আচার্য মহাকনককাঞ্চন সুদূর পিঙ্গলগিরির উত্তরাংশে অবস্থিত সারবানবিহার থেকে ভিক্ষুদলসহ বুদ্ধশাসনের মহিমা রক্ষার স্বনির্বাচিত দায় নিয়ে পরিব্রাজনে বহির্গত হয়েছেন। লক্ষ্য, বিরামনগর। এই যাত্রাতেই অশীতিপর কনককাঞ্চন জীবনে শেষবারের মতো একটিবার ছুঁতে চেয়েছেন নিজের যৌবনের কর্মকেন্দ্র অপর গণরাজ্য উদয়নগরীকে। উদয়নগর ও বিরামনগরী— দু জায়গাতেই রাষ্ট্রতন্ত্রের বিভেদ ও ক্ষমতার রক্তপিপাসু লেলিহান লোভের কৃষ্ণচ্ছায়া। ছলবলকৌশল, প্রস্বত্বভোগীদের প্ররোচনা, অন্তর্বিরোধকে পরিপুষ্টিদান, প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে রাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য মোহকুহক বিস্তারের প্রচারণা— সঙ্ঘভেদের প্রচেষ্টা, দেশবিনষ্টির গরলভাস এই উপন্যাসকে ঘটনা-সমাকীর্ণ করে তোলে। খণ্ড-সময়ের অপচিত প্রবাহের তীব্র গড্ডলের মধ্যেও চিরকালীন মানব-প্রতিযাত্রার ইতিহাস- সূত্রটিকে মহাতেজা মহাকনককাঞ্চন মানবসম্বন্ধের অন্তর্সূত্র রূপে আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার করেছেন। ইতিহাস-সম্ভব তন্ত্রের মাঝে থাকা মানুষের ক্ষেত্রে বার বার সভ্যতার অগ্রগতির নামে স্থবির-উন্মত্ততার বিরুদ্ধে মূর্ত প্রতিযাত্রাই অন্তর্শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে।
ধৈর্যের এক ভয়াবহ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম মনে হচ্ছে।
গৌতম বুদ্ধের পরবর্তী সময় নিয়ে লেখা যেকোনো সাহিত্যেই ভাষায় বেশ একটা কাঠিন্য চলে আসে, যা স্বাভাবিকই। কিন্তু, এইখানে, দুর্লভ সূত্রধর যা করেছেন তা মানা গেল না।
ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠককে নাজেহাল করার প্রচেষ্টা যেন এই বই। যদি, ভাষার জটিল ব্যবহারে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকতো, তবে, আপত্তি ছিল না, কিন্তু, অনন্যবর্তী ও আহাম্মকের খুঁদকুড়ো পড়তে গিয়ে আমাদের যে লেখকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তার দেখা এই সাড়ে তিনশো পাতার দীর্ঘ ও ততোধিক জটিল উপন্যাসে খুঁজে পেলাম না।
লেখকের যে সাবলীল ভাষা, সেটার প্রয়োগ যদি এখানে করতেন তবে এক মহাকাব্যিক উপন্যাসের জন্ম হতো নিঃসন্দেহে।
বিনয় মুখোপাধ্যায় (যাযাবর) তার দৃষ্টিপাত বইয়ে লিখেছিলেন, "ডিসেম্বরের সাঁইত্রিশ ডিগ্রির শীতে গালে ঠান্ডা জল দেবার চাইতে চড় দেয়া ভালো"। দুর্লভ সূত্রধরের "আহাম্মকের খুদকুড়ো" এবং "অনন্যবর্তী" এর ম্যাজিকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যখনই "প্রতিযাত্রা" ধরবেন, তখনই অনুভব করবেন সেই ঠান্ডা চড়! দুর্লভ সুত্রধর তার "প্রতিযাত্রা" দিয়ে শুরুতেই পাঠককে একটা পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেন।
