নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়; নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায় ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়। আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে; যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে; তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে? কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে? সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে। নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়, অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আমার এ আশায় যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়, আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায় দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
Syed Shamsul Haque (Bangla: সৈয়দ শামসুল হক) was a Bangladeshi poet and writer. Haq lived alternately in Dhaka and London. He wrote poetry, fiction, plays - mostly in verse and essays. He, the youngest writer to be honored with Bangla Academy Award, achieved it at the age of 29. He was honored with Ekushey Podok in 1984.
(সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মেছিলেন। বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান সৈয়দ হক। এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি।
সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।
সেই বছরই বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ করেন পরিচালকের সহকারী হিসেবে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি। পুরোপুরি মনোযোগ দেন লেখালেখিতে।
১৯৫০-এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।
সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।
বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাট্য। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।)
নাম: নুরুলদীনের সারাজীবন লেখক:সৈয়দ শামসুল হক ধরন: কাব্য নাটক।
নুরুলদীন রংপুর এর একজন কৃষক নেতা। বাংলায় ১১৮৯ সনে জমিদার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মজলুম কৃষক জনতাকে এক করছেন। বাল্যকালে জমিদার এর খাজনা দিতে না পারায় জমিদাররা হালের বদল কেরে নেয়।বাবা বাধ্য হয়ে কাধে তুলে নেন লাঙ্গল জোয়াল। সেই ভাবেই বাবার মৃত্যু হয়। তারপর বাল্যকাল হতেই অত্যাচারিত কৃষকদের একত্রিত করতে থাকে এবং এ কাজে তাকে সহয়তা করে তার বন্ধু আব্বাস। শেষে জমিদার এর সাথে লড়াই সংগ্রামে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুসময় নূরুলদীন বলে যায়- হামার মরন হয়,জীবনের মরণ যে নাই। এক নূরুলদিন যদি চলি যায়, হাজার নূরুলদীন আসিবে বাংলায়।এক নূরুলদীন যদি মিশে যায়,অযুত নূরুলদীন আসি যায়।নিযুত নূরুলদীন যেন যায় বাচি রয়।
তাই তো কবির ভাষায় -- অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়, আবার নুরুলদীন আসিবে বাংলায়,আসিবে নুরুলদীন একদিন কালো পূর্ণিমায়, দিবে ডাক জাগো বাহে কোনঠে সবায়।
পাঠপ্রতিক্রিয়া: নুরুলদীন এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ইন্টারমিডিয়েট এ পড়াকালিন সময়ে তখন এই বই এর প্রস্তাবনা অংশটি আমাদের পাঠ্য ছিল আর সেই থেকেই আমার পরিচয়,।তারপর কবিতাটা কয়েক বার পরেছিলম,,বারবার মনে হয়েছে যেন নুরুলদীন ডাকছে -জাগো বাহে কোনঠে সবাই। তো এবার পুরা নুরুলদীনের সারাজীবন বইটি পরে এতটুকু বলতে পারি যে আমাদের মধ্য নুরুলদীন সত্বাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদেরও অন্যায় অত্যাচার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। তাহলেই ত নুরুলদীন এর ডাকে সারাদেয়া হবে। রেটিং :৫/৫।
গঠনগত বিচারে "নূরলদীনের সারাজীবন" একটি কাব্যনাট্য, আরো সহজে ভেঙ্গে বললে এটি এমন একটি নাটক যার প্রতিটি সংলাপ (নাটকের প্রয়োজনেই নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্য ব্যতীত) ছন্দের অন্ত্যমিল বজায় রেখে রচিত। যেহেতু এটি একটি কাব্যনাট্য, এর বিচার কাব্য এবং নাট্য উভয় আঙ্গিকে করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
