গল্পটা আলোর, অন্ধকারের কিংবা প্রেমের কিংবা বিকৃতির।
সুলতানপুর এক ছোটো, শান্ত মফস্বল শহর। এই শহরে পা রাখে কিশোর বয়সী রোদ্রময়ী সেন ওরফে রুনু। যার বাবা নিরুদ্দেশ, মা মৃত। বন্ধুত্ব হয় কাছাকাছি বয়সী শাহেদের সাথে। শহরে একের পর এক মেয়ে হারিয়ে যেতে থাকে। শাহেদের সহপাঠী লাবনীও হারিয়ে যায়। মেয়েটা হারিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে দায়ী করতে থাকে শাহেদ। একসময় হারিয়ে যায় শাহেদও। এক অন্ধকূপে। শাহেদ কী ফিরে আসতে পেরেছিল সেই অন্ধকূপ থেকে? রুনুর জীবনে ঠিক কী হয়েছিল? বৃদ্ধ দাদু-দিদা’র সাথে থাকতে থাকতে রুনু কী খুঁজে পেয়েছিল বেঁচে থাকার ঠিকানা। সোমা চক্রবর্তী এতোগুলো বছর পর পালালো কেন জয়ন্ত সেনের সাথে? আশ্চর্যময়ী কে? লাবনী, সোমা না রুনু? ‘ছায়া সময়’ ‘যেখানে রোদেরা ঘুমায়’ ও ‘বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ’ খ্যাত শরীফুল হাসানের আরেকটি অনন্য আখ্যান ‘আশ্চর্যময়ী, তোমাকে’।
Shariful Hasan hails from Mymensingh, Bangladesh. He has spent his childhood by the banks of Brahmaputra river. He completed his Masters in Sociology from University of Dhaka and is currently working in a renowned private organization.
Shariful's first novel was published on 2012 titled Sambhala. With two other books, this captivating fantasy trilogy has received widespread acclimation both within and beyond the borders of Bangladesh. The Sambhala Trilogy was translated in English and published from India.
Although his inception consisted of fantasy and thriller, he has later worked on a variety of other genres. These works have been received fondly by the Bangladeshi reader community. Lot of his works have also been published from different publications in West Bengal.
Award- Kali O Kalam Puroshkar 2016 for 'অদ্ভুতুড়ে বইঘর'
বড় পরিসরে শরীফুল হাসান বরাবরই ভালো লেখেন। "আশ্চর্যময়ী, তোমাকে"র শুরুতে ধারণা করতে পারিনি সুলতানপুর নামক ছোট্ট এক শহরের সাধারণ দুই কিশোর কিশোরীর উপাখ্যান পরবর্তীতে এতোটা উত্তেজনাপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক হবে। পুরো গল্পের বুনন, চরিত্রগুলোর সংগ্রাম , ক্রমপরিণতি আর একের পর এক টুইস্ট বেশ উপভোগ্য। প্রধান চরিত্র রোদ্রময়ী আর শাহেদের পাশাপাশি ছোটখাটো প্রতিটা চরিত্রকেই লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদের জীবনকেও মমত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন - এটা আরেকটা ইতিবাচক দিক। একদম শেষ টুইস্টের পর অতিমানবীয় নৈপুণ্যে ভরা ক্লাইম্যাক্স নিয়ে অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে অবশ্য। উপসংহার এতো নাটকীয় না হলেও গল্পের কোনো ক্ষতি হতো না।
আমার ধারণা এই বছরে যদি আরো একশোটা বইও পড়ি, এটা পছন্দের দিক দিয়ে প্রথমেই থাকবে। স্মল টাউন মিস্ট্রি, সাথে শরীফুল হাসানের ট্রেডমার্ক রোমান্স। দু'টোর চমৎকার মিশ্রন পুরো অভিজ্ঞতাকে করে তুলেছে দারুণ উপভোগ্য। শেষটা মনে থাকবে দীর্ঘদিন। রুনু, শাহেদ, বিশ্বজিৎ, রাহেলা, অসিত, অনুপম, জয়ন্ত- এরাও আমার সাথে রয়ে যাবে লম্বা সময়।
শরীফুল হাসানের ‘আশ্চর্যময়ী, তোমাকে’ উপন্যাসটি শুধু একটি গল্প নয়, বরং এটি ভালোবাসা, অপেক্ষা, বিষণ্নতা, অভিমান ও মানব মনের জটিলতার এক অসাধারণ প্রতিচ্ছবি। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মানবসত্তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে, পাঠকের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটেছে।
গল্পের কেন্দ্রে আছে শাহেদ, যে নিজের অতীতের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু স্মৃতি তাকে বারবার টেনে ধরে। রুনু, যে একদিন তার জীবনে আলো নিয়ে আসে, কিন্তু সেই আলোও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। এই উপন্যাসে ‘অপেক্ষা’ যেন এক চরিত্র হয়ে উঠেছে—কেউ অপেক্ষা করছে প্রিয়জনের ফিরে আসার জন্য, কেউ অপেক্ষা করছে জীবনের স্থিতিশীলতার জন্য, আবার কেউ অপেক্ষা করছে একটি ‘ক্লোজার’-এর জন্য।
লেখক খুব সহজ, অথচ গভীর ভাষায় গল্প বলেছেন, যা পড়তে পড়তে কখনো আনন্দ দিয়েছে, কখনো চোখ ভিজিয়েছে, কখনো হতাশায় ডুবিয়েছে। আশির দশকের মফস্বল জীবন, সামাজিক বাস্তবতা, ৭১-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং মানুষের ভেতরের আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্ব সব মিলিয়ে উপন্যাসটি এক অনবদ্য শিল্পকর্ম হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। শাহেদ, রুনু, বিশ্বজিৎ, রাহেলা বেগম – প্রতিটি চরিত্রের গভীরতা পাঠককে মুগ্ধ করবে। গল্পের ছন্দময় গতিশীলতা, বাস্তবতার সংমিশ্রণ, এবং আবেগের সূক্ষ্ম পর্দা একে সত্যিকারের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছে।
লেখকের আগের কিছু কাজের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, তিনি সমকালীন সামাজিক বাস্তবতা ও থ্রিলারের সংমিশ্রণে এক নতুন ধারা তৈরি করেছেন। উপন্যাসের শেষের অংশটি অত্যন্ত গুছিয়ে আনা হয়েছে,এটি এক অসাধারণ সাহিত্যকর্ম।
‘আশ্চর্যময়ী, তোমাকে’ শুধুই একটি উপন্যাস নয়, এটি জীবনের গল্প, অনুভূতির গল্প, মানব মনের অদ্ভুত সব বাঁকের গল্প। যারা জীবনঘনিষ্ঠ গল্প পছন্দ করেন, তাদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি অবশ্যপাঠ্য বই।
বইয়ের বাইরের কথা:
বইটি নিয়ে কোনো প্রচারণা বা আলোড়ন দেখা যায়নি। লেখক নিজেও কোনো ধরনের মার্কেটিং করেননি, আর প্রকাশকও নীরব ছিলেন। অথচ শরীফুল হাসান এমন একজন লেখক, যিনি বাংলাদেশের সাহিত্যে—বিশেষত সামাজিক উপন্যাস ও থ্রিলার ঘরানায়—গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি যেন চুপচাপ, নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতি বছর মাত্র একটি বই প্রকাশ করেন। প্রকাশকদের তার প্রতিভাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো উচিত ছিল। আমাদেরও উচিত বেশি করে বই পড়া, ভালো লেখকদের কাজকে মূল্যায়ন করা।
শরীফুল হাসান একটা ভিন্নরকম গল্প বলতে চেয়েছেন এবং সে কারণে তার এই চেষ্টাটাকে ধন্যবাদ জানানো যেতেই পারে। তবে তিনি বিশাল কলেবরের উপন্যাসে যে সময়টাকে ধরতে চেয়েছিলেন আমার পড়ে মনে হয়েছে তিনি সেটা পারেননি। বইয়ের সময়কাল ৮০'র দশকের আশেপাশে অথচ পুরো বইতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা লাইনও নেই। হ্যাঁ, এটা মুক্তিযুদ্ধের বই নয়, সেটা আমি জানি। তবে কিছু কিছু ব্যাপার থাকে যেগুলো প্রচ্ছন্নভাবে পাঠককে বোঝায় কোন টাইমলাইনে বই চলছে। ৭০-৮০'র দশক অথচ সেখানে মুক্তিযুদ্ধের মত একটা ব্যাপার নেই, একটা কন্টেম্পোরারি বইয়ে এটা মানা যায়? সময় ধরতে না পারার আরেকটা উদাহরণ দিই। বইয়ে বিভিন্ন চরিত্র দেখলাম ইংরেজিতে প্রচুর কথা বলছে। আমি আমার বাবা মা বা তাদের চাইতে বয়স্ক মুরুব্বিদের মুখে ইংরেজি খুব কম শুনতাম, এই ২০১০ সালের আগেও। সেখানে এ বইয়ের চরিত্র ৭০-৮০'র দশকে দাঁড়িয়ে বলছে, 'ও তো আমার বজম ফ্রেন্ড', 'কেস ওপেন করবো' ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কাছে সমকালীন উপন্যাস তখন সার্থক হয়ে ওঠে যখন সেটা জীবনের একটা অংশ হয়ে যায়, এমন না যে আমি যে জীবন চিনি সে জীবন না হলে আমার কাছে জীবন না। অন্য গল্পও আমার কাছে জীবনই হয়, যদি সেটা আলাদা করে কোনো গল্প মনে না হয়। শরীফুল হাসান হয়তো সুন্দর একটা উপন্যাস লিখতে চেয়েছেন। আমার কাছেও সেটা 'উপন্যাস'ই থেকে গেছে, 'জীবনের গল্প' হয়ে ওঠেনি।
বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণের পর, এই বইটা অসাধারণ লাগলো। বড় পরিসরে লেখক খুব বেশি সুন্দর লিখেছেন। চরিত্রগুলোতে হারিয়ে গিয়ে কখন যে ওদের কষ্টে চোখ ভিজিছে, আবার কখনো লেখনীর সাবলীলতা মুগ্ধ করেছে😊 রোমান্টিক ঘরানার মিস্ট্রি 👌 রৌদ্রময়ী সেন- রুনু🫶
এটাকে আমি সমকালীন বলবো, নাকি থ্রিলার বলবো, নাকি একটু ড্রামাটিক বলবো জানিনা। কিন্তু পড়তে ভালো লেগেছে। কতো জীবন দেখে ফেললাম!
