"মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান মানুষ আসতে আছে মহররমের ধুলার সমান মানুষ আসতে আছে ছিপ ডিঙি শালতি ভেলায় মানুষ আসতে আছে লাঠি ভর দিয়া ধুলা পায় মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বউ-বিধবা বইন মানুষ আসতে আছে আচানক বড় বেচইন আম গাছে আম নাই শিলে পড়ছে সব ফুল গাছে ফুল নাই গোটা ঝরছে সব সেই ফুল সেই ফল মানুষের মেলা সন্ধ্যার আগেই য্যান ভরা সন্ধ্যাবেলা কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই একদিক ছাড়া আর কোনোদিক নাই বাচ্চার খিদা মুখে শুকনা দুধ দিয়া খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া।।"
Syed Shamsul Haque (Bangla: সৈয়দ শামসুল হক) was a Bangladeshi poet and writer. Haq lived alternately in Dhaka and London. He wrote poetry, fiction, plays - mostly in verse and essays. He, the youngest writer to be honored with Bangla Academy Award, achieved it at the age of 29. He was honored with Ekushey Podok in 1984.
(সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মেছিলেন। বর্ণাঢ্য লেখকজীবনের অধিকারী সৈয়দ হক। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, চলচ্চিত্রের গান – যা লিখেছেন সবকিছুতেই পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, সাফল্য।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান সৈয়দ হক। এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি।
সৈয়দ হকের লেখালেখির শুরু তাঁর শৈশবেই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে লিখে ফেলেন দুই শতাধিক কবিতা। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়। সেটাই তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।
সেই বছরই বাড়ি থেকে পালিয়ে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে গিয়েছিলেন তিনি। কাজ করেন পরিচালকের সহকারী হিসেবে। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ করেননি। পুরোপুরি মনোযোগ দেন লেখালেখিতে।
১৯৫০-এর দশকেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। তাঁর উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়।
সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।
তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘একদা এক রাজ্যে’, ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’, ‘পরানের গহীন ভিতর’, ‘অপর পুরুষ’, ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’।
বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’, ‘বারো দিনের জীবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘নির্বাসিতা’।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাট্য। এ ছাড়া অসংখ্য অনুবাদ এবং শিশুসাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ হক।)
সাধারণভাবে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু যুদ্ধ এখানে প্রায় অনুপস্থিত—এ দেখে খানিকটা খটকা লাগতে পারে, এবং এর ব্যাখ্যা লেখক নিজেই দিয়েছেন, এবং সেটা হল এই যে, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ঠিক মুক্তিযুদ্ধের নাটক না! এখানে যুদ্ধকে প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করে লেখক আরও বড় একটা মুক্তির জন্য দর্শককে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন। তাঁর ভাষায়, এই মুক্তি ধর্মীয় কুসংস্কার এবং ধর্মের নৌকায় নৈতিক অন্যায়কে পার করিয়ে দেয়ার কর্মকাণ্ড থেকে।
পুরো নাটকটুকু আমার যতখানি ভালো লেগেছে—ঠিক ততখানিই—কিংবা কে জানে, হয়তো তার চেয়ে বেশিই ভালো লেগেছে নাটক নির্মাণ সম্পর্কে শামসুল হকের লেখাটা। ভাষা এবং ভাষার ব্যবহার নিয়ে চমৎকার কিছু চিন্তা ছিল তাঁর।
ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব বেশি নাটক পড়িনি, কাজেই সে অর্থে তুলনামূলক চিন্তা করে বুঝতে পারছি না আদৌ এই নাটকটাকে কতখানি সার্থক বা অন্য কিছু বলা যায়।
সে নাহয় না-ই পারলাম। পড়ে ভালো লেগেছে—পাঠক হিসেবে এই চাওয়াটুকু তো পূর্ণ!
রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এই প্রথম গীতিনাট্য পড়লাম। চমৎকার লেখনী। স্বাধীনতার পটভূমি থাকলেও এ আসলে কালোত্তীর্ণ। পুরো নাটক জুড়ে খুঁজে পেয়েছি ঐ কথারই অনুরণ- “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।”
বইঃ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (প্রথম প্রকাশ- ১৯৭৬) লেখকঃ সৈয়দ শামসুল হক
"সব্যসাচী লেখক" সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ - ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) সাহিত্যের প্রায় সবগুলো শাখাতেই অবদান রাখলেও কাব্যনাট্য রচনায় তার মতো মুন্সিয়ানা বিরল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলা কাব্যনাটকের শৈল্পিক রূপায়নে তিনি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' আদতে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার একটি নাটক। নাটকটি রচনার পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে লেখকের একটি ব্যাখ্যায় আমরা তাঁর আত্মপ্রতিফলন দেখি। তিনি লিখছেন: “সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, বিদেশ থেকে ছুটিতে দেশে ফিরে, ঢাকার প্রবল নাট্যতরঙ্গে ভেসে যাই এবং ফিরে গিয়ে রচনা করি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’- এক সংকীর্ণ ঘরে, টেবিলের অভাবে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে হাঁটুর ওপর খাতা রেখে, অফিস যাতায়াতের পথে পাতাল রেলে মনে মনে; এই রচনাটি শেষ করে উঠবার পরে মনে হয়, দীর্ঘদিন থেকে এরই জন্যে তো আমি প্রস্তুত ছিলাম।” বুঝতেই পারছেন লেখকের হৃদয়ের কাছের একটি রচনা ছিল সেটি।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক কথা আমরা জানি। এ সময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বর অত্যাচার, নিপীড়নের কথা সর্বজনবিদিত। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক এ নাটকে লেখক তাদের কথা নয়, বরং তুলে ধরতে চেয়েছেন আমাদের দেশেরই কিছু মানুষদের কথা, যারা পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিল। কাহিনী বর্ণনায় জানতে পারি, সতেরো গ্রাম নামের একটি জায়গার কথা। চরিত্রায়নে ওঠে আসে তিনটি পক্ষঃ গ্রামবাসী, পীর এবং মাতবর। যুদ্ধের চরম মুহূর্তে একটি অনন্য পরিস্থিতিকে লেখক তুলে এনেছেন। এই প্রতীকী তিনটি পক্ষের কথোপকথনে লেখক অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জনমানুষের সংগ্রামের দিক-কে তুলে এনেছেন, বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তোলেছেন তাদের স্বভাব-প্রকৃতি-মনোভাব কে। আরেকটা দিকের কথা না বললেই নয়। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এই বিরুদ্ধশক্তিরা এদেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করেছে তা পীড়াদায়ক। লেখক তাই 'যুবক' চরিত্রের মাধ্যমে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখিয়েছেন...
