আত্মা, পরকাল এবং ইতিবাচক ও নেতিবাচক শক্তি নিয়ে অতিলৌকিক বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে অলাতচক্র, যার প্রধান চরিত্র তারানাথ। লোকে চেনে তারানাথ তান্ত্রিক নামে। তাঁর ভাষ্যে, তিনি কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। যৌবনে দেশবিদেশ ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সাধনা আর ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তিনি এসব ক্ষমতা পেয়েছেন। সেইসব অভিজ্ঞতা কখনো অভূতপূর্ব, কখনো ভয়জাগানো, কখনো মনোমুগ্ধকর। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে সংসারজীবনে থিতু হয়েছেন তারানাথ, কিন্তু দুর্দম যৌবনের সেইসব দিনের কথা আজও তাঁর স্মৃতিজুড়ে। সেইসব অভিজ্ঞতার গল্পই তিনি বলে চলেন লেখক আর তার সঙ্গী কিশোরী-কে। গল্পগুলো বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের ভার পাঠকের।
Son of late legendary writer Bibhutibhusan Bandyopadhyay of 'Pather Panchali' fame, Taradas Bandyopadhyay had his schooling at the Ramakrishna Mission School, Rahara. Graduating from Maulana Azad College with Honours in English, he went on to do his post - graduation from the Calcutta University.He joined service with the West Bengal government and rose to the position of director in the Information and Cultural Affairs department, from where he took voluntary retirement. Despite his failing health, Bandyopadhyay found time to associate with cultural and social organisations and remained the honorary vice-president of the Indian Forum of Art and Culture. Taradas leaves behind a large number of short stories and two famous novels - তারানাথ তান্ত্রিক and কাজল. 'কাজল' was a sequel to 'Aparajito' written by his father. Taradas is survived by his wife and two sons.
এত গড়িমসি করে পড়লাম যাতে শেষ না হয়ে যায়, তবু শেষ হয়ে গেল...
অলাতচক্র গতানুগতিক 'তারানাথ তান্ত্রিক'-এর চেয়ে সামান্য ভিন্ন ছিল। প্রথম অংশে ছিল সরসী চাটুজ্জের আড্ডাঘর দিয়ে শুরু। সেখানে তারানাথের বাবা আদিনাথের গল্পের মাধ্যমে অমরজীবনের পরিচয় পাই আমরা। এই অমরজীবন কিংবা মৃত্যুঞ্জয় তারানাথের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে জড়িত।
প্রকৃতির অকৃত্রিম বর্ণনার সাথে আরেকটা যেটা ভালো লেগেছে তা হলো বিভিন্ন পদের খাবারের নাম। তারানাথ ভোজনরসিক, যখনই কোনো জমিদারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়, তখন এত খাবারের নাম করে যে শুনে খিদে পেয়ে যায়!
দ্বিতীয় অংশে ছিল, এই উপন্যাসের কথককে নিয়ে। আমরা শুধু তারানাথকেই চিনেছি! কিন্তু তারানাথ এই গল্পগুলো শোনাচ্ছে কাদের? একজন কথক, অন্যজন কিশোরী সেন। তারা দুজনে চাকরি করে এবং ছুটি পেলেই তারানাথের গল্প শুনতে ছুটে আসে– এটা ছাড়া তাদের নিয়ে আর কিছু জানা হয়নি। আগ্রহও হয়নি। মন শুধু তারানাথের দিকেই থাকত। কিন্তু এই পর্বে কথকের গল্পই শুরু হয়। অফিস থেকে তারা কয়েকজন বিহারের এক জঙ্গল এলাকায় চলেছে কোম্পানির কাজে। এতদিন কথকের ধারণা ছিল, তারানাথের গল্পগুলো শুধু গল্পই। ওসব শুধু তার সামনে থাকলেই বিশ্বাস হয় বটে, তবে কলকাতার ভিড়ে নিছক গাঁজাখুরি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কিন্তু এই গহন বনে এসে লেখকের অবিশ্বাসে চিড় ধরে; এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ঘটে সত্যই শরীর শিউরে উঠে!
অলাতচক্রের সর্বশেষ অধ্যায় ছিল "আবার তারানাথ"– খুব জমাটি গল্প না এটা। অনেকটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দেওয়া। তবে সবমিলিয়ে অলাতচক্র সমান আকর্ষণীয় আগের বইয়ের মতো।
বন্ধু ইশরাতের মতে সুখাদ্য বেশিদিন ফেলে রাখতে নেই। তবুও অনেকদিন হলো ফেলেই রাখছি।যদিও প্রথম দুইটার মুগ্ধতার রেশ এখনো কাটেনি। প্রবলেম হলো সেরাম লেভেলের রিডার্স ব্লকে পড়েছি গত এক মাস। যেখানে প্রতি মাসে মিনিমাম ১৫ খান বই পড়ি সেখানে এ মাসে মাত্র ৪টা। তাই ইনাকে হাতে তুলে নিলাম। গত দুইটার মতো এটার স্বাদ ও অমৃতসম। প্রথম ১০০ পৃষ্ঠা তো একদম একটানে শেষ। তারপর একটু মনে হলো গল্পটা টেনেটুনে বড় করা হয়ছে। কিন্তু শেষ হওয়ার পর ভাবছি আর একটু লম্বা করাই ভালো ছিল। এরকম জিনিস আর কবে পাবো?
