নন্দিত কথাসাহিত্যিক মাশুদুল হকের এবারের লেখাটা একেবারেই ভিন্নধর্মী। উহু, শুধু ভিন্নধর্মী বললে বোঝা যাবে না, বলতে হবে একেবারেই অসচরাচর। ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার আসিফ দীর্ঘদিন নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী দেখে বেড়িয়েছেন। সেসময়ে তিনি রোগী হিসেবে এমন কিছু বিচিত্র মানুষ পেয়েছেন যাদের রোগব্যধি প্রচলিত চিকিৎসা বিজ্ঞান দিয়ে সবসময় ব্যাখ্যা করা যায় না। রোগ ব্যধির রহস্যময় জগতে থেকে ওর উপলব্ধি হয়েছে সবসময়ে রোগেরা বইপত্রে যেমনটা লেখা থাকে তেমন করে আসে না, সব ব্যধির খবরও আমাদের জানা রয়েছে সেটাও সত্যি না। মেডিকেলে এক প্রিয় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় আসিফ এ-সমস্ত অদ্ভুত ও অচেনা রোগদের নিয়ে লিখতে শুরু করলেন, যার ফলাফল অসচরাচর।
মাশুদুল হকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। এক দশকের বেশি সময় ধরে লিখছেন থ্রিলার, সায়েন্সফিকশন ও শিশু-কিশোর সাহিত্য, প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত ভাবে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে।
সাহিত্য-পুরস্কার : এইচএসবিসি-কালিওকলম তরুণ কথাসাহিত্যিক পুরস্কার ২০১৩।
Masudul Haque is a contemporary writer from Bangladesh known for his works on thrillers, Sci-Fi, and children's literature. His works have been published in Bangladesh and India regularly for the last 12 years. He was awarded the Kali O Kalam Young Writer Award in 2013.
৩.৫/৫ "অসচরাচর ১" এর মতো আবেদন সৃষ্টি করতে না পারলেও ২ এর প্রতিটা গল্পই আমার কমবেশি ভালো লেগেছে। লেখক সফলভাবে কাহিনিতে বৈচিত্র্য, অনিশ্চয়তা ও রোমাঞ্চ ধরে রেখেছেন। এটুকু নিশ্চিত - আমরা একটা স্মরণীয় সিরিজ পেতে যাচ্ছি।
মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বাইরে সব নিয়ম না মানা,বেয়াড়া ধরনের অস্বাভাবিক তথা বিশেষ কেস আছে,সেগুলোকে আমরা Atypical বা অসচরাচরের ছাতার তলে নিয়ে আসতে পারি। তবে ঘরানা বিচারে মাশুদুল হকের ‘অসচরাচর’-কে উইয়ার্ড ফিকশন অথবা মেডিক্যাল থ্রিলার কিংবা বডি হরর ক্যাটাগরিতে ফেলতে গেলে হিমশিম খেতে হবে। গতবছর মাইক্রোবায়োলজির বারান্দায় এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে যখন ‘অসচরাচর’ পড়েছিলাম,তখন ‘হোস্ট’,‘প্যারাসাইট’, ‘ফাঙ্গাল’ গল্পগুলোকে মনে হয়েছিলো বডি হররের স্ট্যান্ডার্ডধারী। অসচরাচরের দ্বিতীয় পর্বে মাশুদুল হক গল্পের বাঁকটা সামান্য বদলে বইয়ে দিয়েছেন ক্লিনিক্যালি রেয়ার কিছু ডিজিজের দিকে। তাই বলে সবগুলো গল্পের ভিত বাস্তব দুনিয়ার উপর দু পায়ে ভর দিয়ে চলে এমন না। ‘অসচরাচর ২’ কে তাই ‘ট্রোজান হর্স’ ধরে নিয়ে একটু ভিন্ন লেন্সে দেখা যাক।
গ্রিস আর ট্রয়ের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে গ্রিকরা তখন খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলো না। তখন নিয়ম ছিল কোনো পক্ষ সম্মানের সঙ্গে লড়াইয়ের ইতি টানতে চাইলে একটি ঘোড়া প্রতিপক্ষের কাছে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। তো গ্রিকরা বড়সড় একটা কাঠের ঘোড়া বানিয়ে প্রতিপক্ষের দুর্গের কাছে রেখে আসলো। এমন ব্যতিক্রমী উপহার পেয়ে ট্রয়ের নগরীর অধিবাসীরা তো খুব খুশি। বিশাল কাঠের ঘোড়াটা দুর্গের ভেতর নিয়ে গেল ওরা। চতুর গ্রিকরা আগেই কায়দা করে তাদের দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের কাঠের এ ঘোড়ার ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল। রাতে সুযোগ বুঝে লুকিয়ে থাকা গ্রিক যোদ্ধারা দুর্গের ফটক ভেতর থেকে খুলে দেয়। বাইরে ঘাপটি মেরে থাকা গ্রিক সৈন্যরা ভেতরে ঢুকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কাবু করে ফেলে ওদের। ফিকশন আর সিনেমার জগতে এই ট্রোজান হর্স টেকনিকটা নজরে পড়ার মতো। ২০১৭ সালে জর্ডান পীল ‘Get Out’ নামে একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন। হরর সিনেমা হিসেবে সুপরিচিত প্যাকেজড হবার পরও পোস্টরেসিয়াল অ্যামেরিকা, নিওলিবারেলিজমের সূক্ষ্ম ক্রিটিক করেছিলো সেই সিনেমা। ট্রোজান হর্স‘অসচরাচর ২’এর পাতায় পাতায় দু লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে এদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ক্রিটিসিজম,রোগীদের প্রোফাইলিং,পাওয়ার পলিটিক্সের ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি।
প্রথম গল্প ‘পিচ্ছিল’ জনপ্রিয় টিভি শো এক্স-ফাইলসের সুপার উইয়ার্ড কোনো এপিসোডের মতো। জেলখানা থেকে কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে কয়েদীরা। জেলার শফিকের ধারণা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পগারপার হয়ে যাচ্ছে এসব দাগী আসামীরা। গরাদের আড়ালে পাওয়া যাচ্ছে বিজাতীয় ভাষার লেবেল সাঁটা ওষুধের কৌটা। হদিশ খুঁজতে ড. আসিফের শরণাপন্ন হলে কোনো মতেই কূলকিনারা করতে পারা যায় না এতো সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে কয়েদীরা পালাচ্ছে কীভাবে? খোঁজ মিলছে না সেই ওষুধেরও অরিজিন সোর্সের। দেশের ওষুধ কোম্পানির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়া ডাক্তারদের সমালোচনার সাথে চাইনিজ-বার্মিজ সাপ্লিমেন্ট বেচে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া কোম্পানি আর মধ্যস্থাকারীদের এক অধরা জায়গায় আলো ফেলেছেন লেখক। রোগীদের আর্থসামাজিক অবস্থা কীভাবে চিকিৎসার উপর প্রভাব ফেলে তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই ‘পাথর’ গল্পে। নুনিয়ারছড়ার জেলে বস্তি থেকে আসা বছর ত্রিশেকের রত্না সার্জারি ওয়ার্ড ভর্তি হয় কোলেলিথিয়াসিস অর্থাৎ পিত্তথলিতে পাথর নিয়ে। তার এই পাথর অপসারণের নেপথ্যে মাশুদুল হক আমাদের শুনিয়ে দেন সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্বল্পমূল্যেরও ঔষধ না কিনতে পারার অবস্থার কথা। কারণটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসহযোগিতা হলেও, পয়সার অভাবও যে খানিকটা দায়ী তার পরিস্থিতিটা অনেকটা দেখতে পাই রত্নার গল্পে।
