Jump to ratings and reviews
Rate this book

নৈশ অপেরা

Rate this book
একটা ভেঙে পড়া টাউন। জঙ্গলের ভেতর চার্চ। কিছু ভাঙাচোরা মানুষ। রহস্যময় এক জলাভূমি। বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক শিশু সেখানে মাঝে মাঝে দেখা দেয়। অলৌকিক আখ্যান হতে পারে, হতে পারে রহস্যকাহিনি, অথবা কিছুই নয়। হয়ত শুধুই বেদনার।

তনয়া কি পারবে এই আখ্যানের ভেতর লুকিয়ে থাকা সত্যিটা খুঁজে বার করতে?

410 pages, Hardcover

First published June 17, 2025

11 people are currently reading
110 people want to read

About the author

Sakyajit Bhattacharya

9 books58 followers
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে। পেশায় রাশিবিজ্ঞানী। বিশ্বসাহিত্যের নিষ্ণাত পাঠক শাক্যজিৎ বিচিত্র বিষয়ে নিরীক্ষামূলক গল্প, উপন্যাস লিখছেন সাম্প্রতিক সময়ে।

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
19 (47%)
4 stars
13 (32%)
3 stars
5 (12%)
2 stars
2 (5%)
1 star
1 (2%)
Displaying 1 - 21 of 21 reviews
Profile Image for Harun Ahmed.
1,646 reviews418 followers
Read
August 3, 2025
আমি এতোই হতাশ যে সমালোচনা করারও উৎসাহ পাচ্ছি না। শুধু বলি, এতো এতো "যদি" "কিন্তু" "হয়তো" "অথবা" দিয়ে আর যাই হোক না কেন, রহস্যকাহিনি হয় না।
Profile Image for Abhisek Roy Barman.
3 reviews3 followers
July 29, 2025
'শেষ মৃত পাখি'-র মতন অমন অনবদ্য, শুধু সাম্প্রতিক নয়, বাংলায় লেখা তাবৎ গোয়েন্দাসাহিত্যে এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমী সংযোজনের পর, সেই একই সিরিজের প্রকাশিতব্য উপন্যাস সম্বন্ধে তার রচয়িতার কাছে প্রত্যাশা ও শেষমেশ নিরাশ হওয়ার আশঙ্কা–দুটিই খুব উঁচুতারে বাঁধা থাকে। ইতিমধ্যে শাক্যজিতের লেখা অনেকগুলি ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধনিবন্ধ পড়ে ফেলি এবং মনে ভরসা জাগে যে, 'শে-মৃ-পা' অসময়ে উল্কাপাতের মত আকস্মিক কোনো দৈব অঘটন নয়–বরং একজন নিষ্ঠাবান গদ্যশিল্পীর দীর্ঘ অনুশীলন ও প্রস্তুতির যথাযোগ্য ফসল। এও বুঝতে পারি যে, সাহিত্যগুণের বিচারে, পশ্চিমবাংলার একালের গোয়েন্দাসাহিত্যে এক রাজর্ষি দাশ ভৌমিক ছাড়া শাক্যজিতের সমকক্ষ কেউ নেই। কাজেই প্রত্যাশা আরো প্রশ্রয় পায়।

আপাতত 'নৈশ অপেরা' পড়ে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও বিহ্বল। এ-কাহিনি কি কেবল 'শে-মৃ-পা'-র যোগ্য উত্তরপর্ব, নাকি সাহিত্যগুণে তার চেয়েও স্বতন্ত্র ও উৎকৃষ্ট–তার বিচার হয়তো এই বিহ্বলদশা কাটলে করাই ভালো। এটুকু বলাই যায়– শাক্যজিতের গদ্যের কাব্যময় কারুকার্য; আখ্যানকে বিচিত্র শাখাপ্রশাখায় বিন্যস্ত করে স্থান ও কালের মাত্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত সুদূরবর্তী সূত্রগুলোকে পরস্পরের কাছাকাছি আনার সাবলীলতা; উপরন্তু ঘনবাস্তবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ঘটনাপরম্পরায় ছন্দ, দ্রুতি, গভীরতা এবং চরিত্রদের প্রতি সমবেদনা রাগ দুঃখ দ্বেষের স্ববিরোধী রসায়নকে গাঢ় করে আনার যে নৈপুণ্য দেখিয়ে শেষ মৃত পাখি আমাদের আবিষ্ট করেছিল–তা 'নৈশ অপেরা'তেও স্বমহিমায় বহাল। যদিও, উত্তমপুরুষে একই চরিত্রের বিভিন্ন বয়েসের কথন-কে কোনো অধ্যায় বা পরিচ্ছেদে ভাগ না করে যেভাবে কুরুশের মতই বুনে দেওয়া হয় পরপর–তাতে 'শে-মৃ-পা'-র তুলনায় ‘ডেরেক এখানে বসে আছে’-র কথাই মনে আসে বেশি।

বিষয়বস্তুর নিরিখে মোটা দাগের মিল রয়েছে 'একানড়ে', 'শে-মৃ-পা' এবং 'ডেরেক'-এর সঙ্গে('বীরেশ্বর সামন্ত হত্যারহস্য' এখনও পড়িনি)–মেট্রোপলিস থেকে দূরে ক্ষয়িষ্ণু জনপদে কয়েক দশক আগে ঘটে যাওয়া অপরাধ–পুলিশ যার মীমাংসা করতে পারেনি–এবং সেই অমীমাংসিত অপরাধের প্রায়শ্চিত্তকল্পে এবং পরোক্ষ পাপবোধ-জনিত আত্মক্ষয়ে একটি গোষ্ঠীর বিভিন্ন মানুষ অকালে জরাপ্রাপ্ত হন, স্বাভাবিক জীবনস্রোতের বাইরে ছিটকে পড়েন, অথবা উন্মাদ হয়ে যান। শাক্যজিতের এই লেখাগুলির থিম হিসেবে যদি কয়েকটি শব্দ বেছে নিতে বলা হয় তবে আমি বলব–স্মৃতিভার, নৈরাশ্য, গিল্ট, রিপ্রেশন। স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতা এবং পাপীর নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা–এই দুয়ের সঙ্গে যুঝে সত্যকে বের করে আনতে প্রয়োজন ইতিহাসবিদ, মনোবিশ্লেষক অথবা চিহ্নতাত্ত্বিকের দৃষ্টি ও হেঁশেলে ঢোকা বিড়ালের ক্ষিপ্রতা।

মিথ্যে ও কল্পনার গাদায় ছানবিন করে সত্যকে খুঁজে বের করাই তো হুঁশিয়ার গোয়েন্দার কাজ– কেবল এটুকু ধরলে ধ্রুপদী গোয়েন্দাকাহিনির সঙ্গে শাক্যজিতের উপন্যাসের মিল খুঁজে পাওয়াই স্বাভাবিক–কিন্তু একটা বড় পার্থক্য, যেটা শাক্যজিতের লেখার একটি দার্শনিক এবং রাজনৈতিক প্রস্থানও হয়তো–তা হল, গোয়েন্দাপ্রবর হোমস, পোয়ারো, ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা হাল আমলের অনেক সত্যান্বেষীরা (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) যখন রহস্যভেদ করেন তখন তার সুফল হিসেবে সংসারে ভারসাম্য ফিরে আসে, একটি ছোট্ট সমস্যার যুক্তিসম্মত সমাধান আমাদের আন্তরিক তৃপ্তি দেয়, তার নেপথ্যে ঢাকা পড়ে যায় সভ্যতার সামূহিক সংকট, সমাজ-ইতিহাসের ক্ষতবিক্ষত প্রেক্ষিত।

এদিকে শাক্যজিতের উপন্যাসে যখন রহস্যভেদ হয় তখন সংসারে কোনো ভারসাম্য তো ফেরেই না, বরং উপন্যাসের সব চরিত্র এবং পাঠক স্বয়ং যেন শেষ অবলম্বনটুকু হারিয়ে দিশেহারা বোধ করে। নরহত্যার যে অপরাধ, তার কালপ্রিট-কে খুঁজতে গিয়ে যে মর্মান্তিক বিপর্যয়ের ইতিহাস বেরিয়ে পড়ে বীভৎসতা ও কারুণ্যে মথিত হয়ে, তা দেখে আর নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জোগায় না; দ্বিগুণ পাপবোধ, বিলাপ, হা-হুতাশ এসে গিলে খায় মনের চরাচর। পাঠক হিসেবে যদি বলি মীমাংসা না হলেই বোধহয় ভালো হত – তা হলে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু সত্যান্বেষণের ঠেলায় যে পরিমাণ ঘৃণা, অপমান ও অত্যাচারের যন্ত্রণা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা অসহনীয়, কারণ পাপী ও অপাপবিদ্ধ সব চরিত্রই ততক্ষণে আমাদের চোখে রক্তমাংসের মানুষ–তাদের শরীর বা আত্মার মৃত্যু ও পচন দেখে আমরা আর নির্বিকার থাকতে পারি কই? (বস্তুত, নৈশ অপেরার প্রথম পর্বের কিছুটা পড়ে মনে হয়েছিল এই চরিত্ররা আসলে সকলেই হয়তো মরে ভূত হয়ে গেছে কিন্তু সেটা এখনও তাদের অজানা–হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো' উপন্যাসের সেই আগন্তুকের মত) রহস্যসমাধানের সাফল্যেও তাই কোনো তৃপ্তি পাওয়ার কথা নয়। হয়তো সেজন্যই সিরিজের দুটো উপন্যাসেই শেষমেশ তনয়া, যিনি সত্যান্বেষী, তিনি যেন অকুস্থল থেকে বেরোতে পারলে বেঁচে যান!