শহরের একটা ছেলে, যার সামনে পুরো পৃথিবী উন্মুক্ত, কিন্তু সে অনেক কারণেই নিজেকে মেলে ধরতে পারেনা। সেটা বাবার হারিয়ে যাওয়া, কিংবা হীনমন্যতা, কিংবা কিশোরের খেয়াল কিংবা সব।এই ছেলের জীবনের অধ্যায়ে নতুন এক নাম আসে,রুনু ওরপে রোদ্রময়ী। চুপচাপ জীবনের বন্ধু হয়ে আসে সে। মেয়েটার বাগানের শখ জাগে।আর জাগে কালো গোলাপের লোভ। সেই কালো গোলাপই কাল হলো। যে সামনের বেঞ্চির মেয়েটি গ্রাফাইটে বন্দী থাকতো, সে হঠাৎ করে হারালো। সে কেনো, একসময় ছেলেটিও হারালো। আবার ফিরেও এলো। কিন্তু সময় যেনো আটকে গেলো। সেই কাগজের মেয়েটির অস্তিত্ব খুঁজে বের করতেই কতো জীবন পার করলো!শুধু মেয়েটি না, আ্শেপাশের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ডাক হয়তো পেয়েছিলো ছেলেটি। কিংবা রুনুর সাথে কালো গোলাপ আনতে যাওয়ার অপরাধবোধ।
আমি রিভিউ দেই বলে মনে হয়না। আমি বলি আমার কেনো বইটা ভালো লেগেছে কিংবা কোন জায়গার সাথে আমি রিলেট করতে পেরেছি। মানি যে, এই প্ল্টের মতোন আমি ক্রাইম পেট্টোল কিংবা সিরিজে কাহিনী দেখেছি৷ তাও আমি এক মুহুর্তের জন্য ফেলে রাখতে পারিনি। চরিত্রগুলো এতো জীবন্ত মনে হয়! যেনো আমি রুনুর সাথে বাগান করছি,কিংবা তার অসহায়ত্ব সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছি। গল্পের ছেলেটি, মানে শাহেদের আটকে যাওয়ার বিষয়টা যেনো আমাকেও কুরেকুরে খাচ্ছিলো।পিউর ফিকশনাল আনন্দ দিয়েছে আমাকে বইটি। আমি কেঁদেছি, আঁতকে উঠেছি,আবার চরিত্রগুলোর সাথে সাথে আমিও যেনো হালকা অস্বস্তিতে ভুগেছি। অবশ্য লেখকের কাছ থেকে এমনই আশা করি।
বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ আমার অনেক পছন্দের ৫/৫! এই বইটা মাঝে একটু স্লো বইটা ৩০০ পেজে করা যেতো। কিন্তু অপেক্ষা জিনিস টা এতো টাচি করে তুলে ধরেছেন, বিরক্ত হওয়া ছাড়াই পুরো বই পড়ে শেষ করেছি। সামাজিক থ্রিল ছিল ভালোই, পাঠকদের ভালোই ফিল দিবে।কিন্তু শেষে বেশি সিনেম্যাটিক, আর তার চেয়েও বড় কথা খুনিদের মোটিভ কোনো সেন্স মেক করে না।
কিন্তু সমাজের পীড়ন, স্কুল জীবনের নস্টালজিক ম্যামোরিজ এগুলা সেরা ছিল 👌
বেশ লম্বা একটা বিরতির পর শরীফুল হাসানের লেখা পড়লাম। মাঝখানে এই বিরতিটাই শাপে বর হলো। আমি আবারো হারিয়ে গেলাম বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণের সেই ট্রেডমার্ক বিষণ্নতায় কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণকে লেখক টপকাতে পারে নাই দেখে খুশি হয়েছি।
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসাকে উপজীব্য করে বহু লেখকই গল্প লেখেন কিন্তু শরীফুল হাসান এটাকে রীতিমতো শিল্পের কাতারে নিয়ে গেছেন বলে আমি মনে করি। পাঠক শুরুতেই জানে এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যত নেই তবুও আশায় বুক বাঁধে, জিইয়ে রাখা ধর্মের বোধ তখন পাঠকের মনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “আদৌ চাওয়া ঠিক হচ্ছে তো?” - গল্প তার স্বগতিতে এগিয়ে চলে।
উপন্যাসের শুরু ১৯৭৪ সালে। শেষ ১৯৯৪। গল্পটা শাহেদ আর রৌদ্রময়ীর কিংবা চার বিকৃত মানুষের যাদের কারো কাছে নারী-শরীর মানেই একদলা গরম মাংস কিংবা কারও নারী-পুরুষের মাঝে একটা হলেই হলো। সমকামিতার এই বিষয়টাকে বিকৃত বলেই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে তার সাথে বৈবাহিক ধর্ষণের একটা কনসেপ্ট তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক রুনু-বিশ্বজিৎ চরিত্রের মাধ্যমে। “বৈবাহিক ধর্ষণ”- টার্মটা যথেষ্ট কন্ট্রোভার্সিয়াল। এটাকে গড়পড়তা সকল সম্পর্কের মাঝে টেনে আনাটা যেমন দূষনীয় পাশাপাশি আমরা বিয়ের সময় যে মেয়েদের কনসেন্টের কোনো তোয়াক্কা করি না আমাদের সমাজে (হোক মুসলমান কিংবা হিন্দু সমাজ) সেটারও প্রতিনিধিত্ব করে। মুসলমানের ধর্মে তো স্পষ্টতই বলা আছে, মেয়েদের বিয়ে নিয়ে জোরজবরদস্তি না করতে, এবং পার্টনারের বিষয়ে আগে থেকেই সম্মতি আছে কিনা সেটা জেনে নিতে। যদিও এসব কোর জিনিসপাতি আমাদের সমাজে কিংবা এই উপমহাদেশে এতটা মানা হয় না। লেখকের এই দুটো বিষয়কে উপন্যাসের মধ্যে ইনক্লুড করাটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার বলে মনে করি।
শরীফুল হাসানের লেখা নিয়ে তো আলাদা করে বলার কিছু নেই। শেষের দিকে অবশ্যই অতিমানবীয় কিছু জিনিসপাতি আছে কিন্তু সেগুলোর বর্ণনা মোটেও ক্লিশে ছিল না। শরীফুল হাসান এসব ক্রাঞ্চ মুহুর্ত গুলোকে দারুণভাবে পোট্রে করতে পারেন। পুরো উপন্যাসটাই কালো গোলাপের বাটারফ্লাই ইফেক্ট। পুরো বই-ই ছিল বিষাদময়। সেই বিষাদ শেষে পাতায় গিয়ে হাহকারের উদ্রেক ঘটায়।
আমি ওতো গুছিয়ে কোনো বইয়ের রিভিউ লিখতে জানি না, যা লিখি সবটাই লেখার সময় একের পর এক যা মনে আসে তাই উঠিয়ে দিই। শরীফুল হাসান ঢাউস সাইজে গল্প বলায় দূর্দান্ত। তবে আমি অনুরোধ করবো লেখক যেন পরের ঢাউজ সাইজের কোনো বইয়ে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক টা এড়িয়ে যান। নাহয় একঘেয়ে চলে আসার একটা বিষয় চলে আসবে তখন। আমি চাই না উনার এই ট্রেডমার্ক রোমান্সটা নষ্ট হোক।
Ratings: 4.5/5 7:20 PM; Thu, May 1.
This entire review has been hidden because of spoilers.
সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না — এই প্রবাদটা তো আমরা সবাই শুনেছি।
কিন্তু এই প্রবাদের সাথে কিঞ্চিৎ দ্বিমত আমার আছে। সময় ও নদীর স্রোতের পাশাপাশি জীবনও কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নিজের নির্দিষ্ট গতিপথে এগিয়ে যায়। পিছে ফেলে যায় হাজারো গল্প। যাকে আমরা অতীত বলে অবিহিত করি।
অতীত আবার কখনও সময়কে থামিয়ে দেয়। সেই থেমে যাওয়া সময়ের বৃত্তে মানুষ ঘুরপাক খায়। জীবনের গতিময় পথে খাবি খেতে খেতে খোঁজার চেষ্টা করে নিজেকে বা প্রিয় কাউকে। পেতে গিয়েও পাওয়া হয় না। কারণ যারা একবার হারিয়ে যায়, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা বৃথা!
“আশ্চর্যময়ী, তোমাকে” এমন এক হারানোর গল্প, যা হয়তো এক বা একাধিক জীবনকে অন্যরকম করে দিয়েছে। জীবনে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির সংখ্যাটাই বেশি। কত ঝড়ঝাপ্টা আসে, তাকে পেরিয়ে যাওয়া যায় না। একটু থিতু হওয়ার চেষ্টা করলে, নতুন কোনো ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যেতে হয়।
এ গল্পটা আসলে কার? রুনু, না-কি শাহেদের? শাহেদ আর রুনুর মধ্যে একটা মিল আছে। দুইজনের বাবা-ই হারিয়ে গিয়েছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোথায় চলে গিয়েছে কেউ জানে না। স্বামীর অপেক্ষা করতে করতে শাহেদের মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। সংসারের অবনতি, মায়ের অসুস্থতা, সব মিলিয়ে শাহেদ নিজেও স্বাভাবিক হতে পারেনি। যার কোনো বন্ধু নেই। পড়াশোনায় মন নেই। স্কুলে পেছনের সারিতে বসে। কেউ খেলায় নিতে চায় না। শুধু একটা গুণই শাহেদের আছে, সে চমৎকার ছবি আঁকতে পারে।
অন্যদিকে রুনুর গল্পটা ব্যতিক্রম। বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন মা ছিলেন, দিদা ছিলেন। একসময় সৃষ্টিকর্তার ডাকে দুইজন যখন ওপারে পাড়ি জমান, তখন থেকেই রুনুর বদলে যাওয়া জীবনের শুরু। মেজো ও ছোটো কাকা রুনুকে ভালোবাসলেও, বাবা-মায়ের না থাকা একটা মেয়েকে পেলে পুষে বড় করার দায় কেউ নাইট চায় না। তাই বড় শহর থেকে নানা নানীর কাছে মফস্বল শহরে আগমন হয় তার।
সেখানেই পরিচয় হয় শাহেদের সাথে। শাহেদের মা রুনুকে পেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। বান্ধবীর মেয়েকে কাছে পেয়ে সব দুঃখ ভুলে থাকার একটা ছোট্ট প্রয়াস রাহেলা বেগমের। শাহেদ কারো সাথে না মিশলেও রুনুর সাথে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। বন্ধুত্বও গভীর হতে থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকলে, বড় হতে থাকলে অনুভূতিগুলোও পরিবর্তন হয়। কিন্তু এই মফস্বলে ছেলে ধরার গল্প এসে বদল�� দেয় একাধিক জীবনের অনুভূতি।
শাহেদের ক্লাসমেট লাবণী হারিয়ে যায় ছেলেধরার ফাঁদে পড়ে। শাহেদ যে জন্য নিজেকে দায়ী করে। লাবণীর বাবাও মেয়ের হারিয়ে যাওয়ার জন্য শাহেদকেই দায়ী করে। কিন্তু শাহেদ কী করেছে? সে-ও যে হারিয়ে যায় একদিন। আবার ফিরেও আসে। নিতান্তই ভাগ্যের জোরে। অন্ধকূপে থাকার সময়টা শাহেদের ভুলতে পারে না। তার সামনের লক্ষ্য একটাই, লাবণীকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হব��।
অল্প বয়সের প্রেম পূর্ণতা পায় সামান্যই। সোমার সাথে জয়ন্তর প্রেম ছিল। কিন্তু জয়ন্ত রবিনহুড হওয়ার দরুন অন্য জায়গায় মালা বদল করে সোনা। একদিন জয়ন্তর সাথে পালিয়ে যায় সোমা। তারপর? সোমা কি ফিরে এসেছিল?
সশস্ত্র বিপ্লবে ধনীদের অর্থ কেড়ে নিয়ে গরিবদের দান করা জয়ন্তকে খুঁজছে তারই বন্ধু অনুপম। সোমার সাথে জয়ন্তর প্রেমে সবচেয়ে আঘাত পেয়েছিল সে। কারণ সোমাকে যে ভালোবাসত অনুপম। এই গল্পে অনুপমের ভূমিকা কী? বাদল দাস-ই বা কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? ফরিদ মামার যে অন্ধকার দিক শাহেদ জেনেছে, তা কি আসমা মামীকে জানিয়ে দিবে? নিজাম মামা কোথায় হারিয়ে গেল? হরিণের মুখোশ পরা সেই লোকটি কে? বিশ্বজিৎ রুনুকে পাওয়ার জন্য কতদূর যেতে পারে? যদি ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা না পাওয়া হয়, তাহলে?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কে এই আশ্চর্যময়ী? রুনু, লাবণী, সোমা? না-কি অন্যকেউ?
◾পাঠ প্রতিক্রিয়া :
সামাজিক উপন্যাসের সাথে রহস্য ও কিঞ্চিৎ থ্রিলারের যে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যে নতুন জনরার আবির্ভাব শরীফুল হাসান ঘটিয়েছেন, তাকে সামাজিক থ্রিলার হিসেবে অভিহিত করাই যায়!
