কথাসাহিত্যিক এবং চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামান লেখালেখি করছেন তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষনাসহ নানা ধারায় লিখেছেন তিনি। তার কাজ এবং ভাবনা বিষয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তেমনি কিছু নির্বাচিত বক্তৃতার সংকলন এই বইটি। সমকালীন সাহিত্যের এই বিশিষ্ট লেখকের বক্তৃতায় সাহিত্য, সমাজ এবং জীবন-জিজ্ঞাসার নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
Shahaduz Zaman (Bangla: শাহাদুজ্জামান) is a Medical Anthropologist, currently working with Newcastle University, UK. He writes short stories, novels, and non-fiction. He has published 25 books, and his debut collection ‘Koyekti Bihbol Galpa’ won the Mowla Brothers Literary Award in 1996. He also won Bangla Academy Literary Award in 2016.
কিছু লেখকের প্রজ্ঞা তাদের লেখা পড়তে শুরু করা মাত্র ধরা যায়। কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে, দেশি বিদেশি মনীষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে, নিজেদের বিস্তর জানাশোনার প্রমাণ দিয়ে তারা তাক লাগিয়ে দিতে পারেন। শাহাদুজ্জামান এই শ্রেণিতে পড়েন না। তিনি নিছক গল্প বলার ছলে এগিয়ে যান, কোনোভাবেই নিজের কর্তৃত্ব জাহির করেন না। ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তিনি তার কথার গভীরে নিয়ে যান আমাদের। শাহাদুজ্জামান এমনভাবে একটা বিষয় উপস্থাপন করেন যাতে নিতান্ত গোবেচারা ধরনের পাঠকও তা বুঝতে পারে। এটা একটা দুর্লভ গুণ। এ বইটা যেহেতু বক্তৃতা সংকলন, তাই এখানে লেখক আরো বেশি সরল।সাহিত্য, দীপেশ চক্রবর্তী, একবিংশ শতাব্দীতে জীবনের লক্ষ্য, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির - সব বিষয়েই শাহাদুজ্জামান সহজ এবং সারগর্ভ। বারবার পড়লেও এই লেখাগুলোর আবেদন কমবে না।
একটা ভয়াবহ ভুল ধারণা আমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। বক্তৃতা মানেই আমাদের কাছে কাঠখোট্টা রসকষহীন নিরাবেগ একটা আলোচনা। বক্তা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লান্তিকর সব কথাবার্তা বলেন। আমরা সুদৃশ্য ফোল্ডিং চেয়ারে বসে বসে হাই তুলি। মাঝেমাঝে হাত তালি দিই। বক্তা আর দর্শকসারিতে বসা শ্রোতার মাঝে যে একটা যোগাযোগ হতে পারে, সেটা আমরা খুব বেশি ঘটতে দেখি না। অথচ ইউটিউবে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেড টক দেখতে পারে। চন্দ্রিল ভট্টাচার্য আজ তারাশঙ্কর, কাল বিভূতি,পরশু মতি নন্দীর সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ সব আলোচনা করে যান কলকাতা ক্রিয়েটিভ সোসাইটির প্রোগ্রামগুলোতে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। বক্তৃতার মধ্যে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ানদের ক্রাউড ওয়ার্কের মতো যোগাযোগপ্রবণ হতেই হবে এমন কথা নেই। তবে বক্তৃতার উপস্থাপনভঙ্গির মধ্যেই থাকতে পারে একটা ম্যাজিক ম্যাগনেটিজম। শাহাদুজ্জামানের ‘এ জীবন লইয়া কী করিব ও অন্যান্য বক্তৃতা’ বইটার ৭ টা বক্তৃতার অধিকাংশই এই ম্যাগনেটিজমের জোরে মনোযোগ ধরে রাখে। তবে এক্ষেত্রেও যে এক্স ফ্যাক্টরটা দরকার ছিল সেটা— টার্গেট লিসেনার বা এইক্ষেত্রে রিডার।
