১৯৯০-এর দশকে ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার সরকারি কলোনি, তার ভেতরে জমতে থাকা ঘটনার ভাঁজে ভাঁজে কাহিনি এগোতে থাকে। টুইনওয়ানে পেঁচিয়ে যাওয়া ক্যাসেট, রং নম্বরে প্রেম, সংগীত ভবনে কলিম শরাফী আর সাদি মহম্মদের ছুটির বিকেলের গানের ক্লাস, বিটিভির এ সপ্তাহের নাটক আর ম্যাকগাইভারের জন্য কী তীব্র ছটফটে অপেক্ষা! মেট্রিক পরীক্ষার তুমুল প্রতিযোগিতায় ক্লান্ত স্বপ্নাতুর চোখ, ডিশ অ্যান্টেনার ঝকমকে আবির্ভাব, কলোনির মাঠ জুড়ে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট আর পুতুল বিয়ের মরিচবাতি আনন্দ, ঈদ আর পুজোয় বাতাস জুড়ে ঘিয়ে ভাজা ঘ্রাণ, কলাবতীর বাগান জুড়ে ডানা ঝাপটানো প্রজাপতির খেলা, ছাদের কোনায় গুটিসুটি লুকোনো প্রেম, সালমান শাহের পোস্টার কেয়ামত থেকে কেয়ামত দেয়ালে পতপত করে ঝুলছে আর ওইদিকে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান আলোর মতন জেগে ওঠে। এ গল্পের মূল চরিত্র কাজলী, কৈশোরের খোলস ভাঙছে একটু একটু করে। অনুরাগের সূত্র আর সুঁই ফোটা বিষন্নতার তিরতিরে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ছে সে। তার জীবন জুড়ে লেপ্টে থাকে অশোককাকু, ছোটবোন গুটিসপাখি, বন্ধু রত্না সজীব আর কলোনির জলপাইরঙা নিজস্ব দুপুর। এর মধ্যে কাজলী তার মায়ের কাছ থেকে খুঁজে পায় চনর্কি মন্ত্র। কাজলী জেনে যায়, চনর্কি ভাঙা প্রজাপতি আর ফেরে না। মানুষ কি ফেরে?
Kizzy Tahnin is a contemporary Fiction Writer currently living in Bangladesh. Kizzy is a free spirited soul who is aware of and understands the wider world - and their place in it. She writes to create the world that no one ever seen, the characters no one ever met before.
She has written 3 books and numerous stories both published and yet to be published in national and international literary magazines. Her stories are being translated and published into English.
Publications in Bangla: 1. Der Nambari 2.Budh Grohe Chad Utheche 3.. Ache Ebong Nai 4. Iccher Manchitra
She is a development worker by profession and has been working for more than 7 years to promote and safeguard Culture and Heritage. In early 2016, The Department of Foreign Affairs and Trade of Australia selected Kizzy from Bangladesh for their documentary, named “Story of My Life“ https://www.youtube.com/watch?v=eNTok....