“আশ্চর্যময়ী, তোমাকে” এমনই এক সামাজিক থ্রিলার। যেখানে সমাজের গল্প বলা হয়েছে। বলা হয়েছে জীবনের গল্প। জীবন তার আপন স্রোতে বয়ে যায়। যে স্রোতে ভেসে রহস্য আসে। সমাজের অন্ধকার দিক, মানুষের অন্ধকার অনুভূতিগুলো ফিরে ফিরে আসে। যা হয়তো এই সমাজে খুব বেশি বাস্তব। কিন্তু এই অন্ধকার দিকগুলোর আলোচনা তেমন হয় না। ভুক্তভোগীরা নীরবতা পালন করে বলেই হয়তো, তারা আড়ালে থেকে যায়। নানান অপকর্ম করে।
শরীফুল হাসানের লেখার ভীষণ ভক্ত আমি। তার লেখার মধ্যে এক ধরনের নিজস্বতা আছে। এই নিজস্বতায় তিনি গল্পকে এক ভিন্ন ধরনের গাঁথুনি দেন। যে গল্প স্বমহিমায় এগিয়ে চলে। এখানে লেখকের কোনো জোর থাকে না। নিজস্ব গতিতে গল্প তার লক্ষ্য খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে।
আমি লেখকের বর্ণনা আমাকে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়। তার লেখায় অদ্ভুত এক বিষন্নতা আছে। যে বিষন্ন বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে সবকিছু। পরিবেশ, প্রকৃতির যেরূপ বর্ণনা তিনি দেন; পড়তে মধুর মনে হয়। সেই সাথে প্রাণ সঞ্চার করেন প্রতিটি মুহূর্তে। পাঠকের সাথে গল্পের সংযোগ স্থাপন করতে পারেন বলেই লেখকের লেখা ডুবে যেতে অসুবিধা হয় না।
“আশ্চর্যময়ী, তোমাকে” মূলত আশির ও নব্বই দশকের ঘটনা। সেই সময়ের ঘটনা ফুটিয়ে তুলতে হলে সেই সময়টাকে ধারণ করতে হয়। লেখক খুব দক্ষতার সাথে সেই কাজটি করেছেন। সেই সময়কালের হালচাল তুলে এনেছেন। যেহেতু ১৯৭৫ সালের সময়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, এসেছে আগষ্ট মাসের ঘটনাও। যদিও ঢাকার আঁচ মফস্বলে তেমন প্রভাব ফেলে না।
বইটিকে লেখক তিনটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রতিটি পর্বের মাঝে দুই থেকে তিন বছর একটা দুরত্ব রয়েছে। এই সময়কাল অনেক ছোট, কিন্তু অনেক কিছুই বদলে যায় এই সময়ের মাঝে। সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ পরবর্তী ঘটনার সাথে যেভাবে সংযুক্ত হয়েছে, দারুণ! বইটিতে কিছু ডার্ক এলিমেন্ট রয়েছে। ঘটনাপ্রবাহ সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। তবে সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, এই ডার্ক বিষয়গুলো লেখক সরাসরি বর্ণনা করেননি। তিনি পাঠকের অনুভূতির উপর ছেড়ে দিয়েছেন। পাঠক বুঝে নিবে, আসলে কী ঘটেছে। বা ঘটছে। অন্য কোনো লেখক হলে হয়তো সরাসরি লিখে দিতেন। কিন্তু এই কাজ লেখক করেননি বলে তার একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য।
লেখকের লেখায় একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। কোনো অধ্যায় শুরুর সময় লেখক সরাসরি ঘটনায় যান না। তিনি রহস্যের আবহ ও বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা করেন। এই বিষয়টা ভালো লেগেছে। এতে করে একটা রহস্যের আবহ থাকে, সেই সাথে পাঠকও আগ্রহী হয় ঘটনা জানার প্রতি। ফলে পড়ার গতিও বৃদ্ধি পায়।
একটি উদাহরণ দিই — কোনো একজন অপহ রণ হলো। কিন্তু লেখক সরাসরি সেই বিষয় বলেননি। তিনি একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। কিছু একটা ঘটেছে, সেই আভাস দিয়েছেন। যেমন যে অপহরণ হয়েছে, তার ছবি একজন আঁকছে। কিন্তু কেন এভাবে আঁকছে? পাঠক যখন এই চিন্তায় ডুবে যাবে। তখন লেখক বুঝিয়ে দিবেন সেই মেয়েটি আসলে হারিয়ে গিয়েছে। ক্লিফহ্যাঙ্গার অধ্যায়ের শেষে থাকে, কিন্তু লেখক ক্লিফহ্যাঙ্গার দিয়ে যেভাবে শুরু করেছেন আমার কাছে অনবদ্য লেগেছে। পড়তে ভালো লাগার আরেকটি কারণ এটি।
আগেই বলেছি লেখক এই বইটির মধ্য দিয়ে মানব মনের অন্ধকার অলিগলিতে ঘুরে এসেছেন। আমাদের চারপাশের স্বাভাবিক মানুষ আদতে স্বাভাবিক কি না, এই প্রশ্ন এলেও আসতে পারে। কার, মনে কী চলছে আমরা তো জানি না। যখন জানতে পারি, বিশ্বাস হতে চায় না।
একজন মানুষের জীবনে যত উত্থান পতন থাকে, এক বইতে লেখক সবটা তুলে এনেছেন। ভালোবাসার দুই প্রান্ত একসাথে দেখিয়েছেন। কেউ ভালোবাসে মন থেকে, কারো ভালোবাসা হয় জোর করে আদায়ের চেষ্টা। মানুষ যেভাবে জীবনের প্রতিটি পদে বাঁধার সম্মুখীন হয়, প্রিয়জন হারিয়ে যায়; সবকিছুকে লেখক এখানে উপজীব্য করে তুলেছেন।
এখানে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে, মানুষের সাথে খারাপ কিছু হলে তা মনে দাগ কাটে। যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। লক্ষ্য তখন এর প্রতিশোধ বা সত্য উন্মোচনের হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক মনে হয় বই লেখার ক্ষেত্রে একটা ব্রত নিয়েছেন, তিনি যাকে পাবেন তাকেই মে রে ফেলবে। কেউ বেঁচে থাকবে না। এই বইটি তার উদাহরণ হয়ে থাকবে। শেষটা সকল রহস্যের, সব ধরনের প্রশ্নের যবনিকাপাত ঘটিয়েছেন। সবশেষে লেখকের সিগনেচার স্টাইলে মৃত্যুর মিছিল।
তবে ভুলত্রুটি যে ছিল না, এমন না। কিছু দৃশ্য বেশ সিনেমাটিক লেগেছে। একটু বেশি অতিরঞ্জিত। সেসব অংশে ন্যাচারাল আবহ কম ছিল। ১৯৮৫ সালের দিকে এক মফস্বল শহরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লিফট ছিল কি না আমার জানা নেই।
◾চরিত্র :
একটি গল্পের এক বা একাধিক মূল চরিত্র থাকে। “আশ্চর্যময়ী, তোমাকে” গল্পের মূল চরিত্র হয়তো আপনি রুনু কিংবা শাহেদকে ধরতে পারেন। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে উপলব্ধি করবেন, এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই মূল চরিত্র।
সে হতে পারে রাহেলা বেগম, অসিত সেন, অলকানন্দা। কিংবা হতে পারে বিশ্বজিৎ, ফরিদ মামা, অনুপম, আসমা মামী, বাদল দাস। প্রতিটি চরিত্র লেখক যেভাবে দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন, এখানেই লেখকের মুন্সিয়ানা। কিছু কিছু চরিত্র গল্পের প্রয়োজনে এসেছে, আবার প্রয়োজন মিটিয়ে হারিয়ে গিয়েছে।
আবার কেউ কেউ আছে, যারা না থেকেও অনেকটা জুড়ে গুরুত্ব রেখেছে। লাবণী কিংবা জয়ন্ত তাদের মধ্যে অন্যতম। কিংবা সোমা। তাদের অস্তিত্ব খুব একটা ছিল না। তবুও অনেকটা অংশ জুড়েই তারা ছিল গল্পের প্রাণ হয়ে।
একটি গল্পের চালিকাশক্তি চরিত্র। তাদের যখন দুর্দান্ত প্রতাপে ফুটিয়ে তোলা যায়, বইটিও আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এখানে চরিত্রগুলোর মানসিক দিকও লেখক চেষ্টা করেছেন স্বতন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে। শাহেদের যে মানসিক ভাবভঙ্গি, তার সাথে রুনুর মিলবে না। কেননা দুইজনের একাকীত্ব দুই ধরনের। তাদের অনুভূতি ভিন্ন। এভাবে প্রতিটি চরিত্র, তাদের আলো কিংবা অন্ধকার পর্যায় লেখক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তুলে ধরেছেন।
ফরিদ মামা, অনুপম কিংবা হরিণের মুখোশ পড়া মানুষটার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এখানে এক অন্ধকার পর্যায় উন্মুক্ত করে। বইতে থাকা প্রতিটি চরিত্র পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খুব বেশি মানিয়ে গিয়েছে। আরোপিত মনে হয়নি। ফলে রিলেট করা গিয়েছে সহজেই।
◾বানান, সম্পাদনা ও অন্যান্য :
অন্যধারা প্রকাশনীর বইতে বানান ভুলের আধিক্য একটু বেশি চোখে পড়ে। এই বইতে সেই তুলনায় কম ছিল। তবে বেশ কিছু ছাপার ভুল লক্ষ্য করেছি। একই উচ্চারণের ভিন্ন বানানে ভুল ছিল। যেমন, পর/পড়, কি/কী, লক্ষ/লক্ষ্য, আরও বেশ কিছু।
তবে শরীফুল হাসানের শব্দচয়ন বেশ মুগ্ধতা দেয়। তিনি যেভাবে ইংরেজি শব্দের পরিহার করে কেবল বাংলা পারিভাষিক শব্দের ব্যবহার করেন, পড়তে ভালো লাগে। এই বিষয়টা অনেক লেখকের অনুসরণ করা উচিত বলে মনে করি।
প্রচ্ছদের মধ্যে আশি-নব্বই দশকের একটা ভাব রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তানিয়া সুলতানার অংকন বরাবরই দারুণ। তবে এই প্রচ্ছদ সেই রকমের আগ্রহ জাগানিয়া মনে হয়নি।
বাঁধাই অনেক বেশি শক্ত ছিল। শুরুর দিকে পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল। যদিও সময়ের সাথে সাথে কিছুটা সহজ হয়েছিল।
◾পরিশেষে, শরীফুল হাসানের বইয়ের সাজেশন চাইলে আমার প্রথম পছন্দ বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। আমি সবাইকে এই বইয়ের সাজেশন দিই নিজ দায়িত্বে। লেখকের ছায়া সময় এমনিতেই জনপ্রিয়। এই তালিকায় আরেকটি বই যুক্ত হলো। “আশ্চর্যময়ী, তোমাকে” বইটিও আমি অন্যকে পড়ার পরামর্শ দিবো। থ্রিলার সাহিত্যের এই রমরমা অবস্থায় মানসম্মত সামাজিক উপন্যাস খুব একটা দেখা যায় না। সেখানে সামাজিক উপন্যাসে আশা জাগানিয়া কাজের চেষ্টা করার জন্য লেখক শরীফুল হাসান একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
বইটা শেষ করার পর থেকে কেমন কিম্ভূতকিমাকার হয়ে বসে আছি। মাথার ভেতর আষ্টেপৃষ্টে একধরনের ঘোর তৈয়ার হয়ে আছে। সবকিছুই থম মেরে অনবরত শাহেদ আর রুনু, ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৫ এই টাইমলাইনটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা, গল্পের বাইরেও তো আলাদা একটা জীবন আছে আমাদের নাকি লেখক কোন অভাগাদের জীবনের প্রতিচ্ছবিই একে গেছে পুরো সময়জুড়ে! আদতে তা আমার মানসপটে পরিপাক খাচ্ছে না নাকি জীবনটাই একটা ছন্দ কিংবা গল্প? জানা নেই। শেষের দিকটা নাটকীয় না হলেও গল্পের এতটুকুও ক্ষতি হতো না। শেষ এরকম বই পড়েছিলাম 'বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ' যা আমার সমগ্র মনোযোগকে বিঘ্নিত করে ফেলেছিলো। শেষমেশ 'রুদ্র গোস্বামীর' একটা কবিতা দিয়ে শেষ করি-
তুমি চলে যাওয়ার পর স্লিপিংপিল অথবা নেশার গ্লাস কোনটাই আমাকে ছুঁতে পারেনি। কেননা আমি বিশ্বাস করি মৃত্যু অথবা বখে যাওয়া কোনোটাই ভালোবাসার প্রতিশব্দ নয়। শুধু অফিস ফিরতি পথে যখন স্ট্রিটলাইটগুলো পাখির চোখের মতো তাকিয়ে থাকে, আর রাস্তার বাঁকগুলো মনে করিয়ে দেয় একটা লোক একা, কী ভীষণ একা একা! তখন এই ভেবে খুব কষ্ট হয় যে এমন একটা সন্ধ্যায় ওদের চোখের উপর দিয়ে, ওদের বুকের উপর দিয়ে, তোমার হাত ধরে আমি আর কখনো হেঁটে যেতে পারব না।
৪.৫/৫ ⭐️ আহা কি অসাধারণ একটা কাহিনি, ভাষায় যতই প্রকাশ করি না কেন, কমই হবে! এত বড় মাপের একখান বই তবু পাতায় পাতায় অনুভূতিতে ভরপুর। মনে হলো শাহেদ আর রুনুর চোখ দিয়ে একটা লম্বা জীবন কাটিয়ে আসলাম। রুনু দ্য ফাইটার! 💔 সাসপেন্স, রোমান্স, একশন, থ্রিলার, কি নাই এখানে!
