Son of late legendary writer Bibhutibhusan Bandyopadhyay of 'Pather Panchali' fame, Taradas Bandyopadhyay had his schooling at the Ramakrishna Mission School, Rahara. Graduating from Maulana Azad College with Honours in English, he went on to do his post - graduation from the Calcutta University.He joined service with the West Bengal government and rose to the position of director in the Information and Cultural Affairs department, from where he took voluntary retirement. Despite his failing health, Bandyopadhyay found time to associate with cultural and social organisations and remained the honorary vice-president of the Indian Forum of Art and Culture. Taradas leaves behind a large number of short stories and two famous novels - তারানাথ তান্ত্রিক and কাজল. 'কাজল' was a sequel to 'Aparajito' written by his father. Taradas is survived by his wife and two sons.
আমার সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের নাম 'পথের পাঁচালি'। আর লেখক হিসেবে সবচাইতে প্রিয় বিভূতিভূষণ! আগেও শুনেছেন কথাটা, তাইতো? শুনবেন-ই তো, সুযোগ পেলেই জানাই। দরকারে বলার সুযোগ তৈরি করে নিই।
পথের কবি বিভূতির জীবিতাবস্থায় পালিত শেষ জন্মদিনে সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে একটি বাঁধানো কাল খাতা উপহার দেন। মলাটে সোনালি ঝকঝকে অক্ষরে লেখা ছিল-- 'কাজল'। এই শিরোনামেই অপরাজিতের পরের পর্ব লেখা হবে, এবং সেটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পত্রিকায়, এমনি কথা ছিল। কিন্তু উপন্যাসটি শুরু হওয়ার আগেই তিনি লোকান্তরিত হন।
পরবর্তীতে মায়ের একান্ত উৎসাহে একমাত্র পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত প্রথম উপন্যাস কাজল।
পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, বিভূতিকেই পড়ছি। এত চেনা লেখার ধাঁচ. ভাষার মায়া!
অপরাজিতের শেষাংশে রানুর হাতে বালক কাজলকে সঁপে দিয়ে অপু বেরিয়েছিল দেশভ্রমণে। ফিজির মিশনারি ইস্কুলের মাস্টারি, সমুদ্রের প্রবল ঢেউ, তারায় ভরা আকাশ-- সব, স-ব ছেড়ে কিছুদিন পরেই তাকে আসতে হয় ফিরে। শুধু একটা শব্দ, একটা ডাক না শুনে থাকতে না পারায়। বাবা। কাঙালের মতো তাঁকে ফিরে আসতেই হয় নিশ্চিন্দিপুরে!
কাজল অপুর সেই ফিরে আসারই গল্পকথন। আত্মজের কাছে, আত্মার কাছে, অতীতের কাছে। এতদিনে তার নামযশ হয়েছে কিছুটা, প্রায়ই পাঠকেরা প্রশংসা করে দেয় চিঠিপত্র। আর প্রকাশকরা খাতির করে দেন অগ্রিম সম্মানী। অথচ এই যে হোস্টেলপাড়া, পুরোনো মেস, কলেজ স্ট্রিট.. ক'বছর আগে এখানেই অপুকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল অসহায় হয়ে। পকেটে টাকা ছিল না খাওয়ার মতো, কলেজের ফি দেওয়ার মতো, বাড়িতে একা, অসুস্থ মাকে পাঠানোর মতো। সময়ে সব বদলায়!
একসময় ভবঘুরে জীবনের মোহ ঘুচিয়ে সংসারী, গৃহী পথে ফিরে আসার সুর বাজে অপুর জীবনে। অপর্ণার শূন্যতা ভুলতে, সমমনা হৈমন্তীকে নিয়ে..
প্রবেশিকায় দূর্দান্ত ফল করে জেদ ধরে রিপন কলেজে পড়ার সময় অন্য কেউ ছোঁয় না, চায় না-- কলেজ লাইব্রেরিতে এমন সব বইতে বুুঁদ হয়ে থাকার সময়, অর্থহীন শূন্যতার কারণ, বেঁচে থাকার বিশ্বাস কিংবা জীবনের অর্থ খোঁজার সময় কাজলও একসময় ভাবে ইটকাঠের কলকাতা শহর ছেড়ে ফিরে যাবে গ্রামে। মাকে নিয়ে, সেই নিশ্চিন্দিপুরে।
দিনমাসবছর আর শতাব্দী পেরিয়ে অপরাজিত জীবনের পাঁচালি এভাবেই হয়তো বয়ে চলে। রেললাইন বহে সমান্তরাল..
"ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন বিকীর্ণ জীবন অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন; চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা, যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা এই জেনে।" —জীবনানন্দ দাশ, আট বছর আগের একদিন
মাঝে মাঝেই মন খারাপ থাকে। মন কখনও খারাপ হয় দিনটা ভালো কাটল না বলে, কখনও খারাপ হয় ভালো দিনটা কালের গর্ভে হারিয়ে গেল বলে। মনে হয়, বেঁচে থাকার কি আদৌ কোনো মানে আছে? এই পৃথিবীতে আমি না এলেই বা কী হত? মহাবিশ্বের তুলনায় কত ছোট আমার গণ্ডি, মহাকালের তুলনায় কত ছোট আমার সময়! সবকিছু ছোট ভাল লাগে না, বড় কিছু দেখতে ইচ্ছে হয়। আশেপাশে বিশাল বলতে আছে এক আকাশ, যদিও দালানকোঠা পেরিয়ে শুধুই আকাশ দেখা হয় না বহুদিন। তাও আকাশ দেখি, বিশেষ করে রাতে। রাতের কালো আকাশে সাদা তারাগুলো যেন বহুদূর থেকে বলে, আলো আছে!
