Jump to ratings and reviews
Rate this book

বসুধারা

Rate this book
BASUDHARA
[Novel]
By
Tilottama Majumder

প্রচ্ছদ – সুব্রত চৌধুরী


আগে বলা হত জনপদ। এখন পাড়া। এর নানা স্তর। ধোঁয়া যেমন, নানা বায়ুস্তর ঘুরে পাক খায় এবং নিজেই বায়ু হয়ে ওঠে একসময়। আর আগেকার বায়ুর অভিব্যক্তিতে ঘটিয়ে দেয় রকমফের – সেই প্রক্রিয়ায় আবহমাঙ্কালের জীবনধারা পাক খেতে থাকে জনপদের নানা স্তর ছুঁয়ে, ভেদ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের বাইরেকার রং পালটায়। বদলে যায় চাকচিক্য। কিন্তু আসলে কিছুই কি বদলায়?

বিত্ত ও কৌলীন্যমণ্ডিত গৃহস্তপাড়ার পাশাপাশি চিরকাল গড়ে ওঠে নিম্নপ্রবণ জনপদ। যেমন এই কাহিনীর ‘মাথুরের গড়’ পাড়ার পাশাপাশি উদ্বাস্তু কলোনি, ফটিকবিল বস্তি। উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্থীনের ক্রম-বসবাস ঘিরে যুগে যুগে রচিত হয় পাপা, পুণ্য, বিশ্বাস, সংস্কার, দ্বন্দ্ব, সোষণ, ঈর্ষা ও দ্বেষের ইতিহাস।

মাথুরের গড়ের মল্লিনাথ ডাক্তার উদার ও সর্বজনমান্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গহিন সংস্কার তাঁকে আত্মক্ষয়ী করে। তাঁর আত্মবিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে থাকেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, যিনি ধর্ম ও সংস্কারের শিকড় খুঁজতে খুঁজতে একদিন আবিষ্কার করেন দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমকে – যে থাকে, যাকে হাতড়ে মরতে হয় সারা জীবন, আবার যাকে বুকে করে ভেসে যেতে থাকে খিলপাটনি গাঁয়ের রাধিকা আর শমসের, যে-প্রেমের হাত ধরে সংস্কার টপকে মানবতার জয় প্রতিষ্ঠা করেন চিররুগ্‌ণ অধ্যাপক তৃণাঙ্কুর। এই উপন্যাসে নীলিমা ও নীলোফা দুই বিস্ময়। বয়স এবং সমস্ত সামাজিক বিন্যাসের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এই দুই চরিত্রের মধ্যে গড়ে উঠেছে গাঢ় সম্পর্ক। এই উপন্যাসে মা-বাবার পরিচয়ের লজ্জায় আত্মঘাতী দেবোপমের পাশে আছে অন্য ধরনের মানুষ অনুপম, অরূপ, প্রণবেশ, শেফালির মা। এখানেই একটি কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাকে বুকে তুলে নেয় হরিচরণ ও তার পাঁচ সন্তানের জননী তুলসী। জিনি নামের বউটির মৃত্যুকে ঘিরে একটি গণপ্রতিবাদ হয়। আর ফটিকবিল বস্তিতে এক অন্ধ বালক ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে মানুষের অতীত, বর্তমান এবং হয়তো-বা ভবিষ্যৎ। জীবন অসংখ্য ঘটনা নিয়ে আবর্তিত হতে থাকে।
জীবনকে কখনও লাগে প্রশান্ত ও অসীম। কখনও লাগে অশান্ত ও খণ্ডিত। তবু জীবন থামে না। কোন অলক্ষ্য থেকে নিয়ত নির্মিত হতে থাকে মিলন-বিচ্ছেদ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ভালবাসা-বেদনা। তার ওপরই বর্ষিত হয় চিরন্তন অমৃতের ‘বসুধারা’।

411 pages, Hardcover

Published December 1, 2002

5 people are currently reading
153 people want to read

About the author

Tilottama Majumdar

50 books31 followers
Tilottoma Mojumdar is an Indian Bengali novelist, short story writer, poet, lyricist, and essayist. She writes in the Bengali language. She was born in North Bengal, where she spent her childhood in tea plantations. She was educated at the Scottish Church College at the University of Calcutta.


তিলোত্তমা মজুমদার-এর জন্ম ১১ জানুয়ারি ১৯৬৬, উত্তরবঙ্গে। কালচিনি চা-বাগানে। ইউনিয়ন একাডেমি স্কুলে পড়াশোনা। ১৯৮৫-তে স্নাতক স্তরে পড়তে আসেন। কলকাতায়, স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৯৯৩ থেকে লিখছেন। পরিবারের সকলেই সাহিত্যচর্চা করেন। সাহিত্যরচনার প্রথম অনুপ্রেরণা দাদা। ভালবাসেন গান ও ভ্রমণ। ‘বসুধারা’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার (১৪০৯)। ‘একতারা’-র জন্য পেয়েছেন ডেটল-আনন্দবাজার পত্রিকা শারদ অর্ঘ্য (১৪১৩) এবং ভাগলপুরের শরৎস্মৃতি পুরস্কার (২০০৭)।

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
18 (41%)
4 stars
19 (44%)
3 stars
2 (4%)
2 stars
3 (6%)
1 star
1 (2%)
Displaying 1 - 5 of 5 reviews
Profile Image for Mahmudur Rahman.
Author 13 books356 followers
May 11, 2020
কলকাতার এক কিনারে এক পাড়া, মাথুরের গড়। কোন এক মথুর বাবুর নাম থেকে এই নাম। সেখানে নানা ধরণের মানুষের বাস। সব পাড়াতেই অবশ্য নানা মানুষের বাস। অবশ্য এ পাড়ার একটা বৈশিষ্ট্য হলো সব পরিবার কোন না কোন যুবককে হারিয়েছে। হয় সে বড় ছেলে, নয় ছোট। বৈশিষ্ট্যটা পাড়ার, না সময়ের?

