বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র এক যুবক পুলিশের তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়ে এক ভগ্নপ্রায় প্রাচীন রাজপ্রাসাদে। এখানে বিচিত্র কয়েকটি মানুষের সান্নিধ্যে এসে তার বদ্ধমূল সব ধ্যানধারণা বদলে যায়। তার মধ্যে সুপ্ত চিরকালীন ভারতবর্ষের নানা মানবিক গুণের উন্মোচন ঘটতে থাকে। 'ক্রান্তিকাল' আসলে ভিন্ন চোখে দেখা এক জটিল সময়ের আখ্যান।
Prafulla Roy was a Bengali author, lived in West Bengal, India. He received Bankim Puraskar and Sahitya Akademi Award for his literary contribution in Bengali.
বাতিঘরে আজকে "সান্ত্বনা পুরস্কার দিবস" কাটালাম বলা যায় (মানে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পাওয়া বই পড়ে আর কি!) সাহিত্যিকরা যখন ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকেন তখন তাদের পুরস্কার দেওয়ার কথা মনে থাকে না কারো। তাদের কলমের কালি যখন শুকিয়ে যায়,তাদের লেখা যখন অর্থহীন প্রলাপ হতে শুরু করে তখন পুরস্কার কমিটির টনক নড়ে।অপুরস্কৃত লেখকের যেনতেন কোনো বই বেরুলেই তারা বইটিকে সম্মাননা দিয়ে নিজেদের দোষ স্খালনের চেষ্টা করেন। তো, পড়ে ফেললাম তেমনই একটি বই "ক্রান্তিকাল।" সিনেমার কাহিনি হিসেবে "ক্রান্তিকাল " জম্পেশ। কিন্তু বই হিসেবে? সুখপাঠ্য, গভীরতা নেই, চিরাচরিত ফর্মুলা অনুসরণ করে লেখা, একবার পড়ে দিব্যি ভুলে যাওয়া যায়। টেরোরিস্ট নায়ক ক্ষয়িষ্ণু রাজপরিবারে ঢুকে ব্ল্যাকমেইল করে থাকতে শুরু করলো, "ভারতীয় মহান আদর্শ" দেখে তার মনোভাব বদলে গেলো। এ বইয়ের অকাদেমি কেন, কোনো পুরস্কার পাওয়ারই যোগ্যতা নেই।
গোয়েন্দা, ফ্যান্টাসি, রহস্য কিংবা ভৌতিক ঘরানায় না লিখেও যে টানটান উত্তেজনার উপন্যাস লেখা যায়, এই বইটি না পড়লে আমার সে অভিজ্ঞতা হয়তো হত না।
এখান থেকে মাত্র ২৫০ বছর আগেও প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে ছিল ছোট ছোট সামন্ত রাজ্য বা জমিদারি। সম্রাট বা সুলতানদের কর দেয়া এবং যুদ্ধে সৈন্য সরবরাহ করা বাদে স্থানীয় রাজাদের হাতে ছিল নিজের ভূমির উপর একচ্ছত্র ক্ষমতা। কিন্তু ইংরেজদের আগমনের পরে এইসব ছোট ছোট নেটিভ স্টেট ধীরে ধীরে ভেঙ্গে বিভিন্ন প্রেসিডেন্সির (প্রশাসনিক অঞ্চল) নিচে চলে আসে।
কিন্তু তারপরেও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষজুড়ে প্রায় তিনশোর মত নেটিভ স্টেট টিকে ছিল। কিন্তু ভারত স্বাধীনতা পেলে সরকার একসেসান ঘোষণা করে। অর্থাৎ আলাদা করে কোন নেটিভ স্টেট বলে কিছু থাকবে না। সব হবে অখন্ড ভারতের অংশ। অর্থাৎ রাজা, মহারাজার সাথে ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, মুঠে এমনকি চোর কিংবার ভিখারীরও সাংবিধানিক কোন পার্থক্য থাকবে না। কারণ সকলের ভোট প্রয়োগের ক্ষমতায় কোন পার্থক্য নেই। অন্য অনেক স্টেট সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও হায়াদ্রাবাদের নিজাম এবং ত্রিবাংকুর মহারাজা প্রতিবাদ করে। ফলশ্রুতিতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করে অঞ্চলগুলো ভারতের অধীনে আনে।
