বাবর আলীর রসবোধ, লেখক হিসেবে পরিমিতিবোধ, পর্বতারোহী হিসেবে নিজের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা, প্রকৃতিকে প্রাণময় সত্তা হিসেবে স্বীকার, ছোট ছোট অম্লমধুর ঘটনা, বন্ধুত্ব ও হার না মানা মনোবল - সবকিছুর সম্মিলিত যোগফল "এভারেস্ট ও লোৎসে শিখরে।" বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে লেখকের সাথে বিপদসংকুল অভিযানে ঘুরে এলাম। এতোটা ভালো লাগবে আশা করিনি।
“It’s all about the journey, not about the destination.”
অত্যন্ত পরিচিত এবং ভ্রমণ পরিমণ্ডলে সর্বজনস্বীকৃত এই কথাটা বারবার মনে উঁকি দিচ্ছিল "এভারেস্ট ও লোৎসে শিখরে" বইটির পাতায় পাতায়। কল্পনার মানসপটে একে একে ছবির মতো ভেসে উঠলো বহুল পরিচিত কিছু নাম - নামচে বাজার, অনিন্দ্যসুন্দর পুমোরি, খুম্বু আইসফলের গোলকধাঁধা, ইয়েলো ব্যান্ড, জেনেভা স্পার, ভয়ালদর্শন লোৎসে ফেস, ডেথ জোন প্রভৃতির সমন্বয়ে গোটা এভারেস্ট তথা The Goddess Mother of The World এবং লোৎসে। স্থিতধী এক অভিযাত্রীর এই দিনলিপি পড়তে গিয়ে উষাদি, হ্যাভিয়ের, শচীন, পেম্বা দাই, হতভাগ্য দুই মঙ্গোলিয়ান আরোহী, বীরে তামাং- দের সাথে নিজেকেও এই অভিযানের সহযাত্রী বলে মনে হচ্ছিল।
অভিযাত্রী কিংবা পর্বতারোহী হিসেবে কারো সার্থকতা কোন পাল্লায় মাপা হয় তা জানি না। কিন্তু গল্পকথকের ভূমিকায় বাবর আলীর জবাব নেই! এই ভ্রমণবন্ধুটির লেখালিখির সাথে আমার পরিচয় বহু আগে থেকেই; অঙ্কুরোদগম থেকে চারাগাছ হয়ে সুবিশাল বৃক্ষ রূপে তার লেখার ক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে তারই স্বপ্নের মতো করে- এই অনুভূতি পরম তৃপ্তির।
পাহাড় চড়ার নেশা নিয়ে ব্যাকপ্যাক কাঁধে চাপিয়ে বুনো ট্রেইলে বেরিয়ে পড়া বাবর ভাইকে কুর্নিশ; তার এই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কাজগুলোর জন্যই আজ আমরা একজন পথের কবিকে পেলাম, যিনি আমাদেরকে পাহাড়ের কথা বলেন, প্রকৃতির কথা বলেন!
নিজ মেডিকেলের মানুষ হওয়ার সুবাদে বাবর আলী ভাই এর এভারেস্ট চূড়া ছোঁয়া নিয়ে সবসময়ই একটা গৌরব মিশ্রিত কৌতুহল কিংবা উৎসাহ কাজ করতো। এই অভিযান এর আপডেটের জন্য 'Vertical Dreamers' এর পেজে গিয়ে ঢু মেরে আসতাম পুরো সময়টুকু। এই বই পড়া, তাঁর যাত্রা সম্পর্কে জানা, সাথে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত রসবোধ এবং ফিলোসফি—সবকিছু মিলিয়ে আমি বেশ উপভোগ করেছি।
বাবর আলী ভাইয়ের লেখা কিছু কথা আমার খুব মনে ধরেছে। তুলে দিলাম। “আমি পথিক মানুষ, দেখে যাওয়া আমার কম্মো, বিচার করা নয়।"
“পঞ্চইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ মনে হয় এই জিহ্বাকে। এটি অতিরিক্ত ব্যবহার করে আমরা মাত্রাতিরিক্ত ভোজন করি আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলি। এই একটি অঙ্গের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে পারলে জীবনের নব্বই ভাগ সমস্যাই স্রেফ উবে যাবে।”
"চূড়ায় পৌঁছানোটা লক্ষ্য হলেও যাত্রাপথটুকু যাতে উপভোগ করতে পারি, সেদিকেই থাকে পূর্ণ মনোযোগ। পাহাড়-পর্বতকে কখনোই প্রতিপক্ষ ভাবি না আমি। সেই ধৃষ্টতা আমার নেই। আরোহণের সময় এই সুবিশাল আশ্চর্য ভুখণ্ডের একটা অংশ মনে হয় নিজেকে, ব্যস এটুকুই। কোনো জেদ নিয়ে কখনো কোনো পাহাড়চূড়ার কাছে ছুটে যাই না আমি।”
“আমার মতো খুদে এক মানবসন্তান তার শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে মাত্র। তাকে জয় করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। শীর্ষারোহণের গর্ব বগলদাবা করেও বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। এই সুবিশাল তুষারশিখরের কাছে আমি কতটা তুচ্ছ, ভঙ্গুর, অগুরুত্বপূর্ণ—এই বোধটুকু ফের নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়াতেই আমার আনন্দ।”
অবশেষে নেপালের স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে এভারেস্টের শীর্ষে। পৃথিবীর শীর্ষ বিন্দুতে হিমালয়ের পলির দান বাংলাদেশের ব-দ্বীপের সমুদ্র সমতলের এক ছেলে! এভারেস্ট কিংবা সাগরমাথা কিংবা পিক-১৫ কিংবা চোমোলুংমা- Goddess Mother of the World; যে নামেই ডাকি না কেন তাঁর মহিমা বিন্দুমাত্র কমে না। ভূলোক ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বলোকে দুনিয়ার শেষ বিন্দু সে। আমার মতো খুদে এক মানবসন্তান তার শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে মাত্র। তাকে জয় করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। শীর্ষারোহণের গর্ব বগলদাবা করেও বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। আমার সকল আত্মগরিমা সাগরমাথার পদতলে রেখে যাওয়াই উদ্দেশ্য। 'আমার আমি হই নতজানু'-এতেই আমার সকল আনন্দ। এই সুবিশাল তুষারশিখরের কাছে ক্ষুদ্র মানবসন্তান হিসেবে আমি কতটা তুচ্ছ, ভঙ্গুর আর অগুররুত্বপূর্ণ-এই বোধটুকু ফের নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়াতেই আমার আনন্দ। এই জীবনে প্রথম আট-হাজারি সামিট কিংবা প্রথম এভারেস্ট সামিট একবারই আসে। সেই শৈশবে প্রথমবারের মতো পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার উচ্ছ্বাস নিয়ে কিংবা কৈশোরের বুক ডিবডিব করা প্রেমের অনুভূতি নিয়ে। এই মহার্ঘ অনুভূতি এই জীবনে দ্বিতীয়বার মিলবে না। আজই সেই দিন। সব পর্বতারোহীরই কম-বেশি স্বপ্ন থাকে দুনিয়ার সর্বোচ্চ বিন্দুতে দাঁড়ানোর। সেই স্বপ্ন ছুঁতে পেরে নিজেকে প্রচণ্ড সৌভাগ্যবান মনে হলো!