আশ্চর্যময়ী, তোমাকে: একটি ভালোবাসা, হতাশা, বিষন্নতা, অভিমান, হিংস্রতা ও মানব মনের বিচিত্র রূপের গল্প
এই গল্পের একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে একটি শব্দ- অপেক্ষা; এক বিষন্নের নাম। একই সাথে এর চেয়ে সুন্দর এবং ভয়ংকর কিছু হয়না। যা একই সাথে কাউকে বাঁচিয়ে রাখে এবং কাউকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খায়। অপেক্ষা চরমতম শিখরে পৌঁছেছে সোমার মাধ্যমে- “আমি হয়তো অনন্তকাল এখানে বেঁচে থাকবো। তারপর একসময় মিশে যাব। আমি অপেক্ষা করছি সেই অনন্তকাল কখন শেষ হবে?” স্বামী হারানো রাহেলা বেগম সারাটা জীবন বারান্দার চেয়ারে বসে স্বামী সদরুদ্দিনের অপেক্ষা করে গেছেন। অপেক্ষা করেছেন ছোট ভাই নিজামের জন্যে, হয়তো একসময় তারা ফিরে আসবে। অসিত সেন অপেক্ষা করেন ছেলে জয়ন্ত হয়তো দেখা দিবে। রুনু অপেক্ষা করছে নিজের একটা স্থায়ী ঠিকানা হবে, শাহেদ হয়তো অতীত ফেলে তার সাথে সামনে এগিয়ে যাবে।
কেন এতো অপেক্ষা? কারন মানব মন একটা ‘ক্লোজার’ চায়। এর আগে অপেক্ষার অবসান নেই। চাকরি ছাড়ার এতো বছর পরও লাবনীর বাবা-মা এই শহর ছেড়ে যেতে পারেন নি, একটা ক্লোজারের জন্যে। লাবনী বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে? ওরা কি লাবনীর জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকবে নাকি অপেক্ষার অবসান করবে? অন্যদিকে অপহরনকারী এবং ভালোবাসা ফিরে না পাওয়া মানুষের কুৎসিত রূপ প্রকাশ করে মানব মনে অন্ধকার দিক।
একটি বিষয়ই গল্পে বারবার ফিরে এসেছে- মানব মনের বিচিত্র রূপ।
শাহেদ, রুনু, বিশ্বজিৎ, রাহেলা বেগম, দিদা জ্যোতির্ময়ী সেন— গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর বিকাশ, মনস্তত্ত্ব দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। শাহেদকে কখনো মনে হয়েছে স্থির ও তার প্রতিজ্ঞার প্রতি দৃঢ়। আবার কখনো মনে হয়েছে উদ্দেশ্যেহীন ভাবে ছুটে চলছে অজানার দিকে। যে নিজেকে বদলাতে চায় ভবিষ্যতের জন্যে কিন্তু অতীত অন্ধকার তাকে গিলে ফেলছে, তাকে আকড়ে ধরেছে। নিজের সাথে নিজের এই যুদ্ধ, তার নড়বড়ে মানসিক অবস্থা প্রকাশে লেখক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
এ গল্পে আছে অপেক্ষা, আনন্দ, বিষন্নতা, হতাশা, রাগ- অভিমান, হিংস্রতা এবং ভালোবাসা। আশির দশকের সাধারণ মফস্বল জীবন, সমাজ জীবন, ৭১ পরবর্তী দেশের অবস্থা, হিন্দুদের দেশ ত্যাগ, সংগ্রাম এবং গ্রাম ও মফস্বলে ৭৫ হত্যাকান্ডের প্রভাব- সবকিছুর মিশেলে গড়ে উঠেছে এক অনবদ্য জীবন কাহিনী।
একটানা পড়ে গেছি। তিন বসায় শেষ করেছি। একটুর জন্যেও বিরক্ত হইনি। ছোট ছোট বাক্যে লিখে গেছেন জীবনের গল্প। পড়তে গিয়ে কখনো হেসেছি, কখনো চোখে পানি এসেছে, কখনো ক্ষোভে ফেটেছি, কখনো হতাশায় ডুবেছি, কখনো মনে হয়েছে জীবন কেনো এতো জটিল! মনে হবে এটা ভালোবাসার গল্প, হতাশার গল্প, বিচ্ছেদের গল্প, অপেক্ষার গল্প, সমাজের গল্প আবার কখনো মনে হবে থ্রিলার। যেমন হয়ে থাকে শরীফুল হাসানের সামাজিক থ্রিলারগুলো। কোনো একটা নির্দিষ্ট জনরায় ফেলা যায় না।
প্রথম থেকে গল্প তার মতো ডালপালা মেলে নিজস্ব গতিতে এগিয়েছে। শেষ ১০০ পৃষ্টায় সবকিছু গুটিয়ে এনে এন্ডিং করেছেন। ছোটখাটো কিছু অসংগতি ছিলো (যেমন- প্রথমদিকে শাহেদের বাসা ধুলোময় থাকে বলার পরও ২৯৫ পৃষ্ঠায় বলেছেন মা সবসময় ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরচ্ছন্ন রাখতেন, ১৯৮৪ তে মফস্বলের হাসপাতালে লিফট?)। But it was worth reading. ‘বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ’ মতোই আরেকটি ভালো কাজ। গল্পটা প্রচ্ছদের মতোই সুন্দর।
রেটিং- ৩.৮/৫ ( কিছু ঘটনার জন্যে কিছুটা ড্রামাটিক মনে হয়েছে নাহয় রেটিং আরও বাড়তো। যেমন- বারবার বেঁচে ফিরে আসা। স্পয়লার হয়ে যাবে তাই এর বেশি লিখছি না।)
“ Time marches on but memories stays. Torturing silently the rest of our days.”
- - - Lord Alfred Tennyson
মানুষের মাঝে নিহিত রয়েছে প্রদীপ্ত সৌন্দর্য ও আশ্চর্য দ্যুতিময় এক পৃথিবী গড়ার অসীম সম্ভাবনা। কিছু বই পড়ার মধ্য দিয়ে সেই বিশ্বাস আরও গভীর হয়ে হৃদয়ে আলো ছড়ায়। যখন একজন গল্পকার স্বপ্নের কারিগর হয়ে তাঁদের অন্তর্দৃষ্টির মহিমাময় ঔজ্জ্বল্যে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন স্বপ্নরাজ্যের ছবি। স্বপ্নের সেসব দেশ যেন আমাদেরই হয়ে যায় তখন। প্রকৃত উপন্যাস আসলে এমন একটা শিল্প, যেখানে একজন পাঠক নিঃশব্দে পড়লেও এর কথা সে শুনতে পায়, মনে ও কানে বাজে। পাঠক নিজেও যেন এর অংশ হয়ে ডুবে যায় কোন এক মায়াজালের অতলান্তে। চলুন তবে উপরের বলা চমৎকার অনুভূতিগুলো আমাকে উপলব্ধি করিয়েছে এমন একটা উপন্যাসের সন্ধান দি আজ আপনাদের। কল্পনা বা ভাবানুভূতির চিত্রকে যা শরীফুল হাসান শব্দ বুননের এক অনন্য রূপকে উপস্থাপন করেছেন তার “আশ্চর্যময়ী তোমাকে” উপন্যাসে।
◾ফ্ল্যাপ:
আচ্ছা বলুন তো, হারিয়ে যাওয়া মানেই কি শেষ হয়ে যাওয়া? নাকি কিছু গল্প হারিয়ে গিয়েও থেকে যায় অপেক্ষার গভীরে? "আশ্চর্যময়ী তোমাকে" এমনই এক গল্প যেখানে প্রতিটি চরিত্র এক অনিবার্য সত্যের মুখোমুখি হয়েছে। কখনো অপেক্ষার, কখনো না-পাওয়ার আবার কখনো বা এক অনিশ্চিত পরিণতির।
সুলতানপুর নামের এক নিস্তরঙ্গ মফস্বল শহর। সময়টা তখন ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৫। যেখানে রহস্যজনক ভাবে একের পর এক মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল। কেউ জানে না তারা কোথায় গেল? কেন গেল? গোটা শহরটা চাপা আতঙ্কে ঢেকে যায় আর সেই ভয় এসে থমকে দাঁড়ায় কিশোর শাহেদের জীবনে। একাকী, উদাসী আর নিঃসঙ্গ এই ছেলেটা চমৎকার ছবি আঁকতে ভালোবাসতো কিন্তু বাস্তবের রং যেন বড্ড বেশি বিবর্ণ ছিলো তার জন্য।
শাহেদের বন্ধু লাবণী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই শূন্যতা তাকে ঠেলে দেয় এক গভীর অন্ধকারের দিকে। শহর থেকে মফস্বলে ঠাঁই নেওয়া রুনু, যে নিজেও হারিয়েছে তার বাবা-মাকে। সে কি পারবে শাহেদের এই শূন্যতা ভরিয়ে তুলতে? নাকি সময়ের এক নির্মম মোড়ে তাদের পথ হারিয়ে যাবে আরও একবার? অন্যদিকে, বিশ্বজিৎ তাকিয়ে থাকে রুনুর দিকে আর শাহেদের মা বয়ে বেড়ায় এক অনন্ত প্রতীক্ষা হারিয়ে যাওয়া স্বামীর ফেরার অপেক্ষায়।
এই গল্পটা শুধু শাহেদ, রুনু বা লাবণীর নয়। এখানে আছে অনুপম, যে ভালোবেসেছিল সোমাকে অথচ সোমা পালিয়ে যায় জয়ন্তর সঙ্গে। রহস্যের ধূসর আবরণের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অজানা ছায়া একটি হরিণের মুখোশ, একটি অন্ধকার অতীত আর কিছু না বলা কথা। প্রেম, প্রতীক্ষা, বিশ্বাসঘাতকতা আর সময়ের নির্মম বাস্তবতা এই সবকিছুর জটিল মিশেলে রচিত হয়েছে শরীফুল হাসানের "আশ্চর্যময়ী তোমাকে"। এ গল্প শুধু হারিয়ে যাওয়ার নয়, ফিরে আসারও। কিন্তু ফিরে আসা কি সত্যিই সম্ভব? সেই আশ্চর্যময়ী বা কে রুনু? লাবণী? সোমা? নাকি অন্য কেউ?
◾অনুভূতির ব্যবচ্ছেদঃ
▫️আশ্চর্যময়ী তোমাকে" উপন্যাসটি মূলত একটি সামাজিক থ্রিলার। যা চরিত্রগুলির আবেগ ও রহস্যের মাধ্যমে সমাজের অন্ধকার দিকগুলি উন্মোচন করেছে। প্রতিটা শব্দের অঙ্গার থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো বেরিয়ে আসছিল যেন এর মোহময়তা। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমি কোন এক অদ্ভুত দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি যার ওপারে অপেক্ষা করছে আরেকটি জগৎ। পৃষ্ঠাগুলো উল্টাতে উল্টাতে একসময় অনুভব করি, আমি কেবল শুধু পড়ছি না বরং ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি সেই ভিন্ন বাস্তবতায়। চারপাশের চেনা পরিবেশ মুছে যাচ্ছিল, শব্দগুলো রূপ নিচ্ছিল ছবিতে, চরিত্ররা রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে উঠছিল, আর আমি? আমি তো তখন সেই গল্পেরই এক ছায়াসঙ্গী।
▫️লেখক তার কলমের ছোঁয়ায় চারশো ষোলো পৃষ্ঠার বিস্তৃত এক ক্যানভাসে, আশি-নব্বই দশকের মফস্বল জীবনের রং যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়েছেন। সুলতানপুর নামের সেই ছোট্ট শহরটিতে, বেড়ে উঠা কিশোরটির দিনযাপন, উত্থান-পতন, একাকিত্ব, স্বপ্ন সবকিছুর সঙ্গে অজান্তেই এক গভীরটান অনুভব করছিলাম। গল্পের সেই ধুলোমাখা মফস্বলের গলিতে আমিও যেন হাঁটছিলাম। সেই জায়গাটা অনুভূতিগুলো এতোটাই আপন মনে হচ্ছিল, যেন আমি এক পুরনো অ্যালবামের বিবর্ণ ছবির দিকে তাকিয়ে আছি, যেখানে থাকা প্রতিটি মানুষ অপরিচিত হয়েও কোথাও যেন আমার খুব আপন।
▫️শাহেদ নামের চৌদ্দ বছরের ছেলেটার জীবন বয়সের তুলনায় একটু বেশিই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিল। কাছের মানুষদের হারানোর যন্ত্রণা, দারিদ্র্যের নির্মম চাবুক আর একাকিত্বের শূন্যতা এসবই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন দেখাটা তো তার জন্য যেন এক অলীক কল্পনা। যখনই মনে করেছে সব কিছু নতুন করে সাজিয়ে নিবে, ঠিক তখনই কোনো না কোনো অন্ধকার পরিস্থিতি তাকে ঘিরে ফেলেছে। একটুখানি সুখের আলোর কাছে পৌঁছানোর আগেই যেন কোন অশুভ ছায়া সেটা নিভিয়ে দেয়।