একজন রোগী যতটা না তার চিকিৎসা চায়, অনেক সময়ই তার চেয়ে বেশি করে চায় জানতে-তার আসলে কী হয়েছে। একই ব্যাধির একাধিক দাওয়াই থাকতে পারে, নানা ভাবে চলতে পারে তার চিকিৎসা, ট্রেডিশনাল মেডিসিন, সার্জারি, অ্যায়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি কত ধারার কত পথ রয়েছে। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্তও রোগী নিতে পারেন। কিন্তু তার কী হয়েছে সেই ব্যাধির নাম না জানলে এক অদ্ভুত অসহায়ত্বের সাধ্যে মানুষ মাত্রই পড়ে যান। এই সত্যের হাত ধরে আরেকটি যে সত্য, যেটি আমি নিজ জীবন থেকে শিক্ষা আছে, সেটা হলো কেউ না চাইলে কোনোক্রমেই তার রোগ নির্ণয় করা উচিত নয়। ডায়াগনসিস তাই কিছুটা অন্তর্বাসের রঙের মতো, যে চাইছে না আপনাকে তা জানাতে, উপযাজক হয়ে সেটা আন্দাজ করতে গেলে একটা অস্বস্তিকর মনোমালিন্য হতে পারে। এই অস্বস্তিকর এক ঘটনার মুখোমুখি হোন ড. আসিফ ‘মেরিনা ’গল্পে। প্রিয়ন মিডিয়েটেড, স্লোলি প্রোগ্রেসিভ ডিজিজ ‘কুরু’। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের পাপুয়া নিউগিনির লোকেরা একে একে হাসতে হাসতে মরতে শুরু করেছিলো,কারণ ছিল এই ডিজিজের আগ্রাসন। এর আগে তানজিনা হোসেনের ‘লালেং গ্রামের মেয়ে’ উপন্যাসিকায় এই রোগের উল্লেখ প্রথমবারের মতো পাওয়া যায়। মেরিনার উপসংহার অবধি না যাওয়া অবধি রোগের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল হলেও মাশুদুল হকের ক্ষুরধার এক্সিকিউশনের দরুণ প্রান্তিক অঞ্চলের পাওয়ার পলিটিক্সের এক কিলার কম্বিনেশন ঘটেছে এইখানে। মেরিনা গল্পে মেরিনার চাচা ইয়াকুব জামান আর ড. আসিফের মধ্যকার কথোপকথন লক্ষ্য করা যাক। ইয়াকুব জামানের ধারণা নিপা ভাইরাসের মতো কোনো ভাইরাস ওই নির্দিষ্ট এলাকায় আছে। এনসেফালাইটিসের সাইন সিম্পটমের পরিধি ধরে এই এজেন্টকে দায়ী করা হলেও ড. আসিফ তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। ড. আসিফ কিন্তু জামানের মতো ‘নিপা’ বললেন না,বললেন ‘নিপাহ ভাইরাস’(Nipah) যেটা কিনা ওই ফিল্ডের সাথে জড়িত না হলে ভুল করাটাই স্বাভাবিক। এখানেই শুধু দু-এক লাইনে মাশুদুল হক বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘Who's the doctor here?’ টুইস্ট নির্মানে যথেষ্ট কুশলী হওয়ায় গল্পের চমৎকারিত্ব নজরে পড়ে।‘নির্বাণ আশ্রম’ গল্পটাও ‘ফাইব্রোডিসপ্লাসিয়া অসিফিকানস প্রগ্রেসিভা’ নামের এক দুর্লভ রোগকে উপজীব্য করে লেখা। সম্ভবত ‘অসচরাচর ২’ এর সবথেকে সিনেম্যাটিক টার্নিং দেখা গেছে এখানে। সৈয়দপুর,দিনাজপুর,সিলেটের গোলাপগঞ্জ,জকিগঞ্জ,ঢাকাসহ মানচিত্রের বিস্তৃত জায়গা কভার করতে গিয়ে ন্যারেটিভের টোন পাল্টে পাল্টে গেছে সেখানকার মানুষজনের স্বভাব-চরিত্রে,আঞ্চলিকতা,শরীরী ভাষায়।
‘অসচরাচর’ এর পাঠপ্রতিক্রিয়ায় ড. আসিফকে আনরিয়ালেবল ন্যারেটর হিসেবে উল্লেখ করেছিলাম। দ্বিতীয় পর্ব পড়ে সেই ধারণা আরো পোক্ত হলো। এই ব্যতিক্রমী, সেরিব্রাল গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে মাশুদুল হক সিরিজটার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গেলে একটা ‘ট্রেডমার্ক’ সেট হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। প্রথম পর্বে আদিব রেজা রঙ্গনের অঙ্কনের সাথে এই পর্বে শামীম আহমেদের কাজের পার্থক্য স্পষ্টভাবে খেয়াল করা যায়। আদিবের কাজে হরর মাস্টার জুনজি ইতোর প্রভাব খুব স্পষ্ট ছিল। শামীমের কাজ সে হিসেবে অন্যরকম,স্বকীয়তাও লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় পর্ব নাতিদীর্ঘ হলেও স্পষ্ট ফারাক নজর এড়ায় না। পর্ব তিনের অপেক্ষায়...
সমসাময়িক থ্রিলার লেখকদের মধ্যে মাশুদুল হকের লেখাই আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। তার কোনো লেখাই খুব খারাপ বা খারাপ লাগেনি এখনো পর্যন্ত। 'অসচরাচর' পড়ে ভালো লেগেছিল এবং তার ধারাবাহিকতায় 'অসচরাচর ২' পড়া হলো। ওয়ান টাইম রিড বা রিলাক্সিং রিড হিসেবে ভালো বলা যায়, তবে 'অসচরাচর' এর মতো ভালো লাগেনি।
প্রথমটার মতোই অসচরাচর ২ ও দারুন লাগলো। এই ধরনের বই পড়তে কিছুটা অস্বস্তি লাগে সত্যি। তবে পড়ার সময় ভীষণ রকমের কৌতূহলও কাজ করে। কৌতূহল জাগিয়ে পাঠককে অস্বস্তির মধ্যেও বইয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারার পুরো কৃতিত্ব লেখকের। একটা বিরাট অভিযোগ হচ্ছে বইটা এত পাতলা কেন? অসচরাচর ৩ গাবদো গোবদু মুটো রকমের চাই।
"সব সুস্থ মানুষ একই রকম, অসুস্থ মানুষেরা নিজেদের মত করে নানা ভাবে অসুস্থ।"
বহুদিন পর কোনো গল্পসংকলন পড়ে সম্পূর্ণ তৃপ্তি পেলাম। বই দুটো শেষ করার পর আফসোস হচ্ছে—কেন শেষ হয়ে গেল! "অসচরাচর" এবং "অসচরাচর ২" এই দুই সংকলনের নয়টি গল্পই মুগ্ধ, বিস্মিত আর শিহরিত করেছে। গল্পের সহজবোধ্য ভাষাশৈলী সাধারণ পাঠকদের কাছে বই দুটোকে খুব দ্রুত পৌঁছে দিবে আর বোদ্ধা পাঠকের জন্যও রয়েছে ভাবনার খোরাক।
প্রতিটি গল্পকেই মেডিকেল বা বডি হরর বলা যায়। গল্পের মধ্যে ব্যবহৃত মেডিকেল টার্মগুলো এত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, যেকোনো পাঠক অনায়াসেই গল্পগুলো উপভোগ করতে পারবেন। লেখক মাশুদুল হক দক্ষতার সঙ্গে ডাক্তার আসিফ আহমেদ চরিত্রের মাধ্যমে সবগুলো গল্পকে সংযুক্ত করেছেন এবং গ্রামীণ আবহ ব্যবহার করে গল্পগুলোর ভীতিকর অনূভূতিকে আরও বাস্তব করে তুলেছেন—এই বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেছে।
"অসচরাচর" সংকলনের পাঁচটি গল্প—হোস্ট, প্যারাসাইট, ফাঙ্গাল, ইয়ানোমামিয়ান এবং আন্না; এবং "অসচরাচর ২"-এর চারটি গল্প—পিচ্ছিল, নির্বাণ আশ্রম, মেরিনা এবং পাথর—প্রতিটি গল্পই অনন্য ও সমানভাবে দুর্দান্ত লেগেছে। তাই নির্দিষ্ট করে কোনো একটি প্রিয় গল্প বেছে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বইয়ের নামের মতোই প্রতিটি গল্প "অসচরাচর", যা সাধারণত আমাদের কল্পনারও বাইরে। পড়তে পড়তে আপনি ভয় পাবেন, শিউরে উঠবেন, অস্বস্তি অনুভব করবেন, আবার বিস্মিত হয়ে চিন্তায় নিমগ্ন হবেন। কিছু বিষয় নিয়ে হয়তো আমার মতো ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করতেও বাধ্য হবেন! এমন গল্পসংকলন আপনার অবশ্যই পড়া উচিত। হাইলি রেকমেন্ডেড।
শামীম আহমেদ এবং আদিব রেজা রঙ্গনের করা প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন প্রতিটি গল্পের আবহের সঙ্গে দারুণভাবে মানানসই এবং মনোমুগ্ধকর। চিরকুটের প্রোডাকশন কোয়ালিটি আর বইয়ের মূল্য নির্ধারণ একদম যথার্থ। লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এমন অনবদ্য গল্প উপহার দেওয়ার জন্য। পরবর্তী বইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম!
