কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, হাড়ের বাঁশি আর ভয়ের গদ্যমালা।
অর্ক চক্রবর্ত্তী-র লেখায় ভয় ধরা দিয়েছে কাব্যিক সৌন্দর্য নিয়ে। বুকের রক্ত কেঁপে ওঠা ভয় নয় বরং ওঁর লেখা জুড়ে আতঙ্ক, বীভৎসতা, ভয় ধরা দিয়েছে স্নিগ্ধ শীতল বাতাসের মত যাতে অনায়াসেই ভেসে যাবেন পাঠক। লেখার মাধুর্য এমনই যাতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার পরেও এর রেশ থেকে যায় বহুদিন। সাধারণত ভয়ের বই একবার পড়ার জন্যই উপযুক্ত হয়। খুব কম ভয়ের বইই পাঠক বারবার পড়েন। ‘কৃষ্ণশর্বরী’ তেমনই বারবার পড়ার উপযুক্ত বিরল গোত্রের এক ভয়ের বই। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই বই পাঠ করার পর এর রেশ থেকে বেরোতে পাঠকের বহুদিন সময় লাগবে।
অন্ধ করে দেওয়া রাতের চেয়েও গাঢ় এক অন্ধকার লুকিয়ে থাকে মানুষের মনে। সেই অন্ধকার দিয়ে গড়া পাঁচটি বড়ো গল্প— জঁরের বিচারে যাদের ডার্ক ফ্যান্টাসি বলাই সঙ্গত— সংকলিত হয়েছে এই সুদৃশ্য, সুমুদ্রিত বইটিতে৷ তারা হল~ ১. কেউ জানবে না; ২. জোনাকি; ৩. ছাপ; ৪. শূন্য থেকে শুরু; ৫. খোলস। অতিলৌকিকতা ও মনস্তত্ত্বের অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটেছে এই গল্পগুলোতে। পটভূমি বদলেছে প্রতি ক্ষেত্রে। কিন্তু কিংবদন্তি, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, সর্বোপরি মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম প্রয়োগ এদের প্রত্যেককে একটা আলাদা স্তরে নিয়ে গেছে। রহস্য ও রোমাঞ্চ, মানুষী বীভৎসতার পাশাপাশি মানুষেরই করুণা ও সাহস— সবকিছু অনন্য চেহারায় ধরা দিয়েছে চরিত্রদের আচরণে ও অবস্থানে। লেখাগুলো পড়তে-পড়তে বারবার মনে হয়েছে, লেখক তাঁর পাঠকের মেধাকে পূর্ণ সম্মান জানিয়েই সৃষ্টি করেছেন এই আখ্যানদের। প্রগাঢ় পাঠের পাশাপাশি নিবিড় চলচ্চিত্র-ভাবনাও ঝলসে উঠেছে এদের আকার ও প্রকারে। ডার্ক ফ্যান্টাসিই বলুন, বা সোজা ভাষায় 'অন্ধকারের আখ্যান'-ই বলুন, এই ধারায় সম্প্রতি যত কাজ হয়েছে, তাদের মধ্যে অতি বিশিষ্ট একটি অবস্থানে থাকবে আলোচ্য বইটি। যদি আপনি এই ধারার কদরদান হন, তাহলে এটিকে কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না। লেখককে অভিনন্দন জানাই। তাঁর পরবর্তী প্রয়াসটিও সফল ও সার্থক হবে, এমন আশা রাখি। সেই বইয়ে কিছু ভারতীয় মিথের প্রয়োগ দেখতে পাওয়ার আশায় রইলাম। অলমিতি।
কৃষ্ণশর্বরী বইটি কেনার ইচ্ছে ছিল বইমেলার সময় থেকে। ভৌতিক, গথিক, gaslight era সময়কার গল্প-সংগ্রহ এই বইটি। সম্প্রতি কলোনিয়াল বা gaslight era সমকালের রহস্য, ভৌতিক গল্প পড়ার ইচ্ছে বাড়ছে।
এই বইয়ের কথায় আসি। বইতে রয়েছে ৫টি গল্প। প্রথম গল্পটি বাংলার জমিদার সময়কালের গল্প। গ্রাম বাংলার অন্ধ বিশ্বাস, জমিদারি অত্যাচার আর তার মাঝে অতিপ্রাকৃতিক গল্পটি মোটামুটি ভালো লেগেছে।
জোনাকি গল্পটি সম্ভবত এই বইটির সেরা গল্প। একটা গা শিরশিরে ভাব আছে।
ছাপ আর খোলস গল্পটি অপরাধজনিত কালো গল্প, যার পিছনে রয়েছে অভিশপ্ত অলৌকিক কাহিনী।
