1. বনভূমির ছায়া 2. স্বীকৃতি চাই 3. পাখি হয়ে যায় প্রাণ 4. চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ 5. ঐ লোকটা কে 6. শিল্পসহবাস 7. সবিতাব্রত 8. প্রতিনির্জনের আলাপ 9. জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন 10. ব্লেড 11. মাতৃভাষা 12. বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা 13. উচ্চারণগুলি শোকের 14. শান্তিকল্যাণ 15. নিঃসন্দেহ গন্তব্য 16. ঘৃণা 17. স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল 18. ব্যক্তিগত পোশাক পরলে 19. মেঘেরও রয়েছে কাজ 20. একলা বাতাস 21. গাছগুলো 22. শীতে ভালোবাসা পদ্ধতি 23. স্মৃতিকথা 24. প্রত্যাবর্তনের সময় 25. রূপসনাতন 26. অন্তর্গত মানুষ 27. বদলে যাও, কিছুটা বদলাও 28. একমাত্র কুসংস্কার 29. বয়ঃসন্ধি 30. মৌলিক পার্থক্য 31. সেই সুখ 32. অসভ্য দর্শন 33. একটা কিছু মারাত্বক 34. দূরযাত্রা 35. মিসট্রেস : ফ্রি স্কুল স্ট্রীট 36. শিকড়ে টান পড়তেই 37. অগ্নি দহন বুনো দহন 38. প্রতিক্ষার শোকগাথা 39. কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন 40. ফেরার আগে 41. সাইকেল 42. ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায় 43. স্রোতে রাজহাঁস আসছে 44. মানুষ
কবি আবুল হাসান ছিলেন ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশের প্রধান কবিদের একজন।
১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার বর্ণিগ্রামে তাঁর জন্ম। এটি ছিল তাঁর মাতুলালয়। পৈতৃক নিবাস ছিল পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। নাম আলতাফ হোসেন মিয়া। আবুল হাসানের প্রকৃত নাম ছিল আবুল হোসেন মিয়া। কিন্তু আবুল হাসান নামেই তিনি লেখালেখি করতেন, আর এ নামেই স্মরণীয় হয়ে আছেন।
আবুল হাসান এসএসসি পাস করেন ১৯৬৩ সালে ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি বিদ্যালয় থেকে। তারপর বরিশালের বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজিতে অনার্স পড়ছেন আর পাশাপাশি চলছে কবিতা লেখা, সাহিত্যসংগ্রাম।
এ সময়ই তাঁর সাহিত্য-চেতনা ও রাজনৈতিক-চেতনা বিকশিত হয়ে ওঠে। গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন তিনি। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। কিন্তু অনার্স পরীক্ষা দেননি। ১৯৬৯ সালে যোগ দিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা বিভাগে। সাংবাদিকতায় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ছিলেন গণবাংলা (১৯৭২-৭৩) এবং দৈনিক জনপদের (১৯৭৩-৭৪) সহকারী সম্পাদক। মাত্র ২২ বছর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন খ্যাতিমান কবি, ঢাকা শহরের আলোচিত তরুণ। ব্যক্তিজীবনেও স্বকীয়তায় ভাস্বর প্রেম, দ্রোহ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে। ১৯৭০ সালে এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হন তিনি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ রাজা যায় রাজা আসে, ১৯৭৪-এ যে তুমি হরণ করো এবং ১৯৭৫-এ সব শেষে পৃথক পালঙ্ক।
কবিতায় বলিষ্ঠ মানুষটি শারীরিকভাবে ছিলেন কিছুটা দুর্বল। হৃদযন্ত্রের সমস্যা ছিল তাঁর। অসুস্থতা তাঁকে ক্রমেই নিয়ে যেতে থাকে মৃত্যুর দিকে। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর কবিতা ও ভালোবাসা ছেড়ে তাঁর যাত্রা অনন্তলোকের দিকে।
তাঁর কাব্যনাট্য ওরা কয়েকজন (১৯৮৮) এবং আবুল হাসান গল্প সংগ্রহ (১৯৯০) প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুর অনেক পর। কবিতার জন্য তিনি মরণোত্তর বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৫) এবং একুশে পদক (১৯৮২) পেয়েছেন। আবুল হাসানের কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতায় নিয়ে এসেছিল নতুন সড়ক, নতুন আবহ। আধুনিক নাগরিক, মানুষের নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা, মৃত্যু চেতনা, বিচ্ছিন্নতা তাঁর কলমে পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
কবি আবুল হাসান অনেক অবিস্মরণীয় কবিতার জনক। তিনি আজও জনপ্রিয়, বহুল পঠিত।
আবুল হাসানের নামই জানতাম না আজ থেকে বছর চারেক আগেও। দোষ আমার নয়। কোনো এক বিচিত্র উন্নত-নাসিকা-syndrome-জনিত কারণে, বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপারে আমাদের এই বঙ্গভূমে আলাপ আলোচনা হয় না। তবে সুখের কথা, এই বদভ্যাস ক্রমশ কমছে। যদিও এখনও বাংলাদেশের বইপত্র আমাদের এখানে সহজলভ্য নয়। গোটা কলেজ স্ট্রিট তল্লাশি করে আবুল হাসানের কবিতার বইয়ের অন্তত একপিস কপিও খুঁজে পাইনি।
অথচ মনের মধ্যে নিত্য আসা যাওয়া করে, এখান থেকে ওখান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, কয়েকটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পঙক্তি। জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা। আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই, স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে! ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও। এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া। অতটুকু চায়নি বালিকা!
