বাঙালির সাংগঠনিক প্রতিভা কেন কম? কেন বাঙালির সংগঠন টেকে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন এমন একজন বাঙালি, যিনি নিজে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য-উদাহরণ সংগঠন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ—গড়ে তুলেছেন, টিকিয়ে রেখেছেন বিকাশমান। কিন্তু এ-গ্রন্থ তাঁর সংগঠন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতার বয়ান নয়, এ হচ্ছে একজন অভিজ্ঞত ও প্রশ্নশীল, মননশীল, প্রাজ্ঞ মানুষের নিজের ভেতরে জেগে ওঠা সওয়ালের জবাব ঢঁড়ে ফেরা, ইতিহাসের মধ্যে, সাহিত্যের মধ্যে, সমাজের মধ্যে এবং নিজের জীবন ও নিজের চারপাশের মধ্যে। মৌলিকভাবেই এ-প্রশ্ন তিনি তুলেছেন, এবং মৌলিকভাবেই এ-প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করে গেছেন, ফলে আমরা লাভ করেছি একটা প্রায়-দার্শনিক গ্রন্থ। বেদনা, ভালোবাসা আর প্রজ্ঞার সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লক্ষ করেছেন, বাঙালির সংগঠনিক দুর্বলতার কারণ তার আত্মপরতা, অসহায়তা, আত্মঘাত আর ঊনস্বাস্থ্য। তিনি খুঁজেছেন এই কারণগুলোর বিদ্যমানতার কারণ। লক্ষ করেছেন আমাদের ইতিহাসে সমষ্টির চেয়ে ব্যক্তি কীভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে। চিন্তা আর ভাব, প্রশ্ন আর প্রেম, যুক্তি আর শিল্পের সমাহারের অপূর্ব নিদর্শন এই গ্রন্থ, একই সঙ্গে চিন্তা উদ্রেককারী, মনোহর ও প্রসাদগুণময়।
Abdullah Abu Sayeed (Bengali: আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদ; born 25 July 1939) is a Bangladeshi writer, television presenter, organizer and activist. He is currently the Chairman of Bishwa Sahitya Kendra, a non-profit organization that promotes the study of literature, reading habits and progressive ideas.
Early life:
Sayeed was born in 1939 in Calcutta. His father was Azimuddin Ahmed, a teacher of both English and Bengali literature.He was also a playwright. Sayeed passed SSC exam from Pabna Zilla School in 1955 and HSC exam from Profollo Chandra College in 1957. He later earned the degree of BA and MA in Bengali from the University of Dhaka in 1960 and 1961 respectively.
Career:
Sayeed was a professor of Bengali language in Dhaka College.In mid-1970s he started presenting Shaptabarna (Seven Colors), a multidimensional TV show in Bangladesh Television. In 1978, he founded the Bishwa Sahitya Kendra.
AWARDS:
Sayeed was given the 97th Ramon Magsaysay Award in Journalism, Literature, and Creative Communication Arts for "cultivating in the youth of Bangladesh a love for literature and its humanizing values through exposure to the great books of Bengal and the world".
Bangla Academy Award (2011) for his essays. Ekushey Padak (2005) Mahbub Ullah Trust Award (1998) National TV award (1977)
কিছু শাণিত ও সঠিক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কিছু হাস্যকর রকমের দুর্বল ও সংস্কারজাত ভাবনার যোগফল এই গ্রন্থটি। অধ্যাপক সায়ীদ বাঙালিকে কাছ থেকে দেখে তার প্রতি যতোটা ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ আর বীতস্পৃহ, পৃথিবীর আরো কয়েকটি জাতিকে দূর থেকে দেখে তাদের প্রতি তিনি ততোটাই মোহগ্রস্ত। এই বইটিতে বাঙালির সংগঠনকুশলতাকে বাঙালি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল রঙের সাথে অবাঙালি বিষয়ে কল্পিত ধারণার পানি মিশিয়ে আঁকা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংকরায়ন করে "এগিয়ে" যাওয়ার ব্যাপারে লেখকের অভিপ্রায়ের সাথে টিক্কা খানের অভিপ্রায়ের পার্থক্য সামান্যই বলে মনে হয়েছে। এ-ই যদি হয় শিক্ষিত বাঙালির নমুনা, অশিক্ষিত বাঙালি না জানি কেমন!