বইটির প্রেক্ষাপট ১৭৮২ সনের (১১৮৯ বাংলা) রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ [প্রসংগত বিশেষভাবে উল্লেখ্য, 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' ঘটে ১১৭৬ বাংলা, ১৭৭০ ইং]। চারিত্রিক বিচারে সংখ্যায় খুবই অল্প অথচ সমগুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সন্নিবেশে রচিত এই নাট্যটি দুটি আলাদা গোষ্ঠীর সাংলাপিক পরিক্রমায় রচিতঃ রংপুরের বিদ্রোহী কৃষকসমাজ যার নেতা নূরলদীন (নুরূলউদ্দীন/ নুরুদ্দীন) বনাম ইংরেজ কোম্পানির শাসকগোষ্ঠী। কৃষকচরিত্র সংলাপগুলি রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কাব্যে রচিত এবং ইংরেজ-চরিত্র সংলাপগুলি কাব্যগুণ বজায় রেখে প্রমিত চলিত ভাষায় রচিত।
বলাই বাহুল্য, নাটকের নায়ক/প্রধান চরিত্র নুরলদীন। নাটকের রোমান্টিকতার প্রয়োজনে যদিওবা নুরলদীনের স্ত্রী আম্বিয়ার মধ্যে নায়িকা চরিত্র প্রস্ফুটন্মোখ ছিল, কিন্তু এটি আদতে কোন রোমান্সধর্মী নাটক নয় বলে এই নায়িকা চরিত্র প্রান্তিকভাবে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেনি। উপরন্তু, নাট্যের মাঝামাঝি এক পর্যায়ে আম্বিয়া চরিত্রের হঠাৎ উত্থান (আবির্ভাব বলাই শ্রেয়) এবং হঠাত সমাপ্তি এবং তা যে নায়কের চরিত্র গঠনের প্রয়োজনেই-তা প্রতীয়মান হয়। কৃষকদের সংলাপ আদর্শিক, আম্ভরিক, আবেগপ্রবণ এবং ভাবালুতাময়। কিন্তু ইংরেজদের সংলাপগুলি সাবলীল এবং বুদ্ধিদীপ্তভাবে প্রচ্ছন্ন অথচ প্রকট রসবোধময়; কিন্তু কৌতুক নয়। প্রকৃতপক্ষে, ইংরেজদের সংলাপের এই দৃশ্যগুলিই মূলত এই গম্ভীর নাটকের 'বিশ্রাম' অংশ।
বাস্তব মঞ্চায়নের দিক থেকে চিন্তা করলে, একজন 'সূত্রাধার' এর সূচনায় নাটকটি প্রগমন লাভ করে এবং লেখক নিজেই প্রতি দৃশ্যে দক্ষতার সাথে একাধারে মঞ্চ সংগঠন, পরিচালনা এবং আলোকসজ্জার পথনির্দেশনা রেখেছেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত সবকিছুকেই নির্দেশকের স্বাধীনতায় ছেড়ে দিয়েছেন এমনকি উৎসাহ দিয়েছেন ফ্রেম ভাঙ্গার।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, নুরলদীনের চরিত্রায়নে লেখক বারবার যে "গণমানুষের শাসন" এই দাবিটির ছাপ রাখতে চেয়েছেন আমার জানা নেই এটি কতখানি ঐতিহাসিক আর কতখানি লেখকের কল্পনাপ্রসূত। যদি ঐতিহাসিক হয়, তবে এটি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ যে এত আগের রাষ্ট্রনীতির শিক্ষা (প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা) বিবর্জিত, বলা চলে নিরক্ষর একজন দরিদ্র কৃষকনেতা ক্ষমতালিপ্সার ঊর্ধ্বে উঠে সাম্য, গণরাষ্ট্র এসব বিষয়ে অনুভূতিলাভে সক্ষম ছিল। আর যদি কল্পনাপ্রসূত হয়ে থাকে, তাহলে নায়কের এই দাবিটি আসলে লেখকেরই দাবিতে পরিণত হয়। সেক্ষেত্রে ১৯৮২ সালে রচিত এই বইটি এই কারণে আমার আগ্রহ সঞ্চার করে যে, আশির দশকের লেখকদের মধ্যে এই ধারণাটা আমি আরেক জায়গায় প্রকটভাবে ব্যক্ত পেয়েছি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই' (১৯৮৬)।
বইটি পড়ার আগে দেবীসিংহ, রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে পড়ে নিলে বইটির সময়কাল এবং বিভিন্ন প্রসঙ্গোল্লেখ আরো নিবিড়ভাবে অনুধাবন করা সম্ভবপর হবে এবং ফলশ্রুতিতে পাঠের সময়টুকুতে সন্নিবেশিত হবে নতুন মাত্রা। পাশাপাশি লেখক রচিত বইটির মুখবন্ধ অংশুটুকু অবশ্যপাঠ্য।
সাব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক সম্পর্কে একটা অপপ্রচার আছে আমাদের জেনারেশনে। সে কারনেই তার সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলাম এতদিন। 'নূরলদীনের সারাজীবন' আমার পড়া সৈয়দ হকের প্রথম কোনো সাহিত্য কর্ম। যে অপরিসীম মমতায়, নিপুন হাতের পরশে জীবন্ত করে তুলেছেন একটি নিপীড়িত কৃষক সমাজের ত্রাতা নূরলদীনকে; সেই একই মমতায় এক নূরলদীনই সৈয়দ হককে বাংলা সাহিত্যে দিবে অমরতা, অন্য কিছু যদি তিনি নাও লিখতেন।
নূরলদীনের আহবান যেন আমরা শুনতে পাই-- যাগো বাহে, কোনঠে সবা-য়।
রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহসী কৃষক নেতা নূরলদীনের সংগ্রামের কথা সৈয়দ শামসুল হক অসাধারণ ছন্দময় সংলাপে বর্ণনা করে গেছেন এই "কাব্যনাট্যে"। এই গোঁছের আমার প্রথম পড়া বই এটি। বিংশ শতাব্দীতে এসেও কাব্যের মাধ্যমে যে এত সুন্দর করে একটা পুরো রচনা গেঁথে দেয়ার মত দু:সাধ্য সাধন করা যায় আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না!
