বর্ষার সন্ধ্যায় তেলেভাজা স্রেফ লা-জবাব হলেও সারাদিন উপোসের পর তেলেভাজা দিয়ে পেট ভরাতে গেলে যেমন হয়, ঠিক তেমন অভিজ্ঞতারই সম্মুখীন হলাম এই বইটি পড়তে গিয়ে| “শুকতারা”-র পাতায় মানবেন্দ্র পালের লেখা সব গায়ে-কাঁটা-দেওয়া ছোটগল্পের স্মৃতি অক্ষুন্ন আছে বলে এই বইটি হস্তগত করেছিলাম| বই-এর উপন্যাস (আদতে নভেল্লা)-গুলো পড়তে গিয়ে আদৌ কিন্তু সেই অনুভূতি হলো না| মাত্র তিন-চার পাতায় যেসব টানটান গল্প লেখক পেশ করতেন, এই ফেনিয়ে বড় করা ৩০-৪০ পাতা জোড়া লেখাগুলো তাদের তুলনায় একেবারেই জালি| যে এক-আধখানা লেখা বেশ জমে উঠেছিলো, সেগুলোও দুম করে শেষ করা হয়েছে কোনো নির্ণয়াত্মক পরিণতি ছাড়াই| বাকিগুলোর কথা না লেখাই ভালো, কারণ তাতে সেই গির্জা-পাদ্রী-সাহেব ভূত-অভিশপ্ত ঘর: এই দশচক্রে গল্পকেই ভূতায়িত করে ফেলা হয়েছে| লেখার গুণমাণ-এ ঘাটতির একটা কারণ হতে পারে সম্পাদকের খেয়াল, যাতে এই শতাব্দীতে প্রকাশিত লেখাগুলোই (তাও আবার শুধুমাত্র নভেল্লা) প্রকাশের জন্যে নেওয়া হয়েছে (যখন লেখক অসুস্থ, এবং শারদীয়া “শুকতারা” বাজারের সব থেকে খারাপ পূজাবার্ষিকী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে)| কিন্তু লেখকের আসল ক্ষমতার একটি ঝলক হিসেবে মাত্র একটি ছোটগল্প আছে এই বই-এ, যেটি পড়ে আমায় আবার আকুল হতে হলো এই আশায় যে ভবিষতে কখনো-না-কখনো দেব সাহিত্য কুটির লেখকের ছোটগল্প-গুলোকেও সংকলিত করে আমাদের কাছে পেশ করবে| তদ্দিন অবধি অপেক্ষা করাই উচিত হবে, আর উচিত হবে এই বইটি থেকে দূরে থাকা|
বড় গল্পগুলোর থেকে ছোটগল্প গুলো বেশ টনটনে। শেষের দিকের কিছু লেখা বাদে প্রথম দিকের লেখাগুলো বিশেষ করে বড় গল্পগুলো ভয়ের বদলে বিরক্তি ধরায়। তবে অনেকদিন পরে ভূতের গল্প পড়ছি বলেই কিনা জানিনা, ভালই লেগেছে!
বাংলা সাহিত্যে "ভূত-প্রেত-পেত্নি-ডাইনি" নিয়ে চর্চা কম হয়নি। ঠাকুমার ঝুলি থেকে শুরু করে আধুনিক তন্ত্র-মন্ত্রনির্ভর বই পর্যন্ত দেখলে দেখা যাবে ভুতের বাজার বেশ গরম! আধুনিক "selling like hot kochuries"মার্কা বই আমরা যতই পড়ি, তবুও ক্লাসিকের দিকে মন টানে সবসময়। বাংলা সাহিত্যে ভুত নিয়ে আমার পড়া লেখা সেরা বই বোধ হয় এটি। (হতে পারে এর থেকেও সেরা কিছু আছে, তবে আমার পরিধি এই অবধি)
গল্পগুলোয় লেখার (কিংবা গল্প বলার) ধরণ যতটা সুন্দর, গল্পে কাহিনীর গাঁথুনি ততটা মজবুত ছিল না। জলজ্যান্ত ভূতের উপস্থিতি থাকলেও তাতে ভয়ের অনুভূতি খুব একটা উপস্থিত হতে পারেনি। এছাড়া বেশিরভাগ গল্পের আকারও বেশ বড়সড়, কিন্তু বড় আকারের গল্প হলেও তাতে পরতে পরতে ভয়ের আনাগোনা খুব একটা ছিল না। তবে সুন্দর গল্প বলার ধরনের জন্য এগুলোকেও উপেক্ষা করাই যেত, যদি কি না গল্পগুলোর সার্থক পরিণতি থাকত। "শেষ হৈয়াও হৈলোনা শেষ" ছোটগল্পের একটা বৈশিষ্ট্য হলেও, এখানে অনেক গল্পের "শেষ ই যে হৈলোনা"! একদম হুট করেই শেষ। আরে ভূতের তো একটা গতি করতে হবে, নাকি, অথবা ভূতে পাওয়া মানুষদের? বেশ বড়সড় গল্প হবার পরেও এমন পরিণতিহীন সমাপ্তিটাই বেশি দৃষ্টিকটু লেগেছে। কিন্তু তারপরেও একটা গল্প শেষ করে আরেকটা গল্পে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া গেছে শুধুমাত্র লেখার সুন্দর ধরণটার জন্য। খুব বেশি ভয়ের আশা না নিয়ে, হালকা ভয় ভয় একটা ভাব, কিংবা নিদেন শুধুমাত্র অলৌকিক গল্প পড়ার আশা নিয়ে পড়তে শুরু করলে সময়টা খারাপ কাটবে না।
ও, আর হ্যাঁ, গল্পের সাথে সাথে একটা উপন্যাস (নাকি উপন্যাসিকা) ও আছে। আগে সব গল্পগুলো শেষ করে তারপর উপন্যাসটা পড়েছি। সেটাও ভালোই, অন্তত এতে সমাপ্তি আছে। আর ভয়? না ভয় ততটা নেই। অন্য গল্পগুলো পড়ে বুঝে নিয়েছিলাম কতটুকু আশা করা যায়, সেজন্য বেশ ভালোই লেগেছে।
মানবেন্দ্র পাল (১৯২৬―২০১১) একজন বাঙালি ছোটগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক।।
আমি অনেকদিন থেকে উনার এই ভৌতিক অমনিবাস বইটি পড়বো পড়বো করে ঠিক করে রেখেছিলাম এবং অবশেষে নানান ঝামেলার মধ্য দিয়ে থেকেও সময় নিয়ে হলেও বইটি শেষ করলাম। বলবো আর কি - অসাধারন লেখনি। এরকম ভুতের গল্প এ যাবত কালে খুব সচরাচর দেখা যায় না।।
মোট গল্প ৩০টি। প্রায় প্রতিটা গল্পই স্বাতন্ত্র্য এবং ভৌতিকে আবহে ভরপুর। কোনটিই কোনটি থেকে কম যায় না। ভৌতিক অমনিবাস-২ পড়বো অবশ্যই; এতে কোন সন্দেহ নাই।।
পরিশেষে বলবো বাংলা সাহিত্যে ভৌতিক গল্প বা উপন্যাস অনেক নামকরা সাহিত্যিক লিখেছেন এবং সেই সকল সাহিত্যিকদের প্রতি বিনম্র সম্মান এবং শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই মানবেন্দ্র পাল এর ভৌতিক গল্প বা উপন্যাসসমূহ সম্পূর্ণ অন্যরকম। মানে পড়লেই মনে হয় যে হ্যাঁ আসলেই আমি ভূতের বা ভৌতিক জগতে আছি।।
অনেকদিন পরে একটি ভাল ভৌতিক গল্প ও উপন্যাস এর সংকলন পড়লাম। কিছু গল্প শুধু ভয়ের, কিছু গল্প গা ছমছমে আর কিছু গল্পে ভয় এর সাথে আছে রহস্য। সবচেয়ে ভাল লেগেছে ম্যাকবেথের তরোয়াল।
যখন বয়স কম ছিলো তখন মানবেন্দ্র পালের ভৌতিক বড়গল্প আর নভেলাগুলো দারুন লাগতো। যদিও এখন কোন হরর গল্প বা উপন্যাস পড়ে ভয় পায় না, স্রেফ কৌতুহলে পড়ি, সেই কৌতুহল থেকেই বলবো মানবেন্দ্র পালের গল্পগুলোর আবেদন এখনও কম নয়। বরং উনি কিছুটা আলাদা ঢঙে চিন্তা করতেন, কিন্তু গল্পের এবং ভৌতিক ঘটনাগুলোর স্বাদ দেশি রাখতেন। তার আমলে বা আগে শুকতারা পত্রিকাতে বহুজনা ভালো হরর লিখতো, যেগুলোর একটা দেশি স্বাদ ছিলো। এছাড়া মনে আছে, পনেরো বছর আগে আনন্দমেলা একটা ভৌতিক সংখ্যা বার করেছিলো। সেটাও দারুন ছিলো।