▫️প্রধান চরিত্র শাহেদ এবং রুনু, তাদের সম্পর্ক, জীবনের বিভিন্ন ধাপের মিশ্রণগুলো গল্পের মূল স্রোত হিসেবে কাজ করছে। একদিকে শাহেদের মানসিক দ্বন্দ্ব অন্যদিকে রুনুর নিঃশব্দ প্রতীক্ষা এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে লেখক যে গভীরতা তৈরি করেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। লেখক গল্পের প্রতিটি ধাপকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষভাবে বয়ঃসন্ধি কালের আবেগ আর পরিণত বয়সের মানসিক জটিলতা গুলো। প্রথম ভাগের নিরলস রহস্য এবং পাঠকের মনের মধ্যে চমক সৃষ্টি করার ক্ষমতা, তার পরবর্তী অংশে আরও জটিল হয়ে ওঠেছে। রুনু, শাহেদ ও অন্যান্য চরিত্রগুলির মধ্যে যে সম্পর্কের সূক্ষ্মতা, তাদের গভীরে থাকা ব্যথা, অনিশ্চয়তা এবং তিক্ততা গল্পের বাস্তবতার প্রমাণ দিয়েছে।
▫️এছাড়াও লেখক গল্পের মাঝে রহস্য তৈরি করার জন্য সুনিপুণভাবে একটি কাঠামো গড়ে তুলেছেন, যা পাঠককে আকৃষ্ট করে রাখবে। রহস্যের আবহে প্রবাহিত গল্পটি যেন নিছক কোন কাহিনী নয় বরং এটি একটি সামাজিক বার্তা। যা সমাজের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেছে। তবে কিছু অংশে একটু অতিরঞ্জিত মনে হলেও, সব মিলিয়ে এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক থ্রিলার হিসেবে দাঁড়িয়েছে। একটা বিষয় বিশেষভাবে মনে ধরেছে, লেখক গল্পের প্রতিটি অধ্যায় শুরু করার সময় সরাসরি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যান নি। তিনি গল্পের পরিবেশ এবং আবহ তৈরি করে সেই রহস্য উদঘাটনের জন্য পাঠককে আগ্রহী করে তুলেছেন। এই কৌশল গল্পটিকে আরও জীবন্ত এবং আকর্ষণীয় করেছে।
◾চরিত্র কথনঃ
▫️“আশ্চর্যময়ী তোমাকে” উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নির্দিষ্ট একজনকে মূল চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন। এই উপন্যাসের অন্যতম শক্তি এর চরিত্রগুলোর বাস্তবিক উপস্থাপন। প্রতিটি চরিত্র যেন তাদের নিজস্ব আলো-আঁধারির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। শাহেদ ও রুনু দুজনেই একাকীত্বে ভুগলেও তাদের একাকীত্বের রূপ এক নয়। তাদের অনুভূতি, মানসিক টানাপোড়েন, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সবই ছিল আলাদা। লেখক এরা সহ প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তুলেছেন, এতে কেউ কারো প্রতিচ্ছবি হয়ে যায়নি।
▫️প্রথম দৃষ্টিতে রুনু বা শাহেদকে প্রধান চরিত্র মনে হলেও গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, প্রতিটি চরিত্রই এই গল্পে স্ব- মহিমায় দ্যুতি ছড়িয়েছে। রাহেলা বেগম, অসিত সেন, অলকানন্দা, বিশ্বজিৎ, ফরিদ মামা, অনুপম, আসমা মামী, বাদল দাস প্রত্যেকেই গল্পের বুনোটে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যেন এক রঙিন কাঁচের টুকরো। যার প্রতিটিতে এক এক রকম আলো প্রতিফলিত হয়, এদের কেউই আসলে উপেক্ষিত নয়। আবার কিছু চরিত্র আছে, যারা সরাসরি দৃশ্যমান না হলেও গল্পের আবহ তৈরিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে।
▫️সবচেয়ে বড় ব্যাপার, কোন চরিত্রকেই কখনো অযাচিত মনে হয় নি। যেমন লাবণী, জয়ন্ত কিংবা সোমা তাদের সরাসরি উপস্থিতি কম হলেও গল্পের স্রোতে সজীব থেকে গেছে। গল্পের গতি ও আবহের সঙ্গে এতটাই মিশে গেছে যে, পাঠক হিসেবে তাদের সহজে অনুভব করা গিয়েছে।
◾বই অলংকরণ ও সহায়কদের ভূমিকা:
▫️বইটার প্রচ্ছদ, কাভার সবকিছু বেশ ভালো ছিল। আমার কাছে অন্তত ভালো লেগেছে। আর অন্যান্য থ্রিলার উপন্যাসের ন্যায় এই গল্পটাও প্রথমে স্লো ভাবে এগুতে থাকে, কিন্তু অহেতুক বর্ণনা দিয়ে গল্পকে ভারী করেননি লেখক।
▫️উপন্যাসটা পড়ার ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করেছে। লেখক হয়তো সময়কে পেছনে টেনে নিতে চেয়েছেন। কিন্তু কিছু জায়গায় গিয়ে হঠাৎ মনে হল��, আমি তো এখনই বসে আছি, এই সময়ের মধ্যেই! কিছু অংশে সত্তর-আশির দশকের গন্ধ ঠিকঠাক পাওয়া গেলেও, অন্য কিছু জায়গায় বর্তমান এসে গায়ে যেন ধাক্কা দিচ্ছিল। টুকটাক বানান ভুল বানান আর ছোটখাটো এই অসঙ্গতিগুলো একপাশে রাখলে পুরো অভিজ্ঞতাটা মন্দ ছিল না।
◾যবনিকাঃ
▫️উপন্যাসের বক্তব্য হতে হয় শক্তিশালী। এর ভেতরে থাকতে হয় এমন কিছু, যা আলোকময় বোধের নতুন দরোজা খুলে দেয়। জাপানের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হারুকি মুকারামি উপন্যাস রচনা প্রসঙ্গে বলেন,
“মানুষের মন হচ্ছে দালানের মতো, যার রয়েছে অনেকগুলো তলা। আর উপন্যাস রচনা হচ্ছে চৈতন্যের গভীরে ঢোকা, অনেকটা সিঁড়ি ভেঙে দালানের ভূগর্ভস্থ গভীর অন্ধকার তলার পরেরটিতে নামার মতো। যিনি নামছেন, তার জানা নেই কোথায় রয়েছে করিডোরটি, যেটা দিয়ে নিচের তলায় পৌঁছানো যায়।”
▫️স্বার্থক উপন্যাস রচনার মন্ত্র অন্তত এটাই হওয়া উচিত। উপন্যাসে কাহিনীর স্পর্শময়তা একজন যেন মানুষকে শিহরিত করে রাখতে পারে। আশ্চর্যময়ী তোমাকের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সুখ ও দুঃখের ভেলায় চেপে লেখক যে-সময়টাকে অতিক্রম করেছেন, তাকে বিশ্বস্তভাবে রূপায়ণও করতে পেরেছেন অনেকটাই। গল্প যদি হয় ‘জীবন ও যাপনের ছায়া আর সাহিত্যের অমৃত দ্রাক্ষা-রস’ তবে শরীফুল হাসান তার পুরোটাই আঁকতে পেরেছেন। দেখাতে পেরেছেন নিজের সিদ্ধহস্তের নিপুণতা, যে-ছোঁয়ায় উপন্যাসটা হয়ে উঠেছে জ্বলজ্বলে, জীবন্ত, জীবনঘনিষ্ঠ। সুখপাঠ্য এই উপন্যাসটির জন্য রইল শুভকামনা।
একটা কিশোরের গল্প। যেখানে আবার ঢুকে পড়েছে স্মল-টাউন মিস্ট্রিও! আশি-নব্বইয়ের দশকের এক মফস্বল শহরকে কেন্দ্র করে কিশোর শাহেদের জীবনের দীর্ঘ যাত্রা নিয়ে এই বই। কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত সময়পর্বে তার ব্যক্তিগত জীবন, মানসিক দ্বন্দ্ব এবং অতীতকে আঁকড়ে থাকার প্রবণতাই ফোকাসড ছিল বেশি।।
উপন্যাসটা তিনটি ভাগে বিভক্ত, এবং পজিটিভ দিক এই যে, প্রতিটা ভাগেই চরিত্রগুলোর মানসিক বিকাশ ও বয়সভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি খুব ভালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে রহস্য, আবেগ এবং চরিত্র নির্মাণ বেশ সাবলীল ও আকর্ষণীয়। তবে তৃতীয় ভাগে কাহিনির গতি অনেকটাই নাটকীয়। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় কিছু কাকতালীয়তা। যার কারণে প্রথম দিকের মুগ্ধতার রেশ শেষে এসে ঝিমিয়ে পড়েছিল এবং বলা চলে বিরক্তই হয়েছি।
ওভারঅল বইটা খারাপ না। ধীর তবে প্রাঞ্জল গতি, প্রথম থেকেই গল্পের সাথে আটকে রাখার মত লেখা সবকিছুই ভালো। তবে, সমাপ্তিটুকু আরও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আসলে আমার ক্ষেত্রে, কোনো বইয়ের শেষটা তৃপ্তিদায়ক না হলে,আস্তে অস্তে পুরো জার্নিটাই কেমন যেন ফ্যাকাসে বলে মনে হতে থাকে। So, I'm not satisfied as I wished to be.
"আশ্চর্যময়ী—তুমি কোথায়?'' তুমি কি আছো সময়ের পারে, নাকি হারিয়ে গেছো আঁধারের দ্বারে? স্মৃতির সুরে বাজে তব নাম, অপেক্ষা জানে শুধু অবিরাম!
🟢কাহানি সংক্ষেপ: "আশ্চর্যময়ী, তোমাকে" শরীফুল হাসানের একটি সামাজিক থ্রিলার, যেখানে আলো, অন্ধকার, প্রেম, বিকৃতি এবং মানব মনের জটিলতার গল্প বলা হয়েছে। উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৫ সালের মফস্বল শহর সুলতানপুর, যেখানে একের পর এক মেয়ে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যেতে থাকে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রৌদ্রময়ী সেন (রুনু), যার বাবা নিরুদ্দেশ ও মা মৃত। সে তার দাদু-দিদার কাছে বেড়ে ওঠে এবং স্কুলে পরিচিত হয় শাহেদ নামের এক কিশোরের সঙ্গে, যে নিঃসঙ্গ কিন্তু অসাধারণ স্কেচ আঁকতে পারে। তাদের সহপাঠী লাবণী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়, এবং এরপর আরও কয়েকজন মেয়ে হারিয়ে যেতে থাকে। শাহেদ নিজেকে লাবণীর নিখোঁজ হওয়ার জন্য দোষারোপ করে এবং তাকে খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা করে। গল্পে একের পর এক রহস্য উন্মোচিত হয়—শাহেদের মামা নিজাম, রুনুর মামা জয়ন্ত, তাদের বন্ধু অনুপম , শাহেদের পরিবারের সাহায্যকারী ফরিদ মামা, কনফেক্শনারি দোকানের বাদল দাস এবং অনুপম জয়ন্তর ছোটবেলার বান্ধবী সোমা চক্রবর্তী, শহরের হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের অতীত, এবং তাদের পরিবারের ইতিহাস। কখনও দেখা যায় এক হরিণের মুখোশ পড়া রহস্যময় এক ব্যক্তি কে,আবার কখনও কোন এক পাগল, কখনও বা খুঁড়িয়ে চলা কোন ব্যক্তি !! কারা এরা !! লাবণী হারিয়ে যায়, শাহেদ তাকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু যে সত্য সে খুঁজছে, তা কি আলো? নাকি এক ভয়ংকর শূন্যতা, নিকষ অন্ধকার ,যা তাকে গিলে খাবে?