মনের ভিতর আকুলিবিকুলি করে এই কবির কবিতা ছুঁয়ে দেখার জন্য। অবশেষে হারুন পাঠিয়েছিল আবুল হাসানের রচনা সমগ্র। সেই সমগ্র থেকে কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি পড়েই ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে জলডাকাতের মতো উৎপাত শুরু হয়ে গেছে আমার চেতনা জুড়ে! "রাজা যায় রাজা আসে" কাব্যগ্রন্থের পয়লা লাইনটি :
সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ এটা সেই পাথরের নাম নাকি?
কী আশ্চর্য, কবিতাটির নাম "আবুল হাসান"! কবির মতো আমাদের প্রত্যেকের নিজের প্রস্তরীভূত আত্মনামটিও তো সময়ের ঘষা লেগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। আমরাও তো সেই নামটির অনিচ্ছুক দাস। আমরাও কি ভালোবেসেছিলাম কোনো যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
তারপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে বয়ে চলে স্মৃতি সত্তা ও ভবিষ্যতের অজস্র অনিকেত কোরাস। এক জায়গায় চোখে পড়ে আমার আরেকজন প্রিয় কবি শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা একটি কবিতায় ("গাছগুলো") যেন অতিপরিচিত এক ব্যক্তিগত দেয়াল লিখন :
আমরা যখোন শার্টের তলায় নিজস্ব গোপন ছুরি নিয়ে চলা ফেরা করি প্রতিমুহূর্তের আয়নায় আত্মহত্যা করি আর প্রতিমুহূর্তের অবিশ্বাসে এর ওর সাথে কথা বলি, সে মুহূর্তে ওরা বিলায় ওদের নিজস্ব সম্পদ নির্বিশেষে চুপিচাপি
বিষাদের আমলকি-ছায়ায় বসে কবি আমাকে সরবরাহ করেছেন তাঁর গভীর গোপন দুঃখ। তাঁর বাবা, একজন 'নিম্নমানের মানুষ', যাঁকে নাকি তাঁর মা বলতেন :
তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা? ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে, কত রকম ফন্দি আঁটছে কত রকম সুখে থাকছে, তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
আমি যেন মানস কর্ণে শুনতে পাই কবির নিচু গলায় উচ্চারিত, চামেলী হাতে সেই ব্যর্থ মানুষটি, তাঁর বাবার কথা। আবার পরের পৃষ্ঠাতেই সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দৃপ্ত তিনি :
এই কবিতা তোমার মতো সমালোচকের ভুলশোষকের শাসনত্রাশন ভেঙে ফেলে, মুখের উপর থুথুড়ি দেয় ইচ্ছে হলেই শিল্প দেখায় রক্ত মাখায় এই কবিতা!
এমন অজস্র পঙক্তি নির্ভুল নিশানায় আমার চুলের কাছে ফেরার বাতাসের মতো স্পর্শ করে যায় আমাকে। আমিও সেদিনের ঝঞ্ঝাপীড়িত মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিড়বিড় করি :
মেঘেরও রয়েছে কাজ ওকে ছুটি দাও ওকে দিয়ে দাও ওর কালো আমব্রেলাটি, ফিরে যাক ও তার তল্লাটে!