ভার্সেটাইল সব বিষয়ে বইয়ে অনুলিখিত সাতটা বক্তৃতাকে আমরা মোটামুটি তিনটা ব্রড হেডিংয়ে ভাগ করতে পারি।
১. লেখালিখি নিয়ে নিজের জার্নি আর বর্তমান সময়ের সাহিত্যের প্রবণতা
২. সমাজ ভাবনা
৩. শিল্প ভাবনা
লেখালিখি নিয়ে নিজের সফরের বিষয়ে দুটো বক্তৃতা আছে।‘এ জীবন লইয়া কী করিব’ আর ‘বিশ্বায়নের কালে লেখালিখি’ এই দুই শিরোনামে গড়ে ২৩ পৃষ্ঠায় শাহাদুজ্জামান যেন খুঁজে চলেছেন নিজেরই প্রশ্নের উত্তর। মেডিকেল লাইফ ছেড়ে ফিল্ম অ্যাপ্রিশিয়েশন সোসাইটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-শহীদুল জহির আর তারেক মাসুদের সান্নিধ্য,ক্রিয়েটিভিটির পুঁজি, অ্যাটেনশন আর বাহবার লোভ,আইডিওলজিক্যাল পজিশনের সীমাবদ্ধতা, লেখালিখির ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গীর গুরুত্ব—এমন ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের ভিড়ে লেখকের আত্ম-জিজ্ঞাসাই যেন হয়ে উঠেছে ‘এ জীবন লইয়া কী করিব’ এর কণ্ঠস্বর। আর এই লেখালিখির পথের বিভিন্ন বাঁকে বিশ্বায়নের একটা দীর্ঘ ছায়া তিনি দেখতে পান। সেই তাড়না থেকেই লিখেন, ❝পিকাসো যেমন বলেছিলেন শিল্প হচ্ছে একটা মিথ্যা, যা সত্যকে বুঝতে সাহায্য করে। আমি অক্ষর দিয়ে একটা মিথ্যা জীবন রচনা করতে করতে আমার এই সত্যিকার জীবনটাকে বুঝবার চেষ্টা করি, বিশ্বায়নের যে চাপ সেটাকেও মোকাবিলা করার চেষ্টা করি। চ্যাপলিনের কথাটা আমার পছন্দের। তিনি বলেছিলেন শিল্প হচ্ছে 'আ লাভ লেটার টু দ্য ওয়ার্ল্ড, ওয়েল রিটেন।' শিল্প হচ্ছে পৃথিবীর কাছে লেখা একটা প্রেমপত্র কিন্তু সুলিখিত।❞
লেখালিখির জগতে পা দেয়ার আগেই শাহাদুজ্জামান একটা দীর্ঘ সময় পার করেছিলেন প্রস্তুতিপর্বে। সেই পর্বে তার সাক্ষাৎ হয়েছিলো আশ্চর্য সব মানুষের সাথে।আখতারুজ্জামান ইলিয়াস,শহীদুল জহির, তারেক মাসুদ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে বন্ধুত্ব আর তার সাহিত্য নিয়ে তার টুকরো টুকরো ভাবনার কোলাজ নিয়েই আরেকটা বক্তৃতার আয়োজন। সেখানে একে একে ধরা পড়ে তাদের পরিচয়পর্ব,আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অসুস্থতা, ৩০০ বছর বাঁচতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, পা হারানোর পর ক্রাচে ভর দিয়ে জোরে জোরে হাঁটার প্র্যাকটিস,বিয়ের অনুষ্ঠানে স্টাফ করা পাখি উপহার দেয়ার গল্প,অসম্পূর্ণ উপন্যাসের রোডম্যাপ আর খোয়াবনামার ইতিবৃত্ত। খুব দরদী ভঙ্গিতে আসে ইলিয়াসের ‘কান্না’গল্পটা নিয়ে আলোচনাও। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, এই পুরো বক্তৃতা একটুও বোর করে না।