জমিদার ও ইংরেজ শ্রেণীর কাছে সর্বস্ব হারানো প্রতিবাদী কন্ঠ নূরলদীন, রাজনীতি-দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ কিছুই না বোঝা স্বপ্নালু দৃষ্টির আম্বিয়া, একইসাথে প্রতিবাদী অথচ বাস্তববাদী ধরনের মানুষ আব্বাস; সবগুলো চরিত্রই এত নিঁখুতভাবে এঁকেছেন, তাও আবার ছন্দে, যেন লেখক আমাকে একটা অলিখিত নিমন্ত্রণ দিয়েই দিলেন তার লেখা আরো কিছু কাব্যনাট্যের রস আস্বাদন করতে। একজন অনন্য মেধাবী মানুষ ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক; আপনাকে আমার সেলাম!
সদ্যপ্রয়া�� সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের "নূরলদীনের সারাজীবন" কাব্যনাটকটি পড়ে ফেললাম। নাটকটিতে লেখক রংপুর অঞ্চলের বৃটিশবিরোধী আন্দোলনকে উপজীব্য করেছেন। নাটকটির মূল চরিত্র নূরলদীন যে তৎকালীন কৃষক সমাজকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিল।
নাটকের এক পর্যায়ে নূরলদীন তার ছোটবেলার কথা স্মরণ করে। তার বাবা আর সে মিলে গরুর বদলে নিজেরা হাল চাষ করতো, কারণ তাদের হালের গরুটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল তার বাবা।
নাটকের আরেক পর্যায়ে নূরলদীনের স্ত্রী আম্বিয়ার ক্ষমতা ও অর্থলোভের বিষয়টি দৃষ্টিকটু লেগেছে। এটিই আমাদের বাস্তব সমাজচিত্র। নেতাদের কৃতিত্ব ম্লান হয়ে যায় তাদের আশে পাশের লোভী মানুষগুলোর কারণে।
সবশেষে বলতে চাই, নূরলদীন আমাদের ইতিহাসে এক স্মরণীয় নাম। যখনি অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তখনি কোন এক নূরলদীনের কন্ঠে ধ্বনিত হবে, 'জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?'