তারপর আমার কব্জির নীল ডায়ালের তারার থেকে মুখ তুলে দেখতে পাই যেন খুব পরিচিত একটি দৃশ্যকুসুম :
তোমার কথার মতো নরম সবুজ কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ! তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়...
আবুল হাসানের এই নিবিড় এবং আত্মগত কবিতাগুলো পড়তে পড়তে, তাঁর শৈশব ও শিল্প, প্রেম ও প্রতিনির্জন, মেঘ ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মিসট্রেসের বৃত্তান্তগুলি পড়তে পড়তে, তাঁর মাতৃভূমির মতো অসহায় মা এবং বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসার ব্যক্তিগত পোশাকগুলির কথা পড়তে পড়তে, আমার দিকে জ্যোৎস্নাসিক্ত নির্জন সাইকেলের মৃদু ঘণ্টাধ্বনির মতো বারবার ফিরে ফিরে আসে একটি অনপেক্ষ দীর্ঘনিঃশ্বাস :
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!
“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন
এভাবেই একরাশ বিষণ্ণতা আর নিঃসঙ্গতার বিশুদ্ধ উদ্ধৃতি নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন কবি আবুল হাসান, বিষণ্ণতায় মগ্ন যে এক নিঃসঙ্গ কবি।
স্কুল কলেজে থাকতে আমার প্রিয় রচনা ছিল “তোমার প্রিয় লেখক/কবি”। আমি যে কোন বাংলা ব্যাকরণ ও রচনার বই হাতে পেলেই প্রথমে পড়তাম এই রচনাটি। বেশীরভাগ সময় সব বইতেই লেখক হিসেবে পেতাম রবীন্দ্রনাথের নাম আর কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে, যেন দুনিয়াতে এই দুইজন ছাড়া আর কোন কবি সাহিত্যিক জন্মাননি। একবার শুধু পেয়েছিলাম হুমায়ূন আহমদকে। সেই রচনা পড়ে আমি হুমায়ূন আহমেদের অনেকগুলো বইয়ের নাম মুখস্থ করে ফেলেছিলাম সেসব বই পড়ার আগেই; কিন্তু আফসোস এই রচনা আমার সমগ্র ছাত্রজীবনে একবারের জন্যেও আসে নি। আমিও তাই লেখার সুযোগ পাই নি আমার প্রিয় লেখক বা কবিকে নিয়ে কোন লেখা। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতা আমি যে খুব বুঝি তা আসলে না, সত্যি কথা বলতে গেলে তাঁর কবিতাই আমাকে বোঝে। মনে হয় যেন, তাঁর কবিতাগুলো বুঝি আমার সকল বোধ নিয়ে রচিত হয়েছে। আমি যা যা ভাবতে চাই বা ভাবি সবই যেন লেখা হয়ে গেছে এই কবির কবিতা দ্বারা। কবিতাই আমাকে বোঝে আমি কবিতাকে নই। কবিতা কি সব সময় বুঝতেই হবে? কবিতা কি না বুঝলে চলে না? আমার কাছে মনে হয় কবিতা কোন বোঝার জিনিস নয়, তা একান্তই অনুভবের একটি বিষয়। আমি কীভাবে কবিতাকে নিচ্ছি সেটাই আসল কথা। কবিতার প্রতিটা শব্দ প্রতিটা বাক্য প্রতিটা অক্ষর আমার হৃদয়ের কোথায় কোথায় অনুরণিত হচ্ছে, কীভাবে তা প্রবাহিত হচ্ছে আমার সমগ্র চেতনায়, তাই হল কবিতা। কিন্তু এই মুহূর্তে কেউ যদি আমায় কোন কবিকে নিয়ে লিখতে বলতো আমি তবে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে নয় আবুল হাসানকে নিয়ে লিখতাম।
আমি আবুল হাসানের কথা লিখতে চাই যিনি স্বীকৃতি চেয়েছিলেন বেঁচে থাকার, ভালোবাসার আর অন্ধকারের। তাঁকে স্বীকৃতি দাও। আমি সেই আবুল হাসানের কথা লিখতে চাই যে আবুল হাসান বলেছিলেন এক পাথরের কথা, যে কেবলি লাবণ্য ধরে। আমি কবি আবুল হাসানের কথা লিখতে চাই যিনি তাঁর প্রাণকে পাখি হতে দিতে চেয়েছিলেন আর চারপাশের সব দীনতা দেখে প্রতিবাদী এক আত্মপ্রত্যয়ে উচ্চারণ করেছিলেন সেই অমোঘ বাণী “বদলে যাও, বদলে যাও কিছুটা বদলাও”। আমি সেই আবুল হাসানের কথা লিখেতে চাই, আমি আমার কবির কথা লিখতে চাই।