‘শহীদুল জহিরের দিকে দেখি’ বক্তৃতাটা পুরোপুরি দাঁড়িয়ে আছে জহিরের লেখাকে ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণের ওপর। প্যারেন্থেসিস স্টাইলে জহির ছোট ছোট বাক্য জুড়ে দীর্ঘ বাক্য লিখে নিজের লেখার একটা নিজস্ব ভঙ্গি দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর লেখা ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটা লেখা হয়েছিলো সম্পূর্ণ এক বাক্যে। বাক্যের শেষেও নেই কোনো দাঁড়ি। যেন মহল্লার মানুষের রিপিটেটিভ জীবনধারাকে জহির আটকে দিয়েছিলেন একটা কমায়। এই কমা নিয়েও একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে বক্তৃতার ফুল শার্টের আড়ালে।জাক্সটাপোজিশন,ম্যাজিক রিয়েলিজম, কালেকটিভ থিংকিং কীভাবে জহিরের লেখায় ফিরে ফিরে আসছে তা নিয়ে শাহাদুজ্জামান বলেছেন বাংলার প্রফেসরের মতো। কিন্তু আকর্ষণীয়ভাবে... আর আছে শহীদুল জহিরের ভেতর গোটানো স্বভাব। ভিড় এড়িয়ে কীভাবে নিভৃতে একাকী নেকড়ের মতো জহির একটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সেই সফরনামা বিস্ময়ের।
শিল্প ভাবনার আরেকটা বক্তৃতা এস এম সুলতানকে নিয়ে। তারেক মাসুদের আদমসুরাতের পর সুলতানের সুইং নিয়ে এমন লেখা অনেক হয়েছে। তবে সুলতানের কাজ আন্তর্জাতিক মানের অথচ সুলতান বিউপনিবেশায়নের মতো পায়াভারী প্রবণতা নিজের জীবনাচরণে,কাজে চর্চা করে গেছেন সেই আলাপটা জরুরি। ‘ডিজিটাল মানব’ শিরোনামের বক্তৃতাটার মূল বক্তব্য আমাদের অপরিচিত নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার পারফর্মেটিভ ছায়াজীবনে আমরা নিজেদের কীভাবে হারিয়ে ফেলছি,কীভাবে কমে যাচ্ছে আমাদের অ্যাটেনশন স্প্যান সেই দাসত্ব নিয়েই একটা অ্যাংশাস জেনারেশনের কথা এনেছেন শাহাদুজ্জামান।
আমাদের দেশে চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আন্তজার্তিক পরিসরে অ্যাকাডেমিশিয়ানের কাজ করছেন,তার মধ্যে শাহাদুজ্জামান অন্যতম। দেশের চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উপনিবেশায়নের প্রভাব নিয়ে দেয়া বক্তৃতাটা জনসাধারণের জন্য একটু কমপ্যাক্ট হলেও খুব ইফেক্টিভ একটা আলাপ। এখানে যে আমাদেরও নিজস্ব ট্র্যাডিশন থেকে কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে একটা বিকল্প মডেল তৈরি করা সম্ভব তা চোখে আঙুল দিয়ে এখানে শাহাদুজ্জামান দেখিয়ে দিয়েছেন। প্যালিয়াটিভ কেয়ার, জেরিয়াট্রিক মেডিসিন নিয়ে এর আগেও শাহাদুজ্জামান ‘চিকিৎসা বনাম উপশম’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এখানে তা এসেছে আরো ডালপালা মেলে।
