ঝাল লজেন আনন্দময় ভাষায় লেখা, নানান মজা আর মনখারাপের আলো ছায়ায় বোনা এমন এক বই যা আমাদের মনকে দ্রব করে দেয়। ঝাল লজেন এমন এক স্মৃতিকথা যা আসলে একজনের হয়েও অন্য সবার স্মৃতির কথাই বলে। বলে, ঝাল লজেনের মতো জীবনের আনন্দকেও ভাগ করে নিলে তার স্বাদ বেড়ে যায় হাজার হাজার গুণ। ঝাল লজেন অতীতের সরণি দিয়ে হেঁটে যাওয়া নানান টুকরো স্মৃতির মালা! বেদনা ও ভালবাসার এক অনাবিল আলিঙ্গন।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯ জুন ১৯৭৬, কলকাতায়। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। পৈতৃক ব্যবসায় যুক্ত। প্রথম ছোটগল্প ‘উনিশ কুড়ি’-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত। প্রথম ধারাবাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত। শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১৪, এবিপি এবেলা অজেয় সম্মান ২০১৭, বর্ষালিপি সম্মান ২০১৮, এবিপি আনন্দ সেরা বাঙালি (সাহিত্য) ২০১৯, সানডে টাইমস লিটেরারি অ্যাওয়ার্ড ২০২২, সেন্ট জেভিয়ার্স দশভুজা বাঙালি ২০২৩, কবি কৃত্তিবাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩, উৎসব পুরস্কার ২০২৪, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড ২০২৪, আনন্দ পুরস্কার (উপন্যাস: '‘শূন্য পথের মল্লিকা') ২০২৫ ইত্যাদি পুরস্কারে সম্মানিত ।
স্মরণজিৎ নতুনত্ব প্রত্যাশী বা দুঃসাহসী লেখক নন। এটা তার নিয়মিত পাঠকমাত্রই জানেন। স্মৃতিকথাতেও তিনি চমকে দেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়াস নেননি। স্মরণজিতের ভাষা স্বাদু, কাব্যিক ও মায়াময়। জন্মেছেনও এমন একটা সময়ে যখনকার সাধারণ জীবনযাপনও এখন রূপকথার মতো সজীব-সুন্দর বলে ভ্রম হয়। (আমাদের শৈশবের রঙিন গল্প শুনে আজন্ম শহুরে এক বান্ধবী নিষ্প্রাণ গলায় বলেছিলো, "আমার কোনো শৈশব নেই।" স্কুল - ফ্ল্যাট - ফ্ল্যাট - স্কুল এই ছিলো ওর জীবন।)
লেখকের শৈশব কেটেছে এক যৌথ পরিবারে, বাটানগরে। সেখানকার প্রতিদিনের জীবন, ছুটির দিন, লোডশেডিং, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ফুটবল খেলা, পাড়ার "আব্বুলিশ" মানুষজন, ছাদ, টেলিভিশন, রবীন্দ্রজয়ন্তী - বহু বিষয়ে অম্লমধুর স্মৃতিচারণ করেছেন স্মরণজিৎ (সবচেয়ে মজা পেয়েছি মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে লেখকের বাড়ি থেকে দুদিনের জন্য ঠাণ্ডা মেশিন 'ফ্রিজ' ধার নেওয়ার ঘটনা পড়ে।)কলকাতায় আসার পর স্মরণজিতের জীবন কিছুটা বর্ণহীন হলেও তাতেও ছিলো আনন্দের বহু উপকরণ। পড়ার পুরোটা সময় মুখে হাসি লেগে রইলো। অবশ্য কিছু ঘটনার শুরু উল্লেখ করে পরিণতি না জানানোয় আফসোস রয়ে যায়।
