‘যে কোন মূল্যে’ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করিতে হইবে। এই শপথবাক্য নিত্য যাঁহারা উচ্চারণ করিয়া থাকেন তাঁহারা নিজেদের বলিয়া থাকেন ‘স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী’। সবার উপরে স্বাধীনতা সত্য, তাহার উপরে নাই। স্বাধীনতার নিকট শুদ্ধ প্রাণ নহে, খোদ ন্যায়বিচারও তুচ্ছ। এমনকি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটাইতে হইলেও স্বাধীনতা রক্ষা করা ন্যায্য। যাঁহারা এই দাবি তোলেন তাঁহাদেরই অপর নাম প্রকৃত প্রস্তাবে ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী’ বা লিবারেল। এই বইয়ের ১৮ প্রবন্ধে সলিমুল্লাহ খান নানান দিক হইতে প্রশ্ন তুলিয়াছেন লিবারেলিজম বা স্বাধীনতা-ব্যবসায় মতবাদটি কেন এই স্ববিরোধে পরিপূর্ণ। আরব নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ দেখাইয়াছেন আধুনিক জগতের জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারাই সাম্প্রতিক আত্মঘাতী বোমাবাজণের পূর্বপুরুষ। তাহার বহু আগে ফ্রানৎস ফানো দেখাইয়াছিলেন এই ব্যবসায়ীদের তত্ত্বজ্ঞানী হেগেলের দুনিয়ায় দাস শ্রেণীর বাসনা শ্রমের মধ্যে সীমিত না নির্দিষ্ট। মেহনত-প্রমেহনতেই তাহাদের মুক্তি। ফানোর দুনিয়ায় দেখা যায় ইহার বিপরীত দৃশ্য। সেই দুনিয়ায় দাস শ্রেণীর বাসনা শ্রমে নহে, বরং শাসনে। দাসেরা সেখানে মনিব অর্থাৎ শাসক শ্রেণী হইতে চাহে। সলিমুল্লাহ খান আদমবোমার মধ্যে এই বাসনারই ভাষা খুঁজিয়া পাইয়াছেন। তাঁহার বিচারে আদমবোমা শুদ্ধ পদার্থ নহে, পদও বটে। পদ ও পদার্থ যেখানে একাকার হয় তাহাকে বলে সম্বল বা সিম্বল। আত্মহত্যা করিয়া কহে স্বাধীন হয় না এ কথা সত্য কিন্তু আত্মহত্যার সম্ভাবনা হিসাবে না লইলে স্বাধীনতার কোন ভিত্তিই থাকে না। মহাত্মা গান্ধি হইতে স্যার বিদিয়াধর সুরজপ্রসাদ নাইপল, পণ্ডিত এডোয়ার্ড সায়িদ হইতে কবি শামসুর রাহমান পর্যন্ত স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের নানান রূপ এই বইতে দেখানো হইয়াছে। তাহা হইলে মানব জাতির ভবিষ্যৎ কী?
Salimullah Khan is a Bangladeshi writer, thinker, critic, and public intellectual. Regarded as an eminent thinker of Bangladesh, Khan explores national and international politics and culture using Marxist and Lacanian theories. Informed and influenced by Ahmed Sofa's thoughts, his exploration of Bangladesh's politics and culture has a significant following among the country's young generation of writers and thinkers.
Khan translated the works of Plato, James Rennell, Charles Baudelaire, Frantz Fanon, Dorothee Sölle into Bengali. In Bangladesh, he is a regular guest in talk shows on national and international political issues.
A proponent of anti-colonial movements, Khan has engagements in the global and regional political economy and culture from a Lacanian-Marxist perspective. A critic of Western interventionism, Salimullah Khan analyzes Western thought and discourse through critical scrutiny of the colonial and imperial legacy of the West. From this perspective, he has written on the works of Charles Baudelaire, Walter Benjamin, Michel Foucault, Frantz Fanon, Claude Lévi-Strauss, Edward Said, Aime Cesaire, Talal Asad and many others. Since 1997, his engagement with Freud and Lacan has made him use psychoanalysis to explore Bangladesh's politics and culture and also international issues. He also wrote two books on Freudo-Lacanian philosophy: Freud Porar Bhumika, and Ami Tumi She.