আসলে যেটা হয় যে বিভিন্ন সময় নানারকম প্রশ্ন, নানারকম ভাবনা দিয়ে তাড়িত হই আমরা প্রত্যেকে। তারপর সেই ভাবনা আর প্রশ্নগুলো বহন করে বেড়াই অনেকটা মালবাহী ট্রাকের মতো। ভার বোধ করি। একটা সময় সেই ভারটাকে লাঘব করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সব প্রশ্ন আর ভাবনার বোঝাটাকে নামানোর ইচ্ছা হয়। শাহাদুজ্জামান একমাত্র লিখেই এই বোঝাটাকে নামাতে পারেন। কিন্তু সব বোঝা তো সব জায়গায় নামানো যায় না। কোনো বোঝা নামাই গল্পে, কোনোটা উপন্যাসে, কোনোটা প্রবন্ধে, কোনোটা পত্রিকার কলামে। লেখালেখি করা তাই তার কাছে একটা ভারমুক্ত হওয়ার ব্যাপার। লিখেই মনে ভার হয়ে থাকা প্রশ্নগুলোকে, ভাবনাগুলোকে মোকাবিলা করতে পারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,শিল্প-সাহিত্যে তিন ধরনের কাণ্ড হয়। একটা হচ্ছে কর্মকাণ্ড, দ্বিতীয়টি জ্ঞানকাণ্ড আর তৃতীয়টি রসকাণ্ড। সাহিত্য পত্রিকা করা, সাহিত্য নিয়ে সেমিনার এসবই কর্মকাণ্ডের অংশ। পাশাপাশি সাহিত্য তত্ত্ব তৈরি করা, দার্শনিক চিন্তার দিগন্ত তৈরি করা-এসব জ্ঞানকাণ্ডের কাজ। আর নেহাত সৃজনশীল সাহিত্য কবিতা, উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি রসকাণ্ডের ব্যাপার। রসকাণ্ডের কেন্দ্র থেকে বৃত্ত এঁকে জ্ঞানকাণ্ডের পরিধি থেকে বেরিয়ে শাহাদুজ্জামান বক্তৃতার মধ্য দিয়ে কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত থেকেছেন। শিরোনামের মতোই জীবনের সম্পর্কে বিরাট জিজ্ঞাসা নিয়ে শাহাদুজ্জামান ক্রমাগত খুঁচিয়ে গেছেন আমাদের প্রশ্নবিন্দুগুলোকে।
এই জীবন লইয়া কি করিব – এই বইয়ের নামটাই আমার বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাই কিছু না ভেবেই বইটা নেয়া। অনেকে অনেক প্যাঁচাল পাড়ছে, জীবন নিয়ে কি করবো, লাইফ ইজ মিনিংলেস অথবা অ্যাবসার্ড অথবা জীবনের মানেই হচ্ছে জীবনকে উপভোগ করতে শেখা – এসব কিছু নিয়ে। যা জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে সত্যি মনে হয়, আমি তা অস্বীকার করছি না। বাট, জীবনের কোন মিনিং নাই বলে অথবা কি করিব প্রশ্ন করে আমরা জীবনকে মিনিং দেওয়ার চেষ্টা কয়জনই বা করি? যে প্রশ্নগুলো আমার মাথায়ও আসে মাঝে মাঝে – যেমন টুইটার, ফেসবুক অথবা ইনস্টা তে আপনাদের বলা মিডিয়া সেলিব্রিটি অথবা সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটি রা মাঝে মাঝে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে আইডিয়া প্রেজেন্ট করেন, কয়জন অ্যাকচুয়ালি ওই আইডিয়া ইমপ্লিমেন্ট করেন? অথবা “পলিটিশিয়ানস” অথবা “ইন্টেলেকচুয়ালস(?)” – এই যে অনেক সমস্যার কথা নিয়ে ফেসবুক এ বড় বড় স্ট্যাটাস দেন বা দিচ্ছেন, কয়জন অ্যাকচুয়ালি বড় কথা বলে লাইক, শেয়ার, ফ্যান, ফলোয়ার না কামিয়ে সমস্যার সলিউশন করেছেন? আর কয়দিন পরে নিউ ইস্যু আসলেই সেটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তে লেখালিখি অথবা সমালোচনা করা ছাড়া, আর ম্যাক্সিমাম মেয়েদের পোস্টে শাহবাগী(গায়ে গন্ধ বলা ছাড়া) – এই জীবন নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছু করেছেন? রিমেম্বার হ্যাশট্যাগ রিভার্স ড্রেন বাংলাদেশ? রিমেম্বার জুলাই আপরাইজিং? সেটা নিয়ে রিলস বানানো ছাড়া আর কিছু কি হয়েছে?
