নরেন্দ্রনাথ মিত্র-র জন্ম ১৬ মাঘ, ১৩২৩ বঙ্গাব্দ (৩০ জানুয়ারি, ১৯১৬) অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। পিতা মহেন্দ্রনাথ, মাতা বিরাজবালা। ভাঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই-এ। বি-এ পাশ করেন বঙ্গবাসী কলেজ থেকে। লেখালেখির সূচনা বাল্যকালে। প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘মূক’, প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’। দুটোই ‘দেশ’-পত্রিকায়, ১৯৩৬ সালে। বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জোনাকি’। প্রথম গল্প-সংগ্রহ ‘অসমতল’ (১৯৪৫)। প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ, দেশ-এ ধারাবাহিক, গ্রন্থাকারে নাম ‘দ্বীপপুঞ্জ। গল্পগ্রন্থ প্রায় পঞ্চাশটি। উপন্যাস, বিশেষত, ‘দ্বীপপুঞ্জ’ ‘চেনামহল’, ‘তিনদিন তিনরাত্রি’ ও ‘সূর্যসাক্ষী’, দেশ-পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশকাল থেকেই দারুণভাবে সমাদৃত। চলচ্চিত্রে রূপায়িত বহু রচনার কয়েকটি—সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, অগ্রগামীর ‘হেডমাস্টার’, রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’। ‘রস’ গল্পটির হিন্দি চলচ্চিত্রনাম—‘সওদাগর’। টি ভি সিরিয়ালে গল্পের চিত্রনাট্যরূপ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন প্রমুখ। বিবাহ: ২৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৫। স্ত্রী শোভনা, শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ দিবাকর, সরকার-পরিচালিত সংস্থায় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়র। কনিষ্ঠ অভিজিৎ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের শিক্ষক। প্রিয় লেখক: রবীন্দ্রনাথ। শেখভ, মপাসাঁ, টমাস মান। শখ: উচ্চনীচ নির্বিশেষে মেলামেশা। চিঠি। টেলিফোন। পুরস্কার: আনন্দ (১৯৬১) । মৃত্যু: ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫।
আমরা দোষ দেই শুধুই তরঙ্গদের… কিন্তু ওদেরকে যে আমরাই বানিয়েছি এমন দুমুখী তা কী আমরা কখনো ভাবি? ছোটলেক বলি আমরা ওদের… আসলে কী আমরাও জানি বিশাল মনের অধিকারী হতে, বন্ধুর প্রশংসা শুনে খুশি হতে? ….. এই সমাজের একটা প্রায় অদৃশ্য দিক তুলে ধরেছেন লেখক…. বিবেকে নাড়া দেওয়ার মতো একটা গল্প … definitely deserves 5 stars 🍀
লোকদেখানো বা শোঅফ করার একটা চিত্র এই গল্পে ফুটে উঠেছে। কিভাবে দুই বান্ধবীর মধ্যে নিজের বড়ত্ব প্রমান করার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খুব সুন্দর সম্পর্ক বিষিয়ে ওঠে তাই দেখা যায়।মধ্যে তরঙ্গ যাকে কেন্দ্র করে চলে প্রতিযোগিতা, যে দুইবাসাতেই কাজ করত কিভাবে এই দুই দিকের চাপে পড়ে অন্য সব কাজের লোকদের মতো হতে বাধ্য হয়।যেমন:এক বাসার নিন্দে অন্য বাসায় করা, কামাই দেয়া তাই নিয়েই এই গল্প দ্বিচারিণী!