আমরা বাঙালিরা অন্যের গোলামী করতে স্বচ্ছন্দবোধ করি। লেখাপড়া করে মোটামুটি কোনোরকম একটা চাকরি যোগার করতে পারলে নিশ্চিন্ত হই। অন্যের গোলামী করে হোক বা অন্যের সাহায্য পেয়ে হোক, মাস শেষে নিজের স্বার্থ উদ্ধার হলে আয়েশ করে ঘরে শুয়ে থাকি। সংগঠন আমাদের জন্য বিলাসিতা। কিন্তু জাতীয় জীবনে সংগঠন একটি অপরিহার্য ব্যাপার। সংগঠন ছাড়া একটা জাতির অগ্রগতি হতে পারে না। একটা জাতির সংগঠনগুলো যত শক্তিশালী, সেই জাতি তত শক্তিশালী। আমাদের সাংগঠনিক সামর্থ্য খুবই কম। এটাই জাতি হিসেবে আমাদের দুর্বলতার মূল কারণ। জাতি হিসেবে একাত্তরের আগে আমরা সর্বদা পরাজিত ছিলাম। এর কারণও এই সংগঠনহীনতা। যুগে যুগে এই জাতির উপরে অবিচার হলে আমরা কখনো সাংগঠনিকভাবে এর প্রতিকার করতে পারিনি। ইতিহাসে অল্প কিছু আন্দোলন দেখতে পাই। তবে সেগুলো ক্ষণস্থায়ী এবং নির্দিষ্ট কিছু মানুষের চেষ্টা। বাঙালির এই সংগঠনহীনতার কারণগুলো লেখক খুজতে চেষ্টা করেছেন। প্রথম কয়েকটা প্রবন্ধে লেখক বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। এরপরে স্বাস্থ্য। তারপরে আবহাওয়া। সবগুলো এলিমেন্ট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে। বইটা আমার কাছে অনেক মূল্যবান। কারণ প্রথমতঃ আমি একজন বাঙালি। দ্বিতীয়ত ছোটবেলা থেকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক কাজে জড়িত থেকেছি। এবং স্বভাবতই দেখেছি সাংগঠনিক ব্যর্থতাগুলো। তাই একজন বাঙালি হিসেবে সংগঠনে নিজের অবস্থান বোঝার জন্য বইটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। লেখক কিছু সমস্যা দেখিয়ে দিয়েছেন। এখান থেকে সমাধান খোজা এবং নতুন সমস্যা বের করার কাজটা নিজেকেই করতে হবে। বইটা কোনো গবেষণালব্দ ফলাফল না। লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে ব্যাক্তিবিশেষ মতপার্থক্য হতে পারে। কিন্তু নিজের ব্যক্তিজীবনে ও সাংগঠনিক জীবনে উন্নতির জন্য প্রচুর ভাবনার খোরাক পাওয়া যাবে।
বাঙালির সাংগঠনিক অক্ষমতা, বাঙালির সংগঠন কেন টেকে না - এই নিয়ে আলোচনা করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। উনি যেসব কারন দেখিয়েছেন তার সবই যে মেনে নেয়া যায় এমন না, আবার সবই খারিজ করে দেয়ার মতো এমনও না। আলোচনা কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই উপরিতলের মনে হবে। তবুও কিছু পরিসরে বইটার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে বলেই মনে করছি।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই 'সংগঠন ও বাঙ্গালি'। লেখকের অনেকগুলো প্রবন্ধ সংকলনে সমৃদ্ধ এই বইতে, লেখক খুঁজতে চেয়েছেন জাতিগতভাবে বাঙ্গালি কেন কোনো সংগঠন গড়ে তুলতে এতটা অক্ষম?
লেখক ইতিহাসের দিকে ফিরে যেয়ে দেখিয়েছে, এই জাতি সারাজীবন শাসিত হয়ে এসেছে। নিজেরা কোনদিন শাসন করতে পারেনি। পরাধীন থাকার মানসিকতা রক্তে মিশে গেছে। লেখক তুলে এনেছেন, জাতি হিসেবে আমরা কতটা আত্নকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। লেখক বলেন, "আমার ধারন বাঙ্গালি- যে আজ পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি তার চরিত্রের এই আত্নপরায়ণপ্রবণতাই এর একটা বড় কারন। তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থলিপ্সা আজও তার সংঘবদ্ধতার স্বপ্নের চেয়ে শক্তিশালী"
বাঙ্গালির আবেগের জায়গাটা এত্ত বেশি বাড়াবাড়ি, যা তাঁকে কোনদিন সফল সংগঠন করতে সাহায্য করেনি। দুজন বাঙ্গালি এক জায়গা এক হলে কোনোদিন সাধারণ বিষয়েও আপোষ করতে রাজি হয়নি। কেউ নিজের জায়গা থেকে ছাড় দিতে রাজি থাকেন না। অধ্যাপক তার বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, "আত্নপ্রাপ্তির লাগামহীন লিপ্সায় তারা কামান্ধ ও আপোষহীন। এই জগতে কোনো মানুষের চেয়ে কোনোভাবে নিজেকে কম মনে করে এমন বাঙ্গালি এই পৃথিবীতে নেই।"
লেখক প্রথম ধাপে সংগঠন গড়তে না পারার তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন আঞ্চলিকতাবাদ কতটা ভয়াবহ এই জাতির মানসিকতায়। লেখক আক্ষেপ করে বলেন, বাঙ্গালির দেশ চেতনা আজো জেলাচেতনার বাহিরে গড়াতে পারেনি। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও আঞ্চলিকতাবাদ এতটাই প্রবল, যখন যে জেলার নেতা রাষ্ট্রপ্রধান হোন, তখন মূলত সে জেলাই বাংলাদেশ হয়ে পড়ে।
লেখক বারবার ইঙ্গিত করেছেন বাঙ্গালির তীব্র পরশ্রীকাতর মানসিকতার দিকে। এই ঘৃণ্য মানসিকতা আমাদের কোনোদিন এক হতে দেয়নি। যখন পাঁচ জন এক হয়েছে, বাকি তিন জন ঠিকই তাদের পেছনে লেগে যায়। লেখক বলেন, "আমরা পৃথিবীকে জয় করতে পারি না, তাই সবখানি শক্তিকে ব্যয় করি আত্নরক্ষার জন্য। তাই ব্যক্তিগত স্বার্থ হাতিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের বুদ্ধি যে পরিমাণ টনটনে, সামাজিক স্বার্থের বেলায় ঠিক সে পরিমাণেই ভোঁতা।" তিনি আরো বলেন, "আমরা যে পরিমানে নিষ্ফল, সেই পরিমাণেই নিন্দুক। নিন্দার ভেতর দিয়েই নিজদের অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্ত খুঁজি।"