দেশের বইপাড়ার কথাই বলি – এই দেশে কয়জন বর্তমান সময়ের রাইটার আছেন যাদের মেইন প্রফেশন রাইটিং? আর কয়টা প্রোকাশনী রাইটার দের হয়ে বইয়ের প্রচারণা করেন? আপনারা ড্যান ব্রাউন এর বই বের হওয়ার আগেই ট্রান্সলেশন এর জন্য কাড়াকাড়ি করেন, কয়জন নিজের দেশের বই নিয়ে ইভেন্ট করেন বইমেলার সময় ছাড়া, কখনো কখনো তখনও না। দেশে এত এত ভালো রাইটার আছেন – শুধুমাত্র প্রচারণার কারণে আমরা নাম পর্যন্ত শুনিনি। যা একজন রিডার হয়ে খুবই লজ্জার বিষয়! কিন্তু আমরা ঠিকই জনপ্রিয় কোনো রাইটার এর বই নিয়ে রিডার, প্রকাশক থেকে শুরু করে ছোট ছোট বুকস্টোর পর্যন্ত বিজনেস করার ধান্ধায় থাকি। একমাত্র বাংলাদেশ এর প্রকাশনীগুলোতেই বইয়ের প্রচারবিমুখতা দেখলাম – যেটা, লাইক...একটা বই বের করলাম, রাইটার দের রয়্যালটি দিয়ে দিলাম, এখন বই কোনো নরকে যাক অথবা স্বর্গে যাক সেটা আমাদের দেখার বিষয় না!
ওয়েল, তাই শাহাদুজ্জামান বলেছে ক্রিয়েটিভিটি কে একমাত্র প্রফেশন হিসেবে নেওয়া এই দেশে সম্ভব না, আর নারী হলে সেটা আরও কঠিন।
গুডরিডস-এ এক সময় এক আপুর সাথে পরিচয় হয়েছিল, প্রায় আট-নয় বছর আগে প্রোবাবলি... আমি একটা জিনিস নোটিস করতাম – আপু খুব ননফিকশন পড়ে। আমরা যেরকম রেগুলার ফিকশন পড়ি আর মাঝে মাঝে নন-ফিকশন, আপু ছিল ঠিক উল্টো। আর আমার জিনিসটা বেশ ভালো লাগতো। বাট আমি কখনো সেভাবে নন-ফিকশন পড়ে মজা পেতাম না। হয়তো তখন বেশ ছোট ছিলাম তাই, অথবা শাহাদুজ্জামানের মতো করে সুন্দর সাবলীল ভাষায় আমার জন্য কেউ নন-ফিকশন লেখেনি তাই হবে। যদিও এই বই মূলত তার বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তৃতার সংকলন। তিনি অনেক থট-প্রোভোকিং বিষয় নিয়ে লিখেছেন, কিছু বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে লেখকের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং শহীদুল জহির কে নিয়ে স্মৃতিচারণ। মানে আমি যখন আখতারুজ্জামান কে নিয়ে পড়ছিলাম, আমার এত আনন্দ হচ্ছিল আর খুব প্রাউড লাগছিল যে বাংলা সাহিত্যে খোয়াবনামা-র মতো একটা সৃষ্টি আছে! আর শহীদুল জহির – আমার ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ফেভারিট রাইটারস অ্যান্ড আই থিংক আই’ম গোনা রিরিড হিম।
আর সবশেষে ছিল এস এম সুলতান আর এই জীবন লইয়া কি করিব। কয়দিন আগে কারো ইনস্টা পোস্ট দেখেছিলাম এস এম সুলতান কে নিয়ে (এখন ঠিক মনে নাই) – বাট এস এম সুলতানের ভুবন পড়তে গিয়ে ওই পোস্ট এর কথা মনে পড়ে গেল।
“অনেক এলোমেলো কথা বলা হলো – তবে এই জীবন লইয়া কি করিব, সেই প্রশ্নের উত্তরটা ঠিক দেওয়া হলো না। সত্যি বলতে, এই প্রশ্নের তো একক কোনো উত্তর নেই। যার যার উত্তর তাকেই খুঁজে নিতে হয়।”
