সৌম্য ভট্টাচার্য-র জন্ম ২৩ ডিসেম্বর ১৯৬৫ সালের কলকাতায়। পিতা শচীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, মাতা প্রয়াতা লীলা ভট্টাচার্য। পাঠভবন, কলকাতা এবং নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কৃতী ছাত্র। কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে মেডিসিনে এমডি। ইংল্যান্ড থেকে এমআরসিপি, এফআরসিপ্যাথ এবং হেমাটোলজিতে সিসিএসটি। বিদেশের বিখ্যাত হাসপাতালে চিকিত্সক হিসেবে কাজ করার পর কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেনিগলস হসপিটালে হেমাটোলজি ও হেমোঅঙ্কোলজি বিভাগে বর্তমানে কর্মরত।খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে গৌড়ের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় লেখা তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস গৌড়গোধূলি বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। পরবর্তী উপন্যাস চির কুয়াশার দেশে দুই বাংলার মিলন নিয়ে লেখা একটি ফ্যান্টাসি স্যাটায়ার। স্বাস্থ্য নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রকাশিত হয়েছে সরল বাংলায় প্রশ্নোত্তরভিত্তিক তাঁর তিনটি গ্রন্থ- ব্লাড ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া থামান এবং ডেঙ্গু থেকে বাঁচুন। শখ গান শোনা, দেশভ্রমণ, বহু বিচিত্র বিষয় নিয়ে পঠন পাঠন ও সংগীতচর্চা। ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ তাঁর গাওয়া আটটি গানের একটি সাম্প্রতিক অ্যালবাম।
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা এক কঠিন সাধনা—সময়ের পুরু ধুলো, মানুষের স্বর, রাজনৈতিক আবহ, বিস্মৃত গন্ধ ও দৃশ্য—সব মিলিয়ে গড়ে তুলতে হয় এমন এক জগৎ, যা পাঠককে বর্তমানের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন না করেই অচিরে টেনে নিয়ে যায় বহু দূরের অতীতে, যেন তিনি নিজের চোখেই সেই যুগের আলো-অন্ধকার, উত্থান-পতন, বেদনা ও গৌরব দেখতে পান।
বিশ্বসাহিত্যের তাবড় ঐতিহাসিক আখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, এই ভারসাম্যই তাদের সার্থকতার মাপকাঠি। ধরুন টলস্টয়ের War and Peace, যেখানে ব্যক্তিগত জীবন ও ইতিহাসের স্রোত এক অনন্ত নদীতে মিশে গেছে, বা উম্বের্তো একোর The Name of the Rose সেখানে মধ্যযুগীয় ইউরোপের ধর্মীয়-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে এক গোয়েন্দা-কাহিনির রূপে মেলে ধরা হয়েছে। কিংবা ধরুন হিলারি ম্যান্টেলের Wolf Hall, যেখানে টিউডর ইংল্যান্ডের ক্ষমতার লড়াইকে দেখানো হয়েছে থমাস ক্রমওয়েলের চোখ দিয়ে, যেখানে ব্যক্তিগত কৌশল ও রাষ্ট্রনীতির জটিল মায়াজাল একে অপরের ছায়া হয়ে উঠেছে।
আলোচ্য উপন্যাসের মঞ্চ গৌড়—সেন সাম্রাজ্যের সাঁঝবেলার সেই শেষ দিনগুলো, যখন বৃদ্ধ লক্ষ্মণসেন রাজকার্যে প্রায় বিমুখ, অথর্ব, আর তাঁর উত্তরসূরিরা দম্ভ, বিলাস আর ক্ষমতার লালসায় বুঁদ।
রাজপ্রাসাদের অন্দরে অবৈধ সম্পর্ক আর কামনার কোলাহল, বাইরে কৃষিজমি নিয়ে কৈবর্ত বিদ্রোহ, ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দুর্দশা, বনিক সমাজের ক্ষোভ, তান্ত্রিকদের রাজনৈতিক ফন্দি—সব মিলিয়ে সাম্রাজ্য এক জটিল আবর্তে ডুবে যাচ্ছে।
এই অস্থির সময়েই বখতিয়ার খিলজির আগমন, যার ঝটিকা আক্রমণে গৌড় পতনের মুখোমুখি।
এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে সৌম্য ভট্টাচার্য অনেকগুলো আখ্যান একসঙ্গে বুনেছেন। রাজনীতি, যুদ্ধ, কবি সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রজাদের জীবন, এমনকি দুই বৌদ্ধ ভিক্ষুর যাত্রা—সব ক’টি স্রোত মিলে তৈরি হয়েছে এক জটিল অথচ খরস্রোতা নদী। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্র মহাকবি জয়দেব—এখানে যিনি শুধু গীতগোবিন্দের গদগদ ভক্তিকবি নন, বরং এক অবসন্ন, সৃষ্টিহীন, বিপর্যস্ত মানুষ।
তিনি নতুন প্রজন্মের বিপ্লবী কবিদের সাহচর্যে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই তরুণরা প্রেম ও ভক্তি ছেড়ে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও সমাজের বাস্তবতা নিয়ে লিখছে—যেন এক অন্যধারার সাহিত্য আন্দোলন।
উপন্যাসের গতি ছোট ছোট অধ্যায়ে এগিয়ে চলে, থ্রিলারের তীব্রতায়। সৌম্য বেছে নিয়েছেন এক প্রায় ‘সাল-তারিখবিহীন’ পদ্ধতি—তিনি সংখ্যার বদলে মানুষের সম্পর্ক, ঘটনার ছাপ, সমাজের টানাপোড়েন দিয়ে সময়কে অনুভব করিয়েছেন। ফলে গল্প হয়ে উঠেছে ‘সময়ের কাহিনি’—কেবল ইতিহাসের রেকর্ড নয়।
কয়েকটি পাশ্চাত্যের লেখা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। সৌম্য ভট্টাচার্যের গৌড়গোধূলি সেই ধরণের আখ্যানসমূহের বাংলা সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না, যদিও তার স্বর, গঠন ও ভাষা সম্পূর্ণ দেশজ। যেমন War and Peace-এ নেপোলিয়নের যুদ্ধ ও রুশ অভিজাত সমাজের চিত্র পাশাপাশি বোনা হয়েছে, তেমনই এখানে গৌড় সাম্রাজ্যের পতনের মুহূর্ত ও রাজসভা, কবিসভা, কৃষিজীবী সমাজ, বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য দ্বন্দ্ব একসঙ্গে পথ চলেছে। যেমন একো তাঁর উপন্যাসে সাল-তারিখকে প্রায় অদৃশ্য করে কেবল পরিবেশ ও মানুষের কথোপকথন দিয়ে সময়কে অনুভব করিয়েচেন আমাদের, সৌম্যও তেমনি কালপর্বকে সংখ্যার বদলে আবহের ভেতর মিশিয়ে দিয়েছেন অদ্ভুত দক্ষতায়।
একটি বড় সাদৃশ্য ম্যান্টেলের Wolf Hall-এর সঙ্গে—সেখানে ক্রমওয়েল ঐতিহাসিক চরিত্র হয়েও কথকের ব্যক্তিগত দৃষ্টি ও কল্পনার আলোয় জীবন্ত হয়ে ওঠে, এখানে জয়দেব, কেশব বা কাহ্নের মতো চরিত্ররাও ঐতিহাসিক প্রমাণের গণ্ডি ছাড়িয়ে মানবিক দুর্বলতা, হতাশা, বিদ্রোহ ও কৌশলের আধারে দাঁড়ায়। ফলে, ইতিহাস কেবল ‘ঘটনার তালিকা’ নয়, হয়ে ওঠে এক জটিল মানবসমাজের প্রতিচ্ছবি।
তবে গৌড়গোধূলি-এর একটি দেশজ বৈশিষ্ট্য আছে যা বিশ্বসাহিত্যের অনুরূপ রচনায় সচরাচর পাওয়া যায় না—বাংলা মধ্যযুগীয় সমাজের বহুমাত্রিকতা। এখানে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আগ্রাসন যেমন আছে, তেমনি কৈবর্ত বিদ্রোহের কৃষিভিত্তিক প্রতিরোধ, রাজসভায় ভক্তিকাব্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সামাজিক কবিতার উত্থান—এগুলো ইউরোপীয় ঐতিহাসিক উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া বিরল।
আরেকটি দিক—উম্বের্তো একোর মতো সৌম্যও পাঠককে ‘তথ্যের দাস’ হতে দেন না। তিনি সাল-তারিখের অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে চরিত্রদের জীবনযাত্রা, ভাষা ও মেজাজে ইতিহাসকে মিশিয়ে দেন। এই শৈলী পাঠককে তথ্য-সংগ্রাহক নয়, বরং অভিজ্ঞতাভোগী করে তোলে—যা ঐতিহাসিক উপন্যাসের অন্যতম বড় গুণ।
যদি তুলনার কথা বলি, গৌড়গোধূলি বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহাসিক ক্যানভাসে একইসঙ্গে দেশীয় ও সার্বজনীন—এখানে আছে ক্ষমতার রাজনীতি, ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম, বিদ্রোহ, শিল্পের টিকে থাকা—যা টলস্টয়, একো, ম্যান্টেলদের মতো আখ্যানকারদের সঙ্গেও সংলাপ তৈরি করতে সক্ষম।
