আত্মনির্ণয় বিপন্নতাই এখনকার মানুষের সবচেয়ে বড় অসুখ। যে-অসুখ শ্রুতি বসুকে নিরন্তর অপূর্ণতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। মফস্বল স্কুলের ভাল ছাত্রী শ্রুতি, কলকাতার কলেজে পড়তে এসে আত্মবিস্মৃত হয়েছিল এই বিপন্নতারই অজ্ঞাত হস্তক্ষেপে। শ্রেয়সী আর দেবরূপা – শ্রুতির দুই রুমমেট – পরস্পরের প্রতি অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণের মাধ্যমে যে-সব মুহূর্ত রচনা করেছিল, তারই ঘূর্ণাবর্তে শ্রুতি বন্যায় বিধ্বস্ত নৌকার মতো টুকরো টুকরো ভাঙছিল। অথচ এই ভাঙন হন্তারক ছিল না। শ্রুতি, নিজের বিবিধ খণ্ডের মধ্যেই একদিন নির্ণয় করেছিল নিজেকে। তার ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার রূঢ় ও অলঙ্ঘ্য বোধ, তার নিজের বেঁচে থাকার নির্মম অনিবার্যতা এবং তার বাবা, লতিকাপিসি বা লক্ষ্মীপিসির অসহায় আত্মসমর্পণের বাইরে হোপ – সি সি আই সংস্থার কর্মজীবন তাকে দিয়েছিল মানব জীবনের বহুমাত্রিক অস্তিত্বের খবর। অনেক ভাঙনের পর, দর্শনের পর নিজের অন্তর্গত আত্মার চান্দ্রপ্রকৃতিকে বুঝতে পেরেছিল সে। সত্যের খোঁজে, মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিতে, নিজের ভেতর দৃষ্টি রেখে, সেই ছিল শ্রুতির অমোঘ নির্ণয়।
Tilottoma Mojumdar is an Indian Bengali novelist, short story writer, poet, lyricist, and essayist. She writes in the Bengali language. She was born in North Bengal, where she spent her childhood in tea plantations. She was educated at the Scottish Church College at the University of Calcutta.
তিলোত্তমা মজুমদার-এর জন্ম ১১ জানুয়ারি ১৯৬৬, উত্তরবঙ্গে। কালচিনি চা-বাগানে। ইউনিয়ন একাডেমি স্কুলে পড়াশোনা। ১৯৮৫-তে স্নাতক স্তরে পড়তে আসেন। কলকাতায়, স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৯৯৩ থেকে লিখছেন। পরিবারের সকলেই সাহিত্যচর্চা করেন। সাহিত্যরচনার প্রথম অনুপ্রেরণা দাদা। ভালবাসেন গান ও ভ্রমণ। ‘বসুধারা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার (১৪০৯)। ‘একতারা’-র জন্য পেয়েছেন ডেটল-আনন্দবাজার পত্রিকা শারদ অর্ঘ্য (১৪১৩) এবং ভাগলপুরের শরৎস্মৃতি পুরস্কার (২০০৭)।
তিলোত্তমা মজুমদার স্বস্তি দেন না। ওনার চোখের সামনে আমরা সবাই রাস্তাঘাটে ড্যাংড্যাং করে হেঁটে বেড়াবো, আর ওনাকে সেটা হটসিটে বসে দেখতে হবে? বিলকুল নেহি। চলবে না। একটু কষ্ট হোক। একটু হোঁচট খাই। পড়ে গিয়ে নাকমুখ ভাঙুক। তাহলেই না শান্তি?
ভাবুন কোনো স্বপ্নের পথিক আপনি। সাহিত্য তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পথ ভেঙেছেন মাইলের পর মাইল। আপনি চান এক চুমুক ধ্রুপদী চর্চা। লেখিকা সেটা দেখবেন। দেখে হাসবেন। লক্ষ্য করবেন অদৃষ্টের ন্যায়। তারপর দেখিয়ে দেবেন কালোমাটির কুঁজো। কানায় কানায় উপচে ওঠা জোনাকিসম গদ্য। আপনি কাহিল। মরিয়া কাহিল। হুড়মুড় করে দৌড়ে যাবেন স্রোতের টানে। এবং পড়বেন গিয়ে ফাঁদে। অতি-উদগ্রীব পদস্খলনে... চোরাবালির বুকে!