এতটুকু হলে, এ নাটকটিকে সাধারণ মানের-ই বলা যেত। যে কারণে এটি অসাধারণত্ব লাভ করেছে সেটি হল এর উপস্থাপনা। কাব্যনাট্য লেখা যে কত কঠিন সেটা অনুমান করলে বুঝা যায়৷ কবিতার মানুষের মন কে অন্যভাবে আকর্ষণ করে৷ খুব অল্প কথায় বিরাট দর্শনের উপস্থাপন কবিতাতেই সম্ভব। সৈয়দ শামসুল হক তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন প্রতিটি দৃশ্যে, যার কারণে পড়তে গেলে মনে ছন্দময় অনুভুতি হয়৷ এত সুন্দর! কিছু কিছু না বলে পারছি না। আমাদের এই সবুজে ঘেরা দেশটার বেশীরভাগ মানুষ ধর্মপ্রাণ হওয়ায় তাদের হৃদয়ে এর আলাদা একটা স্থান আছে। যার কারণে সম্পদের প্রাচুর্য না থাকলেও, সুখ-শান্তি ছিল সবসময়ে। যুদ্ধ শুরু হলে সমাজের অধিপতি ও সুবিধাভোগী-পাকিস্তানপন্থী মাতবরেরা নিজের সুবিধা হাসিলের জন্য বিচার-বিবেক বিসর্জন দিয়ে পাকবাহিনীর পক্ষ নেয়। প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে-ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বেছে নেয় অমোঘ অস্ত্র- ধর্মকে! "আপনেরেই মা-বাপ জানি, কইছেন আগে / মুক্তিবাহিনী থিকা দূরে থাকা লাগে/ তারা নিজেরা ছাওয়াল আর ভাই-বেরাদর/ হইলেও কইছেন তা দুশমনের চর/ কইছেন কুটুম্বিতা নাই তার সাথে/ আসলে এ দ্যাশ(পাকিস্তান) তারা দিতে চায় দুশমনের হাতে"
নিরীহ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তারা ক্ষান্ত হন-নি, কূটকৌশলে তারা ধ্বংস করতে চেয়েছেন আমাদের ভাই-বেরাদরদের। শামসুল হক এ ব্যাপারটিকে তুলে এনেছেন এভাবেঃ "আপনের হুকুম মতো এই সারা সতেরো গেরামে/ কোনোদিন কোনো ব্যাটা মুক্তিবাহিনীর নামে/ আসলেই খ্যাদায়া দিসি, যেমন ভিটায়/ খা খা কাক ডাকলে লাঠি হাতে বৌ-ঝি খেদায়/ আপনার হুকুম মতো খোলা রাখছি চাইরদিকে চোখ/ গেরামের মধ্যে কোন সন্দেহজনক/ ঘোরাফেরা দেখলেই পাছ নিছি সাপের মতন/ হুজুরে(!) হাজির ও করছি দুইচাইরজন।"
কী হৃদয়বিদারক! কী নির্মম! এই দুই-চাইরজন ব্যক্তি দিয়ে লেখক যাদের নির্দেশ করেছেন তাদের ভূমিকা-টাও কি অগ্রাহ্য করা সম্ভব। এদেশের মানুষের প্রবল ধর্মবোধকে কেন তারা এ হীন কাজে ব্যবহার করেছেন- লেখক সে প্রশ্ন তুলেছেন। মাতবর চরিত্রটির সাথে পীর চরিত্রটির এক সংলাপ পড়ুনঃ "আমার পক্ষেই হোন আর বিপক্ষেই হোন/ এ কথাটা অস্বীকার করার মতন/ আপনে যে লোক না, সকলেই জানে/ আর তারা এ-ও জানে/ যে আইজ তিন বছর যাবত/ আপনার বংশের দাদা পরদাদা পিরের বাবদ/ যাবতীয় যা কিছু করার, আকছার/ আমরাই করাইয়াছি। আমার এ বংশ করাইয়াছে/ দুইজন দিয়া আছি এক ছাতি যখন মাথায়/ বাকি সব বাকির খাতায়।"
এই মাতবরেরা নিজেরাও কী করেনি। ভেতর থেকে আঘাত করেছে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে। ক্যাপ্টেন সাবকে উদ্দেশ্য করে মাতবরের এই লাইনগুলো থেকে তার ধারণা পাওয়া যায়ঃ "যখন চেনেন নাই, পদঘাট চিনায়া দিয়াছি/ যখন পারেন নাই, কত লোক ধরাইয়া দিয়াছি/ যখন জোগাড় নাই, দুইবেলা খাবার দিয়াছি/ সাধ্যে যতটুকু ছিল, তারো বেশী দিয়াছি আমি সকল সময়"
মাতবর নামক এ চরিত্রটির মাধ্যমে নাট্যকার যেন আমাদের সতর্ক করেছেন সেইসব মানুষদের ব্যাপারে যারা নানা উপায়ে এবং কৌশলে এরা দেশকে ঠকিয়ে নিজে জিততে চেয়েছে। যা দেখে সাধারণ মানুষেরা ফতিয়াদ জানায়ঃ "বুঝি না আল্লাহর/ কুদরত কারে কয়, কারে কয় বিচার-আচার/ যাদের জীবন হইল জন্তুর লাহান (দারিদ্র্য বুঝাতে)/ তারে কিছু দ্যাও নাই, দিয়াছো ঈমান/ আর যারে সকলি দিয়াছো, অধিকার/ তারেই দিয়াছো তুমি দুনিয়ার ঈমান মাপার।"
