কল্লোল যুগের অন্যতম সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ১৯০১ সালের ২১ মার্চ (১৩০৫ বঙ্গাব্দের ৫ চৈত্র) বীরভূমের রূপসীপুরের হাটসেরান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা ধরনীধর মুখোপাধ্যায় ছিলেন আপনভোলা শিল্লী মানুষ। শৈলজানন্দর দু'বছর বয়সে মা হেমবরণী দেবীর মৃত্যু হলে ধনাঢ্য কয়লা ব্যবসায়ী মাতামহ রায়সাহেব মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে বড় হন। শিক্ষাজীবন শুরু হয় রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুলে। সেখানে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর সহপাঠী। দুজনে ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কলেজের পড়া ছেড়ে কয়লাকুঠিতে চাকরি নেন। ১৯৩২ সালে চাকরি ছেড়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন ৷ পরবর্তীকালে তিনি চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ করেন। লীলাবতীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
মাতামহের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কলকাতায় এসে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। কালিকলম ও কল্লোল গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক হয়ে ওঠেন। খনিশ্রমিক, সাঁওতাল ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের অবহেলিত মানুষের জীবন অবলম্বনে তিনি অনেকগুলি উপন্যাস রচনা করেন। বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'কয়লাকুঠীর দেশ'। তাঁর লেখায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কথা ফুটে উঠেছে। অতি সাধারণ জীবনকথা তাঁর লেখনী স্পর্শে হয়ে উঠেছে অসাধারণ। উপন্যাস এবং গল্প মিলিয়ে তাঁর গ্রন্হ সংখ্যা প্রায় দেড়শো।
তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল --- কয়লা কুঠীর দেশে , ডাক্তার , বন্দী , আজ শুভদিন , ঝড়ো হাওয়া , মাটির ঘর , পাতালপুরী ,গঙ্গা-যমুনা , রূপবতী প্রভৃতি৷ 'ডাক্তার' উপন্যাস অবলম্বনে 'আনন্দ আশ্রম' সিনেমাটি নির্মিত হয়৷ তিনি ছিলেন একাধারে কাহিনীকার , চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক৷ তিনি আকাশবানীর নাট্যবিভাগেও কাজ করেছেন৷ দীর্ঘদিন কালিকলম পত্রিকা সম্পাদনা করেন তাঁর অনেক উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছ ৷ তিনি নিজেও একজন পরিচালক ছিলেন। নন্দিনী , শহর থেকে দূরে , বন্দী , অভিনয় নয় , রং-বেরং , কথা কও প্রভৃতি তাঁর পরিচালিত সিনেমা। তাঁর প্রথম ছবি পাতালপুরী । সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য আনন্দ পুরস্কার , উল্টোরথ পুরস্কার এবং যাদবপুর ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি.লিট্ পান ।
পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে ১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয় ।'
