১৯৭১ সালের ২০ মে বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যাটি সংগঠিত হয়। সেই দিনেই দশ হাজার নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়। সেদিন চুকনগরে ভয়াবহতার ইতিহাস সংগ্রহ করতে 'মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট' দুই দিন ব্যাপী (৮ এবং ৯ সেপ্টেম্বর, ২০০০) একটি 'মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে'র আয়োজন করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বজন হারানো মানুষগুলো বীভৎস দিনগুলোর কথা জানাতে এসেছিলেন সেখানে। চুকনগর গণহত্যার প্রায় ২০০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয় সেদিন, যেগুলো ইন্সটিটিউটের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। যাঁরা গ্রন্থনা করেছেন তাঁরা নিজেরাও আলাদাভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন,নোট নিয়েছিলেন এবং ইন্সটিটিউটের সংরক্ষিত উপাদান পরীক্ষা করে ৯০ টি সাক্ষাৎকার সংকলন করছেন। সাক্ষাৎকারগুলো পড়লে দেখা যাবে কি নিষ্ঠুরতায় পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা মানুষ হত্যা করেছিল।
Muntassir Mamoon (Bangla: মুনতাসীর মামুন) is a Bangladeshi author, historian, scholar, translator and professor of University of Dhaka. He earned his M.A. and PhD degree from University of Dhaka. Literary works
Mamoon mainly worked on the historical city of Dhaka. He wrote several books about this city, took part in movements to protect Dhaka. Among his historical works on 1971 is his Sei Sob Pakistani, in which many interviews with leading Pakistanis was published. Most of them were the leading Pakistani characters during the liberation war of Bangladesh.
জন্ম এবং পরিবার মুনতাসীর মামুনের জন্ম ১৯৫১ সালের ২৪ মে ঢাকার ইসলামপুরে নানার বাড়িতে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মিসবাহউদ্দিন এবং মায়ের নাম জাহানারা খান। পিতামাতার তিন পুত্রের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। তিনি ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন। তার স্ত্রী ফাতেমা মামুন একজন ব্যাংকার। মুনতাসির মামুনের দুই ছেলে মিসবাহউদ্দিন মুনতাসীর ও নাবীল মুনতাসীর এবং কন্যা রয়া মুনতাসীর।
কর্মজীবন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই দৈনিক বাংলা/বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন মুনতাসীর মামুন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। এর পাশাপাশি ঢাকা শহরের অতীত ইতিহাস নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। এছাড়া তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউটে' সন্মানিক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। কৈশর থেকে লেখালেখির সাথে জড়িত হয়ে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সেরা শিশু লেখক হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর অনুবাদ, চিত্র সমালোচনা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচনা করেন অনেক বই। তাঁর লেখালেখি ও গবেষনার বিষয় উনিশ, বিশ ও একুশ শতকের পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশ ও ঢাকা শহর।
সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ডাকসুর প্রথম নির্বাচনে মুনতাসীর মামুন ছিলেন সম্পাদক। একই সময়ে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি। ডাকসুর মুখপত্র "ছাত্রবার্তা" প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদনায়। তিনি বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যথাক্রমে প্রথম যুগ্ম আহ্ববায়ক ও যুগ্ম সম্পাদক। তিনি জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ড ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এবং জাতীয় আর্কাইভসের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। ঢাকা নগর জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ঢাকার ইতিহাস চর্চার জ্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেন্টার ফর ঢাকা ষ্টাডিজ (ঢাকা চর্চা কেন্দ্র)। এ কেন্দ্র থেকে ঢাকা ওপর ধারাবাহিক ভাবে ১২টি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বাংলা একাডেমীর একজন ফেলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিনেটের নির্বাচিত সদস্য হয়েছেন কয়েকবার। '৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তিনি একজন প্রতিষ্ঠাতা ও সক্রিয় সদস্য। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ফাতেমা মামুন প্রতিষ্ঠা করেছেন মুনতাসীর মামুন-ফাতেমা মামুন ট্রাস্ট। এ ট্রাস্ট গরিব শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারদের নিয়মিত সাহায্য করছে।
সাহিত্য কর্ম মুনতাসীর মামুনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২০+। গল্প, কিশোর সাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষনা, চিত্র সমালোচনা, অনুবাদ সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুনতাসীর মামুনের বিচরণ থাকলেও ইতিহাসই তার প্রধান কর্মক্ষেত্র। ।
পুরস্কার বাংলা একাডেমী পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার, একুশে পদক, নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন পুরস্কার, হাকিম হাবিবুর রহমান ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক পুরস্কার, ইতিহাস পরিষদ পুরস্কা, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, অলক্ত স্বর্ণপদক পুরস্কার, ডঃ হিলালী স্বর্ণপদক, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৩), মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক, এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিয়েন্স শহর তাঁকে 'অনারেবল ইন্টারন্যাশনাল অনারারী সিটিজেনশিপ' প্রদান করে।
বইটার কন্টেন্টগুলো সহ্য করা যায় না। ১৪৩ পৃষ্ঠার একটা বই পড়তে পাঁচ দিন লাগলো। একনাগাড়ে পড়া যায় না, কিছুক্ষণ পড়ার পরে অস্থিরতা কাটাতে তার চেয়ে তিন-চারগুণ বেশী সময় লেগে যায়। যেখানে জগন্নাথ বালা বলে, "আমার এক ভাই গুলি খায় এবং তাকে বেয়নেট দিয়ে কোপ দিলে তার নাড়িভুঁড়ি বার হয়ে জলে ভেসে যাচ্ছিল। তখন ঐ নাড়িটা বাম হাত দিয়ে চাইপে ধরে আমাকে বলছে- ওরে ভাই, আমার এই নাড়িটা ভিতরে ঢুকায়ে দাও..." সেখানে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ঠিক থাকতে পারে না। নরেন্দ্র গাইনের সাক্ষ্য দেয়, "গোলাগুলি থাইমে গেল দুই তিন ঘণ্টা পর দেখি বহুলোক মইরা পইড়া আছে। যা দেখলাম, মা মইরা গেছে, শিশু বাঁইচা আছে। মরা মায়ের দুধ খাচ্ছে। দুধ খাওয়ার জন্য কানতেছে। এত লাশ হাঁটার জায়গা নাই। মরার উপর দিয়ে হাঁটি চলে আসলাম..." অথবা সমরেশ মণ্ডলের বিবৃতির কথাই ধরা যাক, "নদীতে এত লাশ ছিল যে নদী হাইটেই পার হওয়া যেত..." এগুলো শুনে পূর্বপুরুষের হত্যার যন্ত্রণা যদি কারো গায়ে না লাগে তাহলে তার হয়তো মেরুদণ্ডই নাই। পাকিস্তানী এবং তাদের দোসরদের জন্য আমি যে তীব্র ঘৃণা পুষে রাখি এই বইটি পড়ার পর তার সাথে যুক্ত হল আরো কিছু গুণক।
মাসখানেক ধরে অল্প অল্প করে বইটা পড়তাম, একসাথে বেশিক্ষণ পড়তে পারা যায় না। যতবারই পড়েছি, গা গুলিয়ে উঠেছে; অনেকবারই চোখ দিয়ে পানি পড়েছে। 'মুক্তিযুদ্ধ' এবং 'মুক্তিযুদ্ধের বই' বললে আমাদের এ প্রজন্মের মধ্যে খানিকটুকু যে রোমান্টিসিজম সৃষ্টি হয়, এই বইটি সেই রোমান্টিসিজমের গায়ে দগদগে একটি ঘা; এবং এরকম 'ঘা' এর প্রয়োজন রয়েছে।