বড় ক্রূর এই খেলা। যান্ত্রিক এই বাস্তব। আর ওতেই জাগে, প্রশ্ন। কী নাম এই পাঠক্রমের? আল্টিমেট জিনিয়াস? না বাস্তবিক আঁতলামি? নাকি গিরগিটি রকমফের?
এই যে এই বইটা। পারহ্যাপস লেখিকার 'সেরা' তিনটে লেখার অন্যতম। ভীষন জনপ্রিয়। ভীষন নাম চেনা। তিনটে মেয়ের গল্প (অথবা একটি মেয়ের কাহিনী ও আবছা কটা মুখ...) মেয়েটার নাম শ্রুতি। এই বই, শ্রুতির দর্শনলাভ। ওর ধোঁয়াটে হোস্টেল-জীবন। ওর যৌনতার পাঠ। ওর বেঁচে উঠে মরে যাওয়ার গল্প। শ্রুতি। শ্রেয়সী। দেবরূপা। প্রেমের সমকামী অভিধানে, এক বাদুরঝোলা ত্রিকোণ প্ল্যাটার, যার এক কোণ সর্বদা আঁধার। আর এক কোণ অহেতুক নিষ্প্রভ।
ভালবাসতে চাই আপ্রাণ। বইটিকে। উপন্যাসটিকে। কিন্তু ঠোকর খাই পদে পদে। লেখিকার কলমের ধার, আক্ষরিক অর্থে অসাধারণ। ওনার গদ্যচয়ন বাগিচার ফুলের ন্যায় বিস্তৃত। ইচ্ছে হয়, শেকল ছিড়ে দি দৌড়। আজলা আজলা পান করে সাধ মেটাই গতজন্মের তৃষ্ণা। কিন্ত ওনার পরিবেশনা ভীষন ক্রূর। হাই থিঙ্কিংয়ের দোহাই দিয়ে বেড়াজালে আবদ্ধ। দর্শন। অনেক অনেকটা দর্শন। কুয়াশা, ধোঁয়াশা ন্যায় তাত্ত্বিক প্ররোচনা। উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে ওনার এই ডাইড্যক্তিক সংস্কার জবরদস্তি কামড়ে ধরে। ঘাড় ধরে ভাবায়। মাত্রা পায় শ্রুতির বাড়ন্ত আত্মনির্ণয়।
তবে এর অবদান অলীক। মানব-শরীরে অক্সিজেনের ন্যায়। কল্যাণকারী হয়েও আখেরে জরা বর্ধক। লেখিকা নিজেই নিজের উপন্যাসকে স্বখেদে অক্সিডাইস করে বসেন। ক্রমাগত পথ অবরোধে বেঁকে বসে গদ্যের স্রোত। গতিলোপ পায় তরুণী সময়। আকাশ ফুঁড়ে নামতে থাকে বিভ্রান্তির ঝড়। সাথে এক পশলা ইলশে-ক্লান্তি। হাই ওঠে। প্রগতির খাঁড়ায় জবাই হয় সাহিত্যের মন। আর আমি মানুষটা বসে বসে প্রশ্ন করি। ঐ একই প্রশ্ন।
জিনিয়াস, নাকি...?
সমকাম। এই উপন্যাসের নিরিখে, লেসবিয়ানিজম। তাও আবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির গার্লস হোস্টেলের অন্তরে বারুদজ্বলা আগুন। লেখাটি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভয়ানক রকমের আউটডেটেড। বিশেষত দেবরুপা চরিত্রের উচ্ছৃঙ্খল লোলুপতার গায়ে দৃষ্টিকটু সিপিয়া প্রলেপ। তরুণী বয়স। সময়ের ছাপ। বিধিনিষেধ ও উইচহান্ট। সব নিয়েই যদিও বা মেয়েটিকে বুঝতে চাওয়া যায়। তবুও আমাদের সমস্ত আর্গুমেন্ট কোর্টে গিয়ে নস্যাৎ হয়ে যায়। বিশেষত বইয়ের দ্বিতীয় অংশের ভিত্তিতে। যার উগ্র অতিরঞ্জিত পরিণতি কোথাও গিয়ে শেষমেশ বইয়ের মূল তত্বকেই খামচে বেড়ায়।
বিশ্বাসঘাতকতা বুঝি একেই বলে। অনেক কিছু দিয়েও চকিতে সবটা কেড়ে নেওয়া...