কিন্তু এভাবে ফাঁকি দিয়ে কয়দিন... মানুষ একদিন ঠিক-ই বুঝতে পারে... তখন তাদের কন্ঠে বিদ্রোহী কন্ঠে উচ্চারিত হয়ঃ
"মাতবর সাব, ঘুরায়া নিলেন আপনে সোজা কথাটারে.. কথায় কথায় খালি আল্লারে টানেন/ অথচ, আপনারা না জানা থাকুক, বাবা তো জানেন/ কম কইরা বিশ হাজার লোক আছি গেরামে/ দুনিয়াদারির কামে/ লাগা থাকলে-ও তারি মধ্যে দিনে পাঁচবার/ পশ্চিমা ফিরায়া মুখ হুকুমে আল্লাহর/ হাজিরার সময় হলে, সেজদায়/ গেছি, তখন যেখানে খাড়া, খ্যাতে-মাঠে-হালোটে কাদায়/ নিধুয়া পাথারে, বানে কলার ভেলায়/ আতুড় এতিম অন্ধ যখন দেইখাছি/ হাত ভইরা ভিক্ষাও দিয়াছি/ যদিও নিজের ঘরে সারাদিন জোটে নাই শুকনা শাক-ভাত/ আল্লার হুকুমে তবু করি নাই মিসকিন তফাত/ জস্টির দারুণ ঝড়ে দুনিয়ায় লাগলে মাতন/ মসজিদের ছাদ ভাইঙা পড়ছে যখন/ ছুইটা গিয়াছি/ বুকের পাঞ্জর খুইলা সারায়া দিয়াছি/ যদিও নিজের ঘরে ভাঙ্গা চাল দিয়া/ পানি ভইস্যা সারা রাইত, হইছে দরিয়া।"
কী নির্মল উপস্থাপনা। মাতবরের কথায় তারা অনেকদিন যুদ্ধে যোগ না দিলেও, এখন তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিকামী মানুষের দেখা পেয়ে তারা নিজেদের অধিকার- মর্যাদা সম্পর্কে বুঝতে শিখে। পাহাড়সম অপরাধীর শক্তির তেজ কিভাবে ধ্বসে পড়ে, ক্ষয়ে যায়- তার সঠিক হিসাব ধীরে ধীরে আমাদের চেতনায় প্রবেশ করানোর এক শৈল্পিক প্রয়াস সৈয়দ শামসুল হকের এই নাটক।
নাটকটিতে পীর চরিত্রটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবহ এনেছে। এর মাধ্যমে নাট্যকার প্রকৃত ধার্মিকদের কে তোলে ধরেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের সংশয়াপন্ন মনোভাবকে চিহ্নিত করেছেন। চরিত্রটির জটিলতা নাটককে গভীরতা দিয়েছে। এছাড়া মাতবরের মেয়ে চরিত্রটি এই নাটককে জাগরিত করেছে প্রতিবাদী ঢেউয়ে, দেখিয়েছে কীভাবে ব্যাক্তিগত দুঃখ ভুলে সঠিক কাজটি করতে হয়। তবে, চরিত্রটির দুঃখ আর অসহায়ত্ববোধটুকু কি এড়িয়ে যাওয়া যায়?
মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে বিরুদ্ধশক্তিরা এক পর্যায়ে বুঝতে পারে কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা দেখতে পায় মুক্তিকামী মানুষের জয়বার্তার ইশারা। চারিদিকে স্বাধীনতার হাতছানি। নাট্যকার ওই শব্দের আওয়াজ ধারণ করেছেন শিল্পীর অনুভবের উদারতায়। মাতবরের কথামালায় একে রূপ দিয়েছেন এভাবেঃ
"একি! দূরে য্যান শব্দ শুনি যমুনার/ হঠাৎ ভাঙতে আছে খ্যাতের কিনার/ স্রোতের আঙুল দিয়া খালি হাচড়ায়/ ভিটার তলের মাটি যমুনা সরায়/ সাবধান,সাবধান। নাকি ভুল শোনতে আছি?/ কি হয়? কোথায়?/ ও কিসের শব্দ শোনা যায়?" নাট্যকার এই পঙ্কতির মাধ্যমে পাকিস্তানীদের আধিপত্যবাদের পতনের শব্দ পাঠকের কানে পৌছে দিতে চেয়েছেন।
নাটকটিতে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি রূপক ও ছন্দের সংযোজন নাটকটিকে আরো চিত্তাকর্ষক করেছে। সাবলিক ভাষায় লেখা এই নাটক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে, সচেতন করবে লুকিয়ে থাকা সুবিধাবাদী দোসরদের ব্যাপারে...