লেখক শাহাদুজ্জামান এর সাতটি বক্তৃতার সংকলন এ জীবন লইয়া কী করিব ও অন্যান্য। খুবই চমৎকার বই। চমৎকার সময় কেটেছে লেখকের বিদগ্ধ আলোচনায়। এত কঠিন কঠিন বিষয় আমার মত গবেট শ্রেণীর পাঠককে কিভাবে তিনি গেলালেন সেটা একটা রহস্য হতে পারে। যা বুঝেছি সাতটি বক্তৃতা থেকে তার মূল বিষয় নিয়ে একটু না বলার লোভ সামলাতে পারছিনা-
১. বিশ্বায়নের কালে লেখালেখি এখানে মূল আলোচনাটা এসেছে সামগ্রিক জীবনে গ্লোবালাইজেশন এর প্রভাব। এখন তো আমরা কেউ কারো দূরে নই। কিভাবে বিশ্বায়ন আমাদের চিন্তা, সংস্কার কে পরিবর্তন করছে। এইরকম একটা যুগে বসে ক্রিয়েটিভিটির চ্যালেঞ্জটা কি করে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়েই এই বক্তব্য।
২. ডিজিটাল মানব নোয়াম চমস্কির একটা উক্তি দিয়ে এই বক্তৃতার মূল অংশটুকু কিছুটা কভার করা যায়- "শত শত কোটি টাকা প্রতিদিন খরচ হচ্ছে তোমার ও আমার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।" না, এই আলাপে তিনি কোনো কন্সপায়রেসি থিওরি নিয়ে আলোচনা করেন নি। বেশ চমৎকার সব উদাহরণ দিয়ে নানান যুক্তিখন্ডন করেছেন।
৩. চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যে উপনিবেশবাদের নির্মাণ এই আলাপটা একটু জটিল, তবে খুব ইন্টারেস্টিং। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর গবেষণার ভিত্তিতে ইতিহাসের একটা গমনপথ বা আউটলাইন দাঁড় করিয়েছেন। এবং বলতে চেয়েছেন 'দেয়ার আর ডাইভার্স ওয়ে্স অব বিয়িং ইন দিস ওয়ার্ল্ড'। ইউরোপীয় সভ্যতাই শ্রেষ্ঠ সভ্যতা, বা��িসব ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার এমন চিন্তাকে সমালোচনা করেছেন। যেমন সাঁওতালদের ব্রিটিশবিরোধী লড়াই চলেছিল বনের দেবীর নামে, সেটা আপনার নজরে কুসংস্কার মনে হলেও তারা লড়েছিল আপন ইতিহাস ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে। চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানও যে এত মজার একটা টপিক হতে পারে আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম। কিভাবে এই অসভ্য দেশের অসভ্য মহামারি 'কলেরা', যাকে হিন্দুরা ডাকতো 'ওলাদেবী' আর মুসলমানরা ডাকতো 'ওলাবিবি'; সেই কলেরা ইউরোপীয়দের ভুগিয়ে, সামরিক, রাজনৈতিক সেতু পার করে বাধ্য করেছে এই দেশে অ্যালোপেথিক চিকিৎসা নিয়ে আসতে- এই জার্নিটা চিন্তা করলেই অবাক লাগে। মূলতঃ এই আলোচনাটি ছিল চিকিৎসা নিয়ে। কিন্তু এর সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উপাদান গুলো কিভাবে জড়িত এই হল উপপাদ্য।
