকে তাকানোর সময় পায় না সেখানে আরেকজন জীবনকে ছেড়ে দেয় ভাগ্যের হাতে আবার কেউ জীবনকে উপভোগ করতে চায় প্রতি মুহুর্তে। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো এত এত বৈপরীত্য সত্ত্বেও কারও মতামতকেই অগ্রাহ্য করা যায় না বা ফেলে দেওয়া যায় না কেননা পরিবেশ-পরিস্থিতির দাবিটা বোঝা যায় সহজেই। তাইতো সর্বদা মৃত্যুচিন্তা করা শচিপতিকে যেমন স্বাভাবিক মনে হয় তেমনি স্বাভাবিক মনে হয় বাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকা মোহিনী বা মৃত্যু জীবনের দাবি মেনেই আসবে বলে অপেক্ষা করা অবিনকেও।
লেখকের লেখনী চমৎকার। সহজ-সরল অথচ কেমন যেন চুম্বকের মতো টেনে ধরা একটা ভাষা ব্যবহার করেছেন লেখক। ফলে পড়তে কোনো সমস্যাই হয় না, পৌনে তিনশ পৃষ্ঠা কখন শেষ হয়ে যায় সে খেযালও থাকে না। সাথে প্রধান ছয় চরিত্রের বয়ানে গল্প বলার বিষয়টাও বেশ ইউনিক ছিল। নামকরণের বিষয়টাও ভালো ছিল, ‘অসময়’ নামটা ক্লাইম্যাক্সের সাথে যেমন খাপ খেয়েছে তেমনি খাপ খেয়েছে প্রতিটা চরিত্রের অবস্থার সাথেও। সহজ কথা সহজে বলার অসাধারণ একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বইটা।
এই বুধবার, সকালে ট্রেনে যেতে যেতে বন্ধুর সাথে আলাপচারিতা করছি, পাশ থেকে এক হিন্দুস্তানি ছেলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার চওড়া দুরভাষ যন্ত্রে একটি ভিডিও দেখাল। আমি দেখলাম, কিভাবে জঙ্গিরা একটি মানুষ কে রাস্তায় ফেলে অতি অনায়াসে তার গলা টি কেটে দিল। ছেদিত মানুষটির আখিপল্লব অবসন্নের মতো পিট-পিট করছিল আর আমি স্থির দৃষ্টিতে দেখছিলাম মানুষ কত অমানবিক হতে পারে! আমার তখন শুধু অবন্তি, অর্থাৎ অবিন এর কথাই মনে এল। সে বলত, আমরা যে সভ্যতার গর্ব বোধ করি তা কেবলমাত্র হাতে গোনা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের অগ্রগতির ফসল। হয়ত শতকরা দশজনের জীবনের, ভাবনার উদাহরন টেনে আমারা বড়াই করি যে বাকি নব্বই জনও একই ভাবনায় সংপৃক্ত। সত্যটা আসলে এই যে ওই দশজন যখন দৌড়াচ্ছে, বাকিরা তাদের হামাগুড়ি শৈশবের গন্ডি পেরচ্ছে। অবিন এর কথাটি তাই বড় সত্যি। এরকম নিষ্ঠুর হওয়ার জন্যে মানবজাতির সভ্য হওয়ার মিথ্যাচার না করলেও চলে। কিন্তু এমন করে কেই বা ভাবে? অবিন না হয় ছন্নছাড়া, ঝড়ের মত, জীবনের সবটা সে তার মত করে সত্য-মিথ্যার কষ্ঠি পাথরে যাচাই করে নেয়। কিন্তু তার বন্ধু সুহাস যার বাড়ি অবিন গিয়েছিল? সুহাসের দিদি মোহিনী যে জীবনের পরাজয়টা একরকম ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে? সুহাসের জ্যাঠামশাই যিনি এই পড়ন্ত বয়েসে আর নুতন করে কিছু ভাবতে চাননা? সুহাসের বোন আয়না যে তাদের ক্ষয় ধরা বাড়ীর মান মর্যাদা মাথায় নিয়ে তার যৌবনের ভাবাবেগ কে অযাচিত