২০১৩ সালের আগস্ট মাস। একই রাতে শহরের একাধিক জায়গায় ঘটে যায় নৃশংস কয়েকটি হত্যাকাণ্ড। প্রতিটি অকুস্থলে পাওয়া যায় চিরকুট, যাতে লেখা- 'ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু'। চিরকুটে হত্যাকারীর নামও পাওয়া যায়। মজন্তালী সরকার। পরদিন খবরের কাগজে এই একই হত্যাকারীর নামে বেরোয় আশ্চর্য এক বিজ্ঞাপন। সেখানে দাবি করা হয়, আগামী বারোই সেপ্টেম্বর ফড়িয়াপুকুর ধর্ষণ- মামলার আসামীকে আলিপুর জেলের মধ্যে হত্যা করা হবে।
উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের বিখ্যাত চরিত্রের নামের আড়ালে কে এই অজ্ঞাতপরিচয় 'এথিকাল' খুনি? সোশাল মিডিয়ায় এই নামে ভাইরাল হয়ে যায় ক্যাটওম্যানের কায়দায় পোশাক পরা মুখোশধারী এক নারীর ছবি। কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলি জুড়ে শুরু হয়ে যায় তার উৎপাত। তদন্তভার আসে সিআইডি-র হাতে।
তিন তদন্তকারী অফিসার, তিন টিভি- সাংবাদিক, এক মনোবিদ ও এক নির্যাতিতাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে গল্পের ফ্রেম। কেসে জড়িয়ে যায় একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের নাম।
ক্রাইম আর পানিশমেন্ট, প্রেম আর পলিটিক্সের এই রুদ্ধশ্বাস রোলার কোস্টার রাইডে পাঠক, আপনাকে স্বাগত।
ধর্ষণ একটি লজ্জার বিষয়। কিন্তু কার লজ্জা পাওয়া উচিৎ? যে এই ঘৃণ্য কাজটি করেছে, নাকি যে নির্যাতিত বা নির্যাতিতা হয়েছে? আশ্চর্য ব্যাপার এই যে চুরি করলে চোরের শাস্তি হয়, দুর্নীতি করলে অপরাধীর শাস্তি হয়, কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে ভিকটিম তারই সমাজে মুখ লুকিয়ে থাকতে হয়। যে নির্যাতিত হলো সেই মেয়েটির শুধু মানসিক অবসাদ হয়েই দুর্ভোগ শেষ হয়ে যায় না, বরং নষ্ট হয়ে যায় ছাত্র জীবন, কর্মজীবন ও সামাজিক জীবন। তাই আজও কোনো নারী অত্যাচারিত হলে তাঁকে খবরে নিয়ে এলে মুখটি ঢেকে দেওয়া হয় যাতে সে সমাজে চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। এমনকি কোনো মেয়েকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার চরম পদ্ধতি হচ্ছে ধর্ষণ, কোনো পুরুষকে শিক্ষা দিতে গেলেও তার মেয়ে বউ বোনকে ধর্ষণ করা হচ্ছে সহজ পন্থা।
অন্ধকারে বাড়ির পথে পা দিয়েছে একজন স্কুল ছাত্রী। কোনো একটি অনুষ্ঠানের কারণে কয়েকদিন বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে মেয়েটির। তাকে ঘিরে ধরে কয়েকটি নরপিশাচ। হয়তো মেয়েটির খুব ক্ষতি হয়ে যেত, মোক্ষম সময় উপস্থিত হয় কালো পোশাকে ঢাকা এক নারী মূর্তি। লোকগুলোকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে খুন করে মেয়েটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে পালায় খুনি। তাঁর নাম বলে মজন্তালী সরকার। পরের দিন আসতে থাকে একের পর এক চমক। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে আগামী মাসের নির্দিষ্ট তারিখে জেলের ভেতর খুন হবে কুখ্যাত ধর্ষক। মেয়েদের অশালীন দৈহিক প্রদর্শন করে ছবি ছাপার একটি ম্যাগাজিনকে জানানো হয় আগামীকাল আগুন লাগবে তাদের অফিসে। মজন্তালী সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ওঠে সিনেমায় আইটেম গান রাখার বিরুদ্ধে। এই একের পর এক খুন ও হুমকির তদন্ত করতে নামে সি আই ডি ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা অমিতাভ সান্যাল, দময়ন্তী মুখার্জি, রাহুল ও তানিয়া। অন্যদিকে নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক সৌমিলি, শিরিন ও শাক্য জড়িয়ে পড়ে তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে।
এই উপন্যাসটি শুধুমাত্র একটি রুদ্ধশ্বাস টানটান থ্রিলার হয়েই থেমে থাকেনি, তার সাথে এই ধরণের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ করা হয়েছে তিন সাংবাদিকের কথপোকথনের মাধ্যমে। আজকাল দেখি বেশিরভাগ জনপ্রিয় উঠতি লেখকরা থ্রিলার লেখেন ও এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে থ্রিলারের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাছাড়া এই মোবাইল ও ইন্টারনেটের দুনিয়ায় যেখানে মনোযোগ ধরে রাখা একটা চ্যালেঞ্জ সেখানে এমন টানটান কাহিনী না হলে চলে না। কিন্তু আমি এটা দেখে খুব গর্বিত বোধ করি যে এই থ্রিলারগুলো সবসময় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাকে সফলভাবে তুলে ধরে। এই উপন্যাসটির খোঁজ আমি পেয়েছি সানডে সাসপেন্স থেকে। কিন্তু যারা এই বইটি সংগ্রহ করতে পারবেন তাদের বলবো যে অডিও শোনার আগে আসল বইটি পড়ুন। কারণ নিজে বইটি পড়লে আপনি এই সমাজের মনস্তত্ত্বের দিকগুলো আরো ভালো করে গভীরে গিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পাবেন। সবশেষে বলবো যে কাহিনির শেষে মনে হলো যে এর পরের পার্ট আসার একটি সম্ভাবনা রয়ে গেল। আশা করছি দময়ন্তী মুখার্জি ও তার দলের অভিযান আবার পড়তে পারব।