এই বইটা আগের বইয়ের চাইতে বেশি ভালো লেগেছে। যদিও প্রথম গল্পটি সাইন্স ফিকশন গোছের। কিন্তু মাঝের দুটি গল্পের বাস্তব ব্যাখ্যা রয়েছে এবং অত্যন্ত দুর্লভ দুটি রোগ। দুটি রোগের নামই পড়ার বই থেকে জানা ছিল কিন্তু কখনো বিস্তারিত জানবার আগ্রহ হয় নি। এই বই পড়ে সেই আগ্রহ হচ্ছে, আমার কাছে বইটার গুরুত্বপূর্ণ দিক সেটা একটা। পাশাপাশি গল্পগুলো যে আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে সেটাও দারুণ একটা আবহ দেয়। সব মিলিয়ে আজকের এই বৃষ্টিমুখর অন্ধকার দিনে অসচরাচর এর দ্বিতীয় খণ্ড একটা অসচরাচর অভিজ্ঞতাই দিল।
অসচরাচর ২ শেষ করলাম । টানা অনেক গুলা বই পড়া হল । এভাবে সারা দিনরাত না পড়ে, প্রতিদিন কিভাবে একটু একটু পড়া যায় সেটা যে কবে করতে পারব । আবার কয়েকমাস যাবে একদম কোনকিছু না পড়েই । যাইহোক অসচরাচর এর মতই অসচরাচর ২ এর ছোট গল্পগুলি। বই এর নামটা দেখলে সোজা সরল লাগলেও মনে মনে উচ্চারণ করতে গেলে দেখা যায় বারবার ভুল বলছি । বইয়ের বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই । যেরকম আশা করেছি তেমন পেয়েছি । বলব লেখকের বিষয়ে । ২০১৭ সালের কোন এক সকাল । হেরিংটন ভবনের কোন এক রুমে নটর ডেম কলেজে ভর্তির ভাইভা দিতে ঢুকলাম । টেবিলের অপর পাশে দেখি আমার চে কম বয়সী এক ছেলে ও আমার কিছু বড় এক মেয়ে বসা । ভর্তি হয়ে জেনেছিলাম তারা ছিলেন ডন স্যার আর আতিকা ম্যাম । ডন স্যার এক দুইটা একাডেমিক প্রশ্ন করার পর সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন , " স্কুলের পড়ার বাইরের কোনো বই পড়েছ ? " আমি উত্তর দিলাম । এরপর জিজ্ঞেস করলেন সর্বশেষ কোন বই পড়েছ । তখন মাত্র মিনিমালিস্ট শেষ করেছি । কিন্তু স্যার তো বইয়ের নাম আগে শুনেন নি । জিজ্ঞেস করলেন " রাইটার কে ? " আমি বললাম মাশুদুল হক । উনি বললেন , "মাশুদুল হক কে ? " মাশুদুল হকের কাছে আমার প্রশ্ন " ডা. আসিফ আহমেদ কে ? "
প্রথমটার মতো ঠিক জমলো নাহ। সব মিলিয়ে চারটা গল্প তবে মনে রাখার মত গল্প একটাই সেটা হলো 'মেরিনা'। প্রথম গল্প দুটো এভারেজ ক্যাটাগরির। তবে শেষ গল্পটা লেখক একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। দু একটা গল্পের শেষে তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট কিন্তু পড়তে একঘেয়ে লাগেনা। তবে লেখকের এই ভিন্নধর্মী কেসগুলো ইন্টারেস্টিং এবং সেদিক থেকে তিনি সফল বলা চলে।
রমজান আসলেই আমার জীবন এমন এক ট্র্যাকে উঠে, যেখানে ঘুমের সিগন্যাল থাকে কিন্তু রিসিভার কাজ করে না। সারাদিন ঝিমাই, ক্লাসের লেকচারে মাথা ঘুরে, আর রাত হলেই চোখে ঘুমের নামগন্ধ নেই। সেদিনও তাই, মাঝরাত পার হয়ে যাচ্ছে, আমি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছি, মাথার মধ্যে রযান্ডম চিন্তার ফেস্টিভ্যাল চলছে।
ঠিক তখনই মনে হলো—আরে, বইমেলার বইগুলো এখনো এক কোণায় পড়ে আছে! হাতড়াতে হাতড়াতে উঠিয়ে আনলাম অসচরাচর ২। কিন্তু আমি এবার স্মার্ট, প্রথমটার মতো হাইপের পাল্লায় আর পড়বো না। নিজেকেই কঠিনভাবে ব্রিফ করলাম— "দেখ, তোর হৃদয় জুনজি ইতোর বডি হরর পড়ে পড়ে মরচে ধরা লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে, বেশি আশা করিস না!"
কিন্তু বই খোলার পরই বুঝলাম, আমি আসলে একদম ভুল জায়গায় সতর্কতা নিয়েছিলাম। লেখক কোনো ওয়ার্ম-আপ টাইম না দিয়েই আমার বিশ্বাস, যুক্তি আর ব্রেনের সিগন্যাল প্রসেসিং এক ধাক্কায় ক্র্যাশ করিয়ে দিলেন।
চারটা মেডিকেল কেস, চারটা এমন অদ্ভুত রোগ (যদি ওগুলোকে রোগ বলা চলে!), আর প্রত্যেকটা গল্পের শেষে আমার একটাই প্রতিক্রিয়া—"ওমা, এমনও হয়!" লেখক যেন বইয়ের পাতা ফুঁড়ে বের হয়ে এসে আমাকে বলছেন, "আপা, এমন রোগ হয় কখনো ভাবসেন?" আমি তখন ফ্রিজ হয়ে তাকিয়ে আছি, "ভাই, সত্যিই এমন রোগ হয়?"
সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেলাম "নির্বাণ আশ্রম"-এ। এক পাগলা আর্টিস্ট, যার শিল্পের কাঁচামাল ফাইব্রোডিসপ্লেসিয়া অসিফিকানস প্রগ্রেসিভা। গ্রে’স অ্যানাটমি-তে দেখার সুবাদে রোগের নামটা পড়তে গিয়ে জিভ প্যাঁচ লাগেনি, তবে গল্পের এন্ডিংটা আরেকটু বেশি শকিং হলে ভালো লাগতো।
পিচ্ছিল-এর লাস্ট স্টেজে শফিকের চেহারাটা কেমন হয়েছিল, এটা ভিজ্যুয়ালাইজ করতে গিয়ে ব্রেন হ্যাং হয়ে গেলো। একটা ইলাস্ট্রেশন থাকলে পারফেক্ট হতো!
মেরিনা পড়ে মনে হলো, কিছু অসুখের সত্যিই কোনো আগামাথা নেই!
পাথর-এর এন্ডিংও তাই—শুরুর আগেই শেষ!
লেখকের যেন কোথাও তাড়াহুড়ো ছিল! গল্প জমজমাট করে শুরু করলেন, তারপর এমনভাবে শেষ করলেন যে মনে হলো হুট করে কারেন্ট চলে গেছে, আর আমি অন্ধকার ঘরে বসে বুঝতে পারছি না কী হলো!
শেষ পর্যন্ত যখন বইটা বন্ধ করলাম, মনে হলো হাতে ছিল হাওয়াই মিঠাই, হুট করে ঝড় এল আর সেটা পানিতে গলে গেলো!
এবার আসি প্রোডাকশন কোয়ালিটিতে—ইলাস্ট্রেশন এইবার আর আগের মতো ঝকঝকে লাগলো না, একটু বেশি এবস্ট্রাক্ট হয়ে গেছে। পাতার কোয়ালিটির গ্রাফ এমনভাবে নামছে, মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের মতো অবস্থা।
সব দোষত্রুটি একপাশে রাখলে, অসচরাচর ২ আসলেই অসচরাচর ভালো লেগেছে! এক্সপেকটেশন যতটা লো রেখেছিলাম, ধাক্কাটা ততটাই বড় ছিল। লেখক খুবই মাস্টারপ্ল্যান করে আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন—আর আমি খুশি মনে সেই ফাঁদে পা দিয়েছি! ভিন্নধর্মী গল্প যারা ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটা মাস্ট রিড।
বিশেষ করে যদি আপনি মেডিকেল থ্রিলার, গা ছমছমে রহস্য আর অদ্ভুত কেস স্টাডির ভক্ত হন।
আমার মতো যদি ভাবেন, "দেখি কেমন হয়!"—তাহলে সাবধান, একবার শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত উঠতে পারবেন না। এক্সপেক্টেশন লো রাখুন, কিন্তু সারপ্রাইজের জন্য প্রস্তুত থাকুন!