প্রচ্ছদে আর বিপণনে ফলাও করে কাজী নজরুল বিষয়ক স্মৃতিগদ্য বলা হলেও আদতে "কেউ ভোলে না কেউ ভোলে" শৈলজানন্দের বেড়ে ওঠার গল্প। এ গল্পে নজরুল আছেন, ভালোভাবেই আছেন কিন্তু পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। এ নজরুল দুরন্ত, উদাসীন, বেপরোয়া, বন্ধুবৎসল, অভিযানপ্রিয়। তার বন্ধু শৈলজানন্দ নিজে মুখচোরা হলেও তার গল্পও কম আকর্ষণীয় নয়। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নজরুলের সাথে সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে না পেরে মাতামহের বাড়ি থেকে পলায়ন ও বাবার কাছে থাকার অংশটুকু পড়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি। ছোট ছোট ঘটনায় তৎকালীন সমাজব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন - লেখকের সাথে নজরুল তার হোস্টেলে ছিলেন। রান্নার লোকেরা নজরুলের ধর্মপরিচয় জানতে পেরে তার এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকৃতি জানায়। বন্ধুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে নজরুল নিজেই হোস্টেল ছেড়ে দেন। বইটি তার কালের সাক্ষ্য বহন করছে বলে বহু পাঠকের অভিনিবেশ দাবি করে।
"কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে কেউ ভুলিতে গায় গীতি " - কাজী নজরুল ইসলাম
পশ্চিমবঙ্গ সরকার নজরুলকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করবে।শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ফরমায়েশ পেলেন সুহৃদ কাজীকে নিয়ে লেখা দিতে। শেষ মুহূর্তে শৈলজানন্দ লিখলেন না সরকারের জন্য ;লিখলেন "দেশ" পত্রিকার পাঠকদের জন্য। তবে সেই লেখা শুধু কাজীর ব্যাটাকে নিয়ে নয়। সেই লেখা তার নিজের বাল্য আর কৈশোরের কথাও বটে।কতশত স্মৃতিময় ঘটনার সবাইকে স্থান স্মৃতি দেয় না, কিন্তু যাঁদের দেয় তাঁদেরকে মনের মণিকোঠায় চিরঅম্লান করে রাখে।
শৈলজানন্দের সাথে কাজী নজরুলের পরিচয় ঘটে আসানসোলের রানীগঞ্জে। একই ক্লাসে পড়লেও নজরুল পড়তেন শিয়ারসোল রাজ স্কুলে। আর শৈলজানন্দ রানীগঞ্জ হাই স্কুলের ছাত্র। কাজী ব্যাটার নাম তখনো নজরুল নয়,দুখু মিয়া বলেই সব্বাই ডাকে এই চঞ্চলপ্রাণ কিশোরটিকে। শৈলজার নানার বাগানের পাশেই মুসলমান ছাত্রদের বোডিং। সেখানেই আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন নজরুল। পড়ার খরচ যোগানোর সামর্থ্য নেই নজরুলের, রাজ পরিবারের সামান্য বৃত্তিতে চলে পড়াশোনা, চলে খাওয়া খরচ। বন্ধু শৈল আর নজরুল হরিহর আত্মা। আলাদা স্কুলে পড়লেও সারাদিন একে-অপরের সান্নিধ্যেই কেটে যায়। নজরুলের পড়াশোনার চেয়ে রাত জেগে লেখার চেষ্টা আর ভেবে ভেবে দিন কাটাতেই ঢের আগ্রহ । আর তাতেই শৈলের মানা। বাধা দেয় নজরুলের পাচক ছিনু মিয়াও। এই কিশোর ছিনু মিয়ার সাথে বহুদিন পর দেখা হয় লেখকের।সহাস্য সেই ছিনু মিয়া এবার জীবনযুদ্ধে পরাজিত যোদ্ধা।