সবশেষে বলতে চাই, কোন নাটক-ই বইয়ের পৃষ্টায় সম্পূর্ণ নয়, মঞ্চেই তার সম্পূর্ণতা। মঞ্চায়ন নির্দেশনা, আলোক সজ্জা, নিরবচ্ছিন্ন ঘটনাপ্রবাহের অনেককিছুই বই পড়ে বুঝা যাবে না। ফলে অনেককিছুই হয়তো বাকি রয়ে গেল। যেটুকু পেয়েছি সেটাও কম মনে হচ্ছে না। পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
সৈয়দ শামসুল হকের অন্যতম কাব্যনাট্য ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬) মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। এই কাব্যনাটকে তিনি যুদ্ধকালীন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
কাব্যনাট্যের সূচনাকাল মুক্তিযুদ্ধ। সৈয়দ শামসুল হক দেখিয়েছেন, কালীপুর, হাজীগঞ্জ কিংবা ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী থেকে মানুষ আসছে। দলে দলে যমুনার বানের মতো মানুষ আসছে। কাব্যনাটকে তুলে ধরেছেন, "মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা/ মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা/ মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান/ মানুষ আসতে আছে মহররমে ধূলার সমান... মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বৌ-বিধবা বইন/ মানুষ আসতে আছে আচনক বড় বেচইন"। নারী, পুরুষ, শিশু—সবাই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে। আসেন একজন পীর সাহেবও। আর তারা সবাই জড়ো হয় গ্রামের মাতবরের বাড়িতে। মাতবরের কাছেই তাদের সব প্রশ্ন! তাইতো উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে সবাই মাতবরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এই মাতবরই হচ্ছেন নাটকের প্রধান তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি মূলত পাকিস্তানের সহযোগী, দালাল অর্থাৎ রাজাকার।
গ্রামবাসীর সংলাপের মধ্যে দিয়ে নাটকটি শুরু হয় এবং শাখা-প্রশাখা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রা করে। তাদের সংলাপের মাধ্যমেই উঠে আসে তৎকালীন প্রতিকূল-পরিবেশ-পরিস্থিতি। যুদ্ধকালে এ দেশে একশ্রেণির দালাল-ভণ্ড-পাকিস্তানের দোসরদের সৃষ্টি হয় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাশবিকতায় অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন মুক্তিযোদ্ধারাই এ দেশের শত্রু। আর পাকিস্তানি বাহিনীই বরং ইসলাম ধর্ম বাঁচাতে এসেছে। দেশের মানুষকে রক্ষা করতে এসেছে।
ক্রমাগত যুদ্ধজয়ের খবর শোনে গ্রামবাসী, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং এক এক এলাকার মুক্ত হবার খবরও পায় তারা। এতদিন মাতবরের কথায় ‘দেশবিরোধী’ কাজে যোগ দেয়নি জনসাধারণ; কিন্তু আর তাদের থেমে থাকা চলে না। মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাতে চায় তারা। গ্রামবাসীর কথা: "আপনের হুকুম মতো এই সারা সতেরো গেরামে/ কোনোদিন কোনো ব্যাটা মুক্তিবাহিনীর নামে/ আসলেই খেদায়া দিছি যেমন ভিটায়/ খা-খা কাক ডাকলে দুপুর বেলায়/ লাঠি হাতে বৌ-ঝি খেদায়/ আপনের হুকুম মতো খোলা রাখছি চাইরদিকে চোখ/ গেরামের মধ্যে কোনো সন্দেহজনক/ ঘোরাফেরা দেখলেই পাছ নিছি সাপের মতোন/হুজুরে হাজিরও করছি দুই চাইরজন।" কিন্তু সময়ের প্রবাহে ও সংগ্রামের প্রয়োজনে এই উদ্বিগ্ন ও আশাবাদী গ্রামবাসীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তারা বোঝে মাতবর তাদের ভুল পথে পরিচালিত করেছে। তাই তাদের সব প্রশ্ন মাতবরকে ঘিরে। মাতবরকে জনসম্মুখে আসতে বলে এবং তাদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে বলে।