অসচরাচর ২ তে আছে চারটি গল্প - পিচ্ছিল, নির্বাণ আশ্রম, মেরিনা, পাথর। তন্মধ্যে আমার কাছে নির্বাণ আশ্রম বেশ লেগেছে, বাকিগুলো ঠিকঠাক তবে অসচরাচর ১ এর মতন এতটা মাথায় গেঁথে যায়নি! কোনো মিল থাকলে বা রোগীগুলোর যারা মারা যায়নি পরবর্তীতে কী হলো জানতে পারলে ভালোই লাগতো!
Silas Lamb: Cure them? To what purpose? Edward Newgate: Well to... Bring them back to their senses. Silas Lamb: And make a miserable man out of a perfectly happy horse? ( Stone Hearst Asylum)
একজন রোগী যতটা না চিকিৎসা চায়, অনেক সময়ই তার চেয়ে বেশি করে জানতে - তার আসলে কী হয়েছে। একই ব্যাধির একাধিক দাওয়াই থাকতে পারে, নানা ভাবে চলতে পারে তার চিকিৎসা, ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন, সার্জারি, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি কত ধারার কত পথ রয়েছে। এমনকি কোনো চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্তও রোগী নিতে পারেন। কিন্তু তার কী হয়েছে সেই ব্যাধির নাম না জানলে অদ্ভুত এক অসহায়ত্বের মধ্যে মানুষ মাত্রই পড়ে যান।
মেলার বহুল প্রতীক্ষিত বইটা পড়ে শেষ করলাম। নাহ, এবারও হতাশ হতে হয়নি। তবে গল্পের সংখ্যা কম বলে একটু মন খারাপ লাগছিল। চারটা গল্পই সমান উপভোগ্য। একেবারে ভিন্নধর্মী, অসচরাচর কেস। তবে সবথেকে ভালো লেগেছে মেরিনা নামের গল্পটা। বেশ সাসপেন্স দিয়ে শুরু ও শেষ একটা ধাক্কা দিয়ে। পাথর গল্পটাও সুন্দর। সবমিলিয়ে রহস্য-রোমাঞ্চ, অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারে পরিপূর্ণ গল্পগুলো। এই সিরিজ যেন নিয়মিত বের হয় এই কামনা করছি।
বইমেলা '২৫- এ প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে এই বই আমার প্রথম পড়া। এই বই নিয়ে এতো এক্সাইটেড ছিলাম যে কেনার পরপরই এক বসাতেই শেষ করে ফেলছি।
সচরাচর মেডিকেল সেক্টরে আমরা প্রতিনিয়ত যা দেখি তার বাহিরে আনরিয়েলিস্টিক যা ঘটে ঐসব অসচরাচর ঘটনা নিয়ে ডা. আসিফের বিচরন বলা চলে। ডা. আসিফকে আমরা 'অসচরাচর' এ চিনেছি,তাই আর উনাকে নিয়ে না বলি। এই বইয়ে গল্পের সংখ্যা কম এটা একটা আফসোস। আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে "পিচ্ছিল", "মেরিনা" - এ দুই গল্প। শেষ গল্পে আমার মনে হয়েছে এন্ডিং টা আরেকটু ডিপলি হলে ভালো হতো, কিছু মিসিং মিসিং লেগেছে। ২য় গল্পে এন্ডিং এ্যকশন মুভির ভাইব এসেছে আমার কাছে, যেহেতু মেডিকেল সাইন্স রিলেটেড একটু ভৌতিক ভাইবের বই সেহেতু ঐরকম এন্ডিং হলে মনে হয় ভালো হতো আমার মতে। কিন্তু কিন্তু বইটা পড়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আফসোস আছে একটাই কেন এতো জলদি শেষ হলো!? আরেকটু পড়ি,আরেকটু পড়া যেতো...
ডক্টর আসিফের জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত, অসম্ভব মনে হয় এমন অভিজ্ঞতামূলক ঘটনা—যেগুলো ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । প্রথম বইটি পাঠকদের প্রিয় হয়েছে—গভীর রহস্য এবং কায়েম রাখা টান ছিল। দ্বিতীয়টির দৃষ্টান্তে হয়তো সেই ভয় বা উত্তেজনার গভীরতা কমে গেছে।
এই বইয়ে মোট ৪ টি গল্প যার মধ্যে, পিচ্ছিল এবং নির্বাণ আশ্রম বইয়ে প্রথম দুটি গল্প যা মোটামুটি ভালো লেগেছে। এরপর 'মেরিনা' গল্পটাই আমার মনে দাগ কেটেছে, সেটা নিয়ে বলার কিছু নাই। এককথায় এই বইয়ের সেরা গল্পই এটি। শেষে ছোট্ট একটি গল্প 'পাথর' সেটাও ভালো লেগেছে, ভাবতেছি এরপর থেকে পাথর সংগ্রহ করা শুরু করব...
❝মানুষ অসচরাচর সহ্য করতে পারে না। অসহ্যকে নিবারণ করেই ওরা নিজের স্বস্তি নিশ্চিত করে।❞
অসচরাচর সিরিজের প্রধান চরিত্র ডা. আসিফ আহমেদ। ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষার আগ দিয়ে মারাত্মকভাবে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। সব শেষ হয়ে যাবে মনে হলেও আবার সব নতুন করে শুরু হয়। নতুন একটা অভ্যাসও তৈরি হয়। অ্যাটিপিক্যাল কেসগুলো লিখে রাখেন। ❝অ্যাটিপিক্যাল কেস❞ নিয়ে লেখা ❝অসচরাচর❞ সিরিজের শুরুটা এইভাবেই। প্রথম বইয়ে পাঁচটা ও দ্বিতীয় বইয়ে চারটা অ্যাটিপিক্যাল কেসের কাহিনী আছে।
পিচ্ছিল (𝐆𝐥𝐢𝐬𝐭𝐞𝐧𝐢𝐧𝐠): সৈয়দপুরের রেল কর্মচারীদের জন্য তৈরি হাসপাতালে যখন ডা. আসিফ নিয়োগ পান তখন নিরিবিলি ছিমছাম শহরের মায়ায় পড়ে যান। তবে মাঝেমধ্যে বন্ধবন্ধও মনে হতো। হেলথ-ক্যাম্পেইনে যখন নীলফামারী জেলা কারাগারে যান তখন স্কুল জীবনের বন্ধু শফিককে পেয়ে যান। কারাগারের অদ্ভুত এক ঘটনার কথা বলেন। জেল থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে কয়েদিরা! রুমে পাওয়া যাচ্ছে অদ্ভুত এক ঔষধের শিশি! নিরীহ দর্শন কিছু ঔষধ কীভাবে অলৌকিক কাজ করতে পারে? দুই বন্ধু মিলে কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। কিন্তু দুইবছর আগের এই ঘটনা হঠাৎ পরবর্তীতে আসিফের জীবনে হানা দিবে কে জানতো!
নিত্যদিন যেসব ঔষধ আমরা খাই এগুলো নিরীহ মনে হলেও কি ভবিষ্যতে কোনো ইফেক্ট পড়ে না বা পড়তে পারে না? রাসায়নিক এই সব বড়ি যেমন আমাদের জীবন সহজ করতে পারে তো আবার জটিলও। গল্পের কনসেপ্ট এমনটাই মনে করিয়ে দেয়। প্রথমে ভেবেছিলাম মিস্টার ইন্ডিয়া টাইপ কিছু একটা হবে কিন্তু শেষটা...! মোটামুটি লেগেছে আরকি।
নির্বাণ আশ্রম (𝐀𝐧𝐧𝐢𝐡𝐢𝐥𝐚𝐭𝐢𝐨𝐧 𝐌𝐨𝐧𝐚𝐬𝐭𝐞𝐫𝐲): অদ্ভুত এক আশ্রম যেখানে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষদের এনে রাখা হয়। নাম না জানা এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন তমিজুদ্দিন সরকারের বাবা। বুঝতে পারেন সমাজ তাঁর মতো মানুষদের সহজে গ্রহণ করতে পারে না। তখনই গড়ে তোলেন এক আশ্রম। আশ্রমে এসে ভয়ানক এক অভিজ্ঞতার মুখামুখি হন ডা. আসিফ!