এই বইটাকে আমি ঠিক কতো নাম্বার দেব ভাবছি। খুব সেনসিটিভ একটা সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন। প্রচণ্ড গতিশীল বইটা। বিজ্ঞাপনের ভাষায়, 'টান টান উত্তেজনা। একদম আনপুটডাওনেবল।' কিন্তু কথা হচ্ছে এত্ত দুর্দান্তভাবে যে বইয়ের শুরু, এত্ত চমৎকার যেই বইয়ের গতি, প্রতিটা ক্যারেক্টার এতো ওয়েল ডেভেলাপড আর এতোটা জীবন্ত! কিন্তু তার পরিণতি এমন ক্যান? আমি সত্যিকার অর্থে এই দুই তিন দিন বইটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। হাত থেকে নামাতেই ইচ্ছা করছিল না শেষ না করে। কিন্তু শেষ অংশে লেখক টুইস্ট দেখাতে যেয়ে যে পুরো বইটার *** মারা দিয়ে দিয়েছেন তা কি উনি বুঝতেছেন? এই টুইস্ট লেখক কেন দিয়েছেন বুঝতে পেরেছি, কিন্তু অহেতুকভাবে একটা দিক ছুঁতে যেয়ে লেখক ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন অথবা উনার কিছু একটা হয়েছিল -_- মানে টুইস্টের প্যাটার্নটা থাক, কিন্তু অন্যভাবে হতো...
নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, স্টোরিটা মোটের উপর মজন্তালী সরকারকে নিয়ে। কলকাতা শহরটা হঠাৎ অপরাধীদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছে। যে সে অপরাধী নয়। ধর্ষক, নিপীড়ক কিংবা মেয়েদের ব্ল্যাকমেইলারদের জন্য স্পেশালি। পুরানো পাপেও কেউ ছাড়া পাচ্ছে না। এবং এই সুপার হিরোয়িন আসছেন বলে কয়ে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে। যথারীতি আমজনতা দু'ভাগে ভাগ হয়েছে। মজন্তালীর কর্মকাণ্ডের বৈধতা আর অবৈধতা নিয়ে। দুষ্টের দমন যখন আইন করে হয় না তখন শিষ্টকেই অশিষ্ট হয়ে ভূমিকা নিতে হয়। কিন্তু যত ভালো আর মহৎ কাজই হোক, আইনগত দিক দিয়ে এই মজন্তালী কতোটুক যৌক্তিক? আইনের ধারক-বাহকেরা উঠে পড়ে লাগে মজন্তালীর মূল খুঁজতে।
ছোট্ট করে পটভূমিকাটা একটু বলে নি। কাহিনীর সময়কাল ২০১৩। পার্কস্ট্রীট গণধর্ষণ কাণ্ডের নির্যাতিতা সুজান জর্ডন মৃত্যুপথগামী। এই সময়েই, শহরে আবির্ভুত হলেন এক ভিজিলান্টি সিরিয়াল 'কিলারিণী'... 'মজন্তালী সরকার'। যার মন্ত্র, 'ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু'। শুধু খুনই করেন না, মৃতদেহের পাশে নোট রেখে যান আত্মঘোষণা করে। একাধিক হত্যাকাণ্ডের গুঁতোয় পুলিশও উঠেপড়ে খুঁজতে শুরু করে মজন্তালী কে। অতি সরলীকরণ করে বলতে গেলে, এই সেয়ানা বেড়ালের সাথে চোর পুলিশের খেলাই উপন্যাসের উপজীব্য।
মূল অপরাধ ধর্ষণ হলেও, কাহিনীকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে আরো নানা রঙের অপরাধ তথা অপরাধী ও তাদের দমনের জন্য পুলিশি তৎপরতা। এর পিছনে নিশ্চই কঠিন ও সুবিশাল রিসার্চ রয়েছে। হার্ডকোর পুলিশি প্রসিডিওরাল এই উপন্যাসের ভুমিকাতে লেখক লিখেছেন যে দীর্ঘ দিন ধরে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে। স্বাভাবিক! এত গভীরতা সম্পন্ন বিচিত্র অপরাধের ছায়া, সাথে এত এডমিনিস্ট্রেটিভ ডিটেল দেওয়া কাহিনীর পরতে পরতে... অথচ কি নির্মেদ লেখনী, লেখককে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
পড়তে পড়তে বারবার মনে হচ্ছিল, উপন্যাসের প্রকাশকাল ও বিষয়বস্তুর কি অদ্ভুত সমাপতন! এমন এক সমাজ ও সময়ে আমরা বাস করি যেখানে দশ বছর পরে ইতিহাস আবার নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। আমরা দমবন্ধ হয়ে থাকতে থাকতে প্রহর গুনি সেই সিস্টেমের মধ্যে, যে শুধু আমাদের ঘরের দিদি/বোনকে শহরের মাঝখানে ধর্ষণ করে খুনই করেনা, অর্গানাইজড ভাবে ম্যানুপুলেট করে সেটিকে চাপাও দিয়ে দেয় সেই এক যুগ পুরোনো চেনা সিলেবাস দেখে।
আর সেকারণেই হয়ত লেখক কল্পনা করেছেন এক ক্যাটউওম্যানের। যে কিনা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে নিজের হাতেই তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন আইন।