"চনর্কি" নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় বেড়ে ওঠার গল্প। যেহেতু সে গল্পের শেকড় সত্যে প্রোথিত, তাই নস্টালজিয়া এসে পড়েছে স্বাভাবিকভাবে। লেখিকার কৃতিত্ব এখানেই যে উপন্যাসের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের বিবরণে "অতি আবেগ" কমই আছে, আর থাকলেও সেই সময় থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে তিনি নৈর্ব্যক্তিকভাবে মানুষজন ও প্রতিপার্শ্ব অবলোকন করেছেন।"চনর্কি"র কিশোরী নায়িকার বেড়ে ওঠা,শরীরী জাগরণ, চারপাশের জগতের সঙ্গে বোঝাপড়া -সবই সার্থক coming of age story-র ইঙ্গিত দেয়। না চাইলেও ধানমন্ডির সেই কলোনিতে ফিরে যেতে মন চাইবে, জীবন যেখানে ছিলো সহজ ও সুন্দর।
নব্বই দশকের স্মৃতি এত দক্ষতার সাথে, এত মায়াময় নস্টালজিয়ায় আর কে বইয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। নব্বই নিয়ে সব বই আমি পড়ে ফেলেছি এমন বেয়াড়া দাবী করবো না। তবে যেখানে যতটুকু পড়েছি তাতে চনর্কি অনায়াসে একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে নিতে পারবে। ময়ূর কলোনী নামের একটা কলোনীর মানুষদের কথা বলতে গিয়ে কিযী তাহনিন শেষমেশ পুরো একটি দশকের আখ্যান রচনা করে ফেলেছেন।
ধানমন্ডির সরকারি কোয়ার্টার "ময়ূর কলোনি"র সদ্য কিশোরী কাজলী। তার শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের পথে তার পরিবার, বন্ধু তথা ময়ূর কলোনির বাসিন্দাদের "এইসব দিনরাত্রি"র গল্পে আমরা খুঁজে পাই নব্বইয়ের নস্টালজিয়া।
ব্যক্তিগতভাবে এরকম একটা সরকারি কলোনিতে বড়ো হওয়ায় ছোটবেলার একটা ফ্ল্যাশব্যাক পেলাম যেন। একেকটা ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়ে কলোনির মানুষের কৌতূহল, চিন্তা, আলোচনা, সমালোচনা, উদযাপন আর এসবের মাঝে সময়ের ছুটে চলায় রঙিন দিনগুলো সাজিয়ে খুব সুন্দরভাবে কাহিনী চিত্রায়ন করেছেন লেখক। পারিবারিক সম্পর্কের নোনামিঠে রং মিলান্তির মাঝে 'চনর্কি'র গল্প বলেছেন। চনর্কি মানে রেশম পোকার খোলস বা খাঁচা। খোলস ছেড়ে একসময় সেটা প্রজাপতি হয়ে যায়, কিংবা হয় না।
ল্যান্ডফোনে আড়িপাতা, প্র্যাংক কলে দুষ্টামি, বৃষ্টি নামলে ড্রেনের পানিতে মাছ ধরা, শুক্রবার দুপুরে বিটিভির সিনেমা, বাকের ভাইয়ের ফাঁসি, ভিসিআর-ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ডিশের লাইন, সালমান শাহর মৃত্যু, রবীন্দ্র সঙ্গীত আর সিনেমার সোনালি দিনের গানের মাঝে ব্যান্ড আর পপ গানের স্বর্ণযুগের উত্থান, ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কা ও আয়োজন, ঈদ বা একুশে ফেব্রুয়ারির উৎসবে সবাই মিলে আনন্দ করা, প্রথম প্রেম - সব নিয়ে এক জাদুকরী আবহ।
"নব্বই-ই তো ভালোই, সাচ্ছন্দ্যময় আর সহজ। আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো তাদের সময়কেই আপন ভাববে, নব্বইকে কঠিন ভাববে, কখনো নব্বইতে আর ফিরে যেতে চাইবে না। আমার বাবা-মায়েদের সময়ের মানুষেরা যেমন ভাবে তারাই শ্রেষ্ঠ সময় জন্মেছিল। আমি যে সময়টাতে বড় হচ্ছি তাতে লড়াই, ক্রোধ, বিষন্নতা, প্রেম সবই আছে, আমাদের মতন করে। এ সময়ই সত্য আমার কাছে।"
স্নিগ্ধ, মোলায়েম, মায়াময় কাহিনী। অল্প সময়ে গ্রাস করে নিবে পাঠককে। একেকবার মনে হয় নিজের গল্প বলেছেন লেখক, আবার মনে হয় এ তো আমাদেরই জীবনের কোনো না কোনো অংশের গল্প, আমাদের হারানো অতীত, যা আমরা প্রতিনিয়ত খুঁজে ফিরি কর্পোরেট ব্যস্ততায়। খুবই ভালো লাগলো বইটা পড়তে গিয়ে। লেখকের প্রতি শুভকামনা।
নব্বই এর দশকের ঢাকার ময়ূর কলোনি। এখানেই ১৩ বছরের মেয়ে কাজলী ওরফে কাজু তার বাবা-মা আর ছোট বোনের সাথে বাস করে। তার চোখ দিয়েই পাঠক দেখেন নব্বই এর দশককে, তার হালচালকে, তার কালচারকে। কাজু দেখে সারা বিকেল জুড়ে অশোককাকুর ক্যাসেটপ্লেয়ারে বাংলা সিনেমার গান বাজানো, দেখে বাবার পরকীয়া, মায়ের নির্লিপ্ততা, বন্ধুদের প্রেম, কলোনির বড়ভাই তুহিনের মৃত্যু, দেখে নিজের একটু একটু করে বড় হয়ে যাওয়া, তার জীবনেও কি প্রেম আসে? কারো জীবনই কি আসলে পূর্ণতা পায়? কাকে বলে পূর্ণ জীবন? চনর্কি ভেঙে প্রজাপতি হতে পারাকেই কি পূর্ণতা বলে?
