এক জোছনারাতে অপহরণকারীরা শাফায়েত কবিরকে ফেলে রেখে যায় পাহাড়ি রাস্তার ধারে। জেরা করার সময় একজন বলেছিল, ‘খেয়াল কইরেন শাফায়েত সাহেব, একটা গরু কীভাবে বাঁচে।’ কিন্তু শাফায়েত গরুর মতো বাঁচতে চায়নি। সে কারণে নজরদারি শুরু হয়ে যায়। একের পর এক অচেনা আগন্তুক আসতে শুরু করে তার বাসায়। তারা শাফায়েতকে এক ভয়ংকর খেলায় নামতে বাধ্য করে এবং একজন বলে, ‘এই খেলায় আপনি আউট হয়ে যাবেন—আউট মানে ডেথ।’মায়ের প্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, শাফায়েতের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনিও কি শাফায়েতকে অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন? খালাতো বোন নুসরাত, চন্দ্ররাতে যাকে গাছের মতো নগ্ন হওয়ার উসকানি দেয়, প্রেসের মুখোমুখি করে— সেও কি তাকে একই পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়?
রায়হান রাইনের জন্ম ৮ মার্চ ১৯৭১, সিরাজগঞ্জে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক। গল্প লেখার শুরু ছাত্রাবস্থায়, নিসর্গ ছোটকাগজে, ১৯৯৬ সালে। তাঁর ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসটি ১৪২০ বঙ্গাব্দে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
এক অদ্ভুত সময় পেছনে ফেলে এসেছি আমরা। তখন কেউ কেউ সকালে কাজে বেরিয়ে আর ফিরতো না। গভীর রাতে দরজার খিড়কি খুললেই মুছে যেতো। রাস্তার মোড়ে লাগানো সিসিটিভিতে তাদের নিখোঁজ হবার কোনো চিহ্ন থাকতো না। দেয়ালে লেপ্টে থাকতো অস্পষ্ট মুখের ছবি। নিচে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিচয় আর কোনো খোঁজ পেলে যোগাযোগের বিনীত অনুরোধ। পুলিশ বলতো,তারা জানে না। গোয়েন্দারা বলতো,তদন্ত চলছে। সরকারের কাছে তথ্য থাকতো না।
অথচ শহরের বাতাস জানতো, নিখোঁজের তালিকায় নাম কাদের। অন্ধকারে মিশে থাকা গাড়িগুলো জানতো,কারা তুলে নিয়ে যায় কালো কাঁচে ঢাকা সাদা অ্যাম্বাসেডরে। আর মধ্যরাতের মোবাইল টাওয়ারে দেখা যেতো, কে কোথায় শেষবার অবস্থান করেছিলো। তারপর একদিন নদীর চরে কিংবা মেরিন ড্রাইভের পাশে ঝাউগাছের নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে লাশ। কাউকে কাউকে কাটাতে হয় আয়নাঘর অথবা হাওয়া ভবনের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। অবিরত টর্চারের দাগ শরীরে এঁকে দিতো নির্মমতার মানচিত্র। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ একটাই—রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তে সামিল হওয়া। এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার খাঁড়া যে কোন অপরাধে মানুষের ওপর নেমে আসে তা নিয়ে সম্ভবত জল্লাদরাও বিভ্রান্ত থাকতো। হয়তো দীর্ঘদিন ধরে চলা দুর্নীতির রক্তবীজ দানবটাকে শনাক্ত করে ফেলেছে কেউ কিংবা ব্লগে ‘রুহানিয়াত,‘মজলুম’, ‘ইনকিলাব’ ধরনের শব্দগুলোর উপস্থিতি ব্লগারকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে থাকা তথাকথিত উগ্রপন্থীদের কাতারে। আর তাদের চোখমুখ বেঁধে পানিতে মাথাটাকে চুবিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা বা ক্রসফায়ারে একাউন্টার করতে পারলেই রাষ্ট্র নিরাপত্তার চৌকিদাররা হয়ে যাচ্ছিলো ‘ট্রিগার হ্যাপি’। অপহরণ-গুম-খুনের রাজনীতির শিকার এসব নিখোঁজ চেহারার বিষণ্ণ এক অনুভবচিত্রই আঁকা আছে রায়হান রাইনের ‘একটি বিষণ্ণ রাইফেল’উপন্যাসের শ্বাসরুদ্ধকর আখ্যানে।