শামসুর রাহমান বলেছিলেন- “একজন কবির মূল্যায়নের জন্যে তাঁর প্রধান এবং গৌণ সকল রচনাই পড়া প্রয়োজন”। কিন্তু আমি এখানে শুধু একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করব। আর সেটি হল কবির প্রথম রচনা- “রাজা যায়, রাজা আসে” নিয়ে। নামের মাঝে একধরনের সত্য লুকানো আছে। সত্যি তো রাজারা কখনোই একেবারে চলে যায় না, এক রাজা যায় আরেক রাজা আসে। কেবল রাজারাই আসে, রাজাদেরই আসা যাওয়া। আমাদের আরও খেয়াল করতে হবে এই কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশকাল ছিল বাহাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার যুদ্ধের পরের বছর। অর্থাৎ এক রাজা চলে গিয়ে আরেক রাজার আগমনের কথা ইঙ্গিত করেছেন এখানে কবি। আবুল হাসান মাত্র ২৯ বছর বেঁচেছিলেন, তিনি অকালমৃত কবিদের একজন, কিন্তু তাঁর কবিতায় যৌবনের প্রেম উচ্ছ্বাস পাওয়া যায় না, বরঞ্চ পাওয়া যায় একধরনের বিষণ্ণতা, যেন তাঁর নিজেকে নিয়েই লেখা তাঁর “ক্লান্ত কিশোর তোমাকে” কবিতাটি। কবিতাটির কয়েকটি লাইন লক্ষ্য করা যাক- “দুপুর ঘুরে ক্লান্ত কিশোর তুমি বিকেলবেলায় বাড়ি ফিরলে ক্লান্ত দেখায় ক্লান্ত দেখায়। কিসের একটা কঠিন দুঃখ যেন তোমাকে পাথর ছোড়ে”
এই দুঃখের পাথর খুঁজে বেরিয়েছেন তিনি আজীবন, নিজের নাম নিয়ে যে কবিতা রচনা করেছেন তিনি, সেখানে তিনি বলেছেন সেই দুঃখের পাথরের কথা-
“সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র মায়াবী করুণ এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?”
নিজেকে জানতে চেয়েছেন কবি, তাঁর নাম কি শুধুই একটি নাম নাকি আরও অন্য কিছু বহন করে এর সাথে? জানতে চেয়েছেন এভাবে-
“……তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর? কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?”
অবশেষে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করে, হৃদয়ের খুব কাছাকাছি যারা থাকে, যারা সময়ের সাহসী সন্তান নামে পরিচিত তাঁদের কাছে খুঁজে পেয়েছেন উত্তর-
“এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রুপান্তর একটি নামের মাঝে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা, তুই যার অনিচ্ছুক দাস। কিন্তু তিনি তা চাননি, তাই আরেকটি কবিতায় বলেছেন- “আমি যদি বোলতে পারতাম আমি এর কিছুই নই এই পাথরের চোখ, পরচুলা নকল পোশাক এসব আমার নয় এসব আমার নয়, প্রভু আমি যদি বোলতে পারতাম।”
কি বলতে চেয়েছিলেন আবুল হাসান? আমাদের অন্তর্গত মানুষ সম্পর্কে কি বলতে চেয়েছিলেন তিনি? উন্মোচিত করতে কি চেয়েছিলেন আমাদের ভিতরকার সত্য শয়তানের মুখ? যে অশুভ কিছু নিয়ে আমরা যেতে পারিনা প্রকৃতির কাছে, আবুল হাসান কি তাই বলতে চেয়েছিলেন? এই জন্যেই কি তিনি লিখেছিলেন এই কথাগুলি-
“আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব অসহায়বোধ আর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির কাছে যেতে সাহস পেলাম না।” আধুনিক মানুষের এই যে অধঃপতন, একে অন্যের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিঃসঙ্গতা, অসহায়বোধ তা যেন অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত পোশাক পড়লে আমরা যে কেউ কাউকে চিনি না তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় এমন শব্দগুচ্ছ-
“একটা কিছু মারাত্মক ঘটেছে কোথাও নইলে কিশোর চেনেনা কেন ঘাসফুল? একটা কিছু মারাত্মক ঘটেছে কোথাও নইলে মানুষের দরোজায় টোকা দিলে কেন আজ দরোজা খোলে না? ভালোবাসা, কেবলি......কেবল একটা বাজেয়াপ্ত শব্দের তালিকা হয়?”