শাক্যজিতের সব লেখাই যেন এক চরাচরব্যাপী শোক আর তাকে মুছে ফেলার সিসিফীয় প্রয়াসের ধারাবিবরণী; পরিত্রাণহীন নিরীশ্বর এই পৃথিবীতে নশ্বর মানুষের হাহাকারের নথি–যা আমাদের বিহ্বল ও নিরুপায় করে ছাড়ে। এখানে যদি কোনো আশার ঝলক থাকে, তবে তা রহস্য সমাধানের সম্ভাবনায় নেই; তা আছে (পাকেচক্রে) গোয়েন্দা তনয়ার চরিত্রচিত্রণে – তার মানবিকতায় – অপরাধের নির্মম সত্যকে খুঁজে বের করে, অপরাধীর ইতিহাস জেনে যাওয়ার পরেও তার প্রতি সমব্যথী হওয়ার অমূল্য সংবেদে।
Profile Image for Shuk Pakhi.
512 reviews305 followers
Read
August 10, 2025
বইয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে কিছু বলার নাই। আমি সাহিত্যবোদ্ধা নই।
শুধু এটুকুই বলার this is not my cup of tea.
Profile Image for Ashik.
220 reviews40 followers
Read
August 22, 2025
কেন পড়েছি, কীভাবে পড়েছি আমি নিজেও জানি না।
শেষ করেছি এটাই আশ্চর্যের।
Profile Image for Trinamoy Das.
100 reviews9 followers
August 7, 2025
স্মৃতির মত fickle জিনিস আর কিছু আছে নাকি?

ঝিঁঝির অবিশ্রান্ত আওয়াজের মাঝে সেই স্মৃতি ছিঁড়েখুঁড়ে পাল্টাতে থাকে, বেরিয়ে আসে হেঁচকির মত। তখন চল্লিশ বছর আগের কোনও ঘটনা পরিষ্কার বোঝা যায় না। পরস্পরবিরোধী কথা জমতে থাকে, মল্লযুদ্ধ করার জন্য উদ্যত হয়।

"নৈশ অপেরা"-এর মূল রহস্য সমাধানে তনয়ার ("শেষ মৃতি পাখি"-এর প্রোটাগনিস্ট) কাছে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই স্মৃতির ক্ষয়। তামাদি দুটো কেস, যার ক্রুশ এখনও কিছু লোক বয়ে বেড়াচ্ছে, সেই দুটি কেসের সমাধান বার করা খুব একটা সহজ নয়।

স্মৃতির মত ঝাড়খণ্ডের এই টাউনও ক্ষয়ে গেছে। এককালের হর্তাকর্তা, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা প্রায় সকলে এলাকা ছাড়া। শূন্য কটেজগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কারণ নতুন ট্যুরিস্ট লজ বা শপিং সেন্টার খোলা হবে নাকি।

এইরকম প্রেক্ষা���টে, এমন থিম নিয়ে রহস্যগল্প বাংলা ভাষায় খুব একটা পড়ি নি (ট্রু ডিটেকটিভের তৃতীয় সিজনে ডিমেন্সিয়ার ব্যবহারের কথা খুব মনে পড়ছিল)। নন-লিনেয়ার ভাবে, অগোছালো স্মৃতিঝিঁঝির মত, গল্পের প্লট এগোতে থাকে। বহুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক কিশোরী আর দুইবছরের এক ছেলের সাথে বর্তমানের একটা খুনের কোনোও সম্পর্ক রয়েছে কিনা, সেটা নিয়েই পুরো উপন্যাস।

প্লট নিয়ে কপচাই না, এখানেও কপচাবো না। কিন্তু লেখনীর ধরণ নিয়ে দুই কথা বলব। উপমাবহুল লেখা শাক্যজিৎ বাবুর একটা USP, বুঝতে পারছি। এইরকম বিষাদের স্বাদ "শেষ মৃত পাখি" আর "একানড়ে"-এর প্রতিটা পাতায় পাতায় ছিল। কিন্তু সেই লেখনীই উপন্যাসের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমত, উপন্যাসের অনেকগুলো অধ্যায় উপমার ভারে একদম দাঁড়িয়েই গেছে। একই স্মৃতির কথা একই উপমার মাধ্যমে যদি বারবার ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মত, তাহলে পাঠকের মনে একটু ফ্রাস্ট্রেশন তো আসবেই। জানি, গল্পের মূল থিম জীবনের বৃত্তাকার রূপ আর স্মৃতির অনির্ভরযোগ্যতা, তবু উপন্যাসের মাঝামাঝি আসার পর এই উপমাদের ভিড় আমার বিরক্তির উৎপাদন যে করে নি, তা বললে মিথ্যে বলা হবে।

দ্বিতীয়ত, গল্পের বিভিন্ন কথকের tone। "শেষ মৃত পাখি" তে মূল দুইজন কথক রয়েছে: তনয়া নিজে আর পুরনো এক কবি। এখানে দুই কথকের মধ্যে পার্থক্য সুবিশাল। কবি অমিতাভ মিত্রের ভাষায় ফুটে ওঠে অতৃপ্ত কবিসত্তা আর তপ্ত অনুভূতির জোয়ার। অন্যদিকে তনয়ার ভাষা বিষাদময়ী আর বুদ্ধিদীপ্ত। "নৈশ অপেরা"তে বেশ অনেকজন কথক ভিড়েছে, তারা সবাই নিজেদের কথা উগলে দিয়ে আবার চলে গেছে। কিন্তু tonally এদের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। এই সমস্যাটা সবথেকে ভাল ভাবে বোঝা যায় ইনস্পেকটর অবিনাশ আর আলফ্রেডের জবানি পড়ার সময়। দুইজনের কথা বলার ধরণ এতটাই সদৃশ, যে মনে হবে একই লোকের দুটো ডপলগ্যাঙ্গার। এইরকম চরিত্রাঙ্কনের জন্য আমার মনে হয়েছে পুরো উপন্যাস জুড়ে শুধু তনয়ার নানা রূপের  জবানি শুনছি, আর কিছু নেই, যেন ওই ভূতুড়ে টাউনে তনয়া ছাড়া আর কেউ নেই।

"শেষ মৃত পাখি"-এর মত ততটা ভাল না লাগলেও "নৈশ অপেরা"-এর সৌন্দর্য্য আমি উপেক্ষা করতে পারি না। সামাজিক বৈষম্য আর ধর্মীয় গোঁড়ামির কথা ফিসফিস করে বলে এই উপন্যাস। সেইসকল সমস্যার মাঝে রহস্য ফিকে হয়ে যায়, কিন্তু তবু হাতছানি দিয়ে শেষ পাতা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।
Profile Image for Arnab Kar.
3 reviews
June 29, 2025
পাঠ প্রতিক্রিয়া :-

"নৈশ অপেরা"
লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য,
প্রকাশক : সুপ্রকাশ প্রকাশনী,
প্রথম প্রকাশ : জুন, ২০২৫,
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী ,
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪১০,
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা।