দমকা হাওয়ায় ময়ূর কলোনিতে ভেসে আসে সমসাময়িককালের নানান গল্পকাহিনী - সালমান শাহ, মৌসুমি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, সাদি মুহম্মদ, আইয়ুব বাচ্চু, ক্যাসেটপ্লেয়ারে বাজানো সিনেমার গান, বাকের ভাই, চাচা চৌধুরী, বিল্লু পিন্কি, টিনটিন কমিক্স, ম্যাট্রিক পরীক্ষার উত্তেজনা, বয়সন্ধিকালের কৌতুহল, ছোটখাটো পারিবারিক টানাপোড়ন। এর মাঝেই জীবন বয়ে চলে। এর মাঝেই বয়ে চলে নব্বই এর দশক।
আমরা খুব গর্ব নিয়ে বলি যে আমরা নাইন্টিজ কিড। নব্বইতে জীবনটা কী মধুর ছিল! শৈশব কাটিয়েছি, কৈশোরের শুরুটা পার করেছি। আমার এখনো মনে পড়ে টাকা জমিয়ে কীভাবে ক্যাসেট কিনতাম, সেবা প্রকাশনীর বই কিনতাম। এলাকাভিত্তিক ঈদের উৎসব, সবার বাড়ি বাডি যাওয়া। প্রেম প্রেম গন্ধের হাতছানি।
Kizzy Tahnin সেই নব্বইয়ের একটা গল্প আমাদের শোনাতে চাইলেন কাজলের বয়ানে। যে বয়ানে আছে অসম্ভব মিষ্টি এক গদ্যভাষা, যেটা শুধু পড়ে যেতেই ইচ্ছে হয়। আছে মন খারাপের গল্প, বিষন্নতার গল্প। কোথাও কেউ নেই নাটকটা যে নব্বইয়ের অবধারিত অংশ সেটাও এসে উঁকি দিয়ে যায়। পড়তে পড়তে কখন যে নব্বইতে চলে গিয়েছি টেরও পাই নি। আমার কৈশোরের ময়মনসিংহ এর কথা মনে পড়ছে। গল্পের ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দের জায়গা তুহিনের সাথে গল্প কথকের অসীম দূরের তারপরও খুব কাছের সম্পর্কের জায়গাটি। তারপরও কেউ যদি গল্পে উথাল-পাতাল টার্ন চায়, এই বইটা বোধকরি তাদের ভালো লাগবে না। যারা স্মৃতির ভেতরে ডুব দিতে ভালোবাসেন গল্পটা তাদের জন্য। আক্ষেপ তো থাকেই যে কোনো লেখায়। এই গল্পে আমার আক্ষেপ গল্পটা ভীষণ সরলরৈখিক। কথক বাদে বাকি কিছু চরিত্র বোধহয় আরও এক্সপ্লোর করা যেত। তবে এসব জরুরি আলাপ না।
ক্লাস সেভেনে পড়া কাজলি গল্প বলছে। ময়ূর কলোনির গল্প। বাবা মা,ছোট বোন গুটিপাখি, নানা নানী খালা মামার গল্প। দাদাজান চাচা ফুপুর গল্প। ক্লাসে তিন গোয়েন্দা চালাচালির গল্প, তিন গোয়েন্দা থেকে কিভাবে জীবনে আসে পিরিয়ড - প্রেম তার গল্প। রোজার ঈদের নতুন জামা না দেখানোর গল্প। কাটা মসলায় রান্না করা কুরবানী��� গোস্তের গল্প - বর্তমানে যার বাজারি নাম পেশোয়ারি বিফ। বন্ধু রত্না, সবুজের গল্প। সবুজের পাগলী ফুপিটার গল্প।
এক তৃতীয়াংশ ও যাইনি, আমার মনে পড়ে পাপ্পু মামার কথা। ম্যাট্রিক এ বোর্ড স্ট্যান্ড করা মামার কি যেন অসুখ হলো, ইন্টার পরীক্ষা টা দিতেই পারলো না। এরপর দেখতাম সারাদিন দাবা খেলত নাহয় গেমবয়। পলাশ মামা বিয়ে করে আলাদা চলে গেল। পাপ্পু মামা আর নানু পড়ে রইল বিশাল বাড়ি নিয়ে। মামা প্যারালাইজ হয়ে গেল, বাড়ির কাছাকাছি গেলে প্রস্রাব এর দুর্গন্ধ পাওয়া যেত। মামা মারা গেলে ঝুমু খালা নানুকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। এরপর নানু ও মারা গেলেন। আমার চোখে পানি চলে আসে, মা রুমে এসে পড়ায় মুখ লুকানোর চেষ্টা করি।