কাল মনটা খারাপ ছিল। সম্ভবত আকাশেরও মনটা খারাপ ছিল। তাই আকাশ সমানে ঝরাচ্ছিল তার অশ্রু। বৃষ্টি সম্ভবত সবাইকেই নস্টালজিক করে। মনে পড়ছিল মফস্বলের জীবন, বৃষ্টির কথা। কাগজের নৌকা বানিয়ে কত ভাসিয়েছি বৃষ্টির পানিতে, কখনো অত সময় নেই বলে এমনিতেই ভাসিয়ে দিয়েছি কাগজ। প্রবল বৃষ্টির মাঝে তা ভেসে যেত, ছোট আঁখিজোড়া উজ্জ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখত কতদূর গেল নৌকা। সামনেই কোথাও আটকে গেলে এক দৌড়ে বৃষ্টির মাঝেই গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আসতাম। কাল হঠাৎ মনে হলো, জীবন তার জায়গা থেকে বহুদূরে যেন চলার ফাঁদে আটকে গেছে। তাকে যদি এক দৌড়ে ছাড়িয়ে দেয়া যেত! সে আবার ফিরে যেত তার নিজের জায়গায়। জীবনের মানে কি অবিরাম ছুটে চলা, প্রতিষ্ঠার লোভে, নতুন কিছু পাওয়ার লোভে নিজের সবকিছু ফেলে ছুটে চলা?
ব্যাপারটাকে কাকতালীয়ই বলা চলে। এসব চিন্তার মাঝেই শুরু করলাম কাজল, অপু ট্রিলজির শেষ উপন্যাস। বিভূতিভূষণ যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখানেই শেষ করলেন তারাদাস। অপুর ফিজির জীবন আর কাজলের নিশ্চিন্দিপুরের জীবন দিয়ে শুরু। কিন্তু, উন্মত্তের মত উল্কাবেগে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিয়া মরিলেই সার্থকতা লাভ হয় না। জীবনের আনন্দ রয়েছে অনুভূতির গাঢ়ত্বের ভিতর, জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করিবার ভেতর। তাই অপু ফিরে আসে কাজলের কাছে, তাকে বড় করে তুলতে চায়, অনেক বড়।
মূলত অনুভূতির দিক দিয়ে আর খানিকটা বয়সের দিক দিয়েও কাজলের বড় হয়ে উঠার গল্পই এই উপন্যাস। শুরুটা দারুণ লেগেছিল। প্রথম অর্ধেক প্রায় ঘোরের মাঝেই ছিলাম বলা চলে। যেসব নিয়ে ভাবছিলাম, সেগুলো নিয়েই এগুচ্ছিল উপন্যাস। আনন্দ, বিষাদ সবই ছিল। কিন্তু পরের অর্ধেক ঠিক জমল না।
যখন পথের পাঁচালী শেষ করেছিলাম তখন সম্ভবত রাত এগারটা। তখনই অপরাজিত পড়ার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছে পেয়েছিল আমায়। অপু, অপুর মা, লীলা কাউকে ছাড়তে পারছিলাম না। কিন্তু আমায় ঐ সময়ে অপরাজিত কে দেবে? ইন্টারনেটের কল্যানে ইবুক পেয়ে গেলাম। পড়ে ফেললাম। আমার সবচেয়ে ভালোলাগার উপন্যাস তারাশঙ্করের কবি। তারপরেই পথের পাঁচালী আর অপরাজিতের অবস্থান।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, পথের পাঁচালী আর অপরাজিতের অপু আসলে বিভূতিভূষণ নিজেই। কাজল পড়তে পড়তে, বিশেষ করে ভূমিকাটা পড়ার কারণে মনে, কাজলও যেন তারাদাস নিজেই। ভাবছিলাম, কাজলও যদি বিভূতিভূষণ লিখে যেতে পারতেন, তবে গল্পটা কেমন হত? সম্ভবত এই গল্পটাই তিনি লিখতেন, অথবা অন্য কোনো গল্প। কিন্তু যে গল্পই হোক, বিভূতি আরো বেশি শব্দ ব্যবহার করতেন বলে মনে হয়। খুব তাড়াহুড়ো করে শেষ করে দেয়া হলো বইটা।
যারা পথের পাঁচালী আর অপরাজিত পড়েছেন, তারা কাজলও পড়ে ফেলতে পারেন। খুব একটা মন্দ লাগবে না।
আমি এখন পর্যন্ত হাতে গোনা যে দুই একজন লেখকের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি তাদের একজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ওনার লেখা আদর্শ হিন্দু হোটেল এবং আরণ্যক আমার সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস আর অপু ট্রিলজির তো কথাই নেই।আমার কত বৃষ্টি মাখা দুপুর আমি আমার দাদাভাইয়ের খাটের পিছনের চিপায় বসে ইন্দির ঠাকুরণের মৃত্যু শোকে কান্না করে কাটিয়েছি তার কোন হিসাব আমার কাছে নেই। অপুর নিশ্চিন্দপুরে ঘুরে ঘুরে আসার গল্প যখন শেষবেলায় কাজলকে নিয়ে এসে থিতু হল তখন আমি মোটামোটি খুশি হয়ে দুর্গা,অপর্ণা,হরিহর,সর্বজয়া,ইন্দির ঠাকুরণ কে মেরে ফেলায় যে রাগ করে ছিলাম লেখকের উপরে তা ভুলবার তোড়জোড় করছি। এমন সময় খবর পাই অপু ট্রিলজি শেষ হয়নি।এরপরেও কাজল কে নিয়ে অপুর সামণের দিনগুলোর নতুন যাত্রার বই বেড়িয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম এতা বিভূতি তনয় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা।
এক্ষেত্রে যা হয়। প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি তারাবাবুর উপর। এতো প্রিয় উপন্যাস, এতো প্রিয় চরিত্রগুলোর সাথে উনি ন্যায়বিচার করতে পারবেন তো? আমার চেনা চৌহদ্দি, আম আঁটির ভেপু না আবার কলমের জোরে স্যাক্সোফোন হয়ে যায় সে ভয়ে বইটির খোঁজ পর্যন্ত করিনি বহুদিন। এরপর এক্সময় হাতে আসে তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প যার প্রথম দুটি গল্প বিভূতিভূষণ লিখে গেলেও বই শেষ করে যেতে পারেন নি। পরবর্তীতে তারাদাস তা লিখে শেষ করেন। এবং সেটা পড়ে কি মুগ্ধ হয়েছিলাম তা আগেই বলেছি। সেই ভরসাতেই এবার হাতে নিয়েছিলাম কাজল।
বইয়ের প্রথম দুই প্যারা পড়তে না পরতেই মনে হল আমার বুক থেকে যেন বিশাল একটা পাথর আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। চেনা অলিগলি অনেকদিন পরে দেখলে যেমন প্রথমে ঝাপ্সা থেকে ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করে, মগজের ভোঁতা যন্ত্রনা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে আশৈশব লালন করা বুনো গন্ধগুলো ধাক্কা মারতে থাকে ঠিক সেইরকম একটা অনুভূতি। ১২৬ প্রিশ্তহার বইটা পড়তে গিয়ে একবারের জন্যও মনে হয়নি এখানে বিভূতি বাবু না অন্য কারো শব্দের সাজে কাহিনী সেজেছে। আমি আজিবন কৃতজ্ঞ থাকবো ভাষার খানিকটা আধুনিকায়ন বাদে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বইটি লিখবার সময় কোথাও নিজের স্বকীয়তার প্রভাব রাখার চেষ্টা করেন নি দেখে। শেষ ৫০ পৃষ্ঠা পড়ে বুক জুড়ে শুধু হাহাকার আর হাহাকার। মনের ভেতর যে খালি খালি একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে সেটার জন্যও কেমন একটা মায়া পড়ে যায়। মনে হয় আবার হাতে নেই বইটা।চেনা নিশ্চিন্দপুরের ভিটেতে নিয়ে গিয়ে নিশ্চিন্ত করবার জন্য এবং প্রিয় উপন্যাসটির অপমৃত্যু না ঘটাবার জন্য তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে অশেষ কৃতজ্ঞতা।
এলিনয় এন্ড পার্ক পড়তেছিলাম ৬০পেজে যাবার পর মনে হইল টানা এত গুলা আবেগঘন রোমান্টিক পড়া মানসিক স্বাস্থ্য এর জন্য ভাল না। অতপর বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়া এর সাথে মিলিয়ে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কাজল।
এখন মনটা খালি খালি হয়ে গেছে, :( হাহাকার টাইপ ফিলিং। তারাদাসের লেখা নিয়ে একটাই কথা বলা যায় বাপ কা ব্যাটা!!
