বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক এমন একজন যিনি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় দোর্দণ্ড প্রতাপে বিচরণ করেছেন। কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ এমনকি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও সৈয়দ হককে ছাড়া বাংলা সাহিত্য যেন অনুজ্জ্বল। ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ঐতিহাসিক উপন্যাস ।
Syed Shamsul Haque (Bangla: সৈয়দ শামসুল হক) was a Bangladeshi poet and writer. Haq lived alternately in Dhaka and London. He wrote poetry, fiction, plays - mostly in verse and essays. He, the youngest writer to be honored with Bangla Academy Award, achieved it at the age of 29. He was honored with Ekushey Podok in 1984.
(সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মেছিলেন। বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান সৈয়দ হক। এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি।
সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।
সেই বছরই বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ করেন পরিচালকের সহকারী হিসেবে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি। পুরোপুরি মনোযোগ দেন লেখালেখিতে।
১৯৫০-এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।
সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।
বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাট্য। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।)
ঠিক কী কী গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো উপন্যাসকে "মহাকাব্যিক উপন্যাস" বলা যায় তা নিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও বিভিন্ন উপন্যাসকে মহাকাব্যের সাথে তুলনা করে মহাকাব্যিক উপন্যাসের খ্যাতি দেওয়া হয়। লেখনশৈলী, বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং কাহিনির ব্যাপ্তি বিবেচনায় নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের 'বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ' মহাকাব্যিক উপন্যাসের কাতারে নাম লেখাতে পেরেছে কি না তা ভিন্ন আলোচনা।
বইয়ের প্রথমার্ধের লেখনী, বর্ণনাভঙ্গি কাব্যিক ঢংয়ের; নেশা লাগার মতো, যেন স্বপ্ন ও বাস্তবের মাঝামাঝি পথে এগিয়ে চলা, অনেকটা শরতের মেঘকে হাওয়াই মিঠাই মনে করে মুখে পোরার মতো। তবে পুরো লেখায় নেশাটা ধরে রাখতে পারেননি লেখক। গল্পের মাঝ বরাবর গিয়ে সুর কেটে গেছে, জাদুকরী গল্প কথন একঘেয়ে, একমুখী হয়ে উঠেছে অনেকটা।
নিখাঁদ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস মনে করলে বইটাকে মিসজাজ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে যতটা তার আছে বেশি আছে কিংবদন্তী, সামাজিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, কুসংস্কার, প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। আছে সামষ্টিক স্বার্থের বিপরীতে ব্যক্তিস্বার্থকে জিইয়ে রাখা চিরাচরিত গল্প।
তরুণ কলেজ শিক্ষক মহিউদ্দিন ও তার নেতৃত্বে চলা ছোট গেরিলা দলটি কাহিনির মূলে থাকলেও মহিউদ্দিনকে ঠিক প্রধান চরিত্র বলা যায় না, যেমনটা বলা যায় না ত্রিভুজ প্রেমের কেন্দ্রে থাকা নায়িকা ফুলকি'র ক্ষেত্রেও। গল্পের মূল চরিত্র অতীত ও বর্তমান সময়, এবং এ দুই সময়ে টিকে থাকা মানুষের জীবনধারার রীতিনীতি, বিশ্বাস অবিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি।
বইয়ের ব্যাপ্তি প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার হলেও শেষদিকে তাড়াহুড়ার ছাপ স্পষ্ট এবং সেটা সুখকর নয় যদিও।।
"যুদ্ধ অনেক রকম, এ কথা আমরা ভুলে যাই। যুদ্ধ: নিজের সঙ্গে যুদ্ধ; প্রথা ও প্রচলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ; বিজ্ঞান-যুক্তি-ইতিহাস-সত্যের পক্ষে যুদ্ধ- এবং এ যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রয়োজনে নিজের পিতা ও পরিবারের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ; মনে মনে যুদ্ধ, যে আমি লড়াই করতে অপারগ কিন্তু শত প্রলোভনের সমুখেও বিশ্বাসকে আমি রাখছি অটল; অস্ত্র হাতে যুদ্ধ; শব্দ ও শিল্পকে আয়ুধ করে যুদ্ধ; প্রত্যক্ষ যুদ্ধ না করেও যারা যুদ্ধ করছে তাদের বিজয়ের পরে ধ্বংসস্তুপের ওপর সৌধ নির্মাণের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখবার যুদ্ধ; এবং ভবিষ্যতের জন্যে আমাকে এই নশ্বর দেহেই ও আমার করোটিতে অবিনশ্বর স্বপ্নকেই অনাগত সন্তানদের জন্যে বাঁচিয়ে রাখবার নিভৃত নি:সঙ্গ যুদ্ধ।" এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো খুব বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হলেও এতে উঠে এসেছে একটা সামগ্রিক চিত্র। জলেশ্বরীর আড়ালে লেখক এঁকেছেন গোটা বাংলাকেই। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলছে একদিকে, চলছে অত্যাচার, প্রতিরোধ, বিশ্বাসঘাতকতা আর ধ্বংসলীলা কিন্তু অপরদিকে ওই সময়ে কেবল মুক্তিযুদ্ধই কি সত্যি হয়ে ছিল? মানুষের স্বাভাবিক জীবন কি স্থবির হয়ে গিয়েছিল পুরোপুরি? মানুষ কি কেবল যুদ্ধের কথাই ভাবত দিনরাত? বিষয়গুলো আসলে এত সরল নয়। উপন্যাসের নায়ক সৈয়দ বংশের ছেলে মহিউদ্দিন। সে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, কিন্তু তার রয়েছে একটা একান্ত ব্যক্তিগত জীবন৷ সে তার চাচাতো বোন ফুলকিকে ভালোবাসে। সেই বংশের কাহিনী উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই। একটা পরিবারেই পারিবারিক রাজনীতির উত্থান পতন চলতে থাকে একটা মাজারকে ঘিরে। পরিবারের প্রথম বিদ্রোহী ছিলেন সৈয়দ জালালুদ্দিন। তাঁর প্রথাবিরোধী প্রশ্ন, প্রেম, নীতি সমস্তই নিয়ে এসেছিল বিদ্রোহের বার্তা। অনেক বছর পর মহিউদ্দিন ও, এমনকি ফুলকিও কিন্তু বিদ্রোহেরই প্রতীক। প্রেম ভালোবাসার এই দোদুল্যমানতা ছাড়াও এসেছে বাংলার একাংশের মানসিক অবস্থার বর্ণনা। যুদ্ধটাকে কে কীভাবে দেখছে, কীভাবে ফুলকির মতো নিরীহ একটা নামকে বাংলা বলেই হিন্দুয়ানি ট্যাগ দেয়া হচ্ছে, কীভাবে উচ্চশিক্ষাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, কীভাবে সাধারণ ম্যাজিককে মানুষ ভাবছে অলৌকিক কাণ্ড, কী পটভূমিতে যুদ্ধ বাঁধল, কোন রাজনৈতিক পন্থা কেমন মতবাদ ধারণ করত সেসময়, যুদ্ধের পরের অস্থির সময়ের কথা, ধীরে ধীরে উত্তরণের কথা, একই যুদ্ধ করছে এমন দুজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কথা, কেবল খাবারের ব্যবধানে জাতপাত নিয়ে অসহিষ্ণুতার কথা- আরো অনেক কিছু। সৈয়দ শামসুল হকের নিজের জীবন এবং বংশের কিছু ছায়াও আছে এই উপন্যাসে। এটি এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, কুসংস্কার, কালো মেঘ চিরে সূর্যের আলোর রেখা এমন সমস্ত কিছুই একটা বিরাট ক্যানভাসে ধরতে চেয়েছিলেন সব্যসাচী লেখক।
ঘটনা বা গল্পপ্রবাহে ও বাহুল্য দেখা দেয়। যেটা বর্জন করতে পারলে সেই গল্প বা উপন্যাস তার গায়ে থাকা দাগ মুছে মহাকাব্যের রুপ ধারণ করতে ও পারে। ঠিক তেমনি খুব ভালো হতে গিয়ে অনেকটা থমকে যাওয়া উপন্যাস এই বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ। আমার প্রিয় লেখক রবিশংকর ও মার্কেজের জাদুমাখা ছোঁয়া পেতে পেতে তাড়াহুড়ো তে থমকে পড়া শেষ অংশটুকু কিছুটা মলিন করে দেয় গল্পটাকে।
পীরের মাজার ঘিরে গড়ে উঠা উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল শহর জলেশ্বরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় জলেশ্বরী হাইস্কুলের মাঠে আস্তানা গেড়েছে পাকবাহিনী। আর বর্ষার প্রবল বর্ষণে জলেশ্বরীকে বিচ্ছিন্ন করে মরণকামড় দেওয়ার অপেক্ষায় একদল মুক্তিযোদ্ধা। এরমধ্যে মিলেমিশে যায় কিংবদন্তি, ইতিহাস, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা আর আত্মত্যাগ। সবমিলিয়ে সুখপাঠ্য অসাধারণ এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। শুধু শেষের দিকের তাড়াহুড়োটা না থাকলে পাঁচে পাঁচ দিতাম।
লেখক একঘেয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক মনোভাব পরিহার করতে পারলে গল্পটা বেশি প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে উঠতো সন্দেহ নেই।
তিনি 'বাকশাল' প্রতিষ্ঠাকে শেখ মুজিবের "সর্বোত্তম বিপ্লব" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ তেহাত্তরের জুয়াচুরির নির্বাচন, বাংলাদেশের ইতিহাসের বীভৎসতম দুঃস্বপ্ন—চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন সুকৌশলে। কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় আখ্যান টেনে আনায় বইয়ের কলেবর বেড়েছে, কিন্তু গল্পের শেষটায় তাড়াহুড়ো স্পষ্টত। সামগ্রিক বিবেচনায় "বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ" মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাসের এক প্রশংসনীয় সংযোজন!