‘আনবাড়ি’ বিচ্ছিন্নতার মহাসমুদ্রে ছোটো ছোটো আলোর বিন্দুর মতো বন্ধুত্ব খুঁজে পাওয়ার গল্প আবার ভিড়ের ভেতরে হাত ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাওয়ার গল্প। এটা সেই অভীষ্টের দিকে যাত্রার গল্প, যেখানে কখনোই আমরা পৌঁছাই না।
লুনা রুশদীর জন্ম ২৪ অক্টোবর, ১৯৭৫ সালে। শৈশব কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার্সে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে লেখাপড়া নবম শ্রেণী পর্যন্ত, তারপর ১৯৮৯ থেকে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। মেলবোর্নে লা-ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক, পরবর্তীতে বৃত্তি নিয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং এ স্নাতোকত্তর লেখাপড়া সিডনির ইউ.টি.এস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যাংকিং সেক্টরে চাকরি নিয়ে দশ বছর নিউজিল্যান্ড থাকার পর বর্তমানে আবার মেলবোর্নে। প্রথম বাংলাদেশি পত্রিকা ‘অঙ্কুর’ সম্পাদনা ছাত্রজীবনে। বাংলায় প্রথম প্রকাশিত কবিতা কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৯৪ সালে। এরপর বিভিন্ন বাংলাদেশি ও ভারতীয় পত্রিকায় লেখালেখি। প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি গল্প নিউজিল্যান্ডের ‘লিসেনার’ পত্রিকায় ২০১১ সালে। প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ অরুন্ধতি রায়ের ‘দ্যা ব্রোকেন রিপাব্লিক’ (২০১৩)। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘আর জনমে’ ২০২৪ সালের বইমেলায়। এবং দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বইবাহিক’ও ২০২৪-এর মেলাতেই প্রকাশ পায়।
আমরা সারাজীবন আসলে একটা ঘরের খোঁজেই এক পা দু পা করে হাঁটি। আমাদের একান্ত,নিজস্ব ঘর। ঘরের মেঝেতে,বিছানায়,আসবাবে পড়ে থাকবে আমাদের হাত ও পায়ের কসরত। স্মৃতি ও সময়ের অনন্ত আশ্রয়। তুচ্ছ দৈনন্দিনতার হাওয়ায় বেসামাল পর্দা ফুলে ফুলে উঠবে। সমস্তটা জীবন আমরা খুব করে খুঁজি সেই ঘর। পাই না,পৌঁছাতে পারি না। মনের মাঝে একবার পাবার ভ্রম তৈরি হলে যৌথ স্বপ্নের ভাঙনের অনুনাদে যৌথ ডানার আকাশ ভেঙে যায়। অথচ ভাঙনের আগে সারাজীবন হেঁটে হেঁটে আমরা একটা মুহূর্তের কাছেই পৌঁছাতে চাই।
‘আনবাড়ি’ উপন্যাসিকার পাতায় পাতায় গার্হস্থ্য জীবন ছাপিয়ে চড়া হয়েছে সেই ভাঙনের সুর। ওক কাঠের বইয়ের তাক,পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকা বিল ক্লিনটন নামের বিড়ালটা,বাদামি হয়ে আসা বাঁধাকপি,বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডা কিংবা দূরের জানালায় মার্কের ছায়া দেখতে দেখতে রিনা নামের মেয়েটার নির্জন বাস ওই ‘Alone with Everybody’– কেই ঘুরেফিরে টেনে আনে। বারবার মনে হয়, কথক রিনার মতোই যা কিছু আমি আঁকড়ে ধরতে যাই,মুঠো আলগা হয়ে যায়। এই বেরহমি দুনিয়ায় রিনাদের কাউকে দোষ দেয়ার সাধ্য হয় না। কিন্তু জীবন এমন... রাসেলের ছায়াও আমার কাছে চেনা চেনা লাগে। রিনারা দুঃখ লুকাতে পারে,রাসেলদেরও বোঝে। কিন্তু দিনশেষে উল্টে যাওয়া কচ্ছপের মতো অসহায় হতে হয় রিনাদের। আর আত্মার ভেতর ধাক্কা মারতে থাকে একটাই আওয়াজ... পরাজয়ে ভেঙে পড়বার আওয়াজ।