প্রতিযাত্রার সবচেয়ে উজ্জ্বল চিহ্ন তার ভাষার স্বকীয়তা। পাঠক তা হাড়ে হাড়ে টের পাবেন; অনুভব করবেন। এহেন ভাষার স্বকীয়তা এবং পাশাপাশি উপমা-রূপকে সজ্জিত মায়াজাল পাঠককে চাবুকের মতো আঘাত করবে। কারন পূর্ববর্তী দুটো বই পাঠ শেষে খুব স্বাভাবিকভাবেই পাঠক একটু আয়েশি-ভঙ্গিমায় প্রতিযাত্রা শুরু করতেই পারেন। কিন্তু এই বই পাঠককে যেমন ফেলে দেয় পরীক্ষার মাঝে, তেমনি অসম্ভব বাড়তি মনোযোগের দাবিদার। এ এক নতুন "দুর্লভ সূত্রধর"। ধ্রুপদ পর্যায়ের এসেন্সে নিয়ে এই বই এক নতুন যাত্রা।
বুদ্ধশাসনের মহিমা রক্ষার দায় নিয়ে আচার্য মহাকনককাঞ্চন যে পরিব্রাজনে বহির্গত হয়েছেন এবং যে সময়কালের কথা বর্ণিত হয়েছে তার অবয়বে মানানসই (পাঠকের জন্যে হয়তো না) পোষাক (ভাষা/শব্দ) প্রয়োগে লেখক বেঁছে নিয়েছেন পালি ভাষা এবং শব্দ। ত্রিপিটক এর সাহিত্য ভাষা হওয়ার কারনে হয়তো "প্রতিযাত্রায়" সেই সময়কার বিমূর্ততা ফুঁটে উঠেছে, পাশাপাশি পাঠকও নিঃসন্দেহে বিমূঢ় হয়ে থাকবেন।
পাঠের শুরুতে বারবার অন্তর্জালে শব্দে অর্থ খুঁজতে যাওয়া এবং না পাওয়ার হতাশা পড়ার গতিকে শ্লথ করেছে। তবে কিছু দূর যাবার পরে টের পাই, বইয়ের শেষে "শব্দসন্ধির" (শব্দার্থ) সংযুক্তি। সেখান থেকে পাঠটুকু অপেক্ষাকৃত সহজতর হয়ে উঠেছে। এবং পর্যায়ক্রমে অন্ধকার সয়ে যাবার মতো অচেনা শব্দগুলোও ধীরে ধীরে অনেকটা বোধগম্য ও পরিচিত হয়ে ধরা দেয়।
যদিও এরূপ ভাষার ব্যবহার এবং বুদ্ধদর্শনের একটানা বয়ান কিছুটা মনোটোনাস হয়ে ওঠে বৈকি, তবে ঠিক তখনই "জুঁই ফুলের ঘ্রাণ" পাঠককে আলাদা সুবাস দিয়ে যায়। সুধীরা এবং আবীরা ও সুপণ্যক-অভিদীপ্তের ঘটনাপ্রবাহ সেই মনোটোনাস ফীল থেকে কিছটা মুক্তি দেয়।
"প্রতিযাত্রার" কাহিনির ব্যপ্তি যে খুব বৃহৎ তা নয়, বরং দুর্লভ সূত্রধরের অন্য বইয়ের মতোই সাধারন একটা কাহিনি ধীরে ধীরে অসম্ভব কোন নাটকীয়তা ছাড়াই খুব সাধারন দিকে মোড় নেয়। শুধু এই জায়গায় এসে হয়তো আমরা কিছুটা পূর্বের দুর্লভ সূত্রধরকে খুঁজে পাই। এটুকু ছাড়া লেখক নিজেকে নিয়ে গেছেন যেমন অন্য উচ্চতায়, তেমনি শুরুতেই বলেছি পাঠককে এক সময়সাপেক্ষ এবং ধৈয্যসাপেক্ষ পরীক্ষায় অবতীর্ন হতেই হবে। আগ্রহী হলে এটুকু বলে রাখা শ্রেয় যে, শুরুর ১/২ প্যারা বা ১ পাতা পড়ে নিয়েই সেই সিদ্ধান্ত নেয়া্ উপকারী বলে গন্য হবে।
দূর্লভ সূত্রধরের "প্রতিযাত্রা" নিয়ে খুব দারুন সময় গিয়েছে বলার উপায় নেই। তবে এই নতুন দুর্লভ সূত্রধরকে আবিস্কারের বিস্ময়টুকু এই সময়ে এসে উপভোগ করেছি। সাথে নিজের ধের্য্যটুকুও একটু বাঁধিয়ে নিয়েছি প্রতিযাত্রার ভাষা ও শব্দের স্বকীয়তায়!