চার পাঁচ ঘন্টার মধ্যে হাজারে হাজার মানুষ কী বীভৎস ভাবে মারা যেতে পারে কিছু সৈন্যের পাশবিক ক্রুর খামখেয়ালিপনায় এবং সেই দুর্ভাগ্যের ক্রীড়ানক হয়ে মানুষগুলো যারা যুগের পর যুগ বয়ে বেড়াচ্ছে সেই দু:সহ স্মৃতি- এই বইটি সেরকম দু'শ পরিবারের এক বেদনায় গাঢ় কালচে-নীল জবানবন্দি। এমন সব বর্ণনা আছে, যা কিনা স্বাভাবিক মানুষের দু:স্বপ্নেও আসা সম্ভব না; আর সেসব কিনা লক্ষ মানুষের জন্যে ছিল 'বাস্তব'। আর তাই বইটি মোটেই 'সুখপাঠ্য' নয়, কারণ এসব বর্ণনা কখনো সুখপাঠ্য হয় না৷
বইটি শুধু মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে নয়, বরং সর্বোপরি যেকোনো যুদ্ধের ভয়াবহতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে পারার মত একটি বই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিরাচরিত চেনা দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে নতুন এক অস্বস্তিকর মাত্রা এনে দেওয়ার মতোও একটি বই।
১৯৭১ সালের ২০শে মে বৃহস্পতিবার (৫ই জৈষ্ঠ্য ১৩৭৮ বংগাব্দ) আর দশটা সাধারণ গ্রীষ্মের দিনের মতই সকাল। পার্থক্য শুধু তখন বাংলাদেশ একটি সশস্ত্র যুদ্ধের ভিতরে স্বাধীনতার অর্জনের দিকে যাচ্ছে। ঠিক এইদিনে ততকালীন বৃহত্তর বরিশাল, যশোহর, গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলের মুসলমান- হিন্দু ( অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ) ভারত গমনের উদ্দেশ্যে চুকনগর ভায়া খুলনা হয়ে সীমান্ত পারের জন্য চুকনগর ( চুকনগর কলেজের সামনে বিলে) এর রুপসার শাখা নদী -ভদ্রা নদীতে নৌকায় করে আসে। তখনকার বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে খরস্রোতা ভদ্রা নদীতে এত পরিমাণ নৌকা এসেছিল যে নৌকার উপর হেঁটে নদী পার হওয়া যেত। দুপুরে ভারতে যাওয়ার জন্য নিরাপদ এই সবাই কিছু খেয়ে নেয়ার জন্য রান্না করছে, কেউ গোসল করছে, কেউ বাজারে গেছে শুকনা খাবার কিনতে, ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা করছে। ঠিক তখনি বেলা ১১ টার দিকে ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসে একক দিনে সবচেয়ে বড় গনহত্যা। দুই ট্রাক পাকিস্তানি আর্মি এসে সাব মেশিন গান দিয়ে দুই' ঘন্টার ভিতর হত্যা করে ১০,০০০ জন বেসামরিক নিরীহ বাংলাদেশী মানুষকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অউশউইৎস এ একক দিনের হত্যাকান্ডকেও যেটা হার মানায়, সেইটা চুকনগরের গণহত্যা। বিকাল নাগাদ দেখা যায় যেই নদী নৌকার উপর হেটে পার হওয়া যাচ্ছিল সেটা এখন ভেসে থাকা লাশের উপর হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে, বিল মাঠ শুধু লাশ। কারো মাথার ঘিলু বের হওয়া, কারো চোখ বের হয়ে এসেছে, কেউ কেউ তার বাবা মাকে স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরা, কারো বেয়নেটের খোচায় বের হওয়া পাকস্থলী, সবচেয়ে হৃদয় বিদারক দুই'মাস বয়সের শিশু মৃত মায়ের বুকের দুধ পান করে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত ' ১৯৭১ চুকনগরের গণহত্যা ' বই এই ঘটনার একটা জীবন্ত দলিল। অর্ধেক পড়ার পর মনে হয়েছিল আর পড়া সম্ভব না। অনেক কষ্টে ১৪০ পেজের এই বইটা শেষ করছি। চুকনগরের নাম শুনলে মনে আসে খুলনার চুই ঝালের গরু খাসির মাংস। কিন্তু এখানেই হয়ে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নৃশংস ঘটনা, যেইটা অনেকেই জানিনা, লেখকের মতে এমনকি স্বাধীনতার ১৫ খন্ডের দলিলেও উল্লেখ নেই এই ঘটনার। অবশ্য এই গোত্রে আমিও ছিলাম, খুলনায় বাসা হবার সুবিধার্থে কাছেই চুকনগরের এই গণহত্যাটি জানা ছিল, কিন্তু কত বড় ঘটনা সেটা জানা ছিলনা। সত্য সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে আমার রেটিং ৫ তারকা।