যিনি লিখেছেন বাঙালীর নৃতাত্তিক পরিচয়, দেবলোকের যৌন জীবন সম্পর্কে যিনি করেছেন সনিষ্ঠ গবেষণা, সেই অতুল সুরের পক্ষেই বুঝি সম্ভব ছিল এমন একটি তথ্যে ভরপুর, সজীব, সরস ইতিহাস রচনা।ভারতে বিবাহ প্রথা শুধু, যে প্রাচীন তাই নয়, একই সঙ্গে বহু, বৈচিত্র্যে ভরা। অতি প্রাচীনকাল থেকে নানা জাতির লোক ভারতের জনস্রোতে মিশেছে। ভারতীয় কৃষ্টিতে আজ নানা জাতির ছাপ। বিভিন্ন সেই নরগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ প্রথা ও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। এই সমুদয় প্রথা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য এই গ্রন্থে। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, বৌদ্ধযুগ, কৌটিলীয় যুগ ইত্যাদি গ্রন্থ, ধর্মশাস্ত্র ও সময়কাল সমূহ মন্থন করে তিনি রচনা করেছেন ভারতের বিবাহ প্রথা তথা যৌন জীবনের এই আনুপূর্বিক অমূল্য ইতিহাস। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ব্রাহ্ম, আদিবাসী- কোনও সম্প্রদায়ই বাদ পড়েনি তাঁর আলোচনায়।সমাদৃত এই গ্রন্থের নতুন আনন্দ সংস্করণে বহু নতুন পরিচ্ছেদ। বহু, নতন তথ্যের সংযোজন।
ডক্টর অতুল সুর প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাস বিদ ও সমাজ-বিজ্ঞানী বিদ্বৎ সমাজে ‘দুধর্ষ’ পণ্ডিত রূপে আখ্যাত। বয়স ৯২ বৎসর। রচিত গ্রন্থ সংখ্যা ১৫৪।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ও অধ্যাপক। ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ব’ বিষয়ে এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে সুবর্ণ পদক ও পুরস্কার পেয়েছিলেন। অর্থনীতিতে সপ্রশংশ ডি.এস.সি উপাধি পেয়েছেন। দশ বৎসর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা করেছেন।লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্রপুরস্কার’ পেয়েছেন। মধুসূদন ও রামমোহন পুরস্কার পেয়েছেন। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন থেকে সুশীলা দেবী বিড়লা পুরস্কার পেয়েছেন।
সুবিশাল ও জটিল একটি বিষয় নিয়ে লেখা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এই বইয়ে যা-যা আলোচিত হয়েছে, তার তালিকাটা আগে তুলে দিই~ ১. যৌনজীবনের পটভূমিকা ২. প্রাচীন ভারতের বিবাহ ৩. বেদোত্তর যুগের বিবাহ ৪. বৌদ্ধসাহিত্যে বিবাহ ৫. কৌটিলীয় যুগের যৌনজীবন ৬. যৌনাচারের উপর স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব ৭. জ্ঞাতিত্ব ও স্বজন বিবাহ ৮. হিন্দুসমাজে বিবাহ ৯. ব্রাহ্ম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সমাজের বিবাহ ১০. আদিবাসীর সমাজ সংগঠন ও বিবাহ ১১. বিবাহের আচার অনুষ্ঠান ১২. বিবাহ-পূর্ব যৌন সংসর্গ ১৩. বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সংসর্গ ১৪. হিন্দুসমাজে গণিকার স্থান ১৫. মুসলিম সমাজের বিবাহ ১৬. বিবাহের উপর গণতান্ত্রিক প্রভাব এই নাতিদীর্ঘ বইটি পড়তে গিয়ে বারবার চমকে উঠেছি বিন্দুতে সিন্ধু ধারণের উদ্দেশ্যে লেখকের প্রয়াস দেখে। বিবাহ একটি সুবিশাল ও জটিল বিষয়। তার এত দিক, তাও এত দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে আলোচনা করতে প্রচুর জায়গা লাগে। এত সীমিত পরিসরে সেই আলোচনা, তাও একেবারে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, প্রায় অসম্ভব। লেখক তা সম্ভব করেছেন নিজের প্রজ্ঞা দিয়ে। কিন্তু এতে দুটো সমস্যা আছে~ ১) অত্যধিক সংক্ষিপ্ত আকারের ফলে বহু তথ্য ও কাহিনি তিনি দিতে পারেননি। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব বা নৃতত্ত্বের অনুরাগী পাঠকের কাছে এই আলোচনা "অন্তরে অতৃপ্তি রবে" অনুভূতিই বহন করবে। ২) রচনার পর প্রায় পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময় প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে বহু নতুন তথ্য আমাদের সামনে এসেছে। তার ফলে এই বইয়ে বেশ জোর গলায় বলা নানা কথা এখন বিশ্বাস করা কঠিন। তবু বলব, এই জটিল ও কণ্টকিত বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করতে হলে প্রাইমার হিসেবে এ-বই অতুলনীয়।
আরেকটু গোছানোভাবে লেখা হলে ভালো হতো। অনেক চ্যাপ্টারেই একই কথার/বিষয়ের পুনুরাবৃত্তি আছে।
তবে ইন্টারেস্টিং তথ্যাদিসম্পূর্ণ বই। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় এক-দুই হাজার বছরের চিন্তাভাবনা ও রীতিনীতির অদ্ভুত সুবিধামাফিক রূপরেখা জানা গেল। এ অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিত মানুষের মাঝেও এখনো এত রকমের দ্বিমুখীনীতিপ্রীতি কেন বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে সেটার একটা বিশেষ কারণ এই বই পড়ে মনে হলো হাজার বছরের পাশপাশি অবস্থানকারী বিভিন্ন সংস্কারের অভ্যাস।
এই বই যেহেতু প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত, বর্তমান তথ্যাদির রূপরেখা কী তা জানার আগ্রহ তৈরি হলো।
এটা আমার পড়া অতুল সুরের দ্বিতীয় বই। লেখকের একটা মুদ্রাদোষ হচ্ছে একই কথা বারংবার বলা। যে কথা একবার বললেই হয়, সেখানে তিনি সেকথা কমপক্ষে দশবার করে দশ অধ্যায়ে লিখেছেন। অন্যথায় বইটা অনেক তথ্যবহুল। ভালোই লেগেছে৷ ভারতবর্ষের ইতিহাস জানার জন্য স্টার্টার হিসেবে ভালোই।