গড়পড়তা বই এর মাঝে মাঝে আকস্মিক ভাবেই এমন কিছু বই হাতে চলে আসে, যা কিনা ঘোরের মধ্যে রেখে দেয় বেশ কয়েকদিন। 'মজন্তালী সরকার' এরকমই কিছুর অভিজ্ঞতা দিয়ে গেল। বইমেলার সময় দেখেছিলাম বইটির নাম কিছু বইয়ের গ্রুপে। কিন্তু, সত্যি বলতে কি সেরকম কিছু হাইপ দেখিনি। তদুপরি লেখকও নবাগত। পাত্তা দিইনি। কি করা যাবে! FOMO আর পিয়ার প্রেসারেই কাল কাটাই। আদপে তো মধ্যমেধা।
সম্প্রতি সুলেখক অভীক মোহন দত্তের একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া দেখে স��গ্রহ করার মোটিভেশন পেয়ে গেছিলাম। এমনিতেই আমি স্লো রিডার, সাথে, অফিসও চলছে পুরোদমে... এবং বইটিকেও মোটামুটি আকৃতিতে 'কোঁৎকা'ই বলা চলে। তাত���ও, শেষ দুদিন কোল থেকে নামেনি সেয়ানা বেড়াল 'মজন্তালী'।
২৯৬ পাতার উপন্যাসের শেষটুকু পড়ে বোঝা যায়, 'পিকচার অভি বাকী হ্যায়'। লেখকের প্রতি অনুরোধ বেশি দিন অপেক্ষা করাবেন না প্লিজ। আর হ্যাঁ, বইয়ের পিছনের মলাটে যে একটা গল্পের টিজার গোছের দেওয়া থাকে, সেটি বদলানোর দাবি রাখি। এত সুন্দর একটা বইয়ের পিছনে এত দায়সারা ব্ল্যার্ব কিন্তু এই বইয়ের প্রাপ্য নয়।
পুনশ্চ: যেসব চরিত্রগুলো বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত, তাদের নামকরণের সময় লেখক যে 'সৃজিতীয়' টাচ দিয়েছে, তা মনে খুবই পুলক জাগায়... এর জন্যও লেখকের অতিরিক্ত বাহবা প্রাপ্য 😊
অনেক বই আছে যা পড়া শেষ করার পরেও অনেক সময় পর্যন্ত একটা ঘোরের মধ্যে রেখে দেয়। ভালোলাগার ঘোর। একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি যা আমি কলমের জোরে বোঝাতে পারব না। ‘মজান্তলী সরকার’ সেই ঘোরেরই নাম।
আমার অনেক দিনের আক্ষেপ ছিল যে, বাংলা থ্রিলার অনুভূতিহীন ও নিরস। রোহন রায়ের এই উপন্যাস যেন এক বাটি রসগোল্লা নিয়ে আমার কাছে হাজির হলো।
উপন্যাসের শুরুটা খুবই টানটান। অনেক দিন পর ভালো লেখা পড়তে পেরে আমি বেশ খুশি। রোহন রায়ের লেখনীও চমৎকার; চরিত্রের আবেগ, অনুভূতি লেখক খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
কিন্তু উপন্যাসের মাঝের অংশ কিছুটা বিরক্তিকর। কিছু কিছু অংশ শ্রেফ পুনরাবৃত্তি বলেই মনে হয়েছে, যেগুলো বাদ দিলে গল্পটা অনেক বেশি মেদহীন ও সুখপাঠ্য হতে পারত। পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেক চরিত্রের আমদানি করা হয়েছে, আর তাদেরকে কোনও না কোনও ভাবে গল্পের সাথে যুক্ত করা হয়েছে ‘রেড হেরিং’ হিসেবে। সবচাইতে বিরক্তিকর লেগেছে, যে সমস্ত চরিত্রের বিস্তার শুধু মাত্র একটি প্যারাগ্রাফের জন্যই, তাদেরও লেখক যত্ন করে নাম দিয়েছেন। এত চরিত্র, এত নাম, মনে রাখার পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক। বিভ্রান্তি এড়াতে আমাকে প্রায়ই পৃষ্ঠা উলটে আবার আগের চ্যাপ্টারে ফিরে যেতে হয়েছে। আর নাম গুলোও খুবই বিভ্রান্তিকর—সবর্ণা, সুজান, সম্পূর্ণা, শ্রীপর্ণা, সৌমিলি, শিরিন, শালিনী, সুচেতা, শম্পা ইত্যাদি। দিবাকর দাসের মহাকাল পড়েও এই সমস্যা হয়নি আমার।
ক্লাইম্যাক্সে এসে গল্প আবার গতি পেয়েছে। টানটান উত্তেজনাময়। তবে, ক্লাইম্যাক্সের আগ পর্যন্ত পাঠক যেখানে সবকটা রহস্যের জট খোলার সাক্ষী হচ্ছিল, সেখানে শেষে গিয়ে লেখক পাঠককে অনেকটা সময় ধোঁয়াশার মধ্যে রাখেন। অপরাধী জিজ্ঞেস করে, “তুমি এটা কী করে জানলে?” গোয়েন্দা জবাব দেয়, “হু হু! আমি জেনেছি এই এইভাবে….।” লেখক নিজেই সমসাময়িক বাংলা রহস্য গল্পের খিল্লি করে লিখেছেন, প্রায় সবই ওই স্বপন কুমারের মতো ‘কোথা থেকে কী হইয়া গেল’ কেস, মাথামুন্ডু নেই। লেখকের নিজের ক্লাইম্যাক্সটাও অনেকটা সেরকম।
এই খামতিটুকু বাদ দিলে মজান্তলী আপনাকে নিরাশ করবে না। লেখক তার কলমের তুলি নিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটের যে ছবিটা তুলে ধরেছেন, তা মন ছুঁয়ে যায়। এ এক যথার্থ সাহিত্যিক থ্রিলার। আমার পছন্দের লেখকের তালিকায় আরও একটি নাম যুক্ত হলো।
অনেক যুগ পরে একটা উপন্যাসের এরকম দুর্বার গতিসম্পন্ন নিখুঁত শুরুর ঝাঁজ একেবারে ব্রহ্ম তালু অবধি আলোড়িত করলো। উপন্যাসের অন্তর্নিহিত ভাবনা ও অস্বস্তি জাগানো প্রশ্ন গুলি দ্বারা মুগ্ধতায় চিৎপটাং হয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি শেষ টা ঠিক রহস্য গল্পের সমীকরণের নিটোল খাঁজে না বসে বিষাদ জাগানো কবিতার মতো বাতাসে ভাসমান। অবশ্য লেখক হয়তো এটাই চেয়েছিলেন। সাবলীল বুদ্ধির পাশাপাশি অর্ধতরল কৌতুকবোধটাও এই লেখার জ্বালানি।