মাতবর এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা গ্রামবাসীকে ধমকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মাতবর আগত গ্রামবাসীর প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেশরক্ষায় আহ্বান জানায়: "কও দেখি, বিপদ কোথায় নাই?/ কোন কামে নাই?/ আর সকল কামের চেয়ে বড় কাম হইল দেশ রক্ষা করা।"গ্রামবাসী মাতবরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর তারা নিজে নিজ বিবেক আর বুদ্ধিকে সম্বল করে সঙ্কল্পে অটল থাকে। তারা শ্রেণিবিভেদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের বিপক্ষে মানসিক অবস্থান নেয়; যুক্তির ওপর দাঁড় করায় নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানের বিচারের ভার। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কাব্যনাট্যে তুলে ধরেছেন এভাবে: "বুঝি না আল্লার/ কুদরত কারে কয়, কারে কয় বিচার আচার।/ যাদের জীবন হইল জন্তুর লাহান/ তারে কিছু দ্যাও নাই, দিয়াছো, অধিকার/ তারেই দিয়েছো তুমি দুনিয়ার ঈমান মাপার।"
যুদ্ধকালে পাকিস্তানপন্থিদের বিশ্বাস ও আস্থায় ফাটল ধরে। চোখের সামনে দেখতে পায় মুক্তিকামী মানুষের বিজয়বার্তা। মাতবরের চেতনার আলোড়নকে নাট্যকার কথামালায় রূপ দিয়েছেন এভাবে: "একি! দূরে য্যান শব্দ শুনি যমুনার।/ হঠাৎ ভাঙতে আছে খ্যাতের কিনার;/ স্রোতের আঙুল দিয়া খালি হাঁচড়ায়/ ভিটার তলের মাটি যমুনা সরায়।/ সাবধান, সাবধান। নাকি ভুল শুনতে আছি?/ কি হয়? কোথায়?/ ও কিসের শব্দ শোনা যায়?/ চুপ করো, চুপ করো শুনতে দাও, শুনি। ...আওয়াজ কি পাই খালি আমি একলাই?"সৈয়দ শামসুল হক গণজাগরণের বার্তা দিয়েছেন। মাতবর অন্ধকা���ের আড়ালে রেখে তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই পর্দা সরতেই জনগণ ফুঁসে ওঠে। তারা মাতবরকে বলে, "এখন যে তারাবসব ঝাড়ে মূলে এক্কোর উধাও /গায়েব কামান তাম্বু, সৈন্যরা ফেরার/ লোকে কয়, যুদ্ধের /কম বেশি সুবিধার/না যাওয়ার ফলে /পিছটান দিছে দলেবলে।" তাদের প্রশ্নের জবাবে মাতবর আবারও ভণ্ডামির আশ্রয় নেয়। মাতবর বলে: "মিথ্যা কথা, ডাহা মিথ্যা কথা, তারা এখানেই আছে/ আছে এই তল্লাটেরই ধারে কাছে/ নতুন কৌশল নিয়া নতুন জাগাতে।"
সৈয়দ শামসুল হক এ কাব্যনাট্যে মাতবরের কৌশল, ভণ্ডামি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যুদ্ধচলাকালে একশ্র��ণির রাজাকার পাকিস্তানিদের তোষণে ব্যস্ত ছিল। তারা দেশের বুকে ছুরি বসিয়ে রক্তাক্ত করতে পিছু হাঁটেনি।
মাতবর গ্রামবাসীদের সঙ্গে যেমন ধূর্ততার আশ্রয় নিয়েছে, তেমনই নিজ কন্যার সঙ্গেও অসৎ থেকেছে। পাকিস্তানিদের লালসার কাছে নিজ পুত্রীকে বিসর্জন দিয়েছে। যুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের মা-বোনের সম্ভ্রম লুটেছে। হত্যা করেছে। পাকিস্তানি দখলদার ও এ দেশীয় দোসরদের হাতে লাঞ্ছনার শিকারে পরিণত হয় নারী। সৈয়দ শামসুল হক সে চিত্রও তুলে ধরেছেন: "মানুষের অধিকার নাই তারে সোয়াল করার/ তবে আছে অধিকার নামটি নিবার/ উচ্চারণ ক্যাবল করার/ আর তাই বা’জান আমার/ আল্লাহতালার নাম নিয়া তিনবার/ আমারে পাঠান তিনি পাপের রাস্তায়/ ‘পরে, পাপ হাজারে হাজার/ মানুষ নিশ্চিত করে, সাক্ষী নাম সেই তো আল্লার/ না, কিছুতেই বা’জানের কোনো বাধে নাই/ কারণ দিছেন তিনি আল্লার দোহাই।"
মাতবর, তার মেয়ে এবং গ্রামবাসীর একের পর এক সংলাপে মুক্তিসংগ্রামের বিষয়গুলো পরিস্ফুটিত হতে থাকে। মাতবর গ্রামবাসীকে জানান, তার মেয়েকে তিনি এক রাতের জন্য হলেও পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে মাতবরের মেয়ে অপমানে-লজ্জায় বিষপানে আত্মহত্যা করে। মেয়ে হঠাৎ বিষপান করে এবং মাটিতে পড়ে যায়। গ্রামবাসী রমণীরা তাকে কোলে নেয়।