সহজ ভঙ্গিতে বলা বড্ড পরিচিত একটা গল্পের শেষ পাতা অবধি যেতে কেন এতো ভার চেপে বসলো ভেবে থই পেলাম না৷ নোয়াহ বোমবাখের সিনেমা নাকি অ্যানি আর্নোর ভীষণ ব্যক্তিগত জীবনের পদাবলী ঠিক কীসের সাথে তুলনা করবো আনবাড়িকে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও বেশ থতমত পরিস্থিতি। মেমোয়ার বলে তর্ক তোলা গেলেও ‘আনবাড়ি’ আদতে একটা উপন্যাসিকা। লুনা রুশদীর ডাইভার্সিফায়েড অটোবায়োগ্রাফি? খুব সম্ভব। ওয়েলিংটনে বর্ষাহত দিন, অকল্যান্ডে রাত হলেই জীবন্ত হয়ে ওঠা স্ট্রিপ ক্লাবের হোর্ডিং,অফিসের জানালার বাইরে অ্যান্টেনায় বসা গাঙচিল, লাল রঙের ছাতা,পায়া ভাঙা চেয়ার আর প্রবাস জীবনের প্রচণ্ড হোমসিকনেসের আদলে শব্দ-বর্ণ-গন্ধ নিয়ে মূর্ত হয়ে আছে ‘আনবাড়ি’। বিড়ালের নাম বিল ক্লিনটন দিয়ে কি মনিকা লিউনস্কির সাথে বিলের সম্পর্কের বিধ্বস্ত পরিণতির কথাই ইঙ্গিত করতে চাইলেন? কী জানি! ফাঁকে ফাঁকে গোজা মার্ক স্ট্র্যান্ডের মন কেমন করা কবিতাগুলো যেন আরো একটু মেলানকোলি ঢুকিয়েছে শিরায় শিরায়।
‘মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে আমি কেমন আছি, কিন্তু ঠিক ঠিক বুঝতে পারি না। বেশির ভাগ সময় খুব গাঢ় কোনো অনুভূতি কাজ করে না। হঠাৎ কিছুই ভালো লাগে না। সেসব সময় মনে হয় কোনোদিনই আর কিছু ভালো লাগবে না আমার, হয়তো প্রিয় সব কিছু পেরিয়ে এসেছি, ফেলে এসেছি বহু আগের কোনো সময়ে। এখন হয়তো অবিকল সেই রকম দেখতে কিছু জায়গা আছে, কিছু মানুষ আছে, সেই একই রকম শব্দ, গন্ধ, পারিপার্শ্বিক আছে তবু ঠিক সেই মানুষ সেই জায়গাগুলো কোথাও আর নেই। শুধু কিছু ছাপ, কিছু ছায়া রয়ে গেছে...’
একেকটা শহরে,একেকটা মানুষের জীবনে আমাদের ছাপ থেকে যায়। আর শহরটাও মিশে থাকে চেনা মানুষের মতো আমাদের গল্পে। এভাবে একেকটা বাড়ির ড্যাম্প হয়ে ফুলে যাওয়া দেয়ালে,জানালায়,কার্নিশে...পায়া ভাঙা টেবিলে,বারান্দায় আর নরম আলোয় আমাদের গল্প লেগে থাকে। স্লো মোশনে ঝাপসা হতে হতে পড়ে থাকে শুধু কান্নার ক্বাসিদা...
"মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে আমি কেমন আছি, কিন্তু ঠিক ঠিক বুঝতে পারি না। বেশির ভাগ সময় খুব গাঢ় কোনো অনুভূতি কাজ করে না। হঠাৎ কিছুই ভালো লাগে না। সেসব সময় মনে হয় কোনোদিনই আর কিছু ভালো লাগবে না আমার, হয়তো প্রিয় সব কিছু পেরিয়ে এসেছি, ফেলে এসেছি।। বহু আগের কোনো সময়ে। এখন হয়তো অবিকল সেই রকম দেখতে কিছু জায়গা আছে, কিছু মানুষ আছে, সেই একই রকম শব্দ, গন্ধ, পারিপার্শ্বিক আছে তবু ঠিক সেই মানুষ সেই জায়গাগুলো কোথাও আর নেই।শুধু কিছু ছাপ, কিছু ছায়া রয়ে গেছে..."
"আনবাড়ি" ঘর বা আশ্রয় অনুসন্ধানের গল্প, যা আমরা জীবনভর খুঁজে থাকি, যা আমরা কখনোই পাবো না। বরাবরের মতোই সহজ গদ্যে লিখেছেন লুনা রুশদী। নায়িকার জনতার মাঝে নির্জনতার বোধ আর নৈঃসঙ্গচেতনা কখনো পাঠক হিসেবে আমাকে আক্রান্ত করতে পেরেছে, কখনো পারেনি।বিষয়বস্তু চমৎকার, গল্পের execution কিছু জায়গায় আরোপিত বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে, বই পড়ার অনুভূতি মিশ্র।
'আনবাড়ি' লুনা রুশদীর ফিকশন মেমোয়ার। পয়লা চ্যাপ্টারেই একটা সেন্টিমেন্টাল প্যারাগ্রাফে হুট করে লুনা লিখলেন– "মাঝেমাঝে সমস্ত জীবন হেঁটে আমরা শুধু একটা মুহুর্তের কাছে পৌঁছাই।" পড়তে গিয়ে খুব চমকালাম। হয়তো ঐ বিশেষ মুহুর্তে আমি এখনও পৌঁছাই নাই কিন্তু খুব জোরে হাঁটতেসি।
কলোনিয়াল হ্যাংওভারে আক্রান্ত একজন বোকা পাঠিকা আর প্রচন্ড হোমসিক একজন লেখিকার কানেকশন হয়ে গেলো কী অনায়াসে!