লেখক প্রশ্ন রেখে বলেন, আবেগ উচ্ছ্বাস যে জাতির প্রধান গৌরব, যে জাতি অল্পতেই এত উত্তেজিত পড়ে, তারা কেন আজো অপরাগতকাএ উতরে উঠতে পারছে না। লেখক বলেন, "মানসিক ভারসাম্যের অভাব চিন্তাশীলতার জায়গায় আমাদের বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়েছে। এজন্যেই আমাদের জাতির ভেতর এত কবি, লেখক, শিল্পী, গায়ক, নৃত্যশিল্পী, কিন্তু একজনও দার্শনিক নেই।"
আপনি পড়বেন বইটা, আর পরিচিত হতে থাকবেন বাঙ্গালি জাতির স্বরূপের সাথে। কিছু লজিককে মনে হতে পারে বেশ সস্তা কিংবা ফালতু। আপনার মধ্যে জাতীয়তাবাদের পারদ একটু বেশি থাকতে মাঝেমধ্যে রাগ হতে পারে। কিন্তু তবুও দিনশেষে যখন আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাববেন, লেখকের সাথে দ্বিমত করা সুযোগ খুব কমই পাবেন।
অসাধারণ একটি বই। ছোট কিন্তু অনেক বিস্তৃত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাঙালি জাতির উত্থান পতন এবং অনেক কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি মননের গড়ন নিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় আলোচনা; স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকটা, নীরসতা, উদ্যমহীনতা, এবং ক্ষমতা বা এই ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা - কি নেই এতে! যদিও সংগঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু সংগঠনের চাইতে অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বাঙালি স্বভাব আর আচরণের বিশ্ল��ষণ। আমার মনে হয় প্রতিটি বাঙালি, বিশেষত যারা বাঙালি জাতির চিন্তার ধরণ নিয়ে খানিকটা হলেও চিন্তা ভাবনা করেন তাদের পড়া উচিৎ।
যদিও সায়ীদ স্যার শেষে বাঙালির পশ্চাৎগামী অবস্থার জন্য এই সীদ্ধান্তে দৃঢ়তার সাথে ধারণা করেছেন বাঙালির প্রধান অন্তরায় স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা। আমার বিশ্বাস প্রকৃতিগত অবস্থান। এই পরিবেশই বাঙালির স্বাস্থ্য দুর্বল গঠনের পেছনে দায়ী। তবে এরই ফলশ্রুতিতে আমাদের চিন্তা ভাবনা অথবা অন্যান্য সীমাবদ্ধতা বলে যে দাবী করা হয়েছে সেটা আমি মানতে নারাজ। স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা প্রধান অন্ততায় হতে পারে না। জাপান চীন সহ পূবের জাতি গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা আমাদের চাইতে খুব বেশি উন্নত নয় স্বাস্থ্যর দিক থেকে। আমাদের চিরায়ত কৃষক শ্রেণিও দুর্বল নয়। এবং শক্তিরই প্রতীক, যারা পরিশ্রমীও বটে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আমি সমাজ বিজ্ঞানী নই তাই সমাজ বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ তাত্বিক ভাবে করার চাইতে পর্যবেক্ষণের মাঝেই উত্তর খুঁজতে করতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি এবং সেখান থেকে মনে হয় আমাদের 'রুচিবোধ'টাই মূল সমস্যাটা। এই রুচিবোধ দুই একজনের রুচিবোধ নয়। আমি বুঝাতে চাচ্ছি জাতিগত রুচিবোধ। এটা আসলেই কূপমুন্ডুকতাপূর্ণ। যা আমাদের অঞ্চলকেন্দ্রিক, আন্তর্জাতিক নয়। আমরা যত অঞ্চলকেন্দ্রিক হয়ে থাকবো ততোই স্বজাতি নিচু নিচু মনস্তত্বর চর্চাই করে যেতে থাকবো। কোথাও বাঙ্গালির এন্টারটেইনমেন্ট বোধ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কাউকে কিছু কথা বলেছিলাম, যা মনে হচ্ছে এখানেও প্রাসঙ্গিক। তাই কপি পেস্ট করে রাখলাম, ''আমাদের রুচি খারাপ বলেই আমাদের এক্টারটেইনমেন্ট নিন্ম রুচির, এন্টারটেইনমেন্ট নিন্ম রুচির বলেই নিজের পছন্দর বাইরের সব কিছু আমরা নিতে পারি না, ভালো সেজে থাকার জন্য ধর্মের দোহাই দেই কিন্তু সেই সাথে আবার সব যায়গায় তাকাই জৈবিক আকাঙ্ক্ষায়, সুন্দরকে মন দিয়ে কামনা করি না, কামনা করি শক্তি দিয়ে যাতে প্রতিটি চাওয়া হয়ে উঠে একটি করে ধর্ষণ, একেকটি খুন। একমাত্র যে গ্লোবালাইজেশনের স্রোতের মুক্ত চিন্তা আমাদের এই রুচিবোধ পালটাতে তার সব গুলো পথ আমরা গলাটিপে ধরি কারণ আমাদের নিকৃষ্ট রুচিবোধ নিজের অবস্থান অটুট রাখার জন্য নিজেই সেটা করতে দেয় না।''
বইটির সঙ্গে আমার অনেক অভিজ্ঞতারই ভীষণ মিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে সংগঠক জাতীয় মানুষ নই, কাজটা বেশ শক্তও, তবু দু-একবার মতিভ্রম হয়েছিলো। বলতে নেই, প্রতিবারই হতাশ হয়ে সরে আসতে হয়েছে। নিঃস্বার্থ বা সেবামূলক সংগঠনেও আমরা যেভাবে দল পাকাই, ব্যক্তিস্বার্থ খুঁজি, ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার চেষ্টা করি, এই প্রবণতাকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বেশ ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। অবশ্য কিছু কিছু কথা অতিরিক্ত সাধারণীকৃত হয়ে গেছে। তারপরও মোটের ওপর বইটি চমৎকার। যাঁদের মাথায় সংগঠনের ভূত চাপবে-চাপবে করছে, তাঁরা এটা একটিবার পড়ে দেখলে ভালো করবেন। এমনিতে যাঁরা সংগঠন করেন, তাঁদের উদ্যম আর উৎসাহ সাধারণত অদম্য হয়ে থাকে। সেটি প্রশংসনীয়ও। তবে তাঁরা কিছুটা আবেগী আর বিশ্বাসপ্রবণও হন, ফলে ভ্রমবশত সকলকে নিজের মতোই নিবেদিতপ্রাণ ভাবতে থাকেন। বইটিতে এরকম বাস্তবোচিত কিছু বিষয়ের কথা আছে।