আজকেই রাহার সাথে এগ্রি করলাম যে কনটেম্পোরারি রাইটার দের লেখা আর দ্বিতীয় বার পড়ার ইচ্ছা হয়না। নিপাতনে সিদ্ধ হলো। নস্টালজিক হতে চাইলে আবার পড়ব এটা। Thanks to Mitu for such an amazing gift.
কেউ সুখে থাকলে আমার ভালো লাগে। দুঃখে থাকলে মনে হয়, তার সব দায় বুঝি আমার, ওই যে আমার পুরোনো অসুখ - কাজু
কিছু কিছু বই থাকে, যা নতুন কিছু ভাবায় না, বরং পুরোনো অনুভূতিগুলোকেই আবার তাজা করে তোলে। এই বইটা সেরকমই এক অভিজ্ঞতা। নব্বই দশকের প্রতি আমার আলাদা একটা টান আছে। সময়টা ছিল এক অদ্ভুত মিশ্রণের। আধুনিকতার ছোঁয়া তখনো পুরোপুরি আসেনি, আবার পুরোনো দিনের সরলতাও পুরোপুরি মুছে যায়নি। এ সময়টাকে আমি আঁকড়ে রাখতে চাই, বেঁচে থাকতে চাই সেখানেই। অথচ যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততায় অনেক স্মৃতিই হারিয়ে যায়। এই বইটা হাতে নিয়েই যেন আবার ফিরতে পারলাম সেই সময়ের ভেতর। অবাক করা ব্যাপার হলো, বইটি কেনার ইচ্ছে শুরুতে খুব একটা ছিল না। বইমেলায় কয়েকবার হাতে নিয়েও কিনিনি। হয়তো অবচেতনভাবে একটা দ্বিধা কাজ করছিল। বাংলাদেশের নারী লেখকদের লেখা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা তেমন ভালো না। তাদের রাইটিং স্টাইল আমার কাছে খুব গ্রহণযোগ্য মনে হয় না, মনে দাগ কাটা তো দূরের কথা। তবু শেষমেশ কি ভেবে জানি কিনেই ফেললাম। আর এখন মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস কিনেছিলাম! কারণ এবারের বইমেলায় বের হওয়া আমার পড়া বইগুলোর মধ্যে এটা নিঃসন্দেহে সেরা।
বইটা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এটা যেন আমার পাশের বাসার সেই কাজুর গল্প; এতটাই আপন, এতটাই চেনা। তখনকার কলোনী জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, উৎসব-অনুষ্ঠান, প্রেম-বিচ্ছেদ, গ্রীষ্মের তাপদাহ, শীতের হিমেল সকাল, ছুটির দিন, সেহরি-ইফতার, ঈদ, টিভি, গান, ভিসিআর, ডিশের লাইন, চিঠি, টেলিফোন, নাটক, সিনেমা, ঝালমুড়ি, গল্পের বই, কমিক্স, লোডশেডিং, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট—কি নেই এতে! লেখিকা পাতায় পাতায় বলে গেছেন আমাদের ফেলে আসা জীবনের গল্প, পড়তে গিয়ে না চাইতেও চোখ ভিজে ওঠে। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি লেখিকার গল্প বলার সাবলীলতায়। প্রতিটি লাইন পড়ে মনে হচ্ছিল, বইটা যেন শেষ না হয়। অথচ এ বই থেকে আমার এক্সপেক্টেশন খুব একটা ছিল না। বইটা শুধু একটা গল্প না, বরং এক সময়ের প্রতিচ্ছবি, আমাদের শৈশব কৈশোরের এক টুকরো আয়না।