নকশাল আন্দোলনের পর সেই আন্দোলন দমনে কঠোর হয়েছিল সরকার। এমারজেন্সি আর দমন নীতি। এক পর্যায়ে এমন হলো যুবক দেখলেই তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। অভিযোগ থাকলে গুলি। তেমনই একজন দেবার্চন, কিংবা জামাল কৌশিক। একেকটা তাজা প্রাণ নষ্ট হয়ে গেল মুহূর্তে। কিন্তু নষ্ট মানে কেবল গুলি খেয়ে মরা না। ওই একই সময়ে হেরোইন নামক মারণ নেশার ঘোরে পড়ল একটা প্রজন্ম। সেই নেশার ঘোরে মারা গেল অমলেন্দু।

মল্লিনাথ কালী সাধক। তার প্রপিতামহ রূপচাঁদ স্বপ্নে এসে তাঁকে আদেশ দিয়েছেন কালী পুজো করার। আর সেজন্য তাঁকে সংযম পালন করতে হয়। স্ত্রী সহবাসে প্রবৃত্ত হলেই তাই স্বপ্নে আসে রূপচাঁদ। শিথিল হয়ে পড়েন মল্লিনাথ। একটা সময় তার এই কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে জান স্ত্রী মাধবী। তার আগে অমলেন্দু শুনেছিল বাবা মায়ের কুৎসিত কলহ। সেই থেকেই তার নেশার শুরু। কিন্তু পুত্রের দিকে তাকাননি মল্লিনাথ। ডাক্তার হিসেবে তিনি সবাইকে চিকিৎসা দেন, পয়সা নেন না গরীবের কিন্তু তিনি জড়িয়ে পড়লেন ছুৎমার্গে।

ওদিকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক কট্টর ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে উঠেও ধর্মের বাঁধনে নেই। তিনি মানুষকে মানুষ মনে করেন। মানবিক এই মানুষটি মানুষকে ভালোবাসেন, কিন্তু জানেন না কী করে ভালোবাসোতে হয় কেননা তিনি প্রচণ্ড একা। শ্বেতী ধরেছে তাঁকে। নিজে কুৎসিত হয়ে চলেছেন দিনে দিনে আর ওদিকে আগুনে পোড়া বোন নীলোফাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও সে দাগ দেখে বমন করেন আনিসুজ্জামান।

মানুষের এই অদ্ভুত প্রকৃতি আর মনের ভেতরকার এক পৃথিবী নিয়েই তিলোত্তমা মজুমদারের উপন্যাস ‘বসুধারা’। ২০০১ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাস পরবর্তীতে আনন্দ পুরষ্কার পায়। নানা চরিত্র রয়েছে এই উপন্যাসে। তাদের মানবিক জীবন, আচরিত জীবন আর সময়ের পরিবর্তনের সাথে পরিবেশের অবস্থা এ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। তিলোত্তমা সে সবকিছু নিয়ে এসেছেন এক জায়গায়। ত্নি পৌঁছেছেন একদম গভীরে।

নকশাল আন্দোলনের পরবর্তী অবস্থা, সরকারের দমন নীতির কারণে তৈরি হওয়া মানসিক অবস্থা খুব স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে উপন্যাসে। মানবিক দৃশ্য চিত্রায়নে তিলোত্তমা অসাধারণ। এ উপন্যাসে শেফালীর মা, হরিচরণ মানুষের সেই শুদ্ধতা বা মানবিক মহত্ত্বের প্রতীক। যারা নিচুতলার বাসিন্দা হয়েও কোন দ্বিমুখী চরিত্র ধারণ করে না। সমান্তরালে তিনি এনেছেন বিকাশ, লক্ষ্মী, পরেশ বোসের মতো চরিত্র যারা আপাত পরিপাটি কিন্তু ভেতর থেকে ক্ষয়ে গেছে। নীতির ছিটেফোঁটা যারা ধরে রাখতে পারেনি।

পদাবলী, ইংরেজি কবিতা আবার কখনও মাওয়ের দর্শন উঠে এসেছে এ বইয়ে। আনিসুজ্জামানের দুর্গা বিষয়ক গবেষণা যেমন তিলোত্তমা এনেছেন, তেমনি ছিল পুব বাংলার এক মেয়ে রাধিকার প্রেমের কথা। সে প্রেমকে তিনি তুলনা করেছেন পদাবলীর সঙ্গে।

তিলোত্তমার উপন্যাসে যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটা অনুসঙ্গ, যেমন মানুষের জীবনে। যৌনতা আর যৌন মিলনের চিত্র তিলোত্তমার মতো এতো শৈল্পিক কায়দায় লিখেছেন খুব কম লেখক, অন্তত আমার পাঠে এহেন অভিজ্ঞতা দুর্লভ। তিনি যেমন বিকৃতি দেখান, তেমনি দেখার সৌন্দর্য।
শেষে এসে বসুধারা হয়ে দাঁড়ায় একটা পৃথিবী। যেখানে মানুষ নতুন আর পুরনো, ভালো মন্দ, পাওয়া আর হারানোর দ্বন্দ্বর মাঝে দাঁড়িয়ে জীবনকে খুঁজতে চায়। বেঁচে থাকতে চায়। এখানে দেবার্চনের মধ্য শুদ্ধ, ঋদ্ধ মানুষের কথা আছে। পাশে আছে তারই ভাই দেবাশিস, যার মধ্যে কখনও তা তৈরি হয়নি। আছে ফুলরেণুর মতো প্রতিবন্ধীর ভাঙা জীবন সামলানোর কথা, আছে জীবনের উপর ঘেন্না ধরা দেবোপমের মরে যাওয়ার কথা। তারপরও আনিসুজ্জামান বেঁচে থাকে, নিলোফা ভালোবাসা খুঁজে পায়। শমসেরকে খুঁজতে খুঁজতে রাধিকা তৃণাঙ্কুরের কাছে আশ্রয় পায়।