#মূল_বিষয়বস্তু: 'সংগঠন ও বাঙালি' অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের রচিত একটি আলােচনাধর্মী গ্রন্থ। এটি লেখকের অনেকগুলাে প্রবন্ধ সংকলনে প্রবন্ধ। এই বইটিতে স্যার খুঁজতে চেয়েছেন জাতিগতভাবে বাঙ্গালি কেন কোনাে সংগঠন গড়ে তুলতে এতটা অক্ষম? #পাঠপ্রতিক্রিয়া: "লেখক ইতিহাসের দিকে ফিরে যেয়ে দেখিয়েছে, এই জাতি সারাজীবন শাসিত হয়ে এসেছে। নিজেরা কোনদিন শাসন করতে পারেনি। পরাধীন থাকার মানসিকতা রক্তে মিশে গেছে। লেখক তুলে এনেছেন, জাতি হিসেবে আমরা কতটা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। লেখক বলেন, "আমার ধারন বাঙ্গালি- যে আজ পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি তার চরিত্রের এই আত্মপরায়ণপ্রবণতাই এর একটা বড় কারন। তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থলিপ্সা আজও তার সংঘবদ্ধতার স্বপ্নের চেয়ে শক্তিশালী" বাঙ্গালির আবেগের জায়গাটা এত্ত বেশি বাড়াবাড়ি, যা তাঁকে কোনদিন সফল সংগঠন করতে সাহায্য করেনি। দুজন বাঙ্গালি এক জায়গা এক হলে কোনােদিন সাধারণ বিষয়েও আপােষ করতে রাজি হয়নি। কেউ নিজের জায়গা থেকে ছাড় দিতে রাজি থাকেন না। অধ্যাপক তার বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, "আত্নপ্রাপ্তির লাগামহীন লিপ্সায় তারা কামান্ধ ও আপােষহীন। এই জগতে কোনাে মানুষের চেয়ে কোনােভাবে নিজেকে কম মনে করে এমন বাঙ্গালি এই পৃথিবীতে নেই।" #বইটি_কেন_পড়বেন: বইটি পড়লে সংগঠন গড়া, সংগঠন ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ, সাংগাঠনিক প্রতিভা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাবেন। লেখক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতাে বড় একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। সংগঠনটি গড়ে তুলতে যেসব প্রতিকূলতার মুখােমুখি হয়েছেন এবং তার মােকাবিলা করেছেন সেসব বিষয়গুলাে বিভিন্নভাবে এ বইয়ে উল্লেখ অাছে। #আলোচনা_সমালোচনা: এই বইয়ে বাঙালি জাতির পিছিয়ে পড়ার কারণ দেখানো হয়েছে পরশ্রীকাতর মানসিকতাকে।এই মানসিকতা আমাদের এক হতে দেয় নি।যখন পাঁচজন এক হয়েছে বাকি তিনজন ঠিকই তাদের পেছনে লেগে যায়। লেখক বলেন--"আমরা যে পরিমানে নিষ্ফল, সেই পরিমানেই নিন্দুক।নিন্দার ভেতর দিয়েই নিজেদের অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্ত খুঁজি। " বইটি এইদেশের অধিকাংশ মানুষই পছন্দ করতে পারবে না বলে আমার ধারণা। কারণ লেখকের কথাগুলো অত্যন্ত তেতো ধরণের। মিঠে কথা সবাই পছন্দ করে কিন্ত তেতো কথা হজম করতে জানেই বা কয়জনে? তাছাড়া এদেশে সস্তা দেশপ্রেমিকের অভাব নাই। তারা তো কোনভাবেই লেখকের কথাগুলো নিতে পারবে না। #বইয়ে_সুন্দর_কিছু_কথা: ★আমরা মুখে মুখে বলছি ব্যাক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে রাষ্ট্র বড়। কিন্ত কাজের সময় দেখতে পাচ্ছি রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যাক্তি বড়। ★ছোট বড় যাই হোক যে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রায় একিরকম কঠিন যদি তা সততা দিয়ে গড়ে তোলা হয় ★একটা জাতির সংগঠনগুলো যত শক্তিশালী,সেই জাতি তত শক্তিশালী।আমাদের জাতির সংগঠনের জগৎটা খুবই দুর্বল। ★মানুষ যুদ্ধে যায় একসঙ্গে, কিন্ত পালায় একা-একা। পালাতে পালাতে আমরা একা হয়ে গেছি। একা আর বিচ্ছিন্ন। #ব্যাক্তিগত_মতামত: ব্যক্তিগতভাবে লেখকের কিছু মতের সাথে আমার মতের অমিল ঘটলেও এই বইটি থেকে আমার মনে উত্থিত হওয়া বহুপ্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর আমি পেয়েছি। নিঃসন্দেহে আমি মনে করি বইটি সকল সচেতন পাঠকের পড়া উচিত; অন্তত আমাদের শিকড়ে গড়ে থাকা চেতনাগত ভাইরাসগুলােকে বিলুপ্ত করার জন্য হলেও, যেগুলাে বিলুপ্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা কখনােই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না।
বহুদিন ধরে আমার মনে কিছু প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছিল। যেমন, জাতিগতভাবে আমরা এত স্বার্থপর কেন? প্রত্যেকেই কেন নিজের ভাগেরটা গুছিয়ে নিতে চায় সবসময়? আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দূর্নীতির কালচার, এর কারণ কি শুধুই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা? নাকি এর শেঁকড় লুকিয়ে আছে আরও গভীরে কোথাও? কেন আমরা কোনোকিছুতে স্থায়ীভাবে সংঘবদ্ধ থাকতে পারি না?