এক জোছনারাতে অপহরণকারীরা সাংবাদিক শাফায়েত কবিরকে ফেলে রেখে যায় পাহাড়ি রাস্তার ধারে। অপরাধ? জাতীয় নিরাপত্তার অলিখিত অদৃশ্য সীমারেখা সে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিলো। জেরা করার সময় একজন বলেছিল, 'খেয়াল কইরেন শাফায়েত সাহেব, একটা গরু কীভাবে বাঁচে।' কিন্তু শাফায়েত গরুর মতো বাঁচতে চায়নি। সে কারণে শুরু হয়ে যায় নজরদারি। গলির মুখে দিনরাত দাঁড়িয়ে থাকে কপালে কাটা দাগওয়ালা এক লোক। হাতে সোনালি ব্রেসলেট। একের পর এক অচেনা আগন্তুক আসতে শুরু করে তার বাসায়। তারা শাফায়েতকে এক ভয়ংকর খেলায় নামতে বাধ্য করে এবং একজন বলে, 'এই খেলায় আপনি আউট হয়ে যাবেন -আউট মানে ডেথ।' মায়ের প্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা, শাফায়েতের গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনিও কি শাফায়েতকে অর্থহীন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন? খালাতো বোন নুসরাত, চন্দ্ররাতে যাকে গাছের মতো নগ্ন হওয়ার উসকানি দেয়। প্রেসের মুখোমুখি করে সেও কি তাকে একই পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়? যদিও নুসরাত বলে, 'আমরা ঠিক রাস্তাতেই আছি।' রাষ্ট্রখেলা শাফায়েতকে সবকিছু থেকে উৎখাত করে, এমনকি নিজের পরিচয় ও 'দেহ' থেকেও। তনুজা শারমিনের চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়ে শাফায়েত তার সেই বদলে যাওয়া 'প্রতিকৃতি' দেখতে পায়। এক জবরদস্তিমূলক রাষ্ট্র পরিস্থিতির ভেতর আত্মগোপনে থাকা শাফায়েতের নতুন নাম হয় মুনশি ইব্রাহিম। তার হাতে আসে সিন্দুকে পাওয়া একটি পুরোনো রাইফেল। তবে ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমে এসেছে তারই মতো বহু মুনশি ইব্রাহিম।
❝আপনার ক্ষেত্রেই ধরেন, বুঝতেছেন তো, আপনে যা করতেছেন, দেশবিরোধী যা যা করতেছেন, সে ক্ষেত্রে কিন্তু আরেক ধাপের খেলা শুরু হইছে। সেই খেলা, ওই দিঘির খেলা। আপনি ওই বায়োপলিটিক্যাল দিঘির ভেতর আছেন। আপনি ওই দিঘিতে মিশে যাবেন এবং পানি আপনাকে বদলায়া দেবে। দেখেন, আপনে বদলাইতে চাইতেছেন না। আর ঠিক তখন অপরাধ আপনাকে খুঁজতে শুরু করছে। খুঁজবেই। আপনি অস্ত্র কিনতে যাবেনই, নয়তো অস্ত্রটাই খুঁজে খুঁজে আপনার কাছে আসবে। আপনে কিন্তু খেলতে শুরু করছেন, যেমন আজকেও খেললেন এবং আপনি আউট হয়ে যাবেন। হবেনই, যেহেতু আপনি পানিতে মিশতেছেন না।❞
এই একেকটি সংলাপ শুধু শাফায়েত নয়, পাঠককেও টেনে নেয় রাষ্ট্রের বায়োপলিটিক্যাল খেলায়। ন্যারেটিভের ভাঙাগড়ার নিরীক্ষা না করে রায়হান রাইন এমনই ঠোঁটকাটা আপসহীন ভঙ্গিতে লিখেছেন এই উপন্যাস। প্রতিদিন ডিস্টোপিয়ার মাঝে মাঝে বাঁচতে বাঁচতে লেখাটিকে আলাদা করে ডিস্টোপিয়ান ঘরানার হয়ে ওঠার কোনো চেষ্টা করতে হয় নি। শব্দের কারিকুরি, বাক্যের ব্যারিকেড দিয়ে পায়াভারী না করে রায়হান বরং মনোযোগ দিয়েছেন একটা গল্পকে কীভাবে নির্ভার অথচ ভীষণ এনগেজিং করে তুলতে হয় সেদিকে। ব্রিদিং স্পেস কম,আঁটোসাটো। অজস্র স্বপ্নদৃশ্য , মনোলগ,হ্যালুসিনেশনের ধোঁয়াশাপূর্ণ বিভ্রম থাকলেও তা কোথাও পাঠককে বোর করে না। বরং থ্রিলারের মতোই গতিময় এই উপন্যাস। বাস্তবের নখ-দাঁত বের করা রাজনীতির মাঝে দার্শনিক প্রশ্ন,পেইন্টিং ঢুকে গেছে খুব অনায়াসভঙ্গিতে। সুসংহত, মাপা কনস্ট্রাকশনের মাঝেও রায়হানের গদ্যভাষা এক ধরনের ঘোর তৈরি করে। নদীচরের চন্দ্রগ্রস্ত নরনারীদের মতো বোধ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টরুম কালচার, কাঠি দিয়ে ঘর মাপানোর মতো র্যাগিংয়ের বীজ কীভাবে রাষ্ট্রের দমনপীড়নমূলক রাজনীতির খেলোয়াড়দের জন্ম দেয় সেই প্রবণতাকে লেখক দেখিয়েছেন ভীষণ সূক্ষ্মভাবে। যেন জমিতে রোপন করা একই রকম বীজ থেকে তাদের জন্ম। এরা দুর্যোধনের শত ভাই। একই অভ্যাসের পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছে একে অন্যের ফটোকপি। আর একই শর্তের মধ্য দিয়ে ঘটেছে তাদের পুনরাগমন।