দ্বিচারিণী গল্পটি দুই বান্ধবী ও তাদের কাজের বুয়া তরঙ্গকে ঘিরে এক তীক্ষ্ণ সামাজিক ব্যঙ্গ। প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও, তরঙ্গ যখন দুই বাড়িতেই কাজ শুরু করে, তখন উপঢৌকন ও হিংসা নিয়ে শুরু হয় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সম্পর্ক বিষিয়ে ওঠে। তরঙ্গও তার কাজের চাপ সামলাতে শুরু করে দুই বাড়ির নামে কুৎসা রটানো, ফলে সে পরিণত হয় এক দ্বিচারিণীতে।
গল্পটি মজার ছলে সমাজের ভেতরকার ঈর্ষা, হিপোক্রেসি আর শ্রেণিচেতনার বাস্তব রূপ তুলে ধরে। সংক্ষিপ্ত অথচ প্রভাববিস্তারী এই গল্প পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে আমাদের চারপাশের সম্পর্কগুলো আসলেই কতটা নির্মল?
স্যাটায়ার জনরা আমার সবসময়ই খুব ভাল লাগে। চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের সব কুৎসিত অবস্থাকে লেখক তুলে ধরেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের এই ছোট্ট গল্পটাও তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
গল্পের শুরুতে, দুই বান্ধবী এবং তাদের মাঝের ভালোবাসার সম্পর্ককে দেখতে পাই। একে অপরের সাহায্যে সদা তৎপর। কিন্তু পরিস্থিতি যেন বদলে দেয় সবকিছুই। ভালোবাসার সম্পর্কটা হারিয়ে গিয়ে সেখানে জন্ম নেয় ঈর্ষা, হিংসা, ছলনা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
গল্পের প্রধান চরিত্র তরঙ্গ! পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ঘরে ঝিঁ এর কাজ করছে। শুরুর দিকে সে দুই বান্ধবীর বাসায় কাজ করত আর দুই পরিবারই তাকে পরিবারের অংশের মতনই ট্রিট (এর বাংলাটা মনে করতে পারছি না) করত। কিন্তু কে বেশি ভাল ভাবে ট্রিট করে, আর কে কত বেশি সময় তরঙ্গকে দিয়ে কাজ করায় নিতে পারে এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা যেন নষ্ট করে দেয় সম্পূর্ণ সম্পর্কটাকে।
গল্পে আমরা দেখতে পাই, মানুষ... মানুষের ভালটা শোনার চাইতে, মন্দ কথা শুনতে কত বেশিই আগ্রহী হয়ে উঠে।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের দ্বিচারিণী একটি সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর ব্যঙ্গাত্মক গল্প, যেখানে সম্পর্কের জটিলতা, হিংসা এবং সামাজিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে দারুণভাবে । দুই বান্ধবী ও তাদের গৃহকর্মী তরঙ্গকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রতিযোগিতা যেমন হাস্যরস তৈরি করে, তেমনি সম্পর্কের সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বগুলোও চিন্তায় ফেলে । লেখকের ভাষা সহজ, কিন্তু বক্তব্য তীক্ষ্ণ—যা গল্পটিকে আরও জীবন্ত করে তোলে । সমাজের বাস্তব চেহারা এত সংক্ষেপে উপস্থাপন খুব কম লেখকই পারেন । পাঠের শেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরাও কি কখনো ‘দ্বিচারিণী’ হয়ে উঠি না ?
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের “দ্বিচারিণী” এক তীক্ষ্ণ সামাজিক ব্যঙ্গ, যেখানে দুই বান্ধবীর বন্ধুত্ব ভেঙে যায় ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতার কারণে। কাজের বুয়া তরঙ্গ হয়ে ওঠে এই ভাঙনের কেন্দ্রবিন্দু উপঢৌকন, গুজব আর শ্রেণিচেতনার খেলায় সে একসময় “দ্বিচারিণী” হয়ে দাঁড়ায়। সম্পর্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্বার্থপরতা ও হিপোক্রেসি কীভাবে মানুষকে তুচ্ছ বিষয়েও বিভক্ত করে। হাস্যরসের আড়ালে এটি আসলে আমাদের সামাজিক বাস্তবতার নির্মম প্রতিচ্ছবি। অল্প কথায় লেখক আমাদের ভাবতে বাধ্য করেন ''বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের স্বচ্ছতা কি সত্যিই টিকে থাকে স্বার্থের চাপের কাছে?''