চিন্তাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায���ীদের লেখা "সংগঠন ও বাঙালি" বইতে যে এরকম আরও অনেক প্রশ্নের সদুত্তর পাব তা প্রথমে ভাবতে পারিনি। বইটিতে আলোচনার মূলধারা সংগঠনকে ঘিরে আবর্তিত হলেও ক্রমে এখানে বৃহত্তর সংগঠন হিসেবে উঠে এসেছে রাষ্ট্রের কথা, সরকার ব্যবস্থার কথা। আমাদের সংগঠন কেন টেকে না, আমরা কেন কোনো কিছুতে সংঘবদ্ধ থাকতে পারি না, কেন আমরা সবাই-ই কমবেশি স্বার্থপর ও দূর্নীতিপরায়ণ- লেখক এসব প্রশ্নের কিছু যৌক্তিক উত্তর খু��জতে চেয়েছেন নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে, সূত্র খুঁজেছেন আবহমান কাল ধরে প্রচলিত আমাদের প্রবাদ বাক্যগুলোতে কিংবা ঈশপের গল্পে। হাজার হাজার বছর ধরে বিদেশী শাসনের প্রভাব, আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, দারিদ্রের কষাঘাত, অসহায়ত্ব, আমাদের স্বাস্থ্যহীনতাসহ আরও অনেক বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন বাঙালির সাংগঠনিক দূর্বলতা ও স্বার্থপরতার কারণ হিসেবে। পাশাপাশি আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোর রূপরেখাও বর্ণনা করেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে লেখকের কিছু মতের সাথে আমার মতের অমিল ঘটলেও এই বইটি থেকে আমার মনে উত্থিত হওয়া বহুপ্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর আমি পেয়েছি৷ নিঃসন্দেহে আমি মনে করি বইটি সকল সচেতন পাঠকের পড়া উচিত; অন্তত আমাদের শেঁকড় গেঁড়ে থাকা চেতনাগত ভাইরাসগুলোকে বিলুপ্ত করার জন্য হলেও, যেগুলো বিলুপ্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না।
বইটা প্রকাশিত হয় এই সহস্রাব্দের শুরুতে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যানুরাগী শিক্ষক ও দুর্দম সংগঠক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলাদেশ ও বাঙালির জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থতার তত্ত্বতালাশ করেছেন এই বইটিতে। তাহলে বইয়ের নাম সংগঠন ও বাঙালি কেন?
সায়ীদ বলেন, এদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে না ওঠাই বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ। আজকে বাংলাদেশে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও ২০০০ সালের আগে এদেশে বড় আকারের 'বাংলাদেশি' সংগঠন ছিলো অল্প। ব্র্যাকের মতো এনজিও কিংবা অন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলো- যাদের পরিচালনায় বিদেশি সম্পৃক্ততা থাকে তাদেরকে বাদ দিলে একেবারে বাংলাদেশি অর্গানাইজেশন- তা সে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হোক, নন প্রফিট, সমাজসেবা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বা ক্লাব- বাংলাদেশে এসব সংগঠন সফলতা অর্জন করে এগিয়ে গেছে এমন দেখা যায় নি।
ব্যক্তিমানুষ অমিত সম্ভাবনাবান হলেও যূথবদ্ধ না হলে সাস্টেইনেবল অর্জন করা যায় না বেশি, সমাজকে এগিয়েও নেয়া যায় না। কোন লক্ষ্যের পেছনে একা না ছুটে সমমনা যোগ্য অনেককে নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে আত্মনিয়োগ করলে স্বপ্ন সাকার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই দরকার দলবদ্ধ মানুষ, তাই দরকার সংগঠন। সংগঠনের অংশ হয়ে ব্যক্তি তার মনন ও শ্রমের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে পারে, বাস্তবতাকে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করতে পারে। মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, সেই সম্ভাবনার সবচে অনুপম আনজাম সংগঠন দেয়।
এছাড়া অর্গানাইজেশন গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। সামাজিক শক্তি গড়ে ওঠে।
এসব প্রস্তাবনা যে ভুল নয় তা বর্তমান সময়কে দেখলে প্রতিভাত হবে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, রকমারি, টেনমিনিট স্কুল, শিখো, প্রান আর এফ এল গ্রুপ, ইউনিলিভার, গ্রামীনফোন,এয়ারটেল, ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো, রেডিমেড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো- বাংলাদেশে সংগঠনের জয়জয়কার। এসব সংগঠনে চাকরির জন্য দরকারি স্কিল শেখার জন্য গড়ে উঠেছে আরেকটা পুরো ইন্ডাস্ট্রি, বিশেষত এডটেক। কিন্তু লেখক যখন বইটি লিখছিলেন, এই সংগঠনগুলোর মধ্যকার যেগুলো একেবারে দেশীয়- সেগুলির একটাও ছিলো না বা নিতান্তই শৈশবে ছিলো।