শৃংখলে বদ্ধ করে রেখেছে? পড়শি শচিপতি, বিনু, তপু ও আরও যারা যারা আছে তারা তো ওমনি করে ভাবে না! কেউ ভাবে না আর তাই অবিন কে দেখে, তার কথা শুনে মোহিনীর বুক দুরুদুরু করে, শিউরে ওঠে এক অজানা ভয়ে। তার ভয় হয় অবিন বুঝি তছনছ করে দেবে তার এই মধ্য যৌবনের দেরাজের কোনে রাখা সাদামাঠা জীবন। সত্যি কি অবিন এসে ভেঙ্গে দেবে তাদের এই ক্ষয়িষ্ণু অথচ অচলায়তন সদৃশ মান মর্যাদা বোধ? আর্গল ভেঙ্গে নিয়ে আসবে মোহিনির জীবনে নুতন প্রবাহ! বাকিদেরই বা কি হবে? বিমল করের এই বইটিও তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে রচনা করেছেন বিভিন্ন জনের জবানিতে। বইটি ১৯৭৫ এ সাহিত্য একদেমী পুরষ্কার লাভ করে। লেখক তার নৈর্ব্যাক্তিক লেখনীতে তুলে এনেছেন বিহারস্থিত সুহাসের আদি বাড়ি ও তার চারি পাশের স্তমিত কিন্তু সদা প্রবাহমান জীবন। তিনি তার দক্ষ হাতে একেছেন কলকাতার নগরজীবনের খন্ডচিত্র। এক অসামান্য রঙ্-তুলিতে একেছেন তীব্র গ্রীষ্ম ও তার পশ্চাতে ধেয়ে আসা ঘনঘোর বর্ষার চালচিত্র। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত জীবনের এ খন্ডচিত্র যদিও পাঠকের মনে চম্ক জাগায় না তবে স্বস্তি দেয়।
অনেক দিন পর একটা খুব হালকা ধাঁচ এর সাধারণ উপন্যাস পড়লাম, যেখানে দেখালো সমাজের এক্টু বেনিয়ম কিভাবে অনেকগুলো জীবনকে স্থবির করে দিতে পারে, খাচার পশুর মত বেঁধে দিতে পারে। সেই বাঁধা পড়া সময়টাতে প্রত্যেক্টা জীব কিভাবে নিজের মত করে জীবনকে, সমাজকে দেখে দেখে বাধা পড়ে, তার একটা চমৎকার আখ্যান। বইটার মধ্যে অনেক গুলো পা��্চ লাইন আছে, বুঝতে পারলে ভালো লাগতেই হবে।
লেখক বিমল করের লেখা 'অসময়' উপন্যাসটি ছয়টি মূখ্য চরিত্র যথা মোহিনী, তার বোন আয়না, মোহিনীর ভাই তথা আয়নার দাদা সুহাস, তাদের জ্যাঠামশাই, সুহাসের বন্ধু অবন্তী ওরফে অবিন এবং সুহাসদের পাড়ার তথা ওদের পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শচিপতিকে নিয়ে।
পঁয়ত্রিশ বছরের মোহিনী এক বুদ্ধিমতী ও দায়িত্ববান মহিলা। অল্প বয়সে শচিপতির সাথে তার ঘর বাঁধার ইচ্ছে থাকলেও, বাবার পছন্দ অনুযায়ী তার অন্য একজনের সাথে বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ে হলেও, সংসার তার হয়নি স্বামীর দুশ্চরিত্রের কারণে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সে শ্বশুরবাড়ির পাঠ মিটিয়ে চিরতরের জন্য চলে আসে বাপের বাড়ি। ধীরে ধীরে সংসারের সব দায়িত্বের ভার চলে আসে তার কাঁধে।
অন্যদিকে তার বোন আয়না, বয়স পঁচিশ পেরিয়ে গেলেও সে এখনও অবিবাহিত। মনে মনে সে একজনকে ভালোবাসলেও, দিদির দুর্ভাগ্যতা দেখে এবং পারিবারিক জটিলতার কারণে, তার বলার আর সাহস হয় না। চায় সে সবকিছুকে গোপন রাখতে। কিন্তু সবকিছু কি গোপন রাখা যায়?