"ফাইব্রোডিসপ্লেসিয়া অসিফিকানস প্রগ্রেসিভা" নামক দুর্লভ রোগের ওপর বেইজড গল্পের প্লট। এমন অদ্ভুত রোগ যে আদতেও আছে এই প্রথম জানলাম। এটাই আমার কাছে বইয়ের সেরা গল্প মনে হয়েছে। একটার সাথে আরেকটা কেস এইভাবে জুড়ে যাবে একদমই আশা করিনি।
মেরিনা (𝐌𝐚𝐫𝐢𝐧𝐚): চটপটে মেয়েটার হুট করে আগমন ঘটে ডাক্তার সাহেবের জীবনে আবার হুট করেই উধাও হয়ে যায়! মেরিনার বাবার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ দেখা যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারাও যান। অস্বাভাবিকতার কারণ খুঁজতে যেয়ে...! কেউ না চাইলে কোনোক্রমেই তার রোগ নির্ণয় করা উচিত নয়...
এই গল্পটা শুরুতেই কেন জানি মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম বইয়ের "ইয়ানোমামিয়ান" গল্পের মতো কিছু একটা হবে। কেন যে এমনটা মনে হচ্ছিল নিজেও জানি না কিন্তু অনেকটাই যে মিলে গেছে আসলেই অদ্ভুত লাগতেছে! যদিও রোগের বিষয়টা মিলেনি। সমাপ্তিতে মনে হলো এতোগুলো মানুষ একবারে বুদ্ধিশুদ্ধি কীভাবে হারায় তাও একসাথে? আজব এক রোগ ও কারণ সম্পর্কে জানলাম!
পাথর (𝐒𝐭𝐨𝐧𝐞): সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আসে। কিন্তু তাদের মধ্যে কে আসলেই গরীব বের করা কষ্টকর। রত্না নামের এক রোগীর পিত্তথলি থেকে পাথর বের করেন আসিফ। রোগীর পরিবারের অবস্থা দেখে সাহায্য করেন কিন্তু হঠাৎ হাসপাতাল থেকে উধাও হয়ে যায় তারা। পিত্তথলি থেকে বের করা পাথর পরিষ্কার করতে যেয়ে চমকে ওঠেন।কীভাবে সম্ভব?
খুবই পিচ্চি একটা গল্প। শেষটা যেনো তাড়াহুড়ো করে টানা হয়েছে। এই হুটহাট শেষ করে দেওয়ার জন্য গল্পটা জমে নাই।
❝অনেক সময়ই আমরা এমন সব জিনিসকে রোগ বলতাম যেগুলো পরে জানতে পেরেছি রোগ না, আছে না এমন?❞
রোগের বহুত কঠিন নাম হলেই ধরে নেই যে হয় রোগী মারা যাবে নয়তো এর চিকিৎসা নাই। বইয়ের গল্পগুলো আমার এই ধারণা আরও পোক্ত করলো। রোগ ও প্রকৃতির বর্ণনা লেখক দারুণভাবে করেছেন। সিরিজের পরবর্তী বইগুলোর জন্যও অপেক্ষা করবো। প্রথম বইটা দ্বিতীয়টার থেকে বেশি ভালো লেগেছে আমার। অতিমাত্রায় আশা করেছিলাম সম্ভবত এইজন্যই তেমন একটা ভালো লাগেনি। তবে ওভারঅল মোটামুটি আরকি। বইয়ের প্রোডাকশন, প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশনগুলো সুন্দর হয়েছে।
বই: অসচরাচর ২ লেখক: মাশুদুল হক জনরা: বডি হরর প্রচ্ছদ: শামীম আহমেদ প্রকাশনী: চিরকুট প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা, ২০২৫ পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৮০ মুদ্রিত মূল্য: ২০০/-
প্রথম বইয়ের মতো গল্পগুলো গা গুলিয়ে না উঠলেও গল্পগুলো ভালো লেগেছে। তবে প্রথম বইতে লেখক যে অসচরাচর আবহ তৈরি করেছিলেন, সেই আবহ একমাত্র পেলাম 'পিচ্ছিল' গল্পে। দ্বিতীয় গল্পের বর্ণনা বেশি চমৎকার, প্লটটাও বেশ ইউনিক। লেখক ডাক্তার হওয়ার কারণেই হয়তো এমন এক প্লটের জন্ম। তৃতীয় গল্পটাও উপভোগ্য। শেষ গল্প, যার নাম পাথর; খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু চমৎকার এক বিষয়বস্তু নিয়ে শুরু হওয়ার পর গল্পটা মানবিক হয়ে গেল, ঠিক অসচরাচর কাতারে গেল না। হয়তো এই গল্পটা লেখক এভাবেই বলতে চেয়েছিলেন।
ড. আসিফ আহমেদ ফিরে এসেছেন তার আরো কিছু সচরাচর ঘটে না এমনসব ঘটনা নিয়ে। আগের পর্বে ৫টা গল্প থাকলেও, এই পর্বে রয়েছে ৪টি গল্প। বইয়ের কলেবরও কমেছে কিছুটা। তবে ব্যক্তিগত ভাবে অসচারচর ২ আমার কাছে প্রথমটার মতোই দূর্দান্ত ভালো লেগেছে। শেষ গল্পটা ছাড়া বাকি গল্পগুলো বেশ গুছানো। দুইটা গল্প তো এমনকি প্রথমটার সবচেয়ে ভালো গল্পকেও ছাড়িয়ে যাবে।
পিচ্ছিল 3️⃣.5️⃣/5️⃣
জেলখানা থেকে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে কয়েদীরা। তাদের সেলের ভিতর পাওয়া যাচ্ছে বিজাতীয় ভাষায় লেখা এক ঔষধের কৌটা। কারাগারের জেলার শফিক সাহায্য চাইতে এলো ডাক্তার বন্ধু আসিফের কাছে।
বেশ ভালো লেগেছে গল্পটা। অনেকটা পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে ল্যাবে মিউটেন্ট তৈরি করা টাইপ গল্প। মাশুদুল হকের লিখনশৈলী এত্ত চমৎকার যে কিছু না ঘটলেও একটানা পড়ে যাওয়া যায়। গল্পের শেষটা অদ্ভুত। মূল যে রহস্য সেটারও সমাধান করা হয়নি। আর সে কারনেই রেটিং কিছুটা কম। তবে পড়েছি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে।
নির্বাণ আশ্রম 5️⃣/5️⃣
ফাইব্রোডিসপ্লেসিয়া অসিফিকানস প্রগ্রেসিভা এমন এক বিরল রোগ যার কারনে একজন মানুষের মাংস, হাড়ে পরিণত হয়ে যায়। এই রোগটাকে উপজিব্য করে দারুণ এক প্লটে এই গল্পটা লেখা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে বইয়ের সেরা গল্প আমার মতে। কি নেই এই গল্পে!! অসচারচর সব রোগ, মানুষ হারিয়ে যাওয়া, প্রাচীন বাড়ির রহস্যময় পরিবেশ সব পাওয়া যাবে এক গল্পে। গল্পের ডিটেইলস অসাধারণ। দারুণভাবে সাজানো গল্পটার এন্ডিংটাও চমৎকার।
মেরিনা 5️⃣/5️⃣
আরো একটা চমৎকার গল্প। বলা যায়, উপরের গল্প আর এটা, এই দুটো গল্পই গোটা বইটাকে অসচরাচর প্রথম পর্বের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে। অতি স্বাভাবিকভাবেই কুরু রোগের নাম আগে শুনিনি। এই রোগ এভাবে যে ছড়ায় সেটাও তাই জানা ছিল না। ঘটনার শুরু ড. আসিফের প্রেমিকা মেরিনার বাবার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। সকল পরীক্ষা নীরিক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক থাকলেও ভদ্রলোকের মানসিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে এবং এক পর্যায়ে তিনি মারা যান। আসিফ জানতে পারে একইরকম ভাবে মেরিনার আরো আত্মীয়-স্বজনও মারা গিয়েছে। রোগ নির্ণয় করার লক্ষ্যেই তদন্ত নামে আসিফ।
আর শেষে যা বের হয়, তা ঘূনাক্ষরেও ভাবিনি। দারুণ টুইস্ট আর রহস্যে মোড়া গল্পের রোগটারও বাস্তব ভিত্তি আছে সেটা জেনে আরো অবাক হয়েছি। কতই না বিচিত্র আমাদের এই দুনিয়া!