কাজল বইটির ভূমিকা লিখেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী এবং তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাতা রমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
চার-পাঁচ পৃষ্ঠার এই ভূমিকাতে তিনি পাঠককে জানিয়েছেন লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে লেখালিখি ছিল আরাধনা। তিনি কাজল লেখার ব্যাপারে খুব উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়াও তিনি ইছামতীর দ্বিতীয় ভাগ লিখতে চেয়েছিলেন, লিখতে চেয়েছিলেন অথৈ জলেরও দ্বিতীয় খন্ড। কিন্তু হলো না। কিন্তু কাজল শুরু করার ঠিক আগ মূহুর্তে এই অমিত শক্তির অধিকারী লেখক বিদায় নেন। তার পর উনার সুযোগ্য পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাবার অপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করেন।
বইয়ের নামঃ কাজল (পথের পাঁচালী #৩) লেখকঃ তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১১৪ প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ
কাজল খুব ছোট একটা বই। পড়তে গেলেই ফুরিয়ে গেল। তাই সেখানে প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত লেখার সুযোগও তেমন নেই।
অপরাজিত বইটিতে অপু কাজলে নিশ্চিন্দপুর গ্রামে রাণুদির কাছে রেখে চলে যায় ফিজিতে। সেই নিশ্চিন্দপুর গ্রামে যেন আবার নতুন করে নতুন রূপে ফিরে আসে শৈশবের অপু। কিন্তু তারপর? বিভূতিভূষণ বেঁচে থাকলে হয়তো লেখাটা অন্যরকম হতো কিন্তু উনার পুত্রের হাতে লেখাটি পেয়েছে আলাদা স্বতন্ত্রটা।
পড়তে গিয়ে কোথায় যেন মনে হয়েছে অপুর মাঝে যেন স্বয়ং পিতাকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন লেখক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশেষ করে অপুর মৃত্যুর মাঝে পিতার মৃত্যুকে যেন অংকন করেছেন লেখক।
রাণুপিসির কাছে বেশ কাটছিলো কাজলের। একদিন অপু ফিরে আসে কাজলের কাছে। রক্তের টান অস্বীকার করা যায় না। পালিয়ে বাঁচা যায় না। ফিরতে হয়। তারপর নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে অপু কাজলের জন্য। উত্তারিকার সূত্রে মানুষ কি পায়? অর্থ, সম্পদ খুব বেশি হলে কিছু মূল্যবোধ। কিন্তু বাবার কাছ থেকে কাজল পেয়েছে আলাদা একটা স্বত্ত্বা, যার অনুভূতির ক্ষমতা পার্থিবের মাঝেও অপার্থিব, এই পৃথিবী থেকে বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের শেষ গ্রহটি পর্যন্ত বিস্তৃত, সীমাহীন।
সুখ-দুঃখ, চাওয়া পাওয়া, না পাওয়ার হিসাব করতে করতেই মানুষের জীবন কেটে যায়। হিসাবের অংক মেলে না। শেষ খাতায় পরে থাকে মৃত্যু নামের একটি শূণ্য। কাজল আক্ষেপ করে ভেবেছে একটু ভাল ব্যবহার একটু ভালোবাসার জন্য সারাটা জীবন আক্ষেপ করতে করতে কত মানুষ চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে। খুব কম মানুষই আসছে যারা সুখ আর দুঃখকে জীবন নামের দাড়িপাল্লায় ভারসাম্য করে সত্যিটা জানতে পেরেছে। জেনেছে জীবনের পিছনে ছুটে লাভ নেই, মৃত্যুর জন্য আয়োজন করে লাভ নেই। জীবন আর মৃত্যু, আলো আর অন্ধকার আলাদা নয় শুধু একের প্রকাশে অন্যের অনুপস্থিতি মাত্র।
ব্যক্তিমত মতামতঃ
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে বইটি পড়ার সময় পিতা পুত্রের প্রতিভার তুলনা করতে যান সেটা হবে অনেক বড় মাপের ভুল। প্রতিটি মানুষ তার স্বাতন্ত্র শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। অপরাজিতের কিশোর অপু ছিল অনেকটা জীবনের বাস্তবতার কাছে অপরাজিত আবার কাজলের বাবা অপুকে আমরা পেয়েছি অনেকটা সংযত। তবুও দুই লেখকের দুই অপুকেই ভাল লেগেছে কারণ তাঁদের ব্যক্তিত্বের পার্থক্য থাকলেও দর্শনের স্বাতন্ত্রতা ছিল অনেক কম। আর এখানেই লেখক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার সফল মনে হয়েছে। উনি পিতার ছায়ার বাইরে এসে লিখেও পিতার সৃষ্ট চরিত্রকে তিনি পুনরায় জীবনদান দিয়েছেন।