খন্ডখন্ড কিছু কাব্যাংশ অনবদ্য, রক্তে আগুন ধরে, কিছু অংশ মঞ্চে দেখলে কী নাটকীয় আবহ তৈরি হবে তা পড়তে পড়তেই কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে সম্পূর্ণ নাটকটি দুর্বল। লিসবেথ, আম্বিয়া, লেফটেন্যান্ট, মরিস, টমসন- মূলত কিছু ঐতিহাসিক মন্তব্য বাদে তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই। সম্পূর্ণ নাটকটি বরং শুধু নুরলদীন, লালকোরাস-নীলকোরাস, আব্বাসকে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে, তাও আব্বাসও চরিত্র হিসেবে মানবিক হয়ে ওঠে না। বেশ গৎবাঁধা তার উপস্থিতি।
❝ নূরলদীনের সারাজীবন ❞ সৈয়দ শামসুল হকের একটি কাব্যনাট্য।
বইটির সংলাপগুলো কবিতার মতো ছন্দে রচিত হলেও এর কাহিনি প্রবাহ এগিয়ে চলে নাটকের আঙ্গিকে।
নূরলদীন। কৃষক নেতা। যে ১১৮৯ সালে রংপুরের কৃষক সমাজকে স্বৈরাচারী কোম্পানির কুঠিয়ালদের হাত থেকে বাঁচাতে এক কৃষক বিদ্রোহের ডাক দেন। তার ডাকে কৃষক সমাজ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তার ডাকে রংপুরের বাঙালি কৃষক সমাজ স্বৈরাচারীদের হাত থেকে মুক্তির আশায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
তৎকালীন কুঠিয়াল সাহেবদের অত্যাচারে বাঙালি কৃষকরা নীল চাষ করতে বাধ্য হয়। নীল চাষের ফলে তারা শস্য ফলাতে পারে না। সেই সুযোগ ও দেয় না তাদের অত্যাচারী কুঠিয়াল সাহেবরা। ফলে না খেতে পেয়ে তাদের অনেকেই দূর্বল হয়ে পড়ে, অনেকে মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়ে। দুর্ভিক্ষ পরবর্তী সময়ে ১১৭৬ সালের দুর্ভিক্ষের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ইংরেজদের এই অমানুষিক অত্যাচারে তাদের অন্তর বিষিয়ে ওঠে, তারা মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে স্বৈরাচারী কুঠিয়াল ইংরেজরা বাঙালি চাষা—ভূষা,কামার—কুমার,জেলে,মাঝিদের উপর চাপিয়ে দেয় ধনুক ভাঙা রাজস্ব, কর। রাজস্ব না দিতে পারলে বা দিতে অপারগ হলে তাদের উপর নেমে আসে অমানুষিক অত্যাচার,নির্যাতন। তাদের পিঠে নেমে আসে চাবুকের আঘাত। এমন কী ঘরের মেয়ে, বউ কেড়ে নেয় অত্যাচারীরা। এজন্য তারা রাজস্ব দিতে নিজের হালের গরু বিক্রি করে দেয়। দামি দামি ঘটি—বাটি,দামি কাপড়,গয়না সব বাঁধা দিতে থাকে চড়া সুদে। অনেকে আবার বুকে পাথর বেঁধে,বাধ্য হয়ে নিজের পুত্র সন্তানকে ও নগদ অর্থে বিক্রি করে দেয়। এই প্রসঙ্গে নূরলদীনের কন্ঠে ধ্বনিত হয় : ❝ একদিন টাকায় টাকা সুদ স্বীকার করি মহাজনের ঘরোতে গেইলোম, কর্জ শোধ করিবার না পাই বলিয়া জমি লিখিয়া দিলোম,ঘটি বাটি লাঙল বলদ মই বিক্রি করিলোম,বাপ হয়া বিক্রি করিলাম ব্যাটা, স্বামী হয়া ইস্তিরি,যুবতী কন্যা নিলো কাড়ি,,,.....................❞
কৃষক সমাজ দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে। তাদের হাতে না আছে নগদ অর্থ, না আছে পেটে ভাত,না আছে গায়ে বস্ত্র। নূরলদীন আবার বলে ওঠে ; ❝ আগুন, আগুন জ্বলে, এই ঠাঁই, হামার প্যাটোতে, কিষানের সন্তানের প্যাটের ভিতরে। ..........................................উদাম, উদাম তাঁই, এক সুতা বস্ত্র নাই কঙ্কাল গতরে। ❞ নূরলদীন কৃষকের কষ্ট, সমাজের সাধারণ মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করে তাই বিদ্রোহের ডাক দেয়। তার কন্ঠে ধ্বনিত হয় ; ❝ জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়? ❞ অর্থাৎ, জাগো, ভাই, কোথায় সবাই!!! তার ডাকে সারা দেয় বাঙালি সমাজ, জেগে ওঠে সবাই বিদ্রোহী হয়ে, সবার বুকে প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদের আগুন জ্বলে ওঠে। নূরলদীনের ডাকেই কোম্পানির কামানের সামনে, বন্দুকের সামনে নির্দ্বিধায় বুক পেতে দেয় অনেকে। কিন্তু ইংরেজরা আবার তাদের ভয় দেখায়, নূরলদীনকে কেউ সাহায্য করলে তাদের কঠোর—কঠিন শাস্তি পেতে হবে। অনেকে ভয়ে পিছিয়ে যায়, আবার এগিয়ে আসে। অনেকে ভয় পায়, মৃত্যুর, নুরলদীনের মৃত্যুর, নিজের মৃত্যুর, আপনজনের মৃত্যুর ! কিন্তু নূরলদীন অকুতোভয়, নির্ভীক ! তার মনে মৃত্যুর ভয় নেই, আছে শুধু মুক্তির প্রত্যাশা,প্রতীক্ষা! তার কন্ঠে আবারো ধ্বনিত হয় ; ❝ হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই। এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়, নিযুত নূরলদীন য্যান বাঁচি রয়। ❞ তার এ কথায় সবার মনে সাহস সঞ্চয় হয়। সবাই দ্বিগুণ উৎসাহে অত্যাচারী, স্বৈরাচারী ইংরেজদের রুখতে এগিয়ে আসে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নূরলদীনের ডাকে বাঙালি সমাজ কী সত্যিই বিদ্রোহী হয়ে এগিয়ে আসে,নাকি ইংরেজদের কঠোর শাস্তির ভয়ে পিছিয়ে যায়? নূরলদীন শেষ পর্যন্ত কী বিজয় অর্জন করতে পারে,নাকি তাকে বেছে নিতে হয় ভাগ্যের অমোঘ,নির্মম সত্য,মৃত্যুকে?