মোহিনীর ভাই তথা আয়নার দাদা সুহাস, সে কাজের সূত্রে কলকাতায় থাকে। তবে যখনই দেশের বাড়িতে আসে তখনই কোনো না কোনো বন্ধুকে নিয়ে আসে। এরকমই সে একদিন নিয়ে চলে আসে অবন্তী ওরফে অবিনকে। আর এই অসময়ে অবিনের আসার সাথে সাথেই চির ধরে যেতে থাকে মোহিনীর এতদিনের বন্ধ করে রাখা মনের দরজায়। কিন্তু বন্ধ দরজা কি এতো সহজেই ভাঙা যায়, যতোই সেখানে চির ধরুক?
তবে অবিনের এই অসময়ে আসা কেবল, মোহিনীর জোরপূর্বক সন্ন্যাসিনী হয়ে থাকার জীবন নিয়েই প্রশ্ন তোলেনি, তার আসা আয়না সহ সুহাস, জ্যাঠামশাই ও শচিপতির জীবনকেও পরিবর্তন করে তোলে। 'অসময়' নাম হয়তো এখানেই সার্থক।
একটা পরিবার ও তার সাথে জড়িত কয়েকজন মানুষের হাসি, কান্না, রাগ, আক্ষেপ, প্রেম, বন্ধুত্ব সহ নানান আবেগের ঘনঘটা নিয়ে লেখা এই উপন্যাস। এখানে দেখা গেছে একই জিনিসের উপর ভিত্তি করে হলেও ব্যক্তিভেদে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ভিন্ন। যেখানে শচিপতির কাছে জীবনকে উপভোগ না করে মৃত্যুর অপেক্ষা করা শ্রেয় বলে মনে হয়, ঠিক তেমনই অবিনের মনে হয় মৃত্যু, জীবনের অংশ, অর্থাৎ সে জীবনের দাবি মেনেই আসবে, তারজন্য আগে থেকে অপেক্ষা করা বোকামি। অন্যদিকে মোহিনীর মূল্যবোধ যেমন তার কাছে তার দায়িত্ব বলে মনে হয়, ঠিক তেমনই আবার অবিনের কাছে তা ভিত্তিহীন।
সকলের মতামত গত পার্থক্য থাকলেও লেখক মূখ্য ছয়টি চরিত্রকে দিয়ে যেভাবে কাহিনী বলিয়েছেন, তাতে সকলের পৃথক দৃষ্টিভঙ্গির দাবি বোঝা যায়, অগ্রাহ্য করা যায় না কাউকেই।
সেই 'খড়কুটো' পড়ে লেখকের লেখার ভক্ত হয়েছিলাম। আজ এতদিন পর আবার এই বই সেই পুরনো স্বাদের আভাস দিল। লেখকের ভাষাগত সহজ সরলতা, আবারও মন ভরিয়ে তুললো। টেনে নিয়ে গেল অনায়াসে পাতার পর পাতায়। এককথায় দারুন লাগলো উপন্যাসটা।
বহুদিন পর আবারও একটা দারুন ক্লাসিক পড়লাম, যার রেশ অনেকদিন থেকে যাবে। পাঠকদের বলবো, যারা এখনও এই বই পড়েননি, পারলে একবার পড়ে দেখবেন। আশা করি ভালো লাগবে। পাঠে থাকুন।
লেখকের লেখার স্টাইলটা খুবই চমৎকার ছিলো । গল্পের প্রতিটা চরিত্রকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তার এবং তাদের আশেপাশের পরিস্থিতির বর্ননা করিয়েছেন । সবাই তাদের নিজের দিক দিয়ে সঠিক , কিন্তু একজন আরেকজনের দিক থেকে সঠিক না। লেখক একটা জায়গায় অনেক গুলো মানুষকে জড় করে তাদের প্রত্যেককে তাদের মতো করে বলার সুযোগ করে দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন আমরা আসলে মুখে যা বলি মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করি না আবার মনে মনে যেটাকে ধ্রুব সত্য ভেবে থাকি তা কখনো বাইরে প্রকাশ করি না। - এটা একটা পরিবারের কয়েকজন সদস্যের জীবনের গল্প আর তাদের জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত না থেকেও অদ্ভুতভাবে প্রভাব ফেলা কিছু মানুষের গল্প । 'অসময়' অসময়ের ই গল্প ।