রোহন রায়ের মজন্তালী সরকার নিছক একটি সিরিয়াল কিলার flick নয়; এটি সময়, সমাজ, এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতাকে চিহ্নিত করার এক দুর্দান্ত সাহসী প্রয়াস। গল্পের পটভূমি ২০১৩—যে বছর পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডের নির্যাতিতা সুজেট জর্ডন সমাজের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং কামদুনির মাটিতে জন্ম হয়েছিল প্রতিস্পর্ধী রক্তক্ষরণের। এই বাস্তব রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমির ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে এক নারীবাদী নেমেসিস—মুখোশধারী, ক্যাটস্যুট পরা, এক নারীর প্রতীক, নাম মজন্তালী সরকার।
এই মজন্তালী "বাঘ নয়, বাঘের জাতের বিড়াল", যাকে সমাজ কোণঠাসা করলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার রেখে যাওয়া চিরকুটে লেখা—"ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু"—শুধু আতঙ্ক নয়, এক গর্জন, এক প্রতিবাদ। সেটি যেন নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের এক নিঃশব্দ আর্তনাদের প্রতিধ্বনি। পাঠক অনায়াসে অনুভব করবেন, এই হত্যাগুলি কেবল অপরাধ দমন নয়—এ এক প্রতিশোধ নয়, প্রতিকার না পাওয়ার ক্রোধ।
উপন্যাসের একটি চিরকুটে লেখক তার কণ্ঠে বলে: "বেড়াল এমনিতে খুব নরমসরম ভিতু একটা প্রাণী। কিন্তু আপনি তাকে কোণঠাসা করুন, টের পাবেন সে আসলে বাঘের জাত। মেয়েদের ক্ষেত্রেও এই কথাটা প্রযোজ্য।"
এই কথাগুলো যেন এক সামাজিক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ—যেখানে নির্যাতিতা নারী আর ভিক্টিম থাকে না, হয়ে ওঠে বদলার দেবী।
মজন্তালীর অস্তিত্ব প্রশ্ন তোলে—"কে কাকে রক্ষা করছে?" রাষ্ট্র, যে কি না ধর্ষকের নাম মুছে দিতে ব্যস্ত? নাকি এক অদৃশ্য হাতে ফেলে আসা নারী, যিনি বলে যান: "আমাকে আপনারা একা করে দেবেন না। আপনাদের ছাড়া আমি কেউ নই, কিচ্ছু নই। মানুষের সংগঠিত শক্তি ছাড়া আর কোথাও কোনও ম্যাজিক নেই। ডু ইউ বিলিভ ইন ম্যাজিক?"
এই উপন্যাসের অনন্যতা এখানেই—রোহন রায় বিচার চেয়ে চুপ করে বসে থাকেন না; বরং তিনি গোটা সমাজের স্থিতাবস্থায় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকেন। তাঁর মজন্তালী শুধুই একজন খুনি নয়, বরং—"একটি নিপীড়িত বিবেকের ছায়াযাত্রী, যে আইনের সীমা ভেঙে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চায়"।
উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার পলিফোনিক গঠন—একাধিক কণ্ঠের সমবেত কোরাস, যেখানে প্রত্যেক চরিত্র একেকটি সমাজচিত্র হয়ে উঠেছে। এখানে পুলিশের সিআইডি টিম শুধু তদন্তকারী নয়, বরং তারা প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক চাপের বহিঃপ্রকাশ। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, সদ্য স্বামী-হারানো তদন্তকারী অফিসার দয়মন্তী—তিনি যেন প্রতিটি নির্যাতিত নারীর মানসিক ট্রমার প্রতিনিধি, যাঁর নিজের ব্যক্তিজীবনও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা দ্বারা ছিন্নভিন্ন।
সাথে রয়েছেন টিআরপি-আসক্ত মিডিয়াকর্মীরা, যাঁদের জন্য প্রতিটি ধর্ষণ একটা ‘স্কুপ’, আর প্রতিটি খুন একটা ‘হেডলাইন’। একদিকে তারা মজন্তালীকে দেবী বানায়, অন্যদিকে তার রক্তের ওপর দিয়ে চলে ব্যতিক্রমী প্রচারযন্ত্র। পাশাপাশি রয়েছেন নির্যাতিতা নারী, যিনি কেবল একজন 'ভিক্টিম' নন, বরং লজ্জা-ভয়-ক্রোধের এক জ্যান্ত কোলাজ। মনোবিদ চরিত্রটি উপন্যাসের মধ্যে মনোজাগতিক স্তর যোগ করেন—যেখানে আলোচনায় উঠে আসে, "ধর্ষণ শুধু দেহ নয়, মানসিকতার ওপর আক্রমণ"।
রোহন রায় এই চরিত্রগুলোকে এমনভাবে বুনেছেন যে, পুরো কাহিনি যেন এক সামাজিক ফ্রেস্কো হয়ে ওঠে। ধর্ষণ-সংস্কৃতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মিডিয়া ট্রায়াল, পুর��ষতান্ত্রিক আধিপত্য, এবং রাষ্ট্রের আইনগত অচলাবস্থা—এই সব কিছুকে তিনি গল্পের শরীরে এমনভাবে সংযুক্ত করেছেন যে পাঠক কখনোই মনে করবেন না এগুলো আলাদা আলাদা বক্তব্য; বরং সব মিলিয়ে একটাই প্রশ্ন উঁকি দেয়: "ন্যায় যদি আদালতে না মেলে, তবে কোথায় সে ন্যায়?"