ছিনুর গল্প থাকুক। আমরা বরং শৈলজা আর নজরুলের কথা শুনি। নজরুলের ইংরেজ তাড়ানোর ভূত সেই স্কুলেই সওয়ার হয়েছিল। যার সপক্ষে বহু স্মৃতির সাহায্য নিয়েছেন। সেইসব স্মৃতির সত্যাসত্য নির্ণয়ের ভার বরং পাঠকের ওপর রইল। আমার তো বেশ থ্রিলিং লেগেছে।
শৈলজার মাতামহ রানীগঞ্জের প্রভাবশালী। আছে রায়বাদুর তথা রায়বাহাদুর খেতাবও। মা মরা শৈলের জীবনের গতিপথে এর ভূমিকা 'অ'সামান্য। প্রথম মহাযুদ্ধের জোশ এসে লাগে আসানসোলেও। ইংরেজদের থেকে যুদ্ধবিদ্যা শিখে তাদের তাড়াবেন-এই মন্ত্রে উজ্জীবিত নজরুল সিদ্ধান্ত নেন বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যাবেন। নজরুলের সাথে শৈলজাও ঠিক করেন, যাবেনই যু্দ্ধে। কিন্তু শৈলর হল না, হল নজরুলের। নজরুলের সেনাজীবন নিয়ে কিঞ্চিত লিখে পাঠাতেন বন্ধু শৈলকে। আর সেনাবাহিনীতে থাকবার সময়ই নজরুল লেখা পাঠান কমরেড মুজাফফর আহমদের কাছে। সেই থেকে নজরুলের সাথে বাধা পড়লেন মুজাফফর আহমদ। শৈলজার মতে, পল্টন থেকে ফেরার পর আশ্রয়প্রত্যাশী নজরুলকে নিরাশ করেন নি এই কমরেড।
শৈলজানন্দের নজরুল বিষয়ক কথকথা এখানেই শেষ। কিন্তু শেষ হইয়াও হইল না শেষ। নজরুল সেনাবাহিনীতে চলে গেল। শৈলজানন্দ যেতে পারলেন না। এরপর আর রানীগঞ্জে ফেরেন নি শৈলজানন্দ। তারপর ফিরে গিয়েছেন বাবার কাছে আসানসোলের আরো ভেতরে। পিতা সেখানে বিমাতাসহ থাকেন। বড্ড আমুদে আর পরোপকারী পিতার সান্নিধ্যে দারুণ সময়কে ভোলেন নি, যেমনটি ভোলেন নি যতীনকে, তার দিদিকে, রেলের গার্ডবাবুকে,শেকেল সাহেবকে। আর স্মৃতির পাতা হাতড়ে পাঠককে শোনাতে ভোলেন নি ইয়াছিন সাপুড়ের শিবানী কিংবা লাস্যময়ী নূরজাহানের প্রেমকাহিনী!
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় শুধু নজরুলকেই মনে রাখেননি,ভুলতে পারেন নি শৈশব আর কৈশোরের দুরন্ত সময়টার সঙ্গী কতশত মানুষকে।
শৈলজানন্দের সুন্দরতম বর্ণনার মহিমায় যেন মনে হচ্ছিল সবকিছু চোখের সামনে ঘটে চলছে। আর হ্যা,একে শুধু নজরুল জীবনী ভাববেন না। এটি শৈলজানন্দের আত্মকথা বৈ কিছু নয়।
কাজী নজরুল ইসলামের শৈশবের বন্ধু ও নিজ সময়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখা স্মৃতিকথন উক্ত গ্রন্থ। শৈলজানন্দের পরিচয় শুধু নজরুলের বন্ধু এমনটা নয়, তিনি খনিজ শ্রমিক নিয়ে সার্থক বাংলা গল্পের পথিকৃৎ। কিন্তু শৈলজানন্দের জীবন, তাঁর অতি বিখ্যাত কবি নজরুল ইসলাম থেকে আলাদা করার উপায় নেই। তাঁরা ছিলেন যাকে বলে হরিহর আত্মা। শৈলজানন্দের স্মৃতিকথায় নজরুলের উপস্থিতি কোন কোন সময় তাঁর নিজের থেকে বেশি প্রকট। শৈলজানন্দের মায়াময় স্মৃতিগদ্যে উঠে এসেছে কিশোর নজরুলের অসাধারণ এক প্রতিচ্ছবি; চিরবিস্ময়, চঞ্চল আর দুর্দমনীয় কিশোর নজরুল চোখের সামনে হাসছে, ছুটছে আর খেলনা বন্দুক দিয়ে ইংরেজ মারবার প্র্যাকটিস করছে!