এটাই লেখিকার লেখা আমার প্রথম পড়া বই। এখন মনে হচ্ছে তার বাকি বইগুলোও পড়ে ফেলতে হবে। আগামী বইমেলা থেকে তার নতুন বই আমার উইশলিস্টে থাকবে নিশ্চিতভাবেই।
আমি ৯০দশকে বড় হই নি। কিন্তু ৯০এর প্রতি এক আলাদা ভালোলাগা নিয়ে বড় হয়েছি।
সেই ৯০এর দশককে ঘিরেই এই বইখানা। যারা ৯০এ বেড়ে উঠেছেন তারা তো ফ্ল্যাশব্যাক পাবেনই, সেইসাথে আমার মত যাদের শৈশব-কৈশোর ২০০০এর শুরুর যুগে তারাও অনেক মিল পাবেন।
লেখিকার লেখা বেশ ঝরঝরে। ইনিয়ে বিনিয়ে লেখাকে অহেতুক বড় করার প্রবণতা নেই। আবার সমসাময়িক অনেকের মত ধৈর্য্যচ্যুতি হয়ে হুট করে কলম বন্ধ করে প্রকাশ করার বাতিকও চোখে পড়ল না।
মিমকে ধন্যবাদ লেখিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। . . . নভেম্বর ৭, ২০২৫ | ঢাকা, বাংলাদেশ।
চনর্কি হল নব্বই থেকে আসা এক উড়োচিঠি, যার খাম খুললে ঘর ভরে যায় বৃষ্টিভেজা সোঁদা মাটির গন্ধে!
চনর্কি হাত ধরে নিয়ে যায় স্মৃতির লেনে,তুলে ধরে কিশোরীর স্বচ্ছ চোখে দেখা নব্বই। মনে করিয়ে দেয় বর্ষাদিনে ড্রেন উজিয়ে বেরিয়ে আসা মাছ, ভিজে মাথা নুইয়ে পড়া বাগানের কলাবতী ফুল,খাটের স্ট্যান্ডে মায়ের শাড়ি পেঁচিয়ে ঘরঘর খেলার দিন। বিকালের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, গানের ক্লাসের সারগাম, সন্ধ্যায় মায়ের হাতে ভাজা গরম পিঁয়াজু, কিংবা ডায়াল ঘুরিয়ে অজানা নাম্বারে ফোন দিয়ে বিরক্ত করার অহেতুক আনন্দ -মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা সব স্মৃতি একে একে ঘুরিয়ে দেখাল চনর্কি।প্রথম প্রেমের ঝিরঝিরে আবেগ, প্রথম মন ভেঙে যাবার কষ্ট, প্রথমবারের মতন চিরতরে কাউকে হারিয়ে ফেলার শূণ্যতা, চনর্কিতে উঠে এসেছে সবই।
নব্বই নিয়ে এত মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা আগে কখনো পড়িনি।বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে গল্পের বই পরার মত ছোট ছোট অভ্যাস বা বাড়ির ছাদে ডিশঅ্যান্টিনা বসানোর ঘটনাগুলো যেরকম যত্নে তুলে এনেছেন, তাতে লেখিকার মুন্সীয়ানার প্রশংসা না করে উপায় নেই।কিশোরীর সহজ মনে সরল বর্ণনা লেখাকে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা, যাতে রাগ আছে, হিংসা আছে, ভালোবাসা আছে, আবেগের সবগুলো রূপ ফুটে উঠেছে সহজ কিন্তু গভীরভাবে। নব্বই কিংবা হাজারের শুরুর দিকে যারা বেড়ে উঠেছেন, এই বই তাদের জন্য এক টাইম মেশিন।
নব্বই নিয়ে কিযী তাহনিনের কাছ থেকে আরো লেখা প্রত্যাশা করছি।
২০২৫ রিভিউ বিষয়: বই রিভিউ: ২১ বই: চনর্কি লেখক: কি যী তা হ্ নি ন