অপুর সৌমশান্ত স্বভাবের সাথে দেব দুর্লভ রূপ আর কোমলতার মিশেলের অপর নাম "কাজল"।
পিতার পূর্ব দুখানা পর্বের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তারাদাসের হালের পানি হালহকিকত আড়ালেই বরং হারানো থাক।
বাবার কল্পনার কাজলের প্রতিমাতে খড় বিচালী বেঁধে মাটি ধরিয়ে রং তুলির স্পর্শে সঞ্জীবিত করার সঙ্গীন দায়িত্বভারে ন্যুজ না হয়ে সেই একই অনুভূতি অনুভব কাগজে কলমে তুলে ধরার এই ধারা যেন নিয়তির ই ভবিতব্য।তারাদাস সে নিয়তিকে নিয়তে বেঁধে ছকে এঁকেছেন অপূর্ব তনয়ের তন্ময়তা।
এই রক্তের ধারা যে অমোঘ আকর্ষণে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রকৃতিপাগল পথের কবি,তার বীজ থেকে মহীরুহ মহা আয়েশে আত্মাবেশে অপুর পরেও কাজলে সংক্রামিত হয়েছে সেই অনন্ত ঐশ্বর্য ভরা পরিবেশের মাঝে আত্মসমর্পণের আনন্দে আত্মহারা হবার সহজাত গুন।
বানভট্টের অসমাপ্ত রচনা অনুলিখনের যে গুরুদায়িত্ব পুত্র ভূষণভট্ট পবিত্রজ্ঞানে পিতৃঋণ রূপে পরিসমাপ্তি দিয়েছিলেন,রমা দেবীর বাবলু তার বাবার কাজলে প্রানপ্রতিষ্ঠায় পূর্ন করেছেন মায়ের মঙ্গলময় আর্শীবাদপুষ্ট পিতার লালিত স্বপ্ন।
সবটাই ঠিক ছিলো, শুধু নির্মমতার আরেককাঠি সরেস হয়ে নির্দয়ভাবে অপুকে সবার অলক্ষ্যে অগাস্ত্যযাত্রার আক্ষেপে মনটাই বিষাদে ভরে গেছে।
"বিরাট ভালোর বর্ণনা কি করে দিই বলো তো? মোটামুটি ভালো লাগলে বেশ বড় করে বলা যায়। খুব বেশী ভালো লাগলে তখন আর প্রগলভ হওয়া যায় না।" সেই ক্লাস টু/থ্রির "পথের পাঁচালী" পড়ার অনুভূতি নতুন করে আবার পেলাম যেন। প্রিয় লেখকের পুত্র এর আগেও হতাশ করেননি, আজও করলেন না। সেইই ছোটবেলার মতো নিজেও কল্পনার জগতে বেশ ঘোরাঘুরি করে আসা হলো। নাহ্, সব সুক্ষ্ম অনুভূতি মরে যায়নি দেখা যাচ্ছে! :D "যে চিন্তা করে তার জীবনে কখনো সুখ আসে না।" বোঝা গেলো জীবনে আমার এতো অশান্তি কেন! :( ভাবতে না শেখাটা একটা আশীর্বাদ।
'বানভট্টের পুত্র ভূষণভট্ট অসমাপ্ত 'কাদম্বরী ' শেষ করেছিলেন।' বিভূতিভূষণের ইচ্ছে ছিল 'পথের পাঁচালী ' 'অপরাজিত 'র পর 'কাজল ' লিখবেন; কিন্তু লিখে যেতে পারেননি। পিতার পরিকল্পিত 'কাজল ' লিখেছেন তার পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
রমা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতীভূষণের দ্বিতীয় স্ত্রী বলছেন, ' উনি ছিলেন চিরদিনের ছাত্র - প্রকৃতির এই মহিমময় অনন্ত ঐশ্বর্যভরা পরিবেশ, এর ভেতর আত্নহারা ছিলেন তিনি। প্রকৃতিপাগল বিভূতিভূষণ। ' পথের পাঁচালী, অপরাজিত 'র অপুকে আমরা মহিমময় প্রকৃতির ক্রোড়ে বেড়ে উঠতে দেখেছি। আম আঁটির ভেঁপু বাজানো অপু বড় হয়েছে একধরনের মুগ্ধতা নিয়ে। প্রকৃতির, পৃথিবীর অজনা বিস্ময় তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। তার পায়ের তলায় সর্ষে। ছোট্ট কাজলকে রানুদির কাছে রেখে সে পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে পড়েছে...
কাজল শুরু হয়েছে এখান থেকেই। রানুপিসির পাশে ঘুমানো কাজলের ঘুম কখনো কখনো বিনা কারণে মাঝরাতে ভেঙে যায়। সে দেখে জানালা দিয়ে সুন্দর জ্যোস্না এসে বিছানায় পড়েছে। বাইরের আতাগাছটা - ভুতবোম্বাই গাছটা - উঠানটা অপূর্ব জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে। কাজল দুচোখ মুগ্ধতা নিয়ে প্রকৃতির সমান্তরালে বেড়ে উঠেছে। তার বিহ্বলতা ছুঁয়ে গেছে ধানক্ষেতে, আকাশে, বৃষ্টিতে....