ঘুরে আসলাম আমিও এভারেস্ট! এডভেঞ্চার, ভ্রমণবৃত্তান্ত আর হিউমার সব মিলিয়ে পড়ে খুবই ভালো লেগেছে।তবে বই এর শেষে সংযুক্ত ছবি গুলো দিনলিপির সাথে সংযুক্ত করে দিলে আরো বেশী ভালো লাগত মনে হচ্ছে!
বাবর আলীর লেখা এটি আমার প্রথম কোনো বই। লেখকের শব্দচয়ন এবং বিশেষণসমূহের ব্যবহার চমৎকৃত করেছে। হঠাৎ করে লেখার মাঝে লেখকের করা সব হাস্যরস উপভোগ করেছি। ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে আগে খুব বেশী একটা বই পড়া না হলে যতবার ভ্রমণ কাহিনী পড়েছি ততবারই ভালো লেগেছে।
তবে এবারে ভ্রমণের সাথে যোগ হয়েছে এডভেঞ্চার। বইয়ে সাদা কাগজে ছাপানো কালো অক্ষরগুলো পড়তে পড়তে আমিও সেই রোমাঞ্চের সঙ্গী হয়েছি; পড়তে গিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করেছে এভারেস্ট শুভ্র রাজ্য, মন চেয়েছে লাবুচে গ্রামের সামদেন আন্টির হাতে বানানো এক কাপ আদা চা নিয়ে এভারেস্টের গহীন নিরবতা উপভোগ করার কিংবা উষাদি আর হ্যাভিয়ারের এক দান উনো খেলার। তবে পড়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় নামগুলো মনে রাখতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে।
বইয়ের শেষ একটা ব্যক্তিগত মতামত শেয়ার করি, এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। আমার ব্���ক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয়েছে বইয়ের শেষে ফটো এলবামে ছবিগুলো না দিয়ে যদি মাঝে মাঝে দিতো তাহলে মনে হয় আরেকটু ভালো হতো।
ষষ্ঠ বাংলাদেশী হিসাবে গত বছর এভারেস্ট ও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের সাথে লোৎসে চূড়া আরোহণ করেন ডা. বাবার আলী। এভারেস্ট নিয়ে চূড়ান্ত রকমের আগ্রহ ছিলো ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু কখনো এভারেস্ট সম্পর্কে গুটি কয়েক গল্প বাদে বাস্তব কিছু পড়িনি। এ বই পড়ে বেশ ভালো ধারণা পেলাম। মনে হচ্ছিল বাবর ভাইয়ের সাথে সাথে অদৃশ্য ভাবে অনুসরণ করছি এভারেস্ট। বইটি মূলত দিনলিপি আকারে লেখা। তার সাথে দেখা হওয়া মোটামুটি সবার সম্পর্কে কিছু না কিছু লিখেছেন। বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন অনেকজনের সাথে। লেখার মান বেশ ভালো ছিলো। এভারেস্ট সম্পর্কে অনেক কিছুর ধারনা ছিল না সেগুলো জানানোর জন্য বাবর ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশাকরি তিনি এভাবে ভ্রমণ করতে থাকবেন আর সেগুলো বই আকারে প্রকাশ করে আমাদের জ্ঞান তৃষ্ণা মেটাতে থাকবেন। শেষে বইতে পড়া চমৎকার একটি উক্তি বলতে চাই - "If your goals don't scare you, they are not big enough"
এই বই পড়া শেষ করবার আগেই জানলাম বাবর আলী এবার অন্নপূর্ণা সামিট করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। মাথায় ঘুরছে মানুষ মরন যন্ত্রণাতে তোয়াক্কা করে কিসের নেশায় এই অভিজানগুলো করে? বই পড়ে এখনো সেই সদুত্তর খুঁজে পাই নি।
বইটির শেষের পাতার ছবি গুলো না দেখেও পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটছে। লওৎস থেকে পেছনের এভারেস্ট এর যে ছবি তোলা হয়েছে আমার কল্পনায় অবশ্যই এর চেয়ে সুন্দর ছবি ভাসছিলো। সুখপাঠ্য।