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় অক্ষরে অক্ষরে যেন স্মৃতির এক চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন! একটা বিশেষ সময়; সেই সময়ের কিছু মানুষের জীবন, স্মৃতি,আবেগ, অনুভব জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। যাপিত জীবন আর সময় সবাই ভুলে গেলেও কেউ কেউ ভোলেনা। তুলে রাখেন স্মৃতিপটে সযত্নে, কাগজের সাদা পাড়ে অক্ষরের নকশিকাঁথায় বুনে রাখেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
এই বইয়ের সন্ধান পাই লেখক এনামুল রেজা ভাইয়ের ফেসবুক পোস্ট থেকে। নজরুল নিয়ে লেখা খুব বেশি পড়া হয় নাই, রবি সাহেবের "আমারে দেব না ভুলিতে" বইটা পড়ে যুবক বয়সের বেশ কিছু কাহিনী জানার সুযোগ হইছিল। তাই ভাবলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বইটা পড়েই দেখি।
বাতিঘরে তাই স্টকের অপেক্ষা করতেছিলাম। যখনই স্টকে আসল তখনই দৌঁড়ে বাতিঘর হাজির হলাম। কিন্তু বইয়ের সাইজ দেখে বিশাল হতাশ হলাম। ভেবেছিলাম, ঢাউস সাইজের বই হবে কিন্তু দেখি ক্রাউন সাইজের বই।
তবে, কেনা এবং পড়ার সিদ্ধান্তটা যে ভাল ছিল তা নিয়ে আসলে কোন সন্দেহ নাই। নজরুলের সাথে কিশোর বয়সের স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক। তবে স্মৃতিকথা শুধু নজরুল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, নিজের ম্যাজিশিয়ান সাপপ্রেমী বাবা, মাতামহ, যতীন কিংবা যতীনের বড়দিদি অরুণা ঘোষ - অনেকেই উঠে এসেছেন।
শৈলজানন্দের সুমিষ্ট লেখনী তে এক নিমিষে পড়ে ফেলেছি বইখানা। জীবন তখন সুন্দর ই ছিল বটে। মানু্ষের জীবনের চেয়ে নাটকীয় কিইবা আছে!
অনেকদিন আগে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের “বদলি মঞ্জুর” নামে একটি ছোট গল্প পড়েছিলাম। করুণ সেই গল্পটি মনে দাগ কেটেছিল। এরপর তাঁর আরো কয়েকটি ছোটগল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কল্লোল যুগের প্রতিনিধি এই সাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র পরিচালকের আর কোন গল্প কিংবা উপন্যাস পড়া হয়নি। দেখা হয়নি তাঁর কোন চলচ্চিত্র। সেদিন বইয়ের দোকান গুলিতে ঢুঁ মারতে মারতে হঠাৎ দৃষ্টি চলে গেল তাঁর নামাঙ্কিত একটি বইয়ের দিকে।
বইয়ের শিরোনাম “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে”।
শৈলজা যে কাজী নজরুল ইসলামের বাল্যসখা ছিলেন এই তথ্যটি অজানা ছিলনা। নজরুলের গানের লাইন এবং শৈলজানন্দের নাম দুইয়ে মিলে কিঞ্চিৎ আগ্রহের সৃষ্টি হল। বইটি তাক থেকে নামিয়ে দেখি নজরুলেরই ছবি অঙ্কিত প্রচ্ছদে। পাতা উল্টে উৎসর্গপত্রটি পড়ে মন ভিজে গেল- “আমার সৌভাগ্য, আমি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে পেয়েছিলাম এমন একটি মানুষকে, ঠিক যেরকম মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। কবি