পার্থক্য শুধু এটাই—এই কাহিনির আকাশে ভাসছে বাংলার গোধূলির রঙ, পদ্মার জলের মাটিমাখা গন্ধ, আর সোনার গৌড়ের অস্তগামী সূর্যের শেষ সোনালি আভা; যা কেবল অতীতের এক দৃশ্য নয়, আমাদের নিজেদের ইতিহাসের গভীর, বেদনাময়, অথচ গৌরবদীপ্ত প্রতিচ্ছবি।
তবে এই ঘন আখ্যানের ভেতরে কিছু সূত্র অপূর্ণ থেকে যায়—কয়েকটি চরিত্রের ভাগ্য অমীমাংসিত, কয়েকটি সংঘাতের পরিণতি অদৃশ্য। কিন্তু এই অসম্পূর্ণতাই বাস্তবতার স্বাক্ষর—ইতিহাসও তো কখনো সব উত্তর দেয় না।
বইয়ের শেষে লেখকের ‘পটভূমি’ ও ‘গল্প লেখার গল্প’ বিভাগে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন কোন চরিত্র ঐতিহাসিক, কোনটি কল্পিত, এবং কোথায় তিনি তথ্যের ওপর নিজের কল্পনা বসিয়েছেন। বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাসে এভাবে সৃজন প্রক্রিয়া উন্মুক্ত করে দেওয়া বিরল ঘটনা।
প্রচ্ছদ ও অলংকরণে পিনাকী দে-এর কাজ গল্পের আবহের সঙ্গে মানানসই, যদিও পাঠকের ব্যক্তিগত প্রত্যাশা ভিন্ন হতে পারে। গীতগোবিন্দ ও সমসাময়িক কাব্যের উদ্ধৃতি পাঠের আনন্দ বাড়িয়ে দেয়। প্রুফ রিডিংয়ের ছোটখাটো ত্রুটি ছাড়া ভাষা ও বর্ণনা নিখুঁতভাবে গড়ে উঠেছে।
যদিও সৌম্য ভট্টাচার্য সাহিত্যজগতে comparatively নতুন, তিনি প্রথম পদার্পণেই প্রমাণ করেছেন নিজের সক্ষমতা। এ আত্মপ্রকাশ নবীনের দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপ নয়, বরং ইতিহাসের সেই কিংবদন্তি অষ্টাদশ অশ্বারোহীর মতো এক সাহসী ও বিজয়ী অগ্রযাত্রা।
এ এক সন্ধিক্ষণীর সময়। সেন বংশ অস্তমিত। লক্ষন সেনের রাজত্ব ক্ষয়িষ্ণুপ্রায়। চারিদিকে হানাহানি আর ষড়যন্ত্রের জটাজাল। তার মধ্যে সাংস্কৃতিক কাব্যচর্চা একেবারে তুঙ্গে উঠেছে। কবি জয়দেব, ধোয়ি আরো অনেক কাব্যবিশারাদ লক্ষন সেনের রাজসভা আলো করে বসে আছে। এদিকে বখতিয়ার খিলজী স্বেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাংলার দিকে। তাকে মদদ দিচ্ছে রাজার কাছের কিছু লোক। অবশেষে ঘুন ধরা সাম্রাজ্য অল্প ধাক্কাতেই চুরমার হয়ে গেল। বাংলার বুকে জন্ম নিল এক নতুন বিদেশি সংস্কৃতি। চারিদিকে শুধু লুন্ঠন আর অত্যাচার। সেই যারা আবাহন করে নিয়ে এসেছিল এদের তারাও রেহাই পেল না। পাপের ঘড়া সুদ শুদ্ধ উসুল করতে হলো তাদের। এর মধ্যেই দেখা গেল কেবটদের বিদ্রোহ। যেটা ছিল রাজধানী থেকে দূরে গ্রামাঞ্চলে। এটা দেখে মনে হলো এটাই হয়তো কালে কালে মহীরুহের আকার ধারন করবে। এদিকে জয়দেবও ফিরে গেছে নিজের আপন গ্রামের আলয়ে। যেখানে তাকে ঘিরে আবার একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে। এটাই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে এক আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে থাকে। ওদিকে অন্ধকার সারা বাংলাকে গ্রাস করে।
This entire review has been hidden because of spoilers.
অনেকদিন পরে একটা ভালো বাংলা ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়লাম।
পরপর থ্রিলার পড়ে মাথা একটু শান্ত কিছু পড়তে চাইছিলো - তখন এই বইয়ের নাম আর পটভূমি দেখে আগ্রহ হলো । পড়ে বেশ ভালোই লাগলো। স্নিগ্ধ, মার্জিত ভাষা । মনে হলো যেন দ্বাদশ শতকের বাংলায় টাইম-ট্র্যাভেল করে এলাম।
আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম - শিক্ষিত লেখকের পড়াশোনা / গবেষণা করে লেখা আর 'পপুলার' লেখার মধ্যে ফারাক আছে। এই বইটি প্রথম এবং উৎকৃষ্ট শ্রেণীর। লেখকের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা রইলো, ভবিষ্যতে আরও ভালো লেখা পড়া আশায় রইলাম...