গতকাল বইটি পড়া শেষ করেছি। এখনও তার রেশ কাটেনি। উপন্যাস শেষ, রহস্য উন্মোচিত কিন্তু তবু যেন আমি দুপাশে জঙ্গলঘেরা ডেগাডেগি নদীর ধারে নির্জনে একাকী বসে আছি। উপন্যাসের স্থানীয় চরিত্রগুলো আমার চারপাশ দিয়ে ছায়া আবছায়ার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও নিঃশব্দে পাশে এসে বসছে। কখনও পিছনে এসে দাঁড়াচ্ছে। কখনও কারো গলার আওয়াজ শুনে সেরকমই কোনো ছায়ার পিছু পিছু আমি হয়তো জঙ্গলে ঘেরা উঁচু নিচু পথ দিয়ে পাড়ি দিয়েছি তিতিরকান্না মাঠের দিকে।
আমি বাকিদের মতন উদ্ধৃতি তুলে তুলে গতে বাঁধা নিয়মে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে পারিনা। আমার নিজের বক্তব্যই যতটা সংক্ষেপে হয় লিখে বোঝাতে চেষ্টা করি। স্পয়লার যাতে না দিয়ে ফেলি সেই দিকেও সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়।
লেখকের লেখা আরেকটি রহস্য উপন্যাস দার্জিলিং এর পটভূমিকায় "শেষ মৃত পাখি" পড়ে শিহরিত হয়েছিলাম। থ্রিলার পড়ে যদি thrilled ই না হলাম তো সেই থ্রিলারের সার্থকতা কোথায়? কিন্তু না। শাক্যজিৎ বাবু সেক্ষেত্রে কোনো অভিযোগের জায়গা রাখেননি ওই উপন্যাসে। এমন অদ্ভুতভাবে রহস্যকাহিনী টি উপস্থাপিত হয়েছিল যে সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। তবে এই উপন্যাসটি, মানে "নৈশ অপেরা" কি সেই থ্রিল ধরে রাখতে ব্যর্থ হোলো? সেকথায় পরে আসছি। আমি আবারও ফিরে যাচ্ছি ঝাড়খণ্ডের ডেগাডেগি নদীর তীরে সেই ভেঙে পড়া টাউনটিতে। ভাঙাচোরা বাড়ি। ভেঙে পড়া কিছু মানুষ। ভগ্নপ্রায় চার্চ। আর একটি অর্ধ ভগ্ন কটেজ। প্রকৃতির যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, যেভাবে দিয়েছেন, পড়তে পড়তে প্রতি মুহূর্তে ওই জায়গার সাথে একাত্ম হয়ে যেতে হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা পড়ে প্রকৃতির সাথে বারংবার একাত্ম হয়েছি পূর্বে। বুদ্ধদেব গুহর লেখাতেও এই ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলের প্রাকৃতিক বর্ণনা উঠে এসেছে । সেই বর্ণনায় একাত্ম হয়েছে প্রেম ও প্রকৃতি। কিন্তু এই উপন্যাসের প্রাকৃতিক বর্ণনার পরতে পরতে রয়েছে শিহরণ। হরর ছায়াছবিতে পরিচালক যেমন দর্শকদের ভয় দেখানোর আবহ তৈরি করার প্রভূত সুযোগ পান। কেউ ভয় দেখাতে পারেন কেউ পারেন না। কিন্তু লেখনীর মাধ্যমে গা ছমছমে আবহ তৈরি করা কিংবা এমন একটা আবহ তৈরি করা যেটা পড়ে মুহূর্তে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এমনটা কিন্তু সবাই পারেন না। শাক্যজিৎ পেরেছেন এবং সফল ভাবেই পেরেছেন । সূচনা থেকেই সেই আবহ তৈরি করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রাকৃতিক বর্ণনা এবং তার সাথে একটা অজানা ভয়ের আশঙ্কা। অদ্ভুত একটা গা শিরশিরানি অনুভূতি তিনি ধরে রাখেন সমগ্র প্রথম পর্ব জুড়ে। প্রথম পর্বে গল্প এমন জট পাকায় পাঠকের একসময় মনে হবে একটা লুপের মধ্যে যেন হারিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। চোরাবালিতে গেঁথে যাওয়ার মতন। মনে হবে এই রহস্যের সমাধান কি আদৌ সম্ভব? কীকরে সম্ভব? যেখানে ঘটনা ঘটে গেছে বহু বছর আগে। তার অনেক ক্লু অনেক সাক্ষ্য প্রমাণই হারিয়ে গেছে। তার পরেও কি তনয়া পারবে এই রহস্যের কিনারা করতে?
হ্যা তনয়া। তনয়া ভট্টাচার্য। "শেষ মৃত পাখি" উপন্যাসের সেই সাংবাদিক আবারো ফিরে এসেছেন এই রহস্য কাহিনী তে। পেশায় তিনি গোয়েন্দা নন কিন্তু পূর্বের হত্যা রহস্যের সফলতায় তার উপর এখন মানুষের আস্থা বেড়েছে। তাই তাকে না চাইতেও জড়িয়ে পড়তে হয় কাহিনীর মায়াজালে। জড়িয়ে পড়তে হয় বারবারা, অ্যারন, এডওয়ার্ড, মনীষা, জেনিফার, ডলোরেস, মার্গারেট, ফ্রেডরিক, অবিনাশ, রেভারেন্ড সবার সাথে। আরো দুটি চরিত্র না থেকেও তনয়া কে ঘিরে ছিল সর্বদা, সেই ক্রিস এবং অ্যাগনেস।
উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে জট ছাড়ানোর পর্ব চলে। এই পর্বটি প্রথম পর্বের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু উত্তেজনার মাপকাঠি একই ছিল। অন্তত আমার কাছে তাই ছিল। "শেষ মৃত পাখি" - র সাথে সবকিছু তুলনা করলে হবে কেন? দুটো উপন্যাস তো একই রকম ভাবে এগিয়ে যেতে পারেনা। তাহলে আর পাঠকরা গ্রহণ করবেন কেন? এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে তনয়া শেষ অবধি যেই সিদ্ধান্তে আসেন সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত অভিমত। এই রহস্যের সমাধান কেউ অন্যরকম ভাবে করলেও করতে পারত সেটাও যে ঠিক বলতে পারি তা নয়। কারন পরে আমরা পাঠকরা জানতে পেরেছি তনয়া সত্যসন্ধানী হিসেবে কতটা সঠিক ছিল। তবু তার কাছে শেষ অবধি এক দুটো জিনিস অধরা রহস্য হয়েই থেকে যায় যেটা আমরা পাঠকেরা শেষে গিয়ে জানতে পারি কিন্তু তনয়া জানতে পারেন না। এটাই ওনার জন্যে একটু আক্ষেপ। কিছু ক্ষেত্রে না পাওয়া টাও হয়তো অনেক বেশি পাওয়া হয়ে যায়। যাদের কথা ভেবে তনয়া দিবারাত্র এক করেছে তারা তনয়া কে কাছে টেনেও ভুল বুঝে দূরে সরিয়েছে বারংবার। আর আগনেস? সেই কিশোরীটির কথা ভেবে হৃদয় মুচড়ে ওঠে প্রতি মুহূর্তে। কি পেলো মেয়েটি তার সারা জীবনে? এত আঘাত এত কষ্ট কি সত্যিই তার প্রাপ্য ছিল? কোথাও গিয়ে যেন অ্যাগনেসের এই ব্যথা এই যন্ত্রণা তনয়াকে ছুঁয়ে যায়।
"হা হা বাতাস , শাল সেগুনের প্রহরা ও নির্জন টিলা তোমাকে মনে করাবে মৃত সমাধিদের কাহিনী।"
সত্যিই এই উপন��যাস শেষ করার পরেও মনে করাতে থাকে সেই গঞ্জ, সেই sanctuary homestay , সেই তিতিরকান্নার মাঠ, রহস্যঘেরা জলাভূমি ও জোহার হালে।
তনয়া কে আমরা নিশ্চই খুব শিগগিরই আবার পাবো শাক্যজিতের পরবর্তী রহস্য কাহিনী তে। কিন্তু "নৈশ অপেরা" - এই আবহ , এই মায়া কিন্তু আরো কিছুদিন ছড়িয়ে থাকবে দেহ মনে।
Profile Image for Raihan Ferdous  Bappy.
226 reviews13 followers
August 16, 2025
একটা ভেঙে পড়া টাউন, জঙ্গলের গভীরে লুকিয়ে থাকা চার্চ, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা মানুষ। এর ভেতরেই আছে এক রহস্যময় জলাভূমি, যেখানে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক শিশুর ছায়া মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে। এ কি কেবলই লোককথা? নাকি এর পেছনে আছে কোনো অলৌকিক আখ্যান?

বলছিলাম শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের লেখা রহস্য উপন্যাস 'নৈশ অপেরা'-র কথা। লেখক পুরো উপন্যাস এমনভাবে লিখেছেন যেখানে স্পষ্ট উত্তর নাই। একবার মনে হচ্ছে, ঠিক পথে এগোচ্ছি। আবার, একটু গিয়েই সব যেনো কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে বলেও মনে হয়। একবার মনে হচ্ছিলো এ কি রহস্য উপন্যাস? নাকি হরর? সত্যি বলতে অনিশ্চয়তাই হচ্ছে এই বইয়ের মূল উপাদান।

আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই বইয়ের মুড। পুরোটা জুড়েই যেনো এক দমবন্ধ ব্যাপার ছিলো। ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা ব্যাপারটা আসলেও জোশ।

বইটা ধরার আগেই এক ধরনের ভয় কাজ করছিলো। ভেবেছিলাম, বইটা হয়তো আমার ভালো লাগবে না। বেশকিছু নেগেটিভ রিভিউ দেখেই এহেন মনে হয়েছিলো। কিন্তু শেষ করার পরে আমি ৫/৫ দেয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারিনি, এতোটাই জোশ লেগেছে আমার কাছে।

হ্যাঁ, একটা জিনিস অবশ্যই বলা উচিত। ম্যাক্সিমাম পাঠক পাঠিকার কাছেই 'নৈশ অপেরা' অনেক বেশি ভালো লাগতো যদি লেখাটা আরো স্পষ্ট হতো। 'শেষ মৃত পাখি' যেমন ছিলো তার তুলনায় বলতে গেলে 'নৈশ অপেরা' অনেকের চোখেই অষ্পষ্ট বলে মনে হবে।

তবে, আমি খুব বেশিই উপভোগ করেছি। ইনফ্যাক্ট, 'শেষ মৃত পাখি'-র থেকেও বেশি ভালো লেগেছে। ৫/৫ তো আর এমনি এমনি দেইনি। তাই না? শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত একটা ভার বুকের ভেতর থেকে গেছে, বইটা শেষ করার পরেও মনে হচ্ছে সেই রেশ কাটেনি। চমৎকার লেগেছে। ব্রাভো শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য! ব্রাভো!!
Profile Image for Srijan Chattopadhyay.
58 reviews6 followers
November 28, 2025
অনেক ছোটবেলায় সরস্বতী পূজায় একবার নিথর শিশু কোলে এক মা এর পাথর ফাটানো কান্না শুনেছিলাম। এই উপন্যাস টা পড়ে সেই গুমরে ওঠা বীভৎস দলাপাকানো বিষন্নতা কিছু টা ফিরে পেলাম।

এটা ঠিক গোয়েন্দা অপরাধী খুন সাজানো টানটান থ্রিলার নয়। মানব হৃদয়ের বহুস্তরীয় অন্ধকারের সাগর মন্থন করে তোলা হাহাকারের আর্তনাদ কে নিখুঁত পুরেছেন লেখক রহস্য কাহিনীর মোড়কে।
শেষ মৃত পাখি মন জিতে নিয়েছিল, আর এবার মন হারিয়ে ফেললাম।
অসাধারন।

Happy reading.
Profile Image for Bratabani .
5 reviews2 followers
July 28, 2025
অতিকথন আর পুনরাবৃত্তি এই উপন্যাসে রীতিমতো মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
Profile Image for Kushal Biswas.
8 reviews
September 6, 2025
বইটি চার দিনে টানা পড়ে শেষ করলাম । ৪১০ পাতার বাংলা রহস্য-উপন্যাস আগে পড়েছি বলে মনে পরছেনা। সুবৃহৎ পরিসরে রহস্যের ডালপালা ছড়িয়ে, গল্পের শেষ পর্যন্ত suspense বজায় রেখে তা আবার সুচারু রুপে গুটিয়ে আনা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয় । লেখক এই জায়গায় কিন্তু একশ শতাংশ সফল ।
Profile Image for Mousumi Chakraborty.
3 reviews
June 24, 2025


পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে
সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।

—-১৯৪৬-৪৭,জীবনানন্দ দাশ

… সুতরাং কিশোরী অ্যাগনেস ও’ব্রায়েন-কেও একদিন হারিয়ে যেতে হয়।

এবং এডওয়ার্ড ব্রাউন খুন হয়,ক্রিস ব্রায়ান অপহৃত হয়,মুন্না মারা যায় বা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়,ডেভিড ব্রাউন ও মনীষা ব্রাউন আত্মহত্যা করে। এবং ‘শেষ মৃত পাখি’র ব্রিলিয়ান্ট ডেবিউর তিনবছর পর তনয়ার সঙ্গে পাঠকের অপেক্ষিত দ্বিতীয় সাক্ষাৎটি ঘটে ঝাড়খণ্ডের টিলা-ঝোরা-জঙ্গল-ঘাসবন ও অরণ্যের ঝাঁঝরা অশেষ মৃতদেহ সম্বলিত গঞ্জের জীবন্ত ফসিলের অভয়ারণ্যে। তনয়া আসেন,ছেড়ে যান এবং ছেড়ে গিয়েও আবার ফিরে আসেন গঞ্জের নন-লিনিয়ার সময়প্রদেশে ক্রমাগত মানুষের নেই হয়ে যাওয়ার সত্যি খুঁড়ে বের করতে।