পাথর 2️⃣.5️⃣/5️⃣
পিত্তথলির পাথর কমবেশি আমাদের সবার পরিবারের কমন ঘটনা। কোনো না কোনো আত্বীয় বা বন্ধুর এই অসুখ হয়েছেই। তেমনি এক রোগীর পাথর অপারেশনের পর আবিষ্কার হয় তার পাথরগুলো আসলে অস্বাভাবিক।
গল্পটা কেন যেন মনে হলো হুট করেই শেষ করে দিয়েছেন লেখক। হয়তো আরো অনেক কিছু লেখার ছিল কিন্তু লিখতে পারেননি সময়ের অভাবে, এমনটাই মনে হয়েছে। আর তাই গল্পটা নিয়ে কিছুটা হতাশ। তবে ওই যে বললাম গদ্যশৈলী, শুধুমাত্র এ কারনে বইয়ের সবচেয়ে ছোট এই গল্পটাও পড়তে ভালো লেগেছে।
ব্যক্তিগত রেটিং: ০৯/১০ (একেবারেই অসচরাচর কিন্তু না এই বইয়ের সব গল্প। কিছু গল্পের বাস্তব ভিত্তি আছে, কিছু রোগ আসলেই এক্সিস্ট করে। আমি এমনকি চ্যাটজিপিটি থেকেও জেনেছি যে রোগগুলা বাস্তব। আর এই জিনিসটার জন্যই বইটা আমার কাছে আরো বেশি ভালো লেগেছে। একমাত্র আফসোস বড্ড দ্রুতই শেষ হয়ে গেল বইটা। সচেতন ভাবেই অসচরাচর ৩ এর অপেক্ষায় রইলাম)
'অসচরাচর' কনসেপ্টটার সবচেয়ে ভালো বিষয় এর ফ্রেশনেস। গা ছমছমে অসুখের গল্পগুলো দেশের পরিচিত গ্রাম, মহল্লা, মফস্বলের প্রেক্ষাপটে লেখা বলে দৃশ্যপটটা পরিচিত থাকে। গল্পের বর্ণণায় মনেহয় ডা. আসিফ জীবিত মানুষ, এখানেই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেবা দিচ্ছেন রোগীদের। মানুষের শরীর এত রহস্যময়, সেখানে রোগব্যাধির অ্যাটিপিক্যাল কেইস এর সীমা থাকার কথা নয়। এখন চিন্তার বিষয় হল, যে বেইজ এর উপর দাঁড়িয়ে গল্পগুলো বলা হচ্ছে, তা অনুযায়ী গল্পগুলোর ডালপালা কত এক্সটেন্ট�� ছড়াবে সেটা। এখন ডা. আসিফ কে কখনো সখনো চাপাবাজ মনে হলেও লেখকের কল্পণাকে তো আর ধরে রাখা যাবেনা। তাই বলে এলিয়েন ছবির মত পেট ফুঁড়ে এলিয়েন জন্মাবে এমন গল্প যে স্বাদু হবেনা তা নয়, অবশ্যই হবে। শুধু লক্ষ্য রাখার বিষয় হল ডা. আসিফের হিস্টোরি আর দেশীয় পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী গল্পটা বসছে কিনা টাইমলাইনে। আশা করি এই লিমিটটুকু লেখকের কল্পণাকে সংক্ষিপ্ত করবেনা, বরঞ্চ উপাদেয় করবে। যেমন অসচরাচর ২ তে মাত্র চারখানা গল্প, প্রথম দুটি গল্প- 'পিচ্ছিল' আর 'নির্বাণ আশ্রম' গল্পদুটো ঠিক যতটা ভালো লাগেনি, ততটাই ভালো লেগেছে শেষ দুটি গল্প। 'মেরিনা' আর 'পাথর'। বিশেষ করে 'পাথর' গল্পটার কনসেপ্ট দারুণ। বইয়ের সবচাইতে আকারে ছোট হয়েও সবচাইতে রেলেভেন্ট এবং গভীর লেগেছে এই গল্পটাই। পিত্তথলিতে পাথর, এমন পরিচিত বিষয়টাকে চমৎকার রূপ দেয়া হয়েছে। আবার যেটা বলছিলাম শুরুতেই। লেখকের গল্প কত এক্সটেন্টে ছড়াবে তা নির্ধারণ করবে প্রেক্ষাপট। মেরিনা গল্পটি আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে একদম সংগতিপূর্ণ কিন্তু গল্পের রেঞ্জও বিশাল। এবারের প্রচ্ছদ বা আর্টওয়ার্ক বেশি ভালো লাগেনি আমার। আগেরবার বেটার ছিল।
'অসচরাচর' প্রতি বইমেলায় আসুক। আকারে ছোটই হোক, অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হোক। প্রতিবছর এসে এটি স্মরণীয় একটি সিরিজে রূপান্তরিত হোক।
An idea, like a ghost, must be spoken to a little before it will explain itself.
Charles Dickens
যাহা প্রকৃতির নিয়মরুদ্ধ বেড়াজালকে অতিক্রম করে নিজ পথচলাকে কোনো আগাছা শেকড়ের মত বেড়ে যায় তাকেই অতিপ্রাকৃত হিসেবে ধরা হয়। যদিও আমাদের স্বাভাবিক জীবনে অতিপ্রাকৃতের স্থান নিতান্তই সামান্য তবে আমাদের কল্পনায় এটির লালনার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। মনুষ্যের স্বাভাবিক জীবনের বহমানতায় যখন বিরক্তির সুর শোনা যায় তখন তাদের মনে হয় নিয়মবিরুদ্ধ কিছুর সন্ধানের প্রয়াস করাই যায়। তবে তা ব্যাতীত অতিপ্রাকৃতের যে অস্তিত্ব নেই, কিংবা খোজ না করলেও যে এটি আমাদের সামনে এসে হানা দিবে না, সেই ভাবনাতেও রয়েছে নির্বুদ্ধিতা। আমার বিশ্বাস, আমাদের স্বাভাবিকতার মত সমান্তরালে বাস করে যায় অতিপ্রাকৃত অস্তিত্ব, যা হয়ত সচরাচর চোখে পরে না, কিন্তু অসচাচর দেখা পাওয়া যেতেই পারে।
ড. আসিফ, যিনি অস্বাভাবিকতার চাপে সামান্য স্বাভাবিকতা খুজতে চান না, বরং অস্বাভাবিকতায়ই বাস করতে চান। তবে নাজুক মানসিক অবস্থার এই তরুন ডাক্তারের অভিজ্ঞতা সমূহ তার উপর কিছুটা হলেও চাপ ফেলে। আর তার এইসব উদ্ভট এবং সচরাচর দেখা না পাওয়া অভিজ্ঞতাসমূহের কালেকশন অসচরাচর ২। অসচরাচর প্রথম অংশের অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের শরীরে এক প্রকাশ শিহরণ বইয়ে দিয়েছে। তিনি চিকিৎসক হয়ে খুজে যান অজানা অনেক উত্তর, এবং সত্যের হাত ধরে খুজে বের করেন আরো সত্য। বরং ব্যাধির নাম না জানলে রোগির মাঝে কাজ করে এক অসহায়ত্ব, সেই অসহায়ত্ব থেকে বাচাতেই এই অস্বাভাবিক পথ বেছে নেন তিনি। প্রথম ভাগের ধারাবাহিকতায় ২০২৫ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় অসচরাচর ২।
গত বছর এরকম সময় ই অসচরাচর প্রথম ভাগের পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলাম, এবং এই বছর মেলায় অধির আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম অসচরাচর ২ এর জন্য। তাই সুযোগ পেতেই হাতে নিয়ে শুরু করে ফেলি। অসচরাচর ২ বইয়ে রয়েছে পিচ্ছিল, অনির্বান আশ্রম, মেরিনা ও পাথর নামে চারটি গল্প। চারটি ভিন্ন স্বাদের তবে একই ধরনের চার গল্প। গল্পগুলোর দ্বারা মনুষ্য দেহের অসুস্থতার সাথে অস্বাভাবিকতার এক অদৃশ্য সংযোগ স্থাপন হয়, এবং সেই অদৃশ্য সংযোগ স্থাপনের খোজ করেন আসিফ সাহেব। অসচরাচর ১ পড়ার পর এক অদ্ভুত অস্বাভাবিক অনুভুতি কাজ করেছিলো কেননা গল্পের বহর এবং গল্পের কাল্পনিকতা আমাকে একদম গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তবে প্রথম অংশের তুলনায় দ্বিতীয় অংশের গল্পগুলো অনেকটাই যেনো মিইয়ে গেলো। প্রথম ভাগের ব্যাপারটা কেন কাজ করে নি৷ যেহেতু এটি অসচরাচর এর দ্বিতীয় ভাগ সেক্ষেত্রেই সেই অংশের মতই এটির কাছে একটি প্রত্যাশা স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়েছে। গল্প হিসেবে অসচরাচর ২ এর গল্পগুলো একদম ই মন্দ নয়, তবে প্রথম অংশের মত জমে নি কোনো এক কারনে। তবে লেখকের কাল্পনিকতা এবং হরর বর্ননার ধরন এবং গাথুনি বেশ ভালো, তবে পরবর্তী গল্পগুলো আর ভালো হবে বলে আশা করা যায়।
অসচরাচর এর দ্বিতীয় সংকলন। আবারো ফিরে এসেছে নতুন কিছু দৃশ্যপট। এবারের গল্পগুলো আমার প্রথম সংকলনের তুলনায় বেশি ভালো লেগেছে। লেখক অধিকাংশ গল্পই দারুন সাজিয়েছেন। গল্প খুব বেশি বড় না হলেও তাড়াহুড়ো হয়েছে বলে মনে হয়নি। মাশুদুল হক নিজে চিকিৎসক হওয়ায় যে সুবিধাটা হয়েছে তা হল, তার লেখা মেডিকেল টার্ম আর প্রেক্ষাপটগুলো বাস্তবিক লেগেছে। তবে হ্যা, এসব গল্প দুর্বল হৃদয়ের পাঠকের জন্য নয়। গল্পগুলো আপনাকে আনন্দ দেবার জন্য নয়, তবে গল্পের অভিনবত্ব আপনাকে তৃপ্তি দিতে পারে। অন্তত আমি গল্পকথকের কল্পনার জগতে আবার ফিরে যেতে চাই। সম্ভব হলে, আজই!