ফিজি, আফ্রিকা সমুহ দেশ ঘুরে রক্তের টানে অপু ফিরে এসেছে কাজলের কাছে। ঠিক মনের মতোন করে গড়ে তুলতে চেয়েছে ছেলেকে। অপর্ণাকে সে ভুলে যায়নি একদম; তবু প্রেমে পড়ে আবার বিয়ে করেছে হৈমন্তীকে। অপুর অবর্তমানে বিধবা হৈমন্তী ভালো মা হয়েছে কাজলের।
অপু জীবনকে দেখেছে। যেমনি করে চেয়েছিল তেমনি করেই।সে বলেছে : ' আশ্চর্য একটা অসীমত্বের সন্ধান পেয়ে গেছি। মনে হয় যেন সময় অফুরন্ত - তা ফুরিয়ে যাবে না কোনদিন। জীবনও তাই বাঁধনহারা, অসীম। মহাকাল এত বিশাল - তার আঁচলটুকুই এতো বড় যে সেই বিশালতাকে অনুভব করা বহু দুরের কথা, ধারণাটাকে কল্পনায় আনতেই মানুষের যুগ যুগান্ত কেটে যাবে। এই জীবনকে - ত্রিকালকে বুকের পাঁজরে পাঁজরে ব্যথায় বেদনায়, আনন্দ উল্লাসে, স্বপ্ন জাগরণে প্রতিক্ষনে অনুভব করছি। আমার আর ভয় কি...? ' অপু লিখেছে। খ্যাতি পেয়েছে। সে নিজেকে পূর্ণ মনে করেছে। তবুও কোথাও কি যেন অধরাই থেকে গেছে। জীবনের কোথাও 'কী একটা যেন জানবার কথা আছে - কিছুতেই জানা যাচ্ছে না। ' পথ চলতে ভালোবাসতো অপু। জীবনের পথ চলার বড্ড খাটুনি শেষে একসময় সে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
তরুণ কাজল দার্শনিক নান্দনিকতায় জীবনের বিষন্নরুপ আবিষ্কার করে বিষন্ন হয়; অল্প বয়সেই জীবনের একেবারে আসল জায়গায় ঘা দেয় সে। যেমনটা শেক্সপিয়ার বলেছেন: It (life) is a tale/ Told by an idiot, full of sound and fury/ Signifying nothing. জীবনের অর্থহীনতা আবিষ্কারের পরেও সে জীবনকে অনেক ভালোবাসে। সে বাচ্চা ছেলের মতোন ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। হৈমন্তী তাকে কাছে টেনে বলেন, ' ওমা বুড়ো, তুই কাঁদছিস? তুই না বি,এ পড়িস? '
কাজল আয়তনে ছোট উপন্যাস। ১১৪ পৃষ্ঠার। রামদাসের মতোন পরিষ্কার হৃদয়ের ভবঘুরে যেমন কাজলে টানে, পুরো উপন্যাসটাও আপনাকে টানবে আশা করি ...
প্রকৃতি আর গ্রামীণ পরিবেশের কথা কাব্যিকভাবে, হৃদয়ের কাছাকাছি এনে, একদম শহুরে মানুষের মধ্যেও অনুভূতি জাগ্রত করার দক্ষতা ছিল একজনের। তাঁর নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আরণ্যক, পথের পাঁচালী কিংবা অপরাজিত এর কথা বাংলা সাহিত্য যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন মনে রাখতে বাধ্য হবে। পরবর্তীতে সত্যজিৎ এর হাত ধরে পুরো বিশ্বেই জায়গা করে নিয়েছে তা। আমি জানতাম, তারাদাস অপরাজিত এর পর কাজল লিখেছেন। কিন্তু, তারাদাসের লেখা কেমন তা যাচাই করার ইচ্ছে কখনো হয়ে উঠেনি। কিছুদিন আগে তারানাথ তান্ত্রিক পড়ে উপলব্ধি করলাম, তাঁর লেখনশৈলী এবং গভীরতা পাঠকমনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই। তাই শেষমেশ 'কাজল' পড়েই ফেললাম। কাজল এর মূল ভাবনা, ছোট ছোট নোট আকারে রেখে গিয়েছিলেন বিভূতিই। আর নিজস্ব কথামালা এবং অনুভূতি দিয়ে তা সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন তারাদাস৷ কাজটা যথেষ্ট কঠিন, কারণ এর আগের দুটো উপন্যাস কালজয়ী। সেকারণে সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়৷ ভাষায়, বর্ণনায়, চরিত্র স্থাপনে সেই কাজটা সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন তারাদাস। কাজল এর কথা পরে বলি, তার আগে উপন্যাসের ভালো লাগা কয়েকটা চরিত্রের কথা বলি। প্রথমেই বলব রামদাস বোষ্টমের কথা। বৈষ্ণব দর্শনের আলোকে জীবনকে যিনি দেখেছেন একেবারেই সহজ চোখে। যার কাছে বিত্ত মানেই চিত্তের অস্থিরতা, অতএব বিত্ত বর্জনীয়। এমন সহজ অথচ গূঢ় চরিত্রটি হৃদয় স্পর্শ করেছে। এছাড়াও ব্যোমকেশ, কাজলের স্কুলের বন্ধু, ঝড়ের মতো এক চরিত্র। বই পড়ছে, গাছ চিনছে, গান গাইছে কিন্তু পাঠ্যবইয়ে মন নেই। ব্যোমকেশকে নিয়ে কাজলের এক চমৎকার অ্যাডভেঞ্চার এর গল্প, তার পরিবেশ এবং পরবর্তী উপলব্ধি সুন্দর৷ বরং কাজলই যেন নতুন কিছু দিল না। এ যেন পুনর্বার অপুর বেড়ে ওঠা। জগতের প্রতি, জীবনের প্রতি যার দুর্নিবার আকর্ষণ৷ অপুর চাইতে কিছুটা আলাদা তো বটেই, কারণ অপু বেড়ে উঠেছিল প্রায় একক চেষ্টায়। জীবনকে সে সম্পূর্ণ সহজভাবে, ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছিল। তার রক্তে ছিল এক যাযাবরের স্বভাব। কিন্তু, কাজল অপুর ছেলে, অপুর কাছ থেকেই সযতনে অনেক শিক্ষা পেয়ে বেড়ে উঠেছে সে। খানিকটা হতাশাবাদীও হয়ে পড়ে শেষদিকে৷ অপুর নতুন স্ত্রী হৈমন্তী, যে নিজেও টুকটাক লেখে, অপূর্বর যথার্থ সঙ্গিনীই ছিল। চেতনা, মধুরতা এবং উদারতায়৷ তবুও বিয়েকালীন নানা আনুষ্ঠানিকতায় একবারও অপুর অপর্ণাকে মনে না পড়াটা খুব ব্যথিত করেছে। অবশ্য একবার উল্লেখ আছে পরে অপর্ণার। এটা একক উপন্যাস হিসেবে হয়তো আরো বেশি দাগ কেটে যেত, যেহেতু আমরা অপুর বেড়ে ওঠার মাধ্যমে এক কিশোরের যৌবনে উপনীত হওয়ার দুর্ধর্ষ মুহূর্তগুলো সার্থকভাবে দেখে ফেলেছি, তাই আবারো কাজলের বেড়ে ওঠাটা প্রায় একইভাবে, বইয়ের রাজ্যে, নতুন ভাবনা এবং দর্শনের সাথে, খুব নতুন করে দাগ কাটবে না। যদিও পড়তে বসলে একটানে পড়তেই হবে। উপভোগ্য এবং সুখপাঠ্য।