থ্রিলার হিসাবে এই উপন্যাস অসাধারণ। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, থ্রিলারের টানটান গতি কখনোই থামে না, বরং এই সামাজিক কথোপকথনের মধ্য দিয়েই গতি আরও বেড়ে যায়। প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি ক্লিফহ্যাঙ্গার, পাঠককে শুধু রহস্যের গভীরে টানে না—সাথে সঙ্গে সমাজের কালো আয়নার দিকে তাকাতে বাধ্য করে।
রোহনের লেখার ভেতরে রয়েছে এক নিঃশব্দ pedagogic impulse—একটা শিক্ষাদানমূলক তাগিদ, যা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভুলগুলো তুলে ধরতে চায়। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, এই শিক্ষা কখনও প্রাচ্যদেশীয় নীতিকথা বা ক্লিশে উপদেশের ফাঁদে পড়ে না। বরং লেখকের ভাষা, চরিত্র ও দৃশ্যমান সহিংসতা মিলে এমন এক বাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে 'পাঠ' আর 'প্রতিবাদ' একসাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটে।
ক্লাসরুমের নিরপেক্ষ টেবিল ছেড়ে সেই কথাগুলিই যখন এক ন্যায়ের কাঙ্ক্ষিত অস্ত্রে রূপ নেয়—একটি মুখোশধারী নারী যখন রাষ্ট্রের বিকল যন্ত্রপাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়ে—তখন পাঠকের মনে অনিবার্যভাবে প্রশ্ন জাগে: এই সমাজে মজন্তালীর মতো কেউ কি দরকার? নাকি সে আমাদের অস্বস্তির প্রতিচ্ছবি, যাকে দরকার নেই বলে ভাবতেই আমরা স্বস্তি পাই?
এই প্রশ্নটাই রোহনের উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকা নৈতিক দ্বন্দ্বের কাঁপুনি—যা পাঠ শেষে মাথায় থেকে যায়, কেবল কাহিনির জন্য নয়, নিজেকে নিয়ে একধরনের অস্বস্তিকর আত্মজিজ্ঞাসার জন্যও।
বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে মজন্তালীর আত্মীয়স্বজন বেশ চেনা মুখ। মনে পড়ে যায় মার্ক মিলারের Kick-Ass—যেখানে এক সাধারণ কিশোর মুখোশ পরে শহরের রাস্তায় নামেন অপরাধ দমনে, আইনকে বাইপাস করেই। ঠিক তেমনই, V for Vendetta-র অমর চরিত্র V, যিনি নিপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ান এক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতের ভাষা নিয়ে।
মজন্তালী সরকার যেন এই দুই চরিত্রের ছায়ায় দাঁড়ানো এক দক্ষিণের বোন—কিন্তু তার প্রতিবাদে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। The Girl with the Dragon Tattoo-এর লিসবেথ সালান্ডার যে প্রতিহিংসার আগুনে নিজের ক্ষত বাঁচিয়ে ওঠেন, সেই একই জেদ আর বিচারের তৃষ্ণা মজন্তালীর হাতে পরিণত হয় অস্ত্র হয়ে।
তবে এখানেই আসে রোহনের সৃষ্ট চরিত্রের মূল বৈচিত্র্য—এই ভিজিল্যান্ট কোনো বিদেশি ক্যাপেড ক্রুসেডার নন; বরং তিনি তৃতীয় বিশ্বের এক নারীবাদী আত্মচেতনার রক্তাক্ত অনুরণন। এখানে আইন ব্যর্থ, প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট, বিচার হয়ে ওঠে প্রহসন। অপরাধীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিরাপদ, আর ভুক্তভোগীরাই আদালতের বারান্দায় ভিখারি।
মজন্তালী সেই সমাজের সন্তান, যেখানে ‘ন্যায়’ শব্দটা প্রায়শই হাওয়ায় উবে যায়, আর প্রতিবাদ মানেই আত্মবিসর্জনের প্রস্তুতি। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মজন্তালী যেন ফিকশনের ভেতর থেকেও বাস্তবের গালিতে হেঁটে আসা এক রক্তমাখা সত্য—যার সাথে মুখোমুখি হওয়া মানেই নিজেকে প্রশ্ন করা: "আমার নীরবতাই কি সেই অপরাধের মদদদাতা?"