গল্পের প্রেক্ষাপট স্বাধীনতার ৫০ বছর পর। সেই তিনশো স্টেটের একটি অংশ ছিল প্রতাপপুর স্টেট। স্টেটের রাজবাড়ি প্রতাপপুর প্যালেস জীর্ণ অবস্থায় এখনো টিকে রয়েছে কোনভাবে। নেই আগের সেই জৌলুস, বৈভব, আলোর রোশনাই, ভৃত্য-চাকরদের পদচারণার মুখরতা। কিন্তু এতদিন পরেও বনেদিয়ানায় চিড় ধরেনি এতটুকুও। সাবেক রাজা শৌর্যেন্দ্রনারায়ণের পুত্র সংগ্রামনারায়ণের শিরায় শিরায় প্রভাবিত আভিজাত্য, রাজরক্তের অহংকার। কিন্তু পিতাপুত্র দুজনেই অসুস্থ। প্রাক্তন রাজার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে পুরোপুরি, সে এখন অনেকটা জীবন্ত জড়বস্তুর মত আর অন্যদিকে পুত্র প্রতীকী রাজা তিনবার হার্ট এ্যাটাকে শয্যশায়ী। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পুত্রবধূ সুবর্ণা আর নাতনী দেবী। সুবর্ণাই খুব যত্ন দিয়ে, মমতা দিয়ে নিজের দাদাশ্বশুর এবং শ্বশুর মহাশয়কে সেবা করে চলেছে। এই কাহিনী মূল চরিত্র সুবর্ণাকেই ধরা যায়।
সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিল। প্রাচুর্য না থাকলে রাজবাড়িতে অভাব ছিল না। ডিভোর্সি সুর্বণা খুব গুছিয়ে একদিন চাকুরী, সমাজসেবা আর অন্যদিকে সংসার দিব্যি সামলে চলছিল। কিন্তু একদিন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সদর দরজা খোলা পেয়ে এক সন্ধ্যায় রাজবাড়িতে ঢুকে এলো ভয়ঙ্কর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী। সাথে ভয়ংকর সব আগ্নেয়াস্ত্র। যার উপর ৭০/৮০ টা পুলিশ, মিলিটারি এবং সাধারণ মানুষ হত্যার অভিযোগ। যার মাথার দাম সরকার ঘোষণা করেছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা।
তারপর সম্পূর্ণ অদ্ভুত এক অস্থিরতার মাঝে ঘুরতে শুরু করে গল্পের চাকা। জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে বইটি।
ব্যক্তিগত অভিমতঃ
প্রফুল্ল রায়ের লেখা এই প্রথম পড়লাম। প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছেন লেখক। উপন্যাসটি অনায়াসে ২০০ থেকে ৩০০ পৃষ্টা পর্যন্ত করা যেত। তাই বলে এটা বলছি না লেখক তাড়াহুড়ো করেছেন। বরং এটা বলছি যে লেখক অযথা কাহিনী টেনে লম্বা করে ঢাউস সাইজের বই সৃষ্টির লোভ থেকে নিজেকে সংবরণ করেছেন। আর এটা অনেক বড় একটা গুন কিংবা সঠিক সিদ্ধান্ত। আর এই কারণের এই বইটিতে কোথাও বিন্দুমাত্র একঘেমেয়ি আসে না। ভেতরের উত্তেজনাটা টের পাওয়া যায়। উঠতে ইচ্ছা করেনা শেষ না করে।
ঠিক সেই সময়টা, যখন ভারতবর্ষে রাজতন্ত্র গুলো ভেঙে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ের রাজপরিবার গুলো তাদের ক্ষমতা হারালের রাজকীয় তেজ ও মহিমা বজায় রেখেছেন অনেকটা।
