আবুল হায়াতের ডাক নাম রবি জানতাম না। জানার অবশ্য কথাও না। আত্মজীবনী যখন বের হলো আর বইয়ের নাম রবিপথ দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পড়ার পর বুঝলাম রবি নামটা কেন।
ভদ্রলোক যেমন সুন্দর অভিনয় করেন ঠিক তেমনি তার লেখাও। ঝরঝরে, একটানা পড়ে ফেলা যায়। রবিপথ যদিও বয়সের দোষে দুষ্ট মানে, ঘটনার সিরিয়ালে একটু ঝামেলা আছে মানে আরেকটু অর্গানাইজড হলে ভালো হত। সেক্ষেত্রে আমি দোষ দেব প্রকাশনা সংস্থাকে। আরও ভালো করে এডিট করলে আরও বেশি সুন্দর হতো। আর যদি কিছু ছবিও থাকতো...
সেই দেশ ভাগের সময় বাবা মায়ের হাত ধরে পাকিস্তানে থিতু হওয়া, বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম, পড়াশোনা চাকরি আর অতি অবশ্যই অভিনয়ের সুবাদে ঢাকায় থেকে যাওয়া আবার কাজের জন্য বিদেশ গমন... এই যে একটা গোটা জীবন.. পুরো জীবনটায় এক ঝলক উঁকি দিয়ে আসা বইয়ের মাধ্যমে। আবুল হায়াতের কাছে প্রত্যাশা রইলো অভিনয়, নাট্যগোষ্ঠী নাগরিক, তার মঞ্চ এবং প্যাকেজ নাটকের সময়কাল বা আড্ডা এসব কিছু নিয়ে আরও বিশদে যেন কিছু লেখেন। আসলে সবাই বিটিভির ৮০/৯০ দশকের নাটক/অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন কিন্তু কেন করেন.. সেটা তখনকার নাটক/অনুষ্ঠান লেখক, পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা এদের কারণে কিছুটা বোঝা যায়। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি মঞ্চ থেকে ভিত গড়ে উঠা, এছাড়া প্রচুর বাইরের পড়াশোনা... এরকম একেকজন মানুষ তখন সেই সেক্টরে ছিল বলেই তখন এতো উন্নতি করেছে। ভাল্লাগসে খুব।
খন্দকার মোহাম্মদ শামসুল আরেফীন আবুল হায়াত গোলাম মাহবুব ওরফে আবুল হায়াত ওরফে রবির দাদাবাড়ি ও নানাবাড়ি দুটাই মুর্শিদাবাদে। উনার দাদী আর নানী ছিলেন আপন বোন। রবি মানে আবুল হায়াত সাহেবের বাবা চাকরি করতেন রেলওয়েতে। '৪৭ এর দেশভাগের সময়ে সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানে থাকবেন। চট্টগ্রামের রেলওয়ে অফিসে উনার পোস্টিং হয়। সেখানে অবারিত প্রকৃতি, চারবোনের একভাই আদরের মধ্যমনি হয়ে বেড়ে উঠেন তিনি।
স্কুল, কলেজ, বুয়েটে পড়া, ওয়াসায় জব করা, অভিনয়, ক্যান্সারে বাবার মৃত্যু, বিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ, বিপাশা-নাতাশার জন্ম, মায়ের মৃত্যু, বোন জামাইয়ের মৃত্যু, তিন বছর লিবিয়ায় চাকরি করা, আলী যাকেরের সাথে মনোমালিন্য, ইত্যাকার অনেক কিছু নিয়ে লিখেছেন। অভিনেতা হিসেবে তিনি চেনাজানা চেহারা হওয়ায় পড়তে বেস ভালো লেগেছে। আর বলতেই হবে উনার গদ্য সুন্দর।
কিন্তু অনেক গ্যাপ দিয়ে দিয়ে আত্মজীবনীটা লিখেছেন বলে হয়তো খেই হারিয়ে একই কথা বারবার লিখে ফেলেছেন। এক জায়গায় বলছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি মরণাপন্ন রুগি ছিলেন তা আগে বলেছেন কিন্তু আগের চ্যাপ্টারে আসলে এই বিষয়ে কিছু বলেন নি। এই বিষয়টা এসেছে আরো কয়েক চ্যাপ্টার পরে। আবার আরেক জায়গায় লিখেছেন অমুক বিষয়ে পরবর্তীতে লিখবো কিন্তু ঐ বিষয়টা আসলে তিনি আগের চ্যাপ্টারেই লিখে ফেলেছেন। সাল হিসাব করে টাইম টেবিল মেইনটেইন করলে ভালো হতো। আশির দশকে লিবিয়ায় জব করে ফিরে আসার পরে লিখলেন '৭১ নিয়ে আবার বিপাশার বিয়ের কথা বলে চলে গেলেন নিজের ছেলেবেলার কথায়। এইরকম এক দুবার না বহু বহুবার ঘটেছে। এরকম লেখা পড়তে আমার এলোমেলো লাগে।
উনি বয়স্ক মানুষ এসব গন্ডগোল হতেই পারে। কিন্তু প্রকাশনীর দায়িত্ব ছিলো এগুলো ঠিক করা। তিনি যা লিখেছেন তাই ছাপিয়ে দিয়ে কাজ শেষ করা উচিত হয়নি। পান্ডুলিপিটা সম্পাদকের হাতে পরা উচিত ছিলো। হায়াত সাহেবের সাথে কথা বলে বলে এইসব রিপিটেশনগুলো বাদ দিতে পারতেন উনারা। তাহলে চমৎকার উপভোগ্য একটা আত্মজীবনী হয়ে উঠতো বইটা।
বইয়ের শুরুটা খুবই সুন্দর হলেও রিপিটেশনের কারনে এক সময়ে পাঠক হিসেবে বোর লাগে। তবে হ্যা প্রডাকশন হিসেবে বইটা দারুন হয়েছে। পেপারব্যাক ও হার্ডব্যাক বের হয়েছে। আমি পেপারব্যাক নিয়েছি বাধাই, প্রিন্ট সব মিলিয়ে কোয়ালিটি খুবই ভালো।
বিখ্যাত মানুষের জীবনি আমার পড়তে সবসময় ভালো লাগে। রবি পথ বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াতের লেখা তার নিজের জীবন নিয়ে। বইটা অন্য সব বাইয়োগ্রাফির মত না। এইটা হলা চলে উনার জীবনের কিছু ঘটনা উনিন লিখেছেন। বইটা সুন্দর একটা দিক হচ্ছে প্রতিটি চ্যাপ্টারের নাম হয় কোন গানের কলি বা কবিতার লাইন দিয়ে, এইটা চমৎকার লেগেছে। লেখক বইটা ১০ বছর সময় নিয়ে লিখেছেন, মাঝে অনেক দিন বিরতি ছিলো এর পরে আবার শুরু, আমার কাছে মনে হয় এই গ্যাপের জন্য লেখা গুলো একটু ছাড়াছাড়া আর অনেক ঘটনার পুনারবিত্তি হয়েছে। সব নিয়ে সুন্দর বই।