(বয়স্ক মানুষদের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলবো না করতে করতে ভাবতে বাধ্য হলাম, "জীবন কতো সুন্দর ছিলো তখন।" পরে মনে পড়লো, আমি নিজেই এখন বয়স্ক মানুষ।)
সরস গল্পগাছা, নিজ জীবনের। বাটানগর আর কলকাতার গল্প। লেখকের ছেলেবেলার গল্প, পুজোর গল্প, নিঝুম দুপুরে বই পড়ার গল্প, সিনেমা যাওয়ার গল্প, সারিবেঁধে ভাত খাওয়ার গল্প আর ফুটবলের গল্প। যারা স্মৃতি জমাতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন একটা রঙিন ঘুড়ি জমিয়ে রাখতে, শেষ হয়ে যাওয়া কলমটাও মায়ায় রেখে দেন, তাদের উৎসর্গ করেছেন লেখক বইটা। একটা হারিয়ে যাওয়া সোনালি সময়ের গল্প, যেটা খুব বেশি আগের না, এই বছর চল্লিশ আগের, বইয়ের পাতায় পড়তে ভালো লেগেছে সেই গল্প।
স্মরণজিতের সঙ্গে প্রথম পরিচয় পাতাঝড়ার মরশুমে দিয়ে। পড়তে যেয়ে প্রচণ্ড রকমের হোঁচট খেয়েছিলাম। ঠিক মনে হচ্ছিল যেন আমাদের ছোটবেলাটাকে নিয়ে লেখা কিংবা বাড়ির পাশের ছেলেটির গল্প। স্মরণজিতের লেখার আলাদা স্টাইল আছে। এই স্টাইলটা ভালো লাগে খুব। এই ভদ্রলোকের আত্মজীবনী এমন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার মতো হবে না তো কারটা হবে? নব্বই দশকের পোলাপান হিসেবে মনে হয় স্মরণজিতের স্মৃতিকথার সাথে অনেক কিছুই মেলাতে পেরেছি, যেটা আবার জেন-জি হলে রিলেট করতে হয়তো বা কষ্ট হতো। লোডশেডিং-এর যুগ পেয়েছি আমরাও। সে এক দারুণ আনন্দের সময়। ধুপধাপ করে বের হয়ে যেতাম বাসা থেকে আর সে কী খেলা! বিকেল বেলা আম্মু প্রায়ই গেটে তালা দিয়ে ঘুমাতো, বেচারির উদ্দেশ্য তো মহৎ একটু যদি ঘুমাই... আর আমরা দুই ভাই-বোন আর পাশের বাসার খেলার সঙ্গীরা বারান্দার গ্রিলে ঝুলে ঝুলে নি:শব্দ দুষ্টামি করতাম। স্মরণজিতের স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে মনে পড়ে বাসায় প্রথম কম্পিউটার আনার দিন! উফফ! এখনক মনে পড়ে গেম খেলব সেটা ভেবে কম্পিউটার ছাড়লেই আশপাশ থেকে পিচ্চিরা চলে আসতো বাসায়। সেটাও ভাগাভাগি করেই খেলতে হতো। ডিসেম্বরে পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে বাসার উঠানে পিকনিক করা, হৈ হৈ করে খেলাধূলা, ঝগড়া-মিলমিশ, প্রথম লাইব্রেরির সদস্য হওয়া, হাসিকান্না সবকিছু মিলিয়ে বোধহয় শৈশবটা আসলেই একটা ঝাল লজেন।
🍭⛳ কি ভাবছেন বইটা কেমন হবে? বইটা কি কেনা যাবে? কী আছে এই বইতে? আসুন দেখে নিই.......