শুন্য থেকে শুরু আমার কাছে সবচেয়ে দুর্বল গল্প। এই গল্পে কুখ্যাত কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প , উইচ ট্রায়াল , কলোনিয়াল horror সব মিলিয়ে মিশিয়ে সত্যি বলতে খিচুড়ি হয়ে গেছে। গল্পের কি কোথায় কেন কিভাবে হচ্ছে, খেই ধরতে পারলাম না। প্রচন্ড বোরিং লাগছিলো।
সবমিলিয়ে যে ভয়াল রস, কিছুটা লাভক্রেফট করার চেষ্টা (প্রায় কমবেশি সব গল্পেই reptiles এর সংযোজন রয়েছ, অনেকটা Cthulhu র মতো অজানা প্রাণী আবির্ভাব ঘটিয়ে মানবমনের অচেনাকে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা কাজে লাগানো), জোর করে ভয় দেখানোর চেষ্টা, ডার্ক ফ্যান্টাসি হিসেবে ধরে নিলেও গল্পগুলো পড়ে সেই মজা পেলাম না, যতটা বইটি নিয়ে hyped সৃষ্টি হয়েছে। এক একেকটা গল্পের মধ্যে পৌরাণিক রেফারেন্স, বিশেষ করে যদি সেগুলো অন্য কালচার এর হয়, তুলনায় এত বেশি যে সেগুলো গল্পের মূল আকর্ষণ আর পড়ার গতি শ্লথ করে দেয়। মানছি খুব পড়াশোনা, গবেষণা করে রেফারেন্স নিয়ে গল্পগুলো লেখা, কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি ফিকশন পড়তে গেলে এত যদি এত নোটস নিতে হয়, তাহলে সরাসরি পৌরাণিক গল্প পড়বো। আমার মনে হয় অত্যধিক রেফারেন্স, গবেষণা গল্পগুলোর সাহিত্যরস আর ত্রাস সৃষ্টি করার ব্যাপারটা সম্পর্কে উদাসীন থেকে গেছে। ভালো প্রচেষ্টা, ভবিষ্যতে আরো ভালো গল্পের আশা রাখলাম।
"কৃষ্ণশর্বরী" নিছকই একটি হরর গল্পের সংকলন নয়। এটি এমন এক সাহিত্যিক অভিযান, যেখানে ভয় কেবল বাহ্যিক নয়—তা হয়ে ওঠে চেতনার গভীরে নেমে যাওয়ার মাধ্যম। অর্ক চক্রবর্তীর লেখনী পাঠককে শুধু আতঙ্কিত করে না, বরং সে আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে মানুষের মনোজগৎ, বিশ্বাস ও অজানার প্রতি আকর্ষণকে ছুঁয়ে যায়।
অর্কের ভাবনার বৈচিত্র্য পাঠককে চমকে দেয়। প্রতিটি গল্পেই তিনি একাধিক মাত্রায় কাজ করেন—কখনও পৌরাণিক ছায়ায়, কখনও মনস্তাত্ত্বিক সংকটে, কখনও আবার নরম বাস্তবতার গায়ে হেলান দিয়ে গড়ে তোলেন অলৌকিক এক দুনিয়া। তাঁর গল্পে 'ভয়' একমাত্র বিষয় নয়, বরং একটি পোর্টাল—যার ভিতর দিয়ে ঢুকলে পাঠককে নিজেরই গহন মানসিক গলি-ঘুঁপচিতে ঘুরে বেড়াতে হয়।
লেখকের ভাষা স্বচ্ছ, কিন্তু তাতে অলৌকিকতার এক আবেশ মিশে থাকে। যে কোনো প্যারা পড়ার পরেই একটা হিমশীতল অনুভব মনের কোণে জমে ওঠে। তাঁর লেখায় রয়েছে বাঙালিয়ানার গভীর মাটি, আবার সেই মাটির ভিতর দিয়েই উঠে আসে এক আন্তর্জাতিক মানের ন্যারেটিভ সেন্স।
"কৃষ্ণশর্বরী"-তে অর্ক চক্রবর্তীর গল্প বাছাই ও নির্মাণশৈলী প্রমাণ করে, তিনি কেবল হরর লেখেন না—তিনি একে নির্মাণ করেন, চিত্রিত করেন, এবং ধীরে ধীরে পাঠককে তার ভেতরে আটকে ফেলেন।
এই বইটি শুধু হররপ্রেমীদের জন্য নয়, যারা সাহিত্যে নতুন স্বাদ খোঁজেন, যাঁরা ভয় আর দর্শনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা গল্প ভালোবাসেন—তাঁদের সকলেরই এটি পাঠযোগ্য।