বাংলাদেশে বড় সংগঠন গড়ে না ওঠার কারণ অনুসন্ধান কয়া হয়েছে এই বইয়ে। সায়ীদ বলেন, বাঙালি আত্মপর, ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক। নিজের বুদ্ধি আছে, স্বপ্নও অনেকেরই আছে, আছে লক্ষ্য। কিন্তু দলগতভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা কাঁচা। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো, আরব, আমেরিকান বা ইউরোপীয় বা আফ্রিকানরা আদিতে ট্রাইবাল জীবন যাপন করতো। বাংলাদেশ ভূখন্ডবাসীরা কখনোই ট্রাইবাল ছিলো না। নিচু জমির নদীখালবিল প্রধান এই দেশে যার যার উঠোনেই জীবনধারণের জিনিস পাওয়া যেত। এখনো গ্রামের গেলে দেখা যায় ঘরগুলো খুব দূরে দূরে। মাঝে ক্ষেত আর নিচুজমি, যা বর্ষায় জলের নিচে চলে যায়। ফলে মানুষ বিচ্ছিন্ন, একাকী। কেবল বড় সংকটেই (প্রাকৃতিক দুর্যোগ) সকলকে সমাবিষ্ট দেখা যায়। বাংলাদেশে বিদ্রোহ হয়, কিন্তু বিপ্লব হয় না।
আরো অনেক কারণ বলেছেন, যেমন পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি। আজকের দিনের সেলফ হেল্প বইগুলর মতো লেখা হয়নি বইটি, ফলে অনেক ব্যক্তিগত মতামত অবলীলায় লিখিত হয়েছে, অনেক সামান্য তুলনা থেকে বড় বড় উপসংহার টানা হয়েছে। বিদেশিদের ভালো দিকগুলো দেখেছেন বেশি, প্রসঙ্গক্রমেই।
সবশেষে এদেশের মানুষের সংগঠন তৈরি করতে না পারা ও এতে যুক্ত হয়ে অর্থমূলক অবদান রাখতে না পারার জন্য দুষেছেন স্বাস্থ্যহীনতাকে। স্বাস্থ্যের অভাবের জন্য দায়ী দারিদ্র্য, দারিদ্রের জন্য দায়ী ভালো অর্গানাইজেশন না থাকা(নতুবা চাকরি করবে কই/চাকরি দেবে কে?), অর্গানাইজেশন না থাকার জন্য দায়ী জাতিগত উদ্যমহীনতা/দুর্বল স্বাস্থ্য- একটী দুষ্টচক্র। এখনো দেশের বৃহত্তম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সরকারি চাকরি খোঁজে, কারণ বেসরকারি লাভজন প্রতিষ্ঠান দেশে অপর্যাপ্ত। সরকারি প্রতিষ্ঠানে না হয় কাজ না করতে জানলেও চাকরি যাবে না, কিন্তু বেসরকারি সংগঠন যদি কর্মীদের দিয়ে প্রফিট না আনতে পারে তাহলে ছাটাই করবে না কেন আর নেবেই বা কেন প্রতিষ্ঠানে?
বইয়ের শেষে স্টেট ও রাজনৈতিক দল সংগঠন সম্পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষণ ও মতামত আছে।
পুরোদস্তুর দেশীয় সংগঠন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশের বৃহত্তম লাইব্রেরিই শুধু নয়, একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শক্তি। প্রাক ২০০০ যুগের সবচে বড় বাংলাদেশি সংগঠন সম্ভবত এটিই। এখন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছে, তার শক্তি কমবেশি যাই হোক। ম্যানেজমেন্ট বা বিবিএ না পড়া একজন সাহিত্যপ্রেমী কলেজ শিক্ষক কীভাবে এই সংগঠনকে গড়ে তুললেন তার বিবরণ এই বইয়ে পাওয়া না গেলেও আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের সংগঠক জীবনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত জ্ঞানলাভের জন্য বইটি ভালো।
উল্লেখ্য, সায়ীদ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে।
বাঙালি আমরা কবে শেষ এক সাথে এক কাজ করেছি? প্রশ্নটা আমাকে মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তোলে। সত্যিকার অর্থে বৃহদ স্বার্থে আমরা ’৭১ এরপর আমরা সেভাবে এক হতে পারেছে কিনা তা সত্যিকার অর্থে বিস্ময় কর। কারণ এরপর আমরা আর এক হতে পারিনি। জাতিগত ভাবে আমরা বিভক্ত ছিলাম। এখনও আছি। তবে “সংগঠন ও বাঙালি” বইতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তিনি বাঙালিদের এই সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বলা যায় একদম ধরে বুঝিয়েছেন কেন আমরা সংগঠন বা সংগঠিত হতে পারি না। . বাঙালির সংগঠিত হয়ে কাজ করার প্রতিভা নেই। কেন নেই? বাঙালি কেন সংগঠন টিকিয়ে রাখতে পারে না এই প্রশ্নের উত্তর খুজেছেন একজন বাঙালি। যে নিজেই তৈরি করেছেন একটি সংগঠন এবং সেটি টিকিয়ে রেখেছেন ও এর বিকাশ ঘঠিয়েছেন। তিনি হচ্ছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, তৈরি করেছেন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র”, যা আজ বাংলাদেশের বই প্রেমীদের কাছে অনেক বড় একটি সংগঠন। . তিনি এই সংগঠন তৈরি করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি কিভাবে এই সংগঠনটিকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে সেই সব অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে এনেছেন বাঙালির সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণ সমূহ। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন যে, বাঙ্গা��ির আবেগের জায়গাটা এত্ত বেশি বাড়াবাড়ি, যা তাঁকে কোনদিন সফল সংগঠন করতে সাহায্য করেনি। দুজন বাঙ্গালি এক জায়গা এক হলে কোনোদিন সাধারণ বিষয়েও আপোষ করতে রাজি হয়নি। কেউ নিজের জায়গা থেকে ছাড় দিতে রাজি থাকেন না। অধ্যাপক তার বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, "আত্নপ্রাপ্তির লাগামহীন লিপ্সায় তারা কামান্ধ ও আপোষহীন। এই জগতে কোনো মানুষের চেয়ে কোনোভাবে নিজেকে কম মনে করে এমন বাঙ্গালি এই পৃথিবীতে নেই।" . এই যে স্ংগঠন, সেটা আমাদের জাতিগত জীবনে অনেক অপরিহার্য বিষয়। সংগঠন ছাড়া জাতি ছন্নছাড়া। রাষ্ট্র হচ্ছে অনেক বড় একটি সংগঠন কিন্তু সেই কথা আলাদা। সংগঠনের আগে আমাদের জাতিগত ভাবে আমরা কেন সেটা বড় বিষয়। কারণ সংগঠন করতে হলে আমরা নিজেদের দিকে কত সংগঠিত সেটা দেখতে হবে। এতে দেখা যায় আমরা জাতিগত ভাবে এক হতে পারিনি। যদিও কিছু অল্প ইতিহাস রয়েছে, তবে তা ক্ষণস্থায়ী। বলা যায় আমরা হঠাৎ করেই জ্বলে উঠি, কিছু দিন থেকে পরে সেটা শেষ হয়ে যায়। . “সংগঠন ও বাঙালি” বইটির শুরুর দিকে লেখক আমাদের দেখিয়েছেন বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক দিক। যেখানে আমরা বাঙালির সংগঠন নিয়ে মানসিকতার একটা ধারণা পেয়ে থাকি। কারণ আমরা সংগঠন করার ক্ষেত্রে অনেক উৎসাহ দেখালেও সেটার পরিনতি আমরা দেখতে পাই খুব কম। অপর দিকে আমাদের স্বাস্থ্যের কথা বলা হয়েছে। এটাও সত্য, আমরা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে দুর্বল। একটু চিন্তা করে দেখলে আমরা দেখতে পাবো ইউরোপ, আমেরিকার, আফ্রিকার মানুষের মত আমরা এত শক্তিশালী নই। আমরা তাদের মত এত শক্তিশালী নই। . আবার এখানে আবহওয়ার একটা ব্যাপার রয়েছে। আমরাদের দেশের আবহওয়া এমন এখানে পরিশ্রম না করেই অনেক কিছু পাওয়া যায়। তাই আমরা সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। এদেশের মাটির উর্বরতা থেকে খুব সহজেই ফল পাওয়া যায়, তাই কারো সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে না, তাই আমাদের একত্রিত হতে হয় না। . এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে আমার মনে হয়েছে আমরা আরাম প্রিয় জাতি। বলা যায় আরাম আয়েশ করে থাকতে পছন্দ করি। সেই সাথে স্বার্থপরও বলা যায়, কারণ নিজের স্বার্থ উদ্ধার হলেই হল। বাঙালিরা অন্যের অধীনে থাকেই বেশি পছন্দ করে থাকে। কারণ এটা তাদের রক্তের মধ্যেই রয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা যেমন লেখাপড়া শেষ করব, একটা চাকরি হবে ব্যাস আমাদের লাইফ চলে যাবে। . আমরা আবার পরশ্রীকাতরও। অন্যের ভাল দেখতে পারি না। পেছনে টেনে ধরাই আমাদের কাজ। অথচ হাত বাড়িয়ে দিলে বা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে সেটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয় হতে পারে সেটা আমাদের মাথায় আসে না। বাঙালির মধ্যে যারাই সফলতা পেয়েছেন তারা নিজের চেষ্টায় পেয়েছেন এখানে আসে পাশের মানুষের অবদান খুবই কম। . সবশেষে বলব যে, বাঙালির সাংগঠনিক যে দুর্বলতা রয়েছে সেটা আমাদের সৃষ্টি করা। আর এই বইটি কোন গবেষণা নয়। লেখক তার নিজের অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত দিয়েছেন। বইটি বাঙালির সংগঠন ও সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণ গুলো তুলে এনেছেন। যদিও এখানে অনেকের মতপার্থক্য রয়েছে। তবে লেখক যে সমস্যা গুলো তুলে ধরেছেন সেগুলোর সমাধানের পথও নিজেই বের করে নিয়েছেন। তাই সংগঠন করার ক্ষেত্রে সবার এগিয়ে সহযোগিতা করা উচিত।
আমাদের দেশে সংগঠনের অভাব নেই। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ, সামাজিক থেকে জাতীয় - সব ধরনের সংগঠনই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সংগঠনগুলো কতটা সফল? কয়টা সংগঠন শেষ অব্দি টিকে থাকতে পারে? কতগুলো সংগঠন আসলেই নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে সফল হয়? সংগঠনগুলো কি শেষ অব্দি নিজেদের স্বার্থ পূরণের অভয়ারণ্য হয়ে উঠে না?