উপলব্ধি। অনেক, অশেষ উপলব্ধি। শ্রুতির চোখে, মুখে, সেই উপলব্ধির ছিটে শান্তির জলের মতো ছিটিয়ে দেন লেখিকা। সামাজিক চাহিদার, অসামাজিক মাশুল। প্রকৃতি সন্ধানে, স্বোপার্জিত ভাঙন। আত্মিক ও বৌদ্ধিক গঠনে, অহংয়ের বলি। কতসত রঙ যে স্রেফ মুড়ি মুড়কি মাফিক ছড়িয়ে দেন উনি। নিতে পারলে, ঝোলা ভারী। না পারলে, সবটাই জিরো। আর এই জিরোতেই আমার যত রাজ্যের প্রবলেম।
এত জটিল একটি পৃথিবী তৈরি করলেন লেখিকা। এত কষ্টের বাস্তব ফুটিয়ে তুললেন তুলির আঁচড়ে। আর তারপর স্রেফ ফাঁপা রেখে দিলেন অডিটরিয়ামের মূল মঞ্চ। দর্শন ভালো। দর্শন আনন্দময়। তবে অঙ্ক আরো কঠিন। শূন্য গুণ লক্ষ লক্ষাধিক দিনের শেষে, শূন্যই।
এতে কার কী লাভ হয়, আমি জানি না।
লেখিকা কি নিজেও নিজের কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারলেন শেষমেশ? এত শুন্য। এত ধাপ্পা। শ্রুতির জাগতিক শৈত্যের তল পেলাম যদিও বা, কিন্তু বাকিরা যে হেরে গেলো বিশ্রী ভাবে। ওনার কলমে মানুষ মন প্রস্ফুটিত হলো। তাতে চাহিদার রঙ লাগলো। লাল। গোলাপী। ধূসর। আবার ঝরেও গেল একই দিনে। সবই বড় সার্ফেস লেভেল। ফাঁপা। সাধারণ। ফেটিসাইজেশনে দুষ্ট।
উপন্যাসটি নিজেও তাই। সময়ের সাথে বুড়িয়ে যাওয়া, প্রাচীন, অবান্তর, সুলিখিত একটি দলিল। যা পড়লে পড়াই যায় এক দু-বার। তবে এর ভিত্তিতে পরীক্ষার উত্তর লিখতে বসলে, মুশকিল হ্যা বস...
লেখনী: অসাধারণ। চরিত্রচিত্রণ: চমৎকার। প্লট: নেই। তার জায়গায় আছে লেডিস হোস্টেলে আবাসিকদের বিবসনা দেখার চিরন্তন ফ্যান্টাসি এবং রসময় গুপ্তের উত্তরাধিকার। টপিং হিসেবে রয়েছে দর্শনের হেনা-তেনা। যাউক গিয়া। পুজোয় চিকেনের লেশমাত্র না-থাকা চিকেন মোমো আর চিকেন রোল নিশ্চয় সাঁটিয়েছেন। তাহলে প্লটবর্জিত একটা লেখা পড়তেই বা ক্ষতি কী?