আমার ভীষণ আরাম আদর লাগে লুনা রুশদী'র লেখা পড়তে। মানুষটাকে মায়াময়ী মনে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর পরিযায়ী জীবন, কিছু আনকোরা সম্পর্ক, কিছু এলোমেলো বিকাল, আর রেলিভেন্ট সব কবিতার পঙক্তি ছড়িয়ে আছে সমস্ত বইয়ে। পরিমিত এবং সাটল হিউমার। গল্প বলার ঢং পুরনো দিনের মানুষের মতো। বিচিত্র কিন্তু বিচ্ছিন্ন সব ঘটনা অল্প অল্প করে বলা হলো।
আমাদের জীবন; আসলে স্মৃতি আর স্বপ্নের মাঝামাঝি সময়টুকু। স্মৃতির পরিমাণ বোধহয় একটু বেশিই। ক্রিয়েটিভ রাইটিং পারলে নিজের জীবন নিয়া আনবাড়ি'র মতো একটা বই লেখার চেষ্টা করা যাইতো। তবে বইয়ের সাইজ আরো বাড়াতাম।
বইটার একমাত্র ঝামেলা হলো, এটা জনরা এক্সপেকটেশন পুরোপুরি মেটাতে পারে নাই। মেমোয়ার থেকে যেরকম ডিটেইলড ন্যারেশন আশা করেছি, সেরকম পেলাম না।
লুনা রুশদী আলসেমি করে হোক, বা অন্য কারণে, একটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বইপত্র লেখেন মনে হইতেসে। আরেকটু ঘষামাজা করলে বইটা গোছানো যেতো, আরো কিছু গল্পও বাদ পড়েছে মেইবি। লেখিকা কি একটু উদাসীন? হইতে পারে। কিংবা বইমেলার তাড়া ফিল করসিলেন?
যাই হোক, তাঁকে কোট কইরা তাঁর ডিফেন্স রেডি করলাম– "নিজের অজান্তেই মানুষকে আমরা কেমন বাক্সবন্দি করে ফেলি!"
"তখনো বৃষ্টি চলছিল আর সাথে ঝড়। বৃষ্টির গন্ধটা সব সময়েই চেনা লাগে, স্মৃতি মিশে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে সব স্মৃতি, চেনা গন্ধ, চেনা ছন্দ...এই সব কিছুর আগে কী ছিল? আমি প্রথম কবে বৃষ্টি দেখলাম? কতদিন আমার কোনো প্রথম নেই, এখন যে-কোনো নতুনই ফেলে আসা স্মৃতি বয়ে আনে।"
বা, রাসেলের সাথে কথপোকথনের এই অংশটুকু -
"ওর কথার ভঙ্গিতে অধিকারবোধ আর একটা ঘোর-লাগা ভাব ছিল । শুনছিলাম, যেন উপন্যাস, অন্য কারো গল্প আর একই সাথে নিজের জন্য একটা কান্না এঁকেবেঁকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল ।"
আবার ধরুন - "আমরা বিরাট এক পাজলের ছোটো ছোটো টুকরা মাত্র, একসাথে জোড়া লাগলে একটা সম্পূর্ণ ছবি হয়ে উঠতে পারব অথচ আমরা শুধু নিজেকেই সমগ্র ভেবে নিয়ে অন্যকে বাতিল করে দিচ্ছি। একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না ।"
কিংবা , 'কত ইচ্ছাকৃত ভ্রমের ভিতর বসবাস করি আমরা।'
' মানুষকে নিজের অজান্তেই কেমন বাক্সবন্দী করে ফেলি আমরা। '
- ঠিক এই সময়ে যেন আরও চোখ ও মন খুলতে বলে আমাদের।
অপেক্ষায় আছি, তার চরিত্ররা ঢাকায় কী করে, কোথায় যায়, কী বলে, কী ভাবে - সেকথা কোনো একটা উপন্যাসে দ্রুতই আসবে দীর্ঘ কলেবরে।