অতিপ্রাচীন মালভূমি ও উপত্যকা যারা মহাদেশের জন্ম দেখেছে,যেখানে প্রাগৈতিহাসিক গাছেদের প্রেতশিকড়ের‍ গা বেয়ে সবুজ অন্ধকার ওঠে মাটি ফুঁড়ে,সেখানের ফ্লাকচুয়েটিং স্মৃতি ও আচ্ছন্ন জনমানস,অসুখাক্রান্ত শৈশব ও বিক্ষত বেঁচে থাকা এবং অনস্তিত্বের আশ্চর্য পৃথিবী উপন্যাসের প্রথম পর্ব জুড়ে প্রত্যেকের দিন রাত্রি গোধূলি ও শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায়। আবহ নির্মাণ এত সাবলীল যে অনায়াস নিরাবেগে নিশির ডাকের মতো হাতছানি রেখে যায়। যেহেতু তনয়া শুরু থেকে শেষ অবধি মূলত সন্ধানী,অকাট্য ঈশ্বর হওয়ার দায় তাঁর নেই,সেই কারণে বারবারা-অ্যারন-জেনিফার-অবিনাশ যাদব-আলফ্রেড হেমব্রম ও গঞ্জের অন্যান্যদের মতো তনয়াও ‘নৈশ অপেরা’র অন্যতম ন্যারেটর। কাহিনীর দূর অতীত,অনতিদূর অতীত ও বর্তমান আসলে এদের বিবিধ ন্যারেটিভ,প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অনুভূতি অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। পাঠক এদের সঙ্গে সামিল হয়ে পড়ে গঞ্জের গোলকধাঁধার মতো অ্যানাটমির ভিতর। সময়ের পেটের ভিতর আরেক সময়,তার ভিতর আরেক। ষাটের দশক-আশির দশক,যখন গঞ্জের অ্যাংলো কমিউনিটির ভালো সময়,পঁচাশি সাল থেকে নব্বইয়ের দশক,যখন অ্যাগনেস ও ক্রিস হারিয়ে যায় এবং কমিউনিটির উপসংহারের শুরু হয়,আরও যা শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়,এই সব আলাদা আলাদা কালখণ্ড,এমনকি অ্যাগনেসের নিজের সময়ও অ্যাগনেসের অনস্তিত্বের ভার বহন করে,যা তার উচ্ছলতার আনন্দের বিষাদের একদিন দু’দিন কিংবা কয়েক মাস পরের ঘটনা,অ্যাগনেসের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা,কিন্তু যে কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় ঘটে গেছে,ঐ একটি ঘটনাই চিরকালের মতো ঘটে আছে।
‘নৈশ অপেরা’র সময় আদতে ভাঙনের দিকনির্দেশ। প্রথম পর্বে যদিও গা-ছমছমে রহস্য,তবু তলায় তলায় স্রোত বয় অনপনেয় শোকের। তনয়া নির্ধারণ করেন তিনি কী খুঁজবেন — যারা হারিয়ে যায় তারা কেন হারিয়ে যায়। অ্যাগনেস হারিয়ে গিয়েছিল বলেই কি ক্রিসকেও হারিয়ে যেতে হয়?

লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো — মৃত।
মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো।
মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
— ১৯৪৬-৪৭,জীবনানন্দ দাশ

মানুষের ইতিহাসে এমন অতীত নেই যখন সবলের মুঠো দুর্বলের শ্বাসরোধ করেনি। গঞ্জের নিজস্ব জাতিবৈষম্য শ্রেণিবৈষম্য লিঙ্গবৈষম্য ইত্যাদি যাবতীয় অসাম্যের সমীকরণ উপাদান সেই প্রাথমিক অপরাধেরই,কারণ সব অপরাধ শেষমেশ একটি গল্পেরই পুনরাবৃত্তি। সবল বনাম দুর্বল এই সমীকরণ লক্ষ বছরেও বদলায়নি,বদলে যায় শুধু অবস্থান। প্রশ্ন রয়ে যায় — শুরু কোথায়? শুরু না জানলে নির্ধারণ করা যায় না অন্যায়কারী কে,প্রতিশোধ কার। দ্বিতীয় পর্ব সেই উৎসের দলিল এবং যেহেতু তনয়া শুরু থেকে শেষ অবধি সন্ধানী,ফলত তনয়া ধূসর ভঙ্গুর যে সূত্রগুলো ক্ষয়ের ডিপ্রেসিভ গন্ধ ছাড়ে,সেগুলোকে মিলিয়ে সম্ভাব্য সবথেকে সহজ কার্যকারণ দাখিল করেন। আমরা পাঠকরা,যারা ‘শেষ মৃত পাখি’র সেরিব্রাল উজ্জ্বলতায় বিস্মিত হয়েছিলাম,তাদের কাছে ‘নৈশ অপেরা’র সমাধান তুলনায় সহজ ও অনুত্তেজক লাগতে পারে। মনে হতে পারে যেসব হারিয়ে যাওয়ার বিষ-অভিঘাতে গোটা গঞ্জ ও তার প্রজন্মরা দীর্ঘ পরিণতিহীন মৃত্যু পেতে পারে,সেই সব নিরুদ্দেশের ‘কীভাবে’ ও ‘কেন’ আরও শকিং হ��� না কেন। বুদ্ধির খেলা শুরু হওয়ার আগেই যেন মঞ্চে পর্দা পড়ে গেল।
কিন্তু আমরা কি জানি না,যে সমাজ জানে না মেয়েদের কীভাবে হ্যান্ডল করতে হয়,সেই সমাজে অ্যাগনেসরা কেন হারিয়ে যায়। আমরা তো জানি অ্যাগনেস প্রথম নয়,তার আগে ও পরে মানুষের পদচিহ্নের আদি থেকে আজ অবধি অনেকানেক মেয়েদের নেই হয়ে যাওয়াই প্রথা। যে অপরাধ নতুন নয় এবং যার উপশম নেই,সেই অন্যায়ের স্মৃতি আমাদের অবচেতনে বয়ে এনেছি, ‘নৈশ অপেরা’ সেই সুতোয় টান দেয় অনাড়ম্বরে,শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের পরিচিত নির্মোহতায়। স্তব্ধ হয়ে ভাবি,এই উপন্যাসের আঘাত আমি হৃদয়ে বয়ে বেড়াব ভাস্কর্যের মতো। অ্যাগনেসের জন্য যতবার বেদনা অনুভব করব,মনে হবে একটি রহস্য কাহিনি আমায় জীবনানন্দের আরেকটু কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।

তনয়ার দায় নেই অকাট্য ঈশ্বর হওয়ার,সুতরাং উপন্যাসের উপসংহার জানান দেয়,তনয়া একশো শতাংশ সঠিক নাও হতে পারেন। পাঠক হিসেবে আমি চাই,গঞ্জের অমীমাংসিত রহস্যগুলোর অন্তত একটি সমাধানে তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল হোক। তনয়া ঘোষণা করেন,অ্যাগনেস নেই। অ্যাগনেসের ভূত আসলে মাস হ্যালুসিনেশন কিংবা সাজানো ভূত। পাঠক হিসেবে আমি জানি, ‘নৈশ অপেরা’র ক্ষয় শাপ ও শোকের ক্রনিকলে অ্যাগনেসের ভূত আমার সালভেশন। কারণ,ক্রমাগত অন্যায় অবিচার ও অত্যাচার তাকে নিঃশেষে মুছে দিল,এর চাইতে বিধ্বংসী অন্যায় আর কিছু নেই।

‘মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?’
উপন্যাস কোথাও কি লুকনো নীরব প্রশ্ন রেখে যায়?

সৌজন্য চক্রবর্ত্তীর প্রচ্ছদ প্রশংসনীয়। মুদ্রণ-প্রমাদ নগণ্য।
পরিশেষে লেখককে অভিনন্দন। তনয়া আবার ফিরবেন এবং আরেকটি দুর্দান্ত মানবিক কাহিনি পাঠককে উপহার দেবেন অপেক্ষা রাখি।





Profile Image for Asib Gazi.
86 reviews1 follower
September 15, 2025
এই উপন্যাস আমার জন্য একধরনের মেন্টাল টর্চার হয়ে ছিলো। লাইফে নেসেসারি এভিলের দরকার আছে এরকম।
Profile Image for Preetam Chatterjee.
6,740 reviews355 followers
July 5, 2025
নৈশ অপেরা: শব্দের গহ্বরে এক আত্মার গায়ন

১. ভূমিকা: প্রত্যাশার পুনরুত্থান ও প্রেতায়িত পাঠ

শেষ মৃত পাখি যখন শেষ করি, একটা শব্দ নীরবতার মতো গায়ে লেগেছিল—বিষাদ। সেই বিষাদ ছিল কেবল গল্পের জন্য নয়—একটা হারানো কণ্ঠস্বরের জন্য, যা এখনও বাতাসে ঘোরে কিন্তু ধরা যায় না। তারপর যখন শুনি শাক্যজিতের নতুন উপন্যাস আসছে, নাম নৈশ অপেরা, তখনই বুঝি—এটি কেবল একটি গল্প হবে না, এটি হবে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরের রাতের সংগীত, স্মৃতির কুয়াশা আর আত্মার ছায়া মিশে তৈরি এক অন্ত্যোষ্টি-গান। পাঠ শুরুর আগেই একটা কান্না যেন ভিতরে বাজছিল। যেন জানতাম—এই গল্প আমাকে শান্তি দেবে না, উত্তর দেবে না, বরং কিছু চিরস্থায়ী প্রশ্ন আমার ভেতর রেখে যাবে—অপ্রকাশিত, অনুত্তরিত, অনিবার্য।

"The past is not dead. It’s not even past." — উইলিয়াম ফকনারের এই কথাটি যেন একেবারে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নৈশ অপেরা পড়তে পড়তে। এখানে অতীত শুধু অতীত নয়, সে যেন এক জীবন্ত ভূত—পাশে বসে থাকে, চিঠি লেখে, ডাক দেয়, কখনো কখনো গলা টিপে ধরে।

উপন্যাসটি যেন শুরুই হয় একটি মৃত্যুপ্রহর থেকে। কোথাও এক মৃত শিশু, কোথাও এক হারিয়ে যাওয়া নারী, কোথাও এক নির্বাক শহর—সব মিলিয়ে পাঠক যেন এক গোপন কণ্ঠ শুনতে পায়, অন্ধকারে:

“আমার শরীর নিখোঁজ নয়, আমার সত্তা হারিয়ে গেছে।”