রোহনের ভাষা ঝরঝরে, অথচ তার সরলতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের শ্লেষ, যা চিন্তার মেদ কাটে না—বরং তাতে মোটা দাগ টানে। কলকাতার ঘামে ভেজা গলিপথ থেকে শুরু করে রাজ্যের রাজনীতির দুর্গন্ধময় করিডর—সবখানে পৌঁছে যায় তাঁর কলম, নিখুঁত নির্লিপ্ততায়।
চরিত্রচিত্রণে রয়েছে surgical precision—এমনভাবে তিনি তাদের আঁকেন যে পাঠক ধরতেই পারে না কাকে সহানুভূতি দেবে, আর কাকে ঘৃণা করবে। কারণ, উপন্যাসে কেউ একরৈখিক ‘ভিলেন’ বা ‘হিরো’ নয়। সকলেই ভাঙা, সকলেই সমাজের নির্মম নিপীড়নব্যবস্থার তৈরি প্রোডাক্ট।
এখানে ভালোবাসা আসে ঘৃণার ছায়া নিয়ে, বিচার আসে অপরাধের হাত ধরে। পাঠক বুঝে যায়—এই জগতে ন্যায়বোধ আর নৈতিকতা জোড়ায় বিকোয় না; বরং তারা লুকিয়ে থাকে একেকটি চরিত্রের টানাপোড়েনের ভেতর।
এক মুহূর্তে যে পুলিশ অফিসার হিরো, পরের মুহূর্তে হয়তো তিনিই মোরালি গ্রে। যে সাংবাদিককে initially ঘৃণা করছিলে, তাকে হঠাৎ করেই বুঝতে শুরু করো। এই নৈতিক জটিলতাই রচনার অন্যতম কাঠামোগত শক্তি—একটা এমন লেন্স, যার ভেতর দিয়ে সমাজকে দেখতে গেলে চোখে জল আসে, আবার আগুনও ধরে।
এই উপন্যাসে চরিত্ররা কেউই ন্যায় আর অন্যায়ের textbook-definition-এ আটকে নেই—তারা সকলেই এক অসম্পূর্ণ বাস্তবের সম্পূর্ণ প্রতিনিধি।
শেষত, মজন্তালী সরকার নিছক একটি থ্রিলার নয়—এটি এক সময়-নির্ভর সামাজিক ডকুমেন্টেশন, যেখানে প্রতিটি হত্যাকাণ্ড যেন একেকটি গণমাধ্যম-বঞ্চিত প্রতিবাদের ভাষ্য। শেষ অধ্যায়ে যে অনিশ্চয়তার পর্দা ফেলে দেওয়া হয়, তা শুধু suspense তৈরি করে না—পাঠকের অভ্যন্তরেও রেখে যায় এক অস্বস্তিকর জিজ্ঞাসা।
"পিকচার অভি বাকি হ্যায়"—এই বলিউডীয় সংলাপটি এখানে কেবল কাঁটা দিয়ে নয়, চোখে আঙুল দিয়ে বলে দেয়: ন্যায়ের জন্য লড়াই এখনও অসম্পূর্ণ। পাঠ শেষ করেও পাঠক যেন উপন্যাসের গায়ে লেগে থাকা রক্ত আর নীরব চিৎকার ঝেড়ে ফেলতে পারে না। এটি সেই লেখনী, যা পাঠককে আর আগের মতো থাকতে দেয় না।
বাংলা সাহিত্যে এমন সাহসী, স্পষ্টভাষী, রাজনৈতিক থ্রিলার বিরল। এবং অবাক লাগে, এটি রোহন রায়ের প্রথম একক উপন্যাস! ভবিষ্যতের জন্য তাই শুধু আশাবাদ নয়—একটা genre পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা জাগে।
এই জায়গায় এসে মনে পড়ে নীরজ পাণ্ডের A Wednesday—যেখানে এক 'Stupid Common Man' রাষ্ট্রের শীতল নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে নিজের হাতে তুলে নেয় বিচারের ভার। ঠিক তেমনই, মজন্তালীর চরিত্রটিও “an idea whose time has come”—সে কোনও ব্যক্তি নয়, এক সামষ্টিক ক্রোধের অবয়ব, এক নিপীড়িত সমাজের মুখোশধারী conscience।
উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্নটা এক: যদি রাষ্ট্র ন্যায়ের গ্যারান্টি না দিতে পারে, তবে একজন নাগরিক কী করবে?