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে - প্রবাদবাক্যটি বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। আরো একটা জিনিস আছে যা বিধাতার নির্মাণ, যার উপরে আমার তোমার হাত নেই। যৌন আবেদন। সমাজে স্বীকৃত শুধু এক প্রকার যৌনমিলন - নারী ও পুরুষ। বাকি মিলনেরা যুগ যুগ ধরে লুকিয়ে আছে সমাজে। নারীর প্রতি নারীর টান, পুরুষের মনে পুরুষের নেশা, পুরুষ শরীরে নারী, নারী শরীরে পুরুষ - আহা! মহাকালের মহাকাব্য রচনা হয় এই না-বলা-গল্পগুলোকে নিয়ে। আর সেই সত্যের প্রতি সম্মান বজায় রেখে, কোলকাতা শহরের ইটকাটের মাঝে সমপ্রেমের এক সহজ-কঠিন গল্পের রচনা করেছেন লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার। সেই গল্পে আছে চোখে আঙুল দিয়ে যুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা - মেয়েতে মেয়েতে চুমু খেলে চাঁদ খসে পড়ে না। সবাই দেখে মেয়েতে মেয়েতে চুমু খেয়েছে - সমাজে ঘুণ লেগেছে। শ্রুতি দেখে চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে। শ্রুতির চোখ দিয়ে দেখা এই গল্পে সে কোথায় যেনো বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে - কেন? কেন? কেন? শ্রেয়সীকে কেন শ্রুতির এত ভালো লাগে? দেবরূপা আর শ্রেয়সী কেন জীবনে পুরুষবন্ধু থাকা সত্ত্বেও নিশি রাতে ফিরে আসে দুয়ে মিলে এক হবে বলে? বাকি সবার মতো কেনো শ্রুতি ওদের যৌনতাকে মন থেকে ঘৃণা করতে পারে না? এই সব প্রশ্নের উত্তর পরতে পরতে সাজানো আছে লেখিকার অপূর্ব সুন্দর ভাষায়। এই উপন্যাস প্রেমের গল্প নয়, প্রেমের জটিলতা পর্যন্ত পৌছানোর সুযোগ নেই এই ভিন্নধারার মানুষদের। যারা নিজেদের যৌনতার গো��কধাঁধায় আটকে, তারা কিভাবে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখবে! অনেকগুলো না পাওয়া থেকে এদের ভেতরে তৈরি হয় রাগ, ক্ষোভ, হিংসা। তখন তারা শুধু সমকামী থাকে না, তারা হয়ে ওঠে হিংস্র সমকামী। আর সমাজ আরো একবার চিৎকার করে বলবার সুযোগ পায় - 'দেখো - এরা কত নিকৃষ্ট, কত অসুস্থ, কত ক্ষতিকর।' আর এই অসম্ভব সামাজিক টানাপোড়েন থেকে জন্ম নেয় একটি বড় প্রশ্নের - যে অনুভূতি তোমার নয় তা বোঝার সাধ্যি কি তোমার আছে? হয়তো সে কারণেই দুই নারীর মিলনে সৃষ্ট পূর্ণিমা এমনই এক নারীর পক্ষে বোঝা সম্ভব যে নিজেও হয়েতো চাঁদ হতে চেয়েছিলো, কিন্তু সাহস হয়নি কখনো। তিলোত্তমার লেখার শব্দসম্ভার ও বিষয় অনবদ্য। কিন্তু গল্পের মাঝে মাঝে লাগাম টেনে যুক্তিকথা কোথাও যেনো উপন্যাসের স্বাভাবিক স্রোতকে নষ্ট করেছে। উপন্যাসটি নিখুঁত নয়, যেনো চাঁদের গায়ে দাগের মতো। পড়ে দেখতে পারেন - সমকামীতার জন্যে নয়, মানব মন ও শরীরের জটিলতার জন্যে।
ভাল নয় বলছিনা। কিন্তু, মেয়ে মেয়েতে বা ছেলেতে ছেলেতে যে ভালবাসা তাকে appreciate করতে আমাকে কেন voyure হতে হবে? বইটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল চারিদিকে বোধহয় স্বাভাবিকতা কোথাও কিছু নেই। এটা অবশ্য তিলোত্তমার প্রায় সব বইয়েরি সমস্যা। জীবনের নিতান্ত কুৎসিত দিক গুলোও মিশে থাকে সুন্দরের সাথে, তাই একে সহনীয় করে। ওর বইয়ে অজস্র অন্ধকারের যেন কোন বিরাম নেই। এ আমার সহ্য হয়না।