1990 র দশকে পড়া আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক শ্রদ্ধেয় বিমল করের উপন্যাস "অসময়" পড়বার ইচ্ছে হলো আবার।
এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় শুরু করলাম এই পাঠ। তারপর একটু একটু করে এই কাহিনী মূল চরিত্র মোহিনী ও তার পাশাপাশি আয়না , জ্যাঠামশাই, সুহাস আর শচিপতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার পাঠের স্মৃতি আর এখনকার এই পাঠ মিলেমেশে যাচ্ছিল। এই উপন্যাসের পটভূমি অধুনা ঝাড়খন্ডের কোন এক আধা শহর যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি।সময়টা হয়তো ষাটের দশক। কিন্তু একটি বনেদি পরিবারের রুচি ও সম্মানের ধারক বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই ও তাঁর ভাইপো, ভাইজি যারা তাঁর নিজের সন্তান সম, ছোট ভাই ও তার স্ত্রীর এমনকি নিজের স্ত্রীর অকাল মৃত্যু র পরে এমন একটি পরিবারের ঘটনা ই এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। এই উপন্যাসে মৃত্যু র অনুষঙ্গ বারবার আসে। সেই পটভূমিতে রাঁচি র কাছাকাছি কোনো আধা শহরের ছড়ানো ছেটানো মাঠঘাট , জমি ও গৃহস্থ বাড়ি ও তার লাগোয়া বাগান, অনতিদূরে রেল স্টেশন, রাতের অন্ধকারে ট্রেনের হুইসিলের শব্দ, অথবা গুমগুম শব্দে ট্রেনের চলে যাওয়া , আর বৃষ্টির জলে ভিজে ওঠা বাগানের গাছপালা, ভেজা মাটি, ঘাস,লতা পাতার গন্ধ, রাতের অন্ধকারে সেজবাতির আলোয় আধো অন্ধকারে বিভিন্ন চরিত্রে র মনের আলো- আঁধারি জগতের মধ্যে আমরা একটু একটু করে অমোঘ মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। প্রত্যেকটা চরিত্র ই যেন আমাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। এমন করে জীবনের ঘটে যাওয়া যেন অদৃষ্ট চালিত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যেতে যেতে প্রকৃতি আর মানুষের অনবদ্য সহাবস্থান আমাদের স্নায়ু কে এক বিষণ্ণ অথচ কি গভীর এক টানে বেঁধে ফেলে। আমরা ঐ আধা শহরের দিবারাত্রি র ভোর থেকে রাতের প্রবাহের মধ্যে প্রত্যেক চরিত্রে র সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে থাকি , তা যেন আমাদের বাস্তব জীবনের আত্মীয়তার মতো মনে হতে থাকে। অথচ এই সব চরিত্রের প্রত্যেকের অনুভূতি র মধ্যে এমন এক মন্থর , অনুচ্চ শান্ত, স্নিগ্ধতা যেখানে আছে মৃত্যু অথবা ভাগ্যের পরিহাস, নানা ভাগ্য বিপর্যয় সত্ত্বেও ভালোবাসা র নিগুঢ় পারিবারিক বন্ধন, জীবনকে