🍭সদ্য পড়ে শেষ করলাম আমার প্রিয় সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর মহাশয়ের লেখা “ঝাল লজেন” বইটি। লেখকের লেখা এর আগে আমি সবই পড়েছি। আর এই নতুন বই প্রকাশিত হওয়ার পর তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই বই আমি কিনে পড়বো এবং সংগ্ৰহে রাখবো। ঠিক যেমন ওনার লেখা বাকি বইগুলো রয়েছে। 🥰🥰
~এবার আসি বইয়ের বিষয়বস্তু তে~
🍬🍭‘ঝাল লজেন লেখকের স্মৃতিচারণ মূলক একটি লেখা'! যেখানে তুলে ধরা হয়েছে আশি ও নব্বই দশকের হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতিকথা। সেই সময়ের মফস্সলের বাড়ি, সেই সব বাড়ি কেমন হত তার একটা নিখুঁত বিবরণ। যেটা পড়তে পড়তে মনে হবে হয়তো এই সময় বসে, সেই সময়ের দিনগুলোতে ফিরে গেছি। খুব ভালো করে ঘুরে ফিরে নীজের চোখে দেখছি বাড়িটাকে।
🍬🍭এরপর আছে এক সুন্দর রবিবার যেটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, সেই সময় রবিবার ছিল আনন্দের দিন এখনকার মতো কর্মব্যাস্ত রবিবার নয়। সকাল থেকে উঠেই শুরু হত পড়াশোনা, তারপর বাকিটা সময় খেলা। আবার দুপুর হলেই সপরিবারে একসাথে খেতে বসা...... গল্পের বই পড়া,আহ্ কি ছিলো সেই সব দিনগুলো।
🍬🍭সেই সময় ভীষণ আনন্দের জিনিস হলো লোডশেডিং। একবার লোডশেডিং হলেই সপরিবারে ছাদে উঠে বসে গল্প করা, রাতের আকাশ দেখা। দেখতে দেখতে বাবা জেঠু দের আছ থেকে গল্প শোনা। এখন সেসব দিন কোথায়?
🍬🍭সেই সময় ছাদ ছিল ভীষন প্রিয় জায়গা। মনে হতো এই জায়গায় কেউ বিরক্ত করার নেই, বকা দেওয়ার নেই নিজের মন মতো কাজ করা যায়। আরও একটা জিনিষ বিশ্বকর্মা পূজা আসার আগে থেকেই ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব শুরু হয়ে যেতো। সারা আকাশ জুড়ে কতো ঘুড়ি দেখতে ভীষণ ভালো লাগতো....... সেই সময় টেলিভিশন ছিল বিলাসিতা যেকোনও একটা বাড়িতে থাকলেই পড়ার সবাই মিলে সেই বাড়িতে গিয়ে ছুটির দিনে দুপুরে ভির জমাতো। ছাদে গিয়ে আ্যন্টেনা ঠিক করলেন টেলিভিশন চলতে শুরু করতো। কতোই না মজা হতো ........ আর আজ সেসব দিন কোথায়? শুধুই স্মৃতি.......
🍬🍭তখনকার দিনের, নেমন্তন্ন বাড়ির কিছু নির্দিষ্ট ব্যাপার ছিল। তখন নেমন্তন্ন বাড়িতে এখনকার মতো এমন নানান রকম গেট বানানো হত না। বরং সব শুভকাজের বাড়ির গেট ছিল দু'রকম রঙের কাপড় দিয়ে আয়তাকার করে বানানো। আর শ্রাদ্ধবাড়ির গেট ছিল আয়তাকার আর সাদা কাপড়ের। বিয়েবাড়ির গেটের পাশে চলত সানাইয়ের ক্যাসেট......... তখন বিয়েবাড়িতে গেলে প্রথমে ওই ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক বা স্টার্টার আসত না। গিফট দিয়ে লোকজন অপেক্ষা করত কখন তার খেতে যাওয়ার ডাক আসবে!
🍬🍭সেই সময় দুর্গাপুজো এলেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হত। গঙ্গার বাঁকে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুটে থাকত কাশফুল। গঙ্গার বাঁধের ওপরদিকে দেখাতাম ঢাকিরা আসছে বড় বড় ঢাক নিয়ে। প্যান্ডেল তৈরি শেষ। বাটা কোয়ার্টারের বড় বড় মাঠে মেলা বসছে। তিনখুঁটি কি পাঁচখুঁটির সার্কাস বসছে। টয়ট্রেনের লাইন পাতা হচ্ছে। পুতুলনাচের তাঁবু টাঙানো হচ্ছে। মরণকূপ তৈরির কাঠের পাটাতন গাঁথা হচ্ছে মাটিতে। আস্তে আস্তে ফাঁকা মাঠ চলে যাচ্ছে নানান দোকান, পশরা আর তাঁবুর দখলে। স্কুলেও কেমন যেন ছুটির হাওয়া! আহ্ কি সব দিন ছিলো........