নজরুল ইসলাম সেই বিরলসংখ্যক মানুষের মধ্যে একজন। অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র। অজস্র প্রাণপ্রাচুর্য, অবিশ্বাস্য রকমের হৃদয়ের উদারতা, বিদ্বেষ কালিমামুক্ত, অপাপবিদ্ধ একটি পবিত্র মন, আর নিরাসক্ত সন্ন্যাসীর মতো একটি আপনভোলা প্রকৃতি। আমার সৌভাগ্য, আমিই তার একমাত্র বন্ধু যার কাছে তার জীবনের গোপনতম কথাটি পর্যন্ত সে অকপটে প্রকাশ করেছে। আমার দুর্ভাগ্য, আমার সেই পরমতম বন্ধুর জীবনের মধ্যাহ্নবেলায় ভাগ্যের নিষ্ঠুর একটি মসীকৃষ্ণ যবনিকা নেমে এলো তার মানসলোকে। আমার এ দুর্ভাগ্যের দুঃখ কেউ যদি বোঝে তো বুঝবে মাত্র একজন-যার দুঃখ-দুর্ভাগ্যের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই।
সেই পরম সৌভাগ্যবতী এবং চরম অভাগিনী কবি-প্রিয়া শ্রীমতি প্রমীলার হাতে এই বইখানি তুলে দিলাম”।
এ বই যতদিনে প্রকাশিত হয়েছে ততদিনে নজরুলের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। থেমে গেছে সদাচঞ্চল প্রাণোচ্ছল কবির সকল উচ্ছলতা। বাকশক্তিরহিত নজরুলের জীবন সুধা নিঃশেষপ্রায়। কি করুণ আর যন্ত্রণাময় সেই জীবন! তবে এই বই নজরুলের সেই দুর্ভাগ্য কণ্টকিত দিনগুলি নিয়ে নয়। এই বই নজরুল আর শৈলজানন্দের শৈশব, কৈশোর আর প্রথম তারুণ্যের সেই আনন্দময় আলোকিত দিনগুলি নিয়ে। যে দিনগুলি নিয়ে অনেক অনেক দিন পর পক্ককেশ আর দন্তহীন মাড়ি নিয়েও অস্পষ্ট স্বরে বলা যায় “আহা কি সুখের দিন ছিল”।
রাণীগঞ্জের রায়সাহেবের ফুলবাগানের পাশে ছোট্ট মাটির ঘর। খড়ে ছাওয়া সে ঘরের নাম ‘মহামেডান বোর্ডিং’। “পাঁচটি মুসলমানের ছেলে বাস করে এখানে। সেই পাঁচটি ছেলের ভেতর একটি হল-দুখু মিঞা। ভালো নাম-কাজি নজরুল ইসলাম।” রায় সাহেবের নাতি শৈলজানন্দের সাথে দুখু মিয়ার বন্ধুতার শুরু এই মহামেডান বোর্ডিঙের মাটির ঘরেই। ‘শিয়াড়শোল রাজার স্কুলে’ পড়ুয়া নজরুলের সাথে শৈলজার সেই আজীবন বন্ধুতার প্রারম্ভের গল্প মন কেমন করা স্নিগ্ধ ভাষায় পড়তে পড়তে যেন সেই সময়টাতে ফিরে গিয়েছিলাম নিমেষেই। বইয়ের প্রথম কয়েক পাতা উৎসর্গীকৃত ‘ছিনু’ নামের স্বাস্থ্যবান সুন্দর সদাহাস্যময় একটি চরিত্রের প্রতি। নজরুলকে বড় ভালোবাসত এই ছিনু। নজরুলের সব দৈনন্দিন কাজ বিনা দ্বিধায় করে দিত ছিনু। ছিনু সবাইকে হাসিয়ে মারতো। এই আনন্দময় কিশোরটির কথায় “মনের সকল অন্ধকার কেটে যেত”, “প্রাণ খুলে হেসে বাঁচতাম”- লিখেছেন শৈলজা। লেখক এই উচ্ছল কিশোরটিকে বহুদিন পর আবার খুঁজে পেয়েছিলেন এক জনাকীর্ণ রেলস্টেশনে। ততদিনে জীবনের কাছে হেরে যাওয়া দুঃখজর্জর এক শীর্ণ বৃদ্ধে পরিণত হয়েছে ছিনু। রেলের কম ভাড়ার টিকিট কিনতে গিয়ে মার খাওয়া সেই বৃদ্ধের ভেতর আনন্দোচ্ছল প্রাণবন্ত সেই ছিনুকে খুঁজে পেলেন না শৈলজা। ছিনুর শেষ কথাটি বুকে বড় বাজে-“তোমাকে দেরি করিয়ে দিলাম মিঞা সাহেব। আর ক’দিনই