'আদমবোমা' নামটি বোধকরি স্বাভাবিক শব্দজ্ঞানে আসে না। হ্যাঁ, সলিমুল্লাহ খান কবুল না করলেও বলতে পারি নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিদ্যার শিক্ষক তালাল আসাদের বিখ্যাত গ্রন্থ "On Suicide Bombing " নামের ধারণই খান সাহেবের 'আদমবোমা'।
বেশির ভাগ প্রবন্ধের মূলসুর আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বের সূত্রধরে স্বাধীনতাকামী (অপরপক্ষ মতে,সন্ত্রাসবাদী) ফিলিস্তানিদের নিজেকে সমেত আত্মঘাতী হওয়াকে আপনি ইসলামের প্রভাবে মৌলবাদিতা বলবেন না কি বলবেন আত্মঘাতী ফিলিস্তানিরা কিংবা আফগানিরা স্বদেশপ্রীতির কারণে এই পথ বেছে নিচ্ছেন?
তালাল আসাদের নানা বক্তৃতা, লেখার সাথে তাল মিলিয়ে সলিমুল্লাহ খান যা বলেন তার কায়া অনেকটা দাঁড়ায়-
ইউএস ও তার মিত্রপক্ষ নিজ নিরাপত্তার মুলো দেখিয়ে আফগানি সরকার উচ্ছেদ করেন, ইরাকে হামলা চালান কিংবা ফিলিস্তানিদের হক দাবিকে খাজির করে পক্ষ নেন ইসরাইলের। আর আফগানি,ইরাকি ও ফিলিস্তানিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা ইউএসএ ও তার মিত্রদের মতো রক্তক্ষয়ী পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। তারা ভাবেন নিজে শেষ হবো, সাথে শেষ করবো শত্রুদেরও। এই "বাধ্যবাধিতাকে" ইউএস জোট ইসলামের লেবেল এঁটে বলে ইসলামি "জঙ্গী", অথচ নিজেদের হত্যাযজ্ঞকে নিজ ধর্মের সাথে তো নয়ই, দেশের চূড়ান্ত ভালোত্বের সাথে সাদৃশ্য খোঁজেন পশ্চিমারা।
এই আত্মঘাতী হবার বিষয়আশয় নিয়ে তালাল আসাদ বহু জ্ঞানী, গুণীজনের সান্নিধ্য নিয়েছেন তথা লেখা ধার করেছেন। খান সাহেব আসাদের পিছু ধরেই উদ্ধৃত করেন রবার্ট পাপকে।
রবার্ট পাপ (Robert Pape) নামক মার্কিনমুলুকের গবেষক গবেষণাপূর্বক দাবি করেন,
"১৯৮০-২০০১ সাল পর্যন্ত ১৮৮ টি আত্মঘাতী বোমাহামলা হয়েছে। তারমধ্য শ্রীলঙ্কান তামিল টাইগারা ঘটান ৭৫ টি আত্মঘাতী বোমাহামলা। " তামিল টাইগাররা জাতে তামিল,ধর্মে হিন্দু আর মতে বামপন্থি। তবে গণমাধ্যম কিংবা পশ্চিমারা কেন তামিলদের হামলাকে হিন্দু মৌলবাদিত্ব বলেন জানিয়ে দেন না? এই প্রশ্ন তালাল আসাদের মতো সলিমুল্লাহ খানেরও।
ইহুদি বীর শ্যামসন তথা সূর্যনামীয় আত্মঘাতী মুক্তিকামী পুরুষকে ইহুদীর বীরজ্ঞানে জপ করেন, অথচ ফিলিস্তানি আত্মঘাত মুক্তিপাগলরাই এদের কাছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী। কী নিদারুণ পরস্পরবিরোধিতা!