❝ঘুমিয়ে কী হবে? পরিস্থিতির একই রকম জ্বর নিয়ে আবার জেগে উঠতে হবে। রাতের মধ্যে আকস্মিক এমন কিছুই ঘটবে না যা তোমার আগামীকালকে বদলে ফেলবে। তোমার কিছুই নতুন করে শুরু হবে না। কিন্তু দেখ, সবকিছুই কত আকস্মিক!❞
এমন আকস্মিক কিছু কিছু ঘটনাই লেখক দেখান উপন্যাসের ট্রিগার পয়েন্ট হিসেবে। তবে কোনো হিসাবেই তা ডিউস এক্স মাকিনা হয় না। দোকানের ভিতর অজস্র পুতুলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু,পূর্ণিমায় চাঁদের আলোর নিচে দৃশ্যবিদ্ধ নরনারী কিংবা রাজহাঁসের মতো বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো দৃশ্যকল্পগুলোর পুনঃপুন নির্মাণ করলেও তার কোনোটাই অহেতুক বলে মনে হয় না। এই উপন্যাসে খুব সহজেই বিগত সরকারের ছায়া দেখা যায়। সেইসব গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যেই শাফায়েত একজন, যে কিনা নিজেকে আত্মগোপনে গিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবে কী হতো যদি সে নতি স্বীকার করতো? তার দায়িত্বে খুবই সৎ, একলব্যের মতো একনিষ্ঠ। তাই সে নতি স্বীকার করে না বারবার মৃত্যুকে দু’হাতে আলিঙ্গন করেও। তাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম পন্থাটাই রাষ্ট্র বেছে নেয় বারবার। কিন্তু এরপরও সে বেঁচে যায়। আর উপন্যাসের শেষে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিক ডিটেইলস ব্রড ব্রাশস্ট্রোকে ফুটে ওঠে। আবারও সেই আকস্মিকতাই হয়ে ওঠে প্রধান ড্রাইভিং ফোর্স।
সাম্প্রতিক সমকালীনতা তপ্ত সব ঘটনাবলিকে লেখক বেছে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা শেষমেশ সাম্প্রতিকতা থেকে মুক্তি পেয়ে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভকে স্পর্শ করে। ফলে ‘একটি বিষণ্ণ রাইফেল’-কে কোনো নির্দিষ্ট টাইমফ্রেমে আটকানো যায় না। যেকোনো সময়ে আদতে রাষ্ট্র তো এরকমই। সে তার মতের বাইরে কাউকে সহ্য করে না। ভিন্নমতের মানুষকে একঘরে করে পুরে ফেলতে চায় খাঁচায়। সব রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই শাফায়েত কবিরের মতো মানুষ আছে যারা ভেঙে যেতে চায় না, ���ুখে দাঁড়ায় যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে। তারাই আমাদের স্বপ্ন দেখায়, অনুপ্রেরণা দেয়। আর তখন কেউ কেউ হয় হুইসেলব্লোয়ার। কেউ কেউ দাঁড়ায় রাইফেলের টার্গেটে বুক পেতে দুদিকে হাত ছড়িয়ে। এই ধরনের মানুষগুলোর কারণেই একদিন মানুষের অবদমনের অবসান হয়। তারা নিজেদের হারানো ভাষা খুঁজে পায়। কথা বলতে শেখে। আর সমাবেত কণ্ঠে ফ্যাসিবাদী নীরবতাকে ভেঙে দেয়।
‘একটি বিষণ্ণ রাইফেল’ আমাদের ডিস্টোপিয়ান বাস্তবতার দরজায় কড়া নাড়ে না—তা ভেঙেই ফেলে। যারা সত্যিই সাহস করে দেখতে চান রাষ্ট্রের খোলসের ভেতরকার জৈব-অপরাধের চেহারা, তাদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পাঠ।
দেশের ক্রান্তিকালের পর আলোচনায় আসার মতন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই। সচরারচর এসব বই সরলরৈখিকভাবে এগোয় কিন্তু রায়হান রাইন ভিন্ন এক ধাঁচে লেখার যে প্রয়াস রেখেছেন তা প্রশংসনীয়। ডকু ফিকশনের ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে গভীর উপন্যাসের খাপে লেখা গুরুত্বপূর্ণ এই লেখাটি সকলের পড়া উচিত, আলোচনা করা উচিৎ।