তিলোত্তমা এই একটা উপন্যাসে কতগুলো জীবন ধরে রেখেছেন। উপন্যাসকে করেছেন পৃথিবী।
October 20, 2020
১.
বসুধারা উপন্যাসে মানুষের জীবনের গতিময়তার আবরণে প্রধান হয়ে এসেছে নকশাল আন্দোলনে সৃষ্ট সামাজিক অভিঘাত, হিন্দু মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কে সংস্কার ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব এবং পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের হৃদয়ঘন জীবন।
পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখায় শহুরে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বাইরে ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে নকশাল আন্দোলন এবং বাংলাভাগজনিত বেদনা একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। বসুধারা উপন্যাসের প্রায় একশত চরিত্রের মাঝে মূল চরিত্রগুলো কোন না কোন ভাবে এই ঐতিহাসিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট।
মাথুরের গড় এবং ফটিকবিল সংলগ্ন বস্তি- এই দুই ধারার জীবন যেন দুই পৃথিবীর, অথচ দুই অংশেই একাকার আছে সম্পর্কের সুখ দুঃখ, জীবনের হাসি কান্না। এই শতাধিক চরিত্রগুলোর নাম নিতেই চলে যাবে অর্ধপৃষ্ঠা।
উঁচু জায়গা মাথুরের গড়ে বাস করে অনেকগুলো পরিবার, সমাজে তারা কেউ ডাক্তার, কেউ অধ্যাপক, কেউ পাড়ার দোকানদার, কেউ সরকারি চাকুরে। তাদের নাম জানা যাক।

বিকাশ ও লক্ষ্মী- তাদের সন্তান দেবাশিস, দেবার্চন, দেবাশিসের বৌ শিঞ্জিনি।
প্রণবেশ ও জুঁই- তাদের সন্তান বাপ্পা, প্রণবেশের ভাই নীলাদ্রি, বাবা সচ্চিদানন্দ, মা ইলা, মাসি সন্ধ্যা।
সমরেশ ও নীলিমা, তাদের পুত্র তৃণাঙ্কুর বা মান্তু, পুত্রবধূ শর্মি, কাজের লোক ময়না।
পরেশ বোস ও শবরী, তাদের সন্তান দেবোপম ও অনুপম, পরেশের বস অরুণ সেন।
মল্লিনাথ ও মাধবী, সন্তান অমলেন্দু ও কমলেন্দু, মল্লিনাথের বাবা রূপচাঁদ, বোন লিলি, কাজের লোক কালীতারা।
আনিসুজ্জামান ও নীলোফা। নীলোফার বাবা মনিরুল, মা সনজিদা।
প্রধানত এই ছয়টি পরিবারের কথা ছাড়াও উঠে এসেছে আরো টুকরো অনেক চরিত্র, যেমন- ডাক্তার শিবতোষ, সিপিএম নেতা শ্যামাকান্ত, কংগ্রেস নেতা অনিল সামন্ত, সাতকন্যার বাড়ি, মিথিলেশবাবু ইত্যাদি।

এদিকে ফটিক বিলের বস্তি প্রসঙ্গে লেখক এনেছেন অনেকের জীবনছবি, তারা কেউ কাজ করে মাথুরের গড়ের ধনী বাসায়, যেমন- ময়না ও কালীতারা, কেউ পরিষ্কারক, কেউ রেললাইনে থাকে, কেউ বা পরিবার রেখে কাজ করতে যায় দূর রাজ্যে। এদের নামও জানা যাক।
হরিচরণ ও তুলসী, তাদের পাঁচ পুত্র আর পরবর্তীতে আশীর্বাদ- এক কন্যা সন্তোষী।
রাধিকা ও কার্তিক, তাদের সন্তান পরেশ ও জোছন। তবে তার পূর্ববঙ্গের জীবন ছিল খিলপাটনি গাঁ আর রূপসী নদীর পাড়ে, বাবা সত্যসাধন, পাগল মা আর কাকা কাকি নিয়ে তার ছিল অভাবের সংসার, সাথে গোপন আনন্দের উৎস ছিল মুসলিম প্রেমিক শমসের।
এ ছাড়াও এই বস্তিতে বাস করে শেফালির মা , ফুলরেণু, মাস্টার সত্যব্রত ও তার শিষ্য অন্ধ, নরেন মিত্তির।

২.
অনেকগুলো এক গোছের চরিত্র আছে এতে, যারা সব সংস্কারের উর্ধ্বে, চিন্তায় মুক্ত এবং প্রগতিশীল, সমাজের যথাবিধি নিয়মগুলো শ্বাসরোধকারী হলে যারা উপড়ে ফেলতে দ্বিধা করেন না। এরকম সমধারার সাহসী চরিত্রগুলো হল-
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানা, চাকুরে নীলিমা, বস্তির মাস্টার সত্যব্রত, তরুণ দেবোপম।