🟢প্রতীক্ষার এক অনন্য চিত্র: গল্পে প্রতিটি চরিত্রের জীবনে অপেক্ষা এক অনিবার্য সত্য হয়ে উপস্থিত হয়েছে। কেউ না কেউ কারো জন্য অপেক্ষারত, সময়ের স্রোতে বাঁধা পড়ে আছে তাদের মন, তাদের জীবন। এই অপেক্ষা শুধু শারীরিক দূরত্বের কারণে নয়, মানসিক ও আবেগিক দ্বন্দ্বের ফলেও। রুনু অপেক্ষা করে শাহেদের জন্য, অথচ শাহেদ ডুবে থাকে লাবনীর স্মৃতিতে। বিশ্বজিৎ চেয়ে থাকে রুনুর দিকে, আর রাহেলা বয়ে বেড়ায় শাহেদের বাবার ফিরে আসার প্রতীক্ষা। অসিত সেনের হৃদয়ে জয়ন্তর ফিরে আসার আকুতি, অনুপমের মনে সোমাকে পাবার বাসনা— এইসব অপেক্ষার অনুভূতি গল্পের আবহকে গভীর করে তোলে। এই অপেক্ষার চক্রে ফরিদ মামার জন্য আসমা মামীও এক অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় বন্দী। তার দিন কাটে একটি ফিরে আসার সম্ভাবনায়, যেটা হয়তো কখনোই সত্যি হবে না। প্রেম, ভালোবাসা, অভ্যাস— সবই যেন এক অদৃশ্য বাঁধনে আটকে রাখে মানুষকে অপেক্ষার মরীচিকায়। গল্পের সুরে বেজে উঠে এক অপেক্ষার দর্শন ,না পাওয়ার বেদনা । সময় এগিয়ে চলে, মানুষ বদলে যায়, তবু কিছু অপেক্ষা শেষ হয় না—সেই চিরন্তন সত্যকেই যেন লেখক নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
🟢পাঠপ্রতিক্রিয়া: একটি ভালো গল্প শুধু বিনোদন দেয় না, বরং পাঠকের মনে এক গভীর ছাপ রেখে যায়, তাকে ভাবায় এবং তার চিন্তার জগতে নতুন মাত্রা যোগ করে। "আশ্চর্যময়ী, তোমাকে" ঠিক তেমনই একটি উপন্যাস, যা পাঠককে শুধুমাত্র কাহিনির মোহে আটকে রাখে না, বরং তাকে বাস্তবতা, প্রেম, সমাজ ও আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই উপন্যাসের মূল কাহিনি—শাহেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লাবণীর অনুসন্ধান—শুধু একটি ব্যক্তিগত খোঁজ নয়, বরং এটি এক নিখোঁজ সত্যের প্রতীক, যেখানে একজন মানুষ তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে লড়াই করে লড়াই করে, লড়াই করে জানা অজানার সঙ্গে । গল্পের প্রতিটি স্তরে রহস্যের আবরণ ছড়িয়ে রয়েছে, যা পাঠককে কৌতূহলী করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত এক গভীর প্রতীক্ষার অনুভূতি এনে দেয়। চরিত্রগুলোর গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। শাহেদের মানসিক দোলাচল, রুনুর নীরব প্রতীক্ষা,—সবকিছুই এত জীবন্ত লেগেছে , বিশেষ করে শাহেদ চরিত্রটি বেশ মনে দাগ কেটেছে। ভাষার ব্যবহারও ছিল অনবদ্য। লেখকের বর্ণনাভঙ্গি এতটাই কাব্যময় ও গভীর যে, প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন একটি চিত্রকর্মের মতো অনুভূত হয়। প্রকৃতির বর্ণনা, সময়ের প্রতীকী ব্যবহার, আর সংলাপের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ব্যঞ্জনাগুলো গল্পটিকে শুধু প���ঠযোগ্য করে তুলেনি, বরং এক সাহিত্যিক সম্পদে পরিণত করেছে। গল্পে সমাজের এক অন্ধকার দিক ফুটে উঠেছে—বিকৃত মানসিকতার মানুষের উপস্থিতি। কেউ পুরুষ হয়ে পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, কেউ আবার নিষ্পাপ শিশুদের শরীরের প্রতি বিকৃত মোহ দেখায়। এই ধরনের মানসিকতা শুধু ব্যক্তির নয়, বরং সমাজের ব্যর্থতার প্রতিফলন, যেখানে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যায়, আর ভুক্তভোগীরা নীরবে কষ্ট সয়ে যায়।গল্পে এসব চরিত্র শুধু আতঙ্ক তৈরি করে না, বরং পাঠককে ভাবায়—এই অসুস্থতা রুখতে আমাদের করণীয় কী? নিছক ভয়ের অনুভূতি নিয়েই থেমে যাব, নাকি পরিবর্তনের পথে এগোব? "আশ্চর্যময়ী, তোমাকে" শুধু একটি গল্প নয়, এটি এক অনুভূতি, এক অভিজ্ঞতা, যা পাঠকের হৃদয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অনুরণিত হয়। এই উপন্যাস আমার মনে একটি জায়গা করে নিয়েছে, যেমন লাবণী হারিয়েও শাহেদের মনে অমর হয়ে থাকে। শরীফুল হাসানের লেখা এই প্রথম পড়লাম এবং আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। তার লেখায় একটা নিজ্বসতা আছে যা খুব সহজেই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে।
🟢অন্যান্য: বইয়ের প্রোডাকশন ভালো ছিল আর আমার পড়তেও কষ্ট হয়নি , যদি মেলার শুরুর দিকে অনেকের অভিযোগ দেখেছিলাম কিন্তু আমি ভালো প্রোডাকশন এর টা পেয়েছি। বানানে ভুল ছিল ,কিছু বিশেষণেও ভুল ছিল। বইয়ের প্রচ্ছদটা ছিল চমৎকার। দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করে। গল্পটা এক���ু স্লো লেগেছে আর কেন জানি সেই সত্তর আশির দশক টা দৃশ্যায়ন করতে কষ্ট হয়েছে। কিছু কিছু বর্ণনায় তো মনে হচ্ছিলো আমি বর্তমান সময়েই আছি । এরকম কিছু ছোট ছোট অসঙ্গতি ছাড়া ভালো ছিল গল্পটা।
🟢উপসংহার: "আশ্চর্যময়ী তোমাকে" গল্পটি সমাজের নানা রঙের, নানা স্তরের বাস্তবতার এক জটিল চিত্র। এটি একাধারে ভালোবাসার, প্রতীক্ষার, বিশ্বাসঘাতকতার ও বিকৃত সমাজব্যবস্থার আখ্যান। প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে অপেক্ষার প্রহর গুনেছে—কেউ প্রিয়জনের জন্য, কেউ হারানো সময়ের জন্য, কেউবা এক অসম্পূর্ণ স্বপ্নের জন্য। গল্পে প্রেম আছে, কিন্তু তা নিছক সুখকর নয়; প্রতিশোধ আছে, কিন্তু তা একপাক্ষিক নয়; সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উঠে এসেছে, কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তেমন জোরালো নয়। কিছু চরিত্র স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হয়, কেউ বা অতীতের অভিশাপ বয়ে চলে। আবার কেউ নিজের দুঃখ নিয়ে নীরব থেকে জীবনকে মেনে নেয়। এই উপন্যাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—জীবন কখনো একরেখা নয়, কখনোই সম্পূর্ণ সাদা-কালো নয়। মানুষের মন, তার আকাঙ্ক্ষা, তার সম্পর্কগুলো সবই জটিল, অস্পষ্ট এবং কখনো কখনো ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। গল্প শেষে পাঠক মন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে—একটা না-পাওয়ার, অপূর্ণতার অনুভূতি। তবে সেটাই বোধহয় এই উপন্যাসের সার্থকতা, কারণ
'' জীবন নিজেই তো শেষ পর্যন্ত এক অসম্পূর্ণ গল্প! ''
অনেক বেশি প্রত্যাশা নিয়ে যে পড়তে নিয়েছিলাম তা না হলেও ভিন্ন কিছু আশা ছিলো। কিন্তু সেই এক ই হিন্দু - মুসলিম ভালোবাসা কে কেন্দ্র করে কাহিনীর আবর্তন। কোন ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে বলছি না। বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ, ছায়া সময় এই দুই বইতে একই ধরনের প্রণয়ের পর নতুন কিছু পাঠক হিসেবে প্রত্যাশা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু এই বইটা পড়ে মনে হলো লেখক নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের গণ্ডি থেকে বের হতে পারছেন না।
কাহিনীর শুরু হয় ১৯৭৪ সালের টাইম লাইন থেকে। প্রেক্ষাপট ১৯৭৪, বাংলাদেশ হলেও এই সময়ে বাংলাদেশ যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সাক্ষী হয়েছিলো সে বিষয়ে বইতে কোন উল্লেখ না থাকার বিষয় টা মানতে কষ্ট হয়েছে।
শুরু টা ছিলো চমৎকার। পিতৃহীন, কিছুটা বাউন্ডুলে শাহেদ আর পিতা মাতা হীন রৌদ্রময়ী সেনের দুরন্ত কৈশোর এর সময়টা উপস্থাপন করেছেন দারুন ভাবে। পেজ উল্টানোর সাথে সাথে একটা সামাজিক উপন্যাস ধীরে ধীরে রূপ নেয় রহস্য, রোমাঞ্চে।
দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত কাহিনী বেশ ভালোভাবে আগালেও তৃতীয় পর্ব টা অতিমাত্রায় নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ যা আমার ভালো লাগার সমস্ত বিষয়ে পানি ঢেলে দিয়েছে। প্রায় চার বছর একটা মফস্বল শহরের সরকারি হাসপাতালের কেবিনে শাহেদের কোমায় থাকার ব্যাপারটা কোনমতে হজম করতে পারলেও শেষে গিয়ে ৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমার মত একটা মারামারির দৃশ্য অপ্রত্যাশিত ছিলো। একদম হতাশ।
লেখকের গল্প বলার ধরন সব সময়ের মতোই দারুন। ছোট ছোট সরল বাক্যে সুন্দর ভাবে বিবরণ দিয়েছেন সব কিছুর। সাবলীল বর্ণনাভঙ্গির জন্যই পড়তে কোন ক্লান্তি আসে না। কিন্তু কথায় আছে শেষ ভালো যার , সব ভালো তার। শেষের নাটকীয় যবনিকাপাত না হলে আরো ভালো হতো আর কি।
আশ্চর্যময়ী, তোমাকে একটি অসাধারণ সাহিত্যকর্ম যা পাঠকদের আবেগঘন অভিজ্ঞতা তৈরি করে। এটি শুধুমাত্র একটি থ্রিলার হিসেবে নেয়া যাবে না; এটি জীবনের বিভিন্ন বাঁকের গল্প। মাঝামাঝি গল্প অনেক স্লো মনে হলেও শেষ অধ্যায়তে অস্বাভাবিক এক পেস পাওয়া যায়। একটা একটি সামাজিক থ্রিলার হিসেবে যারা গভীর এবং চিন্তাশীল গল্প পছন্দ করেন, তাদের জন্য একটা অপশন হতে পারে।
❛মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামক ব্যাপারটির খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হলো মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।❜
আমরা সবাই কোনো না কোনো কিছুর অপেক্ষায় থাকি। কেউ সুদিনের অপেক্ষা করে, কেউ নির্দিষ্ট বুক্তির অপেক্ষা করে, কেউ মুক্তির অপেক্ষা করে। অপেক্ষা একটা আশা। এই আশাই আমাদের বাঁচার চালিকাশক্তি।
বাবা, মা, ভাই, বোন মিলে সংসার এমনটাই তো স্বাভাবিক। একটা সুখী পরিবার হতে এই কয়টা মানুষের একত্রে থাকা, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে থাকা ছাড়া আর কি-ই বা চাওয়ার থাকে?
কিন্তু রোদ্রময়ী সেন তথা রুনুর জীবনটা এমন নয়। একসময় বাবা, মা আর দাদুবাড়ির লোকদের নিয়ে বেশ সুন্দর সময় কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ১৪ বছরের রুনুর জীবনের সুরটা কেটে গেল একদম আচমকা বাবার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায়। বলা নেই, কওয়া নেই লোকটা সংসারত্যাগী হয়ে গেল। বাবার বিরহে মা কেমন বদলে গেল। অসুস্থ হয়ে গেল। একসময় এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো। এরপর ঠাকুমাকে আঁকড়ে ধরে চলছিল। দুই কাকা, এক কাকিও ভালোবাসতো। কিন্তু সুখ যেন রুনুর কপালে নেই। ঠাকুমাও পরপারে পাড়ি দিলেন। রোদ্রময়ীর জীবনে মেঘের ছায়া নেমে এলো। ঢাকা থেকে তাকে পাঠানো হলো সুলতানপুর নামক মফস্বলে দাদু, দিদার কাছে থেকে নতুন জীবন তৈরি করে নিতে। ছোট্ট একটা মেয়ের দায়িত্ব কাকা, কাকিমা নিতে চাইলেন না।
শাহেদের জীবনটা নিস্পন্দ। স্বাভাবিক একটা পরিবার সেও পায়নি। বাবা নিরুদ্দেশ হলেন পর থেকে মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। আর্থিক কষ্ট, মায়ের ভঙ্গুরতা এই নিয়ে জীবন চলছে। স্কুলে তেমন মনোযোগ নেই। যেতে হয় পড়তে হয় বলেই যায়, পড়ে। কোনো আশা নেই। নেই কোনো বন্ধুও। সে আঁকতে ভালোবাসে। সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে সে। স্কুল, বাড়ি ফেরা, খাবার রান্না থাকলে খাওয়া আর বিকেলে খেলার মাঠে অন্যের খেলা দেখে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরা এই তার নিত্যকর্ম। মফস্বল এই শহরে জীবন চলছে তার।
সুলতানপুর এসে নিজেকে শুরুতেই মানিয়ে নিতে পারেনি রুনু। তার দাদু অসিত সেন স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পরিচিতি আছে। দাদুর অবসর নেয়া স্কুলেই ভর্তি হয়েছে সে। পরিচিত হয়েছে পাশের বাড়ির রাহেলার সাথে, যাকে রুনু ছোটোমা ডাকে। তার মা বিন্দুর সই ছিলেন তিনি। মানুষটাকে খুব ভালো লাগে রুনুর। ছোটোমার ছেলে শাহেদের সাথেও টুকটাক কথা হয়েছে। ছেলেটা জানি কেমন মিশতে চায় না। সুলতানপুর ছোটো জায়গা, ঝামেলা নেই। কিন্তু এই শহরেই ঘটলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। লাবণী নামে একজন মেয়ে হারিয়ে গেল। শাহেদের ক্লাসমেট ছিল মেয়েটা। শাহেদ বসতো একদম শেষের বেঞ্চে, আর লাবণী প্রথমে। অল্প একটুই কথা হয়েছিল। রুনুর সাথে সেদিন যদি কালো গোলাপের চারা আনতে না যেত তবে কি লাবণী হারিয়ে যেত? অপরাধবোধ আছে শাহেদের, তার থেকেও অনেক বেশি অপরাধবোধ রুনুর।
সময় গড়িয়ে যায়, লাবণী নিখোঁজ থেকে যায়। শাহেদ কেমন চুপসে যায়। রুনুও ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় ভোগে। তবে সেইসাথে তাকে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে হয়। তাকে থেমে থাকলে হবে না। সামনে এগিয়ে যেতে হবে জীবনে অনেক কিছু করতে হবে। একসময় হারিয়ে যায় শাহেদ। কে ধরে নিলো ছেলেটাকে? মা রাহেলা পাগলপ্রায়, রুনু চিন্তায় অস্থির। কোথায় গেল শাহেদ? এরইমধ্যে শহরে থেকে হারিয়ে যায় আরও দুটো মেয়ে। পুলিশ কোনো সন্ধান পাচ্ছে না। এভাবেই মেয়েগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। রুনুর সাহসিকতায় অন্ধকার এক কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় শাহেদকে। কে ছিল সেই খুঁড়িয়ে চলা লোকটা? যার কথা আগে একবার শাহেদ বলেছিল। এই কি তবে লাবণীকেও ধরে নিয়ে গেছে? কোথায় লাবণী? ফিরে এসে শাহেদ এক অন্য মানুষ। নিশ্চুপ, নিজের মধ্যে থাকে, কী হয়েছিল তার সাথে মুখ খোলে না। এঁকে যায় একমনে। দূরত্ব হয়েছে রুনুর সাথেও। রুনুর অনেক অভিমান। কেন শাহেদ কথা বলে না?