একটি বই, কেবলমাত্র একটি বই, একটা গোটা জীবনের, শত-সহস্র বছরের ঠিক-ভুলকে এতো তীক্ষ্ণ প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে তা নিজে না পড়লে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য হতোনা। আসলে, এ যেন একটা পরীক্ষা। আধুনিক বলে, সমান অধিকারের দাবী জানিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠা মানুষরা আদতেই কতটা আধুনিক আর কতটা ভেক-ধারী তা বোঝার উপায় যেন বাতলে দিয়েছে এই বই। কাম-যৌনতা-সমকামীতা আর সামাজিকতাকে একই সারিতে নামিয়ে এনেছেন লেখিকা তার বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে। গল্পের প্রেক্ষাপটে রয়েছে শ্রুতি, সে বাড়ি ছেড়ে কলকাতার হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। তার রুমমেট দেপরূপা ও শ্রেয়সী একে ওপরের সাথে সমকামী সম্পর্কে আবদ্ধ। আর সেই সম্পর্কের সাথে সহজাত পরিচয় না থাকায় দিনে দিনে শ্রুতি যেন ক্ষয়ে যায়। হোস্টেলের বাকিরাও তাদের বিরুদ্ধে কুরুচিকর অভিযোগ এনে একপ্রকার তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এইভাবে শেষ হয় প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে শ্রুতি চাকরিসূত্রে একটি এনজিও এর সাথে যোগদান করে। পথশিশুদের নিয়েই তাদের কাজ। তাদের জীবন-যাপন, সামাজিক অবস্থান, যৌনতা সম্পর্কে ধারণা এবং সমকামী প্রবৃত্তি আবার শ্রুতিকে আরেক পরীক্ষার সম্মুখীন করে। সেখানেও এসে যোগ দেয়, দেবরূপা। এর মাঝেই উঁকি দিয়ে যায় দেবরূপার ভাইয়ের মেয়েলি আচরণ, শ্রুতির ভাই অলুর মানসিক বিপন্নতার মাঝেও কামপ্রবণতা, শ্যামলকাকুর সাথে লতিকাপিসির বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম। 'চাঁদের গায়ে চাঁদ' কেবল যে সমকামীতাকে মর্যাদা দেওয়ার উপন্যাস এমনটা ভাবা বোধহয়, লেখিকার সাথে একপ্রকার অন্যায় করাই হবে। এ নতুন করে ভাবনার রসদ যোগায়। সহজ হতে শেখায়। মুক্ত হতে শেখায়। বদ্ধ ঘরের জানলা বেয়ে আসা এক ফালি চাঁদের আলোর মতোই স্বচ্ছ ও সুন্দর এই জ্ঞান। লেখিকার প্রতি শ্রদ্ধা। তার ভাষার বলিষ্ঠতা, লেখনী-ভঙ্গি বরাবরই আমার বড্ড পছন্দের।
🍂✨📖উপন্যাসের নাম - চাঁদের গায়ে চাঁদ📖✨🍂 ✍️লেখিকা - তিলোত্তমা মজুমদার 🖨️প্রকাশক - আনন্দ পাবলিশার্স 📃পৃষ্ঠা সংখ্যা - ২২৭
🍁🍂আত্মনির্ণয় বিপন্নতাই এখনকার মানুষের সবচেয়ে বড় অসুখ । যে - অসুখ শ্রুতি বসু নামের মেয়েটিকে নিরন্তর অপূর্ণতার দিকে ঠেলে দিয়েছে । শ্রুতির ধারণায় যে - জগৎ অন্তর্গত ছিল , তার সঙ্গে কোনও মিল ছিল না কলকাতার হস্টেল জীবনের । বহু নবলব্ধ বোধ তাকে বিধিবহির্ভূত উপলব্ধির কাছাকাছি । পৌঁছে দিয়েছিল । অনেক ভাঙনের পর আপন আত্মার চান্দ্রপ্রকৃতিকে অনুভব করেছিল সে । এই অনুভবই , সম্ভবত , মানুষের চূড়ান্ত আত্মলিপিলেখা ।🍂🍁