তারানাথ সম্পর্কে নতুন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। অযথায় তা প্যাচালে পরিনত হবে। অলরেডি বহুত প্যাচাল পাড়ছি।
আহারে, শেষ হয়া গেল। বিভূতিভূষন যে আলোর বিভূতি শুরু করেছিলেন, ঠিক তাই তার যোগ্য সন্তান তারাদাস এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। অলাতচক্র তার শেষ অধ্যায়। আর কোনদিন কলকাতার গলিতে তারানাথের বাসায় আড্ডা বসবে নাহ৷ পাসিং শো সিগারেট টানতে টানতে তারানাথ তার ইউনিক স্টাইলে তার জীবনের অদ্ভুত গল্পগুলা বলবেন নাহ। অমরজীবন অথবা মৃত্যুঞ্জয় কখনো হঠাৎ করে উদয় হয়ে রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করবেন নাহ। তারানাথের শেষে বাপবেটা দিয়ে গেলেন একরাশ শূন্যতা। আমার কাছে তারানাথ অমলিন থাকবেন চিরকাল, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র হিসেবে।
অসাধারণ বললেও কম বলা হয়ে যাবে। তারানাথের অভিজ্ঞতার বেশির ভাগ গল্প জুড়েই থাকে তারানাথের সরব উপস্থিতি।কিন্তু এখানে গল্প কথকের জীবনেরও একটা বড় অংশ জড়িয়ে গেছে তারানাথ কিংবা বলা ভালো,অমরজীবনের সাথে। গত শতাব্দীর মধ্য পঞ্চাশ দশকে কলকাতার মট লেনে বসে যেসব গল্প শোনায়, তার এক দীর্ঘসূত্রতার সমাবেশ দেখা গেছে উপন্যাস জুড়ে। গল্প কখনো চলে গেছে ১ম বিশ্বযুদ্ধেরও শুরুর আগের বাংলার বুকে। সেখানে ঘটেছে লৌকিকতা,অলৌকিকতা আর অতিলৌকিকতার এক অপূর্ব মিশেল! অবিভক্ত গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি, নৈসর্গিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় সহাবস্থান সব মিলিয়ে যে অপূর্ব পটচিত্র অলাতচক্রে আঁকা হয়েছে সে অনেক আগেই হারিয়েছে আমাদের মাঝ থেকে।কিন্তু তার আবেদন আর অনুভব বিন্দুমাত্র কমে নি লেখকের গল্প বুনবার ক্ষমতায়। ভাবতেও অবাক লাগে!তারানাথকে নিয়ে মাত্র দুটো গল্প লিখে প্রয়াত বিভূতিভূষণের পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায় কতটা দারুণভাবে এগিয়ে নিয়েছেন,বলা উচিত, আরো উজ্জ্বল করছেন,শাণিত করেছেন তারানাথের গল্পের মুকুটকে। কী নেই এই অতিপ্রাকৃত উপন্যাসে? বরাবরের মতো অতিলৌকিকতার সাথে তাল মিলিয়েছে প্রকৃতিও। এবার যেন একটু বেশি বড় ভূমিকা তার।দূরের পাহাড়েরা এগিয়ে এসে ঘিরে ধরেছে সার্ভেয়ারদের, আছে ডাইনিদের গাছ "বুদ্ধ নারিকেল" এর অন্তর্ধান,পাসাংমারার গান,বনভূমির নির্জনতা,কখনো বা পাখির মড়ক,আদিম সৃষ্টির সময়কার দুর্যোগ,প্রহেলিকাময় ধোঁয়াশা।আবার মেঘভাঙা একফালি রোদ এসে পড়েছে এমন রূপকথার রাজ্যে,যেখানে যুক্তিতর্কের বিচারে সত্যের নির্ণয় হয় না। স্মৃতিমেদুরতায় কখনো মন একসাথে আনন্দিত হয়েছে,আবার কখনো মৃত্যুর বিষণ্ণতা চেপে ধরেছে চারদিক থেকে।আবার ফিরে এসেছি পঞ্চাশের দশকের কলকাতায় । পাসিং শো সিগারেটটা টেনে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে তারানাথ জমিয়েছে তার গল্প। এভাবে কখন যে কেটে গেল এই কটা দিন!
শেষ হয়ে গেল বলে আফসোস থেকেই যায়।আরো কয়েকটা পাতা নেই কেন!