৯০ এর দশকের একটা গল্প, ৯০ দশক পার করে আসা প্রত্যেকের জন্য খুব আদুরে, যেমন আদুরে এই বইটা। বিকেলে আসা ঝালমুড়িওয়ালার মত হরেক মশলার পশরা নিয়ে এসেছে এই গল্পটা।
ঠিক ৯০ দশক না হলেও একটা দীর্ঘকাল আমি নিজে দুটো কলোনির মত ক্যাম্পাসে বড় হয়েছি। কাজু নামের এক কিশোরীর গল্প। ময়ুর কলোনিতে থাকে সে, তার বোন গুটিপোকা আর বাবা-মা। ময়ূরের পেখমের মত, মিষ্টি সব নাম সেই কলোনির বাসাগুলোর, উষা, প্রভাতী আরো কত কী! ধানমন্ডির এই কলোনিতে নানা পেশার, নানা বয়সের মানুষের।
কাজু সবে সবে ক্লাস সেভেনের গন্ডি ছাড়াচ্ছে, তার বন্ধু রত্না, সজীব, সুমন। বাসার সামনে বাগান, সবজী ফল-ফুলের চাষ। রত্নার সাথে চুরি করে গান শিখতে যায়। ছোট্ট কলোনিতে কাজু দেখে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে। জীবনের উত্থানপতন। ঈদ-পূজা পালন করে, সবার বাসায় ঘুরে ফিরে ঈদের খাওয়ার আনন্দ, ঈদের রাতে একসাথে বসে আনন্দমেলা দেখা আরো কত কী! কাজুর নিজের জীবন, ত���র বাবা মা, তার গুটিপোকার গল্প। একদিন কিশোরী কাজু হঠাৎ বড় হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পরিচিত হয় নিত্য নতুন অনুভূতির সাথে। এ অনুভূতি অন্য রকমের। কিশোরীর চোখে বাঁধে অনেক কিছুই। শরীরে আসে পরিবর্তন, আসে মানসিক বদল।
বিকেলে মায়ের কাছে আবদার করে ঝালমুড়ি খাওয়া কিংবা ক্রস কানেকশনে কথা শোনা। এই গল্পগুলো যেন আমার, আমাদের।
কারো বারান্দা থেকে ভেসে আসে ময়ূরকন্ঠী রাতেরও নীলে…
মেট্রিকে ভালো ফল না করায় কেউ নিজের জীবন অনায়াসে দিয়ে দেয়, আবার কারো পরিবারে রেজাল্ট পাস নিয়ে মাথা ব্যথা থাকে না। কে সায়েন্স বা কে আর্টস পাবে, কে ব���় হয়ে শান্তি নিকেতনে যাবে কিংবা কারো স্বপ্ন ডিভি লটারি। মাছ ধরে কেউ খেলে, কেউ সিঁড়ি ঘরে বসে আড্ডা দেয়, রং নাম্বারে কেউ কল দেয় আবার কেউ ভয়ে ভয়ে আইসক্রিম খেতে যায়। এই কেউ কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে, এই আবার মাথায় হাত বুলিয়ে পাতে তুলে দেবে ঈদের খাবার।
সবাই মিলে ঈদ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারী পালন কত কিছুতে মিশে আছে আবেগ। ওই ঝালমুড়ির মত মজার স্বাদের সে অনুভূতি। কিছু না বলা কষ্ট আছে, আছে কিছু না বলা আনন্দ। অনেক অনুভূতি সবাই জানে, অনেক অনুভূতি কেউ জানেনা, অনেকে অনেক কিছু বলে আবার অনেকের অনুভূতি চাপা।
কাজু একদিন, চনর্কি ভাংতে চায়। চনর্কি রেশম পোকার বাসস্থান। এ চনর্কি ভেঙ্গে কেউ বের হতে পারলে সে হয় প্রজাপতি নইলে………।।