এ আত্মঘাতী পথ নিয়ে হানা ও জয়ুসী নামীয় পন্ডিতব্যক্তিগণের দাবি,
"আদমবোমা ফিলিস্তানিদের মুক্তিকৌশল মাত্র।"
২০০১ সালের লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধারক সরকার আফগান যুদ্ধে মার্কিনিদের বাংলাদেশের আকাশপথ ব্যবহারের অনুমতি দেন। নিজে কোন গণতন্ত্র বলে এই নাহক অধিকার দিয়েছিলেন সেই কথা জোরেশোরে বলেন সলিমুল্লাহ খান। এই কাজ কেন নাহক তা প্রমাণে হাজির হন পণ্ডিতগণের দ্বারেদ্বারে।
সলিমুল্লাহ খানের নিজস্ব বাক্যরীতি আর শব্দরীতি প্রচলিত সমাজে যতই অপ্রচলিত হোক না কেন। তাঁর শব্দরীতি,বানানরীতিতে বুদ্ধিবৃত্তির আলাদা ছাপ চোখে পড়ে। সেই অর্থরীতির বলেই তিনি "Liberalism " লিবারালিজম শব্দের তর্জমা করেন স্বাধীনতা ব্যবসায়ী।
সারা বইতে স্বাধীনতা ব্যবসায়ীদেরকে খুব ভালো মনে নেন নাই প্রাবন্ধিক। তবে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠবই মানেন এডওয়ার্ড ওয়াদি সাঈদ রচিত "Orientalism" কে এবং সেরাতম স্বাধীনতা ব্যবসায়ী বলে জ্ঞান করেন সাঈদকে। যদিও, একবাল আহমদ নামক ব্যক্তির সূত্রধরে সমালোচনার বাইরে রাখেন নি সাঈদকেও।
উল্লেখ্য, সলিমুল্লাহ খানের লেখা "Orientalism " বইটির রিভিউ আমার পড়া সেরা বিশ্লেষণী রিভিউ।
বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রবন্ধে ইতালিয় কমিউনিস্ট পার্টির এককালীন সেক্রেটারি আন্তেনিও গ্রামসির বয়ানে জানান দেন,
"বুদ্ধিজীবী সকলেই, তবে ব্যবহার বিচারে পেশার হিসাবে কেউ কেউ মাত্র। "
আবার, তার প্রিয় স্বাধীনতা ব্যবসায়ী সাঈদকে দিয়ে বলান,
"ক্ষমতাবানের মুখের ওপর অকপটে সত্য বলাই বুদ্ধিজীবীর দায়।"
ছফাকে মানেন বাংলার একমাত্র আপাদমস্তক বুদ্ধিজীবী বলে । কেন মানেন তার জবাব দিতেও ভোলেন না।
স্যার সুরযপ্রসাদ বিদ্যাধর নাইপলের গুণমুগ্ধ "প্রথম আলো''র হাসান ফেরদৌস এক প্রবন্ধ লিখেন। কিন্তু চরম কট্টরপন্থী সুরযপ্রসাদ নাইপলকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেন সলিমুল্লাহ খান। স্বয়ং নাইপলের লেখনী মতে,
"নও মুসলমানরাই গোলাম জাতির মানুষ (Colonized people)। "
কট্টরপন্থী নাইপল নও মুসলিম বলতে সমগ্র অনারব অমুসলমানদের ইঙ্গিত করেন। ব্রিটিশপন্থী নাইপলের মুখোশ উন্মোচন করেন প্রাবন্ধিক। এতে সাহায্য নেন নাইপলের লেখাকেই!
"আদমবোমা" প্রবন্ধগ্রন্থের মূল উপজীব্য আত্মঘাতী হবার জায়েজ, নাজায়েজ বিচার নিয়ে। কিন্তু সলিমুল্লাহ খানের পাণ্ডিত্যে খোঁজ পাবেন অজানা কতো তথ্যের,ঘুরে আসবেন জ্ঞানের এক অফুরন্ত জগতে।
এসলাম ও সন্ত্রাসবাদ,শব্দ দুটিকে একত্রে বিশ্ব দরবারে জনপ্রিয় করে তুলেছে আমেরিকা ও তাঁর বন্ধুভাবাপন্ন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা,এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন তাদের কাছে প্রশ্ন তোলা হয় যে,"সন্ত্রাসবাদ কী আর এসলামই বা কী তাদের সংজ্ঞা দাও?"- তখন সেসব দেশের নেতাদের হতবুদ্ধিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এমতাবস্থায় যখন তাদের পকেট সংগঠন জাতিসংঘ পর্যন্ত কোনো সংজ্ঞা ঠিক করতে পারে না তখন ত্রাতার ভূমিকায় আসেন সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ এসরায়েল এর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু,তিনি বলেন,"যা কিছু পাশ্চাত্য,এসরায়েল,এয়াহুদি-নাসারা ট্রাডিশন বা সভ্যতা এবং মঙ্গলের জন্য শত্রুভাবে আপন্ন তাই সন্ত্রাসবাদ"।