বলতে ইচ্ছা হয়--এ গল্পের তাহলে এখনও অনেক বাকি? মনে হয় লেখক খসখস করে লিখে জানাবেন--অনেক।আজকে তো শেষই হবে না,যতদিন বাঁচবো একটু একটু করে বলে গেলেও শেষ হবে নন।তবে আজ থাক।আরেকদিন হবে ক্ষণ।তোমরা পানিফলের ঝাঁক দেখেছো কখনও?পানিফলের ঝাঁক অর্ধেক পুকুর ছেয়ে থাকে,কিন্তু যে কোনো একটা জায়গা ধরে টান দিলে একসাথে সবটা নড়ে ওঠে। আমাদের বেঁচে থাকাও ঠিক তাই। আলাদা ঘটনা বলে কিছু হয় না। সবকিছু সবকিছুর সাথে সম্পর্কিত। তুমি আমি তারানাথ অমরজীবন জীবন মৃত্যু হাসি কান্না--সব। তোমাদের এখনও বয়েস অল্প, পরে নিজেরাই সব বুঝবে।
ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস, ডিসেম্বর মাস পরিক্ষার মাস। এই মাসে মাত্র দুখানা বই পড়েছি । দুখানা হলে কি হবে ভাল জিনিস অল্পেই যথেষ্ট। কিন্ডল কিনেছি গত মাসে একটা । কিন্ডলে পড়া প্রথম বাংলা বই । তারাদাসের লেখার হাত চমৎকার। তারানাথ গল্পের সাথে যে সব খাবারের বর্ননা করেছে সে সব সত্যি অতুলনীয় । আমি বরাবরই খাওয়ার পাগল । বাবার মুখে দাদুর খাবার কথা শুনেছি । সম্ভবত বাই জেনেটিক পেয়ে বসেছে । তুলাই পঞ্জি চালের ভাত , গাওয়া ঘি, মৃগেল মাছের ঝোল দিয়ে দেবদর্শন বাবুর বাড়িতে খাওয়ার কথা শুনে আমিও মাঝ রাতে উঠে রান্না করে খেয়েছি :P . রাবড়ি কি জিনিস কোন দিন চোখে দেখিনি , গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি!! ওহ সে সব কি অসাধারন । এককালের গ্রাম বাংলা থেকে কালের বিবর্তনে হাজার হাজার জিনিস হারিয়ে গেছে লেখক যে শুধু হরর লিখেছেন তাই না গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া একটা অধ্যায় ও তুলে ধরেছেন।
এই কয়দিনে এক টানা গল্প গুলো পড়ে বড় মায়া জড়িয়ে গিয়েছে। বিচক্ষণ পন্ডিতমশাই-এর মতন রিভিউ নাহয় লিখলাম না, কিন্তু এই যে এতটা মন খারাপ রয়ে গেল, সেটা নিয়ে কি করি? এ যেন কালভৈরব গল্পের পুনরাবৃত্তি।
অলাতচক্র কে ভৌতিক উপন্যাস বললে তার অমর্যাদা হয়। ভয়, মানবিকতা এবং প্রাচীন গ্রামবাংলার সুপাঠ্য মেলবন্ধন, এই বইটি তারানাথের শেষ উপাখ্যান। মট লেন এর বৈঠকে পাঠকের শেষ পদার্পণ।
তারাদাস বাবুর লেখনী এবং বর্ণনা ক্ষমতা বরাবরই সুন্দর। অনেকে (এই গুডরিডস-এরই কিছু বক্তা) মনে করেন তিনি তার যশস্বী পিতার 'নাম ভাঙ্গিয়েই' পরিচিত। আমি মনে করি এই নিন্দুকেরা তারানাথের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ঠিক বুঝতে পারে না।
বিভূতিভূষণের এই ভবঘুরে তান্ত্রিককে কেবল এগিয়েই নিয়ে যাননি তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দিয়েছেন তাকে সুন্দর আরেক মাত্রা। এই তারানাথ অনেক সোজা পথের পথিক। মর্মস্পর্শী এবং দরদী। গ্রামবাংলার সহজ সরল মানুষের পাশে। অন্ধকারের বিপরীতে। তার কলম গুনে লোভনীয় রাজভোগ এর ক্ষুধা থেকে তারানাথ কন্যা চারি-র প্রতি অদ্ভুত বাৎসল্য, আমরা সবটাই অনুভব করি। আক্ষেপ হয় আরো কিছু গল্পে তাকে পেলাম না বলে।
সব শেষে কেবল বলতে ইচ্ছা করে, জ্যোতিষাণর্ব তুমি ভালো থেকো। পাসিং শো-এর ধোঁয়ায়, তুমি আলোর হয়ে লড়ো।
কিছু বই আজীবন ফেলে রাখতে মন চায়। পড়লেই তো শেষ হয়ে যাবে। তবে গত সপ্তাহে বৃষ্টির মধ্যে মনে হল তারানাথের মট লেনের বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যাক। খুলে বসলাম অলাতচক্র। তারানাথের বাবার গল্প দিয়ে শুরু, এরপর মাঝখানে তারানাথের আগমন। মাঝখানে গল্পকথকের একটা ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা, যেটার সমাধান তারনাথই দেয় অবশ্য। আবার শেষে গিয়ে তারানাথের গল্প। এই হল মোটামোটি অলাতচক্র। বৃষ্টির মধ্যে, হালকা ঠাণ্ডাভাব, বেশ ভালোই জমেছিল। পুরো বইয়ে কোনো অতিমাত্রায় ভৌতিক ঘটনা নেই। বিশেষ করে বইয়ের বেশিরভাগ কাহিনী জয়তলা নামের এক গ্রামে দেবদর্শন জমিদারকে নিয়ে। সেখানে বাড়াবাড়ি কোনো ভৌতিক ঘটনা ঘটেনি। ঘটেছে কিছু অস্বাভাবিক, অলৌকিকতা। যা তারাদাসের বর্ণনায় জীবন পেয়েছে। অবাস্তবতাকে মনে হয়েছে বাস্তব কিছু। সবমিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা। বিভূতিভূষন তারানাথের দুটো গল্প লিখে গিয়েছিলেন মাত্র। সেই লিগ্যাসি টেনে তারানাথকে কিংবদন্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