এই উপন্যাসের নামেই রয়েছে তার প্রকৃতি—নৈশ, মানে রাত, অন্ধকার, একাকিত্ব, আর অপেরা—সুরেলা, বেদনাবিধুর নাট্যগীতি। এই দুইয়ের মিলন কেবল শব্দগত নয়, এটি এক জন্ম-স্মৃতি আর মৃত্যু-সংগীতের সংলগ্ন রচনা। ঠিক যেন প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজেডির মতো, যেখানে সকল চরিত্রই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু পাঠক পিছন ফিরে দেখে—এটা অনিবার্য ছিল।

"We are all ghosts. We all carry, inside us, people who came before us." —Liam Callanan-এর এই বাক্যটা যেন তনয়ার কণ্ঠে শোনা যায়। উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকেও এক ভুতুড়ে পাঠক বলে ভুল করে—নিজেরই হারিয়ে যাওয়া সময়ের ছায়া হাতে, স্মৃতির খনিতে নামা এক নিষ্প্রভ অভিযাত্রী।

এই উপন্যাসের পাঠ তাই সহজ নয়। একে পড়া মানে শুধু চোখে দেখা নয়, হৃদয়ে শোনা, শরীরে বোধ করা। আর এখানেই লেখকের সাফল্য—তিনি আমাদের আরাম দিতে চান না, তিনি আমাদের চোখে হাত দিয়ে বলেন:

“চোখ খুলে দেখো, ভূতেরাও কাঁদে।”

এবং সেই কান্না... সে পাঠকের আত্মাতেও নেমে আসে, এক গভীর নিশুতি হয়ে।

একপ্রকার "Elegy for the Unwritten", অথবা "Requiem for the Remembered"।

এই উপন্যাস আমাদের সেইসব নামহীন কণ্ঠের সামনে দাঁড় করায়—যাদের জীবন হারিয়ে গেছে কাহিনির বাইরেই।

২. প্লট ও স্থানকাল: ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা এক থিয়েটার
বহরমপুর থেকে শুরু—যে শহর এক সময় নবাবি গর্বে নিজেকে দেখত ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে—তারপর কাহিনি গড়িয়ে যায় মুসাবনির দিকে। কিন্তু এ গতি কোনও অ্যাকশনের নয়, বরং স্মৃতির একটি ক্যামেরা রোল—ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকা সেলুলয়েড, যেন পুরনো প্রজেক্টরে বাজছে এক নৈশ অপেরা।

এই উপন্যাসের প্লটকে যদি আপনি “মিসিং পার্সন” জঁরার সাদামাটা কাঠামোয় ধরতে চান, তাহলে আপনি বিভ্রান্ত হবেন। কেননা, এখানে মিসিং শুধু ব্যক্তি নয়, মিসিং হয়ে গেছে একটি যুগ, একটি ভাষা, একটি ইতিহাস। শেফালি চৌধুরির ছাত্র স্যান্ডি হোয়াইট, যিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত, তাঁর হারিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র এক কিশোরের নিখোঁজ হওয়া নয়—এ এক ghosting of a generation, উপনিবেশ-উত্তর ভারতের প্রান্তবর্তী ক্ষয়িষ্ণু জনগোষ্ঠীর নিঃশব্দ পরিণাম।

“কেউ কোনোদিন ফিরে আসবে না, যারা চলে গেছে তারা ইতিহাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে—চোখে ধুলোর পর্দা।”
— (শেফালির অন্তর্জালে লিখিত পুরনো ব্লগে হয়তো এমন কোনো পঙক্তি ছিল)

মুসাবনি, এই “জ়ার্মান ভূতেদের শহর” যেন এক post-colonial necropolis—যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাঙা দেওয়াল, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ক্লাবের বন্ধ বার, কুয়াশাঘেরা রেলওয়ে কলোনি—সবই এক মৃত থিয়েটারের পরিত্যক্ত সেটপিস। এই শহরটিই যেন উপন্যাসের আসল চরিত্র, আর স্যান্ডি নয়, স্যান্ডি তার প্রেতরূপ।

শাক্যজিত খুব সচেতনভাবে স্থানকে কাহিনির নায়ক করে তোলেন—এখানে শহর শুধুমাত্র প্রেক্ষাপট নয়, বরং স্মৃতির শরীর।

“Places remember. Even if people forget.” —Victoria Schwab

এই উপন্যাসের সময়কালও গূঢ়—এখানে ক্যালেন্ডার চলে না, এখানে সময় একেক জনের ভেতর আলাদা বেগে হাঁটে। বহরমপুরে পুলিশ-সাংবাদিক-প্রাক্তন শিক্ষক মিলে যখন তদন্ত শুরু করে, তখন মুসাবনিতে সময় এক অদ্ভুত স্থিরতায় দাঁড়িয়ে থাকে—ঘড়ি চলে, মানুষ চলে না।

উপন্যাসে একটা বারংবার ফিরে আসা অনুভূতি:

“It’s not that the place has died. It’s that we have stopped hearing its heartbeat.”

সেই “heartbeat” কে শোনার চেষ্টাতেই পাঠক নামতে থাকে—এক রহস্য থেকে অন্য পরতে, কিন্তু সেখানে রহস্যের সমাধান নয়, অমোচনীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়। The mystery remains not in the whodunit, but in the why-we-forgot.

এই প্লট যেন একটি অদৃশ্য অপেরা—যার স্কোর আমরা পাই না, পাই শুধু রিহার্সালের অস্পষ্ট সুর।

স্যান্ডির নিখোঁজ হওয়া যেন সেই শেষ সুর যা হারিয়ে গিয়েছিল,

আর উপন্যাস যেন তার শেষ রিকল।

৩. তনয়া: একজন দর্শিকা, অথবা একজন মরণশীল ঈশ্বরী

এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে যদি কোনও চরিত্রকে বসাতে হয়, তবে নিঃসন্দেহে তা তনয়া। তবে তিনি কোনও কনভেনশনাল ‘প্রোটাগনিস্ট’ নন। বরং, তিনি এক দ্বৈত সত্তা—একদিকে দর্শিকা, অন্যদিকে সৃষ্টিশীল ঈশ্বরী, যিনি নিজেই তাঁর তৈরি মিথের ভিতর ঢুকে যান এবং তাতে বিলীন হন।

তনয়া কি শুধুই শেফালির প্রাক্তন ছাত্রীদের এক? না কি তিনি সেই ‘লাস্ট উইটনেস’, যে কেবল দেখেন, মনে রাখেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলেন না—অথবা বলেন, কিন্তু কেউ শোনে না?

“আমি কাউকে চিনি না। কিন্তু সকলেই যেন আমার পরিচিত। আমি সকলের ভুলে যাওয়া স্মৃতি।”
— তনয়ার ডায়েরির পাতায় একবার লেখা ছিল।

তনয়া একদিকে শিক্ষক, অন্যদিকে অনুসন্ধানকারী। কিন্তু আসলে তিনি এক ‘mourner-in-residence’—এই সমাজের বিস্মৃত মৃত আত্মাদের জন্য এক প্রফেশনাল শোক পালনকারী। তাঁর স্বরভঙ্গিমায় জীবনানন্দের মতো শোক ও প্রত্যাহারের সুর—

“মেয়েটি চলে গেছে। ঘাসে আগুন লেগেছে—সে জানে না, কেউ জানে না।”
(জীবনানন্দ দাশ)

তনয়া চরিত্রটি যেন ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণলতা আর নীলরঙ্গ মেঘের মিশ্র প্রতিভূ। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ—হাসি, অভিমান, প্রশ্ন—সবকিছুতেই আমরা এক ভিন্ন ভারসাম্য টের পাই:

একজন নারী যিনি simultaneously victim and witness, mourner and myth-maker।

আর এই নারীর অস্তিত্ব ক্রমশ একাধারে “ব্যক্তি” ও “কালচরিত্রে” পরিণত হয়। উপন্যাসে তনয়ার পাশে দাঁড়ায় অ্যাগনেস, জেনিফার হোয়াইট, মনীষা—সবাই যেন এক ভিন্ন নামে একটাই আত্মা:

“They keep changing names. But the wound is the same.”

এই নারীচরিত্রেরা সবাই কোনো না কোনোভাবে হারিয়ে গেছেন—কখনও প্রেমে, কখনও শহরে, কখনও কেবলমাত্র "তাঁরা নারী বলেই"। তনয়া, এই বিস্মৃতদের প্রতিনিধিত্ব করেন—তাঁর কণ্ঠে যেন শোনা যায়:

“I’m not just a character. I’m the history you forgot to write.”

তনয়া যেন এক প্রেতাত্মার মতন, যিনি শোকের ভিতরও একটি শুদ্ধ আলোকধারা বয়ে নিয়ে যান। এক সময় মনে হয়—এই উপন্যাসে স্যান্ডির হারিয়ে যাওয়াটা শুধু একজন কিশোরের লুপ্ত হওয়া নয়, বরং তনয়ার হৃদয়ের ভাঙন, যা সমাজের স্মৃতিহীনতাকে প্রতিফলিত করে।

তনয়ার চরিত্রের এক রহস্যময় দ্যোতনা আছে—তিনি যখন কথা বলেন, তখন তা শুধু ভাষা নয়, একধরনের আত্মার কম্পন তৈরি করে। তাঁর অস্তিত্বেই ফুটে ওঠে সেই চিরন্তন নারীসত্তা, যাকে ইতিহাস গোপনে চাপা দেয়।

এবং তাই তনয়া কেবল চরিত্র নন—তিনি এক নৈশ অপেরার সুরেলা ট্র্যাজেডি, যিনি শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দর্শকও বটে, এবং সেই প্রাচীন ভগ্ন গানের রচয়িত্রীও।

৪. আখ্যান নির্মাণ ও ভাষার কারিগরি: এক অপেরা, বহু স্বর

এই উপন্যাস রোমাঞ্চের মোড়কে এক অনুপম শোকসংগীত। পাঠক শুরু করেন হয়তো একজন কিশোরের নিখোঁজ হওয়ার ক্লু খুঁজে, কিন্তু শেষ করেন এক হারানো সময়ের রক্তাক্ত স্মৃতিচারণায়। ‘নৈশ অপেরা’—এই নামটি নিজেই একটি মেটাফোর, একটি সন্ধ্যার উপসংহার যেখানে গানের মতো উঠে আসে মূক আর্তনাদ, আর শব্দের ভেতর নেমে আসে এক প্রেতায়িত বিষাদ।