পথের পাঁচালী ও অপরাজিত পড়ার অনেকদিন পরে কাজল- বইটা আছে জেনে উইশ লিস্টেড ছিল, অবশেষে পড়া হলো। বিভূতিভ���ষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এঁর পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এঁর লেখায় পিতার ইনসাইটগুলো পেয়েছি, যেমন- প্রকৃতি প্রেম, মৃত্যু - এসব পূর্ণ মাত্রায় ছিল। লেখায় নতুনত্ব বিশেষ কিছু নেই, পথের পাঁচালী ও অপরাজিতের ট্রিবিউট ও এরই পথ ধরে কিছু নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছেন তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, কাজলের আত্ম অনুসন্ধানের বিষয়টা অসাধারণ হয়েছে। নিজের বিশ্বাস - অবিশ্বাসের দোলাচাল, আর পিতার পথরেখায় নিজেকে সঁপে দেওয়া, বোহেমিয়ান জীবন আর সংসারী জীবনের যে দোলাচাল- বেশ ভালোভাবেই এসেছে। উপন্যাস পড়তে পড়তে কোথাও মনে হচ্ছিল, এই উপন্যাসে অপু ও কাজলের গল্পে তারাদাস ও তাঁর পিতা বিভূতিভূষণকেই যেন পেয়েছি। যদিও পথের পাঁচালী সিরিজটাও বিভূতিভূষণের আত্মজৈবনিক উপন্যাসও বলা হয়ে থাকে। উপন্যাসের ভাষা, ন্যারেটিভ -ভীষণ সুন্দর । মনে হচ্ছিল যেন বিভূতিভূষণকেই পাঠ করছি, তবে, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এঁরও নিজস্ব স্টাইল আছে, অনুভব করেছি। পরবর্তী বই- তৃতীয় পুরুষ পড়ার অপেক্ষায় আছি। এই সিকুয়েলের চতুর্থ ও শেষ বই।
এখনও অনেককেই বলতে বা লিখতে শুনি, ‘কাজল না-লিখলেও ক্ষতি ছিল না।’ আমি বলি, এই মন্তব্যের কোনও দরকার নেই। তারাদাস বিভূতিভূষণের যোগ্য উত্তরসূরী। অপু আমার কৈশর থেকেই প্রিয় এক চরিত্রের নাম। আমার যত ভালোবাসার চরিত্র আছে, অপু অন্যতম। সেই অপুর নির্মাতা বিভূতি ‘অপরাজিত’ অপুর শেষটা দেখাননি। মানে ইতি টানেননি। তাঁর পুত্র প্রায় একই মমতায় ভালোবাসায় শ্রদ্ধায় সেটা করেছেন। বইটির নাম কাজ বা বিষয়বস্তু অপু-পুত্র হলেও তার অনেকটা জুড়ে অপুর প্রভাব। অপুময় মুহুর্ত কেটেছে আমার। মনে হচ্ছিল, এটা অপুর জন্যই লিখা। অধিক ভালোবাসা পেলে যেমন মা মারা যান, আমারও শব্দরা ঠিক আসে না। আসতে চায় না। তৃতীয় পুরুষ পড়ার আগপর্যন্ত আর লিখছি না এ নিয়ে।
"পথের পাঁচালি" ও "অপরাজিত" ঠিক যে কারণে কালজয়ী.... মুক্তির আনন্দ, সে ব্যাপারটা বোধহয় কাজলে নেই। তবুও কাজল আপন জায়গায় ভাস্বর! সম্ভবত লেখকের সান্নিধ্য খুব বেশিদিন পাননি তাই মায়ের কাছে শোনা বাস্তব ঘটনাই কাজলে প্রভাব ফেলেছে। হ্যাপি রিডিং💙
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, অপরাজিত পড়িবার অনেক বৎসর পর সম্প্রতি জানিতে পারিয়াছি যে তাহার পুত্র এরপর আরো দু খানা বই লিখিয়াছেন যার একটির নাম কাজল আরেকটির নাম তৃতীয় পুরুষ । কাজল পড়া শুরু করিবার পর হইতেই অন্যপ্রকার একটা পরিবর্তন যদিও লক্ষ করিতেছিলাম কিন্তু একটি জায়গায় প্রমাণ পাইলাম যে আসলেই লেখক তার পিতার যোগ্য সন্তান বটে..বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে বহু পূর্বেই অপুর কাছ হইতে তার নিকটতম লোকজন কে একে একে নিষ্ঠুরের ন্যায় কারিয়া লইয়াছেন, লেখক পুত্র তাহার চাইতেও আরো এক কাঠি উপরে....এই উপন্যাসে তিনি খোদ অপুকেই মৃত্যুকূপে ঠেলিয়া দিয়াছেন... বড়ই মর্মান্তিক ব্যাপার স্যাপার...ভেরি স্যাড
তবে, আমার মনে হয় "কাজল" যদি বিভূতিভূষণ লিখতেন তবে এই বইয়ের গল্প হয়ত আরো দীর্ঘসূত্রী হত। পাতায় পাতায় জেঁকে বসত প্রকৃতি, আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা ফুটে উঠত স্পষ্ট রেখার মত। বাক্যগুলি হত আরও অনেক গভীর। পড়তে পড়তে উদাস হয়ে কাটত অনেকটা সময়।
যাহোক, জনে ভিন্নতা থাকলে মনে ভিন্নতা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কলমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ধন্য তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পিতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপূর্ণ বাসনা তিনি পূরণ করেছেন। বিভূতিবাবু নিজের জীবদ্দশায় "কাজল" লিখে যেতে পারেন নি, তাঁর পুত্র বয়োঃপ্রাপ্ত হয়ে হাতে কলম তুলে নিয়েছে পিতার না লেখা গল্প লিখতে!