আর এই চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতেই যেন লেখক বর্ণনা করেছেন বিপরীত চরিত্র, যারা গভীরভাবে সংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্ম ও সমাজের কঠিন নিয়মের বেড়াজাল যাদের দেয় নিরাপত্তা ও পবিত্রতার স্বস্তি। এরকম কিছু চরিত্র হল- কালীভক্ত ডাক্তার মল্লিনাথ, নীলিমার পরিবার, আনিসুজ্জামানের পরিবার বা কলেজের সহকর্মীরা।
প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার বয়ে নিচ্ছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা- কেউ নকশাল আন্দোলনে নিখোঁজ- বিকাশের সন্তান দেবার্চন, প্রণবেশের ভাই নীলাদ্রি। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে মৃত- মল্লিনাথের সন্তান অমলেন্দু, কেউ বা জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহন্তারক- দেবার্চন। অথবা, শ্বাশুড়ি জামাইয়ের অত্যাচারে প্রাণ হারানো জিনি।
তৃণাংকুরের কাছে রাধিকার ভিটেমাটি সংক্রান্ত বয়ান আর আনিসুজ্জামানের কাছে নীলোফার আত্মগত কথা, শেফালির মায়ের জীবনসংক্রান্ত বচন- সবই খুব আশ্চর্য আর মিলজনক, প্রায় অক্ষরজ্ঞানহীন এবং অবহেলিত হলেও এসকল কথা জীবনের উপলব্ধিতে একই কাতারে দাঁড় করায় তাদের।

তিলোত্তমা তার লেখার চরিত্র নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে যেমন বলেছিলেন-
‘যখন লেখা বন্ধ করি, বইয়ের চরিত্রগুলোও তখন থেমে যায়, আবার লেখা শুরু করলেই তারা জীবন্ত হয়ে ওঠে’।
হয়তো অনেকদিন ধরে লেখক এদের লালন করেন বলেই তার কাছে সবাই সুস্পষ্ট, কিন্তু পাঠকদের কাছে যেহেতু তারা অপরিচিত এবং পড়বার মাধ্যমেই তাদের সেসব চরিত্রকে মাথায় নিতে হয়, তাই সুস্পষ্ট হতে কিছুটা সময় লাগে, যেটা এই বইয়ের বড় দুর্বলতা। কারণ চরিত্রের সংখ্যা অনেক, কমপক্ষে একশর বেশি চরিত্র, পড়তে গেলে খেই হারিয়ে ফেলতে হয় যে কার ভূমিকা কী ছিল, যেমন- এত এত নাম যে মাধবী নামটাই আসলে দুটি চরিত্রের হয়ে যায়। পরবর্তীতে, গড়পড়তা একশটি চরিত্র চারশ পাতার বইয়ে কোনমতে এঁটে গেলেও স্বাভাবিকভাবেই সবাই সমানভাবে গুরুত্ব পায় না, আবার গুরুত্ব পাওয়া চরিত্রগুলোও বর্ণিত হয় না ধারাবাহিকভাবে, তা সত্ত্বেও উপন্যাসের অর্ধেকে এসে এই শতাধিক চরিত্রের মধ্য থেকে হাতেগোনা এবং সীমিত সুযোগ পাওয়া কিছু চরিত্র অবশেষে মগজে ঢুকে যায়, যার কারণে তাদের পরিণতি জানতে একটানা পড়ে যেতে হয়, সাগ্রহে।

শেষ বিচারে আনিসুজ্জামান, নীলোফা, রাধিকা, জামাল কৌশিক, দেবোপম, শিঞ্জিনি, মাস্টার সত্যব্রত ও অন্ধ- এই ক’টি চরিত্রগুলোই মনে দাগ কেটে যায়।
এদের চরিত্রের গভীরে আলো ফেলা যাক।

৩.
সর্বধর্ম সমন্বয়ী চেতনা থেকে উৎসারিত দেবী দুর্গাকে নিয়ে আনিসুজ্জামানের গবেষণাকর্ম আশ্চর্যজনকভাবে দুই ধর্মের কাছেই নিগৃহীত হয়। তার কলিগরা এই কাজে খুঁজে পান দেবীদুর্গার প্রতি অশ্রদ্ধা, আর তার পরিবার তাকে হিন্দুধর্মঘেষা বলে ঘোষণা করে এবং পারিবারিক উৎসবে তাকে করে অবাঞ্ছিত। কিন্তু তার পরও তিনি নিজ আদর্শে থাকেন অটল- ‘সহিষ্ণুতা সহিষ্ণুতা, এর পথ সবসময়ই দুর্গম কিন্তু এই ই মানুষের যথার্থ লক্ষ্যের পথ, মানুষের অন্ধত্ব এবং ঔদার্য দুইয়ে মিলেই তার কাজ পাবে পূর্ণতা।

নকশাল আন্দোলনে দেবার্চন আর নীলাদ্রি হারিয়ে গেলেও উপন্যাসের শেষদিকে উঠে আসে জামাল কৌশিক, তার পাগল মুখ দিয়ে লেখক বলিয়ে নেন কিছু তিক্ত সত্য, বামফ্রন্ট তখন ক্ষমতায়, “ওরা আপোসহীনতার কথা বলত, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য এখন কমিউনিজমের মুখোশ পরে সাম্রাজ্যবাদের দালালি”। কিন্তু এই একদল পাগল, যারা শ্রেণীশত্রু খতমের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ, কৃষক শ্রমিকের হাতে বুর্জোয়া ও পুঁজিপতিদের কুক্ষিগত ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের দলে দলে হত্যা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। নকশাল দেখলেই তখন মেরে ফেলবার নিয়ম ছিল, কারণ এই আন্দোলন তখন হিংসাত্মক এবং চোরাগোপ্তা হামলায় পূর্ণ ছিল, রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর এদের মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছিল তাদের সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দিয়ে, দলের আদর্শসংক্রান্ত তাত্ত্বিক আলোচনার প্রশ্নে বিভাজিত হয়েছিল নেতৃত্ব, কিন্তু এত কিছুর পরেও সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ছিল এদের প্রতি। লেখকের ভাষায়- তারা ছিল স্বপ্নবান, হয়তো তাদের পদ্ধতি ভুল ছিল কিন্তু পথে কোন অন্যায় ছিল না।

সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞ জামাল কৌশিকের মাধ্যমেই নীলোফার প্রতি আনিসুজ্জামানের ঘটে প্রেমবোধের জাগরণ, দগ্ধ নীলোফাকে কৌশিক প্রথমবারের মত ভাবতে শেখায়, সে আসলে পদ্ম, নীলোফা নামটা অসম্পূর্ণ, আর নীলুফার বা পদ্ম নামটাই তার অলংকরণ, কৌশিক নীলোফার পুড়ে যাওয়া শরীর দেখে আনিসুজ্জামানের মত বমি করে না, বরং তাকে ভালোবাসা শেখায়, পীরবাবার কাছে করা নীলোফার মানত এভাবেই পূরণ হয়, কেননা ছোটবেলা থেকেই তার ঝলসানো রূপ সবার কাছে নিগৃহীত এমনকি, আনিসুজ্জামান তার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও ঐ একটা ব্যাপার কখনো গ্রহণ করতে পারেন না, যার কারণে সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত হয়েও তার ঘরেই বোরকা পরে থাকতে হয় নীলোফাকে, শুধুমাত্র ঐ কদর্য রূপ ঢেকে রাখার জন্য। কিন্তু, হঠাৎ ফিরে এসে আবার উধাও হবার আগে কৌশিক একটি বড় শিক্ষা দিয়ে যায় আনিসুজ্জামানকে। ফলে, আনিসুজ্জামানের কাছে চাচাত বোন নীলোফা আশ্রিত হন না, বরং নীলোফার হৃদয়ের কাছেই আশ্রয় গ্রহণ করেন আনিসুজ্জামান।

বাবা ছিল পদাবলির গায়ক, তবে পদাবলির প্রতি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই ভালবাসা শুধু নয়, একে আত্মস্থ করা, তার অর্থগুলো স্পর্শ করা, এর মাধ্যমেই রাধিকা অসাধারণ হয়ে ওঠে নীলিমার পুত্র এবং বৌ হতে প্রত্যাখ্যাত তৃণাংকুরের কাছে। আর এক রাধিকা তার হৃদয়ে কখনো জায়গা দেয় শমসেরকে, কখনো দেবর পরমেশের মধ্যে খুঁজে পায় সমশেরকে, আপন স্বামী কার্তিক কেবল দূরেই পড়ে থাকে, পলাশ এবং জোছনকে নিয়ে একাকী কষ্টের সংসারে সে যে আনন্দের কাব্য রচনা করত, তা আগে আবর্তিত হত কল্পনায়- শমসের কে দিয়ে, আর এখন তৃণাংকুরকে দিয়ে।

বস্তিবাসী চরিত্রগুলোর মধ্যে শেফালির মা, অন্ধ আর মাস্টার অভিনব চরিত্র। শেফালির মা রাধিকাকে পরম মায়ায় আগলে রাখে এবং পূর্ববঙ্গীয় গ্রাম্য বচন দিয়ে আভাস দেয় তার প্রজ্ঞার, তার নামের আড়ালে হারিয়ে যায় আসল নাম- সুমিত্রা। অন্ধ আরেক আশ্চর্য চরিত্র, যে কেবল ভবিতব্যের গন্ধ পায়, অতিপ্রাকৃত যেন বাস্তব হয়ে ওঠে তার ভবিষ্যৎবাণীতে। এদিকে তার মাস্টার একজন সৎ চরিত্র, যে বস্তিতে পড়ে আছে এক মহতী লক্ষ্য নিয়ে, জীবনের দার্শনিক ব্যাখ্যাগুলো যার ডায়েরির পাতায় লেখা হয়ে থাকে আর মুখ দিয়ে ঝরে পড়ে অন্ধর কানে, বস্তির সাধারণ ছেলে হয়েও অন্ধ ক্রমশ জীবনকে চিনতে শেখে।

৪.
বসুধারা উপন্যাসে অনেকগুলো কাকতালীয় ব্যাপার খুব চোখে লাগে, যেমন-

কাজ করতে এসে রাধিকা দেখে তার মালকিন নীলিমার বাড়িও পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ঢাকার সেই খিলপাটনি গ্রামে।
রাধিকার প্রেমিক শমসের আবার ফিরে আসে কলকাতায় এবং প্রায় দেখা হয়ে যায় রাধিকার সাথে এটাও কেমন যেন জোর-করানো।
ডায়েরির পাতায় দেবোপম আর মাস্টারের লেখাগুলো সমগোত্রীয় না হলেও তাদের চরিত্রের শিকড় প্রায় একই আর হয়তো এজন্যই দুজনেই লেখে দিনলিপি।
খুব আকস্মিক ঠেকে দেবোপমের মৃত্যুর সাথে সাথেই জিনির মৃত্যু, যদিও দুজনের মৃত্যুর কারণই যথাযথভাবে প্রস্ফূটিত।
কৌশিকের সাথে নীলোফার সম্পর্কে জড়ানোর পর যখন নতুন সন্তান আগমনের জানিয়ে নীলোফা বলে, সে গর্ভবতী, তখন একটা ধাক্কা খেতে হয়।
মুক্ত মানুষ নীলিমা চাকুরি করে ও বৈধব্যজনিত সংস্কার অস্বীকার করেও নিজ পুত্রের সাথে কাজের মেয়ে রাধিকার প্রেম মেনে নিতে পারেন না, তখন এই চরিত্রকে মনে হতে থাকে বৈপরীত্যে ঠাসা।
দেবোপম অনুপমের মা শবরীর সাথে অরুণ বোস কিংবা পুত্রসম অরূপের সম্পর্ক খুব বিকৃত ও অস্বাভাবিক বলে প্রতিভাত হয়, তবে এ কারণেই দেবোপমের আত্মহত্যার কারণটুকু যেন খুব সঙ্গত হয়ে ওঠে।
আর মনে আঁচড় কেটে যায়, সহজ সরল কবিতার মত মেয়ে জিনি, তার প্রতি লক্ষ্মী ও দেবাশিসের নির্যাতন আর এর মাঝেই তার মানিয়ে ওঠার সংগ্রাম, শেষে তার অনাবশ্যক মৃত্যু।
তবে প্রেমের বর্ণনায় তিলোত্তমা মজুমদার অনবদ্য। নীলোফার ও কৌশিক, র��ধিকা ও শমসের, শিঞ্জিনী ও দেবোপম- এদের মিলনের বর্ণনায় তিনি একই সাথে আশ্চর্য পরিমিত এবং বাঁধভাঙা।