বা বাঁচবো। তবু যাবার আগে একবার দেখা হল...” এরপর শৈলজা এবং নজরুলের সেই মাটি মাখা শৈশবের বয়ে যাওয়া দিনগুলিতে ঘটে যাওয়া বিচিত্র সব ঘটনা মায়াময় ভাষায় আমাদের সামনে এসে হাজির হয় লেখকের কলমে। চঞ্চল দুটি কিশোর কখনো ট্রেনে কাটা পড়া সাঁওতাল মেয়েকে দেখতে গিয়ে পথহারা ইংরেজ পরিবারকে পথ দেখান, কখনো গরিব ইংরেজ শেকার সাহেবের কাছে ইংরেজি শিখতে গিয়ে সঞ্চয় করেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দুগগা আর মোতির মা নামের দুটি উজ্জ্বল চরিত্রের সাথে পরিচয় হয় এই সময়েই। একবার স্কুলে ছোট্ট একটি চড়ুই ছানা পড়ে গেল বাসা থেকে। নজরুল কাঁধে করে মই বয়ে এনে বাচ্চাটিকে তুলে রাখলেন তাঁর বাসায়। এই চড়ুই ছানাটিকে নিয়ে শৈলজানন্দ লিখলেন একটি কবিতা আর নজরুল লিখলেন একটি কথিকা( শৈলজানন্দের মতে বর্তমানের গদ্য কবিতা)। প্রিয় বন্ধুর লেখা সেই কথিকা খানি সযত্নে তুলে রেখেছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। পঞ্চু নামের সেই বড়লোক বন্ধুটি, যার ঐশ্বর্যের সীমা নেই। পঞ্চুর আছে গাদা গাদা ডিটেকটিভ নভেল, টিনের বাক্সো ভর্তি বিলেতি বিস্কুট, ঘরভর্তি পঞ্চম জর্জ, সপ্তম এডোয়ার্ড আরো কত লাট বেলাটের ছবি! সর্বোপরি পঞ্চুর ছিল নজরুলের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু একটি বিলেতি এয়ারগান। পঞ্চুর সেই এয়ারগানটি নিয়ে কিশোর নজরুল প্রতিনিয়ত পরখ করে চলেন হাতের টিপ। পেঁপে কিংবা ইটের দেয়ালকে ইংরেজ বানিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে থাকেন নজরুল। সেসবের নিত্য সঙ্গী প্রিয় বন্ধু শৈল। দুজনের জীবনেই ঘটে যায় আরো কত কত বিচিত্র সব ঘটনা। এর মাঝেই কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে উত্তীর্ণ দুই বন্ধু ঘর ছাড়ার পণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে তখন। প্রতিদিন ট্রেন ভর্তি করে বাঙালি ছেলেরা যুদ্ধ করতে যাচ্ছে বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে। নজরুল একদিন এমনি একটি সৈনিক ভর্তি ট্রেন দেখিয়ে শৈলকে বললেন-“যাবে?”। শৈল এক মুহূর্ত দেরি না করে বল্লেন-“ হ্যাঁ যাবো”। নজরুল ইংরেজের উপর মোটেও প্রসন্ন নন, রাজভক্তি একদমই নেই। শৈল তাই নজরুলকে জিজ্ঞেস করলেন কেন যাচ্ছো যুদ্ধে? নজরুল উত্তর দিলেন-“যুদ্ধ একটা বিদ্যে জান তো, সেই বিদ্যেটা আমরা শিখে নেব”। নজরুল যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসে বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করে দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াবেন এই মতলবের কথা বন্ধুকে বলেছিলেন। আর শৈল যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন শুধুই প্রিয় বন্ধুর সঙ্গ সুখ লাভের আশায়। কিন্তু বিধিবাম! যুদ্ধে যাবার জন্য নজরুলের বুকের ছাতি