শাক্যজিত আখ্যান নির্মাণে একাধারে আর্কিটেক্ট এবং সার্জন। গদ্যের কাঠামো যেন হাড়ের মতো শক্ত, কিন্তু তার উপরে ভাষার যে স্নায়ু-সঞ্চালনা—তা নিঃসন্দেহে সংগীতময়। স্মৃতি, দুঃখ আর না বলা অনুভব—এই তিনটি সুর এখানে বারবার ফিরে আসে, যেন বাখের ফিউগ বা রবীন্দ্রনাথের "স্মৃতি-সঙ্গীত"।

উপন্যাসে সময় রৈখিক নয়। এটি স্মৃতির সময়, দুঃস্বপ্নের সময়, যেখানে “আগে-পরে” বলে কিছু নেই—যেখানে একই মুহূর্তে একজন জীবিত, মৃত এবং স্মৃতির মধ্যে আটকে থাকে।

“স্মৃতি দিয়ে সময় গড়ে তোলা যায়। কিন্তু তার মধ্যে বাস করতে গেলে দরকার হয় এক ধরনের মৃত্যু।”

এই স্মৃতিনির্ভর কাঠামোতেই আসে তনয়ার বয়ান, অ্যাগনেসের চিঠি, স্যান্ডির মা জেনিফারের নিরুদ্দেশ অনুভব, এবং মাঝে মাঝে যে ভাষাহীনতা ঢুকে পড়ে—তা যেন কথার ভিতর এক ‘ভোকাল রেস্ট’। পাঠক হিসেবে আমরা যেন কোনো প্রাচীন, পোড়া নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে রিহার্সালের প্রেতশব্দ শুনি।

গদ্যের ভেতরে যে রকম হঠাৎ হঠাৎ ছন্দ আসে—সেই রূপক, সেই শব্দচয়ন, সেই হঠাৎ মৃদু বাক্য ভেঙে পড়া—তা কখনও ঋত্বিক ঘটকের বিভাজিত ভাষা, আবার কখনও রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অনুনয় মনে করিয়ে দেয়।

“সে যাত্রা ফিরে আসার ছিল না, তবু আমি দাঁড়িয়ে আছি ফিরে আসার চৌরাস্তায়।” — (তনয়ার একটি বর্ণনা)

একটি অপেরা যেমন একাধিক কণ্ঠে গাওয়া হয়—সোপ্রানো, টেনর, বারিটোন—এই উপন্যাসেও সেই বহুস্বরতার ছাপ স্পষ্ট। তনয়ার কণ্ঠে যেমন এক ধরণের আর্দ্রতা, অ্যাগনেসের কণ্ঠে আসে ঈশ্বরপতিত কষ্ট, আর জেনিফারের লেখায় রয়ে যায় আত্মগ্লানির গন্ধ। প্রত্যেক কণ্ঠস্বরে গদ্যের গায়ে পড়ে যায় একেকটি আবেগের ছায়া।

এই ন্যারেটিভ টেকনিক—দৃষ্টিকোণ বদলানো, সময় ভেঙে দেওয়া, চরিত্রকে পাঠকের চেয়ে কম জানানো বা বেশিই জানানো—এইসব মিলিয়ে তৈরি হয় এক ‘শ্রুতি-মূলক নাট্যপাঠ’। যেন উপন্যাসটি শুধুই পড়ার নয়—শোনারও।

শেষমেশ, শাক্যজিত ভাষার মধ্যে এমন এক সংগীত প্রতিষ্ঠা করেন যা শুধু অর্থ বহন করে না, আবেগ ধারণ করে, স্মৃতি ধরে রাখে এবং শোকের স্থায়িত্ব দেয়। এই উপন্যাস তাই এক ধরনের রেকিয়েম—মৃত আত্মাদের উদ্দেশ্যে রচিত এক আত্মসঙ্গীত।

৫. অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং প্রান্তিক জনজাতি: ইতিহাসের পাপ ও পাপস্মৃতি
শাক্যজিত ভট্টাচার্যের নৈশ অপেরা কেবল একটি কিশোরের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার গল্প নয়, এটি একটি গোটা জনগোষ্ঠীর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক নিঃশব্দ প্রক্রিয়া। উপন্যাসের গভীরে আছে একটি রাজনৈতিক ভূত, যা ইতিহাস বইয়ে জায়গা পায় না, কিন্তু সমাজের প্রান্তে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায়।

স্যান্ডি হোয়াইট একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কিশোর, কিন্তু তাঁর নিখোঁজ হওয়া যেন কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং একটি অবলুপ্ত জনগোষ্ঠীর নিঃশেষিত আর্তনাদ। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়, যাদের ইংরেজ ঔপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা জন্ম, কিন্তু পরবর্তী ভারতবর্ষের রাষ্ট্রব্যবস্থায় উপেক্ষিত আত্মপরিচয়—তাদের জীবন যেন এক অন্তঃস্মৃত গান, যেটা কেউ শুনতে চায় না।

“ওদের মতো লোকেরা ইতিহাসে থাকে না, ক্যালেন্ডারের ফাঁকে পড়ে থাকে।”—তনয়া

শুধু স্যান্ডি নয়—হারিয়ে যায় অবিনাশ যাদব, হেমব্রম, দোসাদ, অনেক নামহীন শ্রমিক, যারা ছিল মুসাবনির খনির অস্থিমজ্জা। এই নামগুলি উপন্যাসে কেবল চরিত্র নয়—তারা প্রতীক, তারা পাপস্মৃতি। তাদের শরীর থেকে উঠে আসে খনির ধুলোর গন্ধ, রক্তের দাগ, এবং সেই শব্দহীন মৃত্যু যেটা রাষ্ট্র কখনও নথিভুক্ত করে না।

এই নিখোঁজেরা রাষ্ট্রের কাছে “expendable bodies”—যেমন কলোনিয়াল মেশিনে ছিল তাদের পূর্বসূরিরা। খনি এখানে শুধু একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়—এটি একটি ঔপনিবেশিক খননস্থল, যেখানে মানুষ ব্যবহৃত হয়, ফেলে দেওয়া হয়, এবং ভুলে যাওয়া হয়।

“ওরা কারা? সরকারি ফাইলে যাদের নাম নেই, অথচ প্রতিদিন একটা জাতির জন্য মাটি কাটে?”

শাক্যজিত এই শোষণের বর্ণনা দেন শব্দের চেয়ে নীরবতা দিয়ে। পুলিশের অনুপাতিক নিস্ক্রিয়তা, প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত চোখ বন্ধ করে থাকা, এবং মিডিয়ার নির্লিপ্ততা—এসব মিলে তৈরি হয় ঐতিহাসিক উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি।

এই অংশে উপন্যাসটি শুধু সাহিত্যের নয়, একেবারে সামাজিক ন্যায়বিচারের ডকুমেন্ট হয়ে ওঠে। যেন আর্কাইভে সংরক্ষিত হয় না, এমন কণ্ঠগুলি এখানে পুনরায় উচ্চারিত হয়।

“আমরা কারো ইতিহাস হই না—এইটেই আমাদের ইতিহাস।” — (অবিনাশের স্ত্রীর সংলাপ)

সব মিলিয়ে নৈশ অপেরা-র এই স্তরটি পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নির্বাক ইতিহাসও একদিন কথা বলে, যদি কেউ শোনে।

এই প্রসঙ্গে তনয়ার ভূমিকা যেন এক জিজ্ঞাসু ইতিহাসবিদের, আবার এক আত্মার পুরোহিতের, যে ইতিহাসের প্রেততত্ত্বকে ছুঁয়ে দেখতে চায়।

৬. বিষাদ ও রহস্যের সহাবস্থান: ���হস্য নয়, অনুপস্থিতির সংলাপ

নৈশ অপেরা সেই বিরল উপন্যাস, যা পাঠককে রহস্যের জন্য টানলেও, শেষে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক ধ্বংসস্তূপের সামনে—যেখানে কোনও উত্তর নেই, শুধু নিরুত্তর শোক। এ কোনও “হুইডানইট” নয়, বরং এক “হোয়াইডানইট-হোয়াইটান্ট-হোয়াইলাস্টেড”—এক দীর্ঘ আত্মান্বেষণ, যেখানে রহস্য নিজেই নিজেকে বাতিল করে দেয়।

তুমি যদি আশা করো, কোনও স্মার্ট গোয়েন্দা এসে দাগ কেটে বলে দেবে—‘এই খুন করেছে’, তবে এই বই তোমার জন্য নয়। কারণ এই উপন্যাসে ‘খুন’ নিজেই একটি প্রহেলিকা নয়, বরং একটি প্রতীক—এক ক্ষতচিহ্ন, এক বেদনার রেখা।

তনয়ার চোখ দিয়ে আমরা দেখি—একটি সমাজ কীভাবে নিজেকেই ধ্বংস করে, একটি মানুষ কীভাবে নিজের ইতিহাস মুছে ফেলে, একটি প্রেম কীভাবে অপরাধে পরিণত হয়। এই সমস্ত ঘটনাগুলির মাঝে যে অনুপস্থিতি, সেটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় চরিত্র।

“কেউ হারিয়ে গেলে, শুধু মানুষ হারায় না—তার সঙ্গে একটা গল্পও হারিয়ে যায়।”

এই উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল এর বিষাদ-লিপি—এক ধরনের স্নিগ্ধ, নিঃশব্দ কান্না, যা পাঠকের মনে থেকে যায়। চরিত্রগুলি যেমন নিঃশব্দে জ্বলে—ঠিক যেন আরতির বাতি, তেমনি পাঠকের মনেও সেই আলো জ্বলে, নিভে যায়, কিন্তু ধোঁয়া থেকে যায়।

“জীবনে এমন কিছু প্রশ্ন থাকে, যেগুলো জানলে ক্ষতি—তবু জানতেই হয়, যেন বেঁচে থাকা এক ধরনের শাস্তি���”

শাক্যজিত এখানে এক ধরনের প্যাথেটিক ফিলোজফি নির্মাণ করেন—রহস্য এখানে তথ্য নয়, অনুভব। জেরা নয়, জার্নি।

তনয়ার অভিজ্ঞতা যেন পাঠকের নিজের স্মৃতির প্রতিফলন—আমরাও তো হারিয়েছি কাউকে, কোনও উত্তর ছাড়াই, কোনও কারণ ছাড়াই। নৈশ অপেরা সেই শোকের প্রতিরূপ—এক নিরুত্তর আলাপচারিতা, যেখানে প্রশ্নের চেয়ে চুপ করে থাকা বেশি বেদনার।

“সবচেয়ে বড় রহস্য সে নয়, যা কেউ লুকিয়ে রেখেছে। সবচেয়ে বড় রহস্য, যা আমরা মেনে নিই—যেন এটাই নিয়তি।”

শেষে যেন পাঠক শুধু একটি জিনিসই শিখে—বেঁচে থাকা মানে সব সময় উত্তর পাওয়া নয়, অনেক সময় কেবল শোকের সঙ্গে বসবাস করা।

৭. তুলনা ও অন্তঃপাঠ: শেষ মৃত পাখি-র প্রতিধ্বনি ও নৈশ অপেরা-র পার্থক্য

"Smell of the night, silence of the mines, ghosts of lost names—some stories don’t end, they echo."