আর এই প্রশ্নটাই উপন্যাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী স্পর্শ—একটি কল্পকাহিনি, যা বাস্তবের গায়ে ছুরি বসিয়ে চলে যায়।
মজন্তালী সরকার: অন্ধকার শহরের অদম্য প্রতিশোধের কাহিনি
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে অসংখ্য ক্রাইম থ্রিলারের মধ্যে 'মজন্তালী সরকার' যেন একটি বিদ্যুৎচমক—যা শুধু আলো ফেলে না, বরং সমাজের অন্ধকার কোণগুলোকে উন্মোচিত করে, পাঠকের হৃদয়ে এক অস্থিরতা জাগিয়ে তোলে। রোহন রায়ের এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছে, কলকাতার রাতের ছায়ায় লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য যোদ্ধার গল্প বলে। ২৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য নয়, বরং সমাজের এক গভীর ক্ষতের প্রতিফলন—যেখানে ন্যায়ের অভাবে জন্ম নেয় ভিজিলান্টিজমের আগুন। লেখক রোহন রায়, যিনি কলেজের দিনগুলোতে নির্ভয়া কাণ্ডের (২০১২) অভিঘাতে এই প্লটের বীজ রোপণ করেছিলেন, এখানে শুধু গল্প বলেননি; সমাজকে একটি আয়না ধরে দিয়েছেন। পড়তে পড়তে মনে হবে, আপনি কলকাতার সেই গলিপথে হাঁটছেন, যেখানে প্রতিটি ছায়ার পিছনে লুকিয়ে আছে একটি চিৎকার।
'মজন্তালী সরকার' এর কাহিনি শুরু হয় ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের এক অন্ধকার রাতে—কলকাতা এবং তার আশেপাশের এলাকায় একই সঙ্গে ঘটে যায় একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ড। প্রতিটি অকুস্থলে পাওয়া যায় একটি চিরকুট: "ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যু"। চিরকুটে হত্যাকারীর নামও লেখা—মজন্তালী সরকার। পরের দিন একটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখা যায়, যাতে ঘোষণা করা হয়েছে যে আলিপুর জেলের ভিতরে এক ধর্ষণ-অভিযুক্ত ব্যক্তির হত্যা হবে ১২ সেপ্টেম্বর। এই ঘটনা যেন একটি চ্যালেঞ্জ—পুলিশের, সমাজের এবং পাঠকের। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ওঠে একটি ছবি: ক্যাটওম্যান-স্টাইলের কালো পোশাক পরা এক মুখোশধারী মহিলা, যিনি নিজেকে 'নৈতিক' হত্যাকারী বলে দাবি করেন।
একটি জট���ল জাল—যেখানে তিনজন গোয়েন্দা, তিনজন টিভি সাংবাদিক, একজন মনোবিজ্ঞানী এবং একজন ভিকটিমের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প এগোয়। সিআইডি (CID) তদন্তের দায়িত্ব নেয়, কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, মিডিয়ার সেনসেশনালিজম এবং সমাজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যেন তদন্তকে জটিল করে তোলে। লেখক রোহন রায় এখানে স্পয়লার ছাড়াই বলে দেন যে, এটি শুধু একটি সিরিয়াল কিলারের গল্প নয়; এটি একটি সমাজের আয়না—যেখানে ধর্ষণ, নির্যাতন এবং ন্যায়বিচারের অভাবের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় প্রতিশোধের স্রোত। প্লটের গতি অসাধারণ: শুরুতে একটি ঝড়ের মতো দ্রুত, মাঝামাঝি একটু ধীর (কিছু পুনরাবৃত্তির কারণে), এবং শেষে একটি অপ্রত্যাশিত টুইস্ট যা পাঠককে ভাবিয়ে রাখে। এটি পড়তে গিয়ে মনে হয়, যেন আপনি কোনো এক হলিউড থ্রিলারের বাংলা সংস্করণে ডুবে গেছেন, কিন্তু কলকাতার লোকাল ফ্লেভার—যেমন আলিপুর জেল, সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরালতা এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র—এটিকে অসাধারণ করে তোলে।
রক্তমাংসের যোদ্ধা এবং ছায়াময় মানুষ, এই উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো তার চরিত্রসমূহ—যারা শুধু নাম নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে 'মজন্তালী সরকার', সেই রহস্যময়ী মহিলা যিনি কালো পোশাকে লুকিয়ে ধর্ষক এবং নির্যাতকদের শাস্তি দেন। তাঁর পরিচয় অজানা, কিন্তু তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যেন একটি ঘোষণা—ন্যায়ের অভাবে জন্ম নেওয়া প্রতিশোধ। পাঠক তাঁকে দেখতে পাবেন না, কিন্তু অনুভব করবেন: তাঁর মধ্যে মিশে আছে ক্রোধ, করুণা এবং এক অদম্য শক্তি, যা ফেমিনিজমের প্রতীক হয়ে ওঠে।
তদন্তকারীদের মধ্যে অমিতাভ সান্যাল, দময়ন্তী মুখোপাধ্যায়, রাহুল এবং তানিয়া—এই চারজন সিআইডি অফিসার যেন গল্পের মেরুদণ্ড। অমিতাভের যুক্তিবাদী মন এবং দময়ন্তীর সহানুভূতিশীলতা তাদেরকে জীবন্ত করে; তারা শুধু কেস সলভ করছেন না, বরং নিজেদের অতীতের ছায়ার সাথে লড়ছেন। টিভি সাংবাদিকরা—সৌমিলী, শিরীন এবং শক্যম—মিডিয়ার দ্বৈততার প্রতিনিধি: তারা সত্য খোঁজেন, কিন্তু রেটিংসের লোভে সেনসেশন তৈরি করেন। একজন মনোবিজ্ঞানী চরিত্র যোগ করে গভীরতা, যিনি হত্যাকারীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন এবং ভিকটিমদের ট্রমার উপর আলোকপাত করেন। এবং ভিকটিম চরিত্রগুলো—যেমন সুজেট জর্ডানের মতো বাস্তব-অনুপ্রাণিত নারী—যাঁরা গল্পের হৃদয়: তাদের বেদনা, সামাজিক বয়কট এবং পুনরুদ্ধারের চেষ্টা যেন পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
এই উপন্যাসের চরিত্ররা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত, কেউ অতিরিক্ত নয়, কিন্তু কখনো কখনো তাদের সংযোগ অতিরিক্ত মনে হয়, যা পাঠককে বিভ্রান্ত করে। তবু, মজন্তালীর ছায়া সবার উপরে—তিনি যেন একটি প্রতীক, যা পাঠককে প্রশ্ন করে: ন্যায়ের জন্য হত্যা কি ন্যায়?