মনের মধ্যে কিছুটা ভয় নিয়েই 'কাজল' পড়তে বসা। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী কিংবা অপরাজিত পড়ে মুগ্ধ হওয়া পাঠক আমি। তাই তাঁর পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাকে ঠিক কতটা আপন করে নিতে পারবো সেই নিয়ে ভয় হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তারাদাসের লেখা এর আগেও পড়েছি, ভালোও লেগেছে। কিন্তু অপুর পাঁচালীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই অনুভূতি কাজ করবে কি না, সে ব্যাপারে একটু সন্দেহ হচ্ছিলো। কিন্তু বইয়ের কয়েক পাতা পড়েই সেই সন্দেহ দূর হয়ে গেল! ঠিক সেই মায়াভরা লেখা, একদম আগের মতো! বইয়ের শুরুতেই রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি ভালো লেগেছে। বিভূতিভূষণের কি ভীষণ ইচ্ছা ছিল কাজলকে নিয়ে লিখবার, কত খসড়া লিখে রেখেছিলেন তিনি, কত ভাবতেন তিনি কাজলকে নিয়ে, এসব কিছুই বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন রমা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তীতে অবশ্য বিভূতিভূষণের সেই ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেলেও মায়ের উৎসাহে পুত্র তারাদাস তাঁর বাবার সেই ইচ্ছা পূরণের কাজ হাতে নেন এবং তারই পূর্ণরূপ এই কাজল। অপুর পাঁচালীর দ্বিতীয় বই ছিল অপরাজিত। অপরাজিত আমার কাছে ছিল এক দীর্ঘশ্বাসের আরেক নাম। অপুর জীবনের হতাশা, দুঃখ, একাকীত্বের গল্প ছিল প্রত্যেক পাতায়। কিন্তু কাজল যেন তারই মাঝে একটি প্রশান্তির নাম। অপুর ভবঘুরে জীবনে কাজল ছিল সেই একমাত্র সম্বল, যার টানে বাড়ি ফেরা যায়! অপুর ইচ্ছা ছিল কাজলকে বড় মনের মানুষ হিসেবে তৈরি করা এবং যথাসম্ভব চেষ্টাও করেছে সে। আর পাশে থেকে তাকে সাহায্য করেছে হৈমন্তী। কাজলের মাঝে ছিল অপুর ছায়া। বাবার সাথে তার ঠিক যতখানি মনের মিল ছিল, তা যেন আর কারো মাঝে পায় নি কাজল। বাবার মতই পড়তে শিখল, লাইব্রেরী দে��ে এক নিমিষেই খুশি হয়ে যেতে শিখল, ভাবতে শিখল, জীবনের অর্থ খুঁজতে শিখল! এ যেন ঠিক আরেকটি অপু! যে কোন কাজই এক হাত থেকে অন্য হাতে পড়লে, বিভিন্ন রকম পার্থক্য চোখে পড়ে। কিন্তু কাজল পড়বার সময় একবারের জন্যও মনে হয় নি যে আমি বিভূতিভূষণের লেখা পড়ছি না! তারাদাস নিজেকে কাজলের জায়গায় রেখে এবং বাবা বিভূতিভূষণকে অপুর জায়গায় কল্পনা করেই পুরোটা লিখেছেন মনে হল। আর আগের দুটো বই থেকেও ছোটোখাটো অনেক তথ্য সুন্দর করে এখানে ব্যবহার করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে পাঠকদের জন্য চমৎকার এক উপহার কাজল।
রকমরি কার্টে বই যোগ করতে গিয়ে দেখেছিলাম এই বই। জানতাম না যে পথের পাঁচালি আর অপরাজিত এর পরেও বই আছে।কতো খুশি হয়েছিলাম এটা দেখে!নাম দেখে ভেবেছিলাম কাজলকে নিয়েই হবে বইটি শুধু।ভেবেও ভালো লেগেছিলো যে দুর্গা আর অপুর মতো করে কাজলকে চিনবো। পড়ার আগে হয়তো একটু ভয়ে ছিলাম-এর আগের দুটি বইয়ের মতো হবে না। পথের পাঁচালি আর অপরাজিত আমার চেনা গলি- বিভূতিভূষণের শব্দগুলো চেনা।ওখান থেকে নিশ্চিন্দিপুরের গন্ধ বেরোই-বর্ষা চোখের সামনে ভাসে।কিন্তু নিরাশ হয়নি পড়ে।সেই চেনা গন্ধ-বাউন্ডুলে অপু সাথী হয়েছে কাজল। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কাজল আর অপুর বাঁধন। কাজল যেনো সবদিক দিয়ে অপুর অন্য সত্ত্বা। কাজল অপুর মতো করে শৈশব চিনেছে-নিশ্চিন্দিপুরের আনাছে কানাছে। ওর চোখ ফুটেছে অপুর মতো করেই।কাজলের মধ্যে যেনো অপু থেকে গেছে। একটা জায়গায় লেখক লিখেছেন-'পড়ুয়াদের বই গোছানো থাকে না'- that's so wrong!Dear author -Have you met my Mom?? অন্য বইয়ের মতো এই বইয়ের মৃত্যু গুলো নাড়া দেয়। হৈমন্তিকে খুব ভালো লেগেছে।অপুর সাথে আর কারো হয়তো এতো মিলতো না।দুজনের মনের মিল আর কাজলের সাথে তার সম্পর্ক সর্বজয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। সুরপতি বাবুর মৃত্যু কাজলকে যেমন নাড়া দিয়েছে-পাঠককেও নাড়া দিবে। পড়ার পরও রেশ কাটেনি।কিন্তু বড্ড ছোট😒
বিভূতিভূষণ আমার সবচেয়ে পছন্দের সাহিত্যিক। "কাজল" পড়া শুরু করার সময় আশা ও শংকা দুই ই কাজ করছিল। মূল বই অপুর ফিজি তে যাওয়া দিয়েই শেষ হওয়ার পর অপু আর কাজলের জীবন টা কল্পনা করে নিয়েছিলাম । আমার সেই কল্পনা এমন দায়সারা লেখা দিয়ে নষ্ট করে ফেলাটা মানতে পারছিনা। একজন সফল লেখক তার লেখায় মধ্যে দিয়ে স্থান কাল ভেদ করে পাঠককে তাঁর কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যান মুহুর্তের মধ্যেই৷ বিভূতিভূষণের লেখনীতে এই ব্যাপারটা ছিল প্রবল। "কাজল" আমাকে এই অনূভুতি দিতে পারেনি। কেন জানি মনে হয়েছে শুধু লেখার জন্যেই লেখা। জানি বাবার লেখার সাথে ছেলের লেখার তুলনা একটা অসম তুলনা। তবে এই তুলনার ব্যাপারটা আসতোই না যদি এটা মৌলিক কোন লেখা হত। বার বার মনে হচ্ছে কঠিন কাজ গুলো তো করাই ছিল, এত সুন্দর চরিত্র গুলো হাতেই ছিলো, তাও কেন এই দশা? প্লট কখনো দ্রুত গতিতে এগিয়েছে, কখনো অত্যন্ত মন্থর গতিতে। কোন সামঞ্জস্য ছিলোনা। না ছিলো কোন উদ্দেশ্য (purpose)। পুরোটা সময় আমার শুধু মনে হয়েছে "কেন? কি দরকার ছিল?" বিভূতিভূষণের ভক্ত হিসেবে অন্য ভক্তদের কাছে পরামর্শ থাকবে এই বই পড়ে অপু আর কাজল কে হারিয়ে না ফেলার।