৫.
অনেকগুলো মনছোঁয়া বক্তব্য ছিল লেখার ফাঁকে ফাঁকে, যা চিরন্তন এবং জীবনঘনিষ্ঠ।

*সব মানুষই আসলে একটি বস্তুর জন্য আরাধনা করে, তার নাম আনন্দ, এই অপার আনন্দ, যা পাওয়া গেছে প্রথমবার, তার জন্য বেহিসেবি হলে চলে না।
*ব্যক্তিস্বাধীনতাই মানুষের সেই শেষ ভয়ংকর শব্দ, যা পরস্পরকে বিচ্ছিন��ন করে দেয়, যা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করায় না, উপলব্ধি করায় না, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া কিছুই নয় যদি তুমি এর সঠিক ব্যবহার না কর। তোমার স্বাধীনতার ইচ্ছা যেন অন্যের ইচ্ছাকে ব্যাহত না করে কারণ ঐ দাবি তারও আছে।
*বিধিবিধানের মধ্যে নয়, পুণ্য আর কল্যাণের সবটাই নিহিত থাকে ভালবাসার মধ্যে, সততার মধ্যে।
*যত্ন না করলে স্মস্ত সম্পর্ক অভ্যাসে পরিণত হয় বা অভিযোগে। পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষিত বসবাস কেবল সহবাস হয়ে ওঠে, কখনো বা অসহ বাস।
*সুখ দুঃখ সবার জীবনেই আছে, তা পেরিয়ে যাওয়াই কাজ, যদি অন্যের আনন্দ দেখে ঈর্ষায় পুড়ে না যায় কেউ, তবে পরিশ্রম বা অভাব কিছুই মানুষের মনকে মারতে পারে না, মনের সেই আলো তাকে উজ্জ্বল করে রাখে। ভাল রাখে।
*মানুষের চেতনায় প্রশ্ন সূর্যোদয়ের মত অমোঘ, অনিবার্য সত্য। প্রশ্নকে ঠেকানো যায় না, থামানো যায় না, হত্যা করা যায় না, আর তাই মানুষ প্রশ্নকেই এড়িয়ে চলতে চায়।
*সাধারণ মানুষ সর্বক্ষণ নিজের মধ্যে ধর্মভেদ জারি রাখে না, রাখে মাত্র কয়েকজন, আর তারাই অন্যদের মধ্যে এই ভেদ চারিয়ে দেয়, স্বার্থে বা অন্ধ সংস্কারে।
*অবিশ্বাস করলে কি কিছু পাওয়া যায়, বিশ্বাস করলে যা পাওয়া আয্য, তার তুলনায়? বিশ্বাস করলে ঠকতে হয় কখনো কখনো কিন্তু জীবনের যা কিছু প্রাপ্তি তা বিশ্বাস থেকেই উঠে আসে, অবিশ্বাসের ফলাফল চিরকালই শূন্য।
*এই যে দাবি নেই, যৌনতা নেই, চাহিদা নেই, তবু এই যে বুকে লেগে থাকা কষ্ট, এই যে মনে পড়া, জেগে থাকা বোধ- এরই নাম প্রেম, সুন্দর, অনাবিল প্রেম।
*যে হারিয়ে যেতে চায়, তাকে খোঁজার মধ্যে অর্থহীনতা থাকে, আগলে রাখা তাকেই সম্ভব যে আগল স্বীকার করে নেয়। যে মানতে শেখেনি তার ওপর জোর করা যায় কিন্তু মানিয়ে তোলা যায় না।

এরকম কিছু বক্তব্য পড়লেই ভাল হয়ে যায় মন। জীবনকে যেন চেনা যায় ভিন্ন কোণে। জটিল জীবনের বিচিত্র আখ্যানের সাথে সাথে এইসব বয়ান যেন বসুধারা উপন্যাসের বাড়তি পাওনা।