যদি শেষ মৃত পাখি হয় একটি গভীর প্রেমপত্র—রক্তাক্ত, বিষাদময়, তবু প্রেমে নিমগ্ন—তাহলে নৈশ অপেরা সেই প্রেমপত্রের পুড়ে যাওয়া ছাই।
প্রথমটিতে আমরা ভালবাসতে চেয়েছিলাম। দ্বিতীয়টিতে, আমরা শোক করতেই এসেছি।

শেষ মৃত পাখি তে ডেরেক আর তনয়ার সম্পর্ক ছিল এক বিষাক্ত প্রেমের গল্প—ভালোবাসা, অবিশ্বাস, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সব মিলিয়ে এক জীবন-মৃত্যুর ছায়াযাত্রা। কিন্তু নৈশ অপেরা-তে ভালোবাসার অবশিষ্টও নেই। শুধু তার নিঃস্ব স্মৃতি।

তনয়া এখানে সেই আত্মা, যিনি প্রেমকে বহন করেন না, বরং সেই প্রেমের না-পাওয়াগুলোকে বহন করেন। এখানে কোনো ক্লাইম্যাক্টিক প্রেম নেই—এখানে শুধু এমন এক বেদনাবহ অনুরণন আছে, যা যেন শেষ মৃত পাখি-র প্রতিধ্বনি হলেও, তার পরিণত, গম্ভীর, প্রায়-ঈশ্বরীয় সংস্করণ।

“স্মৃতি যখন অতিরিক্ত হয়ে যায়, মানুষ তখন প্রেম করতে পারে না। শুধু কান্না হয়।” — নৈশ অপেরা

শাক্যজিত নিজেও জানেন, এই উপন্যাস আগের চেয়ে অনেক বেশি সাবলীল, পরিণত এবং নির্মম। এখানে তিনি নিরীক্ষা করেন আখ্যানের ভাষা, সময়ের গঠন এবং আত্মার আর্কিটেকচার।

পাঠক যখন নৈশ অপেরা পড়েন, তখন তার মনে পড়ে যায় অলৌকিক বাগান-এর জাদু, ডেরেক এখানে বসে আছে-র ব্যথা, কিন্তু তা যেন আরও বেশি স্টিলড, ফর্মালিনবন্দি, ভূতের জাদুঘরে রক্ষিত।
এখানে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সংলাপ যেন মৃত—কিন্তু তারা কথা বলে।

এই নির্মাণ কৌশল অনেকটা Borges-এর Labyrinths-এর মতো—যেখানে জানার ইচ্ছেই শাস্তি হয়ে ওঠে। আবার, Juan Rulfo-র Pedro Páramo আমাদের শেখায়, মৃতদের গল্প বলাও জীবিতের দায়িত্ব। নৈশ অপেরা যেন সেই ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব ‘ভৌতিক অপেরা’।

এটি পুনরাবৃত্তির ভেতরেও নতুনত্বের ছায়া। যেন এক চেনা গানের নতুন অন্তরা। শাক্যজিত যেন বলতে চান—

“পুরনো মৃত পাখিরা আজও গান গায়, তবে এবার তারা উড়ে না—তারা দেখে, শুনে, আর আমাদের দিকেই তাকিয়ে থাকে।”

এখন কি নিয়ে আসি ৮. উপসংহার: এক প্রেতকাব্যিক অর্ঘ্য, যেখানে সবকিছু গলে পড়ে একটা ধোঁয়াশার ফুলে?

৮. উপসংহার: শেষ নেই এই গানের, এই প্রেতের

“This is the song that has no end, the wound that sings even when silenced.”

নৈশ অপেরা পড়ে মনে হয়—এই উপন্যাস শেষ হয় না, বরং সে পাঠকের ভিতরে বাসা বাঁধে। তার সুর মনে হয় হেমন্তের রাতে ভেসে আসা এক অদ্ভুত গান, যেটা ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে শোনা যায়, কিন্তু ধরা যায় না।

এই উপন্যাস একমাত্র গল্প নয়, এটি এক অবস্থান্তর—জাগরণ আর ঘুমের মাঝে, ইতিহাস আর প্রেতকাহিনির মাঝে, প্রেম আর প্রস্থান-এর মাঝের সেই অনুচ্চারিত স্থান, যেখানে মানুষ আসলে বসবাস করে।

এই গল্পে প্রত্যেক চরিত্র এক একটি নিখোঁজ আত্মা। কেউ তনয়া—যিনি প্রশ্ন করেন কিন্তু উত্তর চান না। কেউ জেনিফার—যাঁকে সমাজ ক্ষমা করেনি, ইতিহাস ভুলে গেছে। কেউ সেই যাদবপাড়ার ছেলে—নামহীন, গন্তব্যহীন।

আর আমরা? আমরাও তো হারিয়ে গেছি, এই কাহিনির পাতায়, পাতার ফাঁকে, ছায়ার ভিতর।

এই উপন্যাস ক্লোজার দেয় না, বরং তার দরজা খুলে রেখে দেয়। যেন বলছে—

“যতক্ষণ মনে থাকবে, গল্পটা বেঁচে থাকবে। যতক্ষণ স্মৃতি আছে, মৃত্যু সম্পূর্ণ হয় না।”

এটি এক প্রেতকাব্যিক অর্ঘ্য—ভবিষ্যতের কোনো অন্ধকার কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে কেউ যেন এই অর্ঘ্য পাঠ করছে, আমাদের জন্য, আমাদের স্মৃতির জন্য।

এই উপন্যাস পাঠককে দুঃখ দেয়, কিন্তু সেই দুঃখ পাঠক ফেরত দিতে পারে না। তাকে বয়ে বেড়াতে হয়, ঠিক সেইভাবে, যেভাবে তনয়া বয়ে বেড়ান তাঁর অন্তঃস্মৃতি।

“এই গল্পটা জানলে শান্তি আসে না, কিন্তু না জানলে রাত ঘুম হয় না।”

এই একটি বাক্যে যেন গাঁথা আছে পুরো নৈশ অপেরা-র আত্মা।

শেষ কথা? এটি একটি উপন্যাস নয়, একটি নৈশ কণ্ঠস্বর—প্রতিটি পাঠকের নিজের ভেতরের।

আর সেই কণ্ঠস্বর—স্রেফ রাতেই শোনা যায়।

অলমতি বিস্তরেণ।
Profile Image for Journal  Of A Bookworm .
134 reviews9 followers
July 28, 2025
#পাঠ_প্রতিক্রিয়া- ২৯/২০২৫

নৈশ অপেরা
লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
প্রকাশনী : সুপ্রকাশ
মূল্য : ৫৪০ টাকা।।

বছরের ২৯ নম্বর উপন্যাস, সুলেখক শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য এর লেখা তনয়া সিরিজ এর দ্বিতীয় বই, প্রথম বই ২০২২ সালের আমার পড়া সেরা রহস্য উপন্যাস ছিল "শেষ মৃত পাখি"।। তারপর এর মধ্যেকার সময়ে লেখকের একটি বই পড়েছি, ২০২৫ সালে নৈশ অপেরা এর প্রকাশের খবর পেয়েই বইটি বুক করি, হাতে পাওয়া মাত্র পড়া শুরু করেছি।। বইটির প্রচ্ছদ, পাতার মান খুব ভালো, বইটি পড়তে পড়তে বুঝেছি এই বই ঝড়ের গতিতে পড়ে ফেলার উপন্যাস নয়, সময় নিয়ে রসস্বাদন করার বই।।

একটা ভেঙে পড়া টাউন।। জঙ্গলের ভেতর চার্চ।। কিছু ভাঙাচোরা মানুষ।। রহস্যময় এক জলাভূমি।। বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক শিশু সেখানে মাঝে মাঝে দেখা দেয়।। অলৌকিক আখ্যান হতে পারে, হতে পারে রহস্যকাহিনি, অথবা কিছুই নয়।। হয়ত শুধুই বেদনার।।
তনয়া কি পারবে এই আখ্যানের ভেতর লুকিয়ে থাকা সত্যিটা খুঁজে বার করতে?