🍬🍭গরমের ছুটি, সারাবছর এমন ছুটির জন্য অপেক্ষা করার মজাটাই আলাদা। গরমের ছুটির একমাস আগে থেকেই মর্নিং স্কুল শুরু হত। তারপর সেই মর্নিং স্কুলের শেষদিনে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান হয়ে স্কুল ছুটি পড়ে যেত। আসল রবীন্দ্র জয়ন্তী আগে হয়ে গেলেও তার উদযাপনটা হত স্কুলে ছুটি পড়ার দিন। মে মাসের কুড়ি বা একুশ তারিখ নাগাদ ছুটি পড়ত সেই সময়। গরমের ছুটির পরপরই শুরু হত হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। তাই ছুটিতে পড়াশুনোও করতে হত বেশি। বাকি সময়টা খেলাধুলা করে কাটতো....... এই ছুটিতে দিন দশেকের জন্য দাদুর বাড়ি যাওয়া, সেখানে গিয়ে আরোও কতো মজা ইত্যাদি ইত্যাদি! এখন ছুটি হীন জীবন, তাই ছোটোবেলার কথা বেশি মনে পড়ে।
🍬🍭তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে.......পুরনো শহর বাটানগর ছেড়ে লেখক চলে আসেন কলকাতায়। শুরু হয় নতুন জীবন। লোকাল ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়। নতুন ভাড়াবাড়িতে থাকা। আসতে আসতে সবকিছু কেমন যেন ভালো লাগতেও শুরু করে লেখকের। স্কুল-কলেজ জীবন কাটিয়ে লেখালিখি শুরু করেন লেখক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা বেরোতে শুরু হয়। তারপর তো আমাদের সবার প্রিয় লেখক হয়ে ওঠেন.....এই ভাবেই লেখক ওনার স্মৃতির কথা বলতে বলতে শেষ করেন এই ঝাল লজেন.......... লেখকের এই স্মৃতিচারণ মূলক উপস্থাপনা আমার ভীষন ভালো লেগেছে। সব বয়সের পাঠকদের এই বই ভালো লাগবে। এই বই পড়তে পড়ত অনেক বাল্য স্মৃতি ভেসে উঠবে। কম বেশি মিল অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। বইটি হার্ড কভার, ভালো কাগজ, ঝকঝকে ছাপা ও আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ সমৃদ্ধ। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার লেখার দীর্ঘায়ু কামনা করি, ভালো থাকবেন!
📌শাসনের মধ্যেও ভালবাসার মেঘ-রোদ্দুর কেমন করে যেন জড়িয়ে থাকত অজান্তে! এখন শাসন নেই, ভালবাসাও নেই!
📌কাল আবার সোমবার! স্কুল আছে! আবার কয়েকটা দিন চলবে পড়াশুনোর চাপ, স্কুলের দৌড়ঝাঁপ! আর চলবে রবিবারের অপেক্ষা!