যথেষ্ট চওড়া হলেও শৈলজার বুকের ছাতি নাকি তা নয়! বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, অপমান ক্ষোভে বিহ্বল শৈলজানন্দের দুঃখে পাঠক আমিও বিচলিত হয়ে উঠি। এর পরের গল্পটুকু মূলত শৈলজার। নজরুল চলে যাবার পর বন্ধুহীন শৈল একদিন অচেনা নির্জন পথ ধরে চলে যান তাঁর বাউন্ডুলে বাবার কাছে। সেই বাবা থাকেন শাল বনের প্রান্তরে, শেয়ালের ডাক আর সাঁওতালদের মাদলের আওয়াজে মুখর, মহুয়ার গন্ধে মাতাল একটি গ্রামে। শৈলজার বাবা পথে প্রান্তরে, বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ান, সাপ ধরেন, বিনা পয়সায় লোকের চিকিৎসা করেন, জাদু দেখিয়ে বেড়ান। বহুবর্ণিল বিচিত্র সেই বাবার সাথে মৃত্তিকার সন্নিধানে কিছুদিন কেটে যায় শৈলজার। এর ভেতরেও নজরুল আছেন। শৈল এবং নজরুল চিঠি লিখতে থাকেন একে অপরকে। তারপর একদিন শৈলজা সেই মৃন্ময় আশ্রয় ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন, আর বাঙালি পল্টন ভেঙে গেলে হাবিলদার নজরুলও ফিরে এলেন। ফিরে এলেন বন্ধুর কাছেই। সদ্যযুবা দুই বন্ধুর আবার একসাথে পথ চলার শুরু এখান থেকেই। প্রিয় সখা নজরুলকে নিয়ে শৈলজানন্দের রেখাচিত্রের সমাপ্তিও এইখানে। এই বই প্রিয় বন্ধুর প্রতি নিষ্কলুষ ভালবাসার প্রতিচ্ছবি, অসাধারণ দুটি মানুষের শৈশবের অলোকিত আখ্যান। শৈশব, কৈশোর আর সদ্য তারুণ্যের রঙিন দিনের কথকতা শৈলজার মায়াময় ভাষায় পড়তে পড়তে আবেগাকুল হয়েছি বারবার। এমন বই বারবার পড়া যায়, এমন বই মনে যে রেখা অঙ্কন করে তা মুছে যায় না দীর্ঘদিনেও।
শিয়াড়শোলে শৈলজানন্দের সাথে কবি নজরুলের পরিচয��। তাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন বইটিতে শৈলজানন্দ। বলেছেন নিজের ও পরিচিত মানুষের অজানা কিছু কথা। দ্বিতীয় বারের মতো সেসব স্মৃতিকথা পড়লাম। নজরুলের কৈশোর ও তারুণ্যের উদ্দীপনা এই বইয়ে ভালো করেই ফুটে উঠেছে।
চঞ্চল, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, উদাসীন, বন্ধুবৎসল— দুই বন্ধুর বেড়ে ওঠার মিষ্টি অথচ বিষণ্ণ গল্প। একইসাথে শৈলজানন্দের আত্মজীবনী এবং কাজী নজরুলের জীবনী গ্রন্থ বলতে পারি এই বইকে। দুই বন্ধুর স্কুল জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন লেখক। যেখানে নজরুলের কবি হওয়ার সূচনা দেখতে পাওয়া যায়।
নজরুলের স্কুল জীবনে কবিতা ও গল্প লেখা, যুদ্ধে যাওয়া, এবং শৈলজানন্দের জীবনের কিছু মিষ্টি অথচ বিষণ্ণ গল্পে ভরপুর বইটা। যতীনের দিদি, সাপুরের স্ত্রী, লেখকের বাবা, দুগগার—জীবনের গল্পগুলোর মধ্যে মাদকতা আছে। মানুষের জীবনের গল্পগুলো এতো বিষণ্ণ হতে পারে! জীবন বড়ই বেদনার। আর মানুষ বড়ই আশ্চর্যের প্রাণী। কত অদ্ভুত রকম তাদের কৌতূহল, কী প্রবল তাদের আবেগ।