তারাদাসের লেখার হাত খুব ভাল। টেনে রাখে এমনিতেই আমি সব সময় বলি হরর আমার খুব অপ্রিয়। শুধু শুধু মানুষকে ভূত প্রেতের ভয় দেখিয়ে লাভ আছে? তারচেয়ে আশেপাশে তাকান জীবিত মানুষ ভূত প্রেতের চেয়ে হাজার গুন ভংয়কর। এককালের গ্রাম বাংলা থেকে কালের বিবর্তনে হাজার হাজার জিনিস হারিয়ে গেছে তার ভিতরে তান্ত্রিক বা গুনীনরা অন্যতম। লেখক যে শুধু হরর লিখেছেন তাই না গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া একটা অধ্যায় ও তুলে ধরেছেন।
হররের দিক থেকে আহামরি কিছু না, পড়ে ভয় পাবেন এমন ও কিছু নাই। কিন্তু লেখকের লেখার হাত ভাল। পড়া শুরু করলে ছাড়ার উপায় নাই।
বাইরে উথাল পাথাল ঝড়, থেকে থেকে দমকা হাওয়া ঝাপটা মারছে জানালার শার্সিতে। পুরো পরিবেশটাই আধিভৌতিক বা অশরীরী গল্পের জন্য এক্কেবারে লাগসই। এই ইট কাঠের শহরে তো সেরকম গল্পের কথক তো আর পাওয়া যাবে না, তাই তারানাথ তান্ত্রিকই সই। এই বইটা সেই অর্থে গা ছমছমে সব ডাকিনীবিদ্যা আর তন্ত্রমন্ত্রের বিবরণে ভরপুর নয়। অলৌকিক ঘটনা আছে, তবে সেগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবীয় হাসি, আনন্দ, দুঃখ , বেদনা। এই বইয়ে তাই অতীন্দ্রিয়তার সঙ্গে গলাগলি করে আছে আধ্যাত্মিকতা, তারানাথ তান্ত্রিকের চেয়েও যেন বেশি দার্শনিক। তাই বলে গল্পের বুনোটে খুব একটা চির ধরেনি, রসভঙ্গও হয়নি। পড়ে দেখুন, পস্তাবেন না বোধহয়।
বাবার সুযোগ্য সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর সৃষ্টি রহস্যময় চরিত্র তারানাথ তান্ত্রিকে খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
এই শীতে শেষ করলাম অলাতচক্র। ভাবতেই খারাপ লাগছে নতুন কোন গল্প শুনতে পারবো না তারানাথের মুখ থেকে সেই কলকাতার মটলেনের বাড়িতে বাসে বৃষ্টিস্নাত কোন রাতে। এই গল্প শুনার খিদে সব সময় ই থেকে যাবে।
আবারো তারানাথ চক্রবর্তীর মজলিসি আড্ডায় কথক এবং কিশোরীর সাথা আমিও জড়ো হলাম৷ তবে এইবারের আড্ডাটা ঠিক জমলো না৷ শুরু দিকটা প্রাণবন্ত ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে কেমন ঝিমুনি ধরে গেল৷ তারানাথের দার্শনিক চিন্তাভাবনার দিকটাও দেখতে পেলাম৷ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী নিঃসন্দেহে চমৎকার৷ কিন্তু উপন্যাস না হয়ে, গতবারের মত গল্প হলেই বোধহয় ভালো হত৷ তবে, আফসোস লাগে! মটলেনে ঝড়বৃষ্টির দিনে মুড়ি আর গরম তেলেভাজার সাথে তারানাথ চক্রবর্তী আর গল্প বলতে বসবেন না৷
প্রথম দিকে খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু শেষটায় মনে হল টেনে লম্বা করা হচ্ছে অযথাই। শেষের দিকে তারানাথ এর আবির্ভাব মোটেই ভালো লাগেনি, একেবারে বেখাপ্পা। কিন্তু প্রথম দিকে একরাশ মু��্ধতা নিয়ে পাতার পর পাতা পড়েছি ,শেষ দিকে একটু বেখাপ্পা লাগলেও ফুল মার্কটাই দিলাম।
বরং দ্বিতীয় প্যারা থেকেই শুরু করি। বলতে চাইছিলাম- এক বৃক্ষের ছায়ার নিচে আরেক বৃক্ষ বাড়তে পারে না। তাই কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ বিখ্যাতদের সন্তানদের আমরা বাবা মায়ের মতো খ্যাতনামা কমই হতে দেখি। তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখকখ্যাতির ক্ষেত্রেও এ কথা মিলে যায়, কিন���তু যা মেলে না তা হলো এ কথার পাল্লার অপরপাশে তারাদাসের লেখার ভর। কখনো এমনও মনে হয়, তারাদাস পিতা বিভূতিভূষণকে ছাড়াতে পারেননি তা নয়। বরং ইচ্ছে করেই ছাড়াননি। হয়ত চাইলে পারতেন। অবশ্য এ কথা বলাটা বাহুল্য। স্বয়ং বুদ্ধ বলে গেছেন সকলেই বুদ্ধ হতে পারেন। তাঁর কথা আমি মানি।