Profile Image for Rupam Das.
72 reviews2 followers
August 10, 2021
বসুধারা
তিলোত্তমা মজুমদার
আনন্দ
৩৫০ টাকা
মাথুরগড় এ বিভিন্ন শ্রেনীর ,জাতির মানুষের বসবাস।তাদের জীবনযাত্রার নানা দিক নিয়ে লেখা এই উপন্যাস।কেউ এখানে তিব্র কুসংস্কারছন্ন রক্ষনশীল, কেউ সংস্কারমুক্ত, কেউ পারিবারিক অশান্তিতে অবসাদগ্ৰস্ত আবার কেউ ভীষণ ভাবে একা।এক‌ই অঞ্চলে গড়ে উঠলেও বস্তি এলাকা ,উদ্বাস্তু কলোনি এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্ত পাড়ার মানুষের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য উপস্থিত। উপন্যাসের সময়কাল খুব সম্ভবত ৭৭ ৭৮ সাল তাই নকশাল আন্দোলনের পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা রয়েছে। এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে মাথুরগড়েও। এই জনপদে কারোর ভাই বা ছেলে কারোর ছাত্র বা কারোর বন্ধু নিঁখোজ বা পুলিশের এনকাউন্টারে মৃত। উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র গুলি ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও শ্রেণীর হয়েও প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যেনো এক সূতোয় গাঁথা। তাদের মধ্যে দিয়েই ভালোবাসা, বেদনা, হতাশা,দ্বন্দ্ব, হিংসা, ঘৃনা, দয়া, অসহায়তা,সাহসিকতা প্রকাশ পেয়েছে সমগ্ৰ রচনায়। শেফালীর মা,রাধিকা,তৃনাঙ্কুর,দেবোপম,আনিসুজ্জামান, নীলিমা চরিত্রগুলি বিশেষভাবে মনে গেঁথে গেলো।তবে আমার মতে সবাই কে ছাপিয়ে গেছে এক নারী চরিত্র নীলোফা।ছোট বেলায় ঘটে
যাওয়া এক ভয়ংকর দূর্ঘটনায় প্রানে বেঁচে গেলেও পুড়ে যায় দেহের উর্ধাংশ।তারপর শুরু হয় তাচ্ছিল্য অবহেলা উদাসীনতা ঘৃনা।সব অপমান কে দূরে ঠেলে জীবনে মানসিক দৃঢ়তার সাথে তাঁর এগিয়ে চলা আমার ভীষন ভালো লাগলো। আবার কিছু চরিত্রের নেতিবাচক পরিনতি মনকে ভারাক্রান্ত করল।সবমিলিয়ে উপন্যাস 'বসুধারা' নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে মানবতার সাথে জীবনে এগিয়ে যাওয়া কেই গুরুত্ব দেয়।
Profile Image for Nira Mukherjee.
37 reviews5 followers
September 15, 2025
এই পৃথিবীর স্রোত সে স্থায়ী নয়, সে বহমান।‌ যুগে যুগে মানুষের মনন ও তার সামগ্রিক পরিমন্ডলে যা কিছু আছে সবই বয়ে চলে নিজের স্ফূর্তিতে।‌ মানুষ নিষ্ফল ব্যর্থতায় ধরে রাখতে চায় তার হাতের মুঠোয় সবটা, কখনও সেই ধরে রাখা হয় বিশ্বাসে আর কখনও সর্বশক্তি দিয়ে।‌কিন্তু দুই ভাবেই সে ব্যর্থ হয় - কারণ ধ্রুব বলে সে যা জানে, মানে, তাতে ভাঙ্গন ধরে কোনো না কোনোদিন। আর এই ভাঙ্গনই বহমান কাল।কালের স্রোত। এই ভাঙ্গন যা মানুষকে বদলায়, তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলায় তার চেতনাকে নতুন আলো দেয় - আর বর্ষিত করে চিরন্তন অমৃতের বসুধারা.
এই কাহিনীর পটভূমি মাথুরের গড়। বিত্তশালী, কৌলিন্যমন্ডিত এক পাড়া - যার পাশেই রয়েছে উদ্বাস্তু কলোনী আর ফটিকবিল বস্তি। এই অঞ্চলের সর্ববিত্ত ও বিত্তহীন মানুষের ক্রম বসবাস ঘিরে গড়ে ওঠা, পাপ, পূণ্য, প্রেম, ভালবাসা, ব্যর্থতা, কষ্ট, অপমান, সংস্কার, দ্বন্দ্ব, ঈর্ষায় জারিত হয় "বসুধারা"র যাত্রা। আলাদা হলেও এই উপন্যাসের প্রতিটি মানুষ একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত এবং অদ্ভুত ভাবে একাকী। এই একাকীত্ব অঙ্গাঙ্গী জড়িত থাকে উপন্যাসের সমস্ত চরিত্রের মধ্যে আর তাদের সবার হৃদয়ের অতলে তির তির স্রোতে বয়ে যায় প্রেম এক অদ্ভুত মুগ্ধতায়.
এই নিরন্তর স্রোতে ভেসে আসে, মল্লিনাথ ডাক্তার। মাথুরের গড়ের সর্বজনবিদিত তিনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সংস্কার শিকড় গেড়ে বসে তার চেতনে, আর তাকে করে তোলে আত্মক্ষয়ী। আস্তে আস্তে তার থেকে দূরে চলে যেতে থাকে তার স্ত্রী, দুই সন্তান। তার এই বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়ে থাকেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যিনি ধর্ম আর সংস্কারের দ্বন্দ্বে একা হয়ে গেছেন বহুদিন; তবু কি আশ্চর্য ভাবে একদিন তিনি মুখোমুখি হন তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমের.
"প্রেম" --- সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা ---- আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে - জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে ----
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে! --
প্রেম আসলে কি? সে এক অনিবার্য বিষ্ময়। চোখের দর্পণে জাগরুক হয়ে সে ছড়িয়ে পরে স্বপ্নে, মননে, শরীরে। তাকে ধরা যায় না, বোঝা যায় না। কিন্তু তার কাছে আহুতি দেওয়া যায় জীবন। মাথুরের গড়ের দেবপম এমনই এক বিস্ময়ে নিগূঢ় পথে পৌঁছে গেছিল জিনির কাছে। জিনিও কি তাকে প্রেম বলে ভেবেছিল? সে শুধু বুঝেছিল পবিত্রতা, সমর্পণ - তার শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায় তা তাদের দুজনের কেউই অনুধাবন করতে পারেনি হয়ত। তবু জেগেছিল চোখ। শব্দ হয়ে গিয়েছিল কবিতা। কবিতার উত্তরণ ঘটেছিল বৈষ্ণব পদাবলীতে। যার সুরে সুরে খিলপাটনি গ্রামের রাধিকা, উদ্বাস্তু কলোনীর রাধিকা ভেসে গিয়েছিল শমসেরের সঙ্গে। শমসেরকে খুঁজেছিল পরমেশের অস্তিত্বে, আর ডুবতে ডুবতে, ভাসতে ভাসতে তৃণাঙ্কুরের হাত ধরে পেয়েছিল আর এক জন্ম। আর এক জন্ম পেয়েছিল নিলোফাও। জামাল কৌশিকের স্পর্শে। ছোট্টবেলায় হঠাৎ অসাবধানে আগুনে দগ্ধ হওয়া নিলোফা, মানুষের করুণায়, ঘৃণায়, বঞ্চনায় নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়া নীলোফা প্রেমকে দেখেছিল গ্রীষ্মের দুপুর ঝলসানো আলোয়। পোড়া শরীরের পাপে ক্লিষ্ট সেই নারী যেনো ধ্যানস্থ হয়েছিল সেদিন এক অপার বিস্ময়ে। যে বিস্ময়ে ঝাড়ুদার হরিচরণ ময়লার স্তুপে খুঁজে পায় এক শিশু আর তাকে বুকে তুলে নেয় স��্তান স্নেহে - আর তাদের থেকে একটু দূরে ফটিকবিল বস্তিতে, এক অন্ধ বালক স্পর্শ করে চলে মানুষের অতীত, বর্তমান হয়ত বা ভবিষ্যৎ।
অদ্ভুত আলোর মত সব মানুষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় এই উপন্যাসের পাতা, আর এই সব কিছুর মধ্যে জীবন তার অসামান্য সম্ভাবনা বুকে করে নির্লিপ্তিতে আবর্তিত হতে থাকে। তার পটভূমিতে কখনও ফুটে ওঠে প্রশান্তি, কখনও বা ক্ষয়।কিন্তু জীবন থামে না। অলক্ষ্য থেকে প্রাচীন রহস্যময়তায় নিত্য গড়ে ওঠে মিলন, বিচ্ছেদ, প্রেম, বেদনা, প্রাপ্তি, শোক - আর জীবনের এই তরঙ্গকে মথিত করে জ্বলে থাকে এক অসামান্য আলো যার নাম "বেঁচে থাকা"
তিলোত্তমা মজুমদারের লেখনী অপুর্ব। কোনো কোনো জায়গায় কবিতার মতো লেগেছে কিছু কিছু লাইন। প্রতিটি চরিত্রের অনুভব, তাদের অনুভূতি, জীবনকে দেখার ভঙ্গি - যেভাবে তিনি বর্ণনা করেছেন - অসাধারণ লেগেছে। তিনি যেমন বিকৃতি দেখিয়েছেন, তেমনি সৌন্দর্য। তবে, আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে, শেষ টা একটু তাড়াহুড়ো করে হলো। শমশের আর রাধিকার বিষয়টা যেনো ঠিক মিটেও মিটলো না, তবে জীবন এমনই যেখানে সব কিছু মেটে না...সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ঠিকই আছে।
"বসুধারা" উপন্যাসটি বহু দিন আমার শেলফে পড়েছিল, এবং কেন জানিনা আমি ঘুরে ফিরে দেখতাম, কিন্তু পড়িনি। তবে, সময়ের আগে বা পরে যেমন কিছু হয়না - তাই হয়ত সঠিক সময়েই এই উপন্যাস উঠে এসেছে আমার হাতে। এই উপন্যাসের মধ্যে থাকা জীবন - তার অক্ষমতা, হারানো পাওয়ার দ্বন্দ্বের মাঝেই আঁকড়ে ধরে রেখেছে সব কিছু আর ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে এক অনন্য পৃথিবী। আমি, সেই সময়ের কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো "বসুধারা" র পৃথিবীর সাথে আমার দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য.
1 review
June 8, 2025
বসুধারা
তিলোত্তমা মজুমদার