সমাজের ক্ষত এবং প্রতিশোধের দ্বন্দ্ব তীব্র ভাবে ধরা পড়েছে এই উপন্যাসে। এই উপন্যাস শুধু থ্রিলার নয়; এটি একটি সামাজিক মন্তব্য। কেন্দ্রীয় থিম 'অপরাধ এবং শাস্তি' —যেখানে আইনের ব্যর্থতা ভিজিলান্টিজমের জন্ম দেয়। লেখক দেখান যে, ধর্ষণের মতো অপরাধে রাষ্ট্রের অকর্মণ্যতা কীভাবে ভিকটিমদের জীবন ধ্বংস করে: শিক্ষা, কর্মজীবন এবং সামাজিক জীবন সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ সংস্কৃতি এখানে তীব্রভাবে উঠে আসে—পশ্চিমবঙ্গের শেষ ২০-৩০ বছরের অপরাধের খতিয়ান ঘাঁটলে যা দেখা যায়, তা অনেকটা গথামের মতো: নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনা ছাপিয়ে যায় সবকিছু। এর পাশাপাশি প্রেম এবং রাজনীতি মিশে যায়: রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কীভাবে তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করে, এবং প্রেম কীভাবে প্রতিশোধের মধ্যে একটি আলোর রেখা আঁকে।
এই উপন্যাসে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকরা সত্যের সাথে সেনসেশনের মধ্যে দ্বিধায় পড়েন, যা সমাজের দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন। এছাড়া, ফেমিনিজম এবং সশক্তিকরণ—মজন্তালী যেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহের প্রতীক, যা নারীদের সুরক্ষার জন্য সমাজের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন তোলে। বৌদ্ধ দর্শনের মতো নয়, এখানে দর্শন হলো বাস্তবতা: আইনের ফাঁকফোকর কীভাবে 'নৈতিক' হত্যাকে জায়েজ করে। এই থিমগুলো পাঠককে ভাবায়—আমরা কি শুধুই দর্শক, নাকি পরিবর্তনের অংশ?
উপন্যাসে দ্রুতগতির প্রবাহ এবং লোকাল টাচ লক্ষণীয়। রোহন রায়ের ভাষা যেন একটি তীর—দ্রুত, তীক্ষ্ণ এবং লক্ষ্যভেদী। বাংলার স্থানীয় স্বাদ মিশিয়ে তিনি কলকাতার রাস্তা, জেলের অন্ধকার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল হওয়ার দিকটি জীবন্ত করে তুলেছেন। ডায়ালগগুলো সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রভাবশালী, এবং ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে অতীতের ট্রমা উন্মোচিত হয়। ন্যারেটিভ মাল্টি-পার্সপেক্টিভ—বিভিন্ন চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প এগোয়, যা সাসপেন্স বাড়ায় কিন্তু কখনো বিভ্রান্তও করে। শেষের টুইস্টগুলো অপ্রত্যাশিত, কিছু ক্ষেত্রে মনে হলেও হতে পারে যে, এগুলো জোর করে যোগ করা। সামগ্রিকভাবে, লেখনশৈলী এমন যে, বইটি একসাথে শেষ করতে ইচ্ছে করে—রাতের বেলা পড়লে ঘুম আসবে না!
এই উপন্যাস আসলে একটি একটি চ্যালেঞ্জ এবং আহ্বান। 'মজন্তালী সরকার' পড়া মানে শুধু একটি বই শেষ করা নয়, এটি সমাজের সেই চিরকুটটি পড়া যা বলে, "শাস্তি হবে"। রোহন রায় এখানে একটি অমর প্রশ্ন রেখে গেছেন: যখন আইন নীরব, তখন কে হবে ন্যায়ের কণ্ঠ? যদি আপনি সেই পাঠক যিনি থ্রিলারের সাথে সমাজের সত্য খুঁজতে চান, তাহলে এই বইটি আপনার জন্য। পড়ুন, এবং দেখবেন, কলকাতার রাত আপনারও ছায়ায় ভরে উঠবে। কী বলেন, এই প্রতিশোধের যাত্রায় যোগ দেবেন?
শুরুটা যতটা ভালো হয়েছিল, সেই আন্দাজে শেষটা একেবারেই জমল না। বড় বেশী সমাপতন আর ইন্টারলিঙ্কে ভর্তি গোটা গল্পখানা। সব চরিত্র নিজেদের মধ্যেই কোনো না কোনো ভাবে কানেক্টেড - আত্মীয়তা, পরিচিতি কিছু না কিছু রয়েছেই। ক্লাইম্যাক্সটাও বড্ড জোর করে খাপে ফেলা হয়েছে বলে মনে হলো, খানিকটা খাপছাড়াও বটে। সব মিলিয়ে মোটামুটি বলা চলে।
i wish in reality we have super hero like this to clean dirtbags like those. I wish in reality men would really understand the pain women go through. the touch, the look and regarding the rape victim nothing to say.
This entire review has been hidden because of spoilers.
৪ দিলাম, সাড়ে তিন দেওয়ার উপায় নেই। গল্পটা একখণ্ডে সমস্ত উত্তরসহ শেষ হলে পাঁচ দিতাম। লেখা সাবলীল, যত্ন আছে, পেজটার্নার, ভ্যালিড প্রশ্নের পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে কথোপকথন সুন্দরভাবে এস্ট্যাবলিশ হয়েছে, কিন্তু একটু বেশি পুনরাবৃত্তি হয়ে গেছে। সেটা সাবজেক্টিভ। ওভারঅল বেশ ভালো।