তারানাথ চক্রবর্তীকে বিভূতি সৃষ্টি করলেও তিনি বিকশিত হয়েছেন ছেলে তারাদাস বন্দো’র হাতে। লিখতে গিয়ে মনে হলো এ বোধয় সে যুগের ফ্যান ফিকশন। হলেও তারাদাস-তারানাথ লেখক ও চরিত্র যেন অঙ্গে অঙ্গে মিতা। আর মিতা তো মিতার সঙ্গে কাঁধে হাত রেখে কথা বলবেই। অলাতচক্র বইটার পাতায় পাতায় সেই হাসির দ্যুতি আর একটা আপন করা মোহনশব্দ।
ভূতে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, গল্পে সনাতনী পৌরাণিকতা ভালো লাগুক কি নাই লাগুক, ভালো গল্পের আদর যাঁদের কাছে আছে তারানাথ তান্ত্রিককে নিয়ে এ উপন্যাস তাঁদের কাছে অদ্ভুত প্রিয়তা পাবে। পেয়েছেও। এই উপন্যাসে অনেকগুলো গল্প এক সুতায় গাঁথা। একসময় ভয় পেয়েছিলাম সুতা বুঝি ছিঁড়ে গেছে। না, ছেড়েনি। তবে দেখলাম হাতে বোনা ফুলের মালার মতোই সেখানে তুলনামূলক ছোট-বড়, বাসি-তাজার মিশ্রণ আছে। এতো মায়াবী বিবরণ পাতায় পাতায় আর এতো মধুর সংলাপ মুখে মুখে। তবু গল্পগুলো সাজানোয় কোথাও যেন আরেকটু পরিচর্যার অভাব বোধ করেছি। তবে মেনেও নিয়েছি। যখন হিরার প্রতিমা পাই তখন একটু নাক ভাঙা মেনে নিতেই পারি। আর গল্পে মেদও আছে। তবে সেটুকু মেদ শরীরকে একটা কমনীয় আভিজাত্য দিয়েছে বলেই মনে হয়। পছন্দ করেছি আমি।
বইয়ের নাম অলাতচক্র কেন তাই ভাবছিলাম। একেবারে শেষের দিকে দার্শনিকভাবে নামটির সঙ্গে গোটা গল্পকে, প্রকারান্তরে গোটা জীবনকে সংযুক্ত করা হলো।
“মৃত্যুঞ্জয় তার হাতের ছড়িটি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে তাঁবুর দিকে। মাঝে মাছে থেমে গিয়ে কাঠিটা দিয়ে মাটিতে কী মেপে দেখছে। তার অপসৃয়মাণ চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এই বিশাল জগতের তুচ্ছাতিতুচ্ছ তৃণখণ্ড থেকে অনাদ্যন্ত মহাকাশে জ্বলন্ত নক্ষত্রের দল পর্যন্ত একটা অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত বাস্তব আত্মীয়তার সূত্রে গ্রথিত। প্রাত্যহিকতায় মায়া সত্যের এই জ্বলন্ত রূপ আমাদের চোখে পড়ে না। কলকাতা শহরের উপগলির এঁদো মেসের ঘর নয়, সমস্ত বিশ্বের বিচিত্র বিস্ময়পূর্ণ পরিধিই আমারও জীবনের পরিধি। জ্বলন্ত নক্ষত্রবেষ্টিত সত্যের অলাতচক্র।”
এই সংযুক্তি আমাকে তুষ্ট করেছে।
একজন মানুষ কি একই সময়ে দুটি স্থানে থাকতে পারে? কথক তার এক বিজ্ঞান গবেষক বন্ধুর কাছে জানতে চান। বিজ্ঞানী বন্ধু জানান বাইলোকেশন অসম্ভব। অর্থাৎ একজন মানুষ একই সমেয় দুই জায়গায় থাকতে পারেন না। কথাগুলো যখন পড়ছি মনে পড়ছিল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কথা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সুপারপজিশন বলে একই বস্তু একই সময়ে তো দুই স্থানে থাকতে পারে। অবশ্য তা কোয়ান্টাম স্তরে সম্ভব। মানুষ তো কোয়ান্টাম স্তরের প্রাণি নয়। সে আকারে অনেক বড়। তারপরও যদি ব্যাপারটার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মিলে যায় হয়ত তারানাথের গল্পের সেই কথক ভদ্রলোক খুব খুশি হতেন। কিন্তু তাকে জানাবে কে? বিভূতি নেই, তারাদাস নেই।
তারাদাস বন্দোপাধ্যায় অলাতচক্র লেখার সাত বছর পর মারা যান (২০১০)।
ভূত বিষয়ে দুটো কথা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি বাঁধা গথের তেমন একক কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও কিছু ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাস করি। তারই ধারায় ভূতে বিশ্বাস করি। ভৌত আমি। ভূতে বিশ্বাস করব না তা কি হয়? ভূত তো জাগতিক উপাদান। আরব দেশের ‘জিনে’র মতো তা কেবল ‘অদৃশ্যমান’ নয়। দৃশ্য অদৃশ্য সব কিছু পাঁচ ভূতের অধীন। আর শব্দগতভাবে তো ভূতের অস্তিত্ব দার্শনিক রীতিমতো। আপেক্ষিক যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, তাদের সাপেক্ষটা কে? জনাব অতীত। আর অতীত মানেই তো ভূত। অর্থাৎ ভূত যেমন স্থান, ভূত তেমন কাল। এইভাবে, আমাদের ভূততত্ত্ব কিন্তু বিজ্ঞানেরও বিস্ময়। দেখা যাচ্ছে ভূত নিছক বিশ্বাসের বিষয় নয়। বাস্তব। কোনো একক ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন তিনিও ভূতেই তৈরি। অতএব নিয়মের অধীন।