'সংগঠন ও বাঙালি' বইটিতে লেখক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিয়ে এসেছেন একটা সংগঠনের আদ্যোপান্তকে। বইতে লেখক দেখিয়েছেন যে কেন বাঙালিরা সংগঠনের ক্ষেত্রে এতটা পিছিয়ে আছে। আমাদের ইতিহাস ঘাটলে দেখতে পাই যে দীর্ঘকাল আমাদের পরাধীন থাকতে হয়েছে, স্বাধীনতার স্বাদ আমরা খুব কমই পেয়েছি আর এজন্যই আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পরাধীনতা।
তাছাড়াও যখনই একটা সংগঠন ভালোভাবে দাঁড়িয়ে যায়, দেখা যায় যে সেখানে ব্যাক্তিস্বার্থ জড়িয়ে পড়ে। মানুষ নিজেদের স্বার্থে সংগঠনকে ব্যবহার করা শুরু করে। আমরা অনেকাংশেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি, সমষ্টির কথা ভাবতে পারছি না কেবলই নিজেদের কথাই ভাবছি। এটা সংগঠনের টিকে থাকার পিছনে প্রধান অন্তরায়।
বইতে অনেক সুন্দরভাবে সংগঠনের ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষমতা ও এর কারণ ও প্রতিকার বর্ণনা করা হয়েছে। আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের লেখনীতে কাঠখোট্টা প্রবন্ধও হয়ে উঠেছে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। বইটি একইসাথে অনেক অনুপ্রেরণাদায়কও বটে। দীর্ঘদিনের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ও লেখকের হাতের অসাধারণ লেখনীতে বইটি এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
সংগঠন ও বাঙ্গালি, অধ্যপক আব্দুল্লাহ আবু সাইদ এর একটি প্রবন্ধ।এই প্রবন্ধে তিনি বাঙ্গালি জাতির সংগঠন গঠনের অক্ষমতা সম্পর্কে তুলে ধরেছেন।পাশাপাশি বাঙ্গালি জাতি বিভিন্ন খারাপ দিক তিনি তুলে ধরেছেন।তবে কয়েকটি অবৈজ্ঞানিক তথ্য তিনি বাঙ্গালি জাতি সম্পকে বলেছেন।যা মোটেও সত্য নয়।তবে জাতি হিসেবে আমরা পরশ্রিকাতর তার নমুনা তিনি দিয়ে গেছেন।
বইটির বেশিরভাগ অংশ গেছে বাঙালির স্বাস্থ্য নিয়ে হাহুতাশ করে। এমন কি বাঙালির স্বাস্থ্যোন্নয়নে পাকিস্তানীদের সাথে শঙ্কর করা নিয়েও তিনি খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এত উচ্ছ্বাস তো ভালো না কাকা! ডাটা ড্রাইভেন ফ্যাক্টের চেয়ে অনেক জায়গায় ইনটুইশনের আশ্রয় নিয়েছেন। অনুমানভিত্তিক এইসব মতামতের সবটুকুই যে অকাট্য সত্যা, তা বলা যায় না। তবে বেশ কিছু চমৎকার পর্যবেক্ষনও আছে বইটিতে।
"আমি আজো বুঝিনা, বাঙালিরর জন্য কোনটা আজ বেশী জরুরী - জ্ঞানান্দোলন না স্বাস্থ্য-আন্দোলন? জ্ঞানান্দোলন তো আমাদের জাতির ভেতর কম-বেশী হয়েছে। কিন্তু যেকারণে আমরা সেই জ্ঞানান্দোলনের ফসলকে ঘরে তুলতে পারি নি তা হলো স্বাস্থ্যহীনতা। শক্তি কম বলে আমরা পৃথিবীকে জয় করতে পারিনা, নিজের সামান্য যা আছে, তা ব্যয় করি আত্মরক্ষারর জন্য.."
সংগঠন ও বাঙ্গালি - আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ওনার লেখা প্রথমবারের মতো পড়া হলো এই বইয়ের মাধ্যমে। আফসোস হচ্ছে আরও আগে কেন পড়লাম না। যাই হোক। আল্লাহ সকল কাজ ঠিক সময় মতোই ঘটান। এক বন্ধুবর বলেছেন, "তুই যে কোথেকে এসব বই পড়স ! তোরে তো ওদের টাকা দেওয়া উচিত এইসব পড়ার জন্যে"। আহারে ভাই, কি যে সোনার খনী মিস করে যাস। মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার একটা বই। একটু মন দিয়ে পড়লে দেড় ঘণ্টার মধ্যে পড়া হয়ে যাবে আশা করি। কেন পড়বো এই ছোট বইটা? আপনি পড়বেন, কারণ আপনি বাঙ্গালি জাতির স্বরূপ সম্পর্কে জানতে চান। আপনি জানতে চান যে, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশটার মধ্যে প্রধানত কিসের অভাব রয়েছে, যার কারণে সবাই আজও তাদের চিন্তাধারা কুয়ার গভীরে আটকে রেখেছে। আপনি জানেন যে, আমাদের চিন্তাভাবনা আচার-আচরণে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো সব সময় ঠিক গুছিয়ে উঠতে বা বলতে পারেন না। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ খুব চমৎকার ভাবে আপনার মনের কথা বলে দিবে। বইটা পড়ে মনের মধ্যে রাগ হতে পারে, অসন্তোষ জাগতে পারে। হয়তো কিছু লজিক একেবারে ফালতু মনে হতে পারে। কিন্তু, মনের মধ্যে অস্বীকার করার উপায় নেই। তেলাপোকার মতো বেঁচে থাকা কুয়োর ব্যাং, সর্বদা আত্মতুষ্ট, অলস এই জাতটাকে জানতে হলে, চিনতে হলে, নিজেকে আবিষ্কার করতে চাইলে এই বই অনন্য।
সংগঠন ও বাঙালী বইতে লেখক "বাঙালী কেন সংগঠন গঠনে দুর্বল" তার উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিভিন্ন জাতির ইতিহাসের সাথে বাঙালী জাতির ইতিহাসের তুলনামূলক আলোচনা করে বাঙালির দুর্বলতা গুলো তুলে ধরেছেন। বহু বহু বছর ধরে শাসিত একটি জনপদের স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন পরনির্ভরতা এবং দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামোর বদৌলতে কেন আমরা সুযোগ পেলে ফায়দা লুটি তার উত্তর ও জানতে চেয়েছেন এ বইতে
স্বাজাত্যবোধের আবেগের বাইরে দাড়িয়ে নিজেদের দোষত্রুটি গুলো এমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে আর কাঊকে দেখিনি। পরিমিতবোধ আর যুক্তির কি দারুণ সমাবেশ! বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের জন্য অবশ্য পাঠ্য।
ভালো বই,বাংলাদেশের মানুষের সংগঠন গড়ে তুলতে না পারার ব্যার্থতার কারণ লেখক খুব ভালো করেই তুলে ধরতে পেরেছেন।বইয়ের আকার ছোট হয়ায় এবং সহজপাঠ্য হয়ার কারণে এক বসায় ই বইটা পুরো শেষ করতে পেরেছি।