🍁🍂আত্মনির্ণয় বিপন্নতাই এখনকার মানুষের বসুকে নিরন্তর অপূর্ণতার দিকে ঠেলে দিয়েছে । মফস্বল স্কুলের ভাল ছাত্রী শ্রুতি , কলকাতার কলেজে পড়তে এসে আত্মবিস্মৃত হয়েছিল এই বিপন্নতারই অজ্ঞাত হস্তক্ষেপে । শ্রেয়সী আর দেবরূপা — শ্রুতির দুই রুমমেট — পরস্পরের প্রতি অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণের মাধ্যমে যে - সব মুহূর্ত রচনা করেছিল , তারই ঘূর্ণাবর্তে শ্ৰুতি বন্যায় বিধ্বস্ত নৌকার মতো টুকরো টুকরো ভাঙছিল । অথচ এই ভাঙন হস্তারক ছিল না । শ্রুতি , নিজের বিবিধ খণ্ডের মধ্যেই একদিন নির্ণয় করেছিল নিজেকে । তার ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার রূঢ় ও অলঙ্ঘ্য বোধ , তার নিজের বেঁচে থাকার নির্মম অনিবার্যতা এবং তার বাবা , লতিকাপিসি বা লক্ষ্মীপিসির অসহায় আত্মসমর্পণের বাইরে হোপ – সি সি আই সংস্থার কর্মজীবন তাকে দিয়েছিল মানব জীবনের বহুমাত্রিক অস্তিত্বের খবর । অনেক ভাঙনের পর , দর্শনের পর নিজের অন্তর্গত আত্মার চান্দ্রপ্রকৃতিকে বুঝতে পেরেছিল সে । সত্যের খোঁজে , মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিতে , নিজের ভেতর দৃষ্টি রেখে , সেই ছিল শ্রুতির অমোঘ নির্ণয় ।🍂🍁
ভালো বই। অসাধারণ সহমর্মিতায় বঙ্গীয় নারীসমাজের এক দীর্ঘ সংগ্ৰামকে লেখিকা বুনেছেন এক অন্তরঙ্গ কিন্তু অন্ধকার আখ্যানের মধ্যে। গল্পের সময়কাল আর কুড়ি বছর পরে হলে এত অন্ধকার নিশ্চয়ই থাকতো না, হোমো বলতেই কলকাতার হস্টেল সুদ্ধ মানুষের হিস্টিরিয়া হতো না, কিন্তু সেটা চরিত্রদেরও দোষ নয়, লেখিকারও নয়। এর পাশাপাশি রয়েছে পাঠকের সঙ্গে কথক সত্তার নিরন্তর আলাপন। ঔপনিবেশিকতার আঘাতে বৌদ্ধিকভাবে উদ্বাস্তু পাঠক আমি। আন্দাজ করি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো এক রীতিকেই এই আলাপনে হয়তো অনুসরণ করা হয়েছে। কালিদাস, ভাসের নাটকের ভণিতায় এই স্বাদ আছে। কিন্তু প্রথম খণ্ডের সঙ্গে দ্বিতীয় খণ্ডের যোগসূত্র ক্ষীণ। পরিণতিতে মন ভরে না। শেষ হয়ে হইল না শেষ – সে তো ছোটগল্পে। উপন্যাসে আরো ভালো বাঁধুনি থাকতেই পারতো। তবু সব মিলিয়ে অনবদ্য অভিজ্ঞতা। মনকে আরো উদার করে।
এই উপন্যাসে আছে এক চমকপ্রদ, বিধুর আখ্যান। এতে মিশে আছে আমাদের পৌরাণিক মিথচেতনার উত্তরাধিকার,গূঢ় মানব-মনস্তত্ত্ব এবং আত্ম-উজ্জীবনের দর্শন। এই মানবজীবন যেন এক চান্দ্রায়ণ ই বটে,অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার পথে যাত্রার শাশ্বত অঙ্গীকার। উপন্যাসে আমার প্রিয় চরিত্র 'দেবরূপা '। আপন অন্তরে সে অনেকখানি কাতর,ব্যথাতুর এবং অসহায়। অন্যদিকে শ্রুতি জীবনের চড়াই উতরাইয়ে সম্পূর্ণা। সৌন্দর্যময়ী শ্রেয়সী যেন অনেকটাই ম্লান এদিক থেকে,উপ���্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে সে মিলিয়ে যায়। তখন শুরু হয় দেবরূপা ও শ্রুতির আত্ম-অন্বেষণ। এই উপন্যাস তার পরতে পরতে আমাদের অন্তর্মুখী করে,আমাদের প্রকৃত সত্তার গহন অতলে উপনীত করে। পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রশ্ন করতে চায় - 'তুমি কী?', 'তুমি কেন'? জীবনভর এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে আমাদের অবিরত বীতশোক হতে থাকার মন্ত্র দেওয়াই যেন মননশীল তিলোত্তমার এই উপন্যাসের চিরন্তন সারাৎসার!
তিলোত্তমা মজুমদারের লেখা প্রথম পড়লাম। সমপ্রেম নিয়ে লেখা এই গল্পটা। তিলোত্তমা মজুমদারের লেখার গাঁথুনি অনেক চমৎকার। চিন্তাভাবনা বেশ গোছানো। আমি আরোও উনার লেখা পড়তে আগ্রহী হয়েছি।