📌প্রিয়জনেরা এখন সবাই দূরে দূরে। ছোটবেলার সেই খেলা ভেঙে গিয়েছে কবে। নেমন্তন্ন বাড়ি তাই আর টানে না আমায়। আনন্দ-উৎসব এখন নীরস সামাজিকতা।
📥🗒️2024 Book Review ~ 47 যদি এই বইটি পূর্বেই কেউ পড়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনাদের ব্যক্তিগত মতামত জানাবেন। এছাড়াও আমার রিভিউ কেমন লাগছে সেটাও জানাবেন নিচের কমেন্ট বক্সে। যদি কিছু ভুল ত্রুটি হয় সেটাও জানতে ভুলবেননা। 🍀 আবারো দেখা হবে পরের রিভিউতে। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন আর অনেক অনেক বই পড়ুন। 🙂 🙏🏻 !! ধন্যবাদ !! 🙏🏻
"Most of our childhood is stored not in photos, but in certain biscuits, lights of day, smells, texture of carpet." _ Alain de Botton
এই বইটি মূলত লেখকের স্মৃতিকথা। তবে মনে হয়, শুধুই লেখকের নয়; আশি আর নব্বইয়ের দশক যাদের বেড়ে ওঠার সময় তাদের সকলের রঙিন সময়ের এক মিষ্টি, মন ভালো করা গল্পই বর্তমান প্রজন্মকে শুনিয়ে যায় "ঝাল লজেন"। এ বই আসলে সেই সময়ের মফঃস্বল, কলকাতা, মানুষ আর জনজীবনের এক জীবন্ত দলিল।
লেখক এই বইকে ভাগ করেছেন দুইটি অধ্যায়ে আর নানান পর্বে। কোথাও তিনি বলেছেন তাঁর প্রিয় ফুটবল খেলোয়াড় কৃষাণু দের কথা, আবার কোথাও শুনিয়েছেন তাঁদের বাড়িতে প্রথম ঠান্ডা মেশিন আসার কথা। কোথাও গল্প এগিয়েছে লেখকের রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের স্মৃতি মেদুরতায় আবার কখনও সেই সময়ের মানুষের প্রেম সম্পর্কে দ্বিচারিতার আলাপে। কখনও মন মজেছে সেসময়ের নেমন্তন্ন বাড়ির কথায় আবার কোথাও হন্যে হয়ে খুঁজেছি দুর্গা পুজার সময় লেখকের মায়ের অভিমানের কারণ। আর জানলাম সে সময়ের খেলাধূলার উন্মাদনা আর ঝাল লজেনের গল্প। আর এই ঝাল লজেনের মধ্যে দিয়ে অমরত্ব লাভ করলো তাঁরাও যাঁরা সহজ জীবনের কথা বলতেন। যাঁরা অনাড়ম্বরের মধ্যেও বেঁচে থাকার আনন্দ জানতেন।
আমরা যখন কোনো মুহূর্তে বাঁচি, তখন অনেক সময়ই তার বিশেষত্ব বুঝে উঠতে পারিনা। বহু বহু বছর পর যখন স্মৃতির টানে অতীতে পাড়ি দিই, তখন মনে হয় আহা, কী সুন্দরই না ছিল সেসব সময়। আর মনটা অজান্তেই খারাপ হয়ে যায়। লেখকের স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে আমিই স্মৃতিচারণ করে ফেলছিলাম মাঝে মাঝে। যদিও আমার ছোটবেলা একেবারেই অনাড়ম্বর, তবুও মনে পড়ে যাচ্ছিল স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যাওয়ার কথা, বাড়ির পিছনের বারান্দায় টেবিল ফ্যান চালিয়ে আর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে টুল নিয়ে পড়তে বসার কথা, আমপাতা দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ বানানোর কথা, মামাবাড়ির ছাদে গরমের ছুটির সন্ধ্যেয় হাওয়া খাওয়ার কথা, স্কুল যাওয়ার সময় ট্রেনে জানলার ধার পাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ির কথা, বাড়িতে কেউ না থাকলে লুকিয়ে "চোখের বালি" পড়ার কথা, শাহরুখ খানকে টিভির বা কম্পিউটারের পর্দায় দেখা আর ভালো ভালো চকলেট বিস্কুট খাওয়ার লোভে বারবার মায়ের কাছে মামাবাড়ি যাওয়ার বায়না,আরও না জানি কত কিছু। লেখক দেখলাম তাঁর সেজো কাকাকে ভাইপো বলে ডাকতেন। ঠিক