দর্শন যদি হয় পাঠকের তৃষ্ণা ও জানার ধর্ম, তবে দুর্লভ সূত্রধরের "প্রতিযাত্রা"র প্রতি প্রতিযাত্রা মোক্ষম অবশ্যই।
আমার পড়া দুর্লভ সূত্রধরের প্রথম বই অনন্যবর্তী। তারপর পড়েছি আহাম্মকের খুদকুড়ো। তারপর এই সদ্য প্রকাশিত বই প্রতিযাত্রা। প্রতিযাত্রা-য় লেখক সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছেছেন। প্রথমেই বলা দরকার, কেন ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গেলেন লেখক? যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের ফরমাটে আমরা অভ্যস্ত, তা রাজা-রাজড়া, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কন্টকাকীর্ণ। সাম্প্রতিককালে অবশ্য ইতিহাস বিনির্মাণের এক বিশেষ উদ্দেশ্যে ইতিহাস-নির্ভর আখ্যানের দিকে নজর পড়েছে একদল বিশেষ মানুষের। তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এই প্রসঙ্গে লেখক বোধহয় তাঁর পরিকল্পনার প্রথমেই স্মরণে রেখেছিলেন, 'ইতিহাসে রাজা বাদশার কথা, যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী সস্তা হয়ে ছড়াছড়ি যায়।' নীতিকে ছাপিয়ে কৌশলের বড়ো হয়ে ওঠা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহৎ স্বার্থকে বিসর্জন, ক্ষমতার সঙ্গে বণিকগোষ্ঠীর অনৈতিক সমঝোতা, এবং সাধারণের নীরবতা ও মূঢ়তা কীভাবে সভ্যতার রথের চাকাকে বারংবার পিছনের দিকে ঘুরিয়েছে, সেটা লেখক এখানে দেখিয়েছেন এবং ইতিহাস ও মানবসম্বন্ধের মূলসূত্রকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। আমার ইতিহাস-দেখার চোখ পরিবর্তন হলো এই উপন্যাস পড়ে। কাহিনী-সংক্ষেপে যাচ্ছি না, আসলে কাহিনী এখানে মুখ্যও নয়, অন্তত আমার কাছে, আমার কাছে মুখ্য, লেখক যেটা বলার জন্য এমন একটা বৃহৎ উপন্যাসের পরিকল্পনা করেছেন, সেখানে তিনি একশোর মধ্যে দুশো শতাংশ সফল। শেষ দশ বছরে বাংলা সাহিত্যে কী কী ক্লাসিক বা ক্লাসিক-পর্যায়ের লেখা হয়েছে, বিশদে আমি জানি না, কিন্তু এই উপন্যাস যে ক্লাসিক, সে বিষয়ে সন্দেহ আমার অন্তত নেই।
একটাই প্রশ্ন আমার প্রকাশকের কাছে, লেখক পরিচিতি নেই কেন? যিনি এরকম একখানা উপন্যাস এই সময়ে লিখতে পারেন, আমরা তাঁকে জানতে চাই, শুধু লেখায় নয়, ব্যক্তি হিসেবেও। লেখকের আগের উপন্যাস 'অনন্যবর্তী' পড়ে আমি প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম লেখকের সম্পর্কে জানতে চেয়ে। প্রকাশক পাশ-কাটানো উত্তর দিয়েছেন, কিন্তু লেখক সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাননি।
প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি এই উপন্যাসটি যদি আপনি পড়তে চান তাহলে আপনাকে বেশ কিছুটা ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। অন্তত আমাকে দিতে হয়েছে। দুইবারের চেষ্টায় শেষ করা গেলো। প্রায় চারশো পৃষ্ঠার উপন্যাসটির ভাষা তৎসম ও প্রাকৃত শব্দবহুল। যদিও উপন্যাসটির সময়কালের জন্যই হয়তো এমন শব্দচয়ন করেছেন লেখক। তবে এটা আরো একটু সহজ হয়তো হতে পারত। উপন্যাসের কাহিনীর সাথে সাথে একটানা বুদ্ধদর্শনের বর্ণনা কিছুক্ষেত্রে বেশ বিরক্তিকর লেগেছে। মূল কাহিনীও কিছুটা স্লো। তবে যদি ঐতিহাসিক উপন্যাস আপনার প্রিয় হয়ে ��াকে আর ভাষাগত বাধা নিয়ে সমস্যা না থাকে তাহলে পড়ে দেখতেই পারেন।