এরুপ গায়ের জোরে দেয়া সংজ্ঞা সাধারণ মানুষ কতটুকু গ্রহণ করবে সেটা একদিকে দেখার বিষয়। আবার যখন পশ্চিমা শ্রেণির কাছে জানতে চাওয়া হয় যে,"সন্ত্রাসবাদের সাথে এসলামের কী সম্পর্ক?"-তখনও তারা কোন সদুত্তর দিতে পারে না,তখন শুধু তারা উদাহরণ দেয়। বর্তমানেও এমন একটা উদাহরণ তারা দিচ্ছে,তারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে আখ্যায়িত করছে। তবে যখন এই সমস্যার গোড়ার দিকে যাওয়া হবে তখন দেখা যাবে যে এই সংকটের জন্ম দেয় পশ্চিমারাই। তারাই গায়ের জোরে ফিলিস্তিনের ভূখন্ডে এয়াহুদিদের স্থান দেয়,সাথে সাথে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করতে তাদের বিরুদ্ধেই এয়াহুদিদের লেলিয়ে দেয়,সেসময় যখন ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূখণ্ডের জন্য সংগ্রাম করে তখন তা হয় অন্যায় যুদ্ধ আর যখন এয়াহুদিরা ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে তা হয় ন্যায় যুদ্ধ। সারাবিশ্বে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা সাম্রাজ্য এ পর্যন্ত অনেক ন্যায়যুদ্ধ চালিয়েছে,উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোঃ- এরাক যুদ্ধ,আফগান যুদ্ধ ইত্যাদি। এমন অবস্থার প্রেক্ষিতেই যখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবি মহাত্মা সলিমুল্লাহ খান তাঁর বই "আদমবোমা" তে গোড়ার দিককার একটি প্রশ্ন তোলেন যে," ন্যায় কী বস্তু? উহার সংজ্ঞাই বা কী?"- তখন আমার মতো সাধারণ পাঠকের মৌনতা অবলম্বন করা ছাড়া আর কীই বা করার থাকে?
সলিমুল্লাহ খান এমন একটা ভাষায় লেখেন যে ভাষায় লিখতে হলে আমাকে বেশ কয়েকবার জন্ম নিতে হবে! কাঠখোট্টা প্রবন্ধ যে এত সরস হতে পারে কে জানতো। টেক এ বাও, ম্যান।
"আদমবোমা" ওরফে আত্নঘাতী বোমা । একুশ শতকে এসে "এসলাম" আর "আদমবোমা" যেন প্রতিশব্দে রুপ নিয়েছে। অন্য দিকে মানবাধিকার পাইকারি ডিলারেরা এই "আদমবোমার" ধুয়া তুলে চষে বেড়াচ্ছে এদেশ ওদেশ। কিন্তু আসল কাহিনী কি?
এই বইয়ের ১৮ প্রবন্ধে সলিমুল্লাহ খান নানান দিক হইতে প্রশ্ন তুলিয়াছেন লিবারেলিজম বা স্বাধীনতা-ব্যবসায় মতবাদটি কেন এই স্ববিরোধে পরিপূর্ণ। আরব নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ দেখাইয়াছেন আধুনিক জগতের জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারাই সাম্প্রতিক আত্মঘাতী বোমাবাজগণের পূর্বপুরুষ। তাহার বহু আগে ফ্রানৎস ফানোঁ দেখাইয়াছিলেন এই ব্যবসায়ীদের তত্ত্বজ্ঞানী হেগেলের দুনিয়ায় দাস শ্রেণীর বাসনা শ্রমের মধ্যে সীমিত বা নির্দিষ্ট। মেহনত-প্রমেহনতেই তাহাদের মুক্তি। ফানোঁর দুনিয়ায় দেখা যায় ইহার বিপরীত দৃশ্য। সেই দুনিয়ায় দাস শ্রেণীর বাসনা শ্রমে নহে, বরং শাসনে। দাসেরা সেখানে মনিব অর্থাৎ শাসক শ্রেণী হইতে চাহে।
আত্মহত্যা করিয়া কেহ স্বাধীন হয় না এ কথা সত্য কিন্তু আত্মহত্যার সম্ভাবনা হিসাবে না লইলে স্বাধীনতার কোন ভিত্তিই থাকে না। মহাত্মা গান্ধি হইতে স্যার বিদিয়াধর সুরজপ্রসাদ নাইপল, পণ্ডিত এডোয়ার্ড সায়িদ হইতে কবি শামসুর রাহমান পর্যন্ত স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের নানান রূপ এই বইতে দেখানো হইয়াছে। কিন্তু তাহা হইলে মানব জাতির ভবিষ্যৎ কী?