তক্ষুনি আমার মনে হল আমিও তো আমার পাড়াতুতো এক জেঠিমাকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বদ্দি বলে ডাকি। জীবন বড্ডো সরল ছিল সেসময়। তখন স্কুলের ব্যাগটা বড্ডো ভারী বলে মায়ের ঘাড়ে সেটা চাপিয়ে দিতাম অনায়াসে কিন্তু আজ তার চেয়েও অনেক ভারী জীবনের বোঝাটা নিজেকেই বইতে হয়। যাই হোক, পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে বড্ডো ভুলভাল বকে গেলাম। এবার কাজের কথায় আসি।
বইটা পড়ে আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি আর খুব উপভোগ করেছি। ওনার একই ধাঁচের প্রেমের উপন্যাসের বাইরে গিয়ে একটু অন্যরকম লেখা বেশ ভালো লাগলো। অলংকরণ গুলোও অপূর্ব। আর প্রচ্ছদের কথা তো না বললেই নয়। এইরকম একটা কিউট প্রচ্ছদের জন্য শিল্পী রৌদ্র মিত্র কে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। লেখক এই বই উৎসর্গ করেছেন তাঁদের, যাঁরা মায়ায় বাঁচে, আবেগে জড়িয়ে ফেলে নিজেদের। তাই এরকম পাঠক হলে বইটা একবার পড়ে দেখতেই পারেন।
"Sometimes you will never know the value of a moment until it becomes a memory."- Dr Seuss
কিছু কিছু অনুভূতির কোনো নাম হয়ে না। সেগুলো কেবল'ই অনুভূতি। যেমন শীতের দুপুরে, গায়ে মিঠে রোদ মেখে কমলা লেবু খাওয়ার অনুভূতি... বহু দিন পর, নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতে পাওয়ার অনুভূতি...স্কুল থেকে ফিরে, মায়ের হাতে বানানো পিঠে খাওয়ার অনুভূতি।
এই বইটির প্রতি পৃষ্ঠার মধ্যে কায়েদ রয়েছে এইরকম সব অনুভূতি। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে মিষ্টিদাদু, পঙ্কা, ভাইপো, মাম্মান, শঙ্কর���া, সোমাদি যেন আমারই কাছের কেউ। লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যায় ন'কাকার হারমোনিয়াম, সোমাদি আর বুইদির গানের সুর, যেন সময়কে অতিক্রম করে আমার কানেও এসে পৌঁছেছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, যে লেখককে আমার বেশ খানিকটা হিংসে হয়েছে। এত সুন্দর অনাড়ম্বর একটা জীবনের স্বাদ আমার পাওয়া হলো না। যেই জীবনে রবিবারের দুপুরগুলো হারিয়ে যেত ডেনকালির জঙ্গল, আটের দপ্তর আর বাহাদুরের সঙ্গে রহস্যে। যেই জীবনে রবিবারের দুপুরগুলো আটকে যেত না Mock Test আর OMR Sheet'এ।
"Most of our childhood is stored not in photos, but in certain biscuits, lights of day, smells, the texture of carpets." - Alain de Botton
ঝাল লজেন কী? কাদের জন্য? লেখকের কথায় যারা পুরনো ভাঙা পেন ফেলতে পারে না, যারা শৈশবের ডোনাল্ড ডাক আঁকা টিফিনবক্সের ঢাকনা জমিয়ে রাখে। ঝাল লজেন আমাদের মনের কোণে লুকিয়ে রাখা প্রতিটি স্মৃতির কথা জানে। প্রথম অঙ্কে শূন্য পাওয়ার কথা, প্রথম সেই ফ্রেণ্ড রিক্যুয়েস্ট, প্রথম টিউশনে চোখাচখি, প্রথম স্বজন হারানোর বেদনা। ঝাল লজেন তাদের সবার যারা বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রথম হাত ঘড়িটা ফেলতে পারে না। যাদের বইয়ের ফাঁকে বুকমার্ক হয়ে রয়ে যায় হলদেতে বাসের টিকিট। আর যারা শত চেষ্টা করেও আজও ভুলতে পারে না সেই ফোন নাম্বার। ঝাল লজেন জমিয়ে রেখে রোজ একটু একটু করে পড়তে হয়। একবারে পড়ে ফেলতে নেই যে!