মেনে নেওয়ার এক অদৃষ্টবাদিতা - এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য আর বিষণ্ণতা র মধ্যেও শালীনতা ও শোভনতার আশ্চর্য মিশেলে গড়ে ওঠা মধ্য তিরিশের বিবাহ বিচ্ছিন্না মোহিনী, তার যৌবনের শেষ প্রান্ত ছোঁয়া বোন আয়না, পরিবারের মৃত্যুর আবহে ভাগ্যের নানা বিপর্যয় সত্ত্বেও ভাই সুহাসের ,সকলের জন্য মমতা বুকে নিয়ে এই শূন্যতা থেকে নিজেকে ভুলিয়ে কলকাতা শহরের হইচইয়ের মধ্যে চাকরিতে ব্যস্ত থাকা- এ সব নিয়ে এই সব চরিত্র ই একে একে নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার মতো করে তাদের জীবনের আপাত সাধারণ দিন ও ঘটনা ব্যক্ত করে গেছে। কখনো মোহিনী, কখনও আয়না, কখনও জ্যাঠামশাই আবার কখনও সুহাস অথবা তাদের আত্মীয় সম প্রতিবেশী শচিপতি যার অভিশপ্ত পরিবারে হানা দিয়েছে মৃত্যু, বারেবারে আকস্মিকভাবে , এরা ঘুরে ঘুরে এসেছে। কখনও ভোরের ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে মাখতে মাখতে, কখনও দুপুরের গরম হয়ে ওঠা দিনের প্রান্তে, কখনও আকাশের কোনে জমে ওঠা কালো মেঘ, তুমুল বৃষ্টি , ভিজে মাটি , গাছপালার গন্ধ মাখা রাতের অন্ধকারে এই সব চরিত্র রা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেছে। মনের কথা। আ��� তাই আমরা শুনেছি। আর এভাবেই এ গল্পের আর এক মূল চরিত্র অবিন এসে দেখা দিয়েছে সুহাসের বন্ধু হিসেবে, পৌঁছে গেছে এই পরিবারের অন্দরমহলে। সেই অবিন যে যুক্তি বাদী, যে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণে বিশ্বাসী নয়, যে বাঁচতে ভালোবাসে, কোনো নিয়ম, শৃঙ্খলা র বাঁধনে বাঁধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে দিতে চায় না বা অন্যকেও জীবনের অদৃষ্টবাদী আত্মসমর্পণ থেকে ফিরিয়ে আনতে চায়। খোলা হাওয়ার মতো তার চিন্ত���, ভাবনা সাহসী , ব্যাতিক্রমী, সমাজ সংসারের ঠুনকো নিয়মকে যে অস্বীকার করতে পিছপা হয় না। আবার যার হৃদয়ে থাকে এক অপূর্ব সহমর্মিতা- এমনই এক বাঁধন হারা যুবক এই সমাজ, রীতিনীতি আর নিজেদের কে গুটিয়ে রাখা জীবনে অভ্যস্ত এই সব মানুষদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়।
এমন ই সব চরিত্র আর ঘটনার অনুচ্চ প্রবাহে সুক্ষ অনুভূতি তে ধরা পড়া প্রকৃতির উপাদানে ভরপুর আমাদের এই জীবনকে যেন কী এক মায়ায় ভালোবাসতে শেখায়। যেখানে স্বাভাবিক, সাধারণ জীবন যাপনের আটপৌরে অভ্যস্ততা য় ভালোবাসা ও টান , মানবিকতা ও প্রগাঢ় জীবনবোধ জড়িয়ে থাকে।