"প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বোধকরি এমন একটা সময় আসে, যখন যা কিছু সে দেখে, শুধু চোখ দিয়ে দেখে না, মন দিয়ে দেখে, তাই মন তাকে আর ভুলতে পারে না সারা জীবনেও। সে সময়টা মানুষের কৈশোর। তাই বোধহয় ইস্কুলের সহপাঠীদের আমরা ভুলতে পারি না। কিন্তু কলেজের বন্ধুদের ভুলে যাই।"
নজরুলের জীবনীগ্রন্থ নয় বরং দুই বন্ধুর বাল্যকালের বিচ্ছিন্ন কিছু করুণ অথচ নস্টালজিক জীবন গল্প পড়তে চাইলে নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন। বইটা পড়ে আশা করি আপনার মন অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে ওঠবে। আর দীর্ঘশ্বাসগুলো আরেকটু দীর্ঘ হবে; শ্বাসকষ্টও হতে পারে। জীবন বড়ই বেদনার।
বেশ লাগলো বইটি। কাজী নজরুলের বাল্য ও তরুণ জীবনের বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল। লেখকের জীবনটাও প্রতিভাত হোল আমাদের সামনে। আর সব চেয়ে বড় পাওনা, বইটি খুব দরদ দিয়ে লেখা। অসামান্য এক বন্ধুত্বের গাথা বইটি।
সঙ্গে পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে দিনু, অবনী, যতীন এরাও দাগ কেটে যায়। ভালো লাগে লেখকের বাবাকেও। আর সবচেয়ে অবাক করে দেয় যতীনের দিদি - লেডি অরুণা ঘোষ। সব মিলিয়ে বেশ ভালো লেগেছে বইটি।
এই বইয়ের কথা অনেকআগে থেকেই জেনেছিলাম। নজরুল বিষয়ক কোন বই পড়তে গেলেই এই বইয়ের নাম রেফারেন্স হিসেবে পাওয়া যায়। সেই হিসেবেই বই পড়া শুরু , ভেবেছিলাম নজরুলকে নিয়েই বেশী কথা হবে। কিন্তু কিছুটা পড়ার পর দেখা গেলো লেখক নজরুলকে নিয়ে নয়, নিজের স্মৃতিকথা লেখছেন। লেখক নিজের মত করে নির্মোহ ভাবে সবার কথা বলে গেলেন। নজরুলকে মহাকবি নয় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবেই পেলাম এখানে। অতিরঞ্জিত বিশেষণের বালাই নেই। লেখকের লেখনীর প্রেমে পরে যেতে হয়। খুবই ভালো একটা স্মৃতিকথা বলা যেতে পারে।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম'কে নিয়ে একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহলের লেখা, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় নিজের বয়ানে অনেক না বলা কথা বলে গেলেন। এতোটা সংবেদনশীল সময়ের চিত্র তুলে ধরা ও সহজ সরল লেখা আমোদে পড়া গেছে।
লেখার মাঝে হারিয়ে যাওয়া সময়কে গতিশীল করেছে। চোখের সামনে ধরা দিয়েছে সেই সময়ে বন্ধুত্বের নিবিড় আবহ। যুদ্ধের মাতম, পড়ালেখা চালিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে নিজেদের আপন ভূবণের সন্ধান পাওয়ার অনিঃশেষ চেষ্টা।
কাকতালীয়ভাবে, সপ্তাহ দুয়েক আগে রাসেল ভাই কিনে দিয়েছিলেন বইটা। ব্যাটম্যান চরিত্রের ইতিহাস পড়তে পড়তে যখন ভালো লাগছিলো না, হঠাত মনে হলো- নজরুলের প্রয়াণ দিবসে তাকে নিয়েই পড়ি না কেন?....
ছোটো আকারের বই। বাল্যবন্ধুর স্মৃতিতে দুখু মিয়া। লেখক নিজেও সেই স্মৃতির বড় একটা অংশ স্বভাবতই। তবু বইটা কৈশোরের মতো মিষ্টি।