তেমনই এক ক্ষমতা হারানো তেজোদ্দীপ্ত রাজপরিবারে ছেলে বিক্রম সিংহ এর সাথে বিয়ে হয় সুবর্ণার। সুবর্ণার বাবা মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বিক্রমের বাবাকে না জানিয়ে নিজেরা বিয়ে করে প্রতাপপুর প্যালেস এ আসে তারা। শ্বশুর সংগ্রামনারায়ণ সিংহ বিয়েটা তো মানলেনই না, এমনকি সুবর্ণাকে বাড়ির নিচতলায় একটা ঘরে থাকার অনুমতি দিলেও দ্বিতীয় তলায় যেখানে সবাই থাকে বা খায় সেখানে যাবার অনুমতি দিলেন না।
একদিন সন্ধ্যার আলো আধারিতে সুবর্ণা তার মেয়ে দেবীকে নিয়ে নিচ তলার বসার ঘর থেকে উপরে যাবার সিঁড়ি তে পা দিতেই অচেন এক লোক দেবীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বাড়ীর সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। পুলিসে তাড়াকরা লোকটাকে আশ্রয় দিতে হবে, কেউ জানবে না এই দায়িত্ব টা সুবর্ণাকেই নিতে হবে। বাড়ীর সবগুলো মানুষের জীবন একটা মানুষের হাতের মুঠোয়।
এটা কোন থ্রিলার বা রোমাঞ্চকর উপন্যাস নয়, তবে পড়তে গিয়ে নিশ্বাস মাঝে মাঝে বন্ধ হবার উপক্রম। একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র যুবক পুলিশের তাড়াখেয়ে রাজপ্রাসদে আটকে পড়ে। কয়েকদিন আটকে থেকে তার নিজের যে বন্ধমূল ধারনাগুলো ছিলো তা একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে। নিষ্ঠুর নিঃসংশ একজন মানুষ কিভবে নিজের মধ্যে মায়া মমতা অনুভব করতে থাকে তা নিয়েই প্রফুল্ল রায় এর " ক্রান্তিকাল"।
অগুরুত্বপূর্ণ বই। অ্যাজ ইউজুয়াল গদগদ ভঙ্গিমায় লেখা। প্রফুল্ল রায়ের কেয়াপাতার নৌকো ট্রিলজিটা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছি। এছাড়া অন্য দু'চারটা উপন্যাস ভালো লেগেছিলো। এটা জমলো না।
প্রতাপপুর সিটির পুরোনো রাজপ্রাসাদের পুত্রবধূ সুবর্ণা। এই প্রাচীন রাজপ্রাসাদে সুবর্ণা থাকে তার মেয়ে দেবী, শ্বশুর বৃদ্ধ সংগ্ৰামনারায়ন ও দাদাশ্বশুর অথর্ব শৌর্যনারায়নের সাথে। স্বামী বিক্রমের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। সুবর্ণ��� একটি কলেজে পড়ান। রাজসিক আধিপত্য না থাকলেও খুবই সম্ভ্রান্ত ও মোটামুটি বিত্তশালী পরিবার। একদিন হঠাৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র এক যুবক পুলিশের তাড়া খেয়ে সুবর্ণাদের রাজবাড়ীতে ঢুকে পড়ে। সুবর্ণারা প্রাথমিকভাবে খুব বিপদের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু ঐ যুবকটির মধ্যে সুপ্ত চিরকালীন ভারতবর্ষের নানা মানসিক গুণের উন্মোচন হতে থাকে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় ঐ যুবকটি। টানটান উত্তেজনায় ভরা এই উপন্যাসটি।
লুৎফুজ্জামান বাবর সম্ভবত এই উপন্যাস পড়েই উৎসাহিত হয়েছিল। সেভেন সিস্টারসের দুঃখ ওই এলাকার অধিবাসী ছাড়া আর কেউ বোঝে না! সকল মুক্তিকামী মানুষের জয় হোক।