অসময় উপন্যাস পাঠ যেন এক ঘোর লেগে যাওয়া অভিজ্ঞতা যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে কষ্ট হয়। 2025 এর এই আধুনিকতা আর প্রযুক্তির এই অভূতপূর্ব আবহে অসময় আমাদের নিয়ে যায় এমন এক সময়ে যেখানে জীবন মন্থর, সামাজিক বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে আটকে থাকা , কিন্তু যেখানে মানুষের মন আর হৃদয় কাঁপে তিরতিরে ভালোবাসার অনুভূতি তে, যান্ত্রিকতায় শক্ত হয়ে যাওয়া আজকের মন যার জন্য কাঁদে। সেই সময়, সেই মানুষ, সেই জীবন যেখানে ব্যথা, যন্ত্রণা, অসহায়তা, থাকা সত্ত্বেও কী এক মায়াময় সহমর্মিতা আর হৃদয় মথিত করা অনুভূতি কে ছুঁতে আমরা হাথ বাড়িয়ে দিই এইসব চরিত্র দের দিকে। ফেলে আসা সেই সময় আমাদের পিছু ডাকে। পাশাপাশি রাখা বিহারের ( অধুনা ঝাড়খন্ড) বাঙালি পরিবারগুলোর সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা আর প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে যেতে হবে "অসময়" র কাছে। সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাওয়া এই অতুলনীয় সাহিত্যের রচয়িতা কে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। আজ যখন এই অশান্ত পৃথিবী আমাদের ভয়ে আড়ষ্ট করে তুলছে, কী এক যান্ত্রিক, মেকি জীবনের অস্বস্তিতে আমাদের সম্পর্কগুলো আলগা হতে থাকছে তখন অবিনের মতো চরিত্র আর অসময়ের মতো উপন্যাস আমাদের, জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়। এখানেই সাহিত্যের সার্থকতা।
যাহা আমি পড়িলাম, সত্যের অপলাপ না-করিতে না বলিয়া পারি না, লেখক প্রণীত এই গ্ৰন্থখানা তাহার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলিয়া প্রতিতী হইয়াছে। একাধিক চরিত্রের উত্তম পুরুষ জবানিতে গল্প বিবৃত করিয়া যাওয়া একেবারে অভিনব নয়, তৎপূর্বে শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ঘরে বাইরে উপন্যাসখানিতে এরূপ প্রয়াস করিয়া গ্ৰন্থখানাকে কালোত্তীর্ণ করিয়া স্বয়ং প্রথিতযশা হইয়া আছেন এরূপ গল্প বলিবার আঙ্গিকে। প্রণত হই সতত। ভ্রষ্ট না হইয়া মূল সন্দর্ভে পদার্পণ করি; মূল চরিত্রগন অবিন, মোহিনী,সুহাস,শচীপতি, আয়না,জ্যেঠামশাই প্রমুখ—কাহিনী ইহাদের কেন্দ্রে রাখিয়া আবর্তিত হয়। মূখ্য চরিত্র মোহিনীর বয়ঃক্রম ছত্তারিংশ চলিতেছে —সে তাহার প্রাকযৌবনে শচীকে কামনা করিয়াছিল কিন্তু শচীর পরিবার যেন কোন দৈব অভিসম্পাতে ক্রমশ বিলীন হইয়া যাইতে থাকে-এক এক করিয়া শচী ব্যাতীত তাহার পরিবারের সকল সদস্যগণের অপমৃত্যু হয় অথবা মানসিক বিকার প্রকাশ পায় —স্বভাবতই মোহিনীর পিতা-মাতা আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া এই প্রণয় অঙ্কুরে বিনষ্ট করিতে মোহিনীকে এক সুদর্শন যুবকের সাথে বিবাহ করাইয়া দেয়—কিন্তু মোহিনী সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করিয়া