রুনুর মামা জয়ন্ত। কিসের বিদ্রো হী মনোভাব নিয়ে লাপাতা হলো। গরীবের রবিনহুড হয়েছে সে। ভালোবাসতো সোমা চক্রবর্তীকে। সংসার পেতেছিল সোমা অন্য ঘরে। কিন্তু কী কারণে একদিন বলা কওয়া নেই সোমা পালিয়ে গেল জয়ন্তর সাথে? এদিকে জয়ন্তকে খুঁজে হয়রান অনুপম। একসময়ের বন্ধু হলেও পুলিশি দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে।
সময় অদ্ভুত। বছর পেরিয়ে গেছে শাহেদ কলেজে উঠেছে। কিন্তু জীবনটা থমকে আছে ঐ এক ঘটনায়। ভুলেনি লাবণীকে। আজও খুঁজে যাচ্ছে। বছর ঘুরে। রুনু মেট্রিক পাশ করে কলেজে ওঠে। নিয়ম করে ছোটোমার সাথে দেখা করে। উপদ্রব হিসেবে আছে বিশ্বজিৎ। ছেলেটা তাকে ভালোবাসে কিন্তু বিরক্ত করে না। দিদাও হয়তো রাজি। কিন্তু রুনুর মন তো তাকে চায় না! সময় স্রোতের মতো বয়ে যায়। বদলে যায় অনেক কিছু। জীবন, জীবনের মানে। ঝড়ের কবলে অনেক কিছুই তছনছ হয়ে যায়। স্বপ্ন, আশা পূর্ণতা পায় না।
শাহেদ, রুনু, বিশ্বজিৎ, অনুপম, সোমা, ফরিদ কিংবা ঐ অদ্ভুত বাদল দাস সবগুলো মানুষ কেমন করে সময়ের স্রোতে নিজেদের জীবনের পরিণতি দেখলো। একটা মফস্বলের ঘটনা যা তাড়িয়ে বেড়ায় এই রহস্য আদৌ জানা যাবে? জানলেও সেটা সম্মুখে আনা সম্ভব? কে সেই ঝড়ের রাতের কিংবা অন্ধকার বাড়ির হরিণের মুখোশ পরা ব্যক্তি? শাহেদের এই সত্য খোঁজার যাত্রা শেষ হবে কখনো? লাবণীর বাবার অপেক্ষা শেষ হবে আর? আশ্চর্যময়ী কে? সোমা? যে অপূর্ণ প্রেমকে পূরণ করার আশায় চলে গেল। নাকি লাবণী? যে হারিয়ে গিয়েও গাঢ় স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল। নাকি রুনু? যে নিজের সাথে যু দ্ধ করে গেল একটু পাওয়ার আশায়, নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশায়।
মানুষের এই চক্রের জীবনে চক্র থেকে বের হওয়া যায় না। তবুও এই চক্রে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে!
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝আশ্চর্যময়ী, তোমাকে❞ শরীফুল হাসানের উপন্যাস। লেখক বেশ অনেকদিনপর বড় কলেবরে ফিরে এসেছেন।
এসব পরে বলি। এর আগে আমি বলে নেই,
আমি একটা উপন্যাস লিখব। সেখানে শরীফুল হাসানকে বারবার মা রবো। জীবিত করে মা রবো। ম রার পর মা রবো।জিউস প্রমিথিউসকে যে শাস্তি দিয়েছিল সেভাবে শরীফুল হাসানকে শাস্তি দিবো। কেন বলেছি এইটুকু যারা উনার লেখা পড়েন বিশেষ করে সামাজিক বিষণ্ন ধারার লেখা পড়েছেন জানেন। লেখকের লেখার হাত চমৎকার এটা পুরান কথা। গতিশীল গল্পে পাঠককে বুদ করে দেন এটাও পুরান। এমনকি অসম্ভব সুন্দর কাহিনির মধ্যে দুঃখ, বিস্বাদ, বিষন্নতা ঢুকিয়ে পাঠকের হৃদয়কে ভেঙে দেন এটাও পুরান। এসব জানার পরে নতুন উপন্যাস পড়তে বসে আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে এরকম ঘটনা ঘটবে। সুতরাং টেনশন লেনেকা নেহি। তারপরেও!
যাই হোক। সত্তুর-আশির দশকের সময়কে নিয়ে লেখা উপন্যাসটি। এই যুগটা নিয়ে দেশীয় লেখা পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। প্রযুক্তির শিকলমুক্ত মনোরম একটা সময়। এই সময়েই রুনু, শাহেদ নামে দুজন মানুষ নিজেদের জীবনের দুরকম সমস্যা নিয়ে শৈশব কাটাচ্ছিল।
এভাবেই কাহিনি এগোয়। ধীরে ধীরে গল্পটা ডালপালা মেলতে থাকে। সেইসাথে বইয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিবে পাঠক। আমিও নিয়েছি। শুরুর দিকে গল্প বুনন, চরিত্রের আনাগোনা, কাহিনি গোছাতে বেশ ভালো লেগে যায় লেখাটা। লেখক সেই সময়ের ঘটনাগুলো তালমিলিয়ে এনেছেন। ১৯৭৪ থেকে শুরু হওয়া গল্পে মফস্বলের জীবন এসেছে, এসেছিল ১৯৭৫ এর ঘটনাও। এই ঘটনার সাথে জনজীবনের মানিয়ে নেয়া, ঢাকার ঘটনায় দূরবর্তী অঞ্চলের জীবনে প্রভাব তেমন একটা না পড়া ব্যাপারগুলো বাস্তব ছিল। তিনটা পর্বে বিভক্ত ছিল উপন্যাসটি। এই তিন পর্বে সময়ের কয়েক বছরের ব্যবধান দিয়ে মোট ১০ বছরের একটা গল্প বলেছেন। যেখানে সময়ে আমূল বদলে গেছিল চরিত্রগুলোর জীবন। অনেক চরিত্রের আনাগোনা ছিল। তবে মূল ছিল কয়েকজন। যাদের গল্প সময়ের ফেরে কখনো আনন্দ দিয়েছে, কখনো কষ্ট দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কষ্ট দিয়েছে বেশি। শেষের দিকে সময়ের আরো ব্যবধানের গল্প ছিল। সেটা না হয় থাক!
পুরো উপন্যাসে একটা অপ্রাপ্তি, বিষন্নতার মেঘযুক্ত আবহ ঘিরে ছিল। রাগ, অভিমান, না পাওয়া, হারানো দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। কখনো প্রকাশ পেয়েছে মানুষের চরিত্রের অন্ধকার দিক, বিকৃত রুচি, মানসিকতার। পুরো উপন্যাসের একটাই ব্যাপার ধ্রুব ছিল। সেটা হলো, ❛অপেক্ষা❜। অপেক্ষার এই চক্রে মানুষের আশা, দুঃখগুলো জুড়ে ছিল। অপেক্ষার সাথে সই পাতিয়েছিল বিস্বাদ।
মানবজীবনে অলৌকিক ঘটনা কম ঘটে। এই উপন্যাসেও অলৌকিকতা ছিল কম। যেন সবাই দুঃখের কান্ডারী এভাবেই চলছিল। লেখকের গল্পে ধরে রাখার ক্ষমতা আর সুন্দর বাক্যগঠন এই দুঃখগুলোকে আপন করে নিতে সাহায্য করেছে। তবে উপন্যাসে কিছু অতিমানবীয় ব্যাপার ছিল যেগুলো বাস্তবিক হতে পারতো। সোজা ভাষায় কিছুটা নাটুকে ছিল। সিনেমার দৃশ্যের মতো ব্যাপার একটু বেশি ছিল। যেখানে হয়তো খুব থ্রিল থ্রিল অনুভব হচ্ছে আর লেখকের উপন্যাসে ঘাই দেয়া ব্যাপার জানা আছে বিধায় মানসিকভাবে সে দৃশ্যগুলোর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সেখানেই অনেকটা নাটুকেপনা ছিল। ব্যাপারটা কিছুটা হতাশ করেছে। তবে ৪১৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসে এইটুক মানা যায়। বাকি ব্যাপার লেখক লেখায় পুষিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু কিছু জায়গায় অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, * ১৯৮৪-৮৫ এরদিক মফস্বল শহরে লিফট ছিল ব্যাপারটা অদ্ভুত। * শুরুর দিকে বলেছিলেন রাহেলা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঘর দুয়ার আশপাশে ধুলোই থাকে। সেখানে উপন্যাসের অন্য পর্বে উল্লেখ আছে রাহেলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করতেন। * মনোরমা কনফেকশনারি থেকে শাহেদ পেস্ট্রি খেয়েছে। বাদল দাস নিজেই তাকে খাইয়েছিল। কিন্তু শেষের দিকে বলা হলো এখানে পেস্ট্রি খাওয়ার ইচ্ছে ছিল, খাওয়া হয়নি। * মনোরম�� কনফেকশনারি পরবর্তীতে সেখানে ফার্মেসি জাতীয় কিছু হয়েছিল উল্লেখ ছিল। শেষের দিকে আবার বলা ওখানে এরপর আর কিছু হয়নি।
মফস্বলের বর্ণনা, সময়র ব্যবধানে সেখানকার পরিবর্তন, ধর্মের প্রতিবন্ধকতা, অস্থির সময়ে মানুষের জীবনযাপন, তল্পিতল্পা গুছিয়ে নতুনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়া ব্যাপারগুল জীবন্ত ছিল। ছোটো শহরের ব্যাখ্যাগুলো খুব কাছের, পরিচিত লাগছিল।
শেষটায় গিয়ে অবাক হয়েছি। অনুমান হালকা করতে পারলেও শেষের দিকের ঘটনাগুলো অবাক করেছে। দুঃখ দিয়েছে। দুঃখ দিবে জানা ছিল তবুও মুখে খুশির হাসি ফুটতে গিয়েই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের কম ব্যবধানে যদি অন্ধকারে ছেয়ে যায় তখন কেমন আর লাগবে! শেষটা বিষন্ন সুন্দর। আক্ষেপে পরিপূর্ণ।
তবে জীবনের এই অপ্রাপ্তিতেই প্রাপ্তি থাকে?