সবশেষে, অলাতচক্র বাংলা সাহিত্য নয় শুধু, বিশ্ব সাহিত্যের বহুমূল্য সম্পদ। বাংলা, আরো বৃহত্তর অর্থে বলতে গেলে ভারতবর্ষীয় ভৌতিকতা যে কী পরিমাণ মৌলিক! পৃথিবী যত সংসর্গে আসছে, জানতে পারছে। অলাতচক্র সেই মৌলিকত্বের হীরকখচিত ছোরা। যেহেতু আমি ভূতের গল্প ভালোবাসি, ও আমার সঙ্গে থাকবে।
"তারানাথ তান্ত্রিক" বইয়ের পরের অংশ হল অলাতচক্র। বইয়ের কাহিনী আগের মতনই তারানাথ তান্ত্রিক বক্তা আর ন্যারেটর আর কিশোরী বাবু হল এখানে শ্রোতা। অলাতচক্রে উঠে এসেছে তারানাথ তান্ত্রিকের জন্মের আগের কিছু কথা। অনেক বেশী হাইলাইট করা হয়েছে অমরনাথকে, কিন্তু সে কে বা কি সেটা বরাবরই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে
তারানাথ তান্ত্রিক বইতে অনেক যায়গায় ন্যারেটর গল্পগুলো সত্য না মিথ্যা এই কথা এড়িয়ে গিয়েছি কিংবা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। কিন্তু এই বইয়ে আমরা ন্যারেটরের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু অলৌকিক ঘটনা এবং তার সাথে তারানাথ তান্ত্রিকের যোগসাজ দিয়ে অনেকটাই বুঝাতে চেয়েছেন তারানাথ যা বলেছেন তা পুরোটাই সত্য।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ এটাকে হরর বই বললে ভূল হবে, হরর না বলে অধভৌতিক অথবা অপার্থিব বললে বেশী মানানসই হবে। গাঁ যে ছমছম করে নাই সেটা বলব না (গভীর রাতে পড়ার সাইড ইফেক্ট)। বই শেষ হবার পর কেন যেন আক্ষেপ থেকে যায় এত জলদি শেষ হয়ে গেল? এত সুন্দর বই আবার হাতে কবে পাবে?
তারানাথ তান্ত্রিকের তৃতীয় বইয়েও তারানাথের গল্প বলার ধার একটুও কমেনি।আগের মতোই প্রাণোচ্ছল সব গল্প।বরং এবার যেন জীবনের আরও একটু কাছের।বিশ পৃষ্ঠা কম হলে হয়তো বইটা আরও টানটান হতো।কিন্তু ক্ষতি কি?একটু রিপিটেটিভই নাহয় হলো!
বিভূতিভূষণের অমর সৃষ্টি তারানাথকে কি সুন্দর করেই না এগিয়ে নিয়ে গেছেন তারাদাস বন্দোপাধ্যায়!একজনের সৃষ্ট চরিত্রকে আরেকজন এতো ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ।
সবচেয়ে আফসোসের ব্যাপার কি জানেন?তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প আর কেউ লিখবে না কখনো।"একটা পাসিং শো ধরিয়ে দেশলাইয়ের কাঠিটা ছাইদানি হিসেবে রাখা নারিকেলের মালায় গুজে দিতে দিতে তারানাথ বলল... " - এভাবে আর তারানাথও গল্প বলবে না। ভালো থেকো প্রিয় তারানাথ জ্যোতির্বিনোদ!
ভূতের গল্প পড়লে এমন গল্পই পড়া উচিৎ। রোমহর্ষক, শিহরণ জাগানিয়া! আর তারানাথের গল্প তো সবসময়ই গ্রাম-বাংলার কাছাকাছি। আর এমন গল্প জমে ভাল। দিনের বে��া পড়েও গা ছমছম করে। চরিত্রায়নও অসাধারণ। একেবারেই অভিনব কিছু চরিত্র আছে যা দুনিয়ার কোন হরর গল্পে পাই নি।
কিছু কিছু বই শেষ করার পরে আক্ষেপ হয়। এইটা হচ্ছে সেই ধরনের বই। কেনো যে শেষ হলো! এরকম বই সারাজীবন পড়লেও বোধহয় বিরক্তি আসবে না। যাইহোক, শেষ করলাম তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের "অলাতচক্র"। যাকে "তারানাথ তান্ত্রিক" সিরিজের তৃতীয় বইও বলা চলে। সত্যি বলতে এই বই নিয়ে বেশি লিখা উচিতই নয়। কি লিখবো? বলেন। এইটা বই কম, জার্নি বেশি। একটা সুন্দর জার্নি। যেখানে মিশে আছে মানবীয় অনুভূতি, স্মৃতিমেদুরতা, ভয়, মানবিকতা, বন্ধুত্ব, গ্রামবাংলার সৌখিন সুন্দর পরিবেশ। না, তবুও বোধহয় শেষ হলো না। আমাকে বলুন কি নেই এতে?! এর উত্তর দেয়াটাই বোধ করি বেশি সোজা হবে।