অনুভূতি : কাব্যনাট্য এই প্রথম পড়া। প্রথম দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে শুরু করলেও মাঝে মাঝে ছেদ পড়ছিল পড়ায় ! তাছাড়া রংপুরের ভাষা অনেক জায়গায় দুর্বোধ্য লাগে। কিন্তু এতকিছুর পরেও কোনো এক অদৃশ্য আকর্ষণে বইটি শেষ করে ফেলি। ❝ জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়? ❞ —অদৃশ্য আকর্ষণ যে এই পংক্তিই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো কিছু অর্জন করতে যে সবাইকে একসাথে জাগতে হয়, রুখে দাঁড়াতে হয় তার মর্মার্থ আমরা জানি!!!
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখার ধরন অতি বৈচিত্র্যময়। বিষয় এবং ধরন অনুযায়ী তিনি তাঁর লেখার ধরন ও পাল্টাতে পারতেন। এই কাব্যনাট্যটি তাঁর অন্যতম সেরা একটি সৃষ্টি। মোট ১৪টি দৃশ্যে সজ্জিত নাটকটির সময়কাল বাংলা ১১৮৯ সাল, বিষয়ঃ রংপুর বিদ্রোহ। রংপুর, দিনাজপুর এবং শেষে কুচবিহার, এই স্থানগুলোর পটভূমিতে কাহিনীটি রচিত। ইতিহাসের পাতায় নূরলদীন পরিচিত নূরুলউদ্দীন নামে, যাঁকে রংপুরের স্থানীয় ভাষায় নূরলদীন ডাকা হতো। সেই নামটিই গ্রহণ করেছেন সৈয়দ হক। ব্রিটিশ শাসনামলে কোম্পানির বিদ্রোহে বাংলাসহ নানান জায়গায় অনেক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম এই রংপুর বিদ্রোহ। এর কথা হয়তো অজানাই থেকে যেতো, ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় সামনে না আনলে। আর এরপর সৈয়দ হক তাঁর এই অবিস্মরণীয় কাব্যনাট্যটির মাধ্যমে অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন নূরলদীনকে। ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রিয় জোতদার দেবী সিংহের অত্যাচারে জর্জরিত কৃষকদেরকে সংঘটিত করেন নূরলদীন। সহায়তা করেন দয়াশীল, আব্বাসসহ অন্যান্যরা। বিদ্রোহ পুরোপুরি সফল না হলেও কোম্পানির অত্যাচারের বির��দ্ধে এ ছিল প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত মশাল। নূরলদীন মৃত্যুর আগেপরে সমানভাবেই তাই উজ্জীবিত করে গেছে কৃষকদের। তাঁর সেই অবিস্মরণীয় আহবান, 'জাগো, বাহে, কোণঠে সবায়?' শুনলে আমাদের ও রক্ত টগবগিয়ে উঠে। নূরলদীনের একমাত্র চাওয়া ছিল, সোনার বাংলার সম্পদ যেন বাংলাদেশেই থাকে। যেন চলে না যায় কোম্পানির হাত ধরে বিদেশে। যেন কৃষকেরা খেয়েপরে মানুষের মতো বাঁচতে পারে। সৈয়দ হক তাঁর অবিস্মরণীয় কাব্যিক রীতিতে ফুটিয়ে তুলেছেন কৃষকদের বিদ্রোহীসত্ত্বা। ফুটিয়ে তুলেছেন নূরলদীনের প্রতিজ্ঞা এবং তেজ, আম্বিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লোভ, কোম্পানির কর্মচারীদের দুরভিসন্ধি এবং ভয়। বাংলা সাহিত্যের এই কালজয়ী সাহিত্যকর্মের অর্ধেক উপাদান নাট্যকার নিয়েছেন ইতিহাস থেকে, বাকি অর্ধেক সম্ভবপরতার ক্ষেত্র থেকে। ছন্দে ছন্দে অত্যাচার, প্রতিবাদ, জয় এবং মৃত্যুর এই সৃষ্টিটি আমার একটি অবিস্মরণীয় পাঠ হয়ে থাকবে।