৪. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: টুকরো ভাবনা এখানে লেখক- গ্রেট আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে টুকরো টুকরো ভাবনাই বলে গেছেন। কখনো অভিজ্ঞতা নিয়ে, কখনো সাহিত্য নিয়ে, কখনো শুধু তাঁর হাসি নিয়ে। একটা অংশ আমি উদ্ধৃত করি- 'আমার কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রধান শক্তি হচ্ছে লেখায় জীবনকে এর সামগ্রিকতায়, এর টোটালিটিতে উপস্থিত করতে পারার চেষ্টায়। তিনি তার গল্প, উপন্যাসে একটা সময়কে, চরিত্রগুলোকে এর শক্তি, সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে নানা বৈপরীত্যসহ উপস্থিত করেন। দর্শনের পরিভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি পজিটিভিস্টদের মতো একটা হাইপোথিসিসের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে লিখতে বসেন না, বরং ফেনোমেনোলজিস্টদের মতো হাইপোথিসিস জেনারেট করেন। একেকটা চরিত্র একেকটা অনুবিশ্বের মতো উপস্থাপিত হয়।'
৫. শহীদুল জহিরের দিকে দেখি আরেক প্রিয় লেখক শহীদুল জহিরের 'মুখের দিকে দেখি' উপন্যাসের আদলে দেয়া বক্তব্যের শিরোনাম। শহীদুল জহির এর ভাষা নিয়ে লেখক নিজের সূচারু দর্শন বর্ণনা করেছেন এখানে। জহিরের প্যারেন্থিসিস ব্যবহার করে করা রচনা, মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের ভাবনা, জীবন কিভাবে তিনি দেখেন এসব বিষয় উঠে এসেছে। অনেক নতুন কিছু জানলাম। আরও জানলাম, শহীদুল জহির ছিলেন সেই লেখক, যিনি একটা কমার দুঃখে দ্বিতীয়বার একটা গল্প ছাপান।
৬. এস এম সুলতানের ভুবন এসএম সুলতানের সামগ্রিক দর্শনকে এ আলোচনায় তিনি বুঝতে চেয়েছেন। কি কারণে এ দেশের প্রতি তিনি অভিমান করেছিলেন তা খুঁজেছেন। ২২ বছর সুলতান কেন চুপ ছিলেন, কেন ছবি আঁকেননি তা খুঁজে বের করেছেন। সবচাইতে কমন যে প্রশ্নটা, সুলতানের ছবিতে যে পেশিবহুল কৃষকদের দেখা যায়, এর পেছনে কারণ কি- তা তিনি সুলতানের ভাষ্যেই ব্যাখ্যা করেছেন।
৭. এ জীবন লইয়া কি করিব এই বক্তৃতার নামেই এ বইয়ের নাম। এই পৃথিবীর সবচাইতে পুরানো প্রশ্ন যার বিষয়। এর তো উত্তর হয়না এত সহজে, তবে নানা মুনির নানা মত আর নিজের ছেঁড়া ছেঁড়া দর্শন নিয়ে তিনি ইন্টারেস্টিং আলোচনাটি করেছেন। এতে তিনি কেন লেখেন সেই প্রশ্নের অন্তত উত্তর আছে।
চমৎকার লেগেছে আমার বইটা। প্রায় প্রতিটি বক্তব্যেই লেখককে ঔপনিবেশিকতা, ইউরোসেন্ট্রিসম নিয়ে হতাশ হতে দেখা গেছে। একে তিনি অস্বীকার করেন নি, বরঞ্চ প্রশ্ন তুলেছেন বারবার 'নিজেদের স্বকীয়তা কি নেই?' এই বলে। আরোপিত আধুনিকতা আর ডিকলোনাইজেশনের কথা প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায়ই চোখে পড়েছে।