যারা বলেন যে ডাক্তার রা পারে শুধু রোবটের মত পড়তে, তাদের ভুল চিন্তা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য অসরাচর সিরিজের দুইটি বই ই যথেষ্ট।
সেকেন্ড পার্ট আগের থেকে অনেক বেটার হয়েছে বলব। একজন ডাক্তার হিসেবে বেশ উপভোগ করেছি বইটা। বেশ ইন্টারেস্টিং ৪ টা নতুন কেস নিয়ে ৪ টা আলাদা গল্প যে কাউকে মুগ্ধ করবে। তবে এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মেরিনা গল্পটা ই বেস্ট ছিল আমার মতে।গল্প গুলো ছোট, হুদাই কলেবর বৃদ্ধির অপচেষ্টা ছিল না।
তবে একটাই আপত্তি বইটা বেশ ছোট। অল্পতেই ফুরিয়ে গেল মনে হচ্ছিল। আরো কিছু গল্প থাকলে ভাল হতো।
বই প্রকাশ পাইছে ২১ তারিখ, আমি মেলায় গেছি ২২ তারিখ। পড়ে শেষ করছি ২৩ তারিখ। তাইলেই বুঝেন, কী পরিমাণ আগ্রহ ছিলো বইটার প্রতি। এক্সপেক্টেশন লেভেল কি মিট করছে? উমম, বলা যায় করছে। মানে অসচরাচর ১ এর মতো এতো ভালো লাগে নাই, তবে ভালো লাগছে। লাস্টের গল্পটা অবশ্য একেবারেই এভারেজ লাগছে। তাছাড়া অসচরাচর ১ এ জানতাম না কী আসতে যাচ্ছে, তাই চমকটা বেশি লাগছে, ভালোলাগাটাও। ২ এ আগে থেকে জানতাম দেখে কি কম ভালো লাগছে? হইতে পারে।
যেসব ঘটনা সচরাচর ঘটে না সেসব ঘটনাকেই এক কথায় অসচরাচর বলা চলে। মাশুদুল হক নিজে পেশায় ডাক্তার, গল্প বলায়ও তিনি সমান মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অসচরাচর-১ এ। কিন্তু অসচরাচর-২ এ কেনো জানি আগের বইয়ের মুগ্ধতাটা পাচ্ছিলাম না। যদিও একটা গল্প- "মেরিনা" ভালো লেগেছে। আগের বইয়ের প্রচ্ছদ এবং বইয়ের অলংকরণ দুর্দান্ত ছিল। এই বইয়ের প্রচ্ছদটা পার্সোনালি ভালো লাগেনি। ২.৫/৫
অসচরাচর ১ পড়ে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। মাশুদুল হকের লেখার স্টাইল আমার বরাবরই খুব প্রিয়। এখানের গল্পগুলো যেভাবে জার্নাল আকারে লেখা—ওটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৌতূহল ধরে রাখার মতো মেদহীন, ঝরঝরে ভাষায় একজন তরুণ ডাক্তারের কলমে উঠে এসেছে একের পর এক বিচিত্র গল্প। বইয়ের চারটা গল্পই আমার সমানভাবে ভালো লেগেছে।
তার তুলনায় অসচরাচর ২ ততটা জমেনি। নির্বাণ আশ্রম গল্পটা আমাকে ব্যোমকেশের চিড়িয়াখানার কথা মনে করিয়ে দিলো। সম্ভবত ১ পড়ে ডাক্তার আসিফকে নিয়ে আমার এক্সপেকটেশন খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল। তারপরও মাশুদুল হকের লেখার গুণে পড়তে মোটেও খারাপ লাগেনি।
পড়া শেষে আমার মনে হচ্ছিল—অসচরাচর সিরিজটা থেকে Guillermo Del Toro অসম্ভব সুন্দর কিছু বানাতে পারতেন, একদম Frankenstein-এর ধাঁচে। কারণ গল্পগুলোতে সেই Del Toro vibe টা খুব স্পষ্ট। আশা করছি অসচরাচর ৩ অসাধারণ কিছু হবে।
আমরা অসচারচর বিষয়গুলো বোধহয় খুব কৌতুহল নিয়ে শুনি। অদ্ভুত কোনো ঘটনা যা সচরাচর ঘটে না তাকেই বলে অসচারচর। মনে আছে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক ডাক্তারের কথা? মানসিক রোগে যার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট হবার পথে ছিল। তারপরও আবার সুস্থ হয়ে ডাক্তারি পেশায় তিনি ফিরে এসেছেন। অসচারচর ১ এ আমরা শুনেছিলাম তার জীবনের চারটি অদ্ভুত কেস হিস্টোরি।
যেহেতু ডাক্তার আসিফ তার অদ্ভুত কেসগুলো নিয়ে গবেষণা করেন, লিখে রাখেন তাই আবারও জমা হয়েছে কিছু অসচরাচর মেডিকেল কেস, কিছু অদ্ভুত ঘটনা। এবং ডাঃ আসিফ আহমেদের ডায়েরি থেকে কয়েকটি মেডিকেল কেস নিয়ে মাশুদুল হক লিখে ফেলেছেন অসচরাচরের দ্বিতীয় কিস্তি। এবারের কিস্তিতেও আগের মতোই চারটি ঘটনা স্থান পেয়েছে। ডাঃ আসিফের সাথে আবারো চলুন ঘুরে আসি অসচারচরের জগতে। এই ঘটনা সত্যি কী মিথ্যা সেটা কে জানে কিন্তু এই পৃথিবীতে অদ্ভুত কিছু যে হরহামেশাই ঘটে এটা তো নিশ্চয়ই মানবেন?