তারানাথের ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছু নাই। এর আগের দুইটা বই যারা পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই চিনবেন। এই বইয়ে একটা নতুন রহস্যময় চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। যার কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন "অমরজীবন"। এই ব্যক্তির উপস্থিতিতে বইটার কাহিনী যেনো আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আর, তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখনী নিয়ে আর কি বলবো? খুব বেশিই চমৎকার।
সবমিলিয়ে, অসাধারণ সুন্দর একটা বই পড়লাম। দারুণ লাগলো। এতোটুকুই বলবো " অলাতচক্র" অবশ্যপাঠ্য।
গল্প বলার গুণই সাধারণ কাহিনীকে অসাধারণ করে তোলে। তারানাথ এর গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের বাইরে থেকে এ গল্প শুধুই উপভোগ করতে হয়।
অদ্যপী অলৌকিক গল্পে তীব্র অনীহা সত্ত্বেও আধুনিক কতিপয় কাহিনীকারের অকাল্ট বিষয়ক ফিকশন পড়া হইয়া গিয়াছে। তাহার কিছু উৎরাইয়া গিয়াছে, কিছু মুখবাদ্যান করিয়া ভয় ধরাইবার চমকপ্রদ প্রয়াস সত্ত্বেও ধরাশায়ী হইয়াছে। তথাপি বাংলা সাহিত্যের অকাল্ট ঘরানার সামান্য যা কিছু রহিয়াছে, তাহার প্রবাদপ্রতিম পিতৃদেবের কাহিনী ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকিলেও পড়া আদপেই হইয়া ওঠে নাই। সম্প্রতি সেই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর কলমে তারানাথ তান্ত্রিকের তৃতীয় পুস্তকে হঠাৎই মনোনিবেশ করিবার সাধ জাগিল। তারানাথের আবির্ভাব বিভূতিভূষণের হস্তে। তাঁহার সুযোগ্য পুত্র সেই কাহিনীর কলেবর ক্রমশঃ পুষ্ট করিয়াছেন পরবর্তী কালে। সুখের বিষয় হইল যে এই প্রথম, প্রথম কাহিনী না আত্মস্থ করিয়াই, সরাসরি সর্বশেষ গ্রন্থে ঝাঁপাইয়া পরিলাম এবং যারপরনাই পুলকিত হইলাম। পূর্বেকার কাহিনী পড়া থাকিলে হয়ত অজ্ঞাতসারেই ভূতকাহিনীকারের ছায়া খুঁজিয়া বেড়াইতাম অন্য লেখকের জবানীতে। ইহাতে পক্ষপাতদুষ্ট হইবার ক্লেশ থাকিয়াই যাইত।
শৈশবে একদা এক ভয়ানক শের শুনিয়াছিলাম। তাহা এইরূপ, “ডিব্বে কে আন্দার ডিব্বা, উস্কে আন্দার আউর এক ডিব্বা…
ডিব্বে কে আন্দার ডিব্বা, উস্কে আন্দার আউর এক ডিব্বা…
(আগে)
আউর উস্কে আন্দার আউর এক ডিব্বা”। অলাতচক্র পড়িতে গিয়া উহাই বারংবার মস্তকে আঘাত হানিতেছিল। একটি কাহিনীর অন্দরে একটি অন্য কাহিনী, তাহার খেই ধরিয়া আগাইতে গিয়া পাই আর এক কাহিনী ও ক্রমশঃ নানাবিধ কাহিনী মিলিয়া মিশিয়া প্রথম কাহিনীর পুচ্ছ আঁকড়াইয়া পুনরায় পূর্বস্থানে ফিরিয়া আসিতেছিলাম। কাহিনীমধ্য মানবিক গুণাবলী, লেখনীর তীক্ষ্ণতা, গ্রামবাংলার সিক্ত মৃত্তিকার ঘ্রাণ এবং হরেক প্রকার খাদ্যসামগ্রীর সুবিস্তৃত তালিকার কথার উল্লেখ নাই বা আনিলাম। ও সর্বোপরি সমস্ত উপকরণের মিশ্রিত শুক্তুনি রাঁধিবার সময় সঠিক ও পরিমিত পরিমানে সরিষা ও রাঁধুনির ব্যবহার হিসেবে অতিলৌকিক কার্যকলাপ! ইহাকে অনবদ্য ব্যতীত অন্যকিছু বলিবার অবকাশ নাই।
বইটার অর্ধেকের বেশি পড়ে ফেলবার পর জানতে পেরেছি, লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর সন্তান। বিভূতিভূষণের সাথে তাই বইটা পড়ার সময় কোনো তুলনা মনে আসেনি।
বিখ্যাত লেখকের ছেলে, তিনি লিখতে এসেছেন তার পিতার লেখালেখির যেই স্থান-কাল-ভাবনা, সেই একই প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বিভূতিভূষণ তারাদাসকে গ্রাস করে ফেলেননি। তারাদাসের লেখার স্বাতন্ত্র্য আছে, আমি যেহেতু জানতাম না বিভূতিভূষণের সাথে তার সম্পর্ক, বইটা পড়ার বেশিরভাগ সময় বিভূতিভূষণের নামটা আমার মাথায় আসেনি।
পরে তুলনা করে দেখলাম, বিভূতিভূষণের লেখার চেয়ে তারাদাসের লেখা সরল। বিভূতিভূষণের লেখায় বাংলাদেশের মানুষের বেদনার জায়গায় জোর বেশি দেয়া হয়েছে, এখানে একটা আলাদা স্বাদ।
রহস্যের গল্প, আধিভৌতিক আধ্যাত্মিক গল্প, তার চেয়ে আমার কাছে বাংলার গ্রামীণ সমাজের হারানো ঐতিহ্যের গল্প বেশি মনে হয়েছে এটি। যা কিছু অতীত, তাই তো ভূত, সেই ভয় না পাওয়ানো ভূতের গল্প এই বইয়ের বিষয়।