৯০ এর গল্প যত বলা যায়, তত কম। বইয়ের পাতায় যতটা এসেছে, তার বাইরেও জগত অনেক বিশাল। অনুভূতি আর আবেগের নাম আমাদের ছেলেবেলা। কিন্তু প্রত্যেক কিশোর কিশোরী যারা বিশেষ করে, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৯ সাল যাপন করে এসেছে, তাদের কাছে এ যেন পুরো স্মৃতির এক আবেগী যাত্রা। আমার যাপিত জীবন এ সময়ে খুব না হলেও অনেক কিছু দিয়ে যেন নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।
গল্পে ,এক কিশোরীর জীবনের অনেক নতুন অনুভূতি এত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন! ৯০ হোক বা বর্তমানের! অনেকেই অনেক কিছু নিজের সাথে মেলাতে পারবেন।
৯০ এর দশক ছিল শুদ্ধ, অশুদ্ধ বিষয় যে ছিল না, তা নয়, তবে এত যান্ত্রিক ছিল না। কলোনির জীবন বা ক্যাম্পাসের জীবনের স্বাদ অন্য রকম। এখানে পরিবারের থেকে এই কলোনির মানুষেরা যেন বেশি আপন হয়ে যায়। সুখে দুঃখে এক সাথে বিলীন। এই ভালো ওই মন্দ মিলিয়ে কলোনি বা চনর্কির জীবন ছিল অন্য এক গন্ধে মোড়া। সে জীবন আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
রেশম পোকার ঘর বা খাঁচাকে চনর্কি বলে। আমার অজানা হাজার বিষয়ের মধ্যে এ শব্দটাও একটা। রেশম সংগ্রহর প্রসেসে বলে, ঐ ঘরে থাকা অর্ধেক রেশম পোকা মারা যাবে গরম পানি ঢালার কারণে। তাদের থেকেই রেশম সংগ্রহ করা হয়। অর্ধেকের জন্ম ও মৃত্যু ঐ চনর্কিতে হলেও বাকি অর্ধেক মরে না (আসলে মারা হয় না)। তারা জন্ম দেয় নতুন রেশমের। তারপর চনর্কি ভেঙ্গে প্রজাপতি হয়ে উড়াল দেয়।
আজকের এ বইটা নিয়ে অল্প বিস্তর আলোচনা করার জন্য মনে হয় ওপরের প্যারাটা জরুরী ছিল।
বইটার নামই 'চনর্কি'। লেখক, কিযী তাহনিন (কী সুন্দর নাম!)। কিযী তাহনিন চনর্কিতে একটা সময়, জীবনকে বেঁধেছেন। নব্বই দশকের ঢাকার কলোনি কালচার। কলোনিতে যারা অন্তত দুটো বছর কাটিয়েছেন তারা জীবনের কোনো না কোনো সময় ঐ সময়টাকে মিস করেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাদের জন্য এ বইটা খুবই সুস্বাদু একটা বই হবার কথা।
মিলেনিয়াল প্রজন্মের কৈশোর-শৈশবের গল্প বলে গেছে 'চনর্কি'। ইদানিং আর্টে দুটো জিনিস বেশ দেখা যায়। সেটা হলো, নস্টালজিক একটা সেটাপ কিংবা একদম রুরাল জীবনযাত্রার গল্প। নস্টালজিক সেটাপের কারণে এই জায়গাতে এসে 'চনর্কি' ক্লিশে কিনা, সে প্রশ্নটা পাঠক তুলতে পারেন। তবে আমার কাছে চনর্কি একদমই ক্লিশে মনে হয়নি। ছেলেবেলার নতুন ক্লাসে ওঠার পর নতুন পাওয়া বাংলা প্রথম পত্রের মত একটা ঘ্রাণ নিয়ে এসেছে 'চনর্কি'।