তখন অধঃপতনের ধুম সবদিকে, রাজনীতির ছলকলায় মত্ত সবাই। তখন তিনি লিখেছেন-
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাংছে তাও রাজনীতি তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি...”
চারিদিকে তখন শুধু অভাব আর অভাব। তিনি তখন উচ্চারণ করেছেন-
আমি জানি না দুঃখের কী মাতৃভাষা ভালোবাসার কী মাতৃভাষা বেদনার কী মাতৃভাষা যুদ্ধের কী মাতৃভাষা শুধু জানি আমি একটি মানুষ আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা। এই অভাবে অনটনে চারপাশের মানুষের দুঃখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কবি, তাই তিনি উচ্চারণ করেছেন-
“আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো? অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুণ্ডার মতো মতবাদ; রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শাণিত দুর্দিন, বন্যা অবরোধ আহত বাতাস আমি কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো?”
যাওয়ার কোন স্থান সে সময় ছিল না। স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল একাকি কবি হেঁটে বেড়ান বিজন প্রান্তরে। বেদনায় ভরা নিঃশ্বাসে তিনি খুঁজে বেড়ান প্রিয় মানুষগুলোকে। কিন্তু কাউকে তিনি পাননা-
“একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই। আমার বোনটি যেই বারান্দায় দাঁড় কাক ডাকলেই বলে ওঠে, ভাই- গুনে গুনে সাতটি চাল ফেলে দে তো কাকটার মুখে? চালের গন্ধ পেয়ে দেখিস কাকটি উড়ে যাবে, আমাদের বিপদ আসবে না।”
বিপদ তবু চলে আসে। যুদ্ধের নরকসম থাবায় কবি সব হারিয়ে ফেলেন তখন তাঁর উচ্চারণগুলি হয় শোকের-
“লক্ষ্মী বউটিকে আমি আজ আর কোথাও দেখি না, ছোটো ভাইটিকে আমি কোথাও দেখি না নরোম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখি না। কেবল পতাকা দেখি কেবল উৎসব দেখি স্বাধীনতা দেখি তবে কি আমার ভাই আজ ঐ স্বাধীন পতাকা? তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?”
তারপর “অনেক রক্ত গেলো” স্বাধীনতা পেল বাংলাদেশ “কেবল শান্তির শর্তে লোকগুলো যার যার বদলে বদলে নেবে” বলেছিল কিন্তু তা কি মানুষ আদৌ পারল? মানুষ সব জায়গায় যাচ্ছে কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না, ভালো থাকছে না, কবি তাই বলছেন- “মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না। সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো আমরা আমাদের নিজেদের কাছে বোলতে পেরেছি ভালো আছি, খুব ভালো আছি?”