মায়া-মমতামাখানো দিন, সুখ-দুঃখ সকলের সাথে ভাগাভাগি, লৌকিক উৎসব, মনভরানো আড্ডা, সরলতা, প্রকৃতি, ভিটেমাটির টান, এসবকেই তো বাংলা বলে মানি। সেই বাংলা যে হারিয়ে গিয়ে ভূত হতে চলেছে, এই বই পড়ে এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশি হাহাকার জাগিয়ে তুলে।
এখানেও তারানাথ তান্ত্রিক গল্প বলছে, কিশোরী ও তার বন্ধু গল্প শুনছে। তবে ভৌতিক গল্প সেরকম নয়, তারানাথের কিশোর জীবনের অদ্ভুত সব গল্প। এখানেই জানা যায়, চারির বিয়ে হয়ে গেছে। তারানাথের গল্প বলার কায়দা অসাধারণ। আমার মোটামুটি ভালোই লাগছিল, খারাপ না।
বইটির অর্ধেক সেই ফেব্রুয়ারি মাসে রেখে দিয়েছিলাম। মনে ইচ্ছে ছিল, প্রবল বর্ষণমুখর কোন সন্ধ্যায় পড়ব তারানাথ তান্ত্রিককে নিয়ে লেখা একমাত্র উপন্যাস 'অলাতচক্র'। কিন্তু, সেই বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তিতিবিরক্ত হয়ে তীব্র দাবদাহের মাঝেই শুরু করলাম বইটা পড়া। আশ্চর্যের ব্যাপার, কাল ভোররাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত-ভূমিকম্প কোনটাই বাকি থাকল না! অতিপ্রাকৃত উপন্যা��� কিংবা থ্রিলারকে মিষ্টি বলা যায় কি? 'অলাতচক্র'কে বোধহয় যায়! এত মোহনীয় উপন্যাস আমি খুব কম পড়েছি, স্বীকার না করে পারছি না। বইটা হাত থেকে রাখার কোন ইচ্ছেই হচ্ছিল না। এত টানটান কাহিনী। তারানাথ তান্ত্রিকের মুখে গল্পের শুরু। অমরজীবন নামে এক আশ্চর্য চরিত্র ছড়িয়ে আছে পুরো উপন্যাসটিতে। এমন এক চরিত্র সে, যার বয়স বাড়ে না, সে কেবল শুভ ছড়ায়, মৃদু হাসি আর দারুণ ব্যবহার তার। কিন্তু, ভবিষ্যত বলে দেয়ার কিংবা বাৎলে দেয়ার উপায় জানা তার, স্বপ্নে দেখার মাধ্যমে। আবার সে যেকোন জায়গায় যেকোন সময় হাজিরও থাকতে পারে। এই অমরজীবনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে গোটা উপন্যাসটা। কে এই অমরজীবন? পৃথিবীর নানান অনুদঘাটিত রহস্যের মধ্যে এক সেও। এই উপন্যাসের সাথে গল্পগুলোর এক বিরাট ব্যবধান হচ্ছে গল্পের এক চরিত্র মানে লেখক নিজেই প্রত্যক্ষ করে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। চাকরিসূত্রে কলকাতা ছেড়ে মাসখানেকের জন্য সিমডেগা যেতে হয় কথককে। কিন্তু সেখানে গিয়ে পাখির মড়ক, গাছ উধাও, অপদেবতা পাসাংমারার গান, কালোরঙের আলো, পাহাড়শ্রেণীর কাছে এগিয়ে আসা ইত্যাদি নানান অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয় সে। মট লেনের হুঁকো হাতে তারানাথ তান্ত্রিক কী করে ডাকামাত্রই হাজির হয়ে যায় সিমডেগায়? সত্তর বছর ধরেও একই রূপে কীভাবে বিচরণ করে অমরজীবন কিংবা মৃত্যুঞ্জয়? গল্পের মধ্যে গল্প বলে এমন এক ঠাস বুনট হয়েছে উপন্যাসটির যে উত্তেজনায় পাতার পর পাতা উল্টে যেতেই হয়। কিন্তু, এত দিন ধরে এমন উপন্যাস পাঠকমনে কেন থেকে গেল? কাহিনীর অভিনবত্বের পাশাপাশি এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গ্রামবাংলার রূপের আন্তরিক বর্ণনা। বোনাস হিসেবে কিছু লোভনীয় খাবারের বর্ণনাও আছে এতে। বইটি পড়তে পড়তে আরণ্যকের কথা মনে পড়ে যায়, বিশেষ করে সিমডেগা অংশে। বই পড়ে একই সাথে উত্তেজনা এবং শান্তির ছোঁয়া দুইই পেলাম। পরিবেশটা ঠিক অনুভব করতে পারছিলাম, ইচ্ছে হয়েছে হারিয়ে যাওয়া অনুপম শান্ত গাঁয়ে ফিরে যেতে। বৃষ্টিমুখর দিনে ফিরে গিয়ে সেই কুঞ্জপিসির অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপের সাক্ষী হতে। আর আছে এক অপূর্ব দর্শন। কেন শেষ হয়ে গেল তারানাথ তান্ত্রিক এর কাহিনী? কেন যুগের পর যুগ চলল না? আফসোস হচ্ছে। এ কাহিনী চলতে পারত চিরকাল ধরে। কিন্তু, আসলেই কি চিরদিনের নয়? 😊
বইটি পড়তে গিয়ে "আরণ্যকের" ছায়া পাচ্ছিলাম। তখনো জানতাম না লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। এর সাথে আছে তান্ত্রিকের অভিজ্ঞতার গল্প। গল্পের গাঁথুনি ভালো, পাঠককে ধরে রাখার মত। ভাল লেগেছে।