এক অপূর্ব মায়াময় স্মৃতিবেলা। টুকরো টুকরো স্মৃতি জুড়ে তৈরি অসম্ভব সুন্দর, মায়া মাখানো রচনা - যা পাঠককে হাসাবে, কাঁদাবে এবং সর্বোপরি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নিজেদের ফেলে আসা হারিয়ে যাওয়া আর ফিরে না পাওয়া সেই সব মুহূর্তগুলোতে, যা হয়ত বহুদিন মনের কোণের ধুলোতে চাপা পড়ে রয়েছিল। এই বই ফিরিয়ে দিল সে সব চাপা পড়া সময়কালকে, সেই সময়ের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো। অজান্তেই পাওয়া যেতে থাকে সেই সব ভালোলাগার স্পর্শ আর গন্ধের আভাস। এই বই পড়ার পর পাঠক অনুভব করেন এক আশ্চর্য মন খারাপের সুখানুভূতি।
একঘেয়ে প্রেম আর একই প্লটের চর্বিতচর্বনকে খিস্তি দিয়ে, বাংলার কালজয়ী লেখক, বিশ্বসাহিত্যের সমস্ত মহৎ সাহিত্যকর্ম পাঠ আর বিশ্লেষণ করা শেষ হওয়ার পরেও যদি বেঁচে থাকি বছর তিরিশ পর, বুক ফুলিয়ে গর্বিত স্বরে সত্যি কথাটা বলব, কথা দিলাম।
Delightful read. Fun yet very nostalgic memoir for all of us, who were growing up in 80s and 90s Kolkata/West Bengal. Well written, makes you laugh and at the same time, pine for those simple, happy-go-lucky days.
স্মৃতিতে মোড়া 'ঝাল লজেন': এক অনবদ্য শৈশবের জার্নি স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা 'ঝাল লজেন' বইটি হাতে নিয়ে প্রথম যে অনুভূতিটা হলো, সেটা হলো নস্টালজিয়া। এই বইটা শুধুমাত্র লেখকের স্মৃতিচারণা নয়, এটি যেন আমাদের প্রত্যেকের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার এক টুকরো কোলাজ। বইয়ের পাতায় পাতায় লেখক আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন আশি ও নব্বইয়ের দশকের সেই রঙিন সময়ে, যখন জীবন ছিল প্রযুক্তির জটমুক্ত, আর সম্পর্কগুলো ছিল অনেক বেশি আন্তরিক। লেখকের সাবলীল ও মজাদার লেখনশৈলী বইটিকে দিয়েছে এক বিশেষ মাত্রা। পড়তে গিয়ে মনে হয়, যেন কোনো বন্ধু তার শৈশবের গল্প শোনাচ্ছে, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি চরিত্র এত জীবন্তভাবে চিত্রিত হয়েছে যে মনে হয়, আমরাও যেন সেই মফঃস্বল শহরের অংশ। সেই সময়ের পাড়ার জলসা, পুজোর উন্মাদনা, নেমন্তন্ন বাড়ির হইহুল্লোড়, কিংবা ট্রামের শব্দ – সবকিছুই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। 'ঝাল লজেন' বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর আবেগিক গভীরতা। শুধুমাত্র হাসি বা আনন্দ নয়, বইটিতে রয়েছে মন খারাপের হালকা ছোঁয়াও। প্রতিটি কাহিনীর মধ্যে দিয়ে লেখক যেমন তুলে ধরেছেন ফেলে আসা সময়ের আনন্দ, তেমনই রয়েছে সেই দিনগুলির জন্য এক চাপা বেদনা। এই আলো-ছায়ার মিশেলই বইটিকে দিয়েছে এক অন্যরকম স্বাদ, ঠিক যেন ঝাল লজেনের মতো। এই বইটি শুধু যারা সেই সময়টাকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাদের জন্যই নয়। নতুন প্রজন্মের কাছেও এটি সেই সোনালি সময়ের এক দলিল, যেখানে তারা খুঁজে পাবে এক ভিন্ন জগতের সন্ধান। এক কথায়, 'ঝাল লজেন' হলো সেই স্মৃতির মালা, যা আমাদের সবার হৃদয়ে গেঁথে থাকা শৈশব ও কৈশোরের টুকরোগুলোকে আবার নতুন করে জীবন্ত করে তোলে। সব মিলিয়ে, 'ঝাল লজেন' একটি অনবদ্য পাঠ অভিজ্ঞতা। এটি শুধুমাত্র একটি বই নয়, এটি আমাদের নিজেদের ফেলে আসা সময়ের প্রতিচ্ছবি। তাই যারা শৈশবের স্মৃতিতে ডুব দিতে চান, তাদের জন্য এই বইটি এক অসাধারণ উপহার।