ঝাড়খণ্ডের একটি ছোট্ট টাউন নাম গঞ্জ, এক বিত্তশালী আংলো পরিবারের এক ছোট্ট শিশু হঠাৎ করেই হারিয়ে যায়।। ঘটনাটি ঘটার প্রায় ৩০ বছর পর ২০২২ সালে সেই শহরে আসেন তনয়া ভট্টাচার্য্য।। আস্তে আস্তে পরিচিত হতে ��াকেন এই মৃত শহরের কিছু মানুষ এর সঙ্গে।।পাঠক হিসেবেও আমরা পরিচিত হতে থাকি বারবারা ব্রাউন, এডওয়ার্ড, মনীষা, অ্যারন, জেনিফার, অবিনাশ যাদব, কিটি গোমস এর মত চরিত্রদের সাথে।। পেঁয়াজের খোসার মতো আমাদের সামনে পরতে পরতে উন্মোচিত হতে থাকে এক ভৌতিক রহস্য কাহিনী।। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই ৩০ বছরের পুরনো অমীমাংসিত রহস্যের সাথে জড়িয়ে পড়েন তনয়া।। জানতে পারা যায় হারিয়ে যাওয়া এই শহরে নতুন কিছু নয়।। এই শহরে আগেও কিছু মানুষ হারিয়ে গেছে, কিন্তু আগেই বলেছিলাম এই শহর ভৌতিক।। তাই হারিয়ে যাওয়ার পরেও ছোট্ট ক্রিসকে ৩০ বছর ধরে এক রহস্যময় জলাভূমির ওপর ঘুরতে দেখেন তার পিসি বারবারা।। আরো একটি মেয়ে যে হারিয়ে গেছিল সেই অ্যাগনেসকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে দেখতে পায় বিভিন্ন মানুষ।। লেখকের লেখনীতে তৈরি হয় অদ্ভুত কিছু দৃশ্য কল্প।। একটি মেয়ে যাকে তনয়া জিপসিদের রাজকন্যা বলতো সে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাদা রঙের একটি জামা আর মাথায় একটি মুকুট পড়েঘুরে বেড়াত, রেভারেন্ড গরম্যান কে আমরা প্রথম দৃশ্য দেখতে পাই একটি জঙ্গলের মধ্যে খালি গায়ে একটি ফোনের রিসিভারকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন।। একটি মৃত শহর, ভেঙে পড়া সাহেবী আমলের বাংলো, জঙ্গলের মধ্যে এক ভাঙ্গা রহস্যময় চার্চ এবং হারিয়ে যাওয়া কিছু মানুষ, এই নিয়ে প্রথম পর্বে লেখক সময় নিয়ে বুনেছেন রহস্যের জাল, সেখানে রহস্যের সাথে সাথে রেখেছেন ভৌতিক কিছু উপাদান।। গল্পের প্রথম ভাগ যেখানে শেষ হচ্ছে অর্থাৎ রহস্য এবং প্লট যেখানে ফাইনালি গঠন করে ফেলেছেন লেখক, সেই জায়গায় এসে রয়েছে গল্পের এমন এক টুইস্ট যা সত্যিই আনএক্সপেক্টেড।।

এরপর শুরু হয় গল্পের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ যেখানে রহস্য উন্মোচনের পালা।। বিশেষ এক কারনে তনয়াকে এই রহস্য অমীমাংসিত রেখেই সেই সময়ে মানে ২০২২ সালে গঞ্জ থেকে ফিরে আসতে হয়।। কিন্তু তিন বছর পর তনয়াকে আবার ফিরতে হয় এই গঞ্জে একটি বিশেষ ঘটনার জন্য।। দ্বিতীয় ভাগে সেই ফিরে আসা এবং রহস্য উদঘাটন।। পাঠক হিসেবে এরকম বহুস্তরীয় মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস বাংলায় আমি অন্তত আগে পড়িনি।।অপরাধ একটা ছিল না, ছিল বেশ কয়েকটা অপরাধ যা ঘটেছিল বেশ কিছু বছর ধরে।। যেটা তনয়ার আগে অবিনাশ যাদব ধরতে পারেননি তা হল এই অপরাধগুলোর মধ্যে কিছু কানেকশন ছিল।। তনয়ার মাধ্যমে রহস্যের আংশিক উন্মোচন সম্ভব হয় এবং বাকিটা পাঠক হিসেবে আমরা জানতে পারলেও তা তনয়ার কাছে অজানাই থেকে যায়।।

পাঠ প্রতিক্রিয়া -

আমি কোনরকম তুলনা তে যাবো না, কোন বইটি ভালো বেশি ভালো লেগেছে।। শেষ মৃত পাখি পারফেক্ট ক্রাইম নিয়ে আমার পড়া সেরা একটি উপন্যাস, নৈশ অপেরা অনেক বেশি সিনেমাটিক এখানকার প্রত্যেকটি দৃশ্য লেখক এত সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন, মনে হচ্ছিল পাঠক হিসেবে আমি জোহার হালে তে দাঁড়িয়ে আছি অথবা তনয়ার সাথে জঙ্গলে রাস্তা হারিয়েছি, অথবা জলাভূমি ওপর প্রান্তে এম্বাসেডর গাড়িটি আমিও দেখতে পারছি।। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন প্রতিটি দিককে অথচ একটা সূক্ষ্ম শিহরণ ঢেলে দিয়েছেন কাহিনীতে, আর এটাই আমার মনে হয়েছে শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য্য এর ইউএসপি।। পুরো দিকটাই তিনি এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন পাঠক প্রতিটি চরিত্রের মানসিক টানাপোড়েনের সঙ্গী হতে পারে শেষ অব্দি।। চরিত্রগুলোর সাথে খুব সহজে মিশে যাওয়ার যে প্রবণতা সেটা হয়ত লেখকের গল্প বুননের সার্থকতা।। লেখক গল্পের প্রথম পর্বে জটিলতা, গঞ্জের পরিবেশ এবং জীবিত ও ভৌতিক চরিত্রগুলো পাঠক এর সামনে এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যাতে পাঠক প্রথম থেকেই একটা মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে বিভ্রান্ত হোন, উপসংহারে পৌঁছে তনয়া, বারবারা অথবা অ্যারন এর মত পাঠকদের ও মনে হবে এই রহস্যের উন্মোচন হওয়া কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল।। যদিও সব রহস্যের কোনো যথার্থ কারণ থাকতে নেই, কিছু রহস্য হয়ত না খুঁজলেও চলে।।
Profile Image for Borhan Hosan.
8 reviews
August 15, 2025
আবারো, আবারো এবং আবারো একটা কিছু ঘটবে৷ নৈঃশব্দ দুপুরে ক্ষুধার্ত ভিখারি দুয়ারে দাড়িয়ে অন্নের আবদার করবে৷ কিন্তু আমি? তাকে পাওয়ার আবদার আমি কার কাছে করবো? কার কাছে? কীসের জন্য এত শোকার্ত লাগছে৷ আদৌও দুঃখবোধে অংশ নিচ্ছি কী না সেটাও প্রশ্ন বটে৷ জলাভূমির পাশে বসে আকাশ দেখা ছাড়া কী ই বা করা যেতে পারে৷

আমি কার কথা বলবো৷ কীভাবে বলবো৷ ঠিক কার জন্য হাহাকার লাগছে আমার? প্রচন্ড বৃষ্টির ভিতরও ঝাপসা গরমের অনুভূতি৷ গলার কাছে আটকে যাওয়া কথাটা বুকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে৷

ঠিক কত বছর অপেক্ষা করে মানুষ? পাঁচ, দশ, পনেরো, ত্রিশ না কি তারও বেশি?

সন্তানের জন্য অপেক্ষা হোক কিংবা প্রেমিকার জন্য৷ কতটুকু অপেক্ষা করা যায়?

রহস্যে মোড়ানো গঞ্জ, স্যাংচুয়ারি৷ ক্রিসের অন্তর্ধান, অ্যাগনেসের হারিয়ে যাওয়া। আবারো, আবারো এবং আবারো,

অপেক্ষা! শোধ! না কি অলৌকিক কিছু?
19 reviews1 follower
September 3, 2025
শেষ মৃত পাখি পরে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তাই এই বই টার বেপারে শুনার পর থেকে খুবি এক্সাইটেড ছিলাম । প্রথমেই বলে দি এই বই টা কিন্তু একটু ডিফিকাল্ট বই । Japanese রহস্য গল্পের মতো লেয়ারেড স্টোরি, অনেক গুলো দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা, অনেক বিব্লিক্যাল শব্দ আর অনেক কষ্ট । সাক্যজিৎ এর লেখা ফাটাফাটি 👌, কিন্তু আমার মাঝে একটু মনে হয়ছিল যে গপ্পটা কে টানা হচ্ছে, অতিরিক্ত স্লো বার্নার। কিন্তু প্রথম অধ্যায় শেষে আর পুরো দ্বিতীয় অধ্যায় টা দুর্দান্ত লেখা । বই টা অনেক মিক্সড রিভিউজ পেয়েছে কিন্তু আমার পড়তে ভালোই লেগেছে বিশেষ করে last ১০০ pages ।
(৩.৮ কারণ আমি শেষ মৃত পাখির সাথে তুলনা করছি
Profile Image for Read with Banashree .
55 reviews4 followers
September 24, 2025
শেষ মৃত পাখির 'পরে লেখকের তনয়াকে নিয়ে দ্বিতীয় উপন্যাস এটি,প্রথমে যেটা বলতে হচ্ছে তাহলে লেখকের চরিত্র নির্মাণ, উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র এত ভালোভাবে গঠন করা হয়েছে যে সত্যি কথা বলতে প্রত্যেকটি চরিত্র যেন উপন্যাসের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। তার সাথে লেখকের সৃষ্ট কিছু অলৌকিক রহস্য সেগুলোও সত্যি কথা বলতে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়, এক কথায় অসাধারণ একটি উপন্যাস,
তবে একটা কথা বলব একটু ধৈর্য নিয়ে পড়বেন কারণ আমার মাঝেমধ্যে পড়তে পড়তে বিশেষ করে প্রথম পর্বে, কে কথক সেটা বুঝতে সময়ে একটু সময় লেগেছিল,
2 reviews
August 31, 2025
বাস্তব পরাবাস্তবের আলো আঁধারিতে ঘেরা এক অনবদ্য মানবিক আখ্যান। গতিময় ঘটনাবহুল রহস্য কাহিনীর ধারণার বাইরে গিয়েও যে পাঠক মনকে আবিষ্ট রাখা যায় তার প্রমাণ এই উপন্যাস। চরিত্রদের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, বেদনা, মায়া, প্রতিশোধস্পৃহার সাথে কখন যে পাঠক একাত্ম হয়ে যায় বোঝাই যায় না। শুধু কাহিনীর শেষে একখণ্ড জোহার হালে পাঠকের মননে মিশে যায়।
Profile Image for S.SARKAR.
2 reviews
October 27, 2025
একটা মেয়ের হারিয��ে যাওয়ার পাপ বোধহয় পুরো টাউনকে খেয়ে ফেললো। অবসাদ আর বেদনাময় অন্য ধরনের রহস্য গল্পঃ। আগনেসের জন্য কষ্ট হচ্ছে। আমার পরম আত্মীয়র মতো। কিছুটা অতিকথন আছে ঠিকই। কিন্তু বিষাদের ছবি তুলতে একটু প্রয়োজন ছিল। আমার মতে অবশ্য পাঠ্য। ৫ তারা।
70 reviews2 followers
August 19, 2025
লেখনি এতো সুন্দর। শেষ অধ্যায়টা চমৎকার।

বুঝলাম না বইটা কেন সবার এতো ভালো লাগে নি এবং সবার কেন শেষ মৃত পাখি ভালো লাগে।
Displaying 1 - 21 of 21 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.