“মেরিনা” গল্পটা ভালো লেগেছে আমার কারণ এখানে শুরু থেকেই রহস্যময় লেগেছে। একটা অদ্ভুত রোগ যেখানে মৃ*ত্যুর আগেও মানুষ খিলখিল করে হাসছে মানষিক বিকারগ্ৰস্থদের মতো ব্যাপারটা অদ্ভুত না? আবার একই পরিবারের অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মা*রা গেছে। কিন্তু ডাঃ আসিফ রোগটা ধরতে পারছেন না। কারণ এই রোগের কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছেন না। কীভাবে ছড়ায়, কেন ছড়ায় এটা জানতে ডাঃ আসিফ এক প্রকার তদন্ত শুরু করলেন।
মানুষের জীবনের অনেকগুলো গোপন দিক থাকে। এই গোপন বিষয় উন্মোচন হোক অনেকেই পছন্দ করে না। সেটা হতে পারে গোপন রোগ বা গোপন কথা। তাই কিছু বিষয় আড়ালে থাকতে দিতে হয়। প্রকাশ পেলেই সমস্যা। এবং ডাঃ আসিফ শেষে এসে ভয়াবহ এক সত্যি উন্মোচন করে ফেললেন। প্রতিশোধের আগুন মানুষকে অন্ধ করে দেয় কী না জানা নেই তবে নরখাদকে পরিনত করেছে এটা আসলেই বেশ অদ্ভুত লাগলো। গল্পটা শুরু থেকেই বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। লেখক চরিত্রগুলোকে ঠিকঠাক কাজে লাগিয়েছেন।
আরেকটি গল্প “পিচ্ছিল”। মূলত এই গল্প দিয়েই বইয়ের শুরু। কিন্তু খুবই অদ্ভুত এবং মনে হচ্ছিল অবাস্তব কিছু। লেখক অবশ্য সুন্দর একটা ব্যাখা দিয়েছেন। আমরা ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাই, যা স্বাভাবিক মনে হলেও অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিছু ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ইচ্ছেমত ওষুধ লিখে দেন রোগীকে। এমন স্বার্থপর অর্থলোভী ডাক্তারদের জন্য এই গল্পটা একটা শিক্ষা হতে পারে। যে ভবিষ্যতে একটা সময় এমন সব উদ্ভট ওষুধ আবিষ্কার হবে যাতে রোগীর শরীরে অদ্ভুত সব প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
আবার শফিকের অতিরিক্ত কৌতুহলের শেষ পরিণতি দেখে রাগ লাগলো এতটা নিশ্চয়ই দরকার ছিল না নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। ডাঃ আসিফ স্বার্থপরের মতো বন্ধু শফিককে বিপদে রেখে এলেন এটাও ঠিক হয়নি। তবে ওষুধ নিয়ে এই গল্পটা ভাবনার বিষয় যে আসলেই পৃথিবীতে ভবিষ্যতে ওষুধ নিয়ে কত ভয়াবহ ঘটনা ঘটতেই পারে এভাবে।
গল্পটির নাম “পাথর”। হুট করে শুরু, হুট করে শেষ। এক জেলে পাড়ার জেলে বউয়ের পেটে পাথর। পিত্তথলিতে পাথর থাকায় অপারেশন হলো কিন্তু সেই পাথর ডাঃ আসিফ পরিষ্কার করে রাখার সময় খেয়াল করেন এটা সাধারণ পিত্তথলিতে হওয়া পাথর নয়। এটা অন্য পাথর তাও আবার দামী! কী করে সম্ভব? কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রশ্নই যেন হারিয়ে যায়। গল্পটা ভালো ছিল। কিন্তু পরিধি আরেকটু বড় হলে উপভোগ্য হতো। হুট করে শুরু হয়ে যেন হুট করেই শেষ এরকম মনে হলো। নট মাশুদুল হক টাইপ গল্প।
"নির্বান আশ্রম" যেখানের কথা কেউ তেমন জানে না। বছরে দুই বার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় রোগীর জন্য। কিন্তু এখানে যারা রোগী হিসেবে আসে তাদের প্রত্যেকের রোগই খুব অদ্ভুত এবং জটিল। কখনো ভালো হবার নয়। এরমধ্যে কিছু রোগী আছে যাদের রোগটা আরো অদ্ভুত। শরীরের মাংসপেশী শক্ত হয়ে হাড়ে রুপান্তরিত হয়ে যায়। আস্তে আস্তে রোগী স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
ডাঃ আসিফের কাছেও সুজন নামে এমন এক রোগী এসেছিল কিন্তু পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে মা*রা গেছে। এবং মৃ*ত্যুর আগে সে এই সরকারদের তৈরি "নির্বান আশ্রম" এ ছিল। কিন্তু তার লা*শ পরিবারকে দেখতে না দিয়ে সৎকার হয় কেন? ডাঃ আসিফ আবার কাকতালীয় ভাবে ডাক্তার হিসেবে এলেন সেইখানে। ঘটনা কী আদতে অন্য কিছু?
এই গল্পটাও ভালো লেগেছে। রহস্যময় এবং কয়েক জায়গায় বেশ হরর গল্পের ফিল দিচ্ছিল। লেখক এখানে সুন্দর গুছিয়ে গল্প বলেছেন এবং সমাপ্তিটাও ঠিক আছে মনে করি।
মাশুদুল হকের বই আগেও পড়া হয়েছে। বেশ সাবলীল লেখনী। তবে কিছু গল্পে আসলে আরেকটু ইমপ্রুভমেন্টের দরকার ছিল। যেন হুট করে হারিয়ে গেল। ওনার লেখা থ্রিলার পড়ে যেমন ভালো লেগেছে ছোটগল্পেও তিনি সফল। ডাঃ আসিফের ভবঘুরে জীবন আশা করি এরপর আরো কিছু চরিত্র দিয়ে গোছানো থাকবে। আরেকটু ডাঃ আসিফের জীবন নিয়েও জানার আগ্ৰহ জমে। ওনার পরিবার কিংবা কাছের মানুষেরা? পরের বইগুলোতে এমন কিছু থাকলে মন্দ হবে না বোধহয়।
চিরকুট প্রকাশনীর প্রোডাকশন কোয়ালিটি নিয়ে কথা বলার জায়গা থাকে না। আগেও এনাদের বই কালেকশনে আছে। কোয়ালিটিফুল কাজ।প্রচ্ছদ আগের মতো মানানসই লেগেছে আমার। ছাপার ভুল ছিল না একেবারেই। তবে একটি সংকলনে মাত্র চারটি গল্প যেন মনে ভরায় না। আরও কিছু গল্পের প্রত্যাশা থাকে। পরের বইগুলোতে বেশি করে গল্প দেয়া হোক।
🎯বইয়ের নাম : "অসচরাচর ২" 🎯��েখক : মাশুদুল হক 🎯প্রকাশনী : চিরকুট প্রকাশনী 🎯প্রকাশ সাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৫
ভিন্নধর্মী কেইস টুকে রাখতে সব ডাক্তারের হাতে একটা জার্নাল থাকা উচিৎ। অন্তত এমন সব মেডিকেল কেইস লিপিবদ্ধ হয়, ইতিহাসে যার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা বিরল। যেসব ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে অব্যাখ্যাত, তার পেছনে যুক্তি খুঁজে তাঁকে বোধগম্য করে তোলা রহস্যভেদী'র কাজ। গোয়েন্দা গল্পে যেমনটা দেখে এসেছি। আমাদের প্রটাগনিস্ট আসিফ অবশ্য গোয়েন্দা নন, ডাক্তার। আর তাই বিরল মেডিকেল কেইসগুলো তাঁর চোখে পড়লে বেশিক্ষণ আর অব্যাখ্যাত থাকে না, পাঠক তার পেছনের রহস্যের সুতো পেয়ে যায় দ্রুতই। কিন্তু রহস্যভেদ-ই কী আর গল্পের শেষ! সচরাচরের বাইরে যত প্রবণতা, তা তৈরী করে দেয় এমন সব সুযোগ অথবা বিপত্তি, যা সাধারণত ঘটে না। যা "অসচরাচর"। সেসব ঘটনার টানাপড়েনে কিছু মেডিল মিরাকল নিয়ে, অসচরাচর।
মাশুদুল হক যত লিখেছেন, তাঁর ওপর চোখ বোলালে দারুণ বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। একদিকে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট-মিনিমালিস্ট জমজমাট অকাল্ট থ্রিলার, ডক্টর কিজিল এডভেঞ্চার সাইফাই, গোটা তিনেক শিশুতোষ বই, আর সর্বশেষ সংযোজন এই অসচরাচর। মজার ব্যাপার হলো, পঁচিশের বইমেলায় বেরোন তাঁর ২টি বই খরগোশকে মারো আর অসচরাচর ২ পাশাপাশি পড়তে গেলে লেখকের গল্পকে দেখার দৃষ্টি, গল্প ভাবার মন আর গল্প বলার পদ্ধতি'র একটা কন্ট্রাস্ট লক্ষ্য করা যায়। অসচরাচর ২-তে এসেছে রহস্যকে সমাধান করার স্পৃহা আর মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রবল ইচ্ছা। প্রটাগনিস্ট আসিফের মধ্য দিয়ে লেখক নিজেই যেন আরো প্রবলভাবে প্রকাশিত হতে পাইছিলেন। অন্যদিকে যে গল্পগুলো খরগোশকে মারো বইতে স্থান পেয়েছে, তারা সম্ভবত কাছাকাছি সময়ে লেখা হলেও, সেসবে আছে Absurd-এর দিকে তাকানোর অনিশ্চয়তা, নিয়ন্ত্রণাতীত ভাগ্যের পথে যাত্রা... অসচরাচর পড়ার সময় পরিস্থিতির রাশ যতটুকু নিজের হাতে অনুভব করা গেছে, খরগোশে তা একেবারেই ছিল না।
মাশুদুল হক Masudul Haque নিজেকে আরো জানতে চাইছেন, আর তাঁর সাথে আমাদেরও যাত্রা চলেছে "দেখি কতদূর যাওয়া যায়, কেমন করে—" মন নিয়ে। এই বয়ে চলা'র আনন্দে তাই আলাদা করে আর ভাবছি না অসচরাচর-২ কতটা দাগ ফেলতে পারলো মনে।