ঘটনা এগোতে থাকে। গ্রামের মানুষ মাতবরের মৃত্যু চায়। এদিকে মাতবরের কানে বারবার পায়ের আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। এই আওয়াজ আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের পদধ্বনি। মাতবর সংলাপ আওড়ান, "আমারে মারলেই হবে গেরামের বিপদ উদ্ধার?/ আমার তো সকলই গ্যাছে, কিছু নাই আর। / গুলির আওয়াজ শুনি নিকটে এবার/ পায়ের আওয়াজ শুনি মাঠ হয়া পার/…./ আমার জীবন নিয়া তবে কও কি হবে তোমার?" পীর বলে, "উঠায়া নিলেই সব উঠান কি যায়? দাগ একটা রাইখা যায়।/ মাটিতে সে দাগ এত সহজে কি যায়?’"শেষপর্যন্ত দেখা মেলে মাতবরের মৃতদেহ। লেখক বলেছেন: "দুম করে গোলা ফাটে। অন্ধকার হয়ে যায়। পর মুহূর্তে আলো জ্বলতেই দেখা যায়, মাথার ওপরে প্রকাণ্ড নিশান, মঞ্চ মুক্তিবাহিনীর লোকে লোকারণ্য। পাইকের এক হাতে লাঠির খোল, অন্য হাতে গুলির রক্তাক্ত ফলা। পড়ে আছে মৃত মাতবর।"
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এতে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি তেমন কোন দৃশ্য নেই, আছে যুদ্ধের আবহ। নেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলার মানুষের পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি অবস্থান।
মাতবর, মাতবরের মেয়ে, গ্রামবাসী, পীরসাহেব, পাইক প্রভৃতি চরিত্রের উপস্থিতিতে সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটের নির্মাণ করেছেন। সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে মাতবরশ্রেণি কিভাবে তাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তা দেখিয়েছেন। শেষপর্যন্ত ঝড়ের কবল থেকে নিজেকে ও একমাত্র সন্তানকেও রক্ষা করতে পারেননি। ভেসে গেছে সবটা। সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাকে অবলম্বন করেই এর দৃশ্যান্তর করেছেন। হাজার বছরের বাঙলির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরব অর্জন হয়েছে, তা মতবরের মেয়ের মতো অসহায় নারী-পুরুষের আত্মত্যাগ ও রক্ত বিসর্জনের ফল।
মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম দখল করে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসছে — এমন সংবাদে গ্রামবাসী ভীত সন্ত্রস্ত। মাতবর তাদের বুঝিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা দেশের দুশমন, তাদের থেকে দূরে থাকাই কাম্য। গ্রামবাসীও বিশ্বাস করেছিল তাকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেনি তারা। তাই চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় আর গ্রামে আগমনের খবর পেয়ে তারা ঠাঁয় নেয় গ্রামের মাতবরের কাছে। পরবর্তী সময়ে মাতবর, পীর, গ্রামবাসী, যুবকদল আর মাতবরের মেয়ের কথোপকথনের মাধ্যমে এগিয়ে গেছে 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' নাট্য কাব্যটি। পাঠ পর্যালোচনা : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাট্য কাব্যটিকে মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধের নাটক বলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের আবহ পুরো নাটক জুড়ে থাকলেও, প্রত্যক্ষভাবে অনুপস্থিত। বরং ধর্মীয় কুসংস্কার আর ধর্মের দোহায় দিয়ে অন্যায় কাজ করার প্রবণতার দিকে প্রকটভাবে আলোকপাত করেছেন লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের নাটক রচনার শৈলী