মানুষ কি এভাবেও ভালোবাসতে পারে? যে ভালোবাসায় দয়িতের চোখের দিকে তাকিয়ে উপেক্ষা করে যেতে পারে মৃত্যুকে! সমস্ত কলুষতা ভুলে চাইতে পারে নতুন ভোর! কিংবা এমন ভালোবাসা; যেখানে বিরক্তি, ঘৃণার মধ্যেও ফুটে ওঠে নির্ভরতা। আবার এমন ভালোবাসা যা সামাজিক প্রতিপত্তির গণ্ডি পেরিয়ে যায় শুধুমাত্র একে অপরের জন্য। কিংবা এমন ভালোবাসা যা দেশের-দশের কল্যাণে কখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি আর। আবার এত ভালোবাসার মাঝেও মনে পড়ে সেই অন্ধ ছেলেটির কথা যে কিনা ভবিষ্যতের গন্ধ পায়; অন্ধকার জীবনের গন্ধ পায়; মৃত্যুর গন্ধ পায়। আর আছে শিউলির মা, রাধিকা, আনিসুজ্জামানের ছোটোকাকীর মত আরও কত কত স্বশিক্ষিত মানবী যারা স্কুলের গণ্ডি না পেরিয়েও শিক্ষা নিয়েছেন নিজেদের জীবনের থেকে। সেই জীবনদর্শনে কোনো খাদ নেই।

এরকমই কিছু প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গল্প, জীবনদর্শনকে সঙ্গে নিয়ে একই সঙ্গে মুগ্ধতা আর মনখারাপে আবিষ্ট হতে চাইলে পড়েই ফেলতে পারেন তিলোত্তমা মজুমদারের 'বসুধারা'।
Displaying 1 - 5 of 5 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.