আমার শৈশব, কৈশোর এক্সাক্ট ৯০ দশকের না। খানিকটা পরের অর্থাৎ ২০০০ এর পরের। এ কারণে পাঠক হিসেবে একদম ১০০% রিলেট করতে না পারার একটা সম্ভাবনা দেখা দিলেও তখনকার জীবন খানিকটা স্লো ছিল আমার ধারণা। যে কারণে অনেকটাই রিলেট করতে পেরেছি আমি। নব্বই দশকে বিটিভির শুক্রবার দুপুরের সিনেমা দেখার জন্য সব কাজ ফেলে রাখা, অ্যান্টেনা ঘোরানোর সেই দিনগুলোর ছবি উঠে এসেছে বইতে। আরো উঠে এসেছে টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে অচেনা নাম্বারে ফোনে দুষ্টুমি করার গল্প। এসেছে কলোনিতে বাচ্চা কাচ্চার দল ধরে ঘুরে বেড়ানো, এ বিল্ডিং এর খবর ও বিল্ডিং এ চর্চা হবার সেই সামাজিক অভ্যাস ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে নব্বই দশকের প্রেমের ছবি।
নব্বই দশকে প্রেম মানেই ছিল সুপার লেভেলের গোপনীয়তা। অমুক ভাইকে দেখলে পেটে প্রজাপতির নাচন, পালাই পালাই ব্যাপারটা মেয়েদের এন্ড থেকে একদম পারফেক্টভাবে তুলে এনেছেন লেখক। লেখক হবার প্রথম ক্রাইটেরিয়া যদি হয় পাঠককে কল্পনা করতে বাধ্য করা তাহলে কিযী তাহনিন ১০০% সফল এখানে।
তবে এগুলো স্রেফ অলংকরণ। এগুলোকে উপজীব্য করেছেন লেখক, তবে বইটা স্রেফ নব্বই দশকের স্মৃতিচারণসর্বস্ব নয়। অনবদ্য মেটাফোরের কাজগুলোর সাথে গল্পটাও ছিল অনবদ্য। সব মিলিয়ে মাত্র ১৪৪ পৃষ্ঠায় চনর্কি ও চনর্কি ভাঙ্গার ভীষণ সুন্দর একটা গল্প, চমৎকার লিখনশৈলীতে শুনিয়ে গেছেন লেখক।
লিটারারি ফিকশন যাদের পছন্দ, তারা কেউই এ বই পড়লে হতাশ হবেন না আশা করি।
সম্ভবত, এই প্রথম কোন কিশোরীর কামিং অফ এজ স্টোরি পড়লাম। কৈশোরিক চাঞ্চল্য, নব্বইয়ের লস্টালজিয়া, কলোনী কালচার সবই আছে পরিমাণমত। ফেলে আসা সময়ের প্রতি আবেগ আছে, আতিশয্যটা নেই। লেখিকার গদ্য ভাষাও চমৎকার।
প্রথানুযায়ী, এরকম বইয়ে স্নিগ্ধ একটা মিষ্টতা মাখানো থাকলেও, “চনর্কি”-এর শেষ অংশ বাদে পুরোটাতেই কেমন যেন বিষণ্ণতার সুর পেলাম বলে মনে হলো; যদিও, হবার কথা ছিল উল্টোটা। আসলেই তেমন নাকি শুধু আমার ভ্রম কে জানে!
আদতে আমি অনেকটাই ফাস্ট রিডার। কিন্তু ১৪৪ পৃষ্ঠার পুচকে সাইজের বইটা শেষ করতে আমার সময় লেগেছে পাক্কা তিনদিন। কারণ বইয়ের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য পড়েছি মন দিয়ে। পুরো গল্পটাই নব্বই দশকের একটা কলোনিকে ঘিরে। কলোনির সেই সময়ের জীবন এবং বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন...এসব নিয়েই সাজানো ছিলো পুরো বইটি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কখনো কলোনির আশপাশে থাকিনি। কিন্তু আম্মা থাকত কলোনির পাশেই। আমার বলা আশি আর নব্বই দশকের সেই সময়ের গল্পগুলো মিলে বইয়ের সাথে। আমার মনে হচ্ছিল যেনো আম্মা আমাকে গল্প শোনাচ্ছে। প্রতিবেশি বান্ধবী, কলোনির ছেলেমেয়েদের আড্ডা দেয়া, ছোটখাটো বিষয়ে বড়সড় গুঞ্জন-ফিসফাস... বইটা একাধারে আমাকে হাসিয়েছে আবার পরক্ষণেই বিষণ্নতায় ছেয়ে দিয়েছে মনকে। মাঝে মাঝে করে তুলেছে নস্টালজিক। কিছুটা আফসোস! আহা...এমন একটা ছেলেবেলা আমি কেন পাইলাম না!