কবিতার ক্ষমতাটাই এতো বিশাল যে সাধারণ দুই পঙক্তি দিয়ে অসাধারণ গল্প গেঁথে ফেলা যায়। নূরলদীনের এই আখ্যানকাব্যে সৈয়দ শামসুল শামসুল হক যেই চিত্র এঁকেছে তা পাঠকের চোখ মন দুইকেই তৃপ্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এর আগে লেখকের উপন্যাস পড়েছি আর এবার নাটক ও কবিতা,এবং তাকে যে বিনা কারণে সব্যসাচী লেখক বলা হয়না তার প্রমাণ পেয়েছি।
."নূরলদীনের সারাজীবন" নাটকের পটভূমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীলচাষের অত্যাচারে জর্জরিত রংপুর অঞ্চল,কারণ লেখকের পিতৃভূমি এটি।বইটি না পড়লেও কৃষকনেতা নূরলদীনের সংলাপ "জাগো বাহে-এ,কোনঠে সবা-য়" সবার জানা।কিন্তু পুরো নাটকটির সংলাপ ছন্দে ও অসাধারণ শব্দশৈলীতে লেখক যেভাবে অলংকরণ করেছেন তার তুলনা হয়না।তাই এই একটি সংলাপের বাইরে আরো কয়েকটি সংলাপের সাথেও পরিচয় করিয়ে দেই। আব্বাস (নূরলদীনের বাল্যবন্ধু): শোনো হে নূরলদীন,মানুষ এমন এক সৃষ্টিছাড়া জীব, উয়ায় অন্তর কেহ পারে নাই করিতে জরীপ। গুডল্যাড (রংপুরের কালেক্টর)ঃতারুণ্যের স্বভাব অবশ্য প্রৌঢ় যে তরুণ ছিল,কল্পনাও করতে পারে না। যখন সে নিজেই প্রৌঢ় হয়, তরুণের দিকে তার দৃষ্টিপাত করে এই প্রশ্ন জাগে, কোনোদিন আমিও যে তরুণ ছিলাম, এ তরুণ বিশ্বাস করবে? শক্তিশালী সংলাপের জন্য লেখক শক্তিশালী চরিত্রও তৈরি করেছেন।সামান্য এক কোম্পানী কুঠিয়ালের ইংরেজ স্ত্রী,তার মাঝেও দেখিয়েছেন বুদ্ধিমত্তার ঝলক।আর মাঝে মাঝে মঞ্চস্থ নাটকের দৃশ্যের ছবি নাটক পড়ার সাথে সাথে জীবন্ত কল্পনা করতেও সহায়ক।
এক সকালে নূরলদীনের পিতা তাকে পড়তে না গিয়ে নিজের সাথে কাজ করতে যেতে বলায় তার মন আনন্দে ভরে উঠেছিল এই ভেবে যে,আজকে আর শিক্ষকের বকুনি শুনতে হবে না। কিন্তু চাষের সময় গরুর স্থলে নিজে গিয়ে নূরলদীনকে লাঙ্গল ঠেলতে দিয়ে নূরলদীনের আনন্দকে শোকে পরিণত করেন তার পিতা। শারীরিক এবং মনকষ্টে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া পিতার মৃতদেহকে তার মনে হয় হালের বলদের দেহ এবং নিজের শোক চিত্কারকে মনে হয় গরুর হাম্বা ডাক। নূরলদীন আবার কবে নিজের ডাককে মানুষের ডাক মনে করতে পারবে?
এটা আমার পড়া প্রথম কাব্যনাটক। সেজন্যই হয়তো বেশি ভালো লেগেছে।
কাব্যনাট্যে লেখক যেভাবে সাবলীল ছন্দ ও শব্দের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন সত্যিই তা মনকে নাড়া দেয়।। নূরলদীনের মতো শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়৷। নিজের একান্তেই বলে উঠি - 'জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?'