নিজ-অর্ধাঙ্গীর অবহেলায় বিমর্ষ এবং উৎপীড়িত বোধ করিয়া পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করে—আর সে শ্বশুরবাড়িমুখো হয় না। ইতোমধ্যে সময় বহিয়া যায় ,বয়ঃক্রম ৩৬-এ উপনীত—পিতামাতা স্বর্গবাসী হয়, অভিভাবক বলতে শুধু জ্যেঠামশাই থাকেন—তিনি মৃত্যুবরণ করিলে মোহিনী একা হইয়া পড়িবে এইরকম একটা ভাবনা তার মস্তিষ্কে সম্প্রতি আনাগোনা করিতেছে —অনুজ কলিকাতা থাকিয়া চাকুরী নিয়াছে,অনুজার বিবাহ হইয়া শ্বশুরালয়ে চলিয়া যাইবে —যক্ষের মত একমাত্র সে-ই এই পৈতৃক সম্পত্তি পরিচর্যা করিবে? মোহিনীর এরূপ দুশ্চিন্তার মধ্যে ঝড়ের ন্যায় অবিন আসিয়া তাহার অন্তঃকরণের প্রভূত পরিবর্তন করিয়া দেয় —যৌবন বিগতপ্রায় —পূজায় পুষ্পমাল্য অর্পণ হেতু প্রভাতেই পুষ্প আহরণ করিতে হয়, মধ্যাহ্নে কুসুম নিষ্প্রভ হইয়া যায় —এই কথা অবিনকে কীভাবে বুঝাইবে সে—অবিন তো ঝড় স্বরূপ আসিয়া ধূলি উড়াইয়া অন্তঃকরণ অস্পষ্ট করিয়া দিল —এর প্রতিকারই বা কী—অবিন তাহার সত্যকেই একমাত্র সত্য ধরিয়া লইয়াছে সে মোহিনীর বিড়ম্বনার কথা কখনোই চিন্তা করিবে না —শুধু চিঠিতে বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা বখে যাওয়া।
বাংলা সাহিত্যে এক অসামান্য সৃৃষ্টি ' অসময়' ৷ গোটা উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে লেখা ৷ অর্থাৎ, উপন্যাসের — মোহিনী, অবিন, আয়না, সুহাস, শচিপতি, জ্যাঠামশাই — এই চরিত্রগুলি প্রত্যেকেই নিজের কথা নিজেই বলেছে ৷ চরিত্রগুলি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ৷ গল্প এগিয়েগেছে নিজের গতিতে ৷ তারপর পাঠককে অবাককরে হটাৎ করে শেষ ৷ পাঠকের সামনে পড়ে থাকে একরাশ প্রশ্ন সহ এক গভীর শূন্যতা ৷ যে শূণ্যতায় পাঠক আস্তেআস্তে ডুবে যায়। খুব সুন্দর বর্ণনা, মনে হবে যেন সমস্ত ঘটনা চোখের সামনে ভাসছে।
কয়েকটি জায়গায় ভালো লাগেনি, যেমন শচিপতির পরিবারের মৃত্যুর কথা তিন - চারবার বলেছেন লেখক। একবার মোহিনীর মুখ দিয়ে, একবারে আয়নাকে দিয়ে, একবার শচিপতি নিজেই। লেখক প্রত্যেকের জন্য বেছে বেছে দুঃখ লিখেছেন, যেমন - মোহিনী ভালোবাসে শচপতিকে কিন্তু বিয়ে হবে অন্য একজনের সাথে। সে বিয়ে টিকবেও না বেশি দিন। অন্যদিকে শচিপতির পরিবার এক এক করে অপক্ষাতে মৃত্যু হবে। সঙ্গে তারও একটা জটিল রোগ হবে। আয়না ভালোবাসে তপুকে, কিন্তু তার বিয়ের কথা হবে অন্য একজনের সাথে। সুহাস ভালোবাসে বুলাকে কিন্তু হঠাৎ করে সুহাস বদলে যাবে। জ্যাঠামশায়ের দুঃখ হল, তার জীবিত অবস্থায় তার ছোটভাই, বৌ, বৌদি মারা যাবে।
এই উপন্যাসের জন্যই লেখক ১৯৭৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান ৷