অসামান্য। ছন্দে ছন্দে কথোপকথনে শব্দের প্রয়োগে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। কথাবার্তা আর নাটকের ভাব সহজেই বোধগম্য। গ্রামবাসীর কণ্ঠে আক্ষেপ শোনা যায় : "যাদের জীবন হইল জন্তুর লাহান তারে কিছু দ্যাও নাই, দিয়াছো ঈমান; আর যারে সকলি দিয়াছো, অধিকার তারেই দিয়াছো তুমি দুনিয়ার ঈমান মাপার।" এরকমই কিছু কিছু ধর্মীয় টানাপোড়েনের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন তিনি নাটকে। যেন আমাদেরকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কিংবা বিবেকের সামনে দাঁড়া করিয়ে দেবার প্রয়াস তার। কখনও কখনও মাতবর যেন কিসের শব্দ শুনতে পায়, যমুনার জল নাকি ঘোড়ার আওয়াজ। "ও কিসের শব্দ শোনা যায়? চুপ করো, চুপ করো, শুনতে দ্যাও, শুনি।"
মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান মানুষ আসতে আছে মহররমে ধূলার সমান মানুষ আসতে আছে ছিপ ডিঙি শালতি ভেলায় মানুষ আসতে আছে লাঠি ভর দিয়া ধুলা পায় মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বৌ-বিধবা বইন মানুষ আসতে আছে আচানক বড় বেচইন আম গাছে আম নাই শিলে পড়ছে সব ফুল গাছে ফুল নাই গােটা ঝরছে সব সেই ফুল সেই ফল মানুষের মেলা সন্ধ্যার আগেই য্যান ভরা সন্ধ্যাবেলা কই যাই কি করি যে তার ঠিক নাই একদিক ছাড়া আর কোনােদিক নাই বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া খাড়া আছি খালি একজোড়া চক্ষু নিয়া।
সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ❝পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়❞। এক বসায় পড়ে শেষ করলাম। একাত্তরের শেষ দিকে বিজয় যখন সন্নিকটে, তখনকার বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জ-এলাকার এক অভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে সৈয়দ হকের অসাধারণ রচনাশৈলীতে। শুরু থেকে শেষ অবধি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত। তবে যেকোনো নাটকই, বইয়ে পড়ার চেয়ে মঞ্চে অভিনীত হতে দেখাটাই বেশি তৃপ্তির, এটা পড়তে গিয়েও তাই মনে হল। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় পড়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন থেকেই। আজ হঠাৎ করে পড়া হয়ে গেল। এই নাটক পড়ে পাঠক মুক্তিযুদ্ধের সেই অদ্ভুত সময়টাকে এবং দেশের একেবারেই সাধারণ মানুষগুলো- যারা কোন পক্ষেই শক্তভাবে ছিল না তাদের মনের গতিপ্রকৃতি দারুণভাবে অনুভব করতে পারবেন, এখানেই নাট্যকারের সার্থকতা।
সেই আশ্চর্য সময়ে পায়ের আওয়াজ পাওয়ার তাৎপর্যটুকু অনুভব করতে পড়ুন ❝পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ❞!
I have found humanism and lyricism in this book. Prominent writer in Bengali literature Syed Shamsul Haque wrote this masterpiece in London which was in 1975. The main characters of this book poetically delivered their dialogue. On the other hand, it is a wonderful illustration of the liberation war which occurred in 1971. Renowned actors and actress Abdullah Al Mamun, Ferdousy Majumder acted beautifully based on this drama. I have read this book on the recommendation of my father. Highly recommended for those who ardently admire Syed Shamsul Haque's write up. The readers will be swept up by his gorgeous writing. Previously I read his translation works of Shaksphere that eventually left an indelible impact on my mind.