সরণ এবং বেলা। অনলাইনে পরিচয়। দেখাও হয়। দুজনের মাঝে জেগে ওঠে ভালোলাগা। প্রেম? অনেকদিন পর সরণ স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়, ভুলে যাওয়া পাসওয়ার্ড মনে পড়ে না।
কিছু গল্প থাকে যা আপনাকে নস্টালজিক করে তুলবে, গল্প এগিয়ে চলার সাথে সাথে প্যারালেলী আপনিও হয়তো জীবনের কোন বাঁকের অংশ বিশেষ কল্পনা করতে থাকবেন। এই উপন্যাসটা এমনই.. আমি বা আমার মতো যাদের (বাংলাদেশীদের) ইন্টারনেট জগৎটার সূচনায় ছিলো ইয়াহু চ্যাট-এমএসএন ম্যাসেঞ্জার, ইয়াহু রুম চ্যাট, তারপর বাংলা ব্লগ - তাদের নস্টারলজিক করে তোলার জন্য এই উপন্যাসের চেয়ে ভাল কিছু মনে হয় না এখন পর্যন্ত লেখা হয়েছে! সম্ভবত বাংলা ব্লগোস্ফিয়ারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস এটি।
মূলত কথোপকথন নির্ভর উপন্যাস, পড়তে গিয়ে শুরুতে মনে হচ্ছিলো অঞ্জন দত্ত ও নিমা রহমানের 'হ্যালো বন্ধু' অ্যালবামের মতো কিছু একটা লিখিত আকারে পড়ছি। কিন্তু ধীরে ধীরে লেখকের গল্প বর্ণনার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে, বিশেষ করে তখনকার (উপন্যাসের রচনাকাল ২০০৬-০৮ সম্ভবত) ঢাকার চিন্তা-চেতনায় আধুনিক যুবক-যুবতীদের জীবনযাত্রার সমসাময়িক অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে।
গল্পের প্রধান দুই চরিত্র সরণ ও বেলার মেইল আদান-প্রদান বেশ উপভোগ্য লেগেছে। সরণের চতুরতা ও উইটের প্রশংসা করতে হয়, আর বেলার মধ্যে একটা বোকা বোকা ভাব - সব মিলিয়ে দারুণ মানিয়েছে। সবচেয়ে ভাল লেগেছে জোর করে পাঠককে খুশি করার মতো গল্পের সমাপ্তি না টেনে।
গত দুই দশকে যত নতুন লেখকের বই পড়েছি অধিকাংশের লেখায় হুমায়ূন আহমেদের একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, এ উপন্যাসটির লেখক ব্যাতিক্রম এবং গল্পের বর্ণনায় দ্রুত টেনে কাহিনী শেষ করে দেয়ার তাড়া ছিলো বলে মনে হয়নি। গল্পের প্লটগুলো সুন্দর ভাবে সাজানো। এক কথায় 'নস্টালজিক আনন্দ পাঠ' ছিলো উপন্যাসটি, এক বসায় পড়ে তৃপ্তি পাওয়ার মতো।
ব্লগের সূত্র ধরে শিমূল ভাইয়ের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম। তবে এই উপন্যাসটা একবারে পড়া হয়নাই কখনওই আগে। লেখকের প্রাঞ্জল বর্ণনায় পড়তে চমৎকার লাগলো। সেই সাথে এক টুকরো ঢাকার চিত্র বর্ণনা। ইয়াহুর চ্যাটরুম বা মেসেঞ্জার, ডায়াল আপ ইন্টার্নেটে ইমেইলের জন্য অপেক্ষা, কলাবাগানের আল বাইক, বুমার্স, আমার বড় হয়ে ওঠার সময়ের ঢাকাকে মনে করিয়ে দেয়।
একটা লেখকের সার্থকতা সেখানেই যখন বই পড়তে গিয়ে মনে হবে- এ যেন সত্যিকারের কারো গল্প। তারপর যখন পাঠকের যাপিত জীবনের সাথে সেই গল্পের নানা জায়গায় মিলে যাবে তখন তো পূর্ণতার আর শেষ নেই। বইটা পড়তে গিয়ে সত্যিই নস্টালজিক হয়ে বেশ কিছু কারণে। সেই সময় আমিও ইয়াহু মেসেঞ্জার ব্যবহার করতাম। জীবনের প্রথম ইমেইল আইডিই ছিল এই ইয়াহু আইডি। তারপর সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইমেইল চেক করা অথবা চ্যাট করা। মডেমে মাস গেলে আবারো রিনিউ করা। আবার ইন্টারনেটে কানেক্টেড থাকা। সেই সময়কার অনলাইন প্রেক্ষাপট আসলেই অন্যরকম ছিল। এরপর একটা কথা না বললেই না, আমাকে ভীষণভাবে নস্টালজিক করেছে একটা জিনিস যেটা কিনা আমি প্রায় ভুলেই বসেছিলাম এই আজকের ইউটিউবের যুগে, তা হল সেই ২০০৫/৬ এ উইনাম্পে গান শোনা। বলা বাহুল্য, আমি নিজে কম্পিউটার ব্যবহার করি সেই ২০০৪ থেকে তো হার্ডডিস্কে কিছু গান কম্পিউটার কেনার সময়ই দিয়ে দিয়েছিল। গানগুলি ছিল এই সামিনা চৌধুরী, তপন, অঞ্জন দত্ত প্রমুখ। কাজেই বেলা সরণের কনভারসেশনের গানগুলিও আমরা ঐ সময় শুনতাম।
যে জিনিসটা বেশি ভাল লেগেছে তা হচ্ছে- শেষটা কী হবে এটা আসলে বোঝা যাচ্ছিল না। বোঝা গেলে হয়তো লেইম হয়ে যেত। লেখক সেটা খেয়াল করেছে বলেই ভাল লেগেছে।
আর আমি যেহেতু সর্বগ্রাসী, মানে যা পাই তাই পড়ি। এজন্যে নতুনদের বইও পড়ি। মাঝে মাঝে এরকম সহজ সরল কথামালার বই পড়তেও বেশ লাগে।