কবির হৃদয় তখন ব্যথাতুর, তখন তিনি বলছেন “অমল কোন পাইনি মানুষ যাকে ধারণ কোরলে আমি আলো পেতাম”। ব্যথাভরা এই হৃদয়ের কথা বলতেই তিনি বলেছেন- হৃদয় একটাই, কিন্তু সবদিকে ওর গতায়াত, বড় গতিপ্রিয় হয় এই বস্তু, বড় স্পর্শকাতর। ওকে আর আগুনে নিও না, জ্বলে যাবে, দুঃসময় দেখিও না, ভিক্ষুকের মতো দ্বারে ভিখ মেগে যাবে। দেখাও মানুষ, ওকে নিয়ে যাও মানুষের কাছে। ওকে নিয়ে যাও সুসময়ে সবিতাকে আলোয় ফেরাও। সবিতার খোঁজে কবি পেলেন এক নক্ষত্রের দেখা, পেলেন শিল্পের খোঁজ। সেই নক্ষত্রই তখন হয়ে গেল তাঁর সকল শিল্প যার সাথে এক বৃষ্টি ঝরা দিনে হৃদয়ের অক্ষরভরা উপন্যাস পাঠ করে তিনি বলেছিলেন-
শিল্প হলো স্বাতীর হাতের ঐ কমলালেবু, লজ্জায় আনত মুখ, রোদের ফড়িং, শিল্প হলো স্বাতীর কানের রিং, শিল্প হলো আঙিনায়, উঠোনে স্বাতীর জ্বলে জীবনের সিক্ত তাজা ঘাস শিল্প তো স্বাতীর বুকের মানবিক হৃৎপিণ্ড, তাই আমি তাঁর হৃৎপিণ্ড বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমি শান্তি আর শিল্পের মানুষ।
আবুল হাসান প্রকৃত পক্ষেই ছিলেন একজন শিল্পের মানুষ। ষাটের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গন দাপিয়ে বেরাচ্ছিলেন যে কজন কবি সাহিত্যিক তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবুল হাসান। আবুল হাসানের প্রথম বই যদিও বাহাত্তরে প্রকাশিত হয় কিন্তু ষাটের দশক থেকেই তিনি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা দিতেন। তখন অবশ্য আবুল হোসেন নামেই তাঁর লেখা ছাপাত। কিন্তু পরবর্তীতে আরেক বিখ্যাত কবির নামের সাথে তাঁর নাম মিলে যাওয়ায় তিনি নিজের নামের একটু পরিবর্তন এনে রাখেন “আবুল হাসান”। আবুল হাসানের প্রথম দিককার কবিতায় যদিও জীবনানন্দের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তবু সময়ের সাথে সাথে নিজের একটি আলদা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য খুব সহজেই আয়ত্ত করেন। তবে বিষণ্ণতা তাঁর লেখাতে থেকে যায় আগাগোড়াই। আবুল হাসানের কবিতা পাঠে তাই একধরনের ভালোলাগা কাজ করে।
দীর্ঘক্ষণ গ্রন্থাগারের উঁচু শেলফের সামনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবার্ষিকী বইটি টেনে নিতে গিয়ে চোখে পড়ল 'রাজা যায় রাজা আসে'। কেমন নির্বিকার পড়ে আছে বইটি। যেন শেষবার কেউ 'আর কখনো পড়া হবে ন���' ভেবে ঠেসে দিয়েছিল। আমি বেশ লক্ষ্য করে দেখেছি, প্রিয় বইগুলো এমন হুটহাট করেই আমার হাতে চলে আসে। বইয়ের পাতা উল্টোতেই একঝাক স্মৃতি ঝুপ করে বইয়ের পাতায় লেপ্টে যায়। বহুবার পঠিত সেইসব মুখস্থ দৃশ্যপট। কতো প্রিয় কবিতা! কতো পরিচয়, প্রিয় সুর! বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কেমন মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। মনে হয়,
“একটা কিছু মারাত্মক ঘটেছে কোথাও নইলে কিশোর চেনেনা কেন ঘাসফুল?"