চরিত্র:
রুনু চরিত্রকে ভালো না লেগে উপায় নেই। এই চরিত্রের দৃঢ়তা, মানসিক চাপ নেয়ার বল, নিজেকে লুকিয়ে রাখার যে প্রবণতা, উজাড় করে ভালোবাসার মন, দায়িত্ব সবকিছু দারুণ ছিল। বিশেষ সময়ে তার যে শক্তি এটা ড্রামাটিক মনে হলেও এমন দৃঢ় নারী চরিত্র মুগ্ধ করবে। তাকে তো এমন হতেই হবে। কেননা সেও তো একজন আশ্চর্যময়ী! শাহেদ চরিত্রটা পারিপার্শ্বিক চাপ, জীবনের ক্ষত, অনুতাপ আর খুঁজে বেড়ানোর যে প্রবণতা সব মিলে দারুণ। বিশেষ করে ভালোবাসার মানুষের জন্য তার মাঝে যে দুঃখ রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ক্ষণিকের ঐ বর্ণনাটুকুতে তাকে অসাধারণভাবে লিখেছেন লেখক। বিশ্বজিৎ চরিত্রটা আমাদের আশপাশেই আছে। ভালোবাসলেই আসলে সব হয় না। পুরুষ চরিত্রের দাম্ভিক গোপন দিক তার চরিত্রে ফুটে উঠেছে। অনুপম, জয়ন্ত, ফরিদ এই চরিত্রগুলো লেখক সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন। ভালো লেগেছিল রাহেলাকেও। তার ভঙ্গুর জীবনের আলো শাহেদের উপস্থিতি, অনুপস্থিতিতে তার পরিবর্তন গুলো মানানসই ছিল। সোমা চরিত্রটা ভালো লেগেছে। সোমা চরিত্রের খোলাসা দারুণ ছিল। আর লাবণী? যে শরীরীভাবে উপস্থিত ছিল অল্প সময় কিন্তু স্মৃতিতে জীবন্ত ছিল পুরো উপন্যাস জুড়ে। না থেকেও যে মনে জায়গা করে নিয়েছে।
প্রচ্ছদ, প্রোডাকশন:
বইটার প্রচ্ছদ শুরুতে তেমন একটা ভালো লাগেনি। তবে দেখতে দেখতে কেন জানি ভালো লেগে গেছে। অন্যধারার সম্পাদনায় উচিত মনোযোগী হওয়া। কী/কি এর সমস্যা পুরো উপন্যাসজুড়ে ছিল। আরো বেশ কিছু ছাপার ভুল, বানানের অর্থের প্রয়োগে ভুল ছিল।
❛জীবন আপন গতিতে চলে। তবে ছন্দপতন হলে সে জীবনকে পুনরায় হয়তো ছন্দে আনা যায় না। কারণ কিছু ঘায়ের উপর মলম দিলেও সেরে যায় না। এই জগতে কত রহস্য আছে। আছে কত আশ্চর্যময়ী। তারা হয়তো মানুষের জীবনকে থমকে দেয় আবার কখনো তাদের গুণেই জীবন বয়ে চলে।❜
"আশ্চর্যময়ী, তোমাকে" মনে হলো সামাজিক থ্রিলার জনরার। চারশো পৃষ্ঠার বই। গল্পের প্লেট ভালো, এত মোটা বই পড়ার সময় বিরক্ত হয়নি। খুব স্লো ভাবেই এগিয়েছে। শুরু থেকে লাবনী হারিয়ে যাওয়া , রাশেদকে অপহরণ করা, নাজিমুদ্দিনের নিখুঁজ ( রাশেদের মামা) জয়ন্তকে পুলিশ কেন খুজছে, সব কিছুর মোটিভ কি? যতটুকু এক্সপেক্টেশন নিয়ে শুরু করছি।শেষটায় ফুলফীল হয়নি। কেন এতগুলা ছেলে মেয়ে নিখুজ হলো এটার উদেশ্য কি কোনটাই ক্লিয়ার না করে নাটকীয় ভাবে শেষ হলো।
নোট: যা লিখতে চাইছিলাম গুছিয়ে লিখে পারিনি। আশা করি আমার মতো যারা এই প্রশ্নগুলা আসবে তারা বুঝবেন।
আশ্চর্যময়ী, তোমাকে বইটা পড়া শুরুর বেশ কিছুদূর যাবার পরেও ঠিক বুঝছিলাম না কাহিনি কিভাবে, কোনদিকে এগুবে। নিস্তরঙ্গ এক মফস্বলের কিছু মানুষকে নিয়ে কাহিনি৷ ঢাকা থেকে আসা রৌদ্রময়ী আর শাহেদের বন্ধুত্বের সুন্দর কাহিনি থেকে আচমকা যেভাবে প্লট পালটে গেছে, তাতে লেখককে বাহবা দিতে হয়। ছোটবেলা থেকে নানা হলিউডি সিনেমাতে আমরা হরহামেশাই দেখি ছোট শহরের নানা রহস্য, অন্ধকার ব্যাপার-স্যাপার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, তাও আবার আমাদের মোটামুটি চেনা নব্বই দশকেরও আগের সময় ঘিরে লেখা এই বইটা পড়ার অভিজ্ঞতাকে তাই সুখকর বলা যায়।
উপন্যাসের দুটো ব্যাপার নিয়ে না বললেই না। প্রথমটা চরিত্রের বিল্ড আপ। প্রতিটা চরিত্র সাধারণ কিন্তু সূক্ষ্ম। লেখক যেভাবে শহরের বর্ণনা দিয়েছেন, প্রতিটা দৃশ্য সাজিয়েছেন সেগুলো সব চমৎকার ভিজুয়ালাইজ করা গেছে বলে আনন্দ পেয়েছি।
বইটা যখন হাতে নিয়েছিলাম, সাইজ দেখে ভয় পেয়েছিলাম কারণ বড় উপন্যাস আমার পড়তে অনেক সময় লাগে..মাঝেমধ্যে reading block এও চলে যাই।এই বই-এর ক্ষেত্রে তা হয়নি,কারণ বইটা খুব স্মুথলি পড়া যায়। প্লট যদিও একটা দীর্ঘ সময়ের পরিসরে আগায়,কিন্তু মাঝে হুট করে কোনো ধাক্কা লাগেনি,যদিও টুইস্টের কোনো অভাব নেই।আর এ ধরনের উপন্যাস আমার আজীবনই ভালো লাগে
মাত্রই বইটা শেষ করলাম একবুক হাহাকার নিয়ে, এত বিষাদ একটা উপন্যাস। বরাবরের মতোই কোথাও এক ফোটা বাড়তি সাহিত্যের কচকচানি নেই, লেখার জটিলতা নেই, শুধু পাঠকদের জন্য 'শেষটা এমন না হলেও পারত’ এই আক্ষেপ রেখে গেছেন লেখক। গল্প পড়ে শাহেদের জন্য খুব মায়া পড়ে গেছে!!! Highly recommended, পড়ে শেষ করতে সময় লাগবে না একদমই।
৪.৫ 💫 অনেকদিন পরে এমন একটা বই পড়লাম যেটা অনেকদিন মনে থাকবে। রোনান্স আর রোমাঞ্চের ব্যালেন্স লেখক ভালোই করেছেন। শেষটা এতো ট্রমাটিক না করলেও পারতেন, কাহিনির কোনো পার্থক্য থাকতোনা।
মাত্রই (রাত আড়াইটা) বইটা পড়ে শেষ করলাম,এত বড় বইটা বিকালে পড়া শুরু করেছিলাম...বইটার মধ্যে কি যেন একটা আছে যা পাঠককে ধরে রাখে...আমি ছাড়তেই পারছিলাম না বইটা.. বইটা ঠিক কোন জনরায় ফেলা যায় তা বলা দুস্কর,তবে এটা ঠিক যে বইটি পড়তে পড়তে পাঠক ঐ জগতে ডুবে যাবে।আমি চেয়েছিলাম যেন একটা হ্যাপি এন্ডিং হোক কিন্তু লেখকের পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল।অনেক সুন্দর একটি বই সাথে প্রচ্ছদটাও আমার অনেক সুন্দর লেগেছে।
বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ এর পর লেখকের আরেকটি চমৎকার উপন্যাস পড়লাম। মন খারাপের অনূভুতি ও এত সুন্দর হতে পারে। আশ্চর্য! শাহেদ, লাবনী, রৌদ্রময়ী আর সুলতান পুরো নামক ছোট্ট শহরের ভিতরে আটকে আছি। শাহেদ তুমি ভালো থেকো!
🔸বইকথন: জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না, নিজের গতিতে এগিয়ে চলে। তবে কখনো কখনো গতিশীল জীবন প্রায়ই স্থবির করে দেয় প্রিয়মানুষের স্মৃতি আর অসমাপ্ত গল্পগুলো। ‘আশ্চর্যময়ী, তোমাকে’ শরীফুল হাসানের এক সামাজিক থ্রিলার, যেখানে আলো-আঁধারের কথা উঠেছে। পটভূমি সুলতানপুর—এক শান্ত মফস্বল শহর, যা ক্রমান্বয়ে অশান্ত হয়ে উঠে একের পর এক নিখোঁজ সংবাদে।
গল্পের কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র শাহেদ আর রুনু—দু’জনের জীবনের একটা মিল আছে: দুজনের বাবাই নিরুদ্দেশ। সেই সাথে দুজনের মামারও খোঁজ নেই। একদিকে শাহেদের মা রাহেলা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে আর শাহেদও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে পৃথিবী থেকে—শুধু ছবিই তার আশ্রয়। দারুণ ছবি আঁকতে পারে সে। মা ও দিদার মৃত্যুর পর রুনু নানা-নানির আশ্রয়ে থাকতে শুরু করে সুলতানপুরে। রাহেলার বান্ধবী ছিল বিন্দু, আর বিন্দুর মেয়েই রৌদ্রময়ী সেন রুনু। মা মরা মেয়ে রুনুকে রাহেলা বেশ স্নেহ করে, ধীরে ধীরে নিত্যদিনের কথা বলার সঙ্গী হয়ে উঠে রুনু। একসময় শাহেদ-রুনুর পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়, অনুভূতি বদলায়। কিন্তু এর মাঝে সহপাঠী লাবণীর হারিয়ে যাওয়া সবকিছু ভেঙে দেয়। হারিয়ে যায় শান্তা আর ফাতেমা। একসময় শাহেদ নিজেও হারিয়ে যায়—ফিরে আসে ভাগ্যের জোরে, তবে কেমন যেন বদলে যায় সে। কি ঘটেছিল শাহেদের সাথে?শাহেদকে রুনু ভালোবাসে, কিন্তু শাহেদ যেন ডুবে থাকে লাবনী স্মৃতিতে, লাবনীকে খুঁজে পাওয়ার আশায়। অপরদিকে রুনুকে ভালোবাসে বিশ্বজিৎ, বিয়ের কথা চলতে থাকে। শাহেদ-রুনু-বিশ্বজিতের সম্পর্কের পরিণতি শেষে কি হয়?
অন্যদিকে জানা যায়, সংসার ছেড়ে সোমা চক্রবর্তীর পালিয়ে যাওয়ার কথা। সোমা কি পালিয়ে গেছে নাকি হারিয়ে গেছে? কি কারণই বা থাকতে পারে? একসময় সামনে আসে সোমা–জয়ন্ত–অনুপমের অসমাপ্ত ত্রিভুজ প্রেম, বাদল দাস ও ফরিদ মামার ভিন্ন রূপ, হরিণের মুখোশ-পরা রহস্যময় মানুষের কথা, বিকৃত মানসিকতার কথা। আচ্ছা,হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কি ফিরে এসেছিল? নাকি কালের ঘূর্ণাবতে চিরতরে হারিয়ে গেছে তারা?
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা একটাই—কে সেই আশ্চর্যময়ী? রুনু? লাবণী? সোমা? নাকি অন্য কেউ? এতোসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে বইটি পড়ার মাধ্যমে।
🔸পাঠপ্রতিক্রিয়া: একটি সুন্দর গল্প কেবল মানুষের মনে আনন্দ দেয় না, কখনো কখনো মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়, বিষণ্ন করে তোলে, সমাজ বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়; ‘আশ্চর্যময়ী, তোমাকে’ এমনই এক গল্প। গল্পের সূচনা থেকেই অপেক্ষার শুরু , উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেন অপেক্ষার মরীচিকা চক্রে আবর্তিত হচ্ছে। বিশ্বজিৎ চায় রুনুকে, রুনু অপেক্ষা করে শাহেদের, কিন্তু শাহেদ হারিয়ে থাকে লাবনীর স্মৃতিতে। লাবনীকে ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধে তার মা-বাবা। রাহেলা বাঁচে স্বামী সদরুদ্দিন ও ছোটভাই নিজামের ফেরার আশায়। অসিত সেনের আকুলতা জয়ন্তের জন্য, অনুপমের তৃষ্ণা সোমার জন্য। আসমা মামীও ফরিদ মামা ফেরার অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় থাকে। প্রেম, অভ্যাস ও স্মৃতি সবাইকে আটকে রাখে এক অদৃশ্য অপেক্ষার ফাঁদে। এতো অপূর্ণ আকাঙ্খার আড়ালে মানবমনের বিকৃত দিকগুলোও ধীরে ধীরে ফুটে উঠে। আমাদের চারপাশে এমন অনেক চেনাপরিচিত মুখ আছে, যাদের ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালের বর্বর আর বিকৃত রূপটি অদেখা থেকে যায়, সময়ের পরিক্রমায় উন্মোচিত হতে থাকে আসল রূপ। লেখক সুনিপুণভাবে সমাজে আলো-আঁধারের গল্প বলেছেন। সামাজিক উপন্যাসে মিশিয়ে দিয়েছেন থ্রিলারের আবহ।
লেখক শরীফুল হাসানের প্রথম বই পড়া হয়েছে এটা দিয়ে। সাধারণত লেখকের অনন্য সৃষ্টি ‘সাম্ভালা’, ‘ছায়াসময়’, ‘বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ’ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। যদিও আমারও এগুলোই প্রথমে উইশলিস্টে ছিল, কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ‘আশ্চর্যময়ী, তোমাকে’ বইটির মাধ্যমে শরীফুল হাসানের লেখনীর সাথে পরিচয়। ২০২৫-এর বইমেলায় প্রকাশিত এই বইটি মনে বেশ দাগ কেটেছে। লেখক খুব চমৎকারভাবে সমাজের গল্প বলেন, সমাজের সুন্দর দিক বর্ণনা করেন সেইসাথে কুৎসিত রূপও তুলে ধরেন। অন্যান্য বইয়ের মতো এই বইটি নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
সমসাময়িক লেখকের মধ্যে শরীফুল হাসান আমার বেশ প্রিয়। লেখার ধরন সাবলীল, বোধগম্য। আর লেখার মাঝে থ্রিল ভাব তো থাকছেই। আশ্চর্যময়ী, তোমাকেও তেমন। আমি প্রচ্ছদ আর নাম দেখে ভেবেছিলাম বইটা আগা গোড়া রোমান্টিক ধাঁচের। কিন্তু শেষে গিয়ে দেখলাম রহস্যজনক গল্প। এর মাঝেও রোমান্টিক কিছু ধারণা পাওয়া যায়। আমি চেয়েছিলাম হ্যাপি এন্ডিং হোক। চেয়েছিলাম শাহেদ আর রৌদ্রময়ীর একটা গোছানো জীবন হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখক কি করলেন তা সবাই পড়লেই বুঝবেন।