সলিমুল্লাহ খান যে ভাষায় লিখে গিয়েছেন, যা বলে গিয়েছেন, সে জায়গায় পৌঁছাতে সত্যিই আমার আরো কয়েকবার জন্ম নিতে হবে। কাটখোট্টা ভাষায় রচিত একটা বই এতটা সরস হতে পারে জানা ছিল না। অসাধারণ।
'লিবারেল' দের স্বাধীনতা ব্যবসায়ী বলে এই বইয়ের পাঠ শুরু হয়। লেখক পশ্চিমাদের বিভিন্ন নীতি আর কাজকারবারের মূলে কী আইডিয়া বা ভাবনা লুকিয়ে আছে তা খতিয়ে দেখতে চান। উপমহাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কী উপায়ে বা কোন পরিস্থিতিতে সে সকল চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন তা ও খতিয়ে দেখা হয়েছে। ইতিহাস আর সেই সকল পন্ডিত যারা ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করেন তাদের সাহায্য নেয়া হয়েছে কোনো একটি সাধারণ সমাধানে পৌছানোর জন্য৷ নানা ধরনের ডিসকোর্সের মধ্য থেকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এসে পৌছানোর চেষ্টা করা যথেষ্ট কঠিন একটা কাজ। এর মধ্যে সেই সকল চিন্তার ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা আছে যা দ্বারা অনেক নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে৷ ধর্মনিরপেক্ষতার একটা রুপ আবিষ্কৃত হয় মহাত্মা গান্ধির মধ্যে। তালাল আসাদ একমত হয়েছেন যে " আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার, তাহার গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার গোড়ায় ছিল তথাকথিত অসভ্য জাতির উচ্ছেদ অথবা পরাধীনাবস্থা। একদা এই কথা খোদ বলিয়াছিলেন জার্মান মনীষী ম্যাক্স বেহবার ( Max Weber) ". মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির অবাঙালি হত্যা নিয়ে একটা সংবাদ প্রকাশ হয় পাকিস্তানে। সেই সংবাদের কতটুকু সত্য তার একটা ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যা রটানো হয় তার খুব কমই ঘটে থাকে। পাকিস্তান এর রটানো এ সংবাদ এর মধ্যে তথ্য প্রদানের সততার প্রমাণ আছে কম। তবে নেই এমনটা বলা যায় না। শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ আছে এই বইয়ে আরো আছে আহমদ ছফা, হাসান ফেরদৌস, শামসুর রাহমান এর কবিতা ( স্যামসন কবিতার উৎস নিয়ে ভালো একটা লেখা আছে এই বইয়ে). সব মিলিয়ে বই পড়ার অভিজ্ঞতা খারাপ হবে না। সলিমুল্লাহ খানের লেখার ভাষা আর বিভিন্ন বানান নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু ধৈর্য নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলে ভালো হয়। আর সবকিছু সহজ আর সাবলীল হতে হবে এমনটা আশা উচিত না।
এই প্রবন্ধে আদমপুত্র হাবিল কাবিল থেকে শুরু করে ইহুদি প্রতিশোধ পরায়ন স্যামসন ও শামসুর রহমানের কবিতা অনেক কিছুই উঠে এসেছে যা একটি ঘটনার সাথে আরেকটির কোনো সাদৃশ্য নেই। বাংলাদেশের সংবিধানের শুদ্ধি পরীক্ষা, নাইপলের পাকিস্তান, এডওয়ার্ড সাইদের উদ্দেশ্যমূলক ইসলাম বিদ্বেষ ও তালাল আসাদ ও ইকবাল আহমদের সত্য উন্মোচন এসব কিছুই একটি ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে। আতশ কাচের ভেতর চোখ রাখলে দেখা যাবে সবগুলো তথ্যসূত্র একটি সূত্রে গাঁথা, আর তা হল স্বাধীনতা ব্যবসা। আমরা যা শুনি, পড়ি বা জানি আসলে তাই ধ্রুব সত্য নয়। ধ্রুব সত্যিকে কাছাকাছি দেখতে হলে জানতে হবে সেইসব মনীষীদের কথা যারা আমৃত্যু নিপীড়িত জনগনের বলেছে কোনো দানবীয় প্রভাব ছাড়া।