আমি নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকি সেই শান্ত বিকেলে। হাতে কবিতার শীর্ণ বই। পড়তে পড়তে মন কেমন করে ওঠে একসময়। তারপর জেনে যাই। জেনে যাই,
মধ্যরাতের নীরবতায় যখন কেউ কোথাও নেই, তেমনই এক সময়ে আমি পাঠ করতে শুরু করি আবুল হাসানকে। কিন্তু, কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেতে কয়েক মিনিটও লাগেনি। এর আগেই যেন এক নেশায় পেয়ে বসলো। এই কবিতাগুলো যেন আঘাত হেনে দখল করে নিলো আমার সব অনুভূতি।
আবুল হাসানের প্রথম কোন কাব্যগ্রন্থ পড়লাম। তাঁর রচনাবলির ভূমিকাতে শামসুর রাহমান বলেছেন 'তিনি যৌবনের বিষণ্ণতা, নৈঃসঙ্গ্য এবং দীর্ঘশ্বাসের কবি। তাঁর শিল্প-সৌন্দর্য বোধ যেমন তীক্ষ্ণ তেমনি তীব্র মানুষের প্রতি তাঁর মমতা, জীবনের প্রতি ভালোবাসা।' পড়তে পড়তে তা-ই মনে হলো। এক মুগ্ধতা সৃষ্টি করে গেলেন আবুল হাসান। কবিতায় আমার পরিসর ছোট। তাই কবিতা নিয়ে বিশদভাবে বিশ্লেষণ ইচ্ছে থাকলেও করতে পারি না। তবুও এইটুকু বলি যে, তাঁর কবিতায় নাগরিক এবং গ্রাম্যজীবন একে অন্যের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে।
আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাজা যায় রাজা আসে' বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে মানুষের স্বপ্নভঙ্গ, হতাশা ও রাজনৈতিক ভাঙন এই গ্রন্থে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বইয়ের নাম থেকেই বোঝা যায়—রাজা আসে, রাজা যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন খুব কমই ঘটে।
কাব্যগ্রন্থে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শোষণ ও অবিচারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা, প্রেম-বিরহ, স্মৃতি ও মৃত্যুচেতনাও সমান গুরুত্ব পেয়েছে। “স্বীকৃতি চাই” কবিতায় কবি মৃত্যুমাখা মাটির উপর দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার ও ভালোবাসার স্বীকৃতি প্রার্থনা করেন, যা তাঁর অস্তিত্বের গভীর আর্তি প্রকাশ করে। আবার “শিল্পসহবাস” কবিতায় শিল্পকে তিনি অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
শৈলীর দিক থেকে আবুল হাসান সহজবোধ্য ভাষা ও গদ্যছন্দ ব্যবহার করেছেন। জটিল অলঙ্কার বা দুর্বোধ্য রূপকের পরিবর্তে তিনি সরল শব্দ দিয়ে গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
তবে গ্রন্থের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক কবিতায় একই ধরণের হতাশা ও বিষণ্ণতার পুনরাবৃত্তি আছে এবং কিছু কবিতা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটনির্ভর হওয়ায় আজকের পাঠকের কাছে অস্পষ্ট মনে হতে পারে।
আমার কবিতা বিশ্লেষণের সামর্থ্য রাখি না। যদি লিখতে পারতাম কতো খানি লিখলে তৃপ্তি পেতাম? জানি না।
আবুল হাসান: বিষন্নতায় মগ্ন এক নিঃসঙ্গ কবি, তিনি তার কবিতায় ৭১ পরবর্তী শাসন আমল, জীবন ও জীবিকার মান, প্রেম, বিরহ বিচ্ছেদ কিংবা ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের অবস্থা ফুটে তুলেছেন। 'রাজা যায় রাজা আসে' বইটা খোঁজ পাই বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের 'ক্র্যাচের কর্নেল' বইটিতে। বরিশাল থেকে লঞ্চে চড়ে কীর্তনখোলা নদী বেয়ে ঢাকায় আসেন লাজুক কবি আবুল হাসান। শহরের অস্থির হাওয়ার ভেতর হাঁটেন। কবিতার বই বের করেন,
নাম 'রাজা যায় রাজা আসে'। লেখেন:
“আমি কার কাছে যাবো, কোনোদিকে যাব?
অধঃপতনের ধুম সবদিকে, সভ্যতার সেয়ানা গুণ্ডার মত মতবাদ, রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিক ওদিক শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শানিত দুর্দিন, বন্যা অবরোধ আহত বাতাস।
আমি কার কাছে যাবো? কোনোদিকে যাবো?” (দূরযাত্রা) --
“শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ, আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!” (মাতৃভাষা) --
“দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
বোন তার বেণি খুলছে, যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত করে বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে-তাও রাজনীতি –---- আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর
বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁখাঁ, খল, তীব্র এক বেদেনির সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতি তাও কি রাজনীতি?” (অসভ্য দর্শন) ---
“মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই, সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন কী লাভ যুদ্ধ করে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন? আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর ...
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না!”
অসাধারণ একটা কাব্যগ্রন্থ। এক নিঃস্বাসে পড়ার মত একটা বই। বেশ কিছু বিখ্যাত কবি সাহিত্যিককে উৎসর্গঃ করে কবিতা আছে। বোঝা যায় হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, নুরুল হুদা ইনারা কবির কাছের মানুষ ছিলেন।
বনভূমির ছায়া
কথা ছিল তিনদিন বাদেই আমরা পিকনিকে যাবো, বনভূমির ভিতরে আরো গভীর নির্জন বনে আগুন ধরাবো, আমাদের সব শীত ঢেকে দেবে সূর্যাস্তের বড় শাল গজারী পাতায়।
আমাদের দলের ভিতরে যে দুইজন কবি তারা ফিরে এসে অরণ্য স্তুতি লিখবে পত্রিকায় কথা ছিল গল্পলেখক অরণ্য যুবতী নিয়ে গল্প লিখবে নতুন আঙ্গিকে!