" দু:খ করো না রামদাস কাকা,আমি তোমাকে একটা নতুন দোতারা বানিয়ে দেবো। "
আমার খুব খুব পছন্দের দুটো বই হচ্ছে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লিখা 'পথের পাঁচালী' আর 'অপরাজিত'। 'কাজল' বইটা লিখেছেন তার ছেলে তারাদাস বন্দোপাধ্যায়। তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের কোনো বই এর আগে আমি পড়িনি। এটাই প্রথম। সত্যি বলতে ভেতরে একটা ভয় কাজ করছিলো যে এর আগের দুইটা পছন্দের বইয়ের মতো এটা হবে কি না। প্রত্যাশা পূর্ণতা পাবে কি না। কিন্তু 'কাজল' বইটা যে কখন আমার মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছে বুঝতেই পারিনি। এতো মায়া,এতো সুন্দরভাবে লিখা হয়েছে এই বই! আহা! মোহিত না হয়ে কোনো উপায় নাই।
এই বইয়ে একটা চরিত্র আছে। চরিত্রের নাম রামদাস। রামদাস কাকা। তাকে যে আমার এতো ভালো লেগেছে, ভাষা দিয়ে এই ভালো লাগা হয়তো প্রকাশ করা সম্ভব না। আমার সবচাইতে পছন্দের চরিত্রগুলোর মধ্যে ইনি থাকবেই থাকবেন।
সবমিলিয়ে খুবই সুন্দর লাগলো আমার কাছে তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের লিখা এই মায়াময় বই।
Quite a fitting finale to the 'Apu Trilogy' with 'Kajol' ('Pather Panchali' and 'Anparajito' being the first two parts) by Taradas Bandhopadhay, Bibhuti's son. The love and description of nature are indistinguishable from those of the father. However, the skepticism that creeps into Apu and takes a firm root in his son, Kajol, is a remarkable deviation from Bibhutibhusan. Kajol delves into thoughts, in a stream of consciousness, that makes him question the meaning of life, the 'absurd' nature of it. The people in the novel are too kind to a budding pantheist which is quite fanciful. Agape becomes the motto of living for a young intellectual.
Post Script: Just found out that there is a fourth part to the Apu saga - Tritiyo Purush. 'Kajol' was written in 1970 while Taradas wrote another segment in 1997. Will read that now: too tempted.
পথের পাঁচালী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অসাধারন উপন্যাস। আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। এখান থেকে প্রায় প্রশ্ন আসে বিসিএস সহ অন্যান্য চাকরির পরীক্ষাতে। তাই এই উপন্যাস থেকে প্রশ্নের ক্যাটাগরি সম্পর্কে জানতে জয়কলির বাংলা সাহিত্য বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
তারাদাস বন্দোপাধ্যায় তার জীবন দর্শন কাজলের মাধ্যমে প্রকাশ করে গিয়েছে, কাজল যেন আমাদের মধ্যে আবদ্ধকৃত কোন এক অজ্ঞাত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। তার এই জীবন দর্শন আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছে, আত্মিকভাবে উন্নতি সাধনের জন্য এই বইটি যথেষ্ট..
পথের পাঁচালী পড়েছি ক্লাস সিক্সে। অপু যখন বাবা মার সাথে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় কেঁদে ফেলেছিলাম। অপরাজিত পড়বার সময় কলেজে পড়তাম, লেখকের উপর খুব রাগই লাগছিলো পড়ার সময়, একটা মানুষের জীবনে এত কষ্ট কেন থাকবে। এতদিন পরে কাজল পড়লাম। কাজল তার আদিস্রষ্টা বিভূতিভূষণের নয়, বরং বিভ���তিভূষণের ছেলে তারাদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা। বাবার অসমাপ্ত লেখা ছেলে লিখেছেন, তাও আবার আরেক বাবার ছেলের গল্প, সমস্ত ব্যাপারটাই আমার বেশ সুন্দর লেগেছে৷ প্রথমে পড়তে গিয়ে লেখনীর পার্থক্য বেশ চোখে পরছিলো, আস্তে আস্তে এই পার্থক্যটা কাটিয়ে লেখার ভেতরে ডুবে যেতে পেরেছি। কাজল অন্যরকম সুন্দর। হয়তো কাজলের গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো, কিন্তু তারপরেও বেশ ভালো লেগেছে। এই সিরিজের সর্বশেষ বই তৃতীয় পুরুষ, আশা করি এই বইটাও প্রত্যাশা পূরণ করতে সমর্থ হবে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পথের পাঁচালিতে আমরা পেয়েছি ছোট্ট অপুকে, অপরাজিত উপন্যাসে অপু বড় হয়েছে এবং আমরা কাজল (অপুর ছেলে)- এর নিশচিন্দিপুর এ প্রত্যাবর্তন এর মধ্য দিয়ে ফিরে পেয়েছি আমাদের ছোট্ট অপুকে। বিভূতিভূষণের 'কাজল' লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তার আগেই তিনি দেহান্তরিত হন। বিভূতিভূষণের সুযোগ্য পুত্র তারাদাস কাজল উপন্যাস লিখে পিতার সেই অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করেন। এ গল্প কাজলের অপু হয়ে ওঠা, কাজলের মাঝে অপুকে ফিরে পাওয়া।