আর যিনি সিনেমা বানাবেন, কথা ছিল। তার প্রথম থীমটি হবে আমাদের পিকনিকপ্রসূত।
তাই সবাই আগে থেকেই ঠিকঠাক, সবাই প্রস্তুত, যাবার দিনে কারো ঘাড়ে ঝুললো ফ্লাস্কের বোতল ডেটল ও শাদা তুলো, কারো ঘাড়ে টারপুলিনের টেন্ট, খাদ্যদ্রব্য, একজনের সখ জাগলো পাখির সঙ্গীত তিনি টেপরেকর্ডারে তুলে আনবেন
বনে বনে ঘুরে ঠিক সন্ধ্যেবেলাটিতে তিনি তুলবেন পাতার মর্মর জোড়া পাখির সঙ্গীত! তাই টেপরেকর্ডার নিলেন তিনি।
একজন মহিলাও চললেন আমাদের সঙ্গে তিনি নিলেন তাঁর সাথে তাঁর টাটকা চিবুক, তার চোখের সুষমা আর উষ্ণ শরীর! আমাদের বাস চলতে লাগলো ক্রমাগত হঠাৎ এক জায়গায় এসে কী ভেবে যেনো আমি ড্রাইভারকে বোললুম : রোক্কো–
শহরের কাছের শহর নতুন নির্মিত একটি সাঁকোর সামনে দেখলুম তীরতীর কোরছে জল, আমাদের সবার মুখ সেখানে প্রতিফলিত হলো, হঠাৎ জলের নীচে পরস্পর আমরা দেখলুম আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ।
আমরা হঠাৎ কী রকম অসহায় আর একা হয়ে গেলাম! আমাদের আর পিকনিকে যাওয়া হলো না, লোকালয়ের কয়েকটি মানুষ আমরা কেউই আর আমাদের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব, অসহায়বোধ আর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির কাছে যেতে সাহস পেলাম না!
"রাজা যায় রাজা আসে"- এক রাজার পর অন্য রাজার আগমন হলে এক সংকটকালীন দুর্ভোগ জন্ম নেয়। যুদ্ধাহত বাংলাদেশের জন্ম নেওয়া সময়টাও রাজার হাতবদলের মতো। এই সংকটেই আবুল হাসান এর বই এর উপস্থাপন। স্বভাবত সেই সময়ের বেদনা, হাহাকার, শুন্যতা বরাবরের মত তাড়া করেছে কবিতায়। যুদ্ধে ভাই-বোন হারানানোর তীব্রতা; অসহায় কোন এক পিতার গল্প বলেছেন যিনি সৎপথে থাকায় তাকে "নিম্নমানের মানুষ" বলে প্রঞ্চনা করেছেন। ঘরমুখো কিশোরদের ক্লান্ত মুখ দেখতে তিনিও ক্লান্ত! হাসতে হাসতে তিনিও বাড়ি ফিরতে চান। এই দুর্দিনমাখা অধঃপতন, সেয়ানা গুণ্ডার শ্বাস, অভাবের মরিচীকা, আহত বাতাস থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছেন। এই মারাত্বক সময় যেন কোন বেদেনীর সাপ খেলার রাজনীতি! তিনি নিজেকে জানতে চেয়েছেন, বারবার প্রশ্ন করেছেন তিনি কি সত্যিই মানুষ নাকি পাথরের চোখ-পরচুলা-নকল পোশাকে আবৃত?
কবিতা বিশ্লেষক আমি না, তবে নির্মলেন্দু গুণকে উৎসর্গ করে যে রাজনীতির কবিতাটি লেখা হয়েছে সেটা খুবই ভাল লেগেছে। কবির শব্দচয়ন খুবই সুন্দর এবং কবিতা পড়লে বোঝা যায় কবি হিন্দুধর্ম সম্পর্কেও অনেক জানতেন, পড